ইঁদুর : বিনোদ ঘোষাল

বিশেষ গল্পসংখ্যা ২০২২ : ভারতের গল্প
সকালে ঘুম থেকে উঠতেই ত্রিদিবের নাকে গন্ধটা ধাক্কা মারল। বমি চলে এল ওর। কী বিশ্রী বোঁটকা গন্ধ! মনে হচ্ছে কিছু একটা মরে পচেছে। মুকুন্দপুরের আলিশান আঠেরো তলার ফ্ল্যাটের জানলা কিংবা ব্যালকনি থেকে নিচের পৃথিবীর সকল প্রাণী, গাড়িঘোড়া পোকামাকড়ের মতো দেখায়। তারা ওই মাটিতেই চলা ফেরা করে, এতটা ওপরে আসার ক্ষমতা নেই। সবাই ত্রিদিব নয়, এতটা উঁচুতে ওঠার ধক সকলের থাকে না। ত্রিদিবের ছিল। একেবারে ছোটবেলা থেকে ছিল আর সেইমতো জীবনের প্রতিটা পদক্ষেপ ও নিয়েছে। সফলতা বরাবর পোষা বেড়ালের মতো পায়ে পায়ে মিঁয়াও মিঁয়াও করতে করতে ঘুরেছে। চণ্ডীতলা নামে গুগুল ম্যাপে না খুঁজে পাওয়া এক জায়গার ত্রিদিব নারায়ণ ব্যানার্জির নাম এখন গুগুলে সার্চ করলে গাদা গাদা রেফারেন্স ভেসে ওঠে। সাইত্রিশ বছর বয়সের মধ্যে ত্রিদিব কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডের একজন সফল কর্তা। ও যে বয়সের মধ্যে সিএসিএস এবং এমবিএ ডিগ্রি হাসিল করেছিল তা সত্যিই বিস্ময়ের। কিন্তু মানুষের অসাধ্য যেহেতু কিছুই নেই সুতরাং ত্রিদিব নারায়ণও ওর মেধা এবং অমানুষিক পরিশ্রম করার ক্ষমতাকে কাজ লাগিয়ে একের পর এক পরীক্ষা সফলতার সঙ্গে পার করেছে। ছোটবেলা থেকেই ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জ শুনতে থাকা ত্রিদিব চ্যালেঞ্জ নিতে ভালোবাসে, বা বলা ভালো চ্যালেঞ্জ এবং নিজের জীবনের সঙ্গে বাজি রাখতে ভালোবাসে। নিজেকে বিপন্ন করে খেলতে নামে, তাতে হয় চুড়ান্ত পরাজয় অথবা সফলতা তার মাঝে কিছু নেই। ত্রিদিবের হাইট চারফুট আট ইঞ্চি। অর্থাৎ গড় বাঙালি পুরুষদের উচ্চতা অনুযায়ী বেশ অনেকটাই কম। এবং শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে পা দেওয়ার পর ত্রিদিব যখন বুঝল বন্ধুরা নির্লজ্জের মতো ধ্যার ধ্যার করে লম্বা হচ্ছে সেখানে ত্রিদিব আর বাড়ছে না বরং ওপরের পাটির সামনের দাঁত দুটো ওর ছুঁচলো টাইপ মুখের ঠোঁট ঠেলে বেরিয়ে আসছে। বন্ধুরা ওকে ক্ষ্যাপাতে শুরু করল। খেলাতে নিতে চাইত না। ওর মুখের, চেহারার গঠন নিয়ে ব্যঙ্গ করত। ওই বয়সের ছেলেপুলেরা যেমন হয় আর কি। একদিন স্কুলে ব্যঙ্গের মাত্রাটা একটু বেশিই হয়ে গেল। ত্রিদিব সেদিন আর মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারল না। যে ছেলেটি ওকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করছিল তার কাঁধে সজোরে কামড়ে দিল। রক্তারক্তি ব্যপার। গার্জেন