আর্কাইভগল্পপ্রচ্ছদ রচনা

উৎসমূলের আগুন : মঞ্জু সরকার

বিশেষ গল্পসংখ্যা ২০২২ : বাংলাদেশের গল্প

এরিনা তার পিতৃসম ফেসবুক বন্ধু উমর আলিকে নিয়ে এই প্রথম একটি স্ট্যাটাস দিয়েছে। শিরোনামে লিখেছে ‘এক বাংলাদেশি পশুর গল্প’। এটা যে নিছক গল্প নয়, শতভাগ সত্য ঘটনা, তার জ¦লজ্যান্ত প্রমাণ : পোস্টে পশু হিসেবে উমর আলির মুখ এবং তার ফেসবুক আইডির লিংকও রয়েছে। পোস্টটি পড়ে নিজের ছবির দিকে তাকিয়ে উমর আলি যেন আজ নিজেকেও চিনতে পারে না। নারীমাংস লোভী এক হিংস্র জন্তুকে দেখে। উপরে পোস্টদাতা এরিনার ছবিতে এতদিন যে চেনা যুবতী নারীমুখ রেড ওয়াইন পানের নেশা জাগাত, আজ তাকে প্রতিহিংসা-পরায়ণ খড়গহস্ত এক ভয়ংকর দেবী মনে হয়। কিন্তু এ যে উমর আলির দেখার ভুল কি ভাবের বিভ্রম নয়, সে জন্য পোস্টটির সঙ্গে প্রকৃত বাস্তবের মিল-অমিল খোঁজে সে সিগারেটের পর্যাপ্ত ধোঁয়ায়।

জন্মসূত্রে আমেরিকান যুবতী যখন বাংলাদেশে প্রথম বেড়াতে আসে, তখন সে ছিল ১১ বছরের কিশোরী। এখন তার বয়স প্রায় একত্রিশ। জীবনে একবারই মাত্র মাস দেড়েকের জন্য মাতৃভূমি বাংলাদেশে বেড়াতে এসেছিল সে। মা ও নানির সঙ্গে পারিবারিক বন্ধু উমর আলির বাসায় বেড়াতে আসার স্মৃতি মনে থাকাটা স্বাভাবিক। মাত্র বছর তিনেক আগে অনলাইনে উমর আলিকে খুঁজে ক্যান্সারাক্রান্ত মায়ের মৃত্যুসংবাদটি জানিয়েছে সে। এরপর পারস্পরিক বর্তমান হালচাল জানা ও ফেসবুকে বন্ধুত্ব হবার পর উমর আলি অসংখ্যবার এরিনার প্রোফাইলে ঢুকে তার সমস্ত ছবি ও পোস্ট আঁতিপাতি দেখেছে। উমর নিজে যেমন, তেমনি এরিনাও ফেসবুকে কোনও ফেক আইডি নয়। বরং তার নিজের মতো শতভাগ সত্যনিষ্ঠ মনে হয়েছে মেয়েটিকে। নিজের একান্ন বছর বয়সে দেখা ১১ বছরের কিশোরী দুই দশকে আমেরিকান জীবনধারায় কী রকম স্বাধীন ও স্বাবলম্বী এক নারীতে পরিণত হয়েছে, ইন্টারনেটে দেখাশোনার কল্যাণে অনেকটা নির্ভুল আন্দাজ করতে পারে উমর আলি। নবীন যৌবনে ঘনিষ্ঠভাবে চেনা তার মায়ের সঙ্গে মিল-অমিল খুঁজতেও অনলাইনে যত দেখেছে ও চিনেছে এরিনাকে, ততই মুগ্ধতা বোধ বেড়েছে উমর আলির। মাতৃহারা এরিনার প্রতি শোক-সহানুভূতি, স্নেহ, মায়া-মমতা, মুগ্ধ ও বিস্ময়-বিহ্বল মনের আকর্ষণ এবং পিতৃসুলভ দায়িত্ববোধ ইত্যাকার আবেগ-অনুভূতিও উথলে উঠেছে। বলা যায় অবসর জীবনের শেষ বয়সে ইন্টারনেটের অসীম শূন্যতায় ঝুলে থাকার মূলে এরিনা তার প্রধান অবলম্বন। বাংলাদেশের গ্রামীণ প্রকৃতিতে রাতের আকাশে পূর্ণিমার চাঁদের মতোই ভালোবাসার আকর্ষণও বটে।

এরিনার মা বাংলাদেশি-আমেরিকান হলেও বাবা জার্মান। মায়ের মৃত্যুর আগেই ডির্ভোস হয় তাদের। বাবা যেহেতু অন্যত্র বিয়ে করেছে, মায়ের সঙ্গেই ছিল এরিনা। মা বাংলাদেশি বলে কেউ তাকে বাংলাদেশি-আমেরিকান বলে কি না কিংবা নিজেকেও সে রকম সে ভাবে কি না, উমর নিশ্চিত নয়। সে কিছু বাংলা বলতে পারে। কিন্তু লিখতে ও পড়তে পারে না একদম। ইংরেজিতে পোস্ট দেয়। তবে পিতৃভাষা জার্মানও জানে। ফেসবুক প্রোফাইলে নিজের সম্পর্কে যেসব তথ্য ও ছবি দিয়েছে এরিনা সেসব ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে ইংরেজিতে লেখা তার স্ট্যাটাসগুলো পড়ার জন্য এরিনার ফেসবুক পাতা প্রিয় ই-বুকের মতো খুলে পড়েছে। অধিকাংশ পোস্টই সামাজিক বা আন্তর্জাতিক কোনও বিষয়ে নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। উমর আলি ও বাংলাদেশ বিষয়ক পোস্টটির আগের পোস্টটি ছিল আমেরিকায় মেয়েদের অ্যাবোরশন-অধিকার হরণের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ। প্রতিটি স্ট্যাটাসে পাওয়া তার বন্ধুদের প্রতিক্রিয়াও পড়েছে উমর। নিজেও এরিনার বেশকিছু নারীবাদী স্ট্যাটাসে লাইক দেওয়া ছাড়াও সহমত পোষণ করে মন্তব্য করেছে। এরিনাও পছন্দ করেছে আলি আংকেলের সমর্থন। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ^বিদ্যালয় থেকে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছে সে। মায়ের মৃত্যুর পর চাকরি করছে এখন বিশ^খ্যাত গুগল কোম্পানিতে। বিয়ে করেনি এখনও। তবে একা ঠিক নয়, বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে লিভ-টুগেদার করছে। নিজেই গাড়ি চালিয়ে অফিস করে, উইক-এন্ডে বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে লংড্রাইভে বা প্লেনে কোথাও বেড়াতে যায়। আটলান্টাবাসী বাবার সঙ্গে দেখা হয় কালেভদ্রে। ইন্টারনেট দুনিয়া সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ এরিনা তিন বছর আগে উমর আলিকে খুঁজে বের করার পর মায়ের পুরোনো বন্ধুকে নিজেরও বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাসংকোচ দেখায়নি। উমর আলি কিছু জানতে চাইলে ব্যস্ততার মাঝেও সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়েছে এরিনা। অন্যদিকে উমর আলির পক্ষে নিজের প্রথম প্রেমিকার সন্তান, বাবা থাকতেও পিতৃছায়া নেই মাথার উপরে, সর্বোপরি সদ্য মাতৃহারা মেয়েটার প্রতি নিজের সন্তানের মতো বাৎসল্যবোধ জাগাটা স্বাভাবিক। এরিনার জন্মতারিখ ৭ ডিসেম্বর মুখস্থ হয়েছে উমরের। গত তিন বছর ধরে দিনটিতে এরিনাকে হেপিবার্থডে উইশ করেছে। টেকস্ট বিনিময় ছাড়াও বেশ কয়েকবার ইন্টারনেট ফোন ও ভিডিও কলে মুখোমুখি দেখা এবং অন্তরঙ্গ কথাবার্তা হয়েছে তাদের। কিশোরী বয়সে যেমন, তেমনি এখনও আলি আংকেলের সঙ্গে ভাঙা বাংলায় কথা বলে এরিনা। উমর আলির বাংলাও বুঝতে পারে। বুঝতে না পারলে ইংরেজিতেই ব্যাখা দেয় উমর। গত তিন বছরে এরিনার জন্য মনে পুঞ্জিভূত ইতিবাচক আবেগ-অনুভূতির মাঝে বিন্দুমাত্র খাদ ছিল না তার। অন্যদিকে উমরকে আবিষ্কার ও অনলাইন সম্পর্ক বজায়ের মূলে যে এরিনার মনে গভীর ষড়যন্ত্র, ঘৃণা ও প্রতিহিংসায় গড়া একটি ইলেকট্রনিক বোমা লুকিয়ে ছিল, তা আজকের পোস্টে বিস্ফোরিত হওয়ার আগে আন্দাজ করতে পারেনি উমর। তাকে ঘিরে এরিনার সচিত্র ও নির্ভুল তথ্য সম্বলিত স্ট্যাটাসটি নিজের টাইমলাইনে সেভ করে অনেকবার পড়েও যেন তার অবিশ^াস ও বিস্ময়ের ঘোর কাটতে চায় না।

দুই

স্টোরি অব এ বাংলাদেশি বিস্ট শিরোনামে এরিনা এক শত উনিশ শব্দের পোস্টে যা লিখেছে, তার সোজাসাপ্টা মানে দাঁড়ায়, উমর আলি নামক সত্তরোর্ধ এই রিটায়ার্ড বাংলাদেশি সচিব এক ছদ্মবেশী পশু। লোকটা তার মাকে ভালোবাসার নামে প্রতারিত এবং ধর্ষণ করেছিল। তার মা আমেরিকায় সেটেল্ড হওয়ার পরও উমর তার সঙ্গে পত্রযোগাযোগ অব্যাহত রেখেছিল। সেসব চিঠির একটাই উদ্দেশ্য ছিল আমেরিকায় এসেই হোক বা বাংলাদেশে, নিজের পারিবারিক জীবন ও সরকারি চাকরি নিরাপদ রেখে মাকে আবারও ধর্ষণ করা। ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চে জন্মভূমি বাংলাদেশে বেড়াতে গিয়েছিল তার মা। সঙ্গে ছিল একমাত্র কন্যা ১১ বছরের এরিনা। পুরানো বন্ধুর আমন্ত্রণে একদিন তার পারিবারিক পার্টিতে সপরিবার যোগ দিয়েছিল। উমর আলি নিজের মতলব গোপন রেখে মিথ্যে সম্পর্কের পরিচয় দিয়েছিল নিজ পরিবারের সবার কাছে। বাসায় পুরানো গার্লফ্রেন্ডকে একান্তে কাছে না পেলেও, সবাইকে আড়াল করে এরিনাকে আদর করতে একটা ফাঁকা ঘরে টেনে নিয়েছিল। এরিনাকে জড়িয়ে তার ঠোঁটে দুর্গন্ধময় চুম্বন করেছে, এরিনার কচি বুক ডলে দিয়েছে এবং কোলে বসিয়ে ধর্ষকামী অঙ্গের প্রহারও দিয়েছে। বিষয়টি সে মাকে বলেছিল। তার মা মৃত্যুর আগে, ক্যানসারের চেয়েও তার জীবনের মারাত্মক ক্ষত-স্মৃতি, পুরানো এই বয়ফ্রেন্ডের আসল পরিচয়টা প্রকাশ করেছিল বেদনার সঙ্গে।

