আর্কাইভগল্পপ্রচ্ছদ রচনা

শরীরের মন মনের শরীর : নাসরীন জাহান

বিশেষ গল্পসংখ্যা ২০২২ : বাংলাদেশের গল্প

সে দিন ঝিমরঙা সন্ধ্যাটার রং ছিল রাস্তার রেডসিগন্যালের মতো, তার আগে অবারিত সবুজ সিগন্যালে রং এমন তুমুল ধাইছিল টুনি বালিকার হি হি হাসির অবিশ্রান্ত স্রোত কিছুতেই থামছিল না। শুধু একটা মুহূর্তের মধ্যে লালটার পুরো ফালি ঢুকে গিয়েছিল।

সেটাই এত ব্যাপক বিভীষিকাময়, সে থেকেই টুনিবেবির অকল্যাণ জীবনের শুরু তৈরি হয়ে যায়।

কোলে ছিল পিচ্চি পুতুল ছোট ভাইটা। পিঠাপিঠি কিন্তু ইয়া লম্বা বজ্জাত বড়ভাই সেন্টু বরইগাছে বানর লাফে মত্ত ছিল।

উঠানটায় পেরোনো দুপুরের আসনপাতা রোদে মা চুল মেলে দিয়ে কাকে ডাকছিলেন, বুবলুর জন্য জরুরি কী কিনতে।

ছটফটে ডাকু বুকু হিসেবে চিহ্নিত টুনিবেবির প্রতিও মায়ের ছিল কড়া চোখ—সাবধান, বুবলুকে দুহাতের ওপরে উঠাসনে, কষে ধরে থাক। ঠোঁট উল্টানি হাসি টুনির, কখনও কিছু পড়েছে আমার হাত থেকে ?

ওরে বুবলুরে তুই আমার প্রাণের, কলিজার…বুবলুর কাজলমাখা গোবদা মুখটায় টুনিবেবি আত্মা উজাড় আদর করতে যাবে, অমনি সেন্টুর গলা—দেখেছিস, বরই গাছটার কোণে কেমন কালো বিছা লটকে আছে ? টুনিবেবির সমস্ত ইন্দ্রিয় শিথিল হয়ে এল। সমস্ত দস্যিতা, সাহস ওই কালো গুচ্ছ চুল বিছাটার সামনে নেতিয়ে যায়।

তারপরও বুবলুকে ফের কষে বেঁধে বেষ্টনিতে গুছিয়ে এনে ঊর্ধ্বমুখী গলা উঠায় টুনি, সাবধান সেন্টু তুই জবাই হয়ে যাবি কিন্তু।

তোর মাথার ওপরেই, একবার দেখবি না ?

ও মাগো বলে টুনির সত্তা ছিটকে সরতে গিয়েও আধপায়ে ভর দিয়ে ঠেসে দাঁড় করায়, ডাহা মিথ্যে ঝারছে সেন্টু। এ বরই গাছের আতিপাতি মুখস্থ টুনিবেবির।

কিছু আগেও চষে এসেছে। এ এলাকা বিছামুক্ত। বাবা টুনিবেবির এ দুর্বলতা জানেন বলে চারপাশ যেভাবেই হোক সুয়োপোকামুক্ত রেখেছেন। সেন্টু ভোরে পাশের বাড়ির কিশোরী মেয়ের ওড়না সরিয়ে ভেতরটা দেখছিল।

ন্যাকা মেয়েটা অর্ধেক লজ্জা অর্ধেক প্রশ্রয়ে গোঙানির মতো হাসছিল, এম্মা, জানো না, কী হয়, কীভাবে হয়…।

ধাঁ ধাঁ করছিল টুনিবেবির মাথা। পা থেকে চুলের ডগা অবধি গুপ্ত বিষের নহর ঝিমঝিমিয়ে উঠতেই চিল্লিয়ে বলেছিল, বাবাকে বলছি, দাঁড়া।

