শ্যে জ্যানেট : মূল : অ্যালেন মাবানকো : অনুবাদ : ফজল হাসান

বিশেষ গল্পসংখ্যা ২০২২ : আফ্রিকান গল্প
[সমকালীন বিশ্বসাহিত্যে আফ্রিকার লেখকদের উপস্থিতি বিশেষভাবে লক্ষণীয় এবং যে কয়জন লেখক উজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছেন তাঁদের মধ্যে কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের বংশোদ্ভূত ‘আফ্রিকার স্যামুয়েল বেকেট’ নামে অভিহিত ফরাসি লেখক অ্যালেন মাবানকো অন্যতম। তিনি একাধারে কথাসাহিত্যিক, কবি, সাংবাদিক ও অধ্যাপক। তাঁর জন্ম ১৯৬৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। শৈশব কাটে কঙ্গোর সামুদ্রিক শহর পয়েন্ট-নোয়্যারে। তিনি দর্শন শাস্ত্রে ব্যাচেলর ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীসময়ে মায়ের ইচ্ছা অনুযায়ী আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেন। তিনি বাইশ বছর বয়সে বৃত্তি নিয়ে ফ্রান্সে যান এবং ইউনিভার্সিটি অব প্যারিস থেকে আইন বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০০২ সালে তিন বছরের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যান অ্যারবর ক্যাম্পাসে ফ্রাঙ্কোফোন সাহিত্যের শিক্ষক ছিলেন এবং পরে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া অ্যাট লস অ্যাঞ্জেলেসের অধ্যাপক নিযুক্ত হন।অ্যালেন মাবানকোর প্রথম উপন্যাস রেড-হোয়াইট অ্যান্ড ব্লু প্রকাশিত হয় ১৯৯৮ সালে। প্রথম উপন্যাস প্রকাশের পর লেখালেখিতে নিয়মিত হন। গ্লাস ব্রোকেন (২০০৫), মেম্যোয়্যার অব পর্কুপাইন (২০০৬), ব্ল্যাক বাজার (২০০৯), টুমরো আই উইল হ্যাভ টুয়েনটি ইয়াস্র্ (২০১০), লাইটস্ অব পয়েন্টে-নোয়্যার (২০১৩) এবং স্মল চিলি (২০১৫) তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতি হিসেবে একাধিক পুরস্কার লাভ করেন। যেমন―রেড-হোয়াইট অ্যান্ড ব্লু উপন্যাসের জন্য ‘গ্র্যান্ড লিটারেরি প্রাইজ ফর ব্ল্যাক আফ্রিকা’, ‘মেম্যোয়্যার অব পর্কুপাইন’ উপন্যাসের জন্য প্রি রেনো (২০০৬) এবং স্মল চিলি উপন্যাসের জন্য ‘প্রি গনকোর্ট’ (২০১৫)। স্মল চিলি উপন্যাসের জন্য ২০১৭ সালে ‘ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ’-এর তালিকায় ছিলেন। এছাড়া ব্ল্যাক বাজার এবং লাইটস্ অব পয়েন্টে-নোয়্যার উপন্যাস দুটি সমালোচকদের ভূঁয়সী প্রশংসা অর্জন করে এবং ফ্রান্সের কুড়িটি বেস্ট সেলার উপন্যাসের তালিকায় (যথাক্রমে ২০০৯ ও ২০১৩ সালে) অন্তর্ভুক্ত হয়। তাঁর উপন্যাসের বিভিন্ন চরিত্র অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক। তিনি আফ্রিকার অভিবাসীদের বাস্তব অভিজ্ঞতাকে চরিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। উপন্যাস ও ছোটগল্প সংকলন ছাড়াও তিনি একাধিক কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা। যদিও তিনি সাহিত্যকর্মের জন্য সমাদৃত কিন্তু সমালোচনাও কুড়িয়েছেন। তাঁর সাহিত্য রচনা বিশ্বের পনেরোটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বর্তমানে তিনি ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া অ্যাট লস অ্যাঞ্জেলেস-এর ফ্রাঙ্কোফোন সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।
