বিশেষ প্রচ্ছদ রচনা : ১৩ কবির শরতের গুচ্ছকবিতা

বিশেষ প্রচ্ছদ রচনা
১৩ কবির শরতের গুচ্ছকবিতা
সাত-শরতে
এক. শাদা মেঘ মায়ের দুধ হয়ে
আকাশ পবিত্র অমল বাতাস বহমান দিগন্তে
শাদা মেঘ মায়ের দুধ হয়ে ভাসা ভাসা
কোথায় যে যায় অবলীলায় সুদূরে মিলায়
আজ কোথাও পাখি নেই শুধু একটু ভালোবাসা
মুখ ফিরিয়ে কাছে এসে হেসে হেসে কুশল শুধায়
পলিমাটির সন্তানসব কেমন আছে ভালো তো
কতদিন দেখা নেই শাশ্বত এই বাংলার সবুজে
শস্য নদী ফল ফুল খালবিল প্রজাপতি সতত
সঞ্চরমান কর্মযোগী তারা সাহসী লড়াকু বাঙালি
বিশ্বাসের শাদা ভেলায় উড়িয়ে দেয় আশা-আকাক্সক্ষা
দিক্বিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে মেঘের বরাভয় আশ্বাসে
শান্তির শাদা পতাকা ওই দৃশ্যমান শাখা-বিশাখা
কোনওদিন থামবে না এই শরতের শান্তি ও শুভ্রতার মিছিল
মানুষ ও ধরিত্রীর মেলবন্ধন যতদিন আগুয়ান হৃদয় স্বপ্নিল
দুই. শরতের আসার আশায়
এই কাল নিরবধি চারিদিকে কী উজ্জ্বল অনিঃশেষ সমাধি
ভেসে ভেসে গড়িয়ে গড়িয়ে শাদা ভেলাগুলো মেঘ সরিয়ে
সমুদ্র থেকে উঠে এসে আকাশে পাখা মেলে ওড়ে বাতাসে
শত সহস্র বছর ধরে এইভাবে শরতের উত্থান নিজস্ব স্বভাবে
সবুজ মাটি নদীর ধুধু চরে গেয়ে ওঠে কাশফুল চামর দুলিয়ে
সোঁ সোঁ সেই নিঃশব্দ সঙ্গীতে ভ্রমর প্রজাপতি গুন্গুন্ অদ্বৈতে
মেলে ধরে মৃত্তিকাজল বৃষ্টির শ্রাবণে ঝর ঝর ঝরে যায় দক্ষিণে
উত্তরে নিঃসঙ্গ পাহাড় মাথা উঁচিয়ে সাগরের দিকে চেয়ে থাকে দাঁড়িয়ে
কখন যে দলে দলে হবে বহমান শাদা মেঘ পরিয়ে দেবে শিরস্ত্রাণ
আকাশে বাতাসের বসবাস শাদা শাদা মেঘের অগাধ বিশ্বাস
সেখানে শরৎ কিছুদিন থাকে তারপর উড়ে উড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে
শরতের আসার আশায় প্রতিনিয়ত প্রতীক্ষায় তবুও মানুষ কী সহায়
তিন. শাদা ডানার পাখি সব মেঘমালায় উড়ে যায় অবলীলায়
নিচের অতলে অগাধ জলমগ্নতার লহরী জলসুন্দরী প্রহরী
বৃক্ষশাখায় ফড়িং মৌমাছি কাঠবেড়ালি আম্ররুপালী মিতালি
নিঃস্বতায় শূন্যে মিলায় অদৃশ্য বাতাসের সঙ্গে নিঃসঙ্গে
ঝরে হলুদ পত্রপল্লব পড়ে ঘুরে নিচে মাটির গায়ে ডানে বায়ে