এরিনার পোস্ট এখানে শেষ হলেও ভয়ের কিছু ছিল না। ফেসবুকে ছড়ানো হাজারো মিথ্যে গল্প-গুজবের মতো অবিশ^াস্য কি ফালতু নারীবাদী আত্মপ্রচার বলে উড়িয়ে দেয়া যেত। কিন্তু ধর্ষণ ও অ্যাবিউজের অভিযোগ উত্থাপনের পর পোস্টের শেষ অংশে ফেমিনিস্ট ও স্যোসাল অ্যাকটিভিস্ট এরিনা তার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। মায়ের মৃত্যুর পর উমর আলির বাংলায় লেখা কিছু চিঠি উদ্ধার করেছে সে। বাংলা জানা এক বন্ধুকে দিয়ে পড়িয়ে লোকটার ধর্ষকামী চরিত্র সম্পর্কে নিশ্চিত প্রমাণও পেয়েছে। অতপর ফেসবুকে তাকে খুঁজে পাওয়ার পর, একদা বাসায় ১১ বছরের এরিনার উপর অ্যাবিউজের স্বীকারোক্তিও আদায় করেছে। পৌঢ় বয়সেও তার ধর্ষকামী চারিত্রিক বিকৃতি অনলাইন যোগাযোগেও প্রমাণিত। বাংলাদেশের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে লিঙ্গ বৈষম্য, ঘরে-বাইরে মেয়েদের উপর নির্যাতন, যৌনহয়রানি ও ধর্ষণের ঘটনা প্রায়ই ঘটে বলে মিডিয়ায় খবর আসে। কিশোরী এরিনা বাংলাদেশে দেড় মাসের অবস্থানকালে ঘরে-বাইরে জনবহুল দেশটায় উমর আলির মতো ছদ্মবেশী বেশকিছু পশুর চোরাগুপ্তা আক্রমণের শিকার হয়েছে এরিনা। সুযোগ পেলেই এরিনার শরীরে থাবা বসানো ছাড়াও চোখের নজর ও মুখের ভাষাতেও হিংস্র পশু-পরিচয়টি পষ্ট করে তুলেছিল তারা। বর্তমানে নারী নেতৃত্বে উন্নয়নশীল মুসলিম দেশটায় নারী নির্যাতন বিরোধী আইন এবং বিশেষ বিচার ব্যবস্থাও চালু হয়েছে। কিন্তু উমর আলির মতো সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত হিপোক্র্যাট তথা ছদ্মবেশী জানোয়ারগুলোর মুখোশ উন্মোচন ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে সে দেশে সত্যিকার নারীপ্রগতি ঘটবে না। এতদিন বিচার হয়নি বলেই নাবালিকা এরিনা ও তার মায়ের মতো আরও বহু মেয়েকে ধর্ষণ-নির্যাতন করার পরও বাংলাদেশ সরকারের একজন শীর্ষ নির্বাহী কর্মকর্তা হতে পেরেছিল সে। এ কারণেই এরিনা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, শিগগির বাংলাদেশে গিয়ে উমর আলির বিরুদ্ধে মামলা করে বিশে^র নারীমুক্তি আন্দোলনে সামান্য হলেও কিছুটা অবদান রাখবে।

এরিনার পোস্টটি উমর আলি নিজের ওয়ালে দেখার আগে তাতে লাইক পড়েছে ৩৫৩টি, মন্তব্য করেছে ৭৭ জন ও শেয়ার করেছে ৩ জন। এছাড়াও অললাইন বিশেষজ্ঞ এরিনার মি টু#, টুইটার, ইনস্টগ্রাম ইত্যাদি একাউন্টেও তার এ পোস্ট নিয়ে ঝড় ওঠা স্বাভাবিক। আতঙ্ক-উত্তেজনায় দিশেহারা উমর আলি ফেসবুকে তার সম্পর্কে এরিনার বন্ধুদের মন্তব্যগুলোও পড়তে শুরু করে।

অধিকাংশ বন্ধুই এরিনাকে সহানুভূতি ও তার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। সম্পূরক মন্তব্য করেছে অনেকে। জেমস গিলবার্ট নামে একজন লিখেছে, ‘খোদ আমেরিকাতেই প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে হলিউড মাস্তানরা অ্যাবিউজের কেসে সমালোচিত হচ্ছে। বাংলাদেশের মতো দুর্বল গণতন্ত্র ও ধর্মান্ধ মানুষের সমাজে ক্ষমতাবান পুরুষদের পক্ষে দুর্নীতি করা যেমন সহজ, তেমনি নারী নির্যাতনের ব্যক্তিগত হেরেম থাকাও স্বাভাবিক। প্রতিবাদ হিসেবে তোমার মামলা করার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই।’ লিজা আন্ডারসন নামে একজন লিখেছে, ‘তোমার মা হয়তো ঐ লম্পটের কারণেই মাতৃভূমি ছেড়েছিল এবং দেশি পুরুষদের ঘৃণা করেই ইউরোপীয় একজনকে বিয়ে করেছিল।’ এই মন্তব্যের নিচেই ডলি নাবাসসুম নামে এক বান্ধবীর মন্তব্য, ‘আমার মনে হয় তোমার মা লোকটাকে সত্যিই ভালোবেসেছিল এরিনা। আর তাই চিঠিগুলো রক্ষা করেছিল আমৃত্যু এবং বেঁচে থাকতে প্রতিশোধ গ্রহণের কথা ভাবেনি। সে যেহেতু মৃতা, তুমি তোমার যৌন-হয়রানির প্রতিবাদ অবশ্যই করবে।’ ক্যাথেরিন ক্যালি নামে একজনের মন্তব্য, ‘সব দেশেই একই চিত্র। মেয়েরা বয়ঃসন্ধিক্ষণে তাদের নিকট আত্মীয়-পুরুষদের দ্বারাই এমন অবিস্মরণীয় ক্ষত ও ক্ষতির শিকার হয়ে থাকে। আমিও হয়েছি।’ আবিদ রহমান নামে একজন বাংলাদেশ ও ইন্ডিয়ায় গণপরিবহনে দুটি সাম্প্রতিক গণধর্ষণ ঘটনার কথা উল্লেখ করে বলেছে, ‘মুসলিম দেশগুলোতে বাসার মেইড সার্ভেন্টসদের উপর যে যৌননির্যাতন ঘটে, তার খুব সামান্যই আমরা জানতে পারি।’ এরিনার মুসলিম বন্ধুটির নাম ও ছবি দেখে উমর আলি বুঝতে পারে না, সে বাংলাদেশি না মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম।

বয়োজ্যেষ্ঠ আলি আংকেল ছাড়াও এরিনার বাংলাদেশি-আমেরিকান বন্ধু থাকা স্বাভাবিক। যে বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে লিভটুগেদার করছে, সেও বাংলাদেশি হতে পারে। এ ছাড়া বন্ধুত্ব রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করার সময়ে উমর দেখেছিল তাদের মিউচুয়াল বন্ধু সংখ্যাা তিন। কাজেই এরিনার বন্ধুদেরও কেউ কেউ উমর আলিকে চেনে নিশ্চিত। দেশে তাকে আরও ব্যাপকভাবে চিনিয়ে দেয়ার জন্য এরিনার পোস্টটি তাদের কেউ শেয়ারও করেছে হয়তোবা। তার মানে এরিনার পোস্ট ভাইরাল হয়ে উঠলে বাংলেদেশি এক পশুকে দেখার জন্য তার ফেসবুক পেজে কোরবানির হাট বসেছে এতক্ষণে।

উমর আলি অবসর জীবনে স্যোসাল মিডিয়া বা নিউজ মিডিয়ায় এভাবে বিখ্যাত-কুখ্যাত হওয়ার কথা স্বপ্নেও ভাবেনি। ভাইরাল হওয়ার বাসনা দূরে থাক, সীমিত বন্ধুদের লাইক-সহানুভূতি পেতে ব্যক্তিজীবন নিয়ে ফেসবুকে কোনও পোস্ট দেয়নি। আজ ফেসবুক খুলে এরিনার পোস্টে নিজেকে দেখে ভিতরে যে তুমুল প্রতিক্রিয়া ঘটে, তাতে এটাকে অবাঞ্ছিত সাইবার অ্যাটাক, নাকি হার্ট অ্যাটাকের পূর্বলক্ষণ বলবে ? হার্ট অ্যাটাকের কথা ভাবতেই বুকের বাদিকটায় ব্যথা ঝিলিক দেয় যেন। আজ বড় বেশি সিগারেট টেনেছে। প্রেসার বেড়েছে অবশ্যই। উমর তার ল্যাপটপের স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বিছানায় লম্বা হয়ে শোয়। এরিনা ও তার পোস্টসহ ভার্চুয়াল জগতকে দুঃস্বপ্নের মতো মিথ্যে ভাবার জন্য চোখ বুজে নিজের বাস্তব জীবন ও জগতের কথা ভাবে।