গল্পসূত্র: ‘শ্যে জ্যানেট’ গল্পটি অ্যালেন মাবানকোর ইংরেজিতে ‘শেই জ্যানেট’ গল্পের অনুবাদ। গল্পটি ফরাসি ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন হেলেন স্টিভেনসন। ইংরেজিতে গল্পটি লন্ডনের বিখ্যাত দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার ২০১১ সালের ২১ এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। গল্পটি সেখান থেকে নেয়া হয়েছে।]
অনেক বছর বাইরে থেকে কয়েক দিনের জন্য বাড়ি এসেছি।
আমরা টে্যাঁয়া-স্যঁ কোয়ার্টারের কাছে শ্যে জ্যানেট পানশালায় বসে আছি। এটা ব্যোকা প্রজাতন্ত্রের রাজনৈতিক রাজধানী লজিনোর সবচেয়ে ব্যস্ত জায়গা।
পানশালার এক কোণে কয়েকজন খদ্দের বসে আছে, কিন্তু ওরা আমাদের কথা শুনতে পায় না। রাত্তির নেমে এলে ওদের মুখাবয়ব ধীরে ধীরে অন্ধকারে তলিয়ে যায়। এখানে আমরা দুঘণ্টা ধরে বসে আছি। এত বছর পরে আমার আংকেল আমাকে দেখে যারপরনাই আনন্দিত।
এইমাত্র ওয়েট্রেস এসে আমাদের পানীয় দিয়ে যায়। মেয়েটির ফিরে যাওয়ার সময় আংকেল ওর সুডৌল নিতম্বের দিকে আকুল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন:
হে বৎস, তুমি কী মেয়েটিকে দেখেছ ? সুন্দরী, তাই না ?
আমি চুপ করে থাকি। মেয়েটি কাউন্টারে যাওয়া পর্যন্ত আংকেল হা করে তাকিয়ে থাকেন। তারপর তিনি আমার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে পুনরায় বলতে থাকেন:
দেশটা বদলে গেছে।
আমি যখন তার মুখমণ্ডলের বিশাল ক্ষতের দিকে তাকাই, তখন তিনি বললেন:
হ্যাঁ, আমি জানি। ক্ষতটা যুদ্ধের জন্যই হয়েছে অথবা তেলের…।
আংকেল আমাদের পেছনে বারান্দায় বসা লোকজনের দিকে তাকালেন। কিন্তু তারা আমাদের কথা শুনছিল বলে মনে হচ্ছিল না। তাই আংকেল তার অসম্পূর্ণ কথা পুনরায় শুরু করেন:
মাঝে মাঝে আমি ভাবি, আমাদের দেশে যদি তেলের ভাণ্ডার না থাকত, তবে কেমন হতো ? শান্তিময় দেশ ? সেই দেশ―যার কোনও ইতিহাস নেই ? আমি জানি না। আমরা কখনও জানব না। আয়তনের দিক থেকে যদিও দেশটা ক্ষুদ্র, তবু ঈশ্বর আমাদের তেলের খনি দিয়েছেন। আমাদের দেশের জনসংখ্যা মাত্র ত্রিশ লক্ষ। তিনি কেন উত্তর দিকে একটু-আধটু তেল দিয়ে বাকি সব তেল দক্ষিণ এলাকায় দিয়েছেন ? সমবণ্টন হলে সবাই আমরা ভাগ পেতাম এবং আমাদের খুনাখুনি করতে হতো না। উফ্, আসলে আমার অনুযোগ করা উচিত নয়। অনেক দেশের সমস্যা আরও প্রকট―জমিনের নিচে অথবা সাগরের তলে কোথাও কোনও তেল নেই।
একনাগারে বলেই আংকেল গ্লাস উপরে তোলেন এবং অবশিষ্ট পানীয় এক সঙ্গে গলার ভেতর ঢেলে দিয়ে আবার বলতে থাকেন:
তেলই শক্তি। যেখানেই তেল, সেখানেই যুদ্ধ। এমন কোনও দেশ আছে, যেখানে পানির জন্য যদ্ধ হয় ? ভেবে দেখ, কোনও একটা দেশে কোথাও পানি নেই, সেই দেশের মানুষ কী বাঁচবে ? তেল আমাদের অনেক ক্ষতি করেছে। উত্তর থেকে দক্ষিণ পর্যন্ত সমস্ত দেশ জুড়ে গৃহযুদ্ধের একমাত্র কারণ এই তেল।
ওয়েট্রেস আরও দুই গ্লাস পানীয় এনে টেবিলের ওপর রাখে। আংকেল হয়তো এক পলকের জন্য ওর গোলাকৃতি পাছার দিকে তাকিয়েছিলেন।
অপূর্ব অঙ্গসৌষ্ঠব, কী বলো ? আমি কোথায় আছি ? কী যেন বলছিলাম ?
