আর্কাইভক্রোড়পত্র

ক্রোড়পত্র : মুক্তিযুদ্ধের অমর আখ্যান : স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র―কালুরঘাট থেকে বালিগঞ্জ : আশফাকুজ্জামান

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র―কালুরঘাট :

‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ একটি অস্থায়ী বেতার কেন্দ্র। একাত্তরের ২৬ মার্চ  সন্ধ্যায় এক ভয়ানক কঠিন সময়ে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় দেশে ছয়টি বেতার কেন্দ্র ছিল। একমাত্র চট্টগ্রাম কেন্দ্র ছাড়া―ঢাকা, রাজশাহী, রংপুর, সিলেট, খুলনাসহ সবগুলো কেন্দ্র পাকিস্তানিদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ২৫ মার্চ গভীর রাতে ঢাকাসহ পূর্ব বাংলার বড় শহরগুলোয় শুরু হয় গণহত্যা। গ্রেপ্তার করা হয় বাংলার মাটি ও মানুষের নেতা বঙ্গবন্ধুকে। গ্রেপ্তারের আগেই তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। রেডিও ট্রান্সমিশন সেটের মাধ্যমে এ ঘোষণা ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা জেনে যায়। ঘোষণা পৌঁছে যায় বিভিন্ন জায়গায় । ২৬ মার্চ ভোরে চট্টগ্রামের প্রধান সড়কে বাঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার খবর মাইকে প্রচার হয়। এটি ছিল একটি ইংরেজি সাইক্লোস্টাইল কপি। এর অনুবাদ করে অনেকগুলো কপি করা হয়। ২৬ মার্চ বেলা ২টা ১৫ মিনিটে আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান  চট্টগ্রাম বেতারে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। সুদূরপ্রাসারী প্রতিক্রিয়া হয় এ ঘোষণার। এটি বাংলাদেশ ও কলকাতা থেকে শোনা যায়।

 সেসময় বেলাল মোহাম্মদ, আব্দুল্লাহ আল ফারুক ও চট্টগ্রাম ফটিকছড়ি কলেজের সহ-অধ্যক্ষ আবুল কাশেম সন্দ্বীপসহ কয়েকজন বেতার কেন্দ্র চালুর কথা ভাবেন। বেতারই হচ্ছে একমাত্র মাধ্যম যার সহায্যে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা মানুষের কাছে পৌঁছানো যাবে। এই ভাবনা থেকে তারা চট্টগ্রাম বেতারকে কাজে লাগানোর কথা ভাবেন। কিন্তু এখানে চরম নিরাপত্তার ঝুঁকি রয়েছে। প্রথমত, যে কোনও সময় পাকিস্তান আর্মি এটা আক্রমণ করতে পারে। দ্বিতীয়ত, চট্টগ্রাম বন্দরে রয়েছে অস্ত্র বোঝাই সোয়াত ও বাবর জাহাজ। সেখান থেকে শেল এসে পড়তে পারে। নিরাপদ দূরত্বে যাওয়া দরকার। সাধারণত প্রত্যেকটা বেতারের একটা ইমার্জেন্সি স্টুডিও থাকে। তখন কালুরঘাট ছিল চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের ইমার্জেন্সি স্টুডিও। তখন তারা আগ্রাবাদ থেকে কালুরঘাট চলে যান। দ্রুত সব ব্যবস্থাপনা অনুসারে ২৬ মার্চ সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে অনুষ্ঠান শুরু করেন। নাম দেন ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’। সেদিন আবুল কাশেম সন্দ্বীপের কণ্ঠ থেকে প্রচারিত প্রথম বাক্যটি ছিল ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী কেন্দ্র থেকে বলছি।’  সে সন্ধ্যায় প্রায় ৪০ মিনিট অনুষ্ঠান সম্প্রচার হয়ে হয়েছিল।

এরই মধ্যে জরুরি হয়ে পড়ে বেতারের নিরাপত্তা। তখন মেজর জিয়াউর রহমান ছিলেন পটিয়ায়। বেতারের নিরাপত্তার জন্য তাঁর সাহায্য চাওয়া হয়। তিনি ৩ লরি সৈন্য পাঠান।

২৬ ও ২৭ মার্চ বেশ কয়েকজন বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করেন। কিন্তু ওই সময় বঙ্গবন্ধুর পক্ষে মেজর জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা সবাইকে আরও বেশি আশ্বস্ত করেছিল যে বঙ্গবন্ধু ও বাঙালিদের নিজস্ব সামরিক বাহিনী আছে।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ছিল এক অকল্পনীয় শক্তি। স্বাধীনতার এত বছর পর আজ সেটা কল্পনা করাও কঠিন। এই কেন্দ্রের প্রথম অনুষ্ঠান শোনামাত্র  অনেকে অশ্রু সংবরণ করতে পারেনি। সে অশ্রু ছিল গভীর আত্মবিশ্বাসে ঘুরে দাঁড়াবার। বাঙালি সামরিক বাহিনী, পুলিশ, ইপিআর সদস্য, আনসার, মুক্তিবাহিনী ও পূর্ব বাংলার আপামর সাধারণ মানুষকে নিয়ে প্রতীকী অর্থে যদি মনে করা হয় সবাই মিলে একটা ফ্রন্ট, তাহলে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ হলো বাংলাদেশ সৃষ্টির মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের দ্বিতীয় ফ্রন্ট। অনেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রকে  মুক্তিযুদ্ধের ১২ তম সেক্টর বলে অভিহিত করেছেন।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ছিল সময়ের সর্বপ্রথম সাংগঠনিক উদ্যোগ। যুদ্ধকালীন প্রচারমাধ্যম। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা মনে করেছিল তারা যা ইচ্ছে তা-ই করতে পারবে। তাদের প্রতিরোধ করার কেউ নেই। কিন্তু স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রথম প্রতিবাদী শক্তি হিসেবে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল তাদের বিজয়-অহংকার। দেশের সীমা ছাড়িয়ে দ্রুত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পাকিস্তানি শাসকদের মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে এই বেতার। বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা, ভয়, আতঙ্ক সবকিছু নিয়ে ২৬ মার্চ থেকে কালুরঘাটে অনুষ্ঠান সম্প্রচার হতে থাকে।

মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই বঙ্গবন্ধুর গ্রেপ্তারের খবর শুনলে মানুষ হতাশ হয়ে পড়বে। বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে। এ আশঙ্কা থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। ২৫ মার্চের পর পাকিস্তান সরকার বারবার বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের খবর প্রকাশ করে যাচ্ছিল, কিন্তু স্বাধীন বাংলা বেতার অব্যাহতভাবে তা অস্বীকার করছিল। বেতার থেকে বলা হয়, বঙ্গবন্ধু সম্পূর্ণ সুস্থ আছেন। তিনি বিপ্লবী পরিকল্পনা কেন্দ্রে আছেন। তিনি সরকার গঠন করেছেন। সেখান থেকে মুক্তিবাহিনীকে নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছেন। এতে পাকিস্তানিরা হতাশ ও বাঙালিরা উদ্দীপ্ত হচ্ছিল। অবশেষে ১২ এপ্রিল  পাকিস্তানি শাসকেরা বাধ্য হয়ে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের সচিত্র খবর প্রকাশ করে।

 এদিকে পাকিস্তানের জল্লাদ বাহিনী নির্বিচারে মানুষ হত্যা করছে। এ যেন মৃত্যুর মুখে অসহায় আত্মসমর্পণ। এমন একটি পরিস্থিতিতে জন্ম নিয়েছিল ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’। অনেকেই এ কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। আবার চলেও গেছেন। কিন্তু সৈয়দ আব্দুস শাকের, বেলাল মোহাম্মদ, রাশিদুল হোসেন, আমিনুর রহমান, শারফুজ্জামান, মুস্তফা আনোয়ার,  আব্দুল্লাহ আল ফারুক, রেজাউল করিম চৌধুরী, আবুল কাশেম সন্দ্বীপ, কাজী হাবিব উদ্দীন এই ১০ জন সদস্য শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যুক্ত ছিলেন। এঁদের বলা হয় স্বাধীন বাংলা বেতর কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ।

ভয়াবহ দুঃসময় সাড়ে সাত কোটি মুক্তিকামী বাঙালির মনোবলকে অক্ষুণ্ন রাখার জন্য এই বেতার কেন্দ্রের কলা-কুশলীরা নিরন্তর কাজ করে গেছেন। বেতারের এক একটি শব্দ যেন এক একটি বুলেট হয়ে বেরিয়েছে। তাদের সৃষ্টিশীল অনুষ্ঠানমালা মুক্তিযুদ্ধ ও দেশের মানুষকে জাগিয়ে তুলত।

মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র নানা উদ্দীপনা ও দেশপ্রেমমূলক অনুষ্ঠান প্রচার করেছে।  এভাবে উৎসাহ  এবং সাহস জুগিয়েছে বাঙালিকে। এ কেন্দ্র থেকে বহির্বিশ্বের মানুষ জানতে পেরেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূচনা পর্বের কথা।

 সে সময় তথ্যপ্রযুক্তি বলে তেমিন কিছু ছিল না। সময়ের খবর পাওয়া যেত না সময়ে। গ্রামাঞ্চলে পত্রিকা যেত প্রায় একদিন পর। তখন অনেক খবরই জানা যেত না। এমন একটি কঠিন সময় এ দেশের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল।  কিন্তু স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে আমাদের খবর দেশের সীমা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ছড়িয়ে পড়েছিল।

 ২৬ থেকে ৩০ মার্চ ৫ দিন কালুরঘাটে বেতার সম্প্রচার হতে থাকে। সেদিন ছিল ৩০ মার্চ। বেলাল মোহাম্মাদ, আবুল কাশেম সন্দ্বীপ, আবদুল্লাহ আল ফারুক, রাশিদুল হোসেন, আ. ম. শারফুজ্জামানসহ তাঁদের দল দুপুরে দুপুরের অধিবেশন শেষ করেছেন, প্রস্তুতি চলছে বিকেলের অধিবেশনের। আনুমানিক  দুপুর ২টা বা ২.১৫ মিনিট হবে। হঠাৎ বিমানের আওয়াজ। দুটি বিমান ট্রান্সমিটার ভবনের ওপরের আকাশে চক্কর দিচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিমান দুটো চলে গেল। কেউ কিছু বুঝে উঠতে পারছেন না কী হলো। এসব ভাবনা শেষ হতে না হতেই বিমান দুটো আবার ফিরে এসে প্রচণ্ডভাবে বিমান থেকে হামলা শুরু করল। তখন জীবন বাঁচানোর জন্য যে যার মতো ছুটতে থাকে। এ হামলায় কেউ নিহত বা আহত হলো না। কিন্তু  সবচেযে বড় ক্ষতি হলো বেতার সম্প্রচার যন্ত্রের। কালুরঘাটের ১০ কিলোওয়াট ট্রান্সমিটার এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় যে, এখান থেকে আর কোনওভাবে সম্প্রচার সম্ভব হলো না।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র―কালুরঘাট থেকে পটিয়া :

দেশের মাটিতে পাকিস্তান আর্মির প্রথম বিমান হামলা। আর সেটি হয়েছিল কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। তারপরও বলতে হবে ওটি ছিল একটি সৌভাগ্যের দিন। কারণ সেদিনের হামলায় মানুষের কোনও ক্ষতি হয়নি। কেবল রাস্তার পাশে একটি কুকুর মরে ছিল। এ ধরনের হামলায় সাধারণত অনেক মানুষের মৃত্যু হয়। বাড়িঘর, দালানকোঠা, ভেঙে পড়ে। কিন্তু বাংলার মাটিতে হানাদার বাহিনীর প্রথম হামলা সত্যিকার অর্থে কিছুই করতে পারেনি।

চট্টগ্রাম বন্দেরে ছিল পাকিস্তানি যুদ্ধজাহাজ। যুদ্ধজাহাজ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকা প্রয়োজন। একাত্তরের ২৬ মার্চ থেকে  কালুরঘাটের ইামর্জেন্সি স্টুডিও স্বাধীন বাংলা বেতার নামে চলতে থাকে। চট্টগ্রাম বেতারের সম্প্রচার ক্ষমতা ছিল ১০ কিলোওয়াট। তাই কালুরঘাটে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রচার ক্ষমতাও ছিল ১০ কিলোওয়াট। কিন্তু এখানে ১ কিলোওয়াট একটি স্বতন্ত্র ট্রান্সমিটার ছিল। সৌভাগ্যক্রমে এই এক কিলোওয়াট ট্রান্সমিটার সে দিনের হামলা থেকে রক্ষা পায়।

৩১ মার্চ সকাল। কয়েকজন বেতারকর্মী কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে যান। তারা ট্রান্সমিটার ভবনে প্রবেশ করেন। ট্রান্সমিটারের প্রায় সবগুলো বৈদ্যুতিক চ্যানেল বিছিন্ন হয়ে গেছে। এটি চালানোর প্রাণপণ চেষ্টা করা হয়। কিন্তু কোনওভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া যায়নি। এদিকে হানাদার বাহিনী শহরে এসে গেছে।

কালুরঘাটেও যেকোনও মুহূর্তে আক্রমণ হতে পারে। তখন সবার একটাই চিন্তা কীভাবে এক কিলোওয়াট ট্রান্সমিটার সরিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু এই সরানোর কাজটি ছিল অত্যন্ত কঠিন। হারুন-অর-রশীদ খানের নেতৃত্বে কয়েকজন মিলে শেষ পর্যন্ত এই কঠিন কাজটি সম্পন্ন করেছিলেন।

এবার একটি ভিন্ন উপায়ে ট্রান্সমিটারটি চালু করা যায়। সেটা হলো একটা ট্রাকে এটি  ইনস্টল করতে হবে।  আরেকটি ট্রাকে একটা জেনারেটর রাখতে হবে। কক্সবাজার ওয়াপদা অফিসে জেনারেটর আছে। একটা জেনারেটর সেখান থেকে আনাও যায়। কিন্তু ওই সময় এটা ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। একবার এখানে বোমা পড়েছে। আবার একই ঝুঁকি নেওয়া যায় না।

কিন্তু সবার একটাই ভাবনা যে কোনও উপায়ে বেতার কেন্দ্র চালু করতে হবে। চট্টগ্রাম ও কালুরঘাট থেকে পটিয়া বেশ দূর। তার ওপর পাহাড়ি ও খানিটকটা দুর্গম এলাকা।

 বেলাল মোহাম্মদের টিমের কাছে পটিয়া তখনও বেশ নিরাপদ মনে হলো। তখন একটি পরিকল্পনা হয়। সেটি হলো ১ কিলোওয়াট ট্রান্সমিটার কালুরঘাট থেকে পটিয়া নিতে হবে। তারপর সেখানে চালু করার বিষয়টি ভেবে দেখতে হবে। তা ছাড়া সেখানে বাঙালি সেনাক্যাম্প আছে। তারাও নিরাপত্তা দিতে পারবে। সব দিক চিন্তা করে শেষ পর্যন্ত পটিয়া আনা হয়। এখানে আনার পর দেখা গেল কিছু যন্ত্রপাতি কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে রয়ে গেছে। এসব যন্ত্রপাতি না হলে বেতার চালু করা সম্ভব না। তখন রাশেদুল হাসান ও শারফুজ্জামান আবার কালুরঘাটে গেলেন। তারা ফেলে আসা খুচরা যন্ত্রপাতি নিয়ে আসেন।

কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো এত কিছুর পরও পটিয়ায় আর চালু করা হলো না। তার ওপর এখানে যারা স্থানীয়ভাবে বাস করেন তাদের জন্যও ঝুঁকি বেড়ে যায়। আবার তারা কিছুটা ভয়ও পাচ্ছিলেন। চট্টগ্রামে অনেক উর্দুভাষি আছে। তারা বাঙলিদের পক্ষে না। এ দেশের স্বাধীনতা চায় না। পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। পাকিস্তানের আর্মিদের সহযোগিতা করছে। হানাদার বাহিনী উর্দুভাষিদের মাধ্যমে আক্রমণের পরিকল্পনা করছে। সবকিছু বিবেচনা করে পটিয়ায় বেতার কেন্দ্র চালু করার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হয়। বেতার কর্মীরা এক কিলোওয়াট ট্রান্সমিটার পটিয়ায় আনলেন। এদিকে প্রতিদিনিই পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে। পাকিস্তানিরা অনেক বেশি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে চট্টগ্রাম শহরে জড়ো হচ্ছে। ইতিমধ্যে ঝুঁকি আরও বেড়েছে। এখন আর পটিয়ায় বেতার কেন্দ্র চালু করা যাবে না। যেকোনও দিন হানাদারেরা এখানেও চলে আসতে পারে। কালুরঘাটের মতো এখানেও বিমান হামলা হতে পারে। অনেক ধরনের বিপদের সম্ভাবনা আছে।

অবশেষে সব পরিকল্পনার পরও পটিয়ায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র চালু কর হলো না।

