সবুজ পাতারা : মূল : গ্রেস ওগোট : অনুবাদ: ঝর্না বিশ্বাস

বিশেষ গল্পসংখ্যা ২০২২ : আফ্রিকান গল্প
[গ্রেস ওগোট―সম্পূর্ণ নাম -গ্রেস এমিলি ওগোট’। তিনি কেনীয় লেখিকা, নার্স, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ ও কূটকৌশলে দক্ষ এক ব্যক্তিত্ব। ১৫ মে ১৯৩০ সালে তিনি কেনিয়ার নায়াঞ্জা জেলার অ্যাসেম্বোতে এক খ্রিস্টান পরিবারে জন্মগ্রহণ এবং ১৮ মার্চ ২০১৫ সালে নাইরোবিতে মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৬২ সালে ওগোট তাঁর প্রথম ছোটগল্প ‘A year of sacrifice’ উগান্ডার মার্কিরি বিশ্ববিদ্যালয়ের আফ্রিকান সাহিত্য সভায় পাঠ করেন। ১৯৬৪ সালে The rain came নামক ছোটগল্পটি আধুনিক আফ্রিকান গল্প সংগ্রহের একটি বিশেষ অংশ হিসেবে প্রকাশিত হয়। ওগোটের প্রথম উপন্যাস The promised land ১৯৬৬ সালে প্রকাশ পায়। তাঁর লেখা সমস্ত গল্পে কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের ওপর ঘৃণা, তাদের একঘরে হয়ে থাকা এবং বহুকাল প্রচলিত নারীত্বের প্রতি ধারণা ও স্ত্রীর কর্তব্য ইত্যাদি লক্ষ করা যায়। ওগোটের গল্পে ঘুরেফিরে এসেছে লুও সম্প্রদায়ের প্রবাদ, লোকগীতি, পৌরাণিক কাহিনি এবং মৌখিক ঐতিহ্য যেসব তাদের সাংস্কৃতিক প্রচারের মূল হিসেবে এই সম্প্রদায়ের চাহিদা পূরণ করত। ওগোটের গল্পের প্রেক্ষাপটে মহিলাদের ভূমিকা, নারীত্বের প্রাধান্য স্পষ্ট এবং পারিবারিক খুঁটিনাটি, সমাজের আধুনিক ও চলতি ধারায় মহিলাদের বিবাহ ও খ্রিস্টান ঐতিহ্যকে আলোকপাত করেছেন। বই প্রকাশ করতে গিয়েও তাঁকে বহু প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছে।১৯৬৮ সালে লেখা তাঁর ‘সবুজ পাতারা’ ছোটগল্পটি এক রাত ও তার পরের দিন সকাল ঘিরে থাকা একটি কাহিনি। গল্পের এই স্বল্প পরিসরেও ওগোট হিংসা, লোভ, শক্তি, দ্বন্দ্ব, লিঙ্গ ভূমিকা এবং সর্বোপরি পূর্ব আফ্রিকান মানুষদের ওপর উপনিবেশীয় রীতিনীতির প্রতি বিরোধিতা প্রকাশ করেছেন।]
একটা স্বপ্নের ভেতর ছিল সে। কোথাও বেশ জোরে একটা আওয়াজ হলো। কানের পাশ থেকে দ্রুত কম্বল সরিয়ে নায়াগর তা শোনার চেষ্টা করল। হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছিল সে। কারও গলার ভারী আওয়াজ ও শব্দ শোনা যাচ্ছিল। পাশ ফিরে সে স্ত্রীকে ডাকতে চাইল। কিন্তু স্ত্রী সেখানে ছিল না। ধড়ফড় করে উঠে দৌড়ে দরজার কাছে গেল। দরজাটা খোলা ছিল। নায়ামুন্ডহে তাহলে কোথায় ? আমাকে না জানিয়ে এভাবে চুপচাপ ঘর থেকে বেরোনোর মানে কী ? আশ্চর্য হলো নায়াগর। কতবার বলেছি, এভাবে হুটহাট দোর খুলে বাইরে যেন না যায় সে, কিন্তু আবারও না বলে বেরিয়ে গেছে। রসো কাল মজা দেখাচ্ছি তাকে!
