আর্কাইভগল্পপ্রচ্ছদ রচনা

একদিন গোলাপি মানুষ : শঙ্খদীপ ভট্টাচার্য

বিশেষ গল্পসংখ্যা ২০২২ : ভারতের গল্প

সকালে আচমকা ঘুমটা ভেঙে গেল। শ্বাস টেনে বুঝলাম দরকারি মৌল উপাদানটি সঠিক পরিমাণে বুকের হাপরে জমা হচ্ছে না। হাত-পায়ের রং ক্রমশ কালচে নীল হয়ে উঠছে। কানের ঠিক ওপরে কেউ যেন হাতুড়ি পিটছে লাগাতার। মাথাটা এবার মনে হয় বোমার মতো ফেটেই পড়বে। এমন শ্বাসরুদ্ধকর ভয়ংকর অভিজ্ঞতা আমার কাছে অবশ্য নতুন নয়। বিজ্ঞানীরা আজকাল প্রায়ই বলছেন, এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণের খবর পাওয়া গিয়েছে বেবিনামেন অঞ্চলে। মাস দুয়েক আগে কিকোরো ছিল। গতবার সেখানেই গিয়েছিলাম। দেরি না করে বেবিনামেন পৌঁছাই। প্রাচীন ঋষির মতো যোগাসনে বসে শ্বাসকার্য চালাই ঘণ্টা সাতেক। আরাম পাই শরীরে। আমার শরীরের রং আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে আসে। কালচে নীল থেকে গোলাপি। ডায়েরিতে কিকোরোর ঠিক নিচেই বেবিনামেনের কথা লিখে রাখি। লিখে রাখি আজকের ঘটনার সমস্ত খুঁটিনাটি।