তেলের কারণে গৃহযুদ্ধ এবং…
ও হ্যাঁ, তাই তো। তুমি যখন ফ্রান্সে ছিলে তখন গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। প্রেসিডেন্ট মনিয়াটো, যিনি ক্ষমতায় ছিলেন, নির্বাচনে পরাজয় মেনে নিতে পারেননি। তিনি গণতান্ত্রিকভাবে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিজয়ী সলোলার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চাননি। এবং কেন চাননি ?
আমি এই ভেবে অবাক হচ্ছিলাম যে তিনি হয়তো বুঝতে পারছেন না আসলে খবরের কাগজ পড়ে যুদ্ধের সবকিছুই জানি। তবু আমি চাই আংকেল কথা বলুক।
তিনি আরও উজ্জীবিত হয়ে বলতে থাকেন:
তেলের মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্বই হলো গৃহযুদ্ধের প্রধান কারণ। মালিক হলে গোপনে তেল বিক্রি করা যাবে এবং বিক্রির সেই উপার্জন দিয়ে ইউরোপে আলিশান বাড়ি কেনা যাবে। এদেশে তেলের মালিক জনগণ নয় বরং প্রেসিডেন্ট এবং তার পরিবারবর্গ। সমস্যা হলো মনিয়াটো ফ্রান্সের সঙ্গে মিলে কাজ করে। কিন্তু সলোলা ফ্রান্সের সঙ্গে কাজ করতে চায় না। সে আমেরিকার সঙ্গে মিলে কাজ করতে চায়। সুতরাং ফ্রান্স ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য মনিয়াটোকে সাহায্য করে। কিন্তু আমেরিকা নতুন প্রেসিডেন্টকে নিরাপত্তা দেয়নি, যিনি গণতান্ত্রিকভাবে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। আমেরিকা মোটেও বোকা নয়। তারা জানে, অন্য জায়গায়, যেমন ইরাক, গিয়ে যুদ্ধ বাঁধিয়ে মওকা লুফে নিতে পারবে। এদেশের তুলনায় সেখানে বরং তারা আরও অনেক বেশি তেল পাবে। কেন এখানে তারা ইরাকের চেয়ে অনেক কম তেলের জন্য যুদ্ধ করবে ?
পানশালার সম্মুখেই একটা ট্যাক্সি এসে থামে। খাটো স্কার্ট পরিহিত দুজন মহিলা বেরিয়ে আসে। আমার আংকেল এবং আমি খুব মনোযোগ দিয়ে তাদের পর্যবেক্ষণ করি। তাদের পায়ে হাই হিল জুতা। জুতার সাইজ হয়তো নয় নম্বর। তারা বারান্দা পেরিয়ে যায় এবং কাউন্টারে গিয়ে মালিকের সঙ্গে কথা বলে। আমরা শুনতে পাই মালিক বলছিল:
এবার আরও বেশি টাকা নিয়ে আসো। গতকাল খুব বাজে দিন ছিল।
আমার আংকেল বললেন:
তুমি দেখেছ ? যুদ্ধ সবকিছু তছনছ করে দিয়েছে এবং আমাদের সর্বনাশ করেছে। বেঁচে থাকার জন্য সবাই সংগ্রাম করছে। আমি যেন কী বলছিলাম ?
