আর্কাইভক্রোড়পত্র

ক্রোড়পত্র : মুক্তিযুদ্ধের অমর আখ্যান : মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর : নতুন প্রজন্মের হাতে ইতিহাসের পতাকা : মফিদুল হক

দেখতে দেখতে পার হয়ে গেল অনেকগুলো বছর। বাংলাদেশ-রাষ্ট্রের বয়স ছাপিয়ে গেল পঞ্চাশ। পঞ্চাশ বছর নেহায়েৎ কম সময় নয়, তবে আমরা যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম, একাত্তরের উজ্জ্বল নিষ্ঠুর সময়ের সাক্ষী, তাঁদের কাছে যুদ্ধের অতীত যেমন মনে হয় অদূরবর্তী স্মৃতি, তেমনি অতিক্রান্ত পথরেখা মনে হয় বড় দ্রুতই পার হয়ে যাওয়া সময়। একইভাবে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরও পেরিয়ে এল পঁচিশটি বছর। ১৯৯৬ সালের সূচনার সেই বিকেল ছিল হঠাৎ-বৃষ্টির পশলায় ধোয়া, উদ্বোধনী আয়োজনে সমবেত অভ্যাগতেরা প্রায় সবাই হয়েছিল বৃষ্টিতে স্নাত, তবে তাতে কারও বিশেষ পরোয়া ছিল না, বরং যখন শহিদ পরিবারের সদস্য-সদস্যারা প্রজ্বলিত করলেন শিখা চির-অম্লান, শিল্পীরা গাইছিলেন গান, ‘মুক্তির মন্দিরে সোপানতলে’, তখন চোখ সিক্ত হয়ে উঠেছিল অনেকের, একাকার হয়ে গিয়েছিল বৃষ্টির পানি ও অশ্রুর ধারা।

আমাদের কাছে মনে হয় এই সেদিন, তবে চোখে দেখতে না পারলেও যখন দেখা পাই নবীন-নবীনার, যারা কোনও না কোনও সময় এসেছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে, হেঁটে গেছে ইতিহাসের ভেতর দিয়ে, তাঁদের জন্মেরও আগের ঘটনা দ্বারা আলোড়িত হয়েছে প্রবলভাবে, তখন বুঝতে পারা যায় সময় পাল্টে গেছে কতটা, বোঝা যায় স্মৃতি-সংরক্ষণের গুরুত্ব, জাদুঘরের শক্তিময়তা। এমন অনেকের দেখা মেলে পরে যারা জীবনের নানা ক্ষেত্রে কর্মরত হয়েছে, পেশাগত জীবনে পরিচয় দিচ্ছেন দক্ষতার, হয়ত জাদুঘরে এসেছিলেন তাদের কৈশোরে বা যৌবনে. তারপর কেটে গেছে পনেরো কিংবা কুড়ি বছর. কিন্তু স্মৃতির সেই আলোড়ন, ইতিহাসের মুখোমুখি হওয়ার অনুভূতি তো তাদের ছেড়ে যায়নি। এমন সব তরুণ-তরুণীর পরিচয় পেলে বোঝা যায় কতটা পথ পেরিয়ে এসেছে এই জাতি এবং কীভাবে সংরক্ষণ করেছে স্মৃতি, রেখেছে তা’ বহমান।

এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে ইয়ান মার্টিনের কথা, একাত্তরে এই তরুণ ছিলেন সামাজিক দায়বদ্ধতা ধারণকারী সক্রিয় ব্যক্তি। বিভিন্ন কর্মকাণ্ডর সঙ্গে সাংবাদিকতাও করেন তখন। একাত্তরের মার্চে তিনি ছিলেন ঢাকায়, বিলেতের উদারবাদী সাময়িকী ‘নিউ স্টেটসম্যান’-এ লিখেছেন পাকবাহিনীর নৃশংসতার মর্মস্পর্শী ভাষ্য। পরে তিনি অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মহাসচিব হিসেবে কাজ করেছেন। বাংলাদেশে ইয়ান মার্টিনের অনেক বন্ধু রয়েছেন। বঙ্গবন্ধু-হত্যার পর দেশ থেকে বিতাড়িত কিংবা প্রতিবাদী প্রবাসী বাঙালিদের সঙ্গে তাঁর ছিল বিশেষ যোগাযোগ। তিনি ঢাকা এসেছেন অনেকবার, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর পরিদর্শন করেছেন, জাদুঘরে বিশেষ বক্তৃতা প্রদান করেছেন। ইয়ান মার্টিন একবার আমাদের বলেছিলেন, বাংলাদেশের তরুণদের সঙ্গে আলাপকালে মনে হয় তারা যেন মুক্তিযুদ্ধ দেখেছে। তাঁর এই কথায় বাংলাদেশের বাস্তবতার পরিচয় মেলে। অনেক ঘাত-প্রতিঘাত আক্রমণ-আঘাত সত্ত্বেও বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা বহমান রয়েছে, বাহিত হয়ে চলেছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।