ঐ দেখ, ঐ পাশে! আওয়াজটা খুব কাছে মনে হলো এখন―তিরিশ গজ মতো দূরে। নিজের বর্শাটা হাতড়িয়ে খোঁজার চেষ্টা করল নায়াগর, তারপর নিজের শক্তপোক্ত শরীরে একটা পাতলা চাদর জড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল।
চুপ চুপ, একদম চুপ! একদল লোককে ওর বাড়ির গেটের দিকে দৌড়ে আসতে দেখা গেল। গেট খুলে ও বেড়ার পেছনে লুকিয়ে পড়ল। ঐ দলের মুখোমুখি হওয়াটা নিরাপদ মনে করল না নায়াগর, ওর মনে হয়েছিল কিছু সাঙ্ঘাতিক লোক থাকতে পারে দলটায়।
তিন বা চারজনকে গেট ছাড়িয়ে এগিয়ে যেতে দেখা গেল আর একটা বড় দল ওদের পেছন পেছন ছুটে আসছিল। লুকোনোর জায়গা থেকে বেরিয়ে সে তাদের অনুসরণ করল।
অসভ্য ঐসব লোক আমার ছটা বলদ নিয়ে পালিয়েছে, এমনই বলল একজন পেছন থেকে।
কিছু ভেব না। এর মাশুল ওদের দিতে হবে। অন্যজনের উত্তর এল।
নায়াগর ওই ভিড়ের মধ্যে মিশে গেল। ও বুঝতে পারল ঐ তিন বা চারজন যারা প্রথমে গেটের সামনে দিয়ে দৌড়েছিল তারাই আসলে বলদ চোর। এবার ওরা একটা বাঁক ঘুরল। মাত্র তিরিশ গজ দূরত্বে থাকা লোক তিনটে হয়ত সম্ভাব্য চোর।
কিছুতেই যেন ওরা লুকাতে না পারে, একজন চিৎকার করে উঠল।
হ্যাঁ, কোনওমতেই না। পেছনে দলের সমস্বরে আওয়াজ এল।
ভিড়ের মাঝে ফাঁকগুলো ক্রমে ছোট হয়ে আসছিল। উজ্জ্বল চাঁদ আকাশে মিশে যেতেই চারপাশে তখন বেশ অন্ধকার।
ওভাবে এলোপাথারি বর্শা ছুড়ো না, যদি নিশানা না লাগে তাহলে ওরা ওটা দিয়েই আমাদের ওপরে নিশানা ঠুকবে। একজন বয়স্ক মতো লোক একথা বলে সাবধান করে দিল।
চোরেরা এবার ভুল পথে বাঁক নিল। ওপোক নদীর ওপর ব্রিজ যা মাসালা ও মিরোগিবাসীদের আলাদা করেছে তা ভুলে ওরা এগিয়ে গেল অনেকটা। ওটা ছাড়িয়ে ওরা ডানদিকে ঘুরল। চোরেরা নদী পার হওয়া চেষ্টা করছিল কিন্তু সহসা চারপাশে ঘিরে থাকা ভিড়ের মধ্যে নিজেদের পেল।
আরেহ্ আরেহ্, ঐ তো, পেছনে লোকগুলো ওভাবেই চিৎকার করছিল।
নদী পেরোনোর জন্য সুরক্ষিত জায়গা খুঁজে পাওয়ার আগেই সেই ভিড় চোরদের ওপর চড়াও হলো। বর্শার আঘাতে ওরা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। চোর ধরা পড়াতে চারপাশে তখন তুমুল গর্জন, চিৎকার ও চ্যাঁচামেচি। জনতার ভিড় ওদের ওপর কোনও দয়া দেখাল না।
এসব হুটোপুটিতে চোরদের মধ্যে একজন নদীর পাশ ঘিরে থাকা জঙ্গলে উধাও হয়ে গেল।
ওকে ধরো, পিছু নাও… ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন চিৎকার করছিল।
দলের তিনজন লোক তখন ঐ পথে দৌড়তে গিয়ে হাঁপিয়ে গেল, ততক্ষণে পথ পেয়ে চোর পালিয়েছে। জঙ্গলটা ঘন আর কাঁটাগাছে ভরা। ওরা দাঁড়িয়ে কিছু শোনার চেষ্টা করল। কোথাও কোনও শব্দ নেই। হাতের বর্শা দিয়ে ঝোপঝাড়ে আঘাত করেও কোনও আওয়াজ এল না। চোরটা নির্ঘাত কোথাও লুকিয়েছে।
অন্য এক চোর তার ছুরিটা বার করে ওই ভিড়ে থাকা একজনের কাঁধে ঠেকাল, পেছন থেকে ছুরির খোঁচা টের পেল সে। এসবের মাঝেই আরেকজন ঝপ করে উঠে ভিড়ের মধ্যে দিয়ে সোজা দৌড় লাগাল। আর সবার অলক্ষ্যে অনায়াসে নদী সাঁতরে ওপারে পৌঁছে গেল।