সেন্টুর মুখ মুহূর্তে পাশুটে! বাবা! এই টুনি প্রেমী মানুষটার জন্মশত্রু যেন সেন্টু, মা পরম আশ্রয় ছিল, কিন্তু বুবলুর জন্মের পর মা বুবলু-অন্ধতা বাদে সব বিষয়ে নিরপেক্ষ। বাবা শুনলে খাড়া রোদে দড়ি হাতে উলটামুখি করে রক্তাবে।

সেই থেকে টুনিকে তোয়াজ করে যাচ্ছে নানাভাবে, কাজ হচ্ছে না।

ভয় দেখাচ্ছে! টুনিবেবি স্থিত হয়ে ঊর্ধ্বমুখী তার রেড সিগন্যাল চোখ ধাবিত করে ফের যেই অন্তর আল্লাদ ওমে বুবলুকে কষে বুকে জড়াতে যাবে—আচমকা এক মস্ত ভূকম্পনে পৃথিবী থেমে গেল, যেন গোপীবাঘা গেয়ে উঠেছে, থেমে থাক… স্ট্যাচু টুনিবেবির দম আটকানো চোখ ক্ষণিকমাত্র দেখতে পেল কালো বিছাটা গায়ে কাঁটা দেওয়া অলস মাথা তুলছে তার ফ্রকের মধ্যেই।

এরপর নিচে কিছু একটা পতিত হওয়ার শব্দ…ভয়ার্ত কম্পনে স্ট্যাচু হওয়া টুনিবেবি মাকে দেখল হায় হায় করে স্থানচ্যুত হয়ে এগিয়ে আসতে…।

বুবলুর প্রকৃতিফাটা আর্তনাদে হুঁশফেরা টুনিবেবি আচমকা নিচ দিকে তাকিয়ে দেখে ইটের কোনায় বুবলুর মাথার রক্ত।

কেন যে মাঠঘাট প্রান্তর পেরিয়ে পালাতে শুরু করেছিল সে, কেন যে ঠায় দাঁড়িয়ে সেন্টুর কাণ্ডটা সবাইকে বলে বাবাকে দিয়ে সেন্টুকে ধোলাই খাওয়ালো না টুনি নিজেও জানে না! টুনির বিছাভীতি সবাই জানে। সেটা টুনির গায়ে ফেললে টুনির হাত থেকে বুবলু পড়বেই তো। একি সেন্টু জানে না। কেন ? আত্মা প্রশ্ন করলে, অবুঝ উত্তর আসে, জানি না।

জীবনের গ্রন্থি থেকে সব সুতো, আলগা, বহু দূরবর্তী হয়ে গেল।

কোত্থেকে কোন পর্যন্ত ছুটেছিল ? সুউচ্চ পাহাড় বেষ্টিত বাড়ি থেকে সে ঘন বনের ভেতর দিয়ে সিঁথির মতো পথটা টপকে টপকে দেখছিল, যেন নতুন করে সেবুপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়টি, টিলা পাহাড়ের ওপর রোজ এখানে আসাযাওয়া, তাও যেন আজ অচেনা। তার পাশঘেরা সুরমা রঙের কবরের মতো দেখতে বিশাল পাহাড়টি।

মনে হয়, এর ভাঁজে লুকিয়ে যায় জীবনের মতো।

কতকাল পর আমরা আড্ডায় বসলাম। কিশোরবেলায় সংগঠনের সময় গভীরভাবে আমাকে টানত শীতল সেতুর চোখ। ভোরের অনন্তে হারিয়ে যাওয়া সেতু ঠিক সেইভাবে আমার মুখোমুখি এসে পৌঁছেছে। কিন্তু আমার চোখে আলো জ্বলছে না যে ? কারণ আমার প্রেম জহির এসে আমার চোখের সলতে জ্বালিয়ে দেয়। একটা বড় এক্সিডেন্টের পর আমি কীভাবে এই আড্ডায় এসে বসতে পারলাম। এটা ভেবে আমি নিজেই অবাক হয়ে যাই। আমার বিছানায় ছটফট করতে থাকা দেহ অথবা কল্পনার সুতোয় ভর করে যাওয়া আমার মনের শরীরের আড্ডা চলতে থাকে।