যুদ্ধ সম্পর্কে ফ্রান্স এবং আমেরিকা নিয়ে এবং…
হ্যাঁ, তাই। তুমি যখন দেশে ছিলে না তখন গৃহযুদ্ধ ছিল। তুমি তা জানো। উত্তর ও দক্ষিণের হানাহানির সংবাদ সবই বিদেশের বিভিন্ন খবরের কাগজে প্রকাশিত হয়েছে। দক্ষিণের লোকেরা ক্ষমতায় এবং তারা তেলের হিস্যা ছাড়তে নারাজ। ভয়াবহ পরিস্থিতি ছিল, বুঝলে প্রিয় বৎস। সবদিক থেকে বিপুল অস্ত্রের আগমন ঘটেছিল। দক্ষিণের লোকেরা অ্যাঙ্গোলানদের সাহায্য চেয়েছিল, এমনকি ফরাসিদেরও। ওরা এসে উত্তর এলাকা দখল করার উদ্দেশ্যে আক্রমণ করে। ভয়ে-আতঙ্কে উত্তর এলাকার লোকজন পালিয়ে গেছে এবং অনেকে ঝোপ-জঙ্গলের ভেতর আশ্রয় নিয়েছি। ক্ষুধার জ্বালায়, মশার কামড়ে এবং বিভিন্ন অত্যুষ্ণ অঞ্চলের রোগবালাইয়ে মারা গেছে। অনেকে কুমীর এবং সিংহের পেটেও চালান হয়েছে। বিশ্বাস করো, জমিনেও যুদ্ধ ছিল, ছিল আকাশেও।
আংকেল বেশ জোরে কথা বলছিলেন এবং একসময় বুঝতে পারেন যে, উপস্থিত খদ্দেররা তার কথা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। পুনরায় কথা বলা শুরু করার আগে তিনি কণ্ঠস্বর নিচে নামিয়ে আনেন:
বন-জঙ্গলে সামান্য উচুঁ দিয়ে সামরিক বিমান উড়ে যেত। যারা আত্মরক্ষার জন্য জঙ্গলের ভেতর আশ্রয় নিয়েছিল তাদের উদ্দেশ্যে বিমান থেকে বলা হতো। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা থেকে বলা হয়েছে যে, ওরা সাহায্য নিয়ে এসেছে এবং খাবার সরবরাহ করবে। অথচ তুমি চাইলে প্রাচীন বামুন অর্থাৎ পিগমিদের মতো বন-জঙ্গলে খাওয়ার জন্য অনেক ফল-ফলাদি পাবে। মশকরা করে পিগমিদের কথা বললাম। তবে ওরা আসলেই খর্ব ছিল এবং ওদের পেটও ছিল ছোট। তাই বিশাল উদরের আমাদের মতো ওদের প্রতিদিন খাওয়ার প্রয়োজন পড়ত না। ওরা খাদ্য এবং পানি ছাড়া সপ্তাহের পর সপ্তাহ বাঁচতে পারত। কিন্তু আমাদের প্রতিদিন খাবার খেতে হয়।
আমার আংকেলের চোখ ভিজে ওঠে। মনে হয় যেকোন সময় অশ্রুর ফোঁটা গড়িয়ে পড়বে। এক মুহূর্তের জন্য তিনি তার গ্লাসের দিকে তাকান। তারপর গ্লাসে পুনরায় পানীয় ঢালেন এবং বলতে আরম্ভ করেন:
আমরা কীসের ভেতর দিয়ে গিয়েছি, তুমি তা জানো না। তুমি খবরের কাগজে যা কিছু পড়েছ, বাস্তবে তার থেকেও অনেক খারাপ পরিস্থিতি ছিল। ভয়ংকর অবস্থা! আমি নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করেছি। আমি সেখানে ছিলাম। শরণার্থীদের সঙ্গে আমি জঙ্গলে ছিলাম। কখনও সন্তান সম্ভবা মহিলারা জঙ্গলের ভেতর শিশু-সন্তান জন্ম দিয়েছে। কেননা তোমাদের দেশে তেল কিংবা যুদ্ধ থাকলেও স্বাভাবিক নিয়মে শিশুদের জন্ম হতো। সবচেয়ে খারাপ দিক হলো, যুদ্ধবিগ্রহের মাঝেও আমরা কিন্তু প্রাকৃতিক খেলায় নিজেদের ব্যস্ত রেখেছি। আমি জানি, তুমি কী বলবে। তুমি বলবে: যুদ্ধ না থামা পর্যন্ত