মানুষেরা উড়ে উড়ে দূরে যায় কাছে আসে না এইকাল চিরকাল
ওই যে শরতের শাদা মেঘ তাকে নিয়ে যায় ভেসে ভালোবেসে
কোনওদিনও কী দেখা হবে আবার প্রকৃতির প্রান্তরে হুহু অন্তরে
চার. দুঃখী শরৎ কী বিষণ্ন
একটুখানি শান্তি সুখ
বিপরীতের কী ব্যথার দুখ
পেয়ে মানুষ খুশি খুব
নীল বেদনায় দিয়ে ডুব
গাঝাড়া দিয়ে উঠে এসে
এক কাপ চা নিয়ে বসে
দূর জানালায় যায় যে দেখা
শরত পাখির শাদা রেখা
মেঘের সঙ্গে উড়ে উড়ে
কোথায় যায় আকাশজুড়ে
সেও যদি মেঘের দলে
মিশে যেতো মন্ত্রবলে
মেঘে মেঘে শুভ্র শূন্য
দুঃখী শরৎ কী বিষণ্ণ
পাঁচ. শিমুলের তুলো ওড়ে আকাশে
এখন তখন নয় কখনও ছিল না কখনও হবেও না
যেহেতু যা হবার তা হয়ে গেছে কতকাল গতকাল যে
আজকাল নয় এ কথা সবাই জানে জেনেছে সে নিজে
তবুও পাখি ওড়ে মহান শূন্যে অপরাহ্নে দিগন্তে ওই অজানা
কিছু অন্ধকার সঘন আন্তরিক বিবেচনায় বাতাসে ওড়ায়
মানুষের স্বপ্নসাধ অগাধ বিশ্বাস সৌহার্দ প্রীতি ভালোবাসা
বিবিধ উচ্চারণে পাখিরা ডেকে ওঠে নিঃশব্দে প্রত্যাশা
মেঘবতী হয়ে ইচ্ছে করে সুদূরের পথে পথ হারায়
সেই পথ মেঘে মেঘে শুভ্রতার শান্ত শোভনে ভাসে
বিষণ্ণ শূন্যতা পরিপূর্ণ হয় আনন্দ আর আমোদিত মনে
বাতাস নিঃশব্দ হলে সবকিছু নিরানন্দে বিচ্ছিন্ন বিজনে
বর্ষার শ্রাবণ শরতে অবশেষে শিমুলের তুলো ওড়ে আকাশে
ছয়. বুকের শুভ্রতা থেকেই উড়ে চলা শুরু
শরৎ এলো ফিরে হাওয়ায় হাওয়ায় শাদা পাল উড়িয়ে
নীল আকাশে পেঁজা পেঁজা তুলোর বান্ডিল ভেসে চলেছে
উদাস সময়টি আরও উদাস হয়ে শূন্যের সঙ্গে মেঘের গায়ে
গড়িয়ে গড়িয়ে যে কোথায় কোন ঠিকানায় উন্মনা ডানা মেলেছে
নিজেকে নিঃস্ব করে আর কতদিন চলবে এই বিহঙ্গের খেলা
অভিবাসী চলমান পাখির সংসার ঘটিবাটি বাবুই বাসা
সব নিয়েই পাওয়া যায় মানুষের বহমান স্বীকৃত অবহেলা
অনিকেত বিপন্ন উদ্বাস্তুর মর্মন্তুদ হা-হুতাশ স্বপ্নভঙ্গ দুরাশা
সঙ্গে নিয়েই এই পরিযায়ী যাত্রা শীতের শৈত্য সমাগমে
প্রকৃতির নিজস্ব ষড়ঋতু-সংবিধান বাৎসরিক অনুষ্ঠান
ঘুরে ফিরে আসে বারবার প্রতিবার এক ঐকিক নিয়মে
বুকের শুভ্রতা থেকেই উড়ে চলা শুরু অন্তরীক্ষে বিব্রত বিজ্ঞান