তিন

সরকারের একজন সিনিয়র ও ব্যস্ত সচিব হিসেবে ফেসবুক বা ইন্টারনেটের অনন্ত জগতে ভ্রমণের অবকাশ ছিল না। সময়ও পায়নি উমর আলি। ফেসবুকে সরকারের নীতি বিরোধী ও চাকরিবিধির শৃঙ্খলা পরিপন্থি স্ট্যাটাস দেয়ার কারণে কয়েকজন কর্মকর্তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়েছে। উমর আলি সরকারে থাকা অবস্থায় যদি ফেসবুকে সক্রিয় থাকত এবং তার বিরুদ্ধে এরিনার এই অভিযোগটি প্রকাশ পেত, তাহলে এতক্ষণে এটা দেশের প্রশাসন তো বটেই, আন্তর্জাতিক মিডিয়াতেও হইচই শুরু হয়ে যেত সন্দেহ নেই। একইসঙ্গে অবাঞ্ছিত এই আক্রমণকে উদ্দেশ্যমূলক ও অসত্য আখ্যা দিয়ে আত্মরক্ষার জন্য সরকারি ক্ষমতার সহায়তা পেত নানাদিক থেকেই। কিন্তু অবসর গ্রহণের পর উমর আলির ক্ষমতার দৌড় যেমন কমেছে, বাস্তব জগতটাও হয়েছে সংকুচিত। মন্ত্রণালয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে চব্বিশ ঘণ্টার জন্য সরকারি গাড়ি-বাড়ি ও দেশজুড়ে হুকুম-তাবেদার সহকারী ছিল সহস্রাাধিক। এখন পনেরশ বর্গফুটের অ্যাপার্টমেন্টে একমাত্র সার্বক্ষণিক কর্মচারী ড্রাইভার ও বাসায় দুজন কাজের লোক। বাসায় স্থায়ী বাসিন্দা স্বামী-স্ত্রী দুজন মাত্র। ছেলেমেয়ে দুটি, দুজনই আমেরিকা ও ইউরোপে নিজস্ব সংসারে সুপ্রতিষ্ঠিত। সারাজীবন সরকারি গোলামি করে সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত করা ছাড়াও উমর আলি দেশে যতটা অর্থসম্পদ সঞ্চয় করেছে, তা বয়স্ক দুজন মানুষের সুখে-সচ্ছলতায় চলার জন্য যথেষ্ট। কাজেই রিটায়ারমেন্ট তথা সরকারি ক্ষমতার মধু থেকে বঞ্চিত হওয়াটাকে এতদিন বড় কোনও ক্ষতি মনে করেনি উমর আলি। সচিব হিসেবে শীর্ষক্ষমতার নেকনজর কিংবা অধঃস্তনদের আনুগত্য ও ভয়-ভক্তিকে কখনওই জীবনের বড় প্রাপ্তি ভাবেনি। অবসরের পর আমলারা অনেকেই ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক দল ও প্রভাবশালী নেতাদের টাচে থাকার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। কেউবা মিডিয়া-টকশোতে দেশ ও জনগণের জন্য উদার প্রেম ও সঠিক দিকনির্দেশনা দান করে খ্যাতি বাড়াতে চায়। উমর আলির ঘনিষ্ঠ ব্যাচমেট প্রধানমন্ত্রীর মূখ্যসচিব হিসেবে অবসর নেয়ার পরও নেতার দলীয় পারপার্স সার্ভ করার জন্য একটি প্রোজেক্ট কো-অর্ডিনেটর পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছে। ঘনিষ্ঠ বন্ধু উমরকেও সে পাশে পেতে চেয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতার মধুর লোভে রাজনৈতিক ক্ষমতার দাসত্ব কি জনগণের তাবেদারি করার একটুও ইচ্ছে জাগে না। আবারও দাসত্বের শিকলে বাঁধা পড়ার চেয়ে নিজের ফ্ল্যাটে স্বাধীন একাকিত্বই শ্রেয় মনে হয় তার। তবে বাসায় একঘেয়ে একাকিত্ব শরীর ও মনের জন্য ক্ষতিকর ভেবে নিয়ম করে লেকের ধারে দুবেলা হাঁটতে যায় উমর। এছাড়া বন্ধুদের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে বিভিন্ন পার্টি ও ক্লাবের সামাজিকতা, টুকটাক কেনাকাটা করতে সুপারমার্কেটে, কখনওবা অপ্রয়োজনেও বিভিন্ন শপিংমল ও নগরীর সীমানা ছাড়ানো গন্তব্যে গাড়িতে ঘুরে বেড়ায়। এভাবে জনারণ্যে চলাফেরার মধ্য দিয়ে প্রতিদিন যত চেনামুখ কি একদম অচেনা মানুষের সঙ্গে সামাজিকতা, তা কোনওরকম আবেগজাত সংযোগ ঘটায় না। অন্যদিকে একা ঘরে বসে রোজ মিডিয়ায় দেখা নেতা ও দেশের দৈনন্দিন হালচাল, তাও কখনওই দেশবাসীর সঙ্গে মিলেমিশে বাঁচার আনন্দবোধ জাগায় না। বরং ঘরে একা থাকলে যেমন, বাইরের দূষিত পরিবেশ ও ভিড়ের কোলাহলেও উমর আলির একাকিত্ববোধ, অল্প-বিস্তর বিরক্তি, রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা ইত্যাদি নেতিবাচক আবেগ-অনুভূতি প্রবল হয়ে উঠতে চায়। এ কারণে বাইরে বেরুলে, রাস্তার ট্রাফিকজ্যাম মোকাবেলা করে গন্তব্যে পৌঁছানোর দায়িত্ব ড্রাইভারের উপর ছেড়ে দিয়ে নিজে চোখকান বুজে সাধারণত মেডিটেশনে বসে আপনমনে একা থাকতেই পছন্দ করে উমর। ড্রাইভার ছেলেটি তার স্যার সম্পর্কে বিল্ডিংয়ের অন্য ড্রাইভার-দারোয়ানদের বলছিল সেদিন, ‘রাস্তায় গ্য্যাঞ্জাম আর জ্যাম দেইখা আমার স্যারে কুনোসমে রা করে না। গাড়িতে চক্ষু বুইজা ঘুমায় যায়। এমন শান্ত ধৈর্যের মানুষ আমি জীবনেও আর দেখি নাই।’

চাকরিজীবনেও উমর আলি ঊর্ধ্বতন ও অধঃস্তন কর্মকর্তাদের কাছে আন্তরিক প্রশংসা-স্বীকৃতি কম পায়নি। একসেপশনাল অ্যান্ড অনেষ্টÑস্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও একবার বলেছিল তার সম্পর্কে। কে জানে উমর এ সমাজে সত্যই ব্যতিক্রমী একজন কি না। তবে প্রশংসা কিংবা নিন্দা যে যাই করুক, অবসর-জীবনে বাইরের বিরক্তকর বাস্তবতা থেকে পালিয়ে ঘরে বসে নিজস্ব জগতেই মুক্তি ও আনন্দ  খোঁজে সে। নিজস্ব জগতটি তার পনেরশ বর্গফুটের চার রুমের ফ্ল্যাটে সীমাবদ্ধ নয় অবশ্যই। বাসায় অনেকগুলো জানালা এবং তিনটি বারান্দা-ব্যালকনি আছে বটে, সেসব ব্যবহার করে বাইরের বিরক্তকর বাস্তবের সঙ্গে সংযোগ ঘটায় না উমর। হাতের স্মার্টফোন, টিভি ও কম্পিউটার স্ক্রিনই এখন তার বদ্ধ জীবনের প্রকৃত জানালা, যে জানালাপথে তার নিজস্ব জগতের সীমা অসীমের পথে লীন হয়ে যেতে চায়। এসব ইলেকট্রনিক জানালা পথে দেখা অসম্ভব গতিশীল, উদ্ভট ও অবাস্তব জগতটাই মনে হয় তার আসল জগত। এখানে প্রবাসী আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে অতীতের পরিচিত বন্ধুবান্ধবদের অনেকের কাছে তড়িৎ গতিতে পৌঁছানো যেমন সহজ, তেমনি বিশ^খ্যাত সব ভিআইপি থেকে শুরু করে বিশ^বাসীর টাচে থাকাও সম্ভব। তারপরও যে নিঃসঙ্গ ব্যক্তিহৃয়ের অপূরণীয় তৃষ্ণা, তা হারানো প্রেম মহুয়ার স্মৃতিসূত্রে তার কন্যা এনিরার সঙ্গে ভার্চুয়াল সংযোগ অনেকটাই পূরণ করে। কখনওবা মনে হয়, গুগলের এরিনাই তাকে রোবটের মতো ইন্টারনেটের অসীম জগতের পাহারাদার ও ফেসবুকের বাসিন্দা বানিয়ে রেখছে। নিজস্ব ভার্চুয়াল জগতের নেশা ও এরিনার বন্ধুত্ব নিয়ে বেশ তো সময় কাটছিল নিঃসঙ্গ রিটায়ার্ড ব্যুরোক্র্যাট উমর আলির। হঠাৎ অতীতের ধর্ষণ-অ্যাবিউজের অভিযোগ তুলে তাকে দেশের আইন-আদালতের আসামি বানানো ও জেলখানায় ঢোকানোর ষড়যন্ত্রটা আসছে কোত্থেকে ? ঝানু গোয়েন্দার মতো প্রশ্নটার সদুত্তর খুঁজে পেতে চায় উমর আলি।

চার

চাকরি থেকে অবসর নিয়ে মাত্র বছর পাঁচেক আগে ফেসবুক একাউন্টটি খুলেছে উমর আলি। একাউন্ট খুলতে নিজের পরিচয় সম্পর্কে যেসব তথ্য ও ছবি দিয়েছে, তার সবই শতভাগ সত্য। ইচ্ছে করলে যুবা বয়সের আকর্ষণীয় ছবি দেওয়া যেত। যেসব ছবি ও তথ্য সরকারি চাকরি, বিয়ে ও নানাবিধ বৈধ সুযোগ-সুবিধা অর্জনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছিল, তেমন ছবির অভাব ছিল না অ্যালবামে ও ল্যাপটপ ফোল্ডারেও। কিন্তু ফেসবুকে বৈধ কী অবৈধ কোনও সুযোগ-সুবিধা লাভের ধান্ধা ছিল না। হারানো প্রেম খুঁজে পাওয়া কিংবা বিশেষ কারও সঙ্গে গোপন কি গভীর সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার বাসনা থেকে নয়, নিছক সময় কাটানোর জন্য একাউন্টটি খুলেছিল সে। ভালোবাসার তৃষ্ণা নিবারণ কিংবা কামপ্রবৃত্তির বিকৃত প্রকাশ ঘটিয়ে পশু উপাধির মতো তীব্র ঘৃণা অর্জনের কথা কল্পনাও করেনি কখনও।

