না : মূল : নাগিব মাহফুজ : অনুবাদ : শামীম মনোয়ার

বিশেষ গল্পসংখ্যা ২০২২ : আফ্রিকান গল্প
[নাগিব মাহফুজ (১৯১১ -২০০৬)―নোবেল বিজয়ী মিশরীয় সাহিত্যিক। ১৭ বছর বয়স থেকে লেখালেখি শুরু করেন। ১৯৩৯ সালে তার প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয়। তার ৩০টি উপন্যাস রয়েছে। ১৯৫৫ থেকে ১৯৫৭ সালের মধ্যে প্রকাশিত কায়রো ট্রিলজি তাকে আরব সাহিত্যের এক অনন্য উচ্চতায় তুলে ধরেছে। এতে তিনি ইংরেজ শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার সময়কালে মিশরের ঐতিহ্যবাহী শহুরে জীবনধারা ফুটিয়ে তোলেন। এ উপন্যাসের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি ১৯৮৮ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। নাগিব মাহফুজের উপন্যাসের প্রায় অর্ধেকের বেশির চলচ্চিত্রায়ন হয়েছে। উপন্যাসের পাশাপাশি তিনি ১০০ টিরও বেশি ছোটগল্প রচনা করেছেন। এগুলির বেশির ভাগই পরে ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে।]গুরুত্বপূর্ণ খবর হলো স্কুলে নতুন প্রধান শিক্ষক এসেছেন। খবরটি পুরো স্কুলে ছড়িয়ে পড়েছে। মহিলা শিক্ষকদের বসার কক্ষেই সে খবরটি শুনল। সে তখন পরবর্তী ক্লাসের পাঠগুলোর বিষয়ে নজর বুলাচ্ছিল। তাকে অভিনন্দন জানাতে অন্য শিক্ষকদের সাথে তাকেও যেতে হবে এবং হয়তো করমর্দনও করতে হবে।
বিষয়টিকে হয়তো এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। তার শরীরের ভিতর দিয়ে একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি বয়ে গেল। নতুন প্রধান শিক্ষকের দক্ষতা নিয়ে সহকর্মীরা কথা বলছে এবং তাঁর কঠোরতার প্রশংসাও করছে। তার সাথে এমনভাবেই হয়তো দেখা হওয়ার সম্ভাবনা ছিল যা ঘটতে চলেছে। তার সুন্দর মুখটি ফ্যাকাসে হলো কিন্তু কালো চোখের দৃষ্টি যেন আরও তীক্ষè হয়ে গেল। যখন সময় এল সকল শিক্ষক দলবেঁধে এক সারিতে প্রধান শিক্ষকের কক্ষের দিকে এগোতে লাগল। নতুন প্রধান শিক্ষক টেবিলের পেছনে তার চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে সবার অভিবাদন ও পরিচয় গ্রহণ করছিলেন। মাঝারি উচ্চতার, গোলাকার মুখ, তীক্ষè নাক, স্ফীত চোখ এবং তাকে দেখে প্রথমেই যে জিনিসটি চোখে পড়ে তা হলো তার ঘন গোঁফ। সে তাঁর দিকে সরাসরি না তাকিয়ে বুকের উপরে চোখ রেখে অগ্রসর হচ্ছিল।
তাঁর দৃষ্টি এড়িয়ে সে হাত বাড়িয়ে দিল। সে তাঁকে কী বলবে ? অন্যরা যা বলেছে তাই ? কিন্তু সে চুপ করে রইল, একটি শব্দও উচ্চারণ করল না। সে কী ভাবছিল, সেটা কী তাঁর চোখ প্রকাশ করেছিল ? নতুন প্রধান শিক্ষক রুক্ষ হাতটি দিয়ে করমর্দন করলেন। সে শক্তভাবে বলল, ‘ধন্যবাদ’। তারপর সে মার্জিতভাবে কক্ষ থেকে বেরিয়ে এল। সে দৈনন্দিন কাজের মধ্যে ডুবে গিয়ে তার উদ্বেগগুলো ভুলে গেল, যদিও তাকে ভালো দেখাচ্ছিল না। মেয়েরা মন্তব্য করল, ‘মিস খারাপ মেজাজে আছেন।’
সে পিরামিড রোড ধরে বাড়ি ফিরে এল, নিজের পোশাক পরিবর্তন করল এবং মায়ের সাথে খেতে বসল। ‘সবকিছু ঠিক আছে ?’ মা তাকে জিজ্ঞাসা করল, তার মুখের দিকে তাকিয়ে।
‘বদরান, বদরান বাদাভি,’ সে সংক্ষেপে বলল। ‘তোমার কি তাকে মনে আছে ? তিনি তো এখন আমাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক হয়ে এলেন।’ ‘সত্যিই!’ তার মা অবাক হয়ে বলল। তারপর, কিছুক্ষণ নীরব থেকে মা আবার বলল, ‘এতদিন পর তার আর কোনও গুরুত্ব নেই―সেটা একটা পুরানো দীর্ঘ-ভুলে যাওয়া গল্প।’ খাওয়ার পর, সে পরীক্ষার খাতা নিয়ে বসার আগে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে নিজের পড়ার ঘরে ঢুকল। সে তাঁকে পুরোপুরি ভুলে গেছে। না, পুরোপুরি না। কীভাবে তাঁকে পুরোপুরি ভোলা যায় ?