কী প্রাকৃতিক খেলা থেকে বিরত থাকা যায় না ? হে প্রিয় বৎস, আমরা যদি যুদ্ধ থামা পর্যন্ত বিরত থাকতাম, তাহলে প্রাকৃতিক খেলা ভুলে যেতাম। তখন আমরা হয়তো জন্তু-জানোয়ারের সঙ্গে খেলতাম। এটা কোনও নতুন কিছু নয়। ইতিহাসে দেখা যায়, কলেরার মতো মহামারির সময়ও নারী-পুরুষ মিলিত হয়েছে। যাহোক, আমার মনে হয় না কলেরার সঙ্গে তেলের আদৌ কোনো সম্পর্ক আছে…
দুজন বারবণিতা আমাদের টেবিলের সামনে দিয়ে চলে গেল। আমার আংকেল ফিরেও তাকায়নি। বরং তার কণ্ঠস্বর ভারী হয়ে ওঠে। সেই ভারী গলায় তিনি বললেন:
জঙ্গলের ভেতর পরিবেশ খারাপ থেকে আরও খারাপ হয়ে গিয়েছিল। একদিন আমরা মাথার ওপর উড়ন্ত তিনটি হেলিকপ্টারের আওয়াজ শুনতে পেয়েছি। খুব নিচু দিয়ে উড়েছিল। মনে হয়েছিল গাছের উঁচু শাখার সঙ্গে স্পর্শ লাগবে। চতুর্দিকে গুজব রটেছিল যে, হেলিকপ্টারগুলো কোনও আন্তর্জাতিক সংস্থার। আকাশে তিনটি হেলিকপ্টার আমরা উড়তে দেখেছি। হেলিকপ্টারের গায়ে ইংরেজিতে বড় অক্ষরের স্পষ্ট লেখা ছিল: ‘পিটিলয়ি’। হেলিকপ্টারগুলো ছিল ফ্রান্সের এক কোম্পানির। সেই কোম্পানি আমাদের দেশে তেল উত্তোলন করত। অবশ্যই হেলিকপ্টারগুলো আমাদের সাহায্য করতে এসেছিল। বিড়ালের ভয়ে, যার কোনও দাঁত নেই কিংবা ধারালো নখও নেই, নেংটি ইঁদুরের মতো আমরা ঝাঁকে ঝাঁকে জঙ্গলের ভেতর গোপন আস্তানা থেকে বেরিয়ে আসি। উল্লাসে আমরা চিৎকার শুরু করেছি। আমরা রীতিমতো নেচেছি এবং জোরে হাত তালি দিয়েছি। একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আনন্দ ভাগাভাগি করেছি। চিৎকার করে বলেছি: ভিভে লা ফ্রান্স! ভিভে লা ফ্রান্স! বেঁচে থাকুক ফ্রান্স! বেঁচে থাকুক ফ্রান্স! অন্যদিকে অনেকে আনন্দে চিৎকার করে বলেছে: লং লিভ আমেরিকা! আমেরিকা অমর হোক! অবশেষে আমরা আরেকবার প্রাকৃতিক খেলায় মত্ত হয়েছি। তবে সেবার কিন্তু বন-জঙ্গলে নয় বরং নিজেদের ঘরবাড়িতে অনেক শিশু-সন্তানের জন্ম দিয়েছি। এক সময় যুদ্ধ থেমে গেছে। শান্তি অমর হোক।
হেলিকপ্টারের পাখার মতো আংকেল হাত ঘুরাতে শুরু করেন এবং কাউন্টারের পিছন থেকে মালিক আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার চোখেমুখে বিস্ময়। আমার আংকেল আরেকবার কণ্ঠস্বর নিচু করেন :
প্রিয় বৎস, দিব্যি কেটে বলছি, হেলিকপ্টারগুলো ওখানেই ছিল এবং আমাদের মাথার ঠিক কয়েক মিটার ওপরে। আমরা ভেবেছি, ওরা আমাদের দিকে চাউল, দুধ, চিনি, রুটি ও মাংস ছুড়ে দিবে। খাদ্যের প্যাকেট কুড়ানোর জন্য আমরা তাড়াহুড়া করে দৌড়ে গিয়েছি। আমরা কনুই দিয়ে একজন আরেকজনকে গুঁতো দিয়েছি, ঝগড়া করেছি এবং বাচ্চাদের পদদলিত করেছি। বয়স্করা বলেছেন, আমরা যেন মহিলা ও শিশুদের অগ্রাধিকার দিই। তুমি কী জানো, আসলে সেদিন কী ঘটেছিল ?
