আর্কাইভগল্পপ্রচ্ছদ রচনা

একটা ফড়িং : ফজলুল কবিরী

বিশেষ গল্পসংখ্যা ২০২২ : বাংলাদেশের গল্প

বহদ্দার হাট মোড় থেকে আপনি যদি পতেঙ্গা সি-বিচ অভিমুখে একটি সিএনজি অটোরিকশা ভাড়া করতে চান,  আপনাকে খুব একটা বেগ পেতে হবে না। কিন্তু যদি পাঁচ-সাত কিলোমিটার দূরত্বের আছদগঞ্জ কিংবা খাতুনগঞ্জ যেতে চান, সিএনজিঅলারা আপনার কান গরম করে দেবে সন্দেহ নেই। এই মাথা গরম পরিস্থিতিতেই আমি আচমকা একটি হৃদয়বিদারক দৃশ্য প্রত্যক্ষ করি।

দেখি ফ্লাইওভারের নিচে একটা পথশিশু একটা ফড়িংয়ের লেজে সুতা বেঁধে শূন্যে ছেড়ে দিয়ে মজা পেতে পেতে হঠাৎই ফড়িংয়ের মাথা থেকে লেজ আর পাখনাগুলোসহ বাদবাকি অংশটা একটানে আলাদা করে ফেলে। তারপর পথশিশুটি যাবতীয় উত্তেজনার সমাপ্তি ঘটিয়ে ফড়িংয়ের ছিন্ন অংশ দুটো ব্যস্ত রাস্তার চলন্ত গাড়ির চাকার নিচে চাপা দিয়ে ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যায়। ব্যাপারটা ভয়ংকর। কিন্তু ঘটনাটা এমনভাবে ঘটল যেন নিয়মিতই এরকম কিছু এখানে ঘটে। প্রাথমিক ধাক্কা সামলে নেওয়ার পর অনুভব করলাম, গগনবিদারি চিৎকার ও চ্যাঁচামেচিতে আশেপাশের পথচারিরা এদকি-ওদিক ছুটতে শুরু করেছে। এর বাইরে অন্য কোনও ঘটনাও কি ঘটেছে তবে? আমার মনে হচ্ছিল ফড়িং নয়, যেন ধড় থেকে মুণ্ডু আলাদা হয়ে যাওয়ার পর একটা জলজ্যান্ত মানুষ রাস্তায় পড়ে আছে। আর ঘটনার আকস্মিকতা সামলে নিয়ে আমি মুণ্ডুটার কাছে গিয়ে দাঁড়াই। তারপর জিজ্ঞেস করি, ‘ভাই আপনার কি খুব কষ্ট হচ্ছে?’

লোকটি হাতের ইশারায় পড়ে থাকা মস্তকের দিকে ইঙ্গিত করে। আমি সেদিকে তাকাই। খুব ক্লান্ত কণ্ঠে মুণ্ডুটি আমার প্রশ্নের উত্তর দেয়ার চেষ্টা করে। লোকটির জন্য আমার মায়া হয়। খানিকটা এগিয়ে গিয়ে মুণ্ডুটি দুহাতে তুলে নিই। তারপর পড়ে থাকা শরীরের সাথে ধীরস্থীরভাবে মুণ্ডুটি পুনরায় জোড়া লাগানোর চেষ্টা করি। ঘটনাটি ঘটে নগরীর বহদ্দারহাট মোড় এলাকায়। আমার দিকে কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে একপলক তাকিয়ে ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। আমি সাহায্য করতেই কুণ্ঠিত কণ্ঠে ধন্যবাদ দিয়ে কিছুই হয়নি এমন একটা ভঙ্গিতে রাস্তা পার হয়ে মাংসের দোকানের দিকে অগ্রসর হয়।