কল। যাইহোক সমস্যা মিটে গেল কিন্তু সেই থেকে ত্রিদিবের নাম হয়ে গেল ইঁদুর। কারণ দেখতেও কিছুটা ইঁদুরের মতো আবার কামড়ানোর দোষও রয়েছে। প্রতিদিন পাড়ায়, স্কুলে এই অপমানের ছিটিয়ে দেওয়া থুতু গিলতে গিলতে ত্রিদিব একসময় বুঝল ওর পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কোনও অর্থ হয় না। একদিন সন্ধেবেলা সে সোজা চলে গেল রেললাইনের ধারে। ট্রেন গেলেই ঝাঁপ মারবে। একটা ট্রেন আসছিল, দূর থেকে তার লাইট দেখা যাচ্ছিল। ত্রিদিব প্রস্তুত হয়েই ছিল। তখন সে ক্লাস এইটে। পকেটে একটা সুইসাইড নোট।
আমার মৃত্যুর জন্য আমার বন্ধুরা দায়ী, সকলে আমার চেহারা নিয়ে এত প্যাঁক দেয় সেই জন্য আমি মরে যাচ্ছি। ভগবান যেন ওদের শাস্তি দেয়। বিদায়।
ইতি
হতভাগ্য ত্রিদিব নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায় (ক্লাস এইট, মাধব স্মৃতি বিদ্যামন্দির)
পিতার নাম, প্রণব নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়
ঠিকানা মেটে পাড়া, চণ্ডীতলা, দেবাই পুকুরের পাশে সবুজ রঙের বাড়ি।
ঝাঁপ দেওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে পিছন থেকে ভাঙা গলায় ডাক। এই খোকা, সন্ধেবেলায় এই ঝোপে দাঁড়িয়ে কী করছিস? সাপখোপের আড্ডা। পড়াশোনা নেই? যা পালা, মন দিয়ে পড়াশোনা কর, নইলে আমার মতো…
ধাতব লাইন দিয়ে মেলট্রেনটা এত শব্দ করতে করতে যাচ্ছিল যে সেই আধপাগলা লোকটার কণ্ঠস্বর পুরোটা শোনা যাচ্ছিল না। কিন্তু তারমধ্যে যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার নিয়ে ফেলেছিল ত্রিদিব। পকেটের সুইসাইড নোটটা চলন্ত রেলের চাকার মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বাড়ি ফিরে সটান বইখাতা নিয়ে পড়তে বসে গেছিল। কার কথা যে কখন কার মগজে, আত্মায় গেঁথে যায় তা স্বয়ং ঈশ্বরও জানেন না, জীবন এমনই রহস্যময়। ওই সন্ধের পর থেকে ত্রিদিবের মাথায় গেঁথে গেল পৃথিবীর ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তার কাছে একটাই অস্ত্র রয়েছে তাহলো মেধা। পড়াশোনায় বরাবরই ভালো ছিল ত্রিদিব। কিন্তু ভালো এতটাই বাড়াবাড়ি রকমের পিকআপ নিল যে মাধ্যমিকে প্রথম দশজনের মধ্যে একজন। জেলার অহংকার ত্রিদিব তারপর একে একে উচ্চ মাধ্যমিক, কলেজ ইউনিভার্সিটি এবং তারপর চার্টার্ড, কোম্পানি সেক্রেটারিশিপ এতটাই দ্রুত ও সফলতার সঙ্গে পাশ করল যে ওকে ইঁদুর নামে ডাকার মতো আশাপাশে কেউই রইল না। অডিট ফার্মে অ্যাপ্রেন্টিস থাকতে থাকতেই ত্রিদিব প্রথম ওপেনিং পেল