স্মৃতির এই বহমানতার নির্মাতা কারা সেই প্রশ্ন আমাদের বিশেষ বিবেচনা দাবি করে। পাশাপাশি এটাও তো মনে করতে হবে স্মৃতি সংরক্ষণে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী সরকারের সকল প্রচেষ্টা রুদ্ধ হয়ে গেল পঁচাত্তরের মধ্য-আগস্টে স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। সেই থেকে স্মৃতি সংরক্ষণে নিছক উদ্যোগহীনতা নয়, এর পাশাপাশি চলছিল ইতিহাসের বিস্মৃতি ও বিকৃতির আয়োজন। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এই আয়োজন পেয়েছিল বিশালতা, তবে সার্বজনীনতা যে পায়নি সেটা লক্ষণীয়। বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির সংগ্রামে বাংলাদেশ কখনও পিছপা হয়নি। ১৯৭৫-পরবর্তী দুঃসময়েও আমরা দেখেছি গান-নাটক-কবিতা- চলচ্চিত্র- ছবিতে মিলে এবং সর্বোপরি স্মৃতিকথায় মুক্তিযুদ্ধের বহুমাত্রিকতা নানাভাবে ফুটে উঠেছে। কেবল গ্রন্থ-রচনার দিকটি যদি বিবেচনায় নিই, তবে বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করতে হয়, মুক্তিযুদ্ধ কত মানুষের অন্তরে তাগিদ সৃষ্টি করেছিল দুঃসহ দিনের অভিজ্ঞতা এবং প্রতিরোধের শৌর্য লিখিতভাবে প্রকাশ করার। মুক্তিযুদ্ধের পর্যালোচনা নিয়ে মতের বিভিন্নতা, দৃষ্টিভঙ্গির ফারাক থাকা অস্বাভাবিক নয়, তবে অস্বাভাবিকতা ছিল দীর্ঘ গণসংগ্রামের মূল তাৎপর্য এবং বঙ্গবন্ধুর অনন্যতা বিচারে। সেখানে রাজনৈতিক অসাধুতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতা নানা আবরণে ছিল সক্রিয়। তবে মুক্তিযুদ্ধ যে মানবিক মাত্রা সঞ্চার করেছিল সেই অগণিত ব্যক্তিগত বয়ান, দুঃখের কিংবা প্রতিরোধের, জন্ম দিয়েছিল মানবিকতার সংহতি ও বিস্তারের। কালক্রমে জন্ম নিল মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য শীর্ষক এক পৃথক ঘরানা। এক্ষেত্রে আরেক ইতিহাসের জন্ম দিল জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলো, যা জনপ্রিয়তায় কেবল শীর্ষের নয়, মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী প্রজন্মের সঙ্গে যুদ্ধদিনের পরিচয়-সাধনে পালন করল দৃঢ়-সংবদ্ধ ভূমিকা। এই মহীয়সী নারী আপন পরিবারের কাহিনি রূপান্তর করলেন প্রায় সার্বজনীন অভিজ্ঞতায় এবং নবীন-নবীনার অন্তরে গড়ে নিলেন নিবিড় অবস্থান। ফলে গণহত্যাকারী যুদ্ধাপরাধীরা যখন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় আবার খামচে ধরে জাতীয় পতাকা, তখন জাহানারা ইমামের ডাকে বিভিন্ন স্তরের মানুষ, বিশেষভাবে তরুণ প্রজন্ম, গড়ে তোলে অভাবনীয় প্রতিরোধের সামাজিক আন্দোলন। ‘একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি’ তরুণের মানসপটে যুদ্ধাপরাধীদের জন্য যে ঘৃণা এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকার গড়ে তোলে সেসবের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী।

এমনি পটভূমিকায় ১৯৯৬ সালে সামাজিক উদ্যোগ হিসাবে প্রতিষ্ঠা পায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। প্রতিষ্ঠার পর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি, বহু মানুষের সম্পৃক্ততা ও অবদানে সমৃদ্ধ ও বিকশিত হয়ে চলেছে জাদুঘর। যে-তরুণেরা একদা দেখেছেন জাদুঘর, সমৃদ্ধ হয়েছেন এর কর্মকাণ্ডে. তাঁরা সক্রিয় হয়েছেন যার যেমন সুযোগ বা সাধ্য, সেই অনুসারে স্মৃতির সংগ্রামে শামিল হতে। এর নানা প্রকাশ নানাভাবে ঘটছে, সে আরেক ইতিহাস, তবে সব মিলিয়ে বলা যায়, বিপুল আত্মদানের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীনতা, আর স্বাধীন ভূমিতে মুক্তির লড়াই রয়েছে অব্যাহত। মুক্তিযুদ্ধের এই বহমানতায় স্মৃতির আধার হিসেবে নবীনের প্রতি হাত বাড়িয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।