আমার ঘরের আশপাশে জনবসতি নেই। অনেক দূরেও নেই। আরও কিছুটা দূরে মানুষের ঘোরাফেরা আছে কি না তাও  জানি না। আমার ঘর বলতে পুরু খসখসে প্লাস্টিকের তৈরি চার দেয়ালের বারো বাই বারো ফুট একটা কামরা। কামরায় জমে থাকা থমথমে শান্তিতেই আমার প্রতিদিনের সুখ। দেয়ালে জানালা তো দূরের কথা, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ফুটো পর্যন্ত রাখিনি, যেখান দিয়ে মাছি গলতে পারে। এই আয়োজনের কারণ আছে। পাছে দূরে কোথাও কোনও নদীর পাড়ের কোনও এক অরণ্যের ঘন গাছগাছালির শরীর ছুঁয়ে বিশুদ্ধ বাতাস ঘরে ঢুকে পড়ে। সেই বাতাস ফুসফুসে জায়গা করে নিলেই তো মহা বিপদ। নিমেষে গায়ের রং দ্রুত বদলে যাবে কালচে নীলে। আমি আরও একবার নিশ্চিত হতে নাভির দুপাশটা দেখে নিই। গোলাপির সঙ্গে সামান্য লাল রঙের আভাস। তার মানে শরীর এখন আমার সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। আনন্দে আমি গান গেয়ে উঠি। মিনিট খানেক পরেই আমার গান বাধা পায় দরজায় শব্দে। কেউ হাত মুঠো করে দরজায় মৃদু ঘা মারছে। দরজা খুলতেই আমার সারা শরীর দারুণ উত্তেজনা আর গভীর আনন্দের মিশেলে কেঁপে ওঠে। চোখের সামনে সমাপ্তি। সমাপ্তিকে আমি প্রথম দেখেছিলাম আজ থেকে তিরিশ বছর আগে। একুশ শতকের প্রথম বছরে তখন আমাদের দুজনেরই বয়েস একুশ। সমাপ্তিকে দেখে মনে হয়েছিল ও যেন রক্তকরবীর পাতা থেকে উঠে আসা রক্ত মাংসের নন্দিনী। সমাপ্তিই ছিল আমার প্রথম ও অন্তিম প্রেম। আমাদের দুজনেরই পছন্দের ফুল ছিল সূর্যমুখী। গোধূলিতে বিভোর হয়ে শুনতাম রাগ হংসধ্বনি। সমুদ্রের তীরে ভেজা বালি দিয়ে পশুপাখির অবয়ব গড়তে পছন্দ করতাম। বিশুদ্ধ বায়ুর খোঁজে আমরা মাঝে মাঝেই পৌঁছে যেতাম পাহাড়ের খুব কাছে। শীতল অক্সিজেন শুষে নিতাম প্রাণ ভরে। হাতে হাত রেখে মেঘের আড়ালে বরফে ঢাকা পর্বতশ্রেণি দেখতাম নির্বাক হয়ে। গভীর অরণ্যে তাবু খাটিয়ে কালো আকাশে সাদা তারার দিকে তাকিয়ে থাকতাম অনেকক্ষণ। তখন সমাপ্তি আমাকে ওর কাজের কথা বলত। অসময়ে ঘুমিয়ে পড়া মানুষকে জাগিয়ে তোলার কাজ ছিল সমাপ্তির। তারপর মানুষের ঝিমুনি ভাব কাটিয়ে তার পঞ্চেন্দ্রিয়কে সক্রিয় করা। মানুষকে চনমনে করে তোলার কাজে সমাপ্তির পারদর্শিতা ছিল অসামান্য। ওর দলের কর্মীদের মধ্যে ওই ছিল সেরা। ওর কাজের কথা শেষ হলে আমার কাজের কথা জানতে চাইত সমাপ্তি। আমার কাজ ছিল সজাগ চনমনে মানুষকে গল্প, কবিতা, গান শোনানোর। মানুষের সংগ্রামের ইতিহাস, সমুদ্রের গল্প, নদীর কবিতা কখনও বা কাকাতুয়ার গান। সেসব শুনে তারা নিজেরাই একদিন কাঠবেড়ালি নিয়ে কবিতা লিখতে শুরু করত কিংবা দূরবর্তী অচেনা কোনও এক মানুষের দুঃখে হঠাৎ মন খারাপ করে উঠত। আমাদের দুজনের এই কাজ ছিল দীর্ঘ প্রক্রিয়ার। কাজে সবসময় যে আমরা সফল হতাম তা কিন্তু নয়। প্রথম দিকে আমাদের এই কাজ পরম আনন্দের জায়গা হয়ে উঠেছিল কিন্তু বছর দশেক পরে সমাপ্তি আমাকে একদিন চিন্তিত মুখে বলল, মানুষের ঘুম যে আর ভাঙছে না দিগন্ত। আমিও লক্ষ্য করলাম যে সজাগ চনমনে মানুষেরা আর কেউ গাছের গল্প শুনে বা ময়ূরের নাচ দেখে উল্লসিত হচ্ছে না। অন্য মানুষের দুর্দশায় বিচলিত বোধ করছে না। আরও বছর দশেক পরে লাগাম পড়ল আমাদের বিশুদ্ধ বায়ুর খোঁজে এদিক ওদিক বেরিয়ে পড়ায়। মানুষ ঘন ঘন ঘরবন্দি হতে শুরু করল। ঘরের বাইরে নাকি মারাত্মক অসুখ ছড়িয়েছে গোটা পৃথিবী জুড়ে। সমাপ্তির সঙ্গে আমার দেখা হওয়া বন্ধ হলো। ঘরের ভিতরে আমি জালে আটকে পড়া মাছের মতো ছটফট করতাম। আমার প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট হত। শরীর কালচে নীল হয়ে উঠত বিশুদ্ধ বায়ুর অভাবে। তখন সমাপ্তির কথা আমার মনে পড়ত। সেই সময়ের পর থেকে আমি তার কোনও খোঁজ পাইনি। দীর্ঘ সময় পর আমার মনোজগতের সুপ্ত বিস্ময়সূচক চিহ্নটিকে জাগিয়ে তোলে সমাপ্তি আজ আমার চোখের সামনে। তার চেহারায় কিন্তু আর আগের জৌলুস নেই। সমাপ্তি মিশকালো ছিল। গায়ের রঙ এখন কেমন হলদেটে। সূর্যমুখী হলুদ। আমি বললাম, ‘তুমি কেমন বদলে গেছ সমাপ্তি।’

সমাপ্তি হেসে বলল, ‘আমি তো বহুকাল হলো মরে গিয়েছি দিগন্ত।’

‘মরে গেছ ?’

