তুমি কি কখনও আলেকজান্দ্রিয়া স্টেশন দেখেছ ? : মূল : আবদু গুবেইর : অনুবাদ : এমদাদ রহমান

বিশেষ গল্পসংখ্যা ২০২২ : আফ্রিকান গল্প
[আবদু গুবেইর সম্পর্কে Under the Naked Sky, Short Stories from the Arab World―বইটিতে, ডেনইস জনসন―ডেভিস আমাদের যে তথ্য দেন তা থেকে জানা গেল, মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে হঠাৎ করেই তিনি সিদ্ধান্ত নেন লেখক হবেন আর বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে যাবেন কায়রো। সেখানে জীবিকার জন্য যখন যে কাজ পাবেন তা-ই করবেন। গুবেইরের পারিবারিক ইতিহাস ধর্ম প্রচারকের। তার পূর্বপুরুষরা ধর্মের প্রচারে কাজ করতেন।চলে গেলেন কায়রো। পালিয়ে। ‘রিদওয়ানের ছুটি’ উপন্যাসে এই বিষয়ই আখ্যানভাগে তুলে এনেছেন তিনি। তারপর তিনি চলে যান কুয়েতে, সেখানে দৈনিক পত্রিকায় কাজ শুরু করেন। কিছুদিন পর সিদ্ধান্ত নেন মিশরে ফিরবেন আর সৃজনশীল লেখালেখিতে নিজেকে উৎসর্গ করবেন। এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে তার তিন খণ্ডের ছোটগল্পের সংকলন আর চারটি উপন্যাস। আবদু গুবেইর মিশরীয়দের নিয়ে গল্প আর উপন্যাস লিখেছেন, যারা কাজের সন্ধানে পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোতে চলে গেছে। ‘তুমি কি কখনও আলেকজান্দ্রিয়া স্টেশন দেখেছ ?’ গল্পটিতেও মাটি ছেড়ে যাবার বেদনাটুকু আছে। মানুষ কোথাও থাকে না। জীবন তাকে কোথাও যেন থিতু হতে দেয় না! মানুষ মাটি ছেড়ে চলে যাবার কালে শুধু শেষবারের মতো চারপাশটাকে চোখ ভরে দেখে নেয়।
তাঁর জন্ম মিশরের নীল তীরবর্তী এক ছোট্ট শহরে, ১৯৫০ সালে।]
প্ল্যাটফর্মের কাঠের তৈরি ছাউনির নিচে বসে থেকেই সে তাকে বলল, তুমি কি জানো, আর সে ছিল নীরবÑ কয়েক বছর আগে ‘তুমি কি কখনও আলেকজান্দ্রিয়া স্টেশন দেখেছ ?’ নামে একটি গল্প লিখেছিলাম।
হাসি দিয়ে সে তার ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, সত্যি ?
সে বলল, হ্যাঁ।
তারপর সে দ্রুত চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে থাকে যাত্রীদের বিশৃঙ্খল ঠেলাঠেলি, ট্রেন থেকে নামবার আর উঠবার দৃশ্য। কিন্তু মেয়েটি―কারণ সে তাকে ভালোবাসে এবং সেও তাকে। খুব তীব্রভাবেই, কারণ কখনও তার সামনে দিয়ে তার হেঁটে যাবার দৃশ্যটাকে ভুলতে পারবে না। কারণ, তার এই হেঁটে যাওয়াটা ছিল স্নানের পোশাক পরে, আর সেই পোশাকে সমুদ্র সৈকতে আর তখন তার পেছন থেকে সে তাকে যেভাবে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখত, তখন তার দেখা থেকে বাদ পড়ত না তার হেঁটে যাওয়ার পথ আলো করে রাখা শহরের বাতিগুলো, আর যেভাবে সে প্রচণ্ড শীতে কাঁপতে থাকত আর যেভাবে সে তার সামনে এসে দাঁড়াত আর তাকে বুকে জড়িয়ে ধরত―ঠিক এসব অদ্ভুত কারণেই সে বলল, গল্পটি আসলে কী নিয়ে ?
আর আসল কথাটা হলো আলেকজান্দ্রিয়া স্টেশন নিয়ে এরকম কোনো গল্পই সে লেখেনি। তবু সে তার জানতে চাওয়ায় বলে―গল্পটি দুজন মানুষকে নিয়ে, যারা দাঁড়িয়ে ছিল স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে আর তারা জীবনের যন্ত্রণাগুলো নিয়ে কথা বলছিল, কারণ তারা আলেকজান্দ্রিয়া ছেড়ে চলে যাচ্ছিল আর হয়তো তারা আরও কিছুদিন এখানে থাকতে চাচ্ছিল। তাদের সমুদ্রের প্রতি গভীর প্রেম ছিল। সে সাঁতার কাটতে পছন্দ করত, যদিও সে যে খুব ভালোভাবে পারত তা না, কারণ একদিন সে একেবারে তীরের কাছেই ডুবতে বসেছিল। তবে সে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল সেই পথ দেখায়, যে পথ দিয়ে তারা পরস্পর সমুদ্রতীরে চলে আসত কিংবা সেসব ব্যাপার―রাতের ক্ষীণ আলোর নিচে তাদের একসঙ্গে বসে পড়া আর গল্প বলা যেন তারা শুধু ঢেউগুলোই দেখছে।
―আর স্টেশনের ব্যাপারটা ? সে জানতে চাইল। গল্পে কি কোনও স্টেশনের উল্লেখ ছিল ?
