
‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি’, ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’, ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, রক্ত লাল রক্ত লাল’ এই গানগুলো শুনলে আজও আমাদের রক্তে নাচন ধরে। এক অদ্ভূত শিহরণ জাগে ধমনীতে। আমরা যারা একাত্তর-পরবর্তী প্রজন্ম তারা এই গানগুলো শুনলে চোখের সামনে ভেসে উঠতে দেখি একাত্তরের সেই দুঃসহ দিনগুলোর ছবি। যুদ্ধক্লান্ত কিন্তু দেশপ্রেমের আলোয় উদ্ভাসিত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মুখগুলো ভেসে ওঠে আমাদের চোখের সামনে, একেবারে জীবন্ত হয়ে ধরা দেয়।
বিশ্বখ্যাত বিটলস ব্যান্ডের বিশ্বখ্যাত কণ্ঠশিল্পী জর্জ হ্যারিসনের ‘বাংলাদেশ’ গানটি যখন শুনি, যারা ইংরেজি ভাষায় রচিত এই গানটির মর্মার্থ পুরোটা অনুধাবন করতে পারি না তারাও, একাত্তরের বাংলাদেশকেই যেন চোখের সামনে দেখতে পাই। ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে আয়োজিত সেই ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ নামের আন্তর্জাতিক সঙ্গীতানুষ্ঠানে উপস্থিত হাজার হাজার মার্কিন দর্শক শ্রোতার চোখেও নিশ্চয় সেদিন ভেসে উঠেছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের ছবি। হাজার হাজার মাইল দূরে বসেও এই গানের মাধ্যমে বাংলাদেশের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক আর তাদের মিত্রদের চাপিয়ে দেওয়া বেদনাদায়ক মানবিক বিপর্যয়ের ছবি নিশ্চয়ই জীবন্ত হয়ে ধরা দিয়েছিল সেদিনের দর্শকশ্রোতার চোখে। সেটাই হবার কথা। শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত এভাবেই যুগে যুগে মানুষের বেদনার কথা, জীবনসংগ্রামের মাহাত্ম্যের কথা তুলে ধরেছে। ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি’সহ শুরুতে উল্লিখিত একাত্তরে সৃষ্ট এ রকম বেশ কিছু জনপ্রিয় গান লিখেছিলেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের গীতিকবি গোবিন্দ হালদার, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার প্রমুখ। ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে দুই বাংলার সঙ্গীতজ্ঞ, কথা-শব্দশিল্পীরা যে ভূমিকা পালন করেছিলেন, সুদূর আমেরিকায় বসে তারই অনুরণন ঘটালেন ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অন্যতম দিকপাল কিংবদন্তি সেতারবাদক পণ্ডিত রবিশঙ্কর আর জনপ্রিয় ব্রিটিশ সঙ্গীতশিল্পী জর্জ হ্যারিসনের মতো দরদি কিছু শিল্পী।

এই দুজন মহান মানুষের উদ্যোগে ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে সেদিন ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ আয়োজনের মাধ্যমে যে ইতিহাস রচিত হয় তা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে গেছে, যেমন জড়িয়ে গেছে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। আর এই ইতিহাসকে পুনরুজ্জীবিত করে তুলেছেন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী বাংলাদেশি সাংবাদিক শামীম আল আমিন। বাংলাদেশে টিভি সাংবাদিকতা জগতের এক সময়ের পরিচিত মুখ এই সাংবাদিক কয়েক বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে স্থায়ী হয়েছেন। সেখানে বসেই তিনি পণ্ডিত রবিশঙ্কর-জর্জ হ্যারিসনদের সেই ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ নিয়ে ‘একটি দেশের জন্য গান’ নামে একটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন।