‘হ্যাঁ, আমরা যখন ঘরবন্দি ছিলাম তখন বাইরের অসুখ আমার শরীরে প্রবেশ করল। অনেক চেষ্টা করেও আমাকে কেউই বাঁচাতে পারেনি। বিশুদ্ধ বায়ুর অভাবে আমি মরে গেলাম। কিন্তু তুমি তো বেঁচে আছ দিগন্ত। এত এত বিপর্যয়ের পরেও! আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে তোমাকে দেখে!’

‘এসো সমাপ্তি ভিতরে এসো।’

সমাপ্তির হাতে হাত রেখে বললাম, ‘তুমি আমাকে আর ছেড়ে যেও না। আমার কাছেই থাকো। কথা দাও যাবে না।’

‘আমার যে আর কোথাও যাওয়ার নেই। আচ্ছা দিগন্ত বলো তো, মানুষ কতবার মারা যায় ?’

‘জানি না।’

‘পুরুষ হলে সাত আর নারী হলে সতেরো। আমার সতেরো হতে আর এক বাকি।’

আমি ঠিক বুঝলাম না সমাপ্তি কী বলতে চাইছে তবু ভাবার চেষ্টা করলাম পুরুষের সপ্তমৃত্যুর কোন ধাপে এখন আমি রয়েছি।

সমাপ্তিকে ভীষণ রোগা দেখাচ্ছে। আমার মনে হলো সে ক্ষুধার্ত।

আমি বললাম, ‘তুমি কিছু খাবে ?’

সমাপ্তি বলল, ‘মৃত্যুর পর আমি কিছুই খাইনি। আমার জিভে স্বাদ নেই। আমি কোনও কিছুর গন্ধ পাই না। ঝাপসা দেখি সবকিছুই। খিদেও পায় না তেমন।’

আমি তরমুজ, আপেল, কমলালেবু বের করি। আনাজপাতি ও আরও সুস্বাদু কিছু খাবার। সমাপ্তি আমাকে দেখছিল। ওর চোখে গভীর ভালোবাসা। স্মিত হাসি। ও দেখল, আমি আপেল, তরমুজ থেকে সমস্ত ফরমালিন আর কার্বাইড শুষে নিয়ে নিজের শরীরে মিশিয়ে দিলাম। দীর্ঘদিনের অভ্যাসে এই কাজ এখন আমার কাছে জলভাত। আনাজপাতি থেকে চেটে নিলাম অন্তর্গত কীটনাশক। তারপর রান্না করে ফল কেটে সমাপ্তির সামনে সাজিয়ে ধরলাম।

সমাপ্তি বলল, ‘যে খাবার তুমি আমাকে দিলে তা খেলে নিশ্চয়ই তোমার পেট ব্যথা করে, বমি আসে, রাতে ঘুম হয় না ?’

আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম।

সমাপ্তি তৃপ্তি করে সমস্ত খাবার খেল। খেয়ে বলল, ‘আমি এত বিশুদ্ধ খাবার প্রথমবার খেলাম দিগন্ত। সমস্ত খাবারের গন্ধ ও স্বাদ দুইই পেলাম।’ ঠিক তখনই এক পশলা স্মৃতি উঁকি দিল। সমাপ্তির ছিল জলের নেশা। বৃষ্টি পড়লে সমাপ্তি চোখে মুখে সুতীব্র উচ্ছ্বাস দেখা দিত। নদীতে সাঁতার কাটত ঘোর গ্রীষ্মের দুপুরে। জল থেকে উঠতেই চাইত না। তারপর আমিও যোগ দিতাম ওর সঙ্গে। শুধু কী তাই, ‘জল পান করেও কী পরম তৃপ্তি পেত সমাপ্তি তাও অনুভব করেছি রন্ধ্রে রন্ধ্রে সেই সময়।

শুনেছি জলের অপর নাম নাকি জীবন। জল ছাড়া মানুষ বাঁচে না। সেই জীবন নামের জল থেকে আর্সেনিক এবং অন্যান্য সমস্ত রাসায়নিক পেটের ভিতর চালান করে পেতলের গ্লাসে সমাপ্তিকে জল দিলাম। সমাপ্তির জলপান দেখে বুঝলাম ও দীর্ঘদিন ধরেই তৃষ্ণার্ত।

জলের তৃপ্তি নিয়ে বলল, ‘তুমি তো বিশুদ্ধ জল পান কর না দিগন্ত। হাতে পায়ে গুটি ওঠে, কিডনি খারাপ হয়, ক্যানসারও হতে পারে তোমার, তাই না ?’