বড়সড় একটা কোম্পানিতে। সেখানে বছর দুয়েক কাজ করার পর তার থেকেও বড় আরেকটি কোম্পানিতে বছর তিনেক এবং তারপর গত কয়েক বছরে বর্তমানে মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির সিইও ত্রিদিব নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়। চারফুট আট ইঞ্চি, ছুঁচলো মুখ ত্রিদিবকে প্রকাশ্যে ইঁদুর বলা তো দূর কি বাত স্বপ্নেও কেউ ওই শব্দ উচ্চারণ করার সাহস পায় না। পৃথিবীর প্রায় বেশির ভাগ দেশ ঘুরে বেড়ানো বিপুল অর্থের অধিকারী ত্রিদিব আজ আকাশটি প্রায় মুঠোয় ধরে ফেলেছে। আর তার বিনিময়ে? হ্যাঁ বিনিময়ে ছাড়তে হয়েছে বেশকিছু। সেটা অবশ্য ত্রিদিব স্যাক্রিফাইজ বলে আদৌ মনে করে না। পুরনো গ্যাদগেদে ভ্যালুজের পশ্চাদ্দেশ কামড়ে পড়ে থাকা বাপ-মা কিংবা স্কুলের বন্ধুরা যারা একসময় ত্রিদিবকে গোটা মানুষ বলে মনে করত না বলে ওর ধারণা, তাদের সকলকে আন্তরিকভাবে ঘৃণা করত ত্রিদিব। সেই ঘৃণা, সেই প্রতিশোধস্পৃহা দিন পেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে মলিন না হয়ে আরও আরও আরও বাড়তে থাকল। তিরিশ বছর বয়সে একটা বিয়েও করেছিল সে। দিব্বি ঢাকঢোল পিটিয়ে। নেহা অগ্রবাল। অন্য একটি কর্পোরেট হাউজে চাকরি করত নেহা। সেখানকার সিএইওর সেক্রেটারি ছিল। বিজনেসের কারণেই যোগাযোগ তারপর আধাখ্যাচড়া একটা প্রেমমূলক ব্যাপার সামলে টপ করে নামি হোটেলে পার্টি দিয়ে বিয়ে। বেঁটে ছেলেদের সাধারণত তার থেকেও বেঁটে কিংবা নিজের সমান হাইটের মেয়েদের বিয়ে করার প্রবণতা থাকে কিন্তু ত্রিদিব বরাবরই মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা থেকে একটু আলাদা। ওর আকর্ষণ ছিল ওর থেকে লম্বা মেয়েদের প্রতি। পাড়ার মেয়েরাও একটা সময় ত্রিদিবকে এই বেঁটে ইঁদুরÑ বলে ডাকত, ফিকফিক করে হাসত, মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করত ত্রিদিবের, হাওয়ায় গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে মিলিয়ে যেতে ইচ্ছে করত। ছেলে হয়ে মেয়েদের কাছে অপমানিত হওয়ার মধ্যে যে আলাদা একটা প্রকট অসম্মান রয়েছে তা বেশ অল্প বয়স থেকেই ত্রিদিব টের পেত, ফলে ওর থেকে অধিক উচ্চতাবিশিষ্ট মহিলাদের প্রতিও জন্মেছিল ঘৃণা, আক্রোশ। শারিরীক কম উচ্চতাকে ত্রিদিব ক্ষমতার উচ্চতা দিয়ে জিততে চেয়েছে বরাবর। আর একটা সময়ে বুঝেও গেছিল ক্ষমতাই শেষ কথা। তার কাছে সকলে বশ। নইলে কোনও সুন্দরী নারী কোনও অসুন্দর কিন্তু অর্থ ও ক্ষমতাবানের বদলে সুপুরুষ সাফাইওলা-দরিদ্রের জীবন সঙ্গিনী