পটিয়া কিন্তু বিমান হামলা থেকে রক্ষা পায়নি। ১৭ এপ্রিল সেখানে বিমান হামলা হয়েছিল। কিন্তু সে সময়ে বেতারকর্মীরা কেউ পটিয়ায় ছিলেন না। ৩ এপ্রিল পর্যন্ত তারা পটিয়ায় ছিলেন। পরে রামগড়ে চলে যান। কোনওভাবে হয়ত হানাদারেরা বেতার কর্মীদের পটিয়ায় অবস্থানের কাথা জেনেছিল।

হানাদার পাকিস্তানিদের কাছে সে সময় চরম আতঙ্কের নাম ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। যেকোনও মূল্যে একে ধ্বংস করতে চেষ্টা করত। এ জন্য তাদের প্রথম টার্গেটই ছিল এই বেতার কেন্দ্র। কারণ এই বেতার পৃথিবীকে জানিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা। জানিয়ে দিয়েছিল সামারিক জান্তার জল্লাদেরা কীভাবে নিরীহ মানুষ হত্যা করেছে। এখান থেকেই এসেছিল তাদের প্রতিরোধের ডাক। মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার সাহস দেখিয়ে ছিল বাঙালি জাতি।

এই বেতারের খবর ছিল, গোপন জায়গা থেকে বঙ্গবন্ধু মুক্তিবাহিনী গঠন করছেন। যুদ্ধের নির্দেশনা দিচ্ছেন। এখান থেকে বেরিয়ে ছিল টিক্কা খানের মৃত্যুর খবর। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এসব খবর তাদের প্রায় মাথা খারাপ করে দিয়েছে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র আবার চালু হোক এটা তারা ভাবতেই পারছে না।

এ জন্য পাকিস্তানি মিলিটারি ১৭ এপ্রিল পটিয়ায় বিমান হামলা করে। তারা ভেবেছিল বেতার কর্মীরা আবার সংগঠিত হয়ে বেতার চালুর উদ্যোগ নিচ্ছে। তাই বিমান হামলা করে তাদের ধ্বংস করতে চেয়েছিল। কিন্তু বেতার কর্মীরা এর অনেক আগেই পটিয়া ছেড়ে রামগড় সীমান্ত এলাকায় চলে যায়। হানাদারেরা চিরতরে এই বেতারকে স্তব্ধ করতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি। উল্টো আরও তীক্ষ্ম ও তীব্র হয়েছে এর কণ্ঠস্বর। তাই ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কণ্ঠস্বর।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র―

পটিয়া থেকে রামগড় :

মুক্তিযুদ্ধে  রামগড়ের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু প্রায় স্বাধীনতাই ঘোষণা দিলেন। ১৬ মার্চ গঠন হলো আওয়ামী সংগ্রাম পরিষদ। এর মাধ্যমে মহকুমা শহর রামগড়ে শুরু হয় ব্যাপক অসহযোগ আন্দোলন। ২৫ মার্চের পর চট্টগ্রামের রাজনীতিবিদ, সামাজিক-সাংস্কৃতিক নেতৃবৃন্দ, সাংবাদিক, অভিনয় শিল্পীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ রামগড়ে আসতে শুরু করে। এ ছাড়া বাঙালি আর্মির বেশ কয়েকজন সামরিক অফিসার রামগড়ে আসেন। তারা রামগড় হাইস্কুল মাঠে গড়ে তোলেন মুক্তিকামী মানুষের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। রামগড় মাঠের এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রই হলো বাংলার মাটিতে মুক্তিফৌজের প্রথম প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।

শত শত তরুণ মাতৃভূমির মুক্তির আশায় এখানে দৃঢ় প্রত্যয়ে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন। রামগড়কে শত্রুমুক্ত রাখতে প্রায় সব রকম প্রস্তুতি নেওয়া হয়। বিভিন্ন স্থানে ঘাঁটি বসান হয়। প্রতিরোধ যুদ্ধ পরিচালিত হয় পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে। এই ছোট মহকুমা শহর রামগড় হয়ে ওঠে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রামের প্রাণকেন্দ্র।  ১৯২০ সালে রামগড় মহকুমা ছিল। তখন ব্রিটিশরা এ অঞ্চল শাসন করত। ১৯৭১ সালে এই রামগড় ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের একটি অন্যতম সেক্টর। কালের বিবর্তনে সব মহকুমা শহর জেলায় রূপান্তরিত হলো। কিন্তু রামগড় রয়ে গেল আগের মতো। তবে ১৯৮৪ সালে এটি উপজেলা হয়।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ছিল ১০ জনের একটি দল। এই দলটিই বিমান হামলার পর প্রথমে পটিয়া আসে। পটিয়া থেকে ৩ এপ্রিল মাইক্রোবাসে রামগড়ে পৌঁছাতে প্রায় সন্ধ্যা হয়েছিল।

এখানে ফেনি নদী ভারত ও বাংলাদেশকে আলাদা করেছে। ওপারে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাবরুম এলাকা এপারে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার রামগড় এলাকা। ভৌগোলিকভাবে ফেনি নদী দুটি দেশকে এখানে আলাদা করলেও সম্পর্ক এবং যোগাযোগের দিক থেকে দূরে রাখতে পারেনি। দুটি এলাকা দুই দেশের হলেও রামগড় ও সাব রুমের জনগণের মধ্যে ছিল একটা নিবিড় সম্পর্ক। সুদীর্ঘকাল ধরে তারা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত। পরস্পর বিশ্বস্ত প্রতিবেশী।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র পাকিস্তানিদের ভয়ঙ্কর চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। তাই পকিস্তান আর্মিরা চট্রগ্রাম অঞ্চল দখলে নিতে মরিয়া। প্রায় প্রতিদিন সেখানে তাদের দখলদারিত্ব বাড়াচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কিছু স্থানীয় উর্দুভষিদের পাকিস্তানপ্রীতি সহযোগিতা করছে। এদের জন্যই তারা আরও দ্রুত নিয়ন্ত্রণ নিতে পারছ। তৈরি হচ্ছে ভারী অস্ত্র নিয়ে। একদিকে ১ এপ্রিল চট্টগ্রামের হালিশহর ও ২ এপ্রিল কোর্ট হিলের অবস্থান পাক বাহিনীর দখলে যায়। ফলে পুরো চট্টগ্রাম বন্দর নগরীর পতন ঘটে। ৩০ মার্চের মধ্যেই চট্টগ্রাম শহর প্রায় মানবশূন্য হয়ে যায়।

পাকিস্তান বাহিনী যেকোনও সময় পটিয়ায় আসতে পারে। এ ক্ষেত্রে ভারতের কোনও সীমান্তে যাওয়াই নিরাপদ। এখান ভারতীয় বেতার শোনা যায়। তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে সমর্থন করছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের খবর প্রকাশ করছে। তাই ১ কিলোওয়াট ট্রান্সমিটারটি ভারতীয় সীমান্তে ইনস্টল করতে পারলে কিছুটা নিরাপদে সম্প্রচার করা যাবে।  পটিয়া থেকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্ত অনেকটা নিরাপদ।

প্রায় শুরু থেকেই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ১০ জনের একটি দল ছিল। বেতার কেন্দ্রের সম্প্রচার ও যাবতীয় পরিকল্পনা তারাই করত। কিন্তু কালুরঘাটে যেদিন বিমান হামলা হলো সেদিন থেকে আবুল কাশেম সন্দ্বীপ ও রেজাউল করিমকে পাওয়া যাচ্ছিল না। এ জন্য সবার মনেই এক ধরনের দুশ্চিন্তা ও অনিশ্চয়তা কাজ করছে। ২ এপ্রিল থেকে পরিকল্পনা হচ্ছিল কীভাবে কোন পথে রামগড়ে যাওয়া যায়। সন্দ্বীপ ও রেজাউল করিমকে না পাওয়ায় সবারই মন খারাপ। তারপরও ৩ এপ্রিল সবাই রামগড়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। পথ হলো পটিয়া-ফুলতলি, কাপ্তাই-রাউজান- নাজিরহাট-ফটিকছড়ি-রামগড়। তাদের গাড়ি যখন পটিয়া থাকে ফুলতলিতে আসল তখনই সৌভাগ্যক্রমে আবুল কাশেম সন্দ্বীপ ও রেজাউলের সঙ্গে দেখা। সবাই একেবারে আনন্দে আত্মহারা। ফুলতলিতে এসে তাদের গাড়িটি যেন ‘কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র’ হয়ে গেল। ১০ জন তারা সবাই এবার এক সঙ্গেই রামগড়ে যাচ্ছেন।

যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে পার্বত্য অঞ্চলেও। সে সময় এইচটি ইমাম ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার প্রশাসক। তিনি তার প্রশাসনিক অফিস রাম গড়ে নিয়ে আসেন। রামগড় থেকে স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করছেন। কিন্তু এরই মধ্যে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজার হাজার মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে পথে নেমেছে।  সবাই ভারতে যাওয়ার জন্য রামগড়ে আসতে শুরু করেছে। এইচটি ইমাম এসব মানুষের জন্য লঙ্গরখানা খোলেন।

কীভাবে বেতার কেন্দ্র চালু করা যায় এটা নিয়েও তিনি ভেবেছেন। পরিকল্পনা করেছেন।  শুধু পরিকল্পনা করে থেমে থাকেননি। ভারতের বিএসএফের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। তাদের একটি ট্রান্সমিটার আছে। সেটা ব্যবহার করা যাবে।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ১০ জনের দলটি ৩০ মার্চ দুপুর পর্যন্ত ছিলেন কালুরঘাটে। তারপর পটিয়া, ৩ এপ্রিল পটিয়া থেকে রামগড়। সবার রামগড়ে পৌঁছাতে সেদিন প্রায় সন্ধ্যা হলো। থানার সামনে এসে থামল মাইক্রোবাস। সবার পরিকল্পনা ছিল পটিয়া থেকে ১ কিলোওয়াট ট্রান্সমিটার রামগড়ে আনবেন। তারপর এখানে এটা ইনস্টল কর হবে। রমাগড় থেকে আবার স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সম্প্রচার হতে থাকবে। 

কিন্তু তারা থানার সমানে নামার সাথে সাথেই এগিয়ে এলেন এইচটি ইমাম। কাছে এসে বললেন যে বিএসএফের (বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স) সঙ্গে তাঁর আলোচনা হয়েছে। তাদের একটি ট্রান্সমিটার আছে সেটি ব্যবহার করা যাবে। একজন বাংলা  ও একজন ইংরেজি ব্রডকাস্টার নিয়ে নৌকায় উঠতে হবে।

তখন বেলাল মোহাম্মাদের দলও তাদের পরিকল্পনা পরিবর্তন করতে বাধ্য হলেন। কখন পটিয়া থেকে সেই ১ কিলোওয়াট ট্রান্সমিটার আসবে এর কোনও নিশ্চয়তা ছিল না। তা ছাড়া ইনস্টল করতেও অনেক ঝামেলা আছে। তার থেকে বরং এটাই ভালো  যদি এখনই বেতার কেন্দ্র চালু করা যায়। তাই পটিয়ার মতো রামগড়েও আর বেতার কেন্দ্র চালু করা হলো না। কালুরঘাটের পর বাংলার মাটিতে আর স্বাধীন বাংলা বেতারের সম্প্রচার হলো না। কিন্তু সবার একটাই লক্ষ্য কখন বেতার  চালু হবে।

রামগড় বাজারে ওড়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা :

ভারত থেকে বিভিন্ন সমরাস্ত্র আনার জন্য ফেনী নদীর ওপর কাঠের সেতু নির্মাণ করা হয়। চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে অস্ত্র পাঠান হয়। ২৭ এপ্রিল মহালছড়িতে পাকবাহিনী ও চাকমা মুজাহিদদের সঙ্গে এক প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে অকুতোভয় তরুণ সেনা অফিসার ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের শহিদ হন। রামগড়ের মাটিতেই সমাহিত করা হয় এ বীর শহিদকে।

ক্যাপ্টেন রফিক ছিলেন ইপিআর বাহিনীর নেতৃত্বে। মেজর জিয়াউর রহমান ছিলেন অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল বাহিনীর নেতৃৃত্বে। তারা দুজনেই সাবরুমে বিএসএফের কর্মকর্তারা সঙ্গে অস্ত্র-শস্ত্র ও গোলা-বারুদের জন্য কথা বলেন। বিএসএফের নির্দেশে ক্যাপ্টেন রফিক সাবরুম থেকে আগরতলা যান। এদিকে মেজর জিয়া সাবরুমে  বিএসএফের পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান ব্রিগেডিয়ার পান্ডের সঙ্গে দেখা করে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন। চট্টগ্রাম শহর পুনর্দখলের জন্য ৫ এপ্রিল পর্যন্ত রামগড়ে অনেক সৈন্য আনা হয়। ২ মে ভোরবেলায় ভারী কামান ও শক্তিশালী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে চারদিক থেকে রামগড় ঘাঁটির ওপর হামলা চালায় পাকবাহিনী। মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুদের প্রতিরোধে সর্বাত্মক চেষ্টা করে। কিন্তু পাক বাহিনীর বিপুল সৈন্য ও ভারী অস্ত্রের মুখে দীর্ঘ সময় যুদ্ধ করা সম্ভব হয়নি। বিকেল ৫টার দিকে পাকবাহিনী পুরো রামগড় দখল করে নেয়। পতন হয় চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা অংশের মুক্তিযোদ্ধাদের সবচেয়ে শক্ত ঘাঁটির।

রামগড়ে ছিল এক নম্বর সেক্টর। রামগড় পতনের পর এ সেক্টর সীমান্তের ওপারে সাবরুম মহকুমার হরিণায় সরিয়ে নেওয়া হয়। এর অধীনে ত্রিপুরা রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে শুরু হয় মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ প্রশিক্ষণ। এসব প্রশিক্ষণ তত্ত্বাবধান করেন মেজর রফিকুল ইসলাম। ১২ বছরের বালক থেকে ৫০ বছর বয়স পর্যন্ত প্রায় সবাই এখানে প্রশিক্ষণ নেয়। রামগড়ের ওপর তাঁরা প্রায়ই গেরিলা হামলা চালায়। পাকবাহিনীর ব্যাপক ক্ষতি করে । সময় গড়িয়ে এক সময় আসে ৭ ডিসেম্বর। সকাল ৯টা ২৫ মিনিট। ভারতীয় বিমান বাহিনীর তিনটি জেট বিমান রামগড়ে দখলদারবাহিনীর অবস্থানের ওপর প্রবল বোমা বর্ষণ করে। প্রায় সাত মিনিট বোমা হামলা শেষে বিমান তিনটি ফিরে যায়। সঙ্গে সঙ্গে স্থলপথে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী পাকহানাদারদের ওপর কঠোর আক্রমণ চালায়। এতে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয় শত্রুরা। ফলে ভীতসন্ত্রস্ত পাকবাহিনীর সৈন্যরা ৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যা থেকে পিছু হটতে শুরু করে। ৮ ডিসেম্বর  সকাল ৯টা ৫০ মিনিটে  আরও দুটি ভারতীয় বিমান পাকঘাঁটির উপর পাঁচ মিনিট বোমা বর্ষণ করে। বিমান থেকে বোমা হামলা আর স্থলে অকুতোভয় বীরযোদ্ধাদের মরণপণ গেরিলা আক্রমণে পাক সেনাদের বিপর্যস্ত করে দেয়। শেষ পর্যন্ত শত্রুরা প্রাণ বাঁচাতে রামগড় থেকে পালাতে শুরু করে। ৮ ডিসেম্বর বিকেলের আগেই  পাক সৈন্যরা সবাই রামগড়ের মাটি ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে যায়।

বিকেল ৪টার দিকে ভারতের সাবরুমের আশ্রয় শিবির থেকে বিজয় উল্লাসে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে দেশের মাটিতে ছুটে আসে রামগড়ের মানুষ। রামগড় বাজারে উড়ানো হয় স্বাধীন বাংলার পতাকা।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র―রামগড় থেকে বাগাফা :

৩০ মার্চ। কালুরঘাট। শেষ হলো দুপুরের অধিবেশন। এর পরই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে বিমান হামলা। এ হামলার পর থেকে এখন পর্যন্ত কোনও অনুষ্ঠান সম্প্রচার হয়নি। কালুরঘাট, পটিয়া ও রামগড়ে-স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার কথা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু একে একে সবগুলো পরিকল্পনা থেকে ফিরে আসতে হয়েছে। প্রতিদিনই হানাদার বাহিনী শক্তি বৃদ্ধি করছে। তাদের হামলার ঝুঁকির বিষয়টি চিন্তা করে শেষ পর্যন্ত বেতার কেন্দ্র আর চালু হয়নি। তাই ৩০ মার্চ কালুরঘাট দুপুরের অধিবেশনই ছিল বেতার কেন্দ্রের শেষ অধিবেশন। অথচ বেতার কেন্দ্র চালুর জন্য কি তীব্র আকাক্সক্ষা সবার! বাংলার মাটিতে আর বেতার কেন্দ্র চালু হলো না। এবার দেখা যাক বিদেশের মাটি বাগাফা জঙ্গলে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র স¤ম্প্রচার হয় কি না।