এই প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটি ২০২১ সালে মুক্তি পেয়েছে। অভিনেতা-আবৃত্তিশিল্পী- রাজনীতিবিদ আসাদুজ্জামান নূরের সুললিত কণ্ঠের ধারাবর্ণনাসমৃদ্ধ এই ছবির মাধ্যমে শামীম একাত্তরে বাংলাদেশের নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান নিয়ে আয়োজিত সেই চ্যারিটি কনসার্টের আদ্যোপান্ত তুলে এনেছেন। কনসার্টটি সম্পর্কে বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ জানেন না এমন অনেক তথ্যের প্রামাণিক দলিল রয়েছে ফিল্মটিতে। সেই ফিল্মটি তৈরি করতে গিয়েই এই কনসার্ট নিয়ে একটি বই লেখার ভাবনা আসে শামীম আল আমিনের মাথায়। ২০২১ সালের একুশের বইমেলায় অন্যপ্রকাশের ব্যানারে প্রকাশিত হয়ে বইটি বাংলাদেশের পাঠকের হাতেও চলে আসে। সেই বইয়ের ভূমিকায় শামীম এমনটিই জানাচ্ছেন।

উন্নতমানের কাগজে ছাপা, চমৎকার বাঁধাই, মাসুম রহমানের চমৎকার প্রচ্ছদ আর ভেতরে প্রাসঙ্গিক প্রচুর ছবিসহ প্রকাশিত এই বইটির শিরোনাম শামীম দিয়েছেন দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ। ১২৬ পৃষ্ঠার বইটির দাম ধরা হয়েছে ৩০০ টাকা। চলচ্চিত্রে যেমন শামীম সেই ঐতিহাসিক কনসার্টের যাবতীয় খুঁটিনাটি তুলে ধরেছেন, বইটির দুই মলাটের মধ্যে সেগুলোকে ছবি আর বর্ণনার মোড়কে পাঠকের হাতে তুলে দিয়েছেন।

দুটি বিষয় বিবেচনায় বলা যায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর মাহেন্দ্রক্ষণে শামীম আল আমিন একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন। বইটি তিনি অতল শ্রদ্ধার সঙ্গে উৎসর্গ করেছেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর ও জর্জ হ্যারিসনসহ ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ আয়োজনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলকে। এই বইয়ের ভূমিকাতেই তিনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে আমেরিকান সাধারণ জনগণের এমন কয়েকটি প্রচেষ্টার কথা তুলে ধরেছেন যা আমারও অজানা ছিল। অজানা ছিল ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট পৃথিবীর রাজধানীখ্যাত নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে সেদিন ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ শিরোনামের আয়োজনে একটি নয়, দুটি শো আয়োজিত হয়েছিল।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে বিদেশি মানুষদের সহায়তার এমন গৌরবজনক অধ্যায় নিয়ে এ রকম অনেক তথ্যই বইটিতে পরিবেশিত হয়েছে যা শুধু কৌতূহলোদ্দীপকই নয়, এগুলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনায় গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচিত হবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে মার্কিন প্রশাসন পাকিস্তানি শাসকদের পক্ষে তথা বাংলাদেশের মানুষের বিপক্ষে অবস্থান নিলেও মার্কিন জনগণ যে কতভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার চেষ্টা করেছেন তার অনেক বিবরণ এই বইতে রয়েছে। মার্কিন সঙ্গীতশিল্পী জর্জ হ্যারিসন, সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি―এ রকম কয়েকজনের সহায়তার কয়েকটি তথ্যই শুধু আমরা জানতে পারতাম গ্র্যান্ড ন্যারেটিভের অংশ হিসেবে। শামীম এই বইতে ইতিহাস খুঁড়ে তুলে এনেছেন আরও অনেক তথ্য।
শামীমের এই বই মূলত ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ নামের সেই আয়োজন নিয়ে। কীভাবে জর্জ হ্যারিসনের ভারতীয় বন্ধু পণ্ডিত রবিশঙ্করের উদ্যোগে পৃথিবীর বাঘা বাঘা সঙ্গীতজ্ঞরা একত্রিত হয়েছিলেন বাংলাদেশের মানুষকে সহায়তায় হাত বাড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান নিয়ে সেই ইতিহাস উঠে এসেছে এই বইতে।