―হ্যাঁ, অবশ্যই সেখানে একটি স্টেশন ছিল। সে বলল, কেননা তারা তো প্ল্যাটফর্মেই দাঁড়িয়ে ছিল আর কথা বলছিল সমুদ্র নিয়ে, শহরের সড়কগুলো নিয়ে আর এখানকার বিস্ময়কর আবহ নিয়ে, পরিবেশ নিয়ে, তারা যে আলেকজান্দ্রিয়া নিয়ে, যেখানে তারা বাস করত আর এখন আলেকজান্দ্রিয়া ছেড়ে চলে যাচ্ছে―বিষাদটুকু নিয়ে, কারণ তারা একজন আরেকজনকে ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে তুলেছিল।
সেও কি সত্যিকার অর্থেই আলেকজান্দ্রিয়াকে ভালোবাসত ? সে জানতে চাইল।
―এটা নিশ্চিত যে সে ভালোবাসত―আর হ্যাঁ, কে এই নগরীকে ভালোবাসে না বল ? সে তাকে বলল।
সে সমুদ্রতীর ভালোবাসত। কিন্তু নগরীর প্রতি তার কোনও আগ্রহ ছিল না। তার কারণ কোনও শীতকাল সে এখানে কাটায়নি। যদি শীতকালটা থাকত, তাহলে অবশ্যই এই নগরীকে সে ভালোবাসবেই, তবে যখন সে এখানে আবার ফিরে আসবে।
―সম্ভবত সে বলল, তবে আমার ধারণা এখানে অন্যকোনও কারণ লুকানো আছে। শুধু শহরে যাওয়ার কারণেই কেউ কোনও শহরকে ভালোবাসবে না। অবশ্যই অন্যকোনও কারণ আছে।
খুব স্বাভাবিকভাবেই, সে জানবার জন্য উদগ্রীব হয়ে ছিল যে এটা কি আসলেই একটা প্রেমকাহিনি ? কিন্তু রহস্যটা লুকিয়ে ছিল দুই লাইনের ভিতর আর খুঁজে বের করাটাও অত সহজ ছিল না, কারণ ব্যাপারটা দুর্বোধ্য।
কিন্তু ব্যাপারটাকে এত জটিল লাগছে কেন ? সে জানতে চাইল। সে বলল, কারণ মেয়েটিকে সে ভালোবাসত―যাত্রীদের ভিড়, ঠেলাঠেলির দৃশ্যের ওপর চোখ রেখেই সে বলল, মেয়েটি ছিল তার স্ত্রীর বোন। তাকে সে আগে কখনওই দেখেনি কিন্তু যেদিন দেখল, পড়ে গেল তার প্রেমে আর ব্যাপারটা স্বাভাবিকভাবেই খুব জটিল।
―আমি বুঝতে পারছি না যে কেন তুমি এমন এক নায়কের জন্ম দিচ্ছ, এমন একটা চরিত্র, যাকে মনে হচ্ছে সে খুব তীব্রভাবে জীবনকে ভালোবাসে। সে সমুদ্র ভালোবাসে। তাহলে কেন তাকে এই ধরনের অনুভূতি দিয়ে সৃষ্টি করছ ?
―সে আসলেই এমন কিছু হোক চায়নি আর এজন্য সে খুব চিন্তিতও কিন্তু তা হলে কী হবে, ব্যাপারটা যে ঘটে গেছে। আর এই ঘটনার পেছনে আর কোনও কারণও ছিল না কিন্তু ব্যাপারটা এভাবেই লিপিবদ্ধ হয়েছে, ঠিক যা সে করেছে।
―ওহ। সে অস্ফুট শব্দ করল।
তারপর, সে আবার যাত্রীদের দেখতে শুরু করল আর সে তাকে খুব গভীরভাবে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। কয়েক মুহূর্তের জন্য নীরব থাকল তারা, যতক্ষণ না সে খুব অস্থিরভাবে নড়ে উঠল। তার স্ত্রী তার জন্য কিছু সিগারেট কিনে আনল, আর সে ছিল ক্লান্ত, কিছুটা অসুস্থ, তাই সে সিগারেট কিনতে যেতে পারছিল না।
―তোমাকে যা করতে হবে, তা হলো গল্পটা পুরোটা তোমাকে পড়তে হবে, তাহলেই দেখবে যে তুমি এটাকে পছন্দ করে ফেলেছ… সে তাকে বলতে লাগল।
―কোন গল্পটা ? তার কথা ভালো করে শেষ হবার আগেই সে কথাটা বলল।
―সে গল্পের নাম ‘তুমি কি কখনও আলেকজান্দ্রিয়া স্টেশন দেখেছ ?
―তুমি কি গল্পটা এই নামেই লিখেছিলে ?
―হ্যাঁ, অনেক দিন আগে।
আমি মনে করতাম যে আমি তোমার সব গল্পই জানি, সে তার কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে, তার মানে হলো তোমার এমন কিছু গল্পও আছে, যা আমি জানি না। তুমি কি লুকিয়ে লুকিয়ে লিখেছ ?
সে বলল―হ্যাঁ, মাঝে মাঝে। কিন্তু অই যে দেখছ ট্রেন চলে এসেছে। আসো, যাই।
যদিও সে ক্লান্ত ছিল আর কিছুটা অসুস্থও তবু সে তাকে তার পিঠে তুলে নেয়, ঠিক যেমনভাবে তাদেরও একদিন ট্রেনের কামরার দরজা দিয়ে উঠতে দেখেছিল। তারপর বিষাদে, গভীর বেদনায়, প্ল্যাটফর্মের যতটুকু দেখা যায়, শেষবারের মতো সে দেখে নেয় স্টেশন, প্ল্যাটফর্ম, মানুষ আর প্ল্যাটফর্মের সেই ঘণ্টাটি!
প্যারিস থেকে
সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