যদিও আমি জানি, তারপরও না-সূচক ভঙ্গিতে মাথা দোলাই যেন তিনি বলতে পারেন।
আমরা হেলিকপ্টারের দরজা খুলতে দেখেছি এবং ভেতরের লোকজন ছিল অ্যাঙ্গোলার। ওরা হাতের অস্ত্র দিয়ে নিশানা তাক করে এবং গুলি ছুড়তে শুরু করে। গুলির ভয়ংকর শব্দে আশেপাশের গাছ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি খোলা হাওয়ায় উড়ে যায়। অনবরত গুলি চলতে থাকে। লোকজন মাটিতে পড়ে যায়, কেউ দৌড়ে পালায় এবং কেউ পানিতে লাফিয়ে আত্মরক্ষা করে। সৈনিকেরা মেশিন গান ব্যবহার করেছিল। আমরা ঘটনার কিছুই জানতে পারিনি। শরণার্থীদের মধ্যে বয়স্ক একজন চিৎকার করে বলেছিল, নিরাপদে সরে যাও! এটা একটা ফাঁদ!
পিছনে বসা খদ্দেরদের চোখমুখ দেখে অনায়াসে বোঝা যায় তারা আমাদের কথাবার্তা শুনে মোটেও খুশি না। হয়তো খানিকটা ভড়কে গিয়ে আমার আংকেল এক মুহূর্তের জন্য নিবৃত্ত হয়। ওরা চলে যাওয়া পর্যন্ত তিনি চুপ করে থাকেন। তারপর একসময় বলতে শুরু করেন:
প্রিয় বৎস, দেখতেই তো পারছ আমি জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসেছি। দেশে পুনরায় শান্তি বিরাজ করা শুরু করে। সবাই আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসি। আমরা পানশালায় যাওয়া আরম্ভ করি, সমুদ্র সৈকতে যাই, এমনকি সব জায়গাতেই আমাদের যাতায়াত শুরু হয়। আমরা দুর্দিনের কথা আস্তে আস্তে ভুলে যেতে থাকি। পাঁচ বছর পরে আবার নতুন করে আমাদের নির্বাচন হয়। ফ্রান্স এবং অ্যাঙ্গোলার পূর্ণ সহায়তা পাওয়া সত্ত্বেও দক্ষিণের প্রেসিডেন্ট পরাজিত হয়। আমরা খুশিতে লাফাতে থাকি। দক্ষিণের পরাজিত প্রেসিডেন্টকে সারা দেশে তন্নতন্ন করে খোঁজা হয়। সে প্রাণের ভয়ে ফ্রান্সে পালিয়ে যায় এবং সেখানেই নির্বাসিত জীবন বেছে নেয়। এখন দেশ উত্তরের শাসনে। সলোলা আমাদের শাসনকর্তা। দক্ষিণের প্রেসিডেন্টকে সাহায্য-সহযোগিতা করার জন্য সে ফ্রান্সের প্রতি অত্যন্ত নাখোশ। তাই সে তেল উত্তোলনের দায়িত্ব আমেরিকার হাতে তুলে দেয়। ফ্রান্স খুশি হতে পারেনি। ফ্রান্সের প্রতিনিধিরা প্যারিসের গোপন আস্তানায় নির্বাসিত প্রাক্তন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে প্রতিদিন সাক্ষাৎ করে। তারা প্রাক্তন প্রেসিডেন্টকে আশ্বস্ত করে যে, তাকে আবার ক্ষমতায় বসানো হবে। কিন্তু আমরা বুঝতে পারি না, দক্ষিণের একজন কেমন করে পুনরায় ক্ষমতা লাভ করবে এবং প্রেসিডেন্ট হবে। সমস্ত দেশজুড়ে আমেরিকার লোকজন। তারা আমাদের ইংরেজি শেখাতে অনেক চেষ্টা করে, কিন্তু সফল হতে পারেনি। কেননা উপনিবেশ শাসনামলে ফ্রান্স তাদের বিদঘুটে উচ্চারণ আমাদের রক্তের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়েছে। আমরা আমেরিকাকে বলেছি, তেল নিয়ে তোমরা যা খুশি তাই করো, কিন্তু আমরা ইংরেজি শেখা প্রত্যাখ্যান করেছি। তারা আমাদের কথায় কোনও তোয়াক্কা করেনি বরং তারা দক্ষিণের প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করিয়ে নিয়েছে। প্রেসিডেন্ট জানেই না যে, সে ভবিষ্যতের জন্য সব তেল আমেরিকার কাছে বিক্রি করে দিয়েছে।
