সৈয়দ শামসুল হককে নিবেদিত কবিতা

সৈয়দ শামসুল হককে নিবেদিত কবিতা
মুহম্মদ নূরুল হুদা
অনন্তের সঙ্গে গোল্লাছুট
যে জানে না তার কোনো ভয় নেই,
যে জেনে গেছে ভয় শুধু তার;
অনন্তের সঙ্গে আড়ি দিয়ে কী লাভ?
বরং অনন্তকে বন্ধু করো তোমার আমার।
অনন্তকে বলি,
এসো, আবার আমরা গোল্লাছুট খেলি;
এসো, আবার আমরা খেলতে শুরু করি ডাংগুলি;
দোল-পূর্ণিমার রাতে জোছনার ডানায় চড়ে
এসো, আরেকবার ঘুরে আসি পরানের গহীন ভিতর;
আমাদের চারপাশে নেবুলার হল্লা,
শাদাবিবর ও কালোবিবরের দাড়িয়াবান্দা,
বাঘবন্দি তারকাপুঞ্জ এক্কা-দোক্কা খেলছে
আপন আপন কক্ষপথে;
আর সেই শৈশব থেকে
আমরাও চড়ে বসেছি আপন আপন রথে;
যেতে যেতে যেখানে থমকে যাই,
সেখানে বদল করি সারথি, সেখানেই ডিগবাজি;
জাদুকরের হাতে আমরা জাদুর রুমাল হতে রাজি।
শুধু রাজি নই কোথাও থেমে যেতে।
অনন্তবাংলার পথে বহমান এক অনন্ত-ব্রহ্মপুত্র;
সেই তো এক প্রমিত বাঙালির জন্ম ও পুনর্জন্মের সূত্র।
বাংলার কবিপুত্র তুমি, তুমি পদ্মাযমুনামেঘনার বহমানতা,
তুমি কর্ণফুলীর মাঝির বুকে দুলে-ওঠা সাম্সানের বৈঠা,
তুমি সুন্দরবনের রাজব্যাঘ্রের ডোরাকাটা চোখের দৃষ্টি,
তুমি শালতমালের বনে বনে জয়দেবের মুষল-বৃষ্টি;
না, কখনো শেষ হয়না কোনো কাহ্নু-পার সৃষ্টি।
তুমি সেই ভুসুকু, তুমি সেই কাহ্নু, তুমি সেই বাউলবাঙালির হাঁটাপথ:
এই ধানকাউনের দেশে তুমি নতুন কবির বুকে কবিতার নতুন শপথ।
আলোর ডানায় চড়ে উড়াল আঁকার আগে বলো, বারবার বলো,
আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি কবি : চলো, পরানের গহীন ভিতরে চলো।
২১.০৯.২০১৬
তারিক সুজাত
আমাকে আপনারা ক্ষমা করবেন
[উৎসর্গ : কবি-সব্যসাচী সৈয়দ শামসুল হক শ্রদ্ধাস্পদেষু]
হাজার নাগরিকের আমি একজন
প্রাচীন এ জনপদে
কতবার আমি ঘুম-ভাঙানিয়া গানে
শহিদ মিনারে দাঁড়িয়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বাণী শুনিয়েছি
-আমাকে আপনারা ক্ষমা করবেন।
আজ যখন দূরে বসে ভাবি
সেই শৈশবের স্মৃতি, – ঘোড়ার গাড়ি, গাড়োয়ান
বুড়িগঙ্গা, দোলাইখাল, সদরঘাটের লঞ্চের ভোঁ ভোঁ …
কলেজিয়েট স্কুল, জগন্নাথ কলেজ
আনিস, আহমদ, তোফাজ্জল, আমির আলী
ফিরে যাই যৌবনের খোলা দরোজায়
বায়ান্নর সন্তান আমি
– আমাকে আপনারা ক্ষমা করবেন।
রাত্রি যখন তন্দ্রা যায়, নগরীর ল্যাম্পপোস্টগুলো
বিষণ্ন হলুদ আলোর রেখা হয়ে
জানালার শিক গড়িয়ে বিছানার পাশে এসে বসে,
আমার কলম তখনও জেগে থাকে লেখার টেবিলে
আমি রেসকোর্স ময়দানে ধাবমান ঘোড়ার
খুরের শব্দের বদলে শুনি
প্রিয় মুজিব ভাইয়ের ডাক …
আমার প্রজন্ম,
৫২ থেকে নগ্ন পায়ে হেঁটে হেঁটে আসে একাত্তরে
পরাণের গহীন ভেতর বাংলাদেশ কাঁদে!