১০ জন বেতার কর্মীর মধ্যে বেলাল মোহাম্মাদ, আব্দুল্লাহ আল ফারুক ও আবুল কাশেম সন্দ্বীপ এইচটি ইমামের সঙ্গে নৌকায় নদী পার হলেন ত্রিপুরা রাজ্যের বাগাফার উদ্দেশে। সেদিন তাদের সঙ্গে ছিলেন আওয়ামী লীগের তিনজন তরুণ সাংসদ-আতাউর রহমান কায়সার, মোশাররফ হোসেন ও মির্জা আবুল মনসুর।

নদী পার হলেই ওপারে ঘন বাঁশঝাড়। আর বাঁশঝাড়ে ঘেরা ত্রিপুরা রাজ্যের সাবরুম থানা। থানায় সবার নাম পরিচয় লেখা হলো। তখন গভীর অন্ধকার নেমে এসেছে। চারদিক ভীষণ নিস্তব্ধ। কোথাও যেন কেউ নেই। প্রায় ৩০ মিনিট অপেক্ষার পর থানায় একটা জিপ এসে দাঁড়াল।

পার্বত্য চট্টগ্রামের মতো উঁচু-নিচু পাহাড়ি রাস্তা ধরে জিপে সবাই ত্রিপুরা রাজ্যের বাগাফায় গেলেন। এখানে আছে সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর (বিএসএফ) ৯২ হেড কোয়ার্টার। গাড়ি থামল একটি বাঁশের ঘরের সামনে। আশপাশে এমন আরও কয়েকটি ঘর আছে। একটি ঘর থকে বেরিয়ে এলেন এক পরিচিত জন। তিনি হলেন এ কে খানের সন্তান শামসুদ্দিন খান জাম্বু। এই সদর দপ্তরে আছে ২০০ ওয়াট শর্টওয়েভ ট্রান্সমিটার। এই ট্রান্সমিটারের কথাই বলেছিলেন এইচটি ইমাম। ট্রান্সমিটার চালাবার জন্য অমর সিং নামে একজন শিখ অপারেটরও আছেন এখানে।

কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে বিমান হামলার পর থেকে সবার সময় কেটেছে পথেঘাটে। ভীষণ অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে। এ সময় তারা বিভিন্ন তথ্য নিজেদের কাছে লিখে রেখেছিলেন। এসব ছিল গত চার দিনে বিদেশি বেতার ও মানুষের মুখ থেকে শোনা তথ্য। প্রায় সবাই জানতেন এগুলো এক সময় কাজে লাগবে। এর মধ্যে ছিল টিক্কা খানের কল্পিত মৃত্যু সংবাদ। বাংলাদেশে হানাদার বেলুচ ও পাঞ্জাবি বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ। চট্টগ্রামে দখলদার ছত্রীবাহিনী নামানো। উর্দুভাষিদের যোগসাজশে পাকিস্তানি সৈন্যদের শহরে প্রবেশ। নিরীহ বাঙালিদের হত্যা। নারী নির্যাতন। দ্রুত মুক্তিবাহিনী সংগঠিত হচ্ছে। জীবন জয়ের শপথ ইত্যাদি। অধ্যাপক সন্দ্বীপ ও বেলাল মোহাম্মাদ বাংলা সংবাদ তৈরি করলেন। আব্দুল্লাহ আল-ফারুক তৈরি করলেন ইংরেজি বুলেটিন।

৩ এপ্রিল। রাত ১০টা। সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হলো। বাগাফায় স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে বেজে উঠল, ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’। খুশিতে সবার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আবুল কাশেম সন্দ্বীপ পড়েছিলেন বাংলা সংবাদ। ইংরেজি বুলেটিন পড়েছিলেন শামসুদ্দিন খান জাম্বু। বাজানো হলো আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি। এর সঙ্গে আরও কয়েকটি সঙ্গীত বাজানো হলো। আবার ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানটি বাজিয়ে সে রাতে স্বাধীন বাংলা বেতারের সম্প্রচার সমাপ্তি হয়।

প্রায় চার দিনের বেশি সবার পথেঘাটে থাকতে হয়েছে। খাওয়া, ঘুম, গোসল বলতে গলে কিছুই ছিল না। অবশেষে ৩ এপ্রিল বাগাফা জঙ্গলে সেটা সফল হলো। এটিই ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রথম অধিবেশন। এ অনুষ্ঠানের দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় এক ঘণ্টা।

বাগাফায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রথম অধিবেশন যখন শেষ হলো তখন রাত ১০টারও বেশি। সেখানে এলেন ভারতের বিএসএফের সদর দপ্তরের একজন ভারপ্রাপ্ত অফিসার। সবাই তাকে বলেন কর্নেল ঘোষ। এই কর্নেল তাদের বললেন যে, ছয়জন এখানে স্থায়ীভাবে চলে আসতে। প্রতিদিন রামগড় থেকে আনা নেওয়া সম্ভব না। কর্নেল ঘোষকে ১০ জনের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু তিনি বললেন ১০ জনের জায়গা হবে না। তাঁর কথা শুনে খুব মন খারাপ হলো। ১০ জনের একটা দল। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সুখে-দুঃখে এক সাথেই আছেন। কাকে বাদ দেবেন কাকে নেবেন। এটা তাদের কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়ে দিল। কাউকে বাদ দিয়ে বিচ্ছিন্ন হওয়ার বিষয়টি ছিল প্রায় অসম্ভব।

কিন্তু এ সময় কালুরঘাট থেকে উদ্ধার করা এক কিলোওয়াট ট্রান্সমিটার তাদের এ কঠিন কাজকে সহজ করে দিল। ৩১ মার্চ কালুরঘাট থেকে যে এক কিলোওয়াট ট্রান্সমিটার উদ্ধার করা হয়েছিল কয়েকদিনের মধ্যেই এটি রামগড়ে পৌঁছাবে। তখন সেটা সম্প্রচার করতে কয়েকজনের প্রয়োজন হবে। তাই রামগড়েও কয়েকজনের থাকতে হবে। তারা কালুরঘাট থেকে আনা এক কিলোওয়াট ট্রান্সমিটার সম্প্রচার করবে। তাই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৪ এপ্রিল বিকেলে ১০ জনের মধ্যে বেলাল মোহাম্মদ, শারফুজ্জামান, মুস্তাফা মনোয়ার, আব্দুল্লাহ আল ফারুক, আবুল কাশেম সন্দ্বীপ গেলেন বাগাফায়। আর রামগড়ে থেকে গেলেন সৈয়দ আব্দুস শাকের, রাশেদুল হোসেন, রেজাউল করিম চৌধুরী, আমিনুর রহমান ও কাজী হাবিব উদ্দিন। সেকেন্দর হায়াত খানও তাদের সঙ্গে ছিলেন।

প্রতিদিন দুটো করে অনুষ্ঠান। প্রথম অধিবেশন সকাল ৮টা থেকে ৯টা। দ্বিতীয় অধিবেশন সন্ধ্যা ৭টা থেকে ১০ টা। অনুষ্ঠানের মধ্যে ছিল যুদ্ধের খবর। গ্রামোফোন রেকর্ডের গান। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থেকে নেওয়া স্লোগান। মুস্তফা আনোয়ার ও বেলাল মোহাম্মাদের লেখা কবিতা ও কথিকা। শর্টওয়েভটি একটানা থাকে ঢাকার দিকে। ঢাকা থেকে ভালোই শোনা যেত। বিখ্যাত সাংবাদিক এবি এম মুসা বাগাফা থেকে প্রচারিত অনুষ্ঠান শুনতেন আবার রেকর্ডও করতেন। এভাবে বাগাফা থেকে সম্প্রচার হতে থাকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দ্বিতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠান।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র-বাগাফা থেকে আগরতলা :

পূর্ব বাংলার মানুষের জীবনের মতো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জীবনেও যেন ঝড় বয়ে যাচ্ছে। দুদণ্ড স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। সেই যে ২৬ মার্চ দুপুর থেকে শুরু হয়েছিল পথচলা। তারপর এ পথের যেন শেষ নেই। কালুরঘাট-পটিয়া-রামগড়-বাগাফা সব জায়গায় বাধা। কোথাও হচ্ছে না একটা দীর্ঘ শুরু । কালুরঘাট ও বাগাফায় তবু শুরুটা হয়েছিল। কয়েকদিন সম্প্রচারও হলো। কিন্তু প্রকৃতির নিষ্ঠুর খেলায় স্থায়ী হতে পারেনি। পটিয়া ও রামগড়ে শুরুই হয়নি।