মোট তিরিশটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত এই বইতে শামীম যেসব তথ্য তুলে ধরেছেন তাকে মোটাদাগে চারটি ভাগে ভাগ করা যায়। এক ভাগে রয়েছে ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য, যার মধ্যে রয়েছে সেই কনসার্ট আয়োজনের উদ্যোগ গ্রহণ, কনসার্টের জন্য তৈরি করা জর্জ হ্যারিসনের বিখ্যাত গান ‘বাংলাদেশ’ গানটি তৈরির গল্প, ভেন্যু হিসেবে ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনকে বেছে নেওয়ার গল্প।
আরেক ভাগে রয়েছে এই আন্তর্জাতিক কনসার্টে অংশগ্রহণকারী ব্যান্ড ও বিভিন্ন দেশের শিল্পীদের পরিচিতিমূলক অধ্যায়। এতে রয়েছে বিখ্যাত ব্রিটিশ ব্যান্ড ‘বিটলস’, এর শিল্পী জর্জ হ্যারিসন, বাংলার সন্তান কিংবদন্তি সেতারবাদক পণ্ডিত রবিশঙ্কর, প্রতিবাদী গানের রাজা মার্কিন শিল্পী বব ডিলান, ব্রিটিশ শিল্পী ও বাদ্যযন্ত্রী রিঙ্গো স্টার, মার্কিন গায়ক ও গীতিকার লিওন রাসেল, মার্কিন গায়ক ও কিবোর্ডিস্ট বিলি প্রিস্টন, কিংবদন্তি ব্রিটিশ গিটারিস্ট এরিক ক্ল্যাপটন, ভারতের কিংবদন্তি সরোদশিল্পী ওস্তাদ আলি আকবর খাঁ, তবলার জাদুকর ওস্তাদ আল্লা রাখা, তানপুরাশিল্পী কমলা চক্রবর্তীকে নিয়ে পরিচিতিমূলক নানা তথ্য।

আরেক ভাগে রয়েছে সেই কনসার্ট যারা সশরীরে চাক্ষুষ করেছিলেন এমন কয়েকজন গুণি ব্যক্তিত্বকে নিয়ে কয়েকটি অধ্যায়। স্মৃতিচারণমূলক এই ভাগে রয়েছে বাংলাদেশের সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলি, মার্কিন চলচ্চিত্রকার লিয়ার লেভিন, ওস্তাদ আলি আকবর খাঁর ছেলে বিখ্যাত সরোদবাদক ওস্তাদ আশীষ খাঁ, কনসার্টের একজন মার্কিন দর্শক লিন্ডা এন্তোনোসি, সেই কনসার্টের জন্য নিউইয়র্কে ঘুরে ঘুরে টিকিট বিক্রি করা ভারতের প্রবাসী কথাসাহিত্যিক জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, ঢাকা কলেজের তখনকার ছাত্র যুক্তরাষ্ট্রে একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিতে গিয়ে সেই ঐতিহাসিক কনসার্টের সাক্ষী হওয়া হায়দার আলি খান, একাত্তরে কাজের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া পশ্চিমবঙ্গের তরুণ অভীক দাশগুপ্ত, তখন বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বাংলাদেশি তরুণ কাজী সাহিদ হাসানের স্মৃতিচারণা।
সবশেষে ভাগে রয়েছে ওই কনসার্ট নিয়ে চলচ্চিত্র, প্রকাশনা ও নানা অর্জনের তথ্য। আছে কনসার্টের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া নিয়ে একটি অধ্যায়। রয়েছে সেই অসাধারণ মানবিক উদ্যোগের পেছনের সকল কিংবদন্তির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে লেখা একটি অধ্যায়। যদিও শামীম আল আমিন তার বইটিকে এই চারটি ভাগে আলাদা করেননি, কিন্তু যেসব বিষয় সন্নিবেশিত হয়েছে তাতে এভাবে ভাগ করা যেত। বইটিতে সেই কনসার্টের জন্য জর্জ হ্যারিসনের লেখা, সুর করা ও গাওয়া সেই বিখ্যাত ‘বাংলাদেশ’ গানটির সম্পূর্ণ কথা ইংরেজিতে পুনঃমুদ্রিত হয়েছে প্রথম ভাগে। এ ছাড়া বন্ধু ধীমান নাথের করা গানটির একটি বাংলা ভাবানুবাদও বইটির প্রথম ভাগে ঠাঁই দিয়েছেন আমার বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের অন্যতম শামীম আল আমিন।
শামীমের ‘একটি দেশের গান’ শীর্ষক প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটির যেমন বহুল প্রচার প্রয়োজন, তেমনি এই তথ্যবহুল বইটিরও পাঠকপ্রিয়তা পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। বইটিতে অজানা এমন অনেক তথ্য পাওয়া যাবে যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বিদেশিদের পক্ষ থেকে আয়োজিত নানা কার্যক্রমে নতুন করে আলো ফেলবে। এ বিষয়ে পাঠক-গবেষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
লেখক : প্রাবন্ধিক