হতে চাইত। কিন্তু তা হয় না। সকলেই পাওয়ারের পা-চাটা গোলাম হয়। নাহ, ঠিক সকলে না হলেও শতকরা নিরানব্বইজন মানুষ এমনই হয়। নেহা অগ্রবালও সেটাই চেয়েছিল। কিন্তু সে চেয়েছিল আরও খানিকটা বেশি। সে ত্রিদিবের ক্ষমতাকে ভালোবাসল আর শরীর ভালোবাসল অর্জুন বাজোরিয়ার। প্রখর বুদ্ধিমান ত্রিদিবের এটা বুঝতে খুব বেশিদিন সময় লাগেনি। ত্রিদিব তখন মুম্বাইতে পোস্টেড। অফিস টুরে মাঝেমাঝেই বিদেশ যেতে হয়, ত্রিদিবের সন্দেহ হলো নেহাকে নিয়ে। একজন প্রফেশনাল হ্যাকারকে দিয়ে নেহার মোবাইল, মেল, সোশাল সাইট সব হ্যাক করে যা যা দেখার, বোঝার সবই করল। কিন্তু অপরাধীকে হাতেনাতে ধরতে প্রমাণ চাই। সাতদিনের জন্য অফিস টুরে যাওয়ার নাম করে পরের দিনই আচমকা ফিরে এসে নেহা এবং অর্জুনকে ওরই ফ্ল্যাটে পুরো ফিল্মি কায়দায় ক্যাচকট কট। নেহা প্রথমে স্বীকার করতে চায়নি, বলেছিল আমি আর অর্জুন স্রেফ ভালো বন্ধু। কিন্তু নেহার অজান্তে ত্রিদিবের ব্যবস্থা করে রাখা গোপন ক্যামেরাগুলো মিথ্যে বলতে জানত না। সেগুলোর ভিডিও ফুটেজ নেহাকে দেখানোর পর নেহা বলেছিল, বেশ করেছি। তোমার বন্ধুরা তোমাকে ঠিক নামই দিয়েছিল তুমি একটা ইঁদুর। তোমাকে ভালোবাসা, তোমার সঙ্গে শোওয়া কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।
ডিভোর্সে সময় তেমন লাগেনি। কিন্তু নেহাকে ঠাসিয়ে একটা থাপ্পড় মারার ইচ্ছে ছিল ত্রিদিবের, উচ্চতার কারণেই সেটা সম্ভব হয়নি। ত্রিদিব আর বিয়ের কথা ভাবেনি। তবে শরীর জাগলে যেসব এসকর্টকে ও হায়ার করত তারা সকলেই হত ত্রিদিবের তুলনায় অনেকটা লম্বা। সেটাই ত্রিদিবের ক্রাইটেরিয়া ছিল। লম্বা মেয়েগুলো ঠিক সঙ্গম নয় বরং ধর্ষণ করত ত্রিদিব। ক্রোধে রক্তাক্ত করে দিত। অনেক এজেন্সি সেইজন্য ত্রিদিবকে বয়কট করেছিল। কিন্তু ভাত ছড়ালে কাকের অভাব আগেও হয়নি, আজও হয় না। নেহা ত্রিদিবকে বলেছিল তুমি শুধু দেখতে ইঁদুরের মতো তাই নয়, তোমার স্বভাবটাও অবিকল ইঁদুরের মতো। ভিতু, ছিঁচকে চোরের মতো স্বভাব তোমার। বন্ধুরা সঠিক চিনেছিল তোমাকে। কোনও এক অন্তরঙ্গ আবেগঘন মুহূর্তে নিজের ছোটবেলার কষ্ট নেহাকে বলে ফেলেছিল ত্রিদিব তারই মোক্ষম প্রতিদান পেয়েছিল ওই সময়ে। কাছের মানুষদের থেকে আঘাত পাওয়া ত্রিদিবের ললাটলিখন। নেহা অপমান করে চলে যাওয়ার পর ত্রিদিবের মানসিক অস্থিরতাটা আরও বেড়ে গেল। মাঝেমাঝেই মনে হতে থাকল ওর ঘরে নেংটি ইঁদুর ঘুরে বেড়াচ্ছে, চিঁক চিঁক করে চিৎকার করছে। প্রথমে এমনটা মাঝেমাঝে হতো কিন্তু তারপর বেশ ঘনঘন হতে