ফড়িং নয়, আমি দেখি লেজ আর পাখাবিশিষ্ট একটা জলজ্যান্ত মানুষ ফড়িংয়ের শরীর ফুঁড়ে বেরিয়ে এসে মাংসের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ঝুলতে থাকা মাংসের দরদাম করতে প্রবৃত্ত হয়। ভয়ে ও আতঙ্কে মাংস বিক্রেতা প্রাথমিকভাবে বসা অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়ায়। তারপর ভয় ও আতঙ্ক কাটিয়ে ধীরে ধীরে তার অস্থিরতা খানিকটা কমে। ভয় পেলেও সম্ভাব্য ক্রেতাকে হাতছাড়া করার লোভ সে সামলাতে পারে না।

আমাদের শহরে আর কোনও মশা-মাছিরও মৃত্যু হবে না, মেয়র আ.জ.ম বশিরের এমন একটি অদ্ভুত ঘোষণা আসে দিন কয়েক আগে। এই ঘোষণাকে এতদিন সবাই চটকদার ভোটের বিজ্ঞাপন ভেবে থাকলেও, অনেকেই ফড়িংয়ের এভাবে ছিন্নমস্তকে পড়ে থাকা স্বচক্ষে দেখার পর তার কথার অসাড়তা নিয়ে সন্দেহমুক্ত হয়। এমনকি কেউ কেউ ঘটানাটি উদাহরণ হিসেবে টেনে আনে। একটা ফড়িং কীভাবে মানুষে পরিণত হয়ে সেদিন মুণ্ডুটা শরীরের সাথে পুনরায় জোড়া লাগিয়ে মাংসের দোাকনে গিয়ে মাংস কিনেছিল বিষয়টিও আলোচনা হতে থাকে। ভয় আর শঙ্কাকে উপেক্ষা করে মাংস বিক্রেতা কীভাবে লোকটির সাথে অল্পবিস্তর ঠাট্টা-মশকরাও করেছে, তারও খানিকটা বিবরণ পাওয়া যায়। জানা যায়, ক্লান্ত লোকটি যখন মাংস বিক্রেতার দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় তখন কসাই শামছু প্রাথমিক ধাক্কা সামলিয়ে তার বিশাল চর্বিযুক্ত ভুঁড়িটি লোকটির দিকে ঝুলিয়ে দিয়ে একটা সরস হাসিও উপহার দেয়। তারপর লোহার শক্ত পাতে রশি দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা তাজা মাংসের টুকরাগুলো থেকে গরুর কোনও বিশেষ অঙ্গের মাংসটা লোকটার পছন্দ বিষয়টি জিজ্ঞেস করে। সেই মুহূর্তে ঝুলে থাকা মাংসের টুকরাগুলো থেকে কালেভদ্রে রক্তের ফোঁটা চুঁইয়ে পড়ে। আর সেই দৃশ্য দেখিয়ে কসাই শাসছু মৃত ফড়িং থেকে বেরিয়ে আসা লোকটিকে জানায় তার দোকানে কোনও বাসি মাংস থাকে না এবং শুধু ষাঁড়ই তার পছন্দ। ষাঁড় ব্যতীত এমনকি গাই কিংবা বলদ গরুর মাংসও সে রাখে না। গাইয়ের কারবার তার পছন্দ না। বলদের কারবারও না। তার দোকানের কাস্টমারের জন্য সে বাজারের সেরা মাংসই বরাদ্দ রাখে।

এরপর থেকে প্রতিদিনই তার দোকানে ঝুলতে থাকা মাংসের ফাঁকফোকরে লুকিয়ে থাকা তাজা রক্তের ফোঁটা কাস্টমারকে প্রলুব্ধ করে। তাদের সামনেই কয়েক ফোঁটা চুইয়ে পড়ে। আশপাশের দোকান থেকে তাজা সবজি আর ফরমালিনমুক্ত মাছের চারপাশ ঘিরে ভন ভন করতে থাকা মাছির আওয়াজ ভেসে আসে। চারপাশে বাজারের ফর্দ হাতে নিয়ে মানুষের হুড়োহুড়ি কিংবা দোকানদারদের ব্যস্ততা ক্রমশ বাড়তে থাকে। মানুষের সকল বিশ^াস-অবিশ^াসের মূলে থাকে একটা ফড়িং। শহরের মানুষকে এভাবে বোকা বানানোর ধান্দা কারা করতে পারে তা নিয়ে ফিসফাস চলতে থাকে।

রিকশার যাত্রীরা জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছা ভাই, আসলেই কি মানুষটিকে আপনারা দেখেছেন?’