যেন খণ্ড খণ্ড মেঘ, দুর্ঘটনার এ স্মৃতি মিলিয়ে গিয়ে ধেয়ে আসে কিছুদিন আগের দৃশ্য।

হাসপাতালের ওটিতে আমাকে নিয়ে কী খেলার হুজ্জত চলল জানি না, আপাতত, হাতটা বেঁচে যাওয়ার স্বস্তির সঙ্গে মস্ত খচখচ, আমাকে অনুসরণ করতে করতে আসছিল জহির ? তাহলে আমাকে নিয়ে সেতুকে জড়িয়ে কিছু আছে তার মধ্যে ?

এলোমেলো প্যাঁচে একসময় বেডে এসে ঘুমিয়ে পড়ি।

ধীরে ধীরে জানালার কাছটায় বসেছিলাম। মনে পড়ে পনেরো বছর আগে মেঠো পাথর ইট ভাঙা সুরকি হোঁচট খেয়ে খেয়ে এ বাড়ির জানালায় প্রথম চোখ পেতেছিলাম।

ভূতের গলির ডামাডোল হুজ্জত, কানে তব্ধা লাগা কী জমজমাট মুখরতার মধ্যেই না জীবনটা ছিল! আচমকা যেন রাক্ষুসী কুয়াশা আমার সব হুজ্জতে কেড়ে নিয়ে আমাকে এক হিমশীতল নির্জনতা উপহার দিল, আমার চির অনভ্যাসের।

আম্মু…

ডাক শুনে ঘাড় ফেরাই।

লম্বাটে হওয়া শিশু বালিকাটি এলোমেলো চুল নিয়ে গরম কাপড়হীন পাতলা শার্টের তলায় কাঁপতে থাকে, সে-কী ? উঠে গিয়ে তাজ্জবে বলি, এত শীত, তুমি এ অবস্থায় এমন কেন ? তুমি তো এমন না, কী সুন্দর নিজের যত্ন জানো…যেন আত্মমগ্ন বলে যাচ্ছি আর ওর অচেনা ওয়াড্রোবের নখে আঁচড় খাচ্ছি, কই, তোমার সোয়েটার কই ?

এখানে থাকব না আম্মু, কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়ে সে, ভূতের গলি চল, প্লিজ…।

আমার আত্মার অন্তস্থলে হাতুড়ির বাড়ি পড়ে।

কিছু আগে নিস্তেজ চিৎকারে আমার প্রাণাত্মা তাই চাইছিল, নিজের বাড়ির সুখ-আনন্দ ভরসার ব্যাপারই আলাদা সবাই বলে, বলত, জহিরের সে-কী উন্মাদনা, আমার আর কন্যার বিপরীত হচ্ছে কেন ?

একেকটা বদলের এত বিচিত্র অনুভব রং কী করে, কেন ?

ভূতের গলির হুজ্জত, রিকশা…গাড়ির হর্ন কলশব্দ অনর্গল প্রথমে সত্তায় ঝিম ধরাত, ধীরে ধীরে স্নায়ুকোষের প্রতিটি অঙ্গ প্রেমে পড়ল ওই মুখরতার।

পাঁচতলার জানালার ওপারের মাঠের খেলায়, বন্ধুদের হুজ্জতে চোখ রেখে কী অনন্ত লাফেই না দিনগুলো গড়াত!