থাকল। ফ্ল্যাটের আনাচাকানাচে তো বটেই, রেস্তোরায়, হোটেলে, এমনকি সেমিনার, কনফারেন্সের মাঝেও ত্রিদিব ইঁদুর দেখতে পেল। এরজন্য বেশ কয়েকবার অত্যন্ত অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়ল। অফিসে, কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডে ওকে নিয়ে হাসাহাসি, আলোচনা শুরু হলো। ত্রিদিব প্রমাদ গুনল। আর ও ব্যঙ্গের পাত্র কিছুতেই হবে না। ঘরের চারদিকে সিসিটিভি লাগিয়ে পরে তার ফুটেজ চেক করে দেখল আসলে কোনো ইঁদুর নেই, ও হ্যালুসিনেট করছে। সেলফ কাউন্সেলিং শুরু করল। কলকাতায় পোস্টিং হয়ে ফিরে আসার পর সেই উন্মাদনাটা আরও কয়েকগুণ বাড়ল। বুঝল আর সময় নষ্ট করা যাবে না, এরপর দেরি হয়ে যাবে। কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডে আজ তুমি যত বড় হনুই হও না কেন কাল তোমাকে আবর্জনার মতো ছুঁড়ে ফেলতে এক সেকেন্ডও সময় লাগে না। অতএব বহু কষ্টে অর্জিত এই জায়াগায় টিকে থাকতে হলে অবিলম্বে কাউন্সেলিং করানো দরকার। শহরের এক নামি সাইকিয়াট্রিস্ট সব শুনে বললেন, রেস্ট নিন, ওষুধ লিখে দিচ্ছি খান, স্ট্রেস কমান আর সবার আগে যেটা দরকার―আপনার ক্ষতটা যেহেতু আপনার কৈশোরে তৈরি। পারলে ওখানেই আবার ফিরে যান। জায়গাটা সহজ করে ফেলুন, দেখবেন ঠিক হয়ে যাবে। সব ভেবেচিন্তে ত্রিদিব ঠিক করল নিজের পৈতৃক ভিটেতে ফিরে যাবে। বাবা গত হয়েছিলেন বেশকিছু বছর আগেই। মা একা থাকতেন। মায়ের ত্রিদিবের সঙ্গে থাকার তেমন কোনও আগ্রহ ছিল না, ত্রিদিবও কোনও দিন বাবা-মাকে নিজের কাছে নিয়ে আসার কথা ভাবেনি। বাবা-মায়ের স্বাভাবিক উচ্চতাও ত্রিদিবকে পীড়া দিত। ওর এই শারীরিক গঠনের জন্য ওদের দুজনকেও দোষী মনে হতো। যাইহোক নিজের স্বার্থেই বহু বহু বছর পর ত্রিদিব এক বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে নিজের গ্রামের বাড়ি চণ্ডীতলার মেটেপাড়ায় গেল। সেখানে বাড়ির অবস্থা, পাড়ার অবস্থা প্রায় একই রয়েছে। শহুরে বিলাস ব্যসনে অভ্যস্ত ত্রিদিবের সেই পরিবেশে নাভিশ্বাস উঠে গেল কিন্তু নিজের উদ্দেশ্য সফল করার জন্য ত্রিদিব চিরকালই সবকিছু করতে পারে। ছেলে এতদিন পর বাড়ি ফিরেছে দেখে বৃদ্ধা মা খুবই খুশি। ছোট এলাকা। ত্রিদিব যে খুব বড় চাকরি করে তা প্রায় অনেকেই জানে, খবর ছড়াল, অনেকেই ত্রিদিবের সঙ্গে দেখা করতে এল। কেউ এল চাকরির সুপারিশ নিয়ে। ত্রিদিব গেল ওর স্কুলে। সেখানে পুরনো রেজিস্ট্রার বার করিয়ে ওর ব্যাচের কয়েকজন যারা এই অঞ্চলে থাকত না তাদের ঠিকানা সংগ্রহ করল। আর