নায়াগর ওমোরোর কাঁধে বিঁধে থাকা ছুরিটা বার করল আর ক্ষতের ওপর নিজের হাত চাপা দিলো যাতে রক্ত বন্ধ হয়। ওমোরোর শরীর কাঁপছিল, টলমল পায়ে সে নায়াগরের ওপর ঢুলে পড়ল। পিঠ গড়িয়ে রক্ত পড়ছিল যাতে কোমর অবধি ভিজে গেল।
অন্য একটা চোর যে ঘাসের ওপর লুটিয়ে পড়েছিল তার গোঙানি শোনা গেল। বাকি দুজন পালিয়েছিল তাই সবাই ঠিক করল একেই উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে। তারা ক্রমাগত ওর বুকে ও মাথায় আঘাত করতে লাগল। কিছুক্ষণ পর প্রায় আধমরা অবস্থায় হাত পা ছড়িয়ে ওকে নিস্তেজ হয়ে পড়তে দেখা গেল।
আরে করছ কী! থামো। ওমোরো বেশ উঁচু গলায় বলল, ‘এভাবে নিজদের হাতে শত্রুকে মেরো না। ওর আত্মা তাহলে আমাদের পুরো গাঁয়ে ঘুরে বেড়াবে। সবাই যতক্ষণে বাড়ি ফিরে যাব ও মরে ভূত হয়ে যাবে’। জনতার ভিড় ওমোরোর এই সতর্কবার্তা মেনে নিল। আশেপাশের গাছ থেকে সবুজ পাতা ছিঁড়ে তাকে সম্পূর্ণ ঢেকে দেওয়া হলো।
সকালে আমাদের সম্প্রদায়ের সবাইকে ডাকা হবে আর তখনই নদীর পাশে ওকে কবর দেওয়া হবে।
প্রত্যেকে চুপচাপ বাড়ি ফিরে গেল। ওমোরোর কাঁধের রক্ত ততক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে। দুই বন্ধুর কাঁধে ভর দিয়ে তাকে আস্তে আস্তে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হলো। কোথাও বিন্দুমাত্র আলো ছিল না, তবে তাতে কোনও সমস্যা হলো না। তাদের চোখ অন্ধকারে অভ্যস্ত। নায়াগরের বাড়ি অবধি এসে পৌঁছল ওরা―গেটটা তখনও আধখোলাই ছিল।
‘কাল সকাল সকাল বেরোতে হবে মনে রেখ’ ওর উদ্দেশ্যে একজন বলল। ‘মেয়ে বৌদের ঘাটে যাবার আগেই আমাদের বেরিয়ে যেতে হবে’।
নায়াগর ঘরে ঢুকল। বাকিরা পেছনে না তাকিয়ে এগোতে শুরু করল। গ্রাম একেবারে শান্ত। বাড়ির কিছু মহিলা জেগে থাকলেও কারও সাহস নেই যে স্বামীর ওপরে কথা বলে। যা কিছু ঘটেছে তা সকালেই শোনা যাবে। এই ভেবে তারা পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল আর মনে মনে সন্তুষ্ট হলো যে তাদের স্বামীরা সুস্থভাবে বাড়ি ফিরে এসেছে।
নায়াগর ঘরে ঢুকে ওষুধের বাক্স খুঁজছিল এবং একটা কোণে তা পেয়েও গেল। সেটা খুলে একটা বাঁশের কৌটো হাতে তুলল। ওটার ঢাকনা খুলে ছাই বার করল। অল্প ছাই জিভের ওপর রেখে ভালো করে থুতু মিশিয়ে তা গিলে ফেলল। আর কিছুটা হাতের তালুতে রেখে গেটের দিকে নিশানা করে ফুঁ দিলো। আবার কৌটোটা জায়গা মতো রাখার পর মনে শান্তি এল।
বিছানার এক পাশে গিয়ে বসল সে। জামাকাপড় খুলতে যাবে ঠিক তখন মাথায় একটা চিন্তা খেলে গেল। খালি ঘরের চারপাশে একবার চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে স্থির করল মরে যাওয়া চোরটাকে একবার দেখতে যাবে।
খুব আস্তে দরজা খুলে তা বন্ধ করে দিলো যাতে কেউ শুনতে না পায়।