যখন তিনি প্রথম তাকে গণিত প্রাইভেট পড়াতে এসেছিলেন, তখন তার বয়স চৌদ্দ বছর। হয়তো চৌদ্দও নয়, চৌদ্দর কাছাকাছি। তার চেয়ে পঁচিশ বছর বড়। তাঁর পিতার সমান বয়স। সে তার মাকে বলেছিল, ‘তার চেহারায় কী যেন একটা গোলমাল আছে, কিন্তু তিনি পড়ান ভালো, বিষয়গুলো ভালোভাবে ব্যাখ্যা করেন।’ মা বলেছিল, ‘কেমন দেখায় তা দিয়ে কি হবে; গুরুত্বপূর্ণ হলো তিনি কীভাবে পড়ান।’ তিনি মজাদার একজন ব্যক্তি ছিলেন, তার পড়ানো সে পছন্দ করত এবং তাকে দিয়ে তার পড়াশোনারও খুব উন্নতি হচ্ছিল। তা হলে ঘটনাটা কীভাবে হলো ? নিজের নিরীহতায় সে বুঝতেও পারত না তাকে যে তার মা পাহারা দেয়। এবং তার জন্য তাঁর আচরণে কোনও পরিবর্তন লক্ষ্য করত না।
কিন্তু একদিন তাকে শিক্ষকের কাছে রেখে, তার বাবা মা তার খালাকে দেখতে একটা ক্লিনিকে গিয়েছিল। শিক্ষক দ্বিতীয় পিতা হিসাবে বিবেচিত। তাই তাদের মধ্যে সামান্য সন্দেহও ছিল না। তা হলে ঘটনাটা কীভাবে ঘটেছিল ? তার ভালোবাসা বা ইচ্ছা ছাড়াই তা ঘটেছিল। সে ভয়ার্তভাবে জিজ্ঞাসা করেছিল এটা কেন করলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘ভয় পেও না বা দুঃখ করো না। এটি তোমার নিজের মধ্যেই রাখবে এবং আমি আবার আসব এবং তোমার যখন বয়স হবে আমি তোমাকে প্রস্তাবের মাধ্যমেই নিয়ে যাব।’ তিনি তাঁর প্রতিশ্রুতি রেখেছিলেন। তিনি বিবাহের প্রস্তাব নিয়েই এসেছিলেন। ততদিনে সে পরিপূর্ণ একটা একটা মেয়ে হয়ে উঠেছে, তার বোঝার বয়স হয়েছে।
সে দেখল তাঁর প্রতি তার কোনো ভালোবাসা বা শ্রদ্ধা নেই এবং তার যে স্বপ্ন যে আদর্শ ও নৈতিকতা সে ধারণ করে তার থেকে এই ব্যক্তিটি অনেক দূরে। তাহলে সে কী করবে ? দুবছর আগে তার বাবা মারা গেছে। মা লোকটির এগিয়ে আসা নিয়ে উদ্বিগ্ন। মেয়েকে সে বলল, ‘আমি তোমার ব্যক্তি-স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি, তাই আমি সিদ্ধান্তটি তোমার কাছে ছেড়ে দিলাম।’
সে তার এই বিরূপ পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন ছিল। তাকে হয়তো প্রস্তাবটা গ্রহণ করতে হবে অথবা চিরতরে দরজা বন্ধ করে দিতে হবে। এটি এমন এক পরিস্থিতি যা তাকে ঘৃণিত কোনওকিছু করতে বাধ্য করার মতো। সে ছিল মনের দিক দিয়ে সমৃদ্ধ, সুন্দরী, আব্বাসীয় বংশজাত আভিজাত্যময় চরিত্রের অধিকারী। কিন্তু এখন সে ফাঁদে আটকা পড়া জন্তুর মতো অসহায়ভাবে সংগ্রামরত। সে যেমন তাঁর শক্তিকে ঘৃণা করে, ঠিক তেমনই সে নিজের দুর্বলতাও ঘৃণা করে। তার সরলতার আপত্তিজনক ব্যবহার সে কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারছে না।