এবার যাত্রা ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা।

৩০ মার্চ কালুরঘাটে দুপুরের অধিবেশনই ছিল শেষ অধিবেশন। আর ৮ এপ্রিল বাগাফায় সকালের অধিবেশনের মধ্য দিয়ে শেষ বাগাফার সম্প্রচার। এবার গন্তব্য আগরতলা। কেউ জানে না স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এ চলার শেষ কোথায়।

৩ এপ্রিল। রাত ১০টায় সব প্রস্তুতি শেষ করে বাগাফায় স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে বেজে উঠেছিল, ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’। এ গানটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে সবার কয়েক দিনের ক্লান্তি দূর হয়েছিল। প্রায় চার দিনের অমানসিক কষ্টের পর বাগাফা জঙ্গলে সম্প্রচার সম্ভব হলো। এটি ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দ্বিতীয় পর্যায়ের অধিবেশন।

অনেক কষ্ট ও ধর্যের পরীক্ষায় জয়ী হয়েছিলেন বেতার কর্মীরা। তারা বাগাফায় দ্বিতীয় পর্যায়ের সম্প্রচার শুরু করেছিলেন। নিজেদের প্রয়োজনীয় প্রায় সবকিছু গুছিয়ে নিয়েছিলেন। কষ্ট হলেও দিন যাচ্ছিল ভালোই। কারণ নিজেদের কষ্ট নিয়ে তাঁরা ভাবছেন না। বেতার কর্মীদের একমাত্র লক্ষ্য স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান ঠিকভাবে সম্প্রচার হওয়া। বাগাফা জঙ্গল থেকে সে কাজটি ঠিকভাবেই হচ্ছিল। সবাই আরও ভালো অনুষ্ঠানের জন্য মনযোগী হচ্ছিলেন।

কিন্তু বিএসএফ কর্তৃপক্ষ হঠাৎই একটা সিদ্ধান্ত নিল। এমন একটি সদ্ধান্তের জন্য কেউই প্রস্তুত ছিল না। ৪ থেকে ৭ এপ্রিল প্রতিদিন বাগাফায় দুটি করে অধিবেশন হয়ে আসছে। ৮ এপ্রিল সকালের অধিবেশনের পরই শুনতে হলো তাদের আর এখানে রাখা হবে না। আগরতলার কাছে একটি শালবন আছে। সেখানে যেতে হবে।

এখানে আছে বিএসএফের ৯১ হেডকোয়ার্টার। এ হেডকোয়ার্টারে রয়েছে একটি ৪০০ ওয়াট শর্টওয়েভ ট্রান্সমিটার। এই ট্রান্সমিটার থেকেই অনুষ্ঠান সম্প্রচার করতে হবে। সবারই খারাপ লাগছে। এক জায়গায় গুছিয়ে নেওয়ার পর আবার সেখান থেকে চলে যেতে হবে। অনেক ঘোরাঘুরি হচ্ছে।  সেই তো কালুরঘাট, পটিয়া, রামগড়, বাগাফা এখন আবার শালবন।

কখনও কখনও  খারাপের মধ্যে একটা ভালো থাকে। ইংরেজ কবি টিএস এলিয়টের মতে―‘আমরা যাকে শুরু বলি সেটাই আসলে শেষ। আর যেখানে শেষ হয় সেখান থেকেই আবার শুরু। আর প্রত্যেক শুরুই একটা নতুন সম্ভাবনা নিয়ে আসে।’ ঠিক তাই। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এই শুরুটা ছিল একটা নতুন সম্ভাবনার।

কারণ শালবনটি আগরতলা শহরের খুব কাছে। ২৫ মার্চ থেকেই শুরু হয় যুদ্ধ। তারপর সেটা চট্টগ্রামসহ সারা পার্বত্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এ অঞ্চলের রাজনীতিবিদ, বাঙালি সামরিক অফিসার, কবি, সাহিত্যিক, লেখক, অধ্যাপকসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের এই আগরতলা আসে। এঁদের মধ্যে ছিলেন, আতাউর রহমান কায়সার, মীর্জা আবুল মনসুর, মোশাররফ হোসেন এম আর সিদ্দিকী, অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ, কর্নেল আতাউল গনি ওসমানি, মেজর জিয়াউর রহমান, ক্যাপেট রফিকুল ইসলাম। ব্রিগেডিয়ার নুরুল ইসলাম, মাহবুব আলম চাষি, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, আমিনুল হক বাদশা, ডক্টর হাবিবুর রহমান, অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরীসহ আরও অনেকে। প্রথম দিকে এখান থেকেই সবাই সর্বাত্মক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে দেশের জন্য যুদ্ধ করছেন। আগরতলা শহরের  ৯১২ কর্নেল চৌমুহনী বাঙালি নেতাদের অফিস আছে। এখান থেকে অনেক তথ্য পাওয়া যাবে। আর এসব তথ্য দিয়ে ভালো অনুষ্ঠান নির্মাণ করার সুযোগ হবে।

৮ এপ্রিল একটা লরিতে সবাই আসলেন শালবাগানে। তাদের অভ্যর্থনা জানালেন বাঙালি কর্নেল শঙ্করপ্রসাদ ব্যানার্জি। তিনি বললেন, ‘অনুষ্ঠান প্রচারের ব্যবস্থা করতে দুই এক দিন সময় লাগবে। এখানে সিগনাল থেকে অনুষ্ঠান প্রচরের ব্যবস্থা করতে হবে। এই সময়টা নিজেদের একটু গুছিয়ে পরিকল্পনা সাজাও। ভালো করে বিশ্রাম কর। আর এটা এক ধরনের সুযোগও। এই সুযোগে ভালো প্রোগ্রাম তৈর করতে থাক।’

কিন্তু এই শালবাগানে তাদের অবস্থা খুব একটা ভালো না। এটা সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর ট্রানজিট ক্যম্প। এখানেও বাঁশের ঘর। বাঁশের মাচা। এক মাচায় তিন-চারজন শুতে হবে। বালিশ, চাদর, তোশক, মশারি  কিছুই নেই। শুধু একটা কম্বল পাওয়া গেল। প্লেটের অভাব ছিল। লাইনে দাঁড়িয়ে রুটি  নিতে হয় । খেতে হয় ঘাসের ওপর বসে।  পাঁচজনের জন্য একবাটি পাতলা ডাল। টয়লেটে কোনও বদনা নেই। বোতল ভরে পানি নিতে হয়। জীবনে এত কষ্ট কখনও করতে হয়নি।

তিনি দিন পর ১২ এপ্রিল কর্নেল সঙ্কর প্রসাদ আসলেন। তিনি আমাদের অবস্থা দেখেতো বিস্মিত! তোমাদের একি হাল হয়েছে ? কখনওই চিন্তাই করিনি এত কষ্ট করছ তোমরা। তোমাদের বাঙালি নেতাদের খোঁজ নিতে বলেছিলাম। নিশ্চয়ই তারা আসেনি। তোমাদের খোঁজ নেয়নি। যাই হোক যা হবার হয়েছে। এখন চল আমার সঙ্গে।

বলেই নিজের গাড়িতে আগরতলা শহরের  ৯১২ কর্নেল চৌমুহনী বাঙালি নেতাদের অফিসে নিয়ে এলেন। এখানে দেখা হলো  এম আর সিদ্দিকীর সঙ্গে। কর্নেল ব্যানার্জি আমাদের সমস্যার কথা জানালেন। জনাব সিদ্দিকী বললেন যে তাদের কাছে সঠিক তথ্য দেওয় হয়নি। সিদ্দিকী সাহেব জানতেন যে বেতার কর্মীরা ভালো আছেন।

তবে এখন থেকে আগরতলা থাকার সিদ্ধান্ত হয়। ৮ এপ্রিল প্রভাতী অনুষ্ঠানের পর তিন দিন বিরতি। তারপর আসল ১২ এপ্রিল প্রভাত। সম্প্রচারের জন্য প্রস্তুত ৪০০ ওয়াট ক্ষুদ্র তরঙ্গ ট্রান্সমিটার। এ ট্রান্সমিটার থেকেই ৮৩.৫৬ মিটার ব্যান্ডে প্রভাতী অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দ্বিতীয় পর্বের অনুষ্ঠান আবার শুরু। কিন্তু এখন থেকে আর লাইভ অনুষ্ঠান হবে না। ট্রান্সমিটারের কাছেও  কারও যেতে হবে না। সব রেকর্ড করা অনুষ্ঠান চালান হবে। রেকর্ডের কাজটি করতে হবে সম্পূর্ণ গোপনীয়তার সঙ্গে। বেতার কর্মীদের পরিচয়ও অত্যন্ত গোপন থাকবে। অনুষ্ঠান রেকর্ডের জন্য সার্কিট হাউসের একটি কক্ষ ব্যবহার করা হয়েছিল। পরবর্তী সময় সার্কিট হাউসের গ্যারেজের কক্ষে রেকর্ড করা হয়েছে। জনাব শঙ্কর প্রসাদ রেকর্ড করা অনুষ্ঠান ট্রান্সমিটারে প্রচারের ব্যবস্থা করেন।