সরকারি চাকুরে পিতা একটা নীতিবাক্য সব সময় স্মরণ করিয়ে দিত। অনেস্টি ইজ দি বেস্ট পলিসি। নিজের সরকারি চাকরিজীবনে উমর আলি নীতিটার মর্যাদা রাখতে পারেনি সর্বদা। কিন্তু চাকরিবিধির শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার পর নিজেকে স্বাধীন ও সত্যনিষ্ঠ রাখার ক্ষেত্রে কোনও বাধা কিংবা ভয় ছিল না আর। ফেসবুকে তাই বর্তমান পেশা হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের অবসরপ্রাপ্ত সচিব ও সাম্প্রতিক পাকাচুল ও আধা-টাকওয়ালা ছবি দিয়েছে। অতীতের চাকরিগত পেশা, শিক্ষা, বর্তমান ঠিকানা, ফোন নাম্বার, কোনওটাই ভূয়া ছিল না। ইচ্ছে করলে প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টসহ দেশ-বিদেশের বহু ভিআইপির সঙ্গে নানা উপলক্ষে তোলা ছবিগুলি দিয়ে ফেসবুকে নিজের অতীত কীর্তিকলাপ প্রচার করতে পারত। কিন্তু আত্মপ্রচারমূলক তেমন স্ট্যাটাস একটাও দেয়নি উমর আলি। প্রোফাইল পিকচারে ছেলে ও মেয়ের পক্ষের শিশু নাতি-নাতনিসহ সস্ত্রীক পারিবারিক ছবি দিয়েছে। প্রবাসী সন্তান, বেশকিছু আত্মীয়-স্বজন, পুরোনো সহকর্মী ও চেনা-অচেনা অনেকেই আছে বন্ধু তালিকায়। নিজের প্রোফাইল লক করে রাখার প্রয়োজন বোধ করেনি।

বন্ধু তালিকায় ক্যালিফোর্নিয়ার কন্যাবয়সি এরিনা ফেসবুকে কবে থেকে এবং কীভাবে তার বন্ধু হলো, তাদের বন্ধুত্বের স্বরূপ, অনলাইন লেনদেন কিংবা প্রচ্ছন্ন মতলব কি ছিল আসলে, ডিজিটাল গোয়েন্দারা সহজেই খুঁজে বের করতে পারবে। কারণ অভিযোগনামায় এরিনার দেয়া অনেক তথ্যই অস্বীকার করতে পারবে না উমর আলিও। বিশেষ করে মায়ের সঙ্গে তার বাংলাদেশে আসা এবং উমর আলির বাসায় আমন্ত্রিত হওয়ার সময়টাও নির্ভুল। উমরের স্ত্রী-সন্তানরাও সাক্ষী দেবে। বাসায় মাত্র একদিন দেখলেও এখনও নিশ্চয় তারা ভোলেনি রহস্যময় আমেরিকান মেহমানদের। উমর আলির ছেলেও যেহেতু এখন আমেরিকায় থিতু হয়েছে, কী প্রসঙ্গে যেন চার/পাঁচ বছর আগেও এরিনা ও তার মা মহুয়ার কথা উঠেছিল। এরিনা তখনও ফেসবুক বন্ধু হয়ে ওঠেনি বলে উমর আলি সঠিক জবাব দিতে পারেনি। কিন্তু একবার মাত্র সাক্ষাৎ-অনুষ্ঠানের প্রায় বিশ বছর পরে, মাত্র তিন-চার বছরের ফেসবুক বন্ধুত্বকে ভিত্তি করে উমর আলিকে পশু প্রমাণের জন্য কিশোরী এরিনার প্রতি তার পাশবিক কাম এবং তার মৃত মা মহুয়ার সঙ্গে উমরের গোপন প্রেম, প্রতারণা ও ধর্ষণের অভিযোগ কি প্রমাণ করতে পারবে সে ?

এরিনা পোস্টে তার মায়ের নাম বলেনি, তবে উমর আলিকে তার মায়ের পুরোনো বন্ধু হিসেবে উল্লেখ করেছে। নতুন করে অনলাইন যোগাযোগর পর এরিনা নিজেও তো বিয়ের আগে তার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে লিভ টুগেদার করার কথা জানিয়েছিল উমরকে। সেখানে ধর্ষণের প্রশ্ন ওঠে না কিন্তু উমর তার মায়ের বন্ধু-প্রেমিক ছিল জেনেও এতকাল পরে ধর্ষণের অভিযোগ তুলছে কেন ? হ্যাঁ, উমর নিজেও ম্যাসেঞ্জারে এরিনাকে স্বীকার করেছে, তার মা অর্থাৎ মহুয়া ছিল তার জীবনের প্রথম প্রেম। যৌবনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ও বিশ^স্ত বন্ধু। মহুয়ার মৃত্যুসংবাদটি শুনে সে সারারাত ঘুমাতে পারেনি। একান্ত ব্যক্তিগত এই শোক ও শূন্যতা পরিবারের কারও সঙ্গেই শেয়ার করতে পারে না। উমর আলির যৌবনে ছেলেমেয়েতে বন্ধুত্ব ও মেলামেশা সহজ-স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল না মোটেও। ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোন আসেনি তখনও। ফলে মহুয়াকে ভালোবেসে বিস্তর চিঠিও লিখেছিল বিয়ের আগে এবং পরেও। মহুয়ার একটি চিঠির জবাব পাওয়ার জন্য ডাকপিয়নের আসার অপেক্ষায় পথের দিকে তাকিয়ে থাকত উমর। মহুয়ার চিঠির জন্যই একদা দেশের ডাক বিভাগ এবং ডাকপিয়নটি হয়ে উঠেছিল সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ও কর্মী। অবসর গ্রহণের বছর কয়েক আগে উমর আলি যখন ডাক বিভাগের প্রধান কর্তাব্যক্তি, বিভাগটিকে আধুনিক করার প্রকল্প গ্রহণের সময়েও মনে পড়েছিল মহুয়ার চিঠিপ্রাপ্তির আনন্দ ও ডাকপিয়নটির কথা। কিন্তু আমেরিকায় গিয়ে বিদেশিকে বিয়ে করার পর মহুয়া আর চিঠি লেখেনি। উমরও তার সরকারি চাকরিজীবনে ক্রমবর্ধমান হারে কর্মব্যস্ত সময় কাটিয়েছে। সংসারে স্ত্রী-সন্তানদেরও সময় দিতে পারেনি যে কর্মব্যস্ত আমলা, তার পক্ষে সাতসমুদ্দুর তের নদী ওপারের প্রেমিকাকে নিয়ে আকাশকুসুম চয়নের বিলাসিতা করার অবকাশ কোথায় ? তবে মহুয়ার পুরানো চিঠিগুলি সযত্নে রক্ষা করেছিল অনেকদিন। মৃত অতীত উমর আলির সমাজ-সংসারে আগুন জ¦ালিয়ে দিতে পারে ভেবে মহুয়ার সমস্ত চিঠি একদিন আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে। অতপর উমর আলি কি প্রথম যৌবনের উচ্ছ্বাসময় কাব্যে ‘মহুয়াকে ভালোবাসি’ ও ‘তোমাকে ছাড়া বাঁচব না আমি’র সেই অগ্নিময় জীবন্ত প্রেমিকটি আছে এখনও ?

না, নেই অবশ্যই। মরে ভূত হয়নি সত্য, কিন্তু যে আছে সে প্রথম যৌবনের উমর নয়। উমর আলির মতোই দেখতে একটি যন্ত্রমানব। চাকরিতে থাকার সময় ঘড়ি ধরে অফিস, মিটিং, ফাইলওয়ার্ক ও আমলাতান্ত্রিক রীতিনীতির শিকলে বাঁধা রোবটের মতো কাজ করে গেছে। চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর দাসত্বের শিকল থেকে মুক্ত হয়েছে সত্য কিন্তু নিজেকে রোবট হিসেবে সন্দেহ করার সঙ্গত কারণ আছে। চাকরিজীবনে রাষ্ট্রক্ষমতার শীর্ষে সেনাপ্রধান কিংবা রাজনৈতিক দলীয় প্রধান যে-ই থাকুক, তাদের চাওয়াটকে গুরুত্ব দিতে নতমস্তক ছিল সর্বদাই। আর স্বাধীন-অবসর জীবনে কোন বসদের হুকুমে হাতের সেলফোনে বা ল্যাপটপে দিনেরাতে তাকিয়ে থাকে এতটা সময় ? তাকে সঠিক চেনে না বলেই হয়তো গুগুলে কর্মরত এরিনার কথা মনে হতো ঘুরেফিরে।

সত্যি বলতে কি, অনলাইনে এরিনা ছাড়া অবসর-জীবনে বিগত কয়েক বছরে নারী কি পুরুষ চেনা কি অচেনাÑকোনও মানুষের সঙ্গেই আবেগজাত সম্পর্কে আসেনি উমর আলি। প্রবাসী সন্তান ও নাতিদের ভাবনা, ভিডিও-চ্যাট ও জরুরি ফোনালাপে কিছুটা আবেগ ভালো লাগার অনুভূতি কাজ করে হয়তো। এছাড়া ভালোবাসা, মুগ্ধতা, বিস্ময়, কৌতূহল, আনন্দ, সহানুভূতি, কৃতজ্ঞতা ইত্যকার মানবজীবনের উপকারী আবেগ-অনুভূতিগুলির উৎস যেন শুকিয়ে গেছে। বাইরে বেরুলে মুখচেনা কি অচেনা অনেকের সঙ্গেই দেখা হয়। হাই-হ্যালো কি এক চিলতে হাসি বিনিময় ছাড়া কারও সঙ্গেই কোনও সংযোগ ঘটে না।

পাঁচ

বাসায় স্টাডি-রুমেই নিজস্ব জগত নিয়ে দিনমান প্রায় একাই থাকে উমর আলি। স্ত্রী রাশেদাকে তার সংসার সামলানোর কাজের লোক এবং ভাগনি সম্পর্কের এক স্থায়ী অতিথি সেবা ও সময় দেয়। হাতের স্মার্টফোন ও টিভি দেখেও অনেকটা সময় কাটায়। তার উপর গাড়ি নিয়ে মার্কেটে কিংবা আত্মীয়-স্বজনদের বাসায় একা কিংবা কোনও স্বজনকে নিয়ে বেড়াতে যায় প্রায়ই। নিজস্ব জগতে মগ্ন স্বামীকে বিরক্ত করে না সাধারণত। কিন্তু আজ অসময়ে তার ঘরে এসে সরাসরি জানতে চায়, ‘এই, ফেসবুকে তোমাকে নিয়ে কে কী সব স্ক্যান্ডাল রটাচ্ছে ? সারাদিন ঘরে বসে অনলাইনে দেশ-বিদেশে এইসব কী অপকর্ম করে বেড়াও তুমি ?’

উমর আলি বুঝতে পারে, এরিনার পোস্ট সম্পর্কে ইতোমধ্যে রাশেদা অবশ্যই কারও কাছে শুনেছে। তার নিজের একটা ফেসবুক একাউন্ট থাকলে সেখানে স্বামী ও তার বন্ধুদের কাউকেই সে বন্ধু করেনি।

‘তোমাকে কে কী বলল ?’