বাংলাদেশে তারুণ্যের যে-শক্তিমত্তা বিভিন্নভাবে প্রদর্শিত হয়েছে তা’ উপচে পড়েছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ক্ষেত্রেও। জাদুঘর হয়ে ওঠে সেই বিচরণ ক্ষেত্র, যেখানে মুক্তিযুদ্ধের মানুষের সঙ্গে নবীনের মিলনের অবকাশ তৈরি হয়। মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাধারা, মূল্যবোধ এবং ইতিহাসের বহু ধরনের উপস্থাপনের সঙ্গে নবীন প্রজন্মের যোগসূত্র রচনা সম্ভব হয় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সুবাদে। আর এখন বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীতে নবীনেরই প্রাধান্য, মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম অপসৃয়মাণ, ফলে স্মৃতির পরম্পরা ধারণ ও বিকাশে নবীনের ভূমিকা হয়ে উঠছে মুখ্য। সেখানে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর যে-ভূমিকা পালন করছে তা’ আরও ফলপ্রদ হতে পারে নবীনের অধিকতর সক্রিয়তার মাধ্যমে। এর নানা প্রকাশ ঘটছে জাদুঘরের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে। আমরা তার কয়েকটি দিকে সামান্য দৃষ্টিপাত করতে চাই।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের জন্য বিশেষ ফলপ্রসূ হয়েছে এর ভ্রাম্যমাণ জাদুঘর কর্মসূচি, ভেতরে সজ্জিত ইতিহাসের উপকরণ নিয়ে বড় আকারের এই বাস পৌঁছে যায় দেশের আনাচে-কানাচে। ২০০২ সাল থেকে বিশেষভাবে তা’ পরিচালিত হচ্ছে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায়। জাদুঘরের কর্মীদলের প্রাক-যোগাযোগের পর কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দিনব্যাপী পরিচালিত হয় প্রদর্শনীর কর্মসূচি। শিক্ষার্থীরা তাদের শ্রেণিকক্ষে কিংবা হলঘরে দেখে জাদুঘর প্রযোজিত তানভির মোকাম্মেল নির্মিত মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্যচিত্র, বাসের ভেতরের খুদে জাদুঘর দর্শনও তাদের জন্য নতুন অভিজ্ঞতা। ছোট আকারে হলেও বাস্তব উপকরণের মাধ্যমে ইতিহাসের উপস্থাপনা কিশোর মনে আলোড়ন তুলতে সক্ষম। সবশেষে জাদুঘরের পক্ষ থেকে আবেদন জানানো হয়, শিক্ষার্থীদের জন্ম তো মুক্তিযুদ্ধের অনেক পরে, মুক্তিযুদ্ধের সবকিছুই তাদের দেখার বাইরে, তারপরও জাদুঘরের প্রদর্শনী তাদের মধ্যে যে সাড়া তোলে সেটা যেন তারা কাজে লাগায়। এমন কাজের একটি সহজ সুযোগ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর তাদের সামনে মেলে ধরে। ছাত্রছাত্রীরা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি বটে, তবে তাদের পরিবার কিংবা পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যে অনেকের রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো দেখার অভিজ্ঞতা। এমন কাউকে বেছে নিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা শুনে জাদুঘরে লিখে পাঠাবার আবেদন জানানো হয় তাদের প্রতি। সহজভাবে এই কাজ সম্পাদনের উপায়ও তাদের বলে দেওয়া হয়। জাদুঘর প্রচারিত লিফলেটে বলা হয়েছে :

‘তোমরা প্রত্যেকে নিজ পরিবারে, পাড়ায়-মহল্লায় কিংবা পরিচিতজনের মধ্যে প্রবীণ কাউকে বেছে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধকালে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা জানতে চাইবে। তোমরা যাঁর কাছে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর কথা জানতে চাইবে হতে পারে তিনি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা, কিংবা হতে পারে তিনি সে সময় ছিলেন তোমাদেরই মতো স্কুল বা কলেজের ছাত্র, কিংবা তিনি হতে পারেন গৃহবাসী কোনও বালিকা বা নারী। এই মানুষটি যেই হোন না কেন এটা মনে রাখবে মুক্তিযুদ্ধকালের প্রতিটি মানুষের অভিজ্ঞতাই মূল্যবান, প্রত্যেকের দেখার মধ্যেই আছে ইতিহাসের উপাদান।’