তারপর আগরতলা থেকে নিয়মিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান সম্প্রচার হতে থাকে। শত্রু বেতারের কাউন্টার দিতে গিয়ে একদিন মোস্তফা মনোয়ার তার কথিকার শেষ বাক্যে বলেছিলেন, ‘ওরা মানুষ হত্যা করছে-আসুন আমরা পশু হত্যা করি।’ পরবর্তীকালে এ বাক্যটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শ্রেষ্ঠ স্লোগান হয়েছিল। বেতার কর্মীদের সাথে আরও কিছু নতুন কণ্ঠস্বর যুক্ত হয়েছিল। অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ ও আমিনুল হক বাদশা নিয়মিত কথিকা পাঠ করতেন। ১৭ এপ্রিল এসেছিলেন বাংলা একাডেমির সুব্রত বড়ুয়া। তিনি বেলাল মোহম্মদের সঙ্গে  সম্প্রচার কাজে যোগ দিয়েছিলেন।

এখান থেকে প্রতিদিন দুটো অধিবেশন হতো

বাংলাদেশ সময় সকাল সাড়ে ৮টা থেকে সাড়ে ৯টা পর্যন্ত প্রথম অধিবেশন। দ্বিতীয় অধিবেশন হতো বিকেল ৫টা থেকে ৭টা। কখনও কখনও রাত ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্তও হতো। এসব অধিবেশনে সম্প্রচার হতো―বাংলা সংবাদ, ইংরেজি সংবাদ, মুজিবনগর অস্থায়ী সরকারের নির্দেশনা। সংবাদ পর্যলোচনা, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থেকে উদ্ধৃতি। রেডিও পাকিস্তান বক্তব্যের কাউন্টার প্রোগ্রাম, পত্রিকার মন্তব্য, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণামূলক সঙ্গীত ও কথিকা, সংবাদ বুলেটিন, বাংলার কথা, মুক্তিযোদ্ধাদের শপথ, জনগণের জয়, সংগ্রামের অনির্বাণ শিখা, স্বরচিত কবিতা পাঠ, স্লোগান, কেন এ মুক্তিযুদ্ধসহ আরও অনকে অনুষ্ঠান।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রথম পর্যায়ের অনুষ্ঠান ছিল কালুরঘাট, দ্বিতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠান ছিল ত্রিপুরার বাগাফ ও আগরতলা। ২৫ মে সকালের অধিবেশনটি ছিল আগরতলা পর্যয়ের শেষ অনুষ্ঠান। তৃতীয় পর্বের অনুষ্ঠান সম্প্রচারের জন্য স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র আগরতলা থেকে চলে যায় কলকাতার বালিগঞ্জে।

স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র―আগরতলা থেকে মুজিবনগর/বালিগঞ্জ :

সত্যিকার অর্থে মুজিবনগর নামে কোনও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ছিল  না। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ক্ষেত্রে এটা শুধুই একটা সম্মোহনী নাম। কলকাতার বালিগঞ্জের ৫৭ বাই ৮ নম্বর বাড়িটিই ছিল মুজিবনগর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। মুজিবনগর মেহেরপুর জেলার একটি ঐতিহাসিক স্থান। কারণ মুক্তিযুদ্ধের সময় এটা ছিল বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী। কিন্তু এখান থেকে কোনও কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব ছিল না। এখানে মুক্তিবাহিনী ও হানাদারদের মধ্যে কয়েকটি যুদ্ধ হয়।

এই মুজিবনগরেই শুরু হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের তৃতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠান। দিনটি ছিল ১১ জ্যৈষ্ঠ। ইংরেজি ২৫ মে। এই দিনটি ছিল বাঙালির জাতীয় কবির জন্মদিন। প্রিয় কবির জন্মদিনটিকে বেছে নেওয়া হয়েছিল ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে’র তৃতীয় পর্যায়ের অনষ্ঠান সম্প্রচারের জন্য। এটা ছিল কোলকাতার বালিগঞ্জ। একটি দোতলা বাড়ি। এ বাড়ির একটি কক্ষ থেকে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে’র আনুষ্ঠানিক সম্প্রচার শুরু হয়। তখন এর নতুন নাম হয় মুজিবনগর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র।

২৫ মার্চ থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ চলতে থাকে। পাকিস্তানিদের ভয়ংকর বর্বরতা ও ধ্বংসের মধ্যেই  ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠন ও ১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণ হয়। তাই দেশের মাটি থেকে কোনওভাবেই সরকার পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছিল না। কলকাতার বালিগঞ্জের সার্কুলার রোডের যে বাড়িটি থেকে স্বাধীন বাংলা বেতারের সম্প্রচার হতো সেটি  ছিল একটি দোতলা বাড়ি। তখন এ বাড়িতেই ছিলেন মুজিবনগর সরকারের মাননীয় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও অন্যান্য মন্ত্রী। এখান থেকেই  বাংলাদেশ সরকার পরিচালনা হতো। 

তখন ভারত সরকারের কাছে একটি শক্তিশালী ট্রান্সমিটারের আবেদন করা হয়। তারা ৫০ কিলোওয়াট একটি মিডিয়াম ওয়েভ প্রদান করে। এ সময় আগরতলা থেকে বেলাল মোহাম্মদসহ অন্যান্য বেতারকর্মী মুজিবনগরে আসেন। এদিকে ঢাকা বেতারের শিল্পী-কলাকুশলীরাও আসতে থাকেন।

২৫ মে ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের তৃতীয় পর্যায়ের প্রথম অধিবেশন। কয়েক দিন পর মুজিবনগর সরকারের মাননীয় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রীরা অন্য স্থানে চলে যান। তখন কলকাতার বালিগঞ্জের ৫৭/৮ বাড়িটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের স্থায়ী কার্যালয় হয়।

প্রতিদিন দুটি অধিবেশনের মধ্য দিয়ে শুরু হলো মুজিবনগর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান। সকাল সাতটায় প্রথম অধিবেশন। দ্বিতীয় অধিবেশন ছিল সন্ধ্যে ৭টায়। মাত্র কয়েকজন লেখক, কথক ও শিল্পী নিয়ে শুরু হয়েছিল  এ কেন্দ্রের তৃতীয় পর্যয়ের নবযাত্রা।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের

কালজয়ী অনুষ্ঠানমালা :

শুরুতে নির্ধারিত অনুষ্ঠানের মধ্যে ছিল―বাংলা খবর, ইংরেজি খবর। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অনুষ্ঠান ‘অগ্নিশিখা’, এম আর আকতার মুকুলের চরম পত্র (এক ধরনের ব্যাঙ্গ রচনা), বিশেষ কথিকা, বঙ্গবন্ধুর বাণী, দেশাত্মবোধক গানের অনুষ্ঠান ‘জাগরণী’ (অনুপ্রেরণামূলক গান)। পরবর্তী পর্যায়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে আরও অনুষ্ঠান য্ক্তু হয়―এর মধ্যে ছিল বিশ্ব জনমত, সাপ্তাহিক জয়বাংলা পত্রিকার সম্পাদকীয় মন্তব্য ইত্যাদি।

মুক্তি বাহিনীর জন্য কয়েকটি অনুষ্ঠান হলো, রণভেরী, রণাঙ্গনের সংবাদ, দর্পণ, এ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ছিল বিশেষ কথিকা। জনাব আশরাফুল আলম দর্পণ কথাটি নিজেই লিখতেন ও পড়তেন।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান পর্যালোচনা করার জন্য সভা হতো। এ সভা থেকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হতো। ২৫ মে মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রথম অনুষ্ঠান শুরু হয়। এদিকে জুলাই মাস থেকে যু্দ্েধর ভয়াবহতা তীব্র হয়। তাই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠানও ব্যাপকভাবে চলতে থাকে। ইতিমধ্যে ‘ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ’ প্রোগ্রাম নামে একটি অনুষ্ঠান যুক্ত হয়। এ অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করতেন আলমগীর কবির ও আলি যাকের। ১০ মিনিটের একটি উর্দু অনুষ্ঠান ছিল। জাহিদ হোসেন সিদ্দিকী শুদ্ধ উর্দুতে পর্যালোচনা করতেন। এতে পকিস্তানি সৈন্যরা বিভ্রান্ত ও দিশাহারা হয়ে পড়ত।

জুলাইতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে আরও কয়েকটি অনুষ্ঠান যুক্ত হয়। এর মধ্যে ছিল জল্লাদের দরবার। ইয়াহিয়া খান ও তার সভাসদদের চরিত্র চিত্রণ করে ব্যঙ্গ নাটিকা―দৃষ্টিপাত। বিশেষ পর্যালোচনা―ইসলামের দৃষ্টিতে। বিশেষ কথিকা রাজনৈতিক মঞ্চ। পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে বিশেষ পর্যালোচনা। এভাবে প্রায় নিয়মিত অনুষ্ঠান যুক্ত হতে থাকে। 

সোনার বাংলা, পল্লী শ্রোতাদের জন্য বিশেষ অনুষ্ঠান, কাঠগড়ায় আসামি, পিন্ডির প্রলাপ, রণাঙ্গনের চিঠি, মুক্ত অঞ্চল ঘুরে এলাম এমন আরও কয়েকটি অনুষ্ঠান প্রচার হয়। ছোট ছেলে-মেয়েদের জন্য ছিল রক্ত-বীজ নামে একটি অনুষ্ঠান। এটির উদ্যোক্তা ছিলেন এম আর আখতার মুকুল। তবে অনুষ্ঠান বেশিদিন চলেনি।

মুজিব নগর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে অনেক শিল্পী নিয়মিত অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন। ‘ইসলামের দৃষ্টিতে’ ও  ‘ধারাবাহিক কথিকায়’ অংশ নিতেন সৈয়দ আলী আহসান। ‘দৃষ্টিপাত’-এ নিয়মিত কাজ করতেন ড. মযহারুল ইসলাম, অধ্যাপক আব্দুল হাফিজ, সাংবাদিক রণেশ দাশ গুপ্ত।

ধারাবাহিক পর্যালোচনায় অংশ নিতেন আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী। ফয়েজ আহমেদ অংশ নিতেন পুতুল নাচের খেলাতে। সাদেকীন ছিলেন পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে। বিশ্বজনমত আমীর হোসেন। গাজীউল হক―সংবাদ পর্যালোচনা। রণাঙ্গনের চিঠি সলিমুল্লাহ।

রাজনৈতিক পর্যালোচনা মাহবুব তালুকদার। আব্দুর রাজ্জাক চৌধুরী মানুষের মুখ। ‘সূর্য শপথ ও পর্যালোচনা’ মাহমুদুল্লাহ চৌধুরী। বদরুল হাসান―দখলীকৃত এলাকা ঘুরে এলাম। বেঈমানের দলিলসহ আরও কিছু অনুষ্ঠান নিয়মিত লিখতেন ও কণ্ঠ দিতেন মোহাম্মদ মুসা। রণাঙ্গন ঘুরে এলাম নাসির চৌধুরী। পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোনও বেতার কেন্দ্র এত বড় ভূমিকা রেখেছে বলে জানা নেই।

যেভাবে বৈদ্যনাথ তলা হলো মুজিবনগর :

মুজিবনগর ও মেহেরপুরের একটি ইতিহাস আছে। ১৯৭১ সালের গোড়ার দিকের কথা। তখনও এ দেশে স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হয়নি। সে সময় মেহেরপুর ছিল খুলনা বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। আর কুষ্টিয়া জেলার মহকুমা। এই মেহেরপুরের একটি জায়গার নাম বৈদ্যনাথতলা। এলাকাটি ঘন আমবাগানে ঘেরা।

২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ২৬ মার্চ স্বাধীন বাংলা বেতারের মাধ্যমে এ ঘোষণা দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। শুরু হয় সর্বাত্মক যুদ্ধ। মার্চের দিনগুলো চলে যায়। আসে এপ্রিল। এপ্রিল মাসের ১৭ তারিখ বাঙালি জীবনে এক ঐতিহাসিক দিন। এ দিন বৈদ্যনাথ তলার আমবাগানে প্রবাসী সরকারের মন্ত্রী পরিষদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হয়। তখন মেহেরপুর মহাকুমার প্রশাসক ছিলেন তৌফিক এলাহী। তিনি এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। 

সকাল ৯টা থেকে নেতৃবৃন্দ আসতে থাকেন। আসতে থাকেন আমন্ত্রিত অতিথি। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রায় ৫০ জন দেশি-বিদেশি সাংবাদিক। বেলা ১১টায় শুরু হয় শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান। কোরআন তেলাওয়াত ও জাতীয় সংগীত দিয়ে সূচনা হয় অনুষ্ঠানের। শুরুতেই বাংলার জনপদকে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই সরকারের রষ্ট্রপতি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। তাজউদ্দিনি আহমেদ ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। আর তাঁর মন্ত্রী পরিষদে ছিলেন পররাষ্ট্র, আইন ও সংসদ বিষয়কমন্ত্রী, খন্দকার মোশতাক আহমদ। অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলেন এম মনসুর আলি। আর এ এইচ এম কামরুজ্জামান ছিলেন স্বরাষ্ট্র, সরবরাহ, কৃষি, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী। নতুন রাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান হলেন কর্নেল এম এ জি ওসমানি। সেনা বহিনীর চিফ অব স্টাফ ছিলেন আব্দুর রহমান। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়। এ ঘোষণাপত্রের কার্যকারিতা ধরা হয় ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে। আর সময় থেকেই বৈদ্যনাথতলার নাম করণ করা হয় মুজিবনগর।

যুদ্ধকালীন প্রথম অস্থায়ী রাজধানী চুয়াডাঙ্গা :

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে কুষ্টিয়া জেলা এবং এ জেলার মহাকুমা চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুরের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ১০ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় গঠিত হয় প্রবাসী সরকার। আর এ দিনই চুয়াডাঙ্গাকে অস্থায়ী রাজধানী হিসেবে ষোষণা করা হয়। এখান থেকে তৈরি হেয়েছে রাষ্ট্রীয় মনোগ্রাম ও সিলমোহর । ১৪ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় প্রবাসী সরকারের শপথ গ্রহণের কথা ছিল। কিন্তু পাকিস্তান বাহিনী কীভাবে যেন এ খবর জেনে যায়। তারা ব্যাপক বোমা বর্ষণ করে চুয়াডঙ্গায়।

প্রবাসী সরকার এখান থেকে সরে আসতে বাধ্য হয় । তারপর সিদ্ধান্ত হয় এমন একটি জায়গা নির্বাচন করতে হবে যেটি ভারত থেকে কাছে ও কিছুটা দুর্গম। সেই বিবেচনায় মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলার আমবাগানকে নির্বাচন করা হয়। আর ১৭ এপ্রিল এখানে অনুষ্ঠিত হয় অস্থায়ী সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান।

রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী দুজনেই এ অনুষ্ঠানে ভাষণ দেন। তাদের ভাষণ প্রচার হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। ভাষণে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, ‘বিশ্ববাসীর কাছে আমরা আমাদের বক্তব্য পেশ করলাম, বিশ্বের আর কোনও জাতি আমাদের চেয়ে স্বীকৃতির বেশি দাবিদার হতে পারে না। কেননা, আর কোনও জাতি আমাদের চাইতে কঠোরতর সংগ্রাম করেনি। অধিকতর ত্যাগ স্বীকার করেনি। জয়বাংলা।’ এভাবেই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ বিদেশি রাষ্ট্রের সরকার প্রধানদের বাংলাদেশেকে স্বীকৃতির আহ্বান জানান। এটাই হলো যুদ্ধকালীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সূচনার ইতিহাস। ১৯৮৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি মেহেরপুরকে কুষ্টিয়া থেকে আলাদা করা হয়। এই মহাকুমাটি একটি স্বতন্ত্র জেলার মর্যাদা পায়।

স্বাধীন বাংলা বেতারের প্রথম পর্ব ছিল কালুরঘাট, দ্বিতীয় পর্ব ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বাগাফা জঙ্গল ও আগরতলা, তৃতীয় পর্ব-২৫ মে কলকাতায়। মুক্তিযুদ্ধ শেষে এটি বাংলাদেশ বেতার নামে চলছে।

সূত্র :

               স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, বেলাল মোহাম্মদ,

               স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ইতিহাস, ড. জাহিদ হোসেন প্রধান

               মুক্তিযুদ্ধে রেডিও, সম্পাদনা আবু সাঈদ, উইকিপিডিয়া, অনলাইন

               যেভাবে চুয়াডাঙ্গা বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাজধানী

               বাংলা উইকিপিডিয়া-বাংলাদেশ অস্থায়ী সরকার     

               মুজিবনগর সরকার কীভাবে গঠিত হয়-জাগো নিউজ ২৪ ডট কম।  

লেখক : সাংবাদিক ও সংগঠক             

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button