আমি মাথা নেড়ে আবার সম্মতি জানাই।

সমাপ্তির চোখে জল। চোখের জল মুছে সে বলল, ‘কেন সবকিছু এমন হয়ে গেল দিগন্ত। কী অপরাধ ছিল আমাদের ? আমরা তো মানুষের পাশেই ছিলাম সারাটা জীবন। তুমি মৌমাছির হারিয়ে যাওয়া নিয়ে পথে বসেছিলে দিনের পর দিন কিচ্ছুটি না খেয়ে। প্রজাপতির মৃত্যু দেখে স্তব্ধ হয়ে যেতে। মনমরা মানুষকে উজ্জীবিত করতে কী কাণ্ডই না করতে! এইসব কি তুমি কেবল একাই ভালোবেসেছিলে দিগন্ত ? আর বাকি মানুষেরা!’

আমি সমাপ্তিকে জড়িয়ে ধরলাম। তার শরীরের ঘ্রাণ নিয়ে তার বিষাদ মুছে ফেলতে মুখে হাসি এনে বললাম, ‘তোমার মনে আছে সমাপ্তি আমার জন্য তুমি একবার চিতল মাছের মুইঠ্যা রান্না করে এনেছিলে। খেয়ে আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আমি রান্না শিখে তোমাকে সর্ষে ইলিশ রেঁধে খাওয়াব। শেষমেষ সেদ্ধ ভাত আর অমলেট খাইয়েই নাকখত দিয়েছিলাম। অমলেটই ছিল রান্না বিষয়ে আমার শ্রেষ্ঠ থিসিস। তোমার মনে আছে ?’

সমাপ্তি হেসে উঠল। সমাপ্তি এখনও হাসছে। নিশ্চয়ই আরও অনেক কথা তার মনে পড়ছে। তার মানে আমি সফল। তাড়িয়ে তাড়িয়ে মুহূর্তগুলোর স্বাদ নিলাম। সারাদিন ধরে স্মৃতির মনোরম এলাকার আনাচকানাচে আমরা হাতে হাত রেখে টহল দিলাম। রাতে খোলা আকাশের ভরাট তারার দিকে তাকিয়ে থাকলাম অনেকক্ষণ। দেখলাম কত শত আলোকবর্ষ দূরের তারাগুলো দেখতে একই রকম আছে। হয়তো বা পৃথিবী থেকে অনেক অনেক দূরে আছে বলেই তারা অক্ষত। ঠিক তখনই সমাপ্তি আমার হাত শক্ত করে ধরে বলল, ‘শোনো দিগন্ত পৃথিবী আবার আগের মতো হবে। এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস। হবেই। মানুষই ফিরিয়ে আনবে আগের পৃথিবী। সুখের পৃথিবী। এমন পৃথিবী যেখানে শিশুরা নিশ্চিন্তে এক্কাদোক্কা কুমিরডাঙা খেলতে পারে। তুমি আবার বিশুদ্ধ বায়ু ফিরে পাবে দিগন্ত। পাবেই। হাল ছেড়ো না।’ তারপর সমাপ্তি আমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ল। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়তে খুব বেশি সময় নিল না। দীর্ঘ সময় ধরে বিনিদ্র রাত কাটানোর পর আমারও দুচোখ ভারী হয়ে ঘুম এল।

ভোরবেলায় উঠে দেখি, সমাপ্তি আর নেই। ঘরের চারপাশেও কোথাও দেখতে পেলাম না তাকে। বুঝলাম সমাপ্তি চলে গিয়েছে। কিন্তু কোথায় গেল ? সে তো বলেছিল, তার আর কোথাও যাওয়ার নেই। তাহলে কি মৃত্যুর শেষ ধাপে… ?