রিকশার প্যাডেলে গতি দ্বিগুণ করতে উদ্যত রিকশাশ্রমিকেরা পায়ের জোর যেন মুখে এসে থামে, ‘কী যে বলেন ভাই, আমি নিজেই তো খোঁজ নিতে গেছিলাম। কসাই শামছুর লগে দেখাও কইরা আইছি। বেডার কী দেমাগ হইছে এখন। মাটিতে পা পড়ে না। ইউটিবঅলারা রাতদিন হেরে জব্দ কইরা রাখে’।

রিকশারোহী যাত্রীদের অবিশ^াস তবু কাটে না। তাদের অফিসের তাড়া কিংবা বাজারের ব্যাগ নিয়ে ছোটাছুটিতেও ছেদ পড়ে, বিষয়টি নিয়ে গুরুতর সন্দেহ বাড়তে থাকে।

ফড়িংটিকে ঘিরে বহদ্দারহাট মোড়ে ঘটতে থাকা ঘটনাগুলোর মধ্যেই জানা যায় ঠিক যেখানে পথশিশুটি মস্তক থেকে লেজ আর পাখাযুক্ত শরীরটা আলাদা করে ফড়িংটি ছুঁড়ে ফেলেছিল, ঠিক সেখানেই সিটি কর্পোরেশনের লোকেরা মেয়রের নির্দেশে ছিন্ন অংশ দুটো উদ্ধার করতে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে। যদিও ঘটনার পর পাশের কর্ণফুলী নদীর জল বহুদূর পর্যন্ত গড়িয়ে গেলেও কীভাবে ফড়িংটি ওখান থেকে উদ্ধার করা হবে তা নিয়ে একপক্ষের সন্দেহ ও অবিশ^াস কমানো যায়নি। কিন্তু ফড়িংটিকে ঠিকই উদ্ধার করা হয় এবং শোকাহত পরিবেশে দাফনের জন্য তোড়জোড় শুরু হয়। মানুষের ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে ফড়িঙটিকে যথাযথ জানাজা শেষে কবরস্থ করার ঘোষণা দেওয়া হয়। ফড়িংটির শরীর থেকে যে মানুষটি বেরিয়ে এসে মাংসের দোকানে দাঁড়িয়ে কসাই শাসছুর দোকান থেকে মাংস কিনেছিল, তাকে জানাজায় দেখা যায় না। কিংবা জানাজায় তাকে দেখা গেলেও কেউ হয়তো তাকে চিনতে পারে না।

যে লোকটি সেদিন বহদ্দার হাট মোড় থেকে পতেঙ্গা সি-বিচ অভিমুখে একটি সিএনজি অটোরিকশা ভাড়া নিয়ে দরকষাকষি করতে করতে আমার সাথে চোখাচোখি হয়েছিল কিংবা, অপর যে লোকটি পাঁচ-সাত কিলোমিটার দূরত্বের আছদগঞ্জ কিংবা খাতুনগঞ্জ অভিমুখে সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে যাত্রা করতে করতে আমাকে দেখেছিল তাদেরও কেউ সম্ভবত ফড়িংয়ের শরীর ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা লোকটিকে সনাক্ত করতে পারবে না।

যারা সেদিনের ঘটনাটির প্রত্যক্ষদর্শী, তাদের বর্ণনায় সাধারণ মানুষের মনে নিশ্চিত বিশ^াস জন্মেছে যে, ফড়িংটি আদতে ফড়িং নয়।

ফড়িংটি শেষপর্যন্ত ছিন্ন মস্তকে মানুষের গোলকধাঁধার বিষয় হয়ে সিটি কর্পোরেশনের নির্ধারিত কবরস্থানে শায়িত হয়।

ঢাকা থেকে

সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button