গেটের কাছে তাকে মোটেও দোনামনায় দেখা গেল না বরং এক নাগাড়ে হাঁটা শুরু করল। মাঝে একবার মনে হলো ‘গেট বন্ধ করেছিলাম তো’ ? তাই সে পেছনে তাকাল। হ্যাঁ, ওটা বন্ধই দেখাচ্ছে। রাতের এই ঘুটঘুটে অন্ধকারে কিছু অশুভ উপস্থিতির আভাস ছাড়া বাকি সব শান্ত ছিল। একটু পরেই ভোর হয়ে আসবে। পুবের আকাশে এক চিলতে আবছা সোনালি আলো যা দিনের আগমন বার্তা নিয়ে আসে তা ক্রমে পৃথিবীর দিকে তখন ঝুঁকে আসছিল।
‘ওর পকেটে নিশ্চয়ই টাকাকড়ি পাওয়া যাবে’। নায়াগর বেশ জোরেই বলল নিজেকে। ও জানত, চুরি করা বলদ বিক্রি করে ফেলেছিল চোরেরা।
‘বাকিরা একেবারে বোকা, একবারও খুঁজে দেখল না’। ও থামল আর কিছু শোনার চেষ্টা করল। কেউ কি আসছে ? না। নিজেরই পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছিল সে।
‘যদিও একবার মনে হলো হয়তো পালিয়ে যাওয়া দুজন চোর ফেরত আসতে পারে’। ‘না। তা হতে পারে না। এত বোকাহদ্দ তারা নয় যে এখনই তারা আবার আসবে’ ।
সবুজ পাতা জমানো সেই জায়গা দেখা গেল। মেরুদণ্ডে একটা ঠাণ্ডা শিরশিরানি টের পেল নায়াগর। মনে হচ্ছিল হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানি বন্ধ হয়ে আসছে। বুকের উপর হাত রেখে একবার পরীক্ষা করে নিল। হ্যাঁ, ঠিকঠাক চলছে। অল্প ঘাবড়ে গেছিল সে। এরপর দ্রুত পা বাড়াল, নিজের পায়ের শব্দ ওকে খুব বিরক্তিতে ফেলছিল।
নায়াগর যখন খুনোখুনির জায়গায় পৌঁছল, দেখল সবকিছু ঠিকঠাক রাখা আছে যেমনটা ছেড়ে গেছিল। কিছুক্ষণ দাঁড়ালো কিন্তু কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না। চারপাশে একবার তাকিয়ে নিল কেউ আসছে কিনা। কোথাও কেউ নেই। মৃতদেহের পাশে ও ছাড়া আর কেউ ছিল না। এবার সে একটু ঘাবড়ে গেল। ওর অন্তরাত্মা যেন জিজ্ঞেস করল, ‘মৃতদেহকে বিরক্ত করা কেন’ ? ‘এই টাকা দিয়ে তুমি কী করবে’ ? তোমার তিন স্ত্রী আর বারোটি সন্তান ছাড়া খাবার-দাবার, গরু-বাছুর যা চাই তার চাইতে তোমার বেশিই আছে। এর বেশি তুমি কী চাও’ ? এমন কিছুই যেন সে শুনতে পেল। অল্প ভয় পেলেও নিজের দৃঢ় ইচ্ছার বিরুদ্ধে ও যেতে পারল না।
‘এত দূর থেকে যে কাজের জন্য এসেছ, সেই মানুষ তোমার সামনে শুয়ে আছে। শুধু হাতটা ওর পকেটে দিতে হবে আর সেই সমস্ত টাকা-পয়সা তখন তোমার। এখনই নিজেকে প্রচুর ঐশ্বর্যের মালিক ভেব না, পৃথিবীতে এমন একটিও লোক নেই যার টাকার দরকার হয় না’।
নায়াগর মৃত লোকটির দিকে ঝুঁকে খুব তাড়াতাড়ি ওর ওপরে থাকা পাতাগুলো সরাতে শুরু করল। ওর হাত মৃত লোকটির হাতে ঠেকল যা বুকের কাছে ভাঁজ করে রাখা ছিল। সেটা তখনও গরম। একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল নায়াগরের সারা শরীরে, ও দাঁড়িয়ে পড়ল। মৃত ব্যক্তির এরকম গরম থাকা অস্বাভাবিক। প্রচণ্ড ঘাবড়ে ও এসব কথাই ভাবছিল। আবারও লোকটার দিকে ঝুঁকে তার পিঠের দিকটা ঘুরিয়ে দেখে নিল। এবার তাকে মৃতই মনে হচ্ছে।
খুব তাড়াতাড়ি অনিশ্চয়তার সাথে পকেট খোঁজা শুরু হলো। প্রথম পকেটে সে তার হাত ঢোকাল। ওটা খালি ছিল। তারপরে খোঁজ দ্বিতীয় পকেটে―সেটাও খালি পেল। নিরাশ হলো সে। তারপর মনে পড়ল এরকম চোরেরা সাধারণত তাদের টাকাপয়সা গলায় মাদুলির মত বাঁধা পুটুলিতে রেখে থাকে।