কয়েকজন শিক্ষকের। তারা সকলেই রিটায়ার করে গেছিলেন। পাড়ার পুরনো বন্ধুদের অনেকেই নিজের অঞ্চল ছেড়ে বাইরে যায়নি, সেখানে থেকেই কাজকম্ম করে। ত্রিদিব তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বাড়িতে ডেকে নিয়ে এল। এলাহি খাওয়াল। সঙ্গে দামি মদ। বন্ধুরা মদ খেয়ে গদগদ হয়ে বলল, তুই যত বড়ই হস না কেন আমাদের কাছে কিন্তু তুই ইঁদুরই থাকবি আজীবন। বন্ধুরা বড় হয় না।
সেই কথা শুনে ত্রিদিব ওর ছুঁচলো মুখ বেঁকিয়ে হাসল। যে কজন বন্ধু আর পাড়ায় এখন থাকে না, তাদেরও ফোন নাম্বার জোগার করল। তারপর সকলের মোবাইল নাম্বার কালেক্ট করে আবার ফিরে এল নিজের শহরে।
ত্রিদিব শহরে ফিরে যাওয়ার দিন পনেরোর মধ্যে ওর স্কুলের পুরনো বন্ধুরা প্রত্যেকেই তাদের নামে একটি করে পার্সেল পেল। চমৎকার মোড়ক। খুলতেই দেখা গেল ভেতরে রয়েছে একটি মৃত নেংটি ইঁদুর। সঙ্গে একটি চিরকুটে লেখা দ্য মাউজ ইজ ডেড। এ কোন উন্মাদের কাজ! প্রেরকের নাম, ঠিকানা, ফোন নাম্বার কোনোটিরই বাস্তবে অস্তিত্ব ছিল না। প্রতি সপ্তাহে অমন একটি করে পার্সেলে একটি করে নেংটি ইঁদুর এবং সঙ্গে চিরকূট লেখা দ্য মাউজ ইজ ডেড। দু-তিনবারের পর বন্ধুরা আর পার্সেল নিতে চাইল না। তখন তাদের পরিবারের কারও নামে। সেটাও একসময় নেওয়া বন্ধ হয়ে গেল কিন্তু ততদিনে ত্রিদিব এই অদ্ভুত খেলায় মেতে উঠেছে। বাজার থেকে ইঁদুর কিনে নিয়ে আসা, তাদের বিষ দিয়ে মারার পর ভালো প্যাকেটে মুড়ে ওর ছোটবেলার বন্ধু, প্রাক্তন শিক্ষকদের, যারা ওকে একসময় ইঁদুর নামে ডেকে ব্যঙ্গ করত তাদের নামে পার্সেল করে পাঠানো এবং সঙ্গে দ্যা মাউজ ইজ ডেড চিরকুট। উফফ কী যে মজা! পরিচিতরা পার্সেল নিতে অস্বীকার করার পর ত্রিদিব থামতে পারল না। রবার্ট সুলিভান নামের এক লেখক তাঁর বই ‘র্যাটস’-এ লিখেছেন, ইঁদুর হলো মানুষের ‘মিরর স্পিসিস’। এরা মানুষের সমান্তরাল মহাবিশ্বে বসবাস করে। মানুষের নগর এদের প্রিয় জায়গা। বইটা একাধিকবার পড়েছে ত্রিদিব। বিশেষ করে ঐ মানুষের সমান্তরাল মহাবিশ্ব কথাটি ওর বড় প্রিয়। বেশ যদি ধরেও নেওয়া যায় ও একজন মানুষ নয় আসলে একজন ইঁদুর, তাহলেও এই মানুষের পৃথিবীতে বসবাসের সম্পূর্ণ অধিকার ওর রয়েছে এবং মানুষদের উচিত বিশ্বের প্রতিটি ইঁদুরকে ভালোবাসা, তাকে কাছে রাখা।