অসময়ে কান্না থামাতে পারি না
ফুসফুসের বেয়াড়াপনাও আমি ক্ষমা করে দিতে পারি
কিন্তু
প্রিয় মানুষের হাসি হাসি মুখ দেখবো না,
যাঁরা প্রবল আলোর ঝাঁঝালো মঞ্চে
আমার পাশে বসেছিলেন
কাঠফাটা রোদে নগরীর অলিতে গলিতে
যাঁদের নিয়ে বেড়িয়েছি
সন্তানসম দুই মানিক আমার!
তোমাদের ঘড়ির কাটাগুলো এখন এতো দ্রুত ঘোরে
আমার মন্থর শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে
তোমাদের প্রসারিত দুই বাহু
আর আলিঙ্গন করতে পারি না
-আমাকে আপনারা ক্ষমা করবেন।
কবিতার মঞ্চ, নাট্যশালার ঝলমলে আলো ফেলে
যেদিন সন্ধ্যায় আমি আমার প্রিয় নগরী ছেড়ে এসেছি
তোমাদের হাতে তুলে দেয়া চাবি – সেই চাবি!
যে চাবি কেবল দ্রুতলয়ে শিখে ফেলে
মানবিক সম্পর্কের দরোজাগুলো রূদ্ধ করে দিতে
প্রবাসের বন্ধ ঘরে, ক্লান্ত ফুসফুসে
যখন আমার প্রিয় রমনার একটু হাওয়া প্রয়োজন
তখন কেবল এই বৃদ্ধ কলমটি
পুরনো বন্ধুর মতো পাশে রয়ে গেলো!
কোথাও আর কেউ নেই
বিক্রমাদিত্যহীন এই দেশে
আর কোনো কালিদাস কী জন্ম নেবে না?
– আমাকে আপনারা ক্ষমা করবেন।
মধুমিতা চক্রবর্তী
প্রিয় কবি’র জন্মদিনে অজ্ঞাতকুলশীল ভক্তের প্রণতি-
স্বপ্নচারি স্পর্ধিত কৈশোর চোখের অনাদি বারান্দায়
শব্দভুক নিষিদ্ধ তৃষ্ণা হয়ে নিরন্তর খেলারাম ক্লান্তিহীন খেলে যায়।
উন্মাতাল যৌবনের মুখর আঙ্গিনায়
যেনো কার নিঃশব্দ অভিসার,
উৎকণ্ঠ প্রতীক্ষায় দিনমান- কান পেতে রই
অচেনার ভিড় ঠেলে অকস্মাৎ মূর্ত হয় কবি
সত্তার বিশুদ্ধ চত্বরে-
আবিরাম পায়ের আওয়াজ শুনি-
বানভাসি জীবনের আশার ভেলায়
বুঝি তার পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়।
প্রখর রোদেলা জন্মক্ষণে, ফুল হয়ে ঝরে পড়ে
বৈশাখের অমূল্য পঙ্ক্তিমালা-
ভালোবাসাপুচ্ছ নেড়ে খেলা করে
পরানের গহীন ভিতর-
জলেশ্বরীর সন্মোহক কবি
তার পায়ে সুনিপুণ শব্দের নূপুর পরায়,
পায়ের আওয়াজ তুলে পরানের গহীন ভিতর-
খেলারাম খেলে যায়!