‘রুদ্র আর ঋদ্ধি ফোন বরেছিল। তোমার সেই আমেরিকান বান্ধবীর মেয়ে নাকি তোমার ছবি দিয়ে তার মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে কী কম্পিলিন করেছে। আমাদের বাসায় যখন এসেছিল, ঘরে টেনে নিয়ে ওইটুকু বিদেশি মেয়কেও নাকি তুমি ছাড়োনি। ছি! এতদিন পর ফেসবুকে মেয়েটা সব ফাঁস করে দিয়েছে। বাংলাদেশে এসেও এবার মামলা করবে লিখেছে।’

ছেলেমেয়েরা দেখল কেমনে ? ওরাও কি এরিনার ফেসবুক বন্ধু ? অনুচ্চারিত এ প্রশ্নের জবাব স্ত্রীর টাটকা প্রতিক্রিয়া থেকেই বুঝতে পারে, প্রথমে সিলেটি-আমেরিকান পুত্রবধূ কোহিনূর দেখেছে। তৎক্ষণাৎ সে স্বামী ও অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী ননদকেও ট্যাগ করে দেখিয়েছে। ঋদ্ধি তার মাকে একটু আগে ফোনে বলেছে, ‘যদি এসব নিয়ে পত্রপত্রিকাতেও লেখালেখি শুরু হয়, তোমাদের জামাই দেখলে আমার সংসারও ভাঙবে। আর আমিও তখন ছাড়ব না, লম্পট বাপের বিরুদ্ধে নিজেও সাক্ষী দেব এবং কোনও সম্পর্কই রাখব না।’

অন্ধ স্নেহের প্রধান দাবিদার আত্মজার তীব্র প্রতিক্রিয়া জেনে উমর আলির বুকের ধকধক স্পন্দন বাড়ে। তবু শান্ত ও স্বাভাবিক কণ্ঠে স্ত্রীর কাছে জানতে চায়, ‘আর রুদ্র কী বলেছে ?’

‘বাপের বদনামে সে তো আর বউয়ের মতো খুশি হবে না। আমাকে বলল, তুমি এখন আব্বুকে কিছু বলো না। আমি খোঁজখবর নিয়ে দেখছি এরিনার মোটিভটা আসলে কী। আব্বু পারলে সাইবার ক্রাইমের কোনও লইয়ারের সাথে আলাপ করুক। পুলিশ ডিপার্টমেন্টেও চেনা আইজি বা ডিজির সঙ্গে কথা বলতে বলো।’

ছেলের প্রতিক্রিয়া ও বাবার হয়ে ও ষড়যন্ত্র মোকাবেলার সিদ্ধান্ত কিছুটা সাহস ও সান্ত্বনা জোগায়। কিন্তু কন্যার মতো স্ত্রীর কণ্ঠেও যেন একই সুর, হঠাৎ এরিনা ও তার বান্ধবীদের সঙ্গে বিদ্রোহী ও নারীবাদী হয়ে উঠেছে উভয়ে।

‘যৌবনকালে অফিসের পিএ ও বাসার কাজের মেয়েদের সঙ্গেও ফস্টিনস্টি করেছ! আর এখন এই বুড়ো বয়সে মেয়ের বয়সি একটা মেয়ের সঙ্গে ইন্টারনেটে কী সব শুরু করেছ তুমি ? কেন সে ফেসবুকে ছবি দিয়ে এমন কলঙ্ক রটায় ? বাসায় তাদের প্রথম দেখেও আমার সন্দেহ হয়েছিল। এতদিন পর, প্রমাণপত্র না থাকলে মামলা করার হুমকি দিয়েছে এমনি এমনি ? ছি! ছি! লজ্জা ঢাকতে এবার বিষ খেতে হবে আমাকে।’

‘নিজের চোখে কিছু না দেখে না বুঝেই তুমি যা শুরু করলে, তাতে তো বাড়িতেও এক সঙ্গে থাকা যাবে না দেখছি।’

‘যাবে কোথায় ? আগামী সামারে ছয় মাস আমেরিকা আর সুইডেনে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে থাকব ভাবছিলাম। কিন্তু এরকম কলঙ্কের পর ছেলেমেয়ের বাসায় মুখ দেখাতে পারবে ? মেয়ে তো আগেভাগেই বাপের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে না বলেই দিয়েছে। আর বউ তো ইতোমধ্যে তার পরেহেজগার বাবামাকেও বলে দিয়েছে অবশ্যই।’

উমর আলি এবার দৃঢ় সিদ্ধান্ত জানায়, ‘তোমরা সম্পর্ক রাখো বা না রাখো, তাতে আমার কিছু যায় আসবে না। ফেসবুকে কেন এবং কে আমার বিরুদ্ধে এসব সড়যন্ত্র করছে, আমি তাদের খুঁজে বের করব। আমাকে ডিস্ট্রাব করো না প্লিজ। হুদার মাকে আমার কফি দিতে বলো।’

ঘরে একা হয়ে উমর দীর্ঘশ^াস ফেলা ছাড়া কিছু করতে পারে না। ধরা যাক, এরিনার অভিযোগ শতকরা শতভাগ সত্য। কিন্তু অভিযুক্তের জবাব না জেনে, রক্ত সম্পর্কিত স্বজনদের মধ্যেও ঘৃণা ও লজ্জার আবেগ যেভাবে উথলে উঠছে, তাকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারে না সে। কন্যা পিতাকে খুব ভালোবাসে বলে তার ভয়-ঘৃণার অনুভূতিটাও তীব্রতর হয়ে উঠেছে সহসা। তাছাড়া ইউরোপে থেকেও প্রেম ও যৌনতা বিষয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গি যে অতিমাত্রায় সংরক্ষণশীল ও সংকীর্ণমনা ধার্মিক মায়ের মতো। হয়তো জামাই বাবাজির কারণেই ভয় পেয়েছে বেশি। সুইডেনে থেকেও সে মসজিদে যায়, বাসাতে নামাজ পড়ে এবং মদ্যপানের পার্টি এড়িয়ে চলে সর্বদা। কাজেই যত প্রভাবশালী ও সম্মানিত হোক, লম্পট শ^শুর ও তার কন্যাকে সে হেয় চোখে দেখবেই।

অন্যদিকে এরিনার ফেসবুক পোস্ট উমর আলির আগেই পুত্রবধূ নুরজাহানের চোখে পড়াটা সন্দেহজনক তবে অস্বাভাবিক নয় মোটেও। কারণ জন্মসূত্রে বৃটিশ হলেও শৈশব থেকে আমেরিকায় বড় হয়েছে সে। যেহেতু উভয়ে সমবয়সি, দীর্ঘ শিক্ষাজীবন, নারীবাদী চিন্তা, মাতৃভাষা ও বাংলাদেশি সংযোগ কিংবা যে কোনও সূত্রেই হোক, তাদের ফেসবুক বা টুইটার বন্ধুত্ব হওয়াটা স্বাভাবিক। নূরজাহানের সিলেটি বাবা-মা হোটেল ব্যবসায় নিয়ে লন্ডন থেকে আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছিল। ব্যবসায়ের সাফল্যে নিউইয়র্কে বাড়ি-গাড়ি কিনে আমেরিকায় থিতু হয়েছে। উমর আলিও উচ্চশিক্ষার জন্য ছেলেকে আমেরিকায় পাঠিয়ে সে দেশেই তাকে প্রতিষ্ঠিত দেখার স্বপ্ন দেখেছিল। সিলেটি-আমেরিকান শ^শুরের মেয়েকে বিয়ে করে ছেলে পিতার ও নিজেরও স্বপ্ন সহজেই পূরণ করেছে। বিয়ের ক্ষেত্রে ছেলের যোগ্যতার চেয়েও তার পিতার উচ্চপদস্থ সরকারি অবস্থানকে গুরুত্ব দিয়েছিল নুরজাহানের উচ্চশিক্ষাবঞ্চিত কনজারভেটিভ পিতামাতা। কিন্তু তাদের বৃটিশ-আমেরিকান কন্যাটির কাছে বাংলাদেশে শ^শুরের প্রতিষ্ঠা-সম্মানের যে কানাকড়ি মূল্য ছিল না, সেটা রিটেয়ার করার পর আমেরিকায় ছেলের সংসারে তিনমাস অবস্থানের সময় হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল স্বামী-স্ত্রী দুজনেই। সরাসরি শ^শুরকে সিদ্ধান্ত দিয়েছিল বউমা, আমেরিকায় থাকতে চাইলে দেশের সবকিছু বেচে দিয়ে আলাদা বাড়ি কিনে আলাদাভাবে থাকতে হবে।

এরপর ছেলের বাসায় যাওয়ার ইচ্ছে হয়নি উমর আলি ও তার স্ত্রীরও। ছেলেই সপরিবার দেশে বেরিয়ে গেছে একবার। আজ এরিনার ফেসবুক পোস্টে শ^শুরকে নিজের পিতামাতার পাশে জন্তু-জানোয়ারের মতো তুচ্ছ করার সুযোগ পেয়ে নিশ্চয় খুশি হয়েছে পুত্রবধূ। আর এরিনার এ পোস্ট যদি ষড়যন্ত্র হয়, এই চক্রান্তের সঙ্গে তার জড়িত থাকাটা অস্বাভাবিক নয়।

এরিনার পোস্টকে নারীবাদী চমক, ফেসবুকের ফালতু প্রচারণা কিংবা ষড়যন্ত্রমূলক সাইবার আক্রমণ ভেবে অনলাইন থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিজের বাস্তবে স্বস্তি ও সাহস খুঁজছিল উমর আলি। কিন্তু এরিনার আক্রমণ ইতোমধ্যে নিজের সংসারে যে ঝড় তুলেছে, তা অনলাইনে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা কিংবা এটিএম বুথ থেকে অনেকের একাউন্ট থেকে টাকা ছিনতাইয়ের মতো সাইবার ক্রাইমের চেয়ে কম মারাত্মক ও ক্ষতিকারক নয়। এমন সংকটে স্ত্রী পাশে দাঁড়ানো দূরে থাক, কাজের লোক দিয়ে রুটিন কফি পাঠানোর দায়টাও অগ্রাহ্য করে আজ।