মুকুন্দপুরের গগনচুম্বী মস্ত আলিশান ফ্ল্যাটের আঠেরোশ স্কোয়ারফুটে একা ত্রিদিব নারায়ণ একটা সময় টের পেল ওর আর অফিস করতে, লম্বা মেয়ের সঙ্গে সেক্স করতে, ডাক্তারের বলে দেওয়া ওষুধ খেতে ভালো লাগছে না। ওর ভালো লাগছে ফ্ল্যাটের মধ্যে খাঁচায় ভরে রাখা শতশত সাদা, ধূসর ইঁদুর, তাদের কিঁচকিঁচ শব্দ, তাদের গায়ের, মল-মূত্রের গন্ধ। বিষ খাওয়ানোর পর ওদের তুলতুলে, রোমশ মৃতদেহগুলো দুহাতে চটকাতে এক অদ্ভুত আরাম! প্রতিটি মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে একটি বার্তা দ্যা মাউজ ইজ ডেড। দিতে হবেই। ওর কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডের যারা পরিচিত এবার তাদের অমন পার্সেল পাঠানো শুরু করল। অফিসে আর যায় না। দিনরাত এক করে শুধু পার্সেল বানানো আর পাঠানো। সব চেনা পরিচিতদের পাঠানোর পর তারপর ওর ক্লায়েন্টদের ডেটাবেস থেকে অ্যাড্রেস বার করে পাঠানো শুরু। পৃথিবীতে মানুষের যেমন অভাব নেই, ইঁদুরেরও অভাব নেই। মানুষের সঙ্গে ইঁদুরের লড়াই যুগযুগান্তের। নতুন প্রস্তর যুগ থেকে চলে আসছে এই যুদ্ধ। দুই প্রজাতি পরস্পরকে শেষ করে ফেলতে চেয়েছে। পুরোপুরি মুছে দিতে চেয়েছে পৃথিবীর বুক থেকে। কিন্তু তারা বসবাসও করেছে সবচেয়ে পাশাপাশি, বলতে গেলে একে অপরকে জাপটে। বিশ্বের অন্যতম উন্নত শহর নিউইর্ক ইঁদুরের জন্য বিখ্যাত। সমীক্ষা বলছে এই শহরে প্রতি চারজন মানুষ পিছু একটি ইঁদুর রয়েছে। বিশ্বের ফিনানশিয়াল ক্যাপিটাল নিউইউর্কে যদি ইঁদুরের সংখ্যা কুড়ি লাখ হতে পারে তাহলে এটাই প্রমাণিত হয় যে ইঁদুরের গুরুত্ব মানুষের থেকে কিছু কম নয়। কখনও ইঁদুরের প্রতি মাত্রাধিক ভালোবাসা কখনও তাকে তীব্রঘৃণা এই ধরনের নানা রকম পরস্পরবিরোধী আত্মোপলব্ধির কথা ডায়েরিতে লিখতে থাকল ত্রিদিব। এবং একটা সময় বাইরের জগতের সঙ্গে নিজেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে ফেলল।
দুনিয়া থেকে সব ইঁদুর নির্মূল করতে হবে। মুছে দিতে হবে নামটা। সেই দায়িত্ব ওকেই নিতে হবে। আচমকা ত্রিদিব এক সন্ধেয় টের পেল খাঁচাগুলোর দরজা খুলে সব ইঁদুর ওর ফ্ল্যাটের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে। ওদের জ্যান্ত ধরার জন্য অমানুষিক পরিশ্রম করল কিন্তু জ্যান্ত ইঁদুর ধরা অত সহজ নয়, অতবড় ফ্ল্যাটে প্রচুর ফার্নিচারের আনাচে কানাচে ইঁদুরগুলো লুকিয়ে পড়ল, ত্রিদিব ক্রোধে গর্জন করে ইঁদুরগুলো ধরার মরিয়া চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে ইঁদুর মারার কড়াবিষগুলো একসঙ্গে ঢেলে খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে ঘরের সর্বত্র ছড়িয়ে দিল। সোল্লাসে দেখল লুকিয়ে পড়া ইঁদুরগুলো বেরিয়ে এসে সেই খাবার তরিবত করে খাচ্ছে। আহ কী আনন্দ!