হাঁটু গেড়ে মৃত লোকটির পাশে বসে ও গলার দিকে তাকাল। নিশ্চয়ই ওতে বাঁধা একটা ছোট পুটুলি পাওয়া যাবে। সব পেয়েছির খুশিতে ওর মুখের কোনে হাসি ঝিলিক দিয়ে উঠল। হাতে কোনও ছুরি না থাকায় ঠিক করল পুটুলিটা মাথার ওপর দিয়ে বার করে নেবে। নায়াগর মৃতের দিকে ঝুঁকে পড়তেই ডান চোখে একটা তীব্র আঘাত পেল। কিছু দূরে ছিটকে ও অচৈতন্য হয়ে গেল।
চোরের সদ্য জ্ঞান ফিরলেও সে ভীষণ দুর্বল ছিল। কিন্তু নষ্ট করার মতো সময় তার কাছে ছিল না। দ্বিতীয় চেষ্টায় সে কোনেওমতে উঠে দাঁড়াল। সারা শরীর রক্তে ভেজা থাকলেও মাথা একদম পরিষ্কার কাজ করছিল। চারপাশ থেকে সবুজ পাতা জড় করে সে নায়াগরের ওপর স্তূপের মতো বোঝাই করে দিল। এরপর ব্রিজ ধরে এগিয়ে গেল যেটা আগের বার হাতাহাতিতে খুঁজে পায়নি।
তাড়াতাড়ি হাঁটতে শুরু করল সে―নায়াগরের আত্মা শরীর ছাড়ার আগেই ওকে এখান থেকে সরে পড়তে হবে। ভোর হয়ে আসছিল। মিগুয়া নদীর কাছাকাছি সময় থাকতে পৌঁছতে হবে যাতে রক্তলাগা জামাকাপড় ধুয়ে ফেলা যায়।
সূর্যোদয়ের আগেই, ওই সম্প্রদায়ের দলনেতা ওলিএলো ঢোল বাজিয়ে গ্রামের সকলকে অন্তিম সংস্কারের কথা জানিয়ে দিল। ঠিক এক ঘণ্টার মধ্যেই সবাইকে সেই ওপোক গাছের নিচে জড় হতে দেখা গেল যেখানে সাধারণত অপরাধমূলক ও সামাজিক কাজকর্মের শুনানিতে হত্তাকর্তারা আলোচনায় বসে থাকেন। ওলিএলো জনতার উদ্দেশ্যে তখন বলা শুরু করল,
‘আপনাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়ত গতরাতে আমাদের দলের ওপর ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার কথা জানেন। চোরেরা ওমোগোর খোঁয়াড় ভেঙে চাষের কাজে লাগানো ছয়টা বলদ চুরি করে পালিয়েছিল’।
ওহ্…! ভিড়ের ভেতর থেকে আওয়াজ এল।
ওলিএলো আবারও বলতে শুরু করল, ফলে হাতাহাতিতে রক্তারক্তি হলো আর এখন ওখানে একটা লাশ পড়ে আছে।
তাই নাকি ? বয়স্ক মতো একজন জানতে চাইল।
ওলিএলো উত্তরে বলল, হ্যাঁ। একদম তাই। এখন যা বলছি শোনো সকলে। আমাদের আইন বলে অপরিচিতকে এমনভাবে হত্যা করতে নেই। তাও চোর এবং পরস্ত্রীকাতর লোকদের আমরা পশু বলেই গণ্য করি। যদি এমন অপরাধে সাবস্ত্য কাউকে হত্যা করা হয় তাহলে কাউকে খুনী বলে মেনে নেওয়া হয় না। খুন হওয়া ব্যক্তিকে একজন অশুভ আত্মা হিসেবে ধরা হয়। যে এই সমাজের ক্ষতি করতে চেয়েছিল যার বিপরীতে এই সমাজেরও একটা কর্তব্য আছে নিজের ও তার সন্তানকে তা থেকে রক্ষা করার; তাদের প্রতি দেখভালের। তাই তাকে এই সমাজ থেকেই দূর করা উচিত যাতে সে অন্য কোনও পরিবারের এমন ক্ষতি না করতে পারে। কিন্তু সাদা চামড়ার মানুষদের আইন অন্যরকম। তাদের আইনি মতে, তুমি যদি এরকম কোনও চোরকে ধরে মেরে ফেল বা স্ত্রীর সাথে কুঠিতে সময় কাটানোর জন্য তাকে খুন করো তাহলে তুমিও সমানভাবে দোষী এবং তোমাকেও হত্যা করা হবে। কারণ ঐসব ফিরিঙ্গি লোক মনে করে তাদের আইন আমাদের থেকে বেশি ক্ষমতাবান, আমাদের আগে থেকেই তাই সাবধান হওয়া দরকার। আমাদের পূর্বপুরুষেরা আছেন―কিন্তু ওদের তা নেই। সেই কারণে মৃতদের তারা কবর দেয় বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে গিয়ে।