এই আবেদনে সাড়া দিয়ে সারা দেশের শিক্ষার্থীরা মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনছে প্রবীণদের কাছে এবং তা’ লিখে পাঠাচ্ছে জাদুঘরে। প্রত্যক্ষদর্শীর এই ভাষ্যের সংখ্যা ইতোমধ্যে পেরিয়ে গেছে ৬০,০০০। এই কাজে স্বেচ্ছায় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন শিক্ষকেরা এবং এর মূল কারিগর নবীন শিক্ষার্থীবৃন্দ। কেবল সংখ্যায় নয়, আরও নানা দিক দিয়ে এই কাজ গুরুত্ববহ।

২০১৬ সাল থেকে স্বাধীনতা দিবস উদযাপনে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে বর্তমান প্রজন্মের অভিযাত্রীদল আয়োজিত অদম্য পদযাত্রা কর্মসূচি দ্বারা। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের বাণী তুলে ধরে তরুণ এই পদযাত্রীদল ২৬ মার্চ দল বেঁধে হেঁটে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার থেকে পৌঁছয় সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে। যাত্রাপথে তারা ছুঁয়ে যায় ইতিহাসের স্মৃতিবহ নানা স্থান এবং এভাবে পদযাত্রায় যোগ করে আলাদা মাত্রা। তাদের আবেদনে বলা হয়েছে :

‘আমাদের অসামান্য শোক, সাহস আর গৌরবের স্থানগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে হৃদয়ে জাগরণ তোলে অভিযাত্রীরা। ৭ মার্চ-এর উত্তাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে বাঙালির মুক্তি ও স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর উদাত্ত স্লোগানে মুখরিত হয় অভিযাত্রীরা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পাশ দিয়ে ধানমণ্ডি ৩২ হয়ে অভিযাত্রীরা যায় আগারগাঁও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রদক্ষিণ শেষে মিরপুর বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর তুরাগ নদীর পাড় ধরে দিগন্তজোড়া ধান ক্ষেতের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কবি নির্মলেন্দু গুণের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে উচ্চারিত হয়―

‘বাতাস―বাতাস শুধু নয়, ত্রিশ লক্ষ মানুষের দীর্ঘশ্বাসময়।’

নৌকায় ভেসে সাদুল্লাপুরের শতবর্ষী বটের ছায়ার পরশ নিয়ে বেগুনবাড়ি, আক্রান, খাগান, কলমা গ্রামের মেঠোপথ ধরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে অভিযাত্রীদল ছুটে চলে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধের উদ্দেশে।’

এভাবে দলবদ্ধভাবে সারাদিনের পথ পেরোবার মধ্যদিয়ে সৃজনশীল উদ্যমে ইতিহাস ধারণ করতে উদ্যোগী তরুণদল। এখন এই কর্মসূচি পরিণত হয়েছে নিয়মিত বার্ষিক ঘটনায় এবং বিশেষভাবে আলোড়িত করছে নবীনদের। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ঘিরে রয়েছে এমনি আরও কতক উদ্যোগ, যার চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে সম্পৃক্ত তরুণদল। এখানে উল্লেখ করা যায় জাদুঘর প্রবর্তিত মুক্তি ও মানবাধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক প্রামাণ্যচিত্র উৎসব, যা এখন প্রতিবছর নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এবং ক্রমেই প্রসারিত হচ্ছে আকারে, গভীরতর হচ্ছে ভাবনা ও কর্মে।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আরেক তাৎপর্যময় উদ্যোগ গণহত্যা বিষয়ক গবেষণা এবং করণীয় নির্ধারণে সক্রিয় ‘সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব জেনোসাইড অ্যান্ড জাস্টিস’, বাংলাদেশের গণহত্যার বাস্তবতা, এর বিভিন্ন দিক, বিচারের প্রয়াস ইত্যাদি জরুরি বিষয় অধ্যয়ন ও তা বিশ্ববাসীর কাছে মেলে ধরতে সেন্টার সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। তরুণ গবেষকদের আগ্রহী, অনুপ্রাণিত ও দক্ষ করে তুলতে প্রশিক্ষণ-অধ্যয়ন ও গবেষণার বিভিন্ন উদ্যোগ সেন্টার নিয়ে আসছে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বাংলাদেশের গণহত্যা ও বিচার ঘিরে সাতটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করেছে এবং ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব জেনোসাইড স্কলার্সের প্রতিষ্ঠানিক সদস্য হিসেবে কাজ করছে। এক্ষেত্রে তরুণরা যে-ভূমিকা পালন করছে তা’ অনেকের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে, তরুণ গবেষকেরা কেবল অতীত গণহত্যা নয়, চলমান রোহিঙ্গা গণহত্যা নিয়ে বাস্তব তথ্যানুসন্ধান ও বিশ্লেষণের কাজ করছে, যা’ বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য।

এভাবে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম গৌরব ও বেদনার অতীত ইতিহাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে শান্তি ও সৌহার্দের উন্নত সমাজ গঠনে অবদান রাখবে, সেই প্রত্যাশা আমরা করতে পারি।

 লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button