তারপর পরম তৃপ্তিতে পেট ভরে ডিনার সেরে ঘরের প্রতিটা দেওয়ালে ত্রিদিব লিখল দ্য মাউজ ইজ ডেড। নিচে লিখল মাস্ট বি ডেড। তারপর শুয়ে পড়ল।
ঘুম ভাঙার পর ত্রিদিব টের পেল ঘরে বিশ্রী গন্ধ। কিছু একটা মরে পচেছে। ইস্স্ নিশ্চয়ই ইঁদুর! কিন্তু এত দ্রুত পচল কীভাবে? তাহলে কি কয়েকদিন পর ঘুম ভাঙল ওর? হতে পারে। তবে ইঁদুরগুলো কোথায় গেল? মরা ইঁদুরগুলো কোথায়? বিষ খাওয়া ইঁদুরগুলো হন্নে হয়ে খুঁজতে থাকল। একটাকেও পেল না। এ কী করে সম্ভব! দ্যা মাউজ মাস্ট বি ডেড। তাহলে কই সেগুলো? কী বিশ্রী বোঁটকা গন্ধ। ত্রিদিবের দম বন্ধ হয়ে আসতে থাকল। এখনই সিকিউরিটিকে ফোন করতে হবে কিংবা পেস্ট কন্ট্রোল। কাকে করা যায়? কে খুঁজে বার করতে পারে পচে দুর্গন্ধ ছড়ানো মৃত ইঁদুরগুলো? ভাবতে ভাবতেই ত্রিদিবের ফ্ল্যাটের দরজায় দুমদুম করে ধাক্কা। কারা এইভাবে অভদ্রের মতো ধাক্কা দিচ্ছে? তারমানে গন্ধটা অনেকদূর ছড়িয়েছে। যাক এবারে হিল্লে হবে। ত্রিদিব ওর মেন দরজাটা খুলে দেওয়ার জন্য বেডরুম থেকে বেরিয়ে ড্রয়িংরুমের দিকে যেতে গেল তার আগেই ওর দরজা ভেঙে হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে পড়ল অনেকগুলো মানুষ। ফ্ল্যাটের কয়েকজন, সিকিউরিটি গার্ড তো রয়েছেই দুজন পুলিশকেও দেখতে পেল ও। এ কী! ইঁদুর ধরতে পুলিশ এসেছে! হা হা করে হেসে উঠতে গেল ত্রিদিব কিন্তু সেই সুযোগ পেল না। অবাক হয়ে দেখল, সবকটা লোক নাকে রুমাল চেপে ওর বেডরুমের দিকে যাচ্ছে। তারপর খাটের নিচ থেকে মরা ইঁদুরের মতোই খুঁচিয়ে টেনে বার করে আনছে ওরই শরীরটা!
পুলিশ অফিসারটি মনোযোগ দিয়ে ত্রিদিবের কয়েকদিনের বাসি মৃতদেহটি অবজার্ভ করে আন্দাজ করলেন, সম্ভবত বিষক্রিয়ায় মৃতু। কী বিষ সেটা পোস্টমর্টেমে জানা যাবে। ত্রিদিবের বডিটা একটা প্লাস্টিকে মুড়ে ফেলা হলো, ঠিক যেভাবে ত্রিদিব মৃত ইঁদুরগুলো পার্সেল করার জন্য প্যাকেটে ভরত। তারপর…
কলকাতা থেকে
সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