ছয়

উমর আলি ড্রাইভারকে ফোনে গাড়ি বের করতে বলে। স্ত্রীকে কিছু না বলেই বাসা থেকে বেরিয়ে গাড়িতে গিয়ে ওঠে। ড্রাইভারকে দূরের এক নিরিবিলি কফিসপের গন্তব্য বলে নিজে চোখ বুজে আজ গাড়িতে ধ্যানে বসেও এরিনা ও তার মৃত মায়ের মুখ দেখে। যোগাযোগের পর এরিনা ও তার মায়ের ছবি পাওয়ার বায়না উমরই করেছিল একদিন। মায়ের সঙ্গে নিজের একটা যৌথ ছবি পাঠিয়েছিল এরিনা। ছবিটা নিজের ল্যাপটপ খুলে রোজই দেখে উমর আলি। হাতের মোবাইল ফোনটাতেও আছে। মহুয়াকে আর দেখতে না পাওয়ার গভীর বেদনা পুষিয়ে নিতে তার যুবতী কন্যা এরিনাকে সামনা-সামনি দেখার বাসনাটির কথাও লিখেছিল একদিন। দ্বিধাহীন জবাব দিয়েছিল এরিনা, চলে আসো আমেরিকায়। তোমার ছেলে তো নিউইয়র্কে থাকে। সেখানে আসলে তুমি ক্যালিফোর্নিয়ায় আমার কাছে এসেও কিছুদিন থাকতে পারবে। অথবা টিকেট-ভিসা পাঠিয়ে দাও, আমি বাংলাদেশে তোমার কাছে চলে আসতে পারি। এরিনার এসব দ্বিধাহীন সিদ্ধান্ত ষড়যন্ত্রমূলক ছিল কি না, জানে না উমর আলি। তবে তাকে দেখার ইচ্ছেটা সত্যই জোরালো হয়ে উঠেছিল বলে তার এমন জবাবে পুলকিত হয়েছিল সে। কিন্তু মৃত বান্ধবীকন্যার কাছে প্রকাশ্য অভিসার নিজের কিংবা ছেলের পরিবারে অশান্তির কারণ হতে পারে ভেবে সংযত করেছে নিজেকে। অন্যদিকে আল্লা না করুক, স্ত্রী যদি হঠাৎ মরে যায় আর উমর আলি তারপরও একা বেঁচে থাকে কয়েক বছর, কয়েক লক্ষ টাকা ব্যয় করেও এরিনাকে নিজের বাড়িতে এনে রাখতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবে না। যতদিন খুশি থাকতে পারবে এরিনা। এসব কথা এরিনাকে লেখেনি সে। তবে কল্পনায় তার সঙ্গলাভের পথ ও সুখ কত শতবার যে খুঁজেছে! এমনকি প্রথম যৌবনে মহুয়ার কথা ভেবে যেমন, তেমনি এরিনার কথা ভেবে ভেবে একদিন নিজের শিশ্নের উত্থানক্ষমতাও পরখ করেছে। কিন্তু যাদের সুখশান্তির কথা ভেবে নিজের এসব একান্ত কামনা-বাসনা গভীর গোপনে রেখেছিল, তা আজ এরিনাই প্রকাশ করে দিয়ে উমর আলির সফল ও সুখী সংসারে প্রতিহিংসার আগুন জ¦ালাতে চায় কেন ?

গাড়িতে নিজের ধ্যানমগ্নতা সঙ্গের স্মার্টফোনে ঘন ঘন ফোন ও ম্যাসেজ আসার সংকেত বিঘ্ন ঘটায়। বুঝতে পারে সে, এরিনার পোস্টের প্রতিক্রিয়ায় স্বজন-বন্ধুরা সব মজা পেতে কিংবা কৌতূহল বশেও এখন উমর আলির সঙ্গে কথা বলতে চাইছে। জানতে চাইছে তার বক্তব্য। কিন্তু আক্রান্ত উমর প্রতিপক্ষ শত্রুর শক্তি, কৌশল ইত্যাদি না বুঝে এবং নিজের রণকৌশল নির্ধারণ না করে কোনদিকে এগুবে ?

সচিব থাকার সময়েও একবার তার মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি নিয়ে সংবাদমাধ্যমে বেশ সাড়া জাগানো খবর হয়েছিল। তাকে তলব করেছিল খোদ প্রধানমন্ত্রীও। কিন্তু কোটি কোটি টাকার অনিয়ম-দুর্নীতি তো তার মেয়াদে সে একা করেনি। এসব অভিযোগ মোকাবেলার জন্য খোদ মন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের আইন-বিভাগ, অ্যাটর্নিজেনারেল ও বিশেষ বাহিনী পাশে ছিল। তথ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে গণমাধ্যমের মালিক-সম্পাদকদের টাইট দেওয়ায় রিপোর্টারদের লম্ফঝম্ফ বন্ধ হয়েছে। একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে সেই কমিটির মাধ্যমেই ধামাচাপা পড়েছিল সব অভিযোগ।

কিন্তু অবসর জীবনে স্যোসাল মিডিয়ায় এক প্রাক্তন সচিবের নৈতিকতা বিরোধী এমন মুখরোচক খবর মোকাবিলায় কোনও পুরুষই তার পাশে দাঁড়াবে না। খবরটা দেশের প্রিন্ট মিডিয়াতেও কেউ তুলে দেবে নিশ্চিত। ক্যাডার সার্ভিসে নিজের সাফল্যে প্রতিদ্বন্দ্বী ও ঈর্ষান্বিত শত্রুর সংখ্যাও তো কম ছিল না। উমর আলি আগে প্রোমোশন পাওয়ায় চাকরি ছেড়ে দিয়েছিল একজন। এরা এবার উমরকে হেনস্থা করার এমন সুযোগ দেখে বগল বাজাবে সবাই। নিজেদের যৌন-ক্যালেঙ্কারি গোপন রাখার জন্য সাধু সেজে উমরকেই ধিক্কার দেবে একদার প্রধানমন্ত্রীর প্রিয় অনেস্ট ও একসেপশনাল সচিবটিকে। ফোনে-মিডিয়ায় স্বজন-শুভার্থীদের উপস্থিতি অগ্রাহ্য করে উমর আলি তাই নিজের করণীয় সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্তে আসতে চায়।

গুলশানের নিরিবিলি কফি হাউসে স্যান্ডউইচ-কফির অর্ডার  দেয় সে। কফির পেয়ালায় চুমুক দিয়ে এরিনার ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে ঢোকে আজ। যে বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে লিভটুগেদার করছে, তাকে খুঁটিয়ে ও খতিয়ে দেখা দরকার। ছেলেটি যদি বাংলাদেশি ও বাংলাভাষা জানা হয় তবে মহুয়াকে লেখা উমর আলির পুরোনো প্রেমপত্রগুলোর অনুবাদ এমনভাবে বুঝিয়েছে, তাতে উমরের কাব্যাশ্রয়ী গভীর প্রেমকে হয়তো লেলিহান কাম হিসেবে সনাক্ত করেছে এরিনা। বাঙালির জাত হিংসের খবর এরিনার তো জানার কথা নয়। আবার এও হতে পারে, তার সরলতার সুযোগ নিয়ে কোনও বাংলাদেশি যুবক আসলে তাকেই প্রতারণা করেছে এবং বন্ধুত্বের নামে শরীর-সম্ভোগের মজা লুটে কেটে পড়েছে। এসব ঘটনায় যে জিঘাংসা-প্রতিহিংসা জন্মেছে এরিনার মনে, তা ঝেড়ে ফেলার জন্য উপযুক্ত পাত্র হিসেবে নাগালের মধ্যে পেয়েছে উমর আলিকেই। আবার যে মেয়ে নির্দ্বিধায় উমরের ফ্ল্যাটে আসার জন্য টিকেট পাঠাতে বলেছিল, মামলার ভয় দেখিয়ে মোটা অঙ্কের একটা এমাউন্ট হাতিয়ে নেয়ার মতলব থাকাটাও বিচিত্র নয়।

গত তিন চার-বছরে এরিনার সঙ্গে অনলাইন যোগাযোগের রেকর্ড ও স্মৃতি খতিয়ে দেখেও নতুন করে মেয়েটির আসল মতলব বোঝার চেষ্টা করতে হবে। গত তিন মাস ধরে তার সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে বা ম্যাসেঞ্জারে কথা হয়নি। খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল এরিনাকে, সময় চেয়ে উমর আলি তিনচার বার ম্যাসেজ দিয়েছে। খুব ব্যস্ত আছি এখন। সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়ে কিংবা জবাব না দিয়ে এড়িয়ে গেছে উমর আলিকে। শেষে এক উইকএ্যান্ডে ক্যালিফোর্নিয়ার সকাল নয়টায় সরাসরি ভিডিওকল করেছিল উমর। ফোন ধরেনি এরিনা। আসলে ততদিনে এরিনা বাংলাদেশে আসা এবং উমর আলির বিরুদ্ধে মামলা করার প্রস্তুতি হয়তো চূড়ান্ত করে ফেলেছিল। উমরের ম্যাসেজ এবং ভিডিও ও ফোনকলের রেকর্ডও হয়তো তার বাৎসল্যবোধ নয়, অতীতের অ্যাবিউজ তথা ধর্ষণের ঘটনাই প্রমাণিত হবে। অন্যদিকে প্রথম সাক্ষাতে ১১ বছরের কিশোরীর সঙ্গে কথাবার্তা ও সংঘটিত আচরণের কোনটা অস্বীকার করবে উমর ? প্রতিপক্ষের উকিল এ নিয়ে বিস্তর জিজ্ঞাসাবাদ করবে সন্দেহ নেই। আইন-আদালত এবং সংবাদপত্রের রিপোর্টারদের মুখোমুখি হওয়ার নিয়তিকে ধেয়ে আসতে দেখে উমর আরও অস্থির ও উত্তেজিত বোধ করে। আইন-আদালত কি মিডিয়ায় মুখোমুখি হওয়ার আগে বিশ বছর আগে এরিনা ও তার মায়ের সঙ্গে প্রথম এবং শেষ সাক্ষাৎকারের স্মৃতি সততার সঙ্গে সবিস্তারে স্মরণ করা প্রয়োজন। নিজেকে এবং নিজের আইনজীবীকে অকপটে শতভাগ স্বীকারোক্তি দেবে উমর আলি।

সাত

সুখী ও সফল মানুষও জীবনের একঘেয়ে দৈনন্দিনতায় বাঁচার আনন্দ-উত্তেজনা খুঁজে পায় না বলেই হয়তো বৃদ্ধবয়সে বড় স্মৃতিকাতর হয়ে ওঠে। যাপিত জীবনের উত্তেজক কি মধুর ঘটনার স্মৃতি দিয়ে শূন্যতা পূরণ করে অনেকটা। কিন্তু উমর আলির নবীন যৌবনের প্রেম শেষ বয়সেও জীবন্ত হয়ে ওঠা নিছক স্মৃতিকাতরতা নয়, মৃত প্রেমিকা তার কন্যার মাধ্যমে ভয়ংকর বাস্তব হয়ে উঠে উমর আলির বর্তমান ও ভূত-ভবিষ্যৎ একাকার করে দেবে, এমনটা কোনওদিন ভাবেনি সে।