‘আমাদের এখন এমন করা উচিত। আমরা মোট তিরিশ জনকে ঐসব ফিরিঙ্গির কাছে পাঠাব যারা দলবদ্ধ হয়ে বলবে যে তারা সবাই মিলে চোরকে মেরেছে। বাছারা, তোমরা আমার কথাটা মনে রেখ। ফিরিঙ্গিদের রীতিনীতি শুধু অল্প মানুষের ওপর প্রযোজ্য। তাই একজোট হয়ে থাকলে আমাদের কাউকেই এর শাস্তি স্বরূপ ফাঁসিতে ঝুলতে হবে না’।
বৃদ্ধ লোকটি বেশ ভালো বুঝিয়েছে। সবাই একসাথে চিৎকার করে বলল। মোট তিরিশ জনকে তখন বাছা হলো যারা ফিরিঙ্গিদের ক্যাম্পে যাওয়ার জন্য সত্বর বেরিয়ে পড়ল।
মহিলাসহ আরও কয়েকজন লোক সেখানে একসাথে জড়ো হলে দলটাকে খুব বড় দেখা গেল। সবাই মিলে সেই নদীর কাছে পৌঁছল যেখানে মৃত চোরকে পাতা দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে এবং অপেক্ষাও চলল ওখানে সাদা চামড়ার পুলিশদের আসার।
নায়ামুন্ডহে নায়াগরের আরেক স্ত্রীর পাশে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় গো নায়াগর’ ? তাকে তো দেখতে পেলাম না’।
ভিড়ের মধ্যে চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে সে বলল, বোধহয় ওই তিরিশ জনের সাথে গেছে। আজ খুব সকালে বেরিয়ে পড়েছিল। আমি ভোরে উঠে দেখলাম গেট খোলা। সেই সকালেই ওরা গ্রাম ছেড়েছিল।
নায়ামুন্ডহের মনে পড়ল, ওরা যখন নদীর দিকে যাওয়া সরু পথটা ধরে এগোচ্ছিল, সকালের শিশিরে ওদের পায়ের পাতা ভিজে যাচ্ছিল। সেই রাস্তা ধরে এগোতেই মনে মনে প্রার্থনা চলছিল নতুন সকালের আর সেখানে লম্বা ঘাসগুলোকে সম্পূর্ণ শিশিরে ঢাকা দেখাচ্ছিল। নায়ামুন্ডহে নায়াগরের আরেক স্ত্রীকে তাদের স্বামী আর কোথায় যেতে পারে তা নিয়ে জিজ্ঞেস করতে চাইল কিন্তু তাকে দেখে মনে হলো সে বেশ অস্বস্তিতে আছে, তাই সে ভাবল চুপ থাকাই ঠিক হবে।
আসার সময় কালো বিড়ালের রাস্তা পার হওয়াটা আমার মোটেও ভালো লাগেনি। নায়ামুন্ডহে আরেক স্ত্রীকে জানাল।
হ্যাঁ। সাতসকালে সামনে দিয়ে কালো বিড়াল অতিক্রম করাটা অশুভ। নায়ামুন্ডেহের কথায় সায় দিলো সে।
জোরে লরির আওয়াজ পাওয়া গেল তখন। ওরা তাকাতেই দেখল ধুলো উড়িয়ে দুটো পুলিশ লরি এদিকেই এগিয়ে আসছে। লরি দুটো সবুজ পাতার স্তূপের কাছে এসে থামল। একজন ইউরোপীয় পুলিশ ও চারজন আফ্রিকান পুলিশকে সেখানে নামতে দেখা গেল। অন্য আরেক লরির পেছনটা খুলে দিতেই দলের মধ্যে থেকে বাছাই হওয়া সেই তিরিশ জন নেমে এল।
‘তোমাদের দলনেতা কোথায় ?’ সাদা পুলিশ জিজ্ঞেস করল।
ওলিএলো এগিয়ে গেল।
‘আমাকে সব সত্যি বলো, যা যা ঘটেছিল সেদিন। আমি বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করি না এইসব লোক যা বলছে। নাকি তুমিই এদের এমন বুঝিয়ে সুঝিয়ে পাঠিয়েছ ?