তার স্পর্শে- জাদুকরী জীবন্ত ছোঁয়ার
অস্তিত্বের মৃত্তিকা ফুঁড়ে পুনর্জন্মে হাসে
ভাবনার বোধিবৃক্ষ-
ফুলে-ফলে ভরপুর আকাক্সক্ষায় অপূর্ব সম্ভার।
হৃৎকলমের টানে লেখে জাতি তার গর্বের ইতিহাস
জন্ম-জন্মান্তরের ধ্বনি শোধে চারণ কবির মসি
এক্লান্ত নিষ্ঠায়।
মিথ্যের অনন্ত গ্রাসে একা লড়ে-
সত্যনিষ্ঠ দৃপ্ত পরিচয়ে সাহস্য হৃদয় এক- একা লড়ে যায়।
হে আমার চৈতন্যের সব্যসাচী বিমূর্ত কাণ্ডারি-
জলেশ্বরীর মৃত্যুঞ্জয় স্বপ্নদ্রষ্টা- নমস্য জাদুকর,
অমার নিস্ফলা আয়ুষ্কাল শর্তহীন সঁপো দিই
তোমার অমূল্য সৃষ্টির পদতলে-
বিদগ্ধ লেখনি যেনো অবিরাম পথ চলে জীবন্ত তৃষ্ণায়
যেনো জেগে ওঠে বিপুলা মাতৃভূমি- নিঃশঙ্ক প্রতীক্ষায়।
সাজ্জাদ কবীর
চলুন বেরিয়ে পড়ি…
[সৈয়দ শামসুল হককে]
চলুন বেরিয়ে পড়ি দুইজনে, এক অনন্তের পথ ধরে, যেখানে সূর্য হাতছানি দেয়, রোদেরা খেলা করে ছায়ার সাথে আর ছায়ারা রোদের। আপনার পিছনে আমি, পদচিহ্নে পা ফেলে ফেলে। আপনার গীতিকাব্যের সুরের দোহাই, যদি না মেলাতে পারি পা ক্ষমা করে দেবেন। বরং আমিও শুনবো সেই সুর আর আনাড়ির মত পা ফেলে ফেলে এগিয়ে যাব। গন্তব্য এক করে দিয়েছে নিয়তি, হারাবো না।
চলুন বেরিয়ে পড়ি অন্তহীন আনন্দের পথে, যে পথের দুই পাশে পল্লবিত তরুসারির শাখা দোলে। কেউ বলতেই পারে, এ বুঝি বিদায় সম্ভাষণ। কখনওই না। আমি জানি এ করতালি, এ অভিবাদন আপনার কবিতাসকলের জন্য, যার স্বাদ নিতে আমিও হেঁটে যাব আপনার পথ ছুঁয়ে ছুঁয়ে।
চলুন বেরিয়ে পড়ি সময়ের পথে, যেখানে সে রাজার মত পথ চলে। তাকেই অর্চনা করি, যখন জেনেছি তার শুরু নেই শেষ নেই। তাই অস্তগামী সূর্য অন্য কোথাও উদয় হয়, নিয়ে আসে নতুন ভোর। চলুন বেরিয়ে পড়ি জাগরণের পথে, যেখানে আপনার গান শর্ষেক্ষেতে ফুল হয়ে ফোটে আর ফাগুন-বাতাস হয়ে জাগে; কবিতার পঙ্ক্তিরা মেঘ হয়ে ছায়া দেয় আর আলো ছড়ায় তারা হয়ে।
চলুন বেরিয়ে পড়ি অস্তিত্বের পথে, যেতে যেতে আরও দূর পথে। গাঙুড়ের জল বেয়ে যদি আমরা পৌঁছাই ইন্দ্রসভায় তবে প্রশ্ন করবো- কোনটা সত্য, আপনার কবিতাবীজ নাকি অকল্য শরীর আমার?
চলুন বেরিয়ে পড়ি…
সাদিকুর রহমান পরাগ
জীবনকে ছুঁয়ে জীবনের উদযাপন
(সব্যসাচী লেখক-কবি সৈয়দ শামসুল হককে নিবেদন)
শৈশবেই জেনেছি মানুষ
চলে যায় না-ফেরার দেশে
জীবনকে চোখ রাঙায়
মৃত্যু নামের এক অজানা ভয়
কিন্তু আমি তো জেনে গেছি
মানুষ যায় না- রয়ে যায়
পৃথিবীর বুকে চরণচিহ্ন ফেলে
আমি তো জেনে গেছি মানুষ
রয়ে যায় জীবনের জয়গানে
পরাণের গহীন ভিতরে প্রতিধ্বনিত
যে আমার আমি-সেও তো জীবনের আমি
মৃত্যুর চোখে চোখ রেখে আমিও
বেঁচে থাকি জীবনের আয়োজনে
ইতিহাসের পাতায় পাতায়
প্রতিটি জনপদে প্রতিটি সভ্যতায়
ঘুরে বেড়িয়েছি জীবনের অণ্বেষণে
ভাষার দরিয়ার ভাসিয়েছি জীবনের ভেলা
নিসর্গ জুড়ে অনুভব করেছি জীবনের ছোঁয়া
রাতের আকাশের তারাগুলোও
আমাকে বলেছে জীবনের কথা
জীবনের পায়ের আওয়াজ পেয়েছি
সংগ্রামে-দ্রোহে আর মানুষের জাগরণে
জীবনকে গর্জে উঠতে দেখেছি
৭ মার্চ রেসকোর্সের জন অরণ্যে
নিষিদ্ধ লোবানে শুকেছি জীবনের ঘ্রাণ
ভালোবাসা ও প্রেমের দারুণ উদ্দামতায়
একেছি জীবনের গল্প
এভাবেই জীবনকে ছুঁয়ে
জীবনের উদযাপনে একদিন
পেরিয়ে যাবো মৃত্যুকে