শেষ দেখারও প্রায় দুই দশক আগে আমেরিকা চলে গিয়েছিল মহুয়া। আর উমর ততদিনে সরকারি চাকরিতে ঢুকে বিয়ে করেছে। মহুয়ার সঙ্গে বিয়ে না হওয়ার পেছনে দায়টা শুধু এককভাবে উমর আলির ছিল না। তাই বিচ্ছেদের পরও মহুয়ার আমেরিকার ঠিকানায় ও উমরের অফিসের ঠিকানায় আগের মতোই চিঠি লেখালেখির মাধ্যমে সম্পর্কটা অব্যাহত ছিল কিছুদিন। মহুয়ার বিয়ের সংবাদটি জানার পর উমর লেখা বন্ধ করে দিয়েছিল। তবে সরকারি কাজে আমেরিকা যাওয়ার সুযোগ হলে মহুয়ার সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল। আর এমন স্বপ্ন উমর দেখে এসেছে অবসর গ্রহণের আগে পর্যন্ত। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার, সরকারি কাজে উমর আলি ল্যাটিন আমেরিকা, এশিয়া ও ইউরোপের বেশকিছু দেশে গেলেও আমেরিকা যাওয়ার সুযোগ পায়নি একবারও। এ কারণেও হয়তো ছেলেকে আমেরিকায় স্থায়ী করা এবং অবসরজীবনে অভিবাসী মহুয়ার দেশে নিজেরও স্থায়ী হওয়ার স্বপ্ন ও সম্ভাবনা জোরালো হয়ে উঠেছিল।

বিচ্ছেদের দেড় যুগ পরে ঢাকায় নিজ বাসায় মহুয়াকে আবারও দেখতে পাওয়ার সুযোগটি অপ্রত্যাশিত ও অকল্পনীয় ছিল বলেই তা উমর আলির জবীনে অবিস্মরণীয় আনন্দের স্মৃতি হয়ে আছে। বাংলাদেশে আসার পর মহুয়াই তার সঙ্গে যোগাযোগ করে সাক্ষাতের আগ্রহ প্রকাশ করে। জার্মান স্বামী সঙ্গে আসেনি, উপরন্তু তাদের পারিবারিক ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের সাক্ষী মহুয়ার মা ও আমেরিকান মেয়েকেও সঙ্গে আনবে বলে উমর বাসায় পার্টির ব্যবস্থা করতে আপত্তি করেনি। উমরের সুখীসংসার দেখার কৌতূহল ছিল মহুয়ার। অন্যদিকে মহুয়া ও তার মেয়েকে দেখার প্রবল আগ্রহে চাপা পড়েছিল পুরাতন প্রেমের ঝুঁকি। নিজের পরিবারের সবাইকে সত্য বলেছিল সে। মহুয়ার বাবা ও উমরের বাবা একই বিভাগে সরকারি চাকরি করত। পাশাপাশি সরকারি কোয়ার্টারে থাকত তারা। ঘনিষ্ঠতা ছিল দুই পরিবারের মধ্যে। সেই ঘনিষ্ঠতার সাক্ষী হয়ে মহুয়ার মা তো সঙ্গে ছিল। কিন্তু মহুয়া ও উমরের মধ্যে চেনাজানা সম্পর্কের আড়ালে যে গভীর প্রেম, সেই প্রেমের বিকাশ ও বিচ্ছেদের ইতিহাস জানত না কেউ। উভয়ে অতীত সম্পর্ক নিয়ে নীরব ছিল বলে কেউ টের পায়নি সামাজিক সম্পর্কের উৎসমূলে তাদের লুকানো আবেগ। তাছাড়া তাদের অতীতের গোপন সম্পর্কের চেয়ে মহুয়ার আমেরিকা প্রবাস, জার্মান স্বামী এবং আধাজার্মান আর আধাবাঙাল কন্যা এরিনাই হয়ে উঠেছিল সবার আগ্রহের বিষয়। উমরের বড় ছেলে রুদ্র তার ক্যামেরা বের করে বসার ঘর থেকে শুরু করে খাওয়ার টেবিলে বিস্তর ছবি তুলেছিল।

খাওয়ার টেবিলে যখন সবাই গল্পে জমে উঠেছে, তখন শোবার ঘরে উমর আলির জরুরি ফোন কল এসেছিল। মন্ত্রী ফোন করেছিল উমরকে। মেয়ের কাছে খবর শুনে ফোন ধরতে পাশের ঘরে ছুটে গিয়েছিল উমর। ওই সময়ে জয়েন্ট সেক্রেটারি পদমর্যাদায় একটি অধিদফতরের ডিজি ছিল সে। মন্ত্রীর এক ক্যান্ডিডেটকে চাকরি দেয়ার তদবিরে জি স্যার, হ্যাঁ স্যার, দেখব স্যার ইত্যাদি ঘাড় এলানো কথাবার্তার সময়ে এরিনা কখন খাওয়ার টেবিল ছেড়ে ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ফোনালাপ শুনছিল, টের পায়নি উমর। চোখে পড়তেই মন্ত্রীর কথায় বিরক্তি মুছে গিয়ে যে বিমুগ্ধ-চমক, তা প্রথম যৌবনের মহুয়াকেও চকিতে মনে করিয়ে দিয়েছিল। মহুয়ার চেয়েও তার মেয়েটা অনেক সুন্দর। জিন্সের প্যান্টের সঙ্গে একটা টাইট ফিটিং হলুদ টিসার্ট পরেছে। দুহাত দরজার দুদিকে ছড়িয়ে দিয়ে ইচ্ছে করেই সে কি তার স্তনের অবয়ব অমন স্পস্টতায় ফুটিয়ে তুলেছিল ? বয়ঃসন্ধিক্ষণে আসা কিশোরীর মাসিকও শুরু হয়েছে সম্ভবত। মন্ত্রীকে স্যার স্যার করতে গিয়ে এরিনা সম্পর্কে এটুকু ভেবে, সালাম জানিয়ে ফোন রেখে দিয়ে উমর মুখের হাসি প্রসারিত করে তাকে ডেকেছিল, আসো ভিতরে। মুখের আহ্বানের চেয়ে হয়তো ইশারা ভাষাই স্পষ্টতর হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এরিনা যে তার পোস্টে ইংরেজিতে ‘ঘরে টেনে নিয়েই ঠোঁটে চুমু দেয়ার অভিযোগ করেছে’, তা সম্পূর্ণ অসত্য ও উদ্দেশ্যমূলক। কারণ ইসারায় আহ্বান পাওয়ামাত্র ভিতরে এসেছিল এরিনা। উমর চেয়ারে বসে সিগারেটের প্যাকেট খুলেছিল। কারণ খাওয়ার টেবিলের আড্ডায়, বিশেষ করে মহুয়ার বুড়ি মায়ের সামনে অনেকক্ষণ সিগারেট টানতে পারেনি সে। এরিনাকেও পাশের চেয়ারে বসতে বলে তার অনুমতিও নিয়েছিল, আমি কি ধূমপান করতে পারি ? চকিতে মনে পড়েছিল, মহুয়া তার ধূমপান পছন্দ করত না। কিন্তু এরিনা অনুমতি দিয়ে বলেছিল, ‘আমার ড্যাডিও স্মোকার। মা বলেছে আফটার এইট্টিন আমিও স্মোক করতে পারব।’

এরিনাকে তার বাবা সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করার কথা ভাবতেই সেই প্রথম জানতে চায়, ‘তুমি কার সঙ্গে অত স্যার স্যার করে কথা বলছিলে ?’

‘আমার মন্ত্রী। আমি একটা ডিপার্টমেন্টের সিইও, মিনিস্টার স্যার আমার উপর খুব ডিপেন্ড করে।’

এরিনা উমরের মন্ত্রী-অফিসের অহঙ্কারকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে সরাসরি মায়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক নিয়ে কৌতূহল দেখায়, ‘মা দেশে থাকার সময় তুমি কি তার বয়ফ্রেন্ড ছিলে ?’

‘হ্যাঁ, আমরা খুব ভালো বন্ধু ছিলাম।’

হয়তো নিজের স্ত্রী-সন্তানেরা জিজ্ঞেস করলে উমর এতটা দৃঢ়তার সঙ্গে স্বীকারোক্তি করত না। কিন্তু এরিনা যেন এটুকু জেনে সন্তুষ্ট হতে পারছিল না। তৎক্ষণাৎ জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তোমরা কি প্রায়ই ডেট করতে ?’

উমর এরিনার কৌতূহল এড়াতে, তাদের সম্পর্কটা যে মোটেও খারাপ কিছু ছিল না সেটা বোঝাতেও বটে, জবাব দিয়েছে, ‘তুমি মায়ের চেয়েও সুন্দর ও ইন্টিলিজেন্ট। বড় হলে মায়ের মতো তুমিও আমার বন্ধু হবে, হবে না ডার্লিং ?’

‘কিন্তু আমরা নেকস্ট উইকে আমেরিকা চলে যাব। বড় হলেও আমার সঙ্গে ডেট করতে পারবে না তুমি।’

‘তোমরা চলে গেলে তোমাকে বেশ মিস করব। এসো, এখনই তোমাকে একটু আদর করে দিই ?’

উমর আলি দরজার দিকে তাকিয়ে এবং টেবিলে ওদের কলহাস্য শুনে, এরিনার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টি রেখে দুহাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। মুহূর্তের জন্যও দ্বিধা না দেখিয়ে উমরের বুকে ধরা দিয়েছিল মেয়েটি। প্রথমে তার দুগালে চুম্বন করে, চকিতে মহুয়ার সঙ্গে মিলনের আনন্দ-আবেগের স্মৃতি স্মরণে আসায় শরীরী আবেগও প্রবল হয়ে উঠেছিল সম্ভবত। এরিনার ঠোঁটে লিপস্টিকের গাঢ় লাল রঙ ছিল। চুম্বনের দাগ যাতে নিজের ঠোঁটে না লাগে, সেই সতর্কতা নিয়ে আলতো করে তার ঠোঁটেও চুম্বন করেছিল। এটা কি পাশবিক বা রাক্ষুসে কামের প্রকাশ ছিল ? উমরের শিশ্ন ধর্ষকামী অস্ত্র হয়ে বিদ্ধ করতে চেয়েছিল এরিনাকে ? কিছুতেই মনে করতে পারে না সে।

এরপর মহুয়ার এরিনা ডাক শুনে উভয়ে বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দলের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। চুম্বনের দাগ ও স্মৃতি আড়াল করার জন্য উমর আলি অবশ্য টেলিফোনের মন্ত্রীর আবদারের উল্লেখ করে বিরক্তি প্রকাশ করেছিল বেশ।

আট

এরিনা অপরিণত বয়সে বাংলাদেশে এসে যৌনহয়রানির গল্প শুনিয়ে উমর আলিকে পশু সম্বোধন করে যে ঘৃণা প্রদর্শন করেছে, উমর আলি শতভাগ সৎ স্মৃতিচারণে কতটা অপরাধী প্রমাণিত হবে, জানে না সে। হয়তো বিজ্ঞ আইনজীবীরা বলতে পারবে। কিন্তু এ ঘটনার জন্য জীবনে একবারও অনুতাপবোধ জাগেনি তার। বরং অন্যতম মধুর স্মৃতি হিসেবে সময়ে-অসময়ে কত হাজারবার যে সঙ্গ দিয়েছে!