যেন অলৌকিক চক্রে পা রাখতাম, পাঁচতলার সিঁড়ি এক ফুঁয়ে ডিঙিয়ে রিকশায় চড়ে আজিজ সুপারে। কতরকম শিল্প মিশেলের আবর্তেই না পাক খেত উদ্দাম জীবন।

জাস্ট এক শহরেই অথচ এ তো দূরবর্তী, আর এত বদলের আবর্ত স্থিততায় আমরা ছিটকে পড়লাম।

সব, প্রাণের সব দূরে ফেলে আমরা যেন ব্যাপক কাঁটাতারের দূরত্বে এসে পড়লাম।

কন্যাকে বুকে চেপে ফের জানালার ওপারের জলা গাঙ, বা কাঁকর রাস্তা অথবা এক কঠিন নির্জন কুয়াশা শীতের শূন্যে চোখ গাঁথলাম।

টং টং গিটারের মীড় ধেয়ে আসে কোন প্রান্ত থেকে।

কতদিন পর জীবনের এই প্রান্তে এসে আমরা কিশোরকালের মতো বসেছি। আমাদের বন্ধুগুলোর মধ্যে এখনও তারুণ্য থাকলেও জীবনচক্রে আমরা সহসা এক হতে পারি না আজকাল। অত্যাশ্চর্য চমকে আমার ইন্দ্রিয়তে ওম অগ্নির মিহি প্রলয় বয়, চোখের সামনে থেকে সেদিনের সব দৃশ্য সরে যায়, একী গিটারের, না সরোদ…, কোত্থেকে ধেয়ে আসছে সুর ? সামনের বাঁশের ওপর ভর দেওয়া নির্মাণরত হাফ বিল্ডিংটার ওপার থেকে ? জামগাছ জানালায় কান পাতি আমি।

আমি কেন এত ছটফট করছি ওই বাজনের মিহিতায় ?

কাটা জামগাছটা ডানা ঝাপটায়।

স্পষ্ট হচ্ছে কাছবর্তী দৃশ্য। গিটারে আচ্ছন্ন আমরা যে যেখানে পারি বসে আড্ডায় মত্ত ছিলাম।

সেতুর চোখের ঘোর বারবার আমার তন্ত্রীকে যত নাড়াচ্ছিল, তত আমি জহিরের অদৃশ্য হাত আঁকড়ে নিজেকে ধাতস্থ করছিলাম। কিছু পরে বেহালা তুলে নিল সে, তার সঙ্গী মৌমিতা ঘাড় ফেলে অস্ফুটে বিড়বিড় করছিল, এ হুজ্জতে বেহালার বেইজ্জত হবে, কত কিছু যে পারো তুমি সেতু, আমার আর জহিরের বন্ধুরা চিল্লিয়ে ওঠে নানা কোরাসে, কেন, আমরা কি শৈল্পিক নই ? আমরাই তো ওকে বাজাতে বললাম, এটা তো আর ফর্মাল মঞ্চ না, কথাবার্তা হুজ্জত তো হবেই।

প্রশ্ন করি উচ্চকিত, তোর নাকি একটা বই বেরুবে এ মেলায় ? তুই তো বহুবর্ণ, এ বছর কীসের বই হে পণ্ডিত, সব্যসাচী ?

আচমকা পরিস্থিতি বদলে গেল। কিছু কোরাস জান্তব মুখ টকটকে চোখের উপস্থিতিতে, ছিটকে পড়ল বেহালা, গিটার, সেতুর দেহ রক্তের নিঃসীমে ক্রমশ…।

নিজের দিকে চোখ যায়। কে যে আমাকে পঙ্গু হাসপাতালের কথাটা বলেছিল। ওকে দেখতে না গেলে আজ…। নিজের ভঙ্গুর দশার দিকে তাকিয়ে ফের জহিরের সঙ্গে তর্কটা তাতিয়ে ওঠে, অ্যাক্সিডেন্টটা ভাগ্যে ছিল, সিঁড়ি থেকে পড়েও তো আমার হাতটা ভাঙতে পারত।

আমি আর ভাবতে পারি না।

জানালা আঁকড়ে নিথর হয়ে যাই।

ঢাকা থেকে

সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button