ওলিএলো ধীরে সুস্থে এক একটা কথা খুব পরিষ্কার করে বলতে থাকল। আফ্রিকান পুলিশ অফিসার ওর কথাগুলো অনুবাদ করে দিচ্ছিল।
‘ওদের আপনার কাছে পাঠিয়েছিলাম, এটা জানাতে যে গতরাতে আমরা সবাই মিলে চোরটাকে মেরে ফেলেছি।’
‘কী ?’ তুমি মেরেছ তাকে ? সাদা পুলিশ অফিসার ওলিএলোর দিকে এগিয়ে গেল। বাকি পুলিশ তাকে অনুসরণ করল।
‘তুমি মেরেছ’ ? আবারও জিজ্ঞেস করল পুলিশ অধিকর্তা।
‘না। আমরা সবাই মিলে মেরেছি।’ ওলিএলো এই কথাতেই টিকে রইল।
‘কতবার তোমাদের বলা হয়েছে যে নিজেদের হাতে এমন মারকাটারি বন্ধ করো।’ যতক্ষণ না আইন তাকে শাস্তি দিচ্ছে ততক্ষণ কেউ দোষী নয়। তোমাদের লোকেরা কী শুনতে পায় না!’ অভদ্রভাবে সাদা পুলিশ তার হাতের লাঠিটা ওলিএলোর দিকে নিশানা করল।
‘এইবার আমি তোমাদের দেখাব আইন কীভাবে মানতে হয়। বলো কে মেরেছে ?’ খুব রাগে সাদা পুলিশ অফিসার জিজ্ঞেস করল।
ভিড়ের দিকে হাত দেখিয়ে ওলিএলো জবাব দিলো, ‘আমরা সবাই।’
‘ওসব বাজে কথা রাখ। প্রথম আঘাত কে করেছে ?’
ভিড়ের লোকজন অধৈর্য হয়ে পড়েছিল। তারা পাঁচ পুলিশ অফিসারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
‘আমরা সবাই একসাথে চোরকে আঘাত করেছি’। তাদের চিৎকার শোনা গেল।
‘আপনাদের যেমন ইচ্ছে, আমাদের গ্রেফতার করতে চাইলে করুন। এর জন্য বোধহয় আরও কটা লরি আপনাদের পাঠাতে হবে’।
‘মৃত লোকটা এখন কোথায় ?’ সাদা পুলিশ অফিসার ওলিএলোর কাছে জানতে চাইল।
‘ওইখানে’। পাতা বোঝাই জায়গাটার দিকে দেখিয়ে ওলিএলো উত্তর দিলো।
পুলিশ সেদিকে এগোল। পেছনের ভিড়ও এগিয়ে গেল। পুলিশেরা লাশ নিয়ে যাওয়ার আগে সবাই মৃত লোকটাকে এক ঝলক দেখতে চাইছিল।
গতবার এই এলাকায় যখন খুন হয়, পুলিশ সেই লাশ কিসুমুতে নিয়ে গেছিল যেখানে সেটা টুকরা করে আবার সেলাই করা হয়েছিল। তারপর তা ফেরত দিয়ে বলেছিল, ‘এই নাও তোমাদের লোক, এবারে কবর দাও।’ সে সময় কেউ কেউ দাবি করেছিল যে এরকম লাশ থেকে পিত্তথলি বের করে নেওয়া হতো যা পুলিশের কাজে লাগানো কুকুরদের দেওয়া হতো যাতে সেই কুকুরেরা চোরের বাড়ি পর্যন্ত খোঁজ দিতে পারে। অনেকে এসব গল্প বিশ্বাস করত। তাই তাদের মনে হয়েছিল লাশটাও পুলিশ নিয়ে গিয়ে এমনই করবে।
ইউরোপীয় অফিসার অন্য অফিসারদের লাশের ওপরে থাকা পাতাগুলো সরিয়ে দিতে বলল। প্রথমে কিন্তু কিন্তু করলেও পরে তাদের সেই কথা মানতে হলো।
সবার আগে ওলিএলো এগোল ও লাশের দিকে অবিশ্বাস্যভাবে তাকিয়ে থাকল। তারপর সে ভিড়ের দিকে তাকালো, ও পরে পুলিশের দিকে। ‘আমি ঠিক আছি তো ? কোথায় গেল সেই চোর ?’ লাশের দিকে সে দ্বিতীয়বার তাকাল। এ তো নায়াগরের লাশ, তাঁর খুড়তুতো ভাই যে মৃত এখন আর যার ডান চোখে একটা তীক্ষè কাঠের শলা বিঁধে আছে।
নায়ামুন্ডহে কান্নায় ভেঙে পড়ল আর ভিড়ের ভেতর থেকে দৌড়ে ছুটে এল লাশের দিকে। স্বামীর মৃত শরীরের ওপর সে অঝোরে কাঁদতে লাগল। তারপর ভিড়ের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলল, ‘কোথায় সেই চোর যাকে তোমরা মেরেছ ? কোথায় সে ?’