আমার কষ্ট হয়। কষ্টের ওজন ক্রমে বেড়ে গিয়ে আমার দুচোখ ফেটে নোনা জল গড়িয়ে নামে। সমাপ্তিকে আমি কোনওভাবেই হারাতে চাইনি। তাকে ছাড়া আমি বাঁচি কী করে! সমাপ্তি বলেছিল, পৃথিবী নাকি আবার আগের মতো হবে! আমি আবার বিশুদ্ধ বায়ু ফিরে পাব! হাল ছাড়তে নিষেধ করেছিল সে।

আমার ভীষণ ভয় করল। বিশুদ্ধ বায়ুর সংস্পর্শে মৃত্যুভয়। বিশুদ্ধ বায়ুকে আমি সর্বাংশে এড়িয়ে চলি। সমাপ্তির কথায় যে আশা ছিল তা আমার মধ্যেও জারিত হয়েছে। এই নিখাদ আশা আর ঘোর মৃত্যুভয়ের দ্বন্দ্বে আমি ভীষণ আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম। এই আক্রান্ত মন নিয়েই আমি খুঁজে বার করলাম সবুজ গাছগাছালিতে ঢাকা ছোটখাটো এক অরণ্য। অরণ্যের ঠিক মাঝখানটায় এসে যখন দাঁড়ালাম আমার শরীরের রঙ ততক্ষণে বদলাতে শুরু করেছে। বাড়ছিল শরীরের উত্তাপ। আমার শরীর কালচে নীল হয়ে উঠছে দ্রুত গতিতে। শ্বাস বুঝি গলার কাছে এসেই আটকে যাচ্ছে। হাতে আর বেশি সময় নেই। আমি কিন্তু মরতে চাই না। বেবিনামেন পৌঁছালাম খুব দ্রুত। প্রাণভরে শরীরে পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত অঞ্চলের বায়ু নিলাম। তবু আমার শ্বাসকষ্ট কমল না। বুকের ভিতরটা ফাঁকা ফাঁকা ঠেকছে। অগত্যা রাস্তার ম্যানহোলের ঢাকনা খুলে মুখটা আমূল ঢুকিয়ে দিলাম ভিতরে। শ্বাস নিলাম ঘন ঘন। কালচে নীল রঙটা এবার বুঝি কিছুটা হালকা। তবু ফাঁড়া কাটেনি। পুরোনো একটা ম্যাটাডোর গোছের গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল কাছেই। গাড়িটা চালু করতেই পেছনের নল দিয়ে হলহল করে গাঢ় কালো ধোঁয়া বেরিয়ে আসতে লাগল। আমি চটপট নলটাকে মুখের ভিতর পুরে দিলাম একেবারে গলা অব্দি। তারপর হুঁকো যেভাবে টানে ঠিক সেভাবে ঘণ্টা দুয়েক ধরে ধোঁয়ায় ভরিয়ে তুললাম ফুসফুস।

আমার গায়ের রং এখন গোলাপি। নাভির পাশটা কিঞ্চিত লাল। সুস্থ বোধ করছি। শ্বাস-প্রশ্বাস প্রায় স্বাভাবিক। আমি শান্ত হই। আবার ফিরে যাই অরণ্যের কেন্দ্রে। হাল আমি ছাড়িনি সমাপ্তি। কতরকমের সবুজ গাছগুলোর ঘন ডালপালা, পাতা ছুঁয়ে বিশুদ্ধ বায়ু আমার নাকের পাশ দিয়ে বয়ে যায়। যদিও বিপজ্জনক তবু এতক্ষণের মুঠো হওয়া হাত দুটো খুলে এমনভাবে ছড়িয়ে দিই আকাশের দিকে যেন গোটা অরণ্যটাকেই দুহাতে আঁকড়ে ধরতে চাই।

সমস্ত শক্তি দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিই। শরীর ক্রমশ কালচে নীল হয়ে ওঠে। আমি হাল ছাড়ি না। কত লক্ষ জন্মের, কত লক্ষ মৃত্যুর আগের সেই সতেজ চনমনে জীবনে ফিরে যেতে ঝলসে যাওয়া ফুসফুসে ফেলে আসা বিশুদ্ধতা আমি উন্মাদের মতো ভরে নিতে থাকি।

কলকাতা থেকে

সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button