পাঁচজন উর্দি পড়া লোক পানশালায় প্রবেশ করে এবং পেছনের দিকে বসে। আমার আংকেল কয়েক সেকেন্ডের জন্য তাদের দিকে তাকিয়ে পরখ করেন এবং কণ্ঠস্বর নিচুতে নামান। কেননা তিনি জানেন, সেই সময় জোরে কথা বললে নির্ঘাত আমাদের হলুদ বাড়িতে আতিথেয়তা নিতে হতো। সৈনিকদের সম্মুখে যুদ্ধ নিয়ে আলাপ-আলোচনা করা মোটেও সমুচীন নয়।
এখন আমাদের নতুন করে নির্বাচন করতে হবে। দক্ষিণের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ফিরে এসেছে এবং ফ্রান্সের সহায়তায় সে নির্বাচনে লড়বে। কিন্তু আমাদের উত্তরের প্রেসিডেন্ট বলেছে দেশের পরিস্থিতি নির্বাচনের অনুকূলে নয়। দক্ষিণের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট পাল্টা ঘোষণা করেছে পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, নির্বাচন অবশ্যই হতে হবে। সুতরাং তারা প্রস্তুতি নিতে থাকে। এই কী হলো! তুমি কী পানীয় শেষ করতে চাও না ?
আমি গ্লাস উঁচু করে পলকেই গলার ভেতর ঢেলে দিই। আমার আংকেল আমাকে অনুসরণ করেন এবং বলতে থাকেন :
অ্যাঙ্গোলার মাধ্যমে প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট অস্ত্র এবং গোলাবারুদ এনে জড়ো করে এবং অ্যাঙ্গোলাবাসীদের সাহায্য করার জন্য অনুরোধ করে। উত্তরের প্রেসিডেন্ট যদি নির্বাচন দিতে গড়িমসি করে তবে শক্তি প্রয়োগে তাকে ক্ষমতা থেকে সরানো হবে। শেষপর্যন্ত কী হবে, কেউ জানে না। অনেকে বলাবলি করে যে, পুনরায় গৃহযুদ্ধ শুরু হবে। কিন্তু শুধু আমি একটা বিষয়ে নিশ্চিত, তেলের জন্য সাধারণ মানুষের জীবনে কোনও পরিবর্তন আসবে না।
আমি কাউন্টারের পেছন দিকে তাকাই। আমার আংকেল ঘড়িতে সময় দেখে।
সময় যেন হাওয়ায় উড়ে যায়। ইতোমধ্যে সাড়ে দশটা বেজে গেছে।
বিল পরিশোধ করে আমরা পানশালার বাইরে এসে ট্যাক্সি নিই। স্বাধীনতা সরণির দিকে যাব, যা আড়াআড়িভাবে ল্যুজিনজো হয়ে চলে গেছে। কদাচিৎ আমি আমার আংকেলের মুখের ক্ষতস্থানের দিকে তাকাই। তিনি আমার দিকে ঘোরেন:
চলো, আগামীকাল আবার পানশালায় যাই। তুমি কী দুজন বারবণিতাকে দেখেছিলে ? একজন তোমার এবং অন্যজন আমার। আমি টাকা দেব। চিন্তা করো না। আমি বাজি ধরতে পারি, তুমি অনেক দিন ল্যুজিনজোর স্কার্ট দেখোনি!
আমি কিছুই বললাম না। ঘুমে প্রায় অর্ধেক বিভোর। হ্যাঁ, আমি আগামীকাল আবার পানশালায় যাব, আমার আংকেলের সঙ্গে…
অস্ট্রেলিয়া থেকে
সচিত্রকরণ : রাজীব দত্ত