তিনি বললেন, ‘দেখ আমি আবার ফিরে এসেছি, আমার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার জন্যই কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি।’ তিনি আরও বললেন, ‘শিক্ষাদান বিষয়টার প্রতি তোমার ভালোবাসার কথা আমি জানি এবং আমি আশা করি তুমি বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা শেষ করবে।’
কথাগুলো শুনে সে এমন রাগ অনুভব করেছিল যেমনটি সে আগে কখনও অনুভব করেনি। সে তার কদর্যতা যেমন প্রত্যাখ্যান করেছিল তেমনভাবে তার জবরদস্তিও প্রত্যাখ্যান করল। তার কাছে বিবাহ বিসর্জন দেওয়া সামান্যই ছিল। সে তার নিজের মত করে থাকাটাকেই স্বাগত জানিয়েছিল, কারণ আত্ম-সম্মানের সাথে একাকিত্ব মানে নিঃসঙ্গতা নয়। সে অনুমান করেছিল তার মা হয়তো এই লোকটির কাছে অর্থের দিক দিয়ে ঋণী। সে তার মাকে বেশ সোজা কথায় বলেছিল, ‘না’। তার মা বলেছিল, ‘আমি আশ্চর্য হয়েছি তুমি প্রথম থেকেই এই সিদ্ধান্ত নাওনি কেন।’ লোকটি তার পথ আটকে দিয়েছিল এবং বলেছিল, ‘তুমি কীভাবে অস্বীকার করতে পারলে ? তুমি কি এর ফল বুঝতে পারছ না ?’ সে তখন দৃঢ়ভাবে বলেছিল আপনাকে বিবাহ না-করার পরিবর্তে যে কোনও ফল আমি মেনে নিতে প্রস্তুত।’ সে তার পড়াশোনা শেষ করল এবং তার অবসর সময়গুলো কাজে লাগাবোর জন্য সে শিক্ষকতার কাজ বেছে নিয়েছিল।
এর পরেও অনেক বিবাহের প্রস্তাব এসেছে কিন্তু সে সবসময়েই তা ফিরিয়ে দিয়েছে। ‘কাউকে কি তোমার পছন্দ হয় না ?’ তার মা তাকে বার বার জিজ্ঞাস করত। ‘আমি জানি আমি কী করছি,’ সে মৃদুভাবে উত্তর দিত। ‘সময় চলে যাচ্ছে।’ ‘যেতে দাও, আমি যেমন আছি তাতেই আমি সন্তুষ্ট।’
দিন গড়িয়ে যায়। বয়স বাড়তে থাকে। সে ভালোবাসা এড়িয়ে যায়, তার ভয় হয়। তার সমস্ত শক্তি দিয়ে সে আশা করে জীবন সুখের চেয়ে শান্তভাবে, শান্তিতে কেটে যাওয়া ভালো। সে নিজেকে বোঝায় সুখ ভালোবাসা এবং মাতৃত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। সে তার দৃঢ় সিদ্ধান্তের জন্য কখনও অনুশোচনা করে না।
আগামীতে কী হবে কে জানে ? কিন্তু বর্তমান নিয়ে সে খুব অস্বস্তিতে আছে, তার জীবনে আবার তাঁর উপস্থিতি। দিনের পর দিন তার সাথে চলতে হবে। যে তার অতীতকে জীবন্ত করে তুলবে এবং বর্তমানে তা বেদনাদায়কভাবে উপস্থাপন করবে।
তারপর, একদিন প্রথমবার যখন তিনি তার কক্ষে তাকে একাকী পেল, তখন তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেমন আছ ?’
সে শীতলভাবে জবাব দিলো, ‘ভালো আছি।’
কিছুটা দ্বিধা নিয়ে তিনি জিজ্ঞাস করলেন, ‘তুমি কি … মানে, তুমি কি বিয়ে করেছ ?’
কোন একজনের সাথে কথা সংক্ষেপ করতে কেউ একজন যেমন উত্তর দেয় তেমন নিরুদ্বিগ্নভাবে সে বলল, ‘আমি তো আপনাকে বলেছি, আমি ভালো আছি।’
সচিত্রকরণ : রাজীব দত্ত