এরিনা যেমন উমরের কাছে পাওয়া আকস্মিক এই উপহার ভোলেনি, গত বিশ বছরে হাজারো চুম্বনের চাপে আলি আংকেলের হালকা চুম্বনের সঙ্গে প্রাপ্ত সিগারেটের গন্ধটাও ক্রমে কটুদুর্গন্ধ হয়ে উঠেছে। উমর আলিও তেমনি মিনিট কয়েকের ঘরোয়া মিলনের স্মৃতির সময়টাকে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করেছে, ছবি এঁকেছে নবীন যৌবনা এরিনার নগ্ন শরীরের এবং বাস্তবে যা ঘটেনি তাও কতভাবে কতশতবার যে ঘটিয়ে দেখেছে! এরিনা নিশ্চয় জানে বিজ্ঞানীদের গবেষণালব্ধ অভিমত, মানুষের অবদমিত কামচেতনা তার কল্পনাশক্তিকে প্রভাবতি করে, এমন কি ঘুমের মধ্যেও স্বপ্নে অসম্ভভকে সম্ভব করে তোলে। এরিনা কি এইসব কামচেতনার কল্পনা ও স্বপ্নবিকৃতিকে সাক্ষী করে উমর আলিকে পশু বা হিংস্র ধর্ষক প্রমাণিত করবে ?

স্ত্রী ছাড়া অন্য কোনও নারীর সঙ্গে শরীরী সম্পর্কে লিপ্ত হয়নি, এতটা সৎ সে নিজেকে দাবি করে না। তবে নারীর প্রতি সহিংসা, যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণ যাকে বলে, তেমন আচরণ কি করেছে কারও সঙ্গে ? এমন অভিযোগ এরিনা কিংবা তার মা দূরে থাক, নিভৃতে হাতের নাগালে পাওয়া সামান্য কাজের মেয়ে, এমনকি বিবাহিত স্ত্রীও করতে পারবে বলে মনে হয় না। ফেমিনিস্ট এরিনার আলি আংকেলকে জানোয়ার সম্বোধনের হিংস্র ঘৃণার উৎস আসলে অন্য কোথাও, যা উমর জানে না।

অবশ্য এর আগেও মুদ্রিত গণমাধ্যমে একজন ব্যুরোক্র্যাট হিসেবে উমর আলি প্রভুভক্ত কুকুর, চাষির গোলার ধান লোটা ইঁদুর, রাজনীতিকের বাহন হাতি-ঘোড়া ইত্যাদি উপমায় ঘৃণা ও উপহাসের পাত্র হয়েছে সাংবাদিকদের কলমে। আমলাতন্ত্রের প্রাপ্য এসব গালমন্দ তেমন গায়ে লাগেনি। এরিনাও মানবতাবাদী কিংবা বিপ্লবী রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দুর্নীতিগ্রস্ত বাংলাদেশের একজন শীর্ষ আমলাকে জন্তু-জানোয়ার যা-ই বলুক, সহজে মেনে নিত উমর আলি। কিন্তু রিটেয়ার করার পর অন্য সহকর্মীদের মতো প্রভুভক্ত কুকুর হয়ে বাড়তি সম্পদ-সুবিধা-খ্যাতি-প্রতিপত্তি লুন্টনের বদলে গৃহকোণে অতীত প্রেমের স্মৃতি থেকে যখন বাঁচার আনন্দ খুঁজছে, তখন এরিনার কি এভাবে তাকে আক্রমণ করা উচিত হয়েছে ? তার মা বেঁচে থাকলে এমনটি করতে পারত সে ? নাকি মা ও বাবাকে কাছে না পাওয়ার ঝাল মেটাচ্ছে নিরাপরাধ আলি আংকেলের উপরে ?

শুধু নারীনির্যাতন বিরোধী নয়, সাইবার ক্রাইম দমনে দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা নিয়ে নতুন আইন হয়েছে। ধর্ম ও জাতির পিতাকে অবমাননা এবং প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আপত্তিকর স্ট্যাটাস দেয়ায় বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও হয়েছে। কিন্তু কন্যাসম আমেরিকান নাগরিক এরিনার বিরুদ্ধে কি এ দেশীয় আইনে মানহানির মামলা করতে পারবে উমর আলি ? ছেলের পরামর্শ মতো বিষয়টি নিয়ে পরিচিত আইনজীবী বন্ধু ও পুলিশের উচ্চপদস্থ একজনের সঙ্গে কথা বলতে পারে উমর। কিন্তু তার আগে স্বয়ং এরিনার সঙ্গে কথা বলে তার সাম্প্রতিক অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। এর আগে এরিনা ব্যস্ততার অজুহাতে ফোনালাপ বা ভিডিও কলের জন্য অ্যাপোয়েন্টমেন্ট দেয়নি। আজ সরাসরি ফোন করে না পেলে, তাকে ম্যাসেঞ্জারে দীর্ঘ ম্যাসেজ পাঠাবে উমর আলি।

সিদ্ধান্ত নিয়ে উমর আলি ঘড়িতে আমেরিকান সময় মাপে এবং এরিনার সম্ভাব্য অবস্থান ও ব্যস্ততা অনুমান করে। সে যখন অফিসে বা রাস্তায়, বিষয়টা নিয়ে কথা বলা যাবে না। রাতে যখন সে ঘরে থাকবে এবং তার ঘুমানোর আগে কল দিতে হবে। অতএব এরিনার সুবধিাজনক সময়ের অপেক্ষায় থাকে উমর আলি।

রাত জেগে বিস্তর মহড়া ও প্রস্তুতি শেষে, পরদিন সকালের নাস্তার পর ঘরের দরজা বন্ধ করে এরিনাকে প্রথমে ফোন করে উমর। ম্যাসেঞ্জারের পর হোয়াটসঅ্যাপে, এমনকি সরাসরি ফোনেও সংযুক্ত হতে পারে না। বুঝতে দেরি হয় না, প্রাপক তাকে ব্লক করে দিয়েছে। ফেসবুকের মাধ্যমে এরিনার উদ্দেশে একটি পোস্ট দিতে গিয়ে বন্ধুতালিকায় এরিনাকে আজ খুঁজে পায় না আর। তার মানে ফেসবুকেও আনফ্রেন্ড করে দিয়েছে উমর আলিকে। এরিনার যে বিস্ফোরক পোস্ট নিজের টাইমলাইনে সেভ করে রেখেছিল, খুঁজতে গিয়ে দেখে ডিলিট হয়ে গেছে সেটিও। বিষয়টা ভৌতিক কাণ্ডের মতো চমক সৃষ্টি করে উমর আলির মনে। আগে এরিনার টাইমলাইনে গিয়ে যেমন তার সমস্ত পোস্ট পড়তে পারত, নানারকম ছবি দেখতে পারত, আজ তার মুখস্ত ফেসবুক নামটি লিখে সার্চ করার পরও এরিনার ফেসবুক সে ওপেন করতে পারে না। তার মানে ফোনে বা ইন্টারনেট যোগাযোগের সবরকম পথই উমর আলির জন্য রুদ্ধ করে দিয়েছে সে। বাস্তবে শেষ দেখা ও বোঝাপড়া আদালতেই হবে, এ জন্যই কি ? নাকি নারীবাদী এরিনা মানবিক বিবেচনায় তার ঘৃণা-প্রতিহিংসার পোস্ট প্রত্যাহার করে নিয়েছে ? নাকি আমেরিকান ছেলে ও পুত্রবধূই তার সম্মান বাঁচাতে পায়ে ধরে নিবৃত করেছে তাকে ? উমর আলি কোনও সিদ্ধান্তেই স্থির হতে পারে না। এখন প্রমাণ দেখাতে না পারলে লোকে ভাববে হয়তো, এরিনা ও মহুয়া বলে বাস্তব পৃথিবীতে কেউ নেই, ছিল না কোনওদিন, সবই উমর আলির কল্পনা মাত্র!

কিন্তু নিজের স্মৃতি ও স্বপ্ন-কল্পনায় যে বিন্দুমাত্র খাদ নেই, এটা প্রমাণের জন্য এরিনার পাঠানো মা ও মেয়ের যৌথ ছবিটা বের করে উমর আলি। ছবিটা নিজের ল্যাপটপে ও ফোনের ফোল্ডারে সেভ করে রেখেছে বলে এরিনা চেষ্টা করেও হয়তো মুছে দিতে পারেনি। অসংখ্যবার দেখা ছবিটাকেও আজ টাটকা নতুন ছবির মতো অপলক তাকিয়ে দেখে উমর আলি। মহুয়ার মৃত্যুসংবাদ শুনে এ ঘরে বসেই তার স্মৃতি যেমন জীবন্ত হতে দেখেছিল, শোকের আবেগ ভিজিয়ে দিয়েছিল চোখ, আজও মহুয়ার আত্মজা এরিনাকে সাক্ষী রেখেই সেসব স্মৃতি জীবন্ত হয়ে উঠতে থাকে। এরিনার ফেসবুক পোস্ট পড়ে নিজের ভিতরে সৃষ্ট ক্ষত, উদ্বেগ-আতঙ্ক যা কিছু গভীর ও পুঞ্জিভূত হয়ে উঠেছিল, নবীন যৌবনের প্রথম প্রেমিকার দিকে তাকিয়ে সেইসব যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতি বুকে মোচড় দিয়ে অশ্রু হয়ে ঝরতে থাকে। কান্না দিয়েই যেন আজ এরিনার বুকের ঘৃণার লেলিহান আগুন নিভিয়ে দিতে চায়। উমর আলির ব্যক্তিহৃদয়ের একান্ত এ কান্না এরিনা এবং কোনও ফেসবুক বন্ধু কোনওদিন দেখতে পাবে না জেনেও কান্নাটা আরও আকুল হয়ে ওঠে।

ঢাকা থেকে

সচিত্রকরণ : নাজিব তারেক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button