এরকম দমচাপা পরিস্থিতিতে সেই ভিড় দুই বা তিন জনের ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে গেল। তাদের মধ্যে থাকা মহিলারা বুক চাপড়ে কাঁদতে শুরু করল; আর পুরুষেরা যারা গতরাতে চোরকে হত্যা করেছিল তাঁরা একে অন্যের দিকে হতবাক হয়ে চাওয়াচাওয়ি করতে থাকল। সেদিন নায়াগরকে তারা বাড়ি অবধি ছেড়ে গেছিল। এটুকু তাদের স্পষ্ট মনে আছে।
ওলিএলো তখন চোখের জল লুকোনোর চেষ্টা না করে ভিড়ের উদ্দেশ্যে বলল, ‘সুপ্রিয় বন্ধুরা, কোনও এক অশুভ শক্তির হাত আমাদের ওপর ভর করেছে। এতে সমাজের ভেঙে পড়লে চলবে না। নায়াগর এখন মৃত কিন্তু তাঁর আত্মা সবসময় আমাদের সাথে থাকবে।’
কিন্তু ওলিএলোর এরকম কথায় নায়ামুন্ডহের মন বিগলিত হলো না। লোকগুলোর কথাও সে বিশ্বাস করতে পারছিল না যারা বলছিল যে চোরদের সঙ্গে হাতাহাতির পর তারা নায়াগরকে এই গ্রামে প্রবেশ করতে দেখেছিল। পুলিশের সাথেও একচোট হয়ে গেল যখন সে দেখল কিসুমুতে পোস্টমর্টেমের জন্য তার স্বামীর মৃতদেহটি লরির পেছনে তোলা হচ্ছে। একজন পুলিশ অফিসার তাকে সান্ত্বনা দিয়ে জানালো, যে তার স্বামীর মৃত্যু নিয়ে খুব শিঘ্রই পুরো গ্রামে তল্লাশি চালানো হবে।
নায়ামুন্ডহে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘যদি কথা দেন যে আমার স্বামীকে জীবিত অবস্থায় আমার কাছে ফেরত দেবেন, তাহলেই সব শুনব’।
নায়ামুন্ডহে নিজের কাপড় ছিঁড়ে কব্জিতে বেঁধে নিল। তারপর সে বিলাপকারীদের পেছন পেছন এগিয়ে গেল, হাতদুটো মাথার উপর তুলে চোখের জলে ভাসতে ভাসতে নায়ামুন্ডহে বিড়বিড় করে বলে চললÑ
প্রিয়তম তুমি ওচিএঙের পুত্র
ওমোলোরওর পুত্র তুমি
অঝোরধারায় বৃষ্টি নেমেছে
বৃষ্টি ঝরে পড়ছে
রাতের গাঢ় অন্ধকার
দীর্ঘ ও ঠাণ্ডা সমস্ত রাত
ওহ! আমার মায়ের প্রিয় জামাতা তুমি
ক্ষমা করার মত হৃদয় আমার নেই
মাফ করার মতো বড় হৃদয় আমার নয়
এই সমস্ত বিলাপকারী আমায় এখন ঠকাচ্ছে
হ্যাঁ, তারা আমায় সহানুভূতির ছলনায় ঠকাচ্ছে
সূর্য যখন নিজ ঘরে ফিরে যাবে
সেই অন্ধকারে ওরা আমায়
আবার একা করে দেবে।
রাতের ঠাণ্ডায় যখন
প্রত্যেক নারী তার কাছের মানুষটির ওমে জড়িয়ে থাকবে
সেখানে এমন কেউ নেই, কেউ না
যে এক রাতের জন্যে আমার স্বামীকে ফিরিয়ে দিতে পারে
আহ! আমার প্রেমিকপুরুষ, ওচিএঙের পুত্র তুমি
আমার মায়ের প্রিয় জামাতা।
পশ্চিমবঙ্গ থেকে
সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