১ শ্রাবণের মেঘে মেঘে
শ্রাবণের মেঘে মেঘে উড়ে গেছে
শরতের রোদসী আকাশ।
গুটিয়ে নিয়েছে ডানা সাগর ঈগল।
বেনোজলে ভাসে রাজহাঁস।
নদীতীর ছেড়ে গেছে বাবুই বাথান;
এ ভাদ্রেও অকস্মাৎ বেহুলা ভাসান;
থেমে গেছে শিকারির ডানা,
খোঁজে না সাপের ডিম, ইঁদুরের ছানা।
ভুবন চিলেরা আর শাখায় শাখায়
বুকে মুখে করে না কুজন :
শরতে অঝোর বৃষ্টি, ভাসে ত্রিভুবন।
২ কাদাখোঁচা জলচর পাখি
বাদামি রঙের পাখি, ওড়ে নিজ ছকে,
ছিট-ছোপ, দাগ, উল্কি ডানার পালকে;
হলুদ-বাদামি ঠোঁট, পা-জোড়া হলুদ
গাঢ় জলপাই রঙে শরীরটা বুঁদ;
কাদাখোঁচা জলচর পাখি,
ঘাসের ভেতরে বাসা, ক্ষিপ্র দুই আঁখি।
ঝাঁকে ঝাঁকে যায় উড়ে যায়;
অকস্মাৎ থেমে যায়, যদি
ফুঁসন্ত জলের বাধা পায় অবেলায়।
৩ রাজঘুঘু
কালো ঠোঁট, পা দুটো গোলাপি,
সাদাটে শরীরে তার বালুরং ঝাঁপি।
কৃষ্ণবর্ণ অর্ধবৃত্ত ঘাড়ের ওপর।
ছোট ডাল, গাছের শিকড়
এই নিয়ে গড়ে নিজ ঘর।
ঘাসপাতা,শস্যবীজ খুঁজে খুঁজে
শরতেও ওড়ে রাজ ঘুঘু;
দুপুরে নির্ঘুম পাখি
ডেকে ওঠে সহজ সবুজে।
৪ বিরল বিপন্ন পাখি
কাঠময়ূরের দেখা মেলে না শরতে।
বৃষ্টির পালকে জাগে পরতে পরতে।
ঘুরে ঘুরে ওড়ে মন-বন:
বেগুনি-সবুজ চক্র দেহে অগণন,
ডানা, লেজ, চোখে ও অধরে।
ধূসর রঙের পাখি, সহজ নজরে।
বিরল বিপন্ন পাখি হে কাঠময়ূর,
ঋতুর হৃদয়ে তুমি নিত্য হুহুর্পু।
৫ ডাহুকের বুক
লালচে লেজের তলা,
সাদা তার মুখ-বুক-গলা;
খুঁটে খায় জলজ ঘাসের ডগা,
প্রতিবেশী ধ্যানী কানি বগা;
খুঁটে খায় কচি ধান, পাতা;
চকিতে সন্ত্রস্ত যদি,
তোলে ক্ষিপ্র মাথা।
শরতেও ঘুরছে ডাহুক
শরতেও উড়ছে ডাহুক;
ঋতুর বদল হয়,
বদল হয় না শুধু
ডাহুকের বুক।
২৭.০৮.২০১৬
শরৎবীক্ষণ
ক.
ভাদ্র-আশ্বিন স্বপ্নের দিকে হাত বাড়ায়
না, ভাদ্র- আশ্বিন শরতের ছায়াকে খোঁজে
না, ভাদ্র-আশ্বিন কিছু স্মৃতির কাছে
নীলিমার বুক পেতে থাকে
শরৎ প্রশান্তির হিম
শরৎ কাশের স্বভাবে আপ্লুত
শরৎ ডাগর মাঠে স্বস্তি-সফর।
খ.
শরৎ বাসনা ছোঁয়া শিকড়ের জাগরণ
শরৎ বাসনার আকুল সত্যের স্বীকৃতি
শরৎ বাসনাকে সমবায়ী চেতনায় ডাকে
শরৎ বাসনাকে আনন্দপরমার টানে
নগ্ন নীলের গান শোনায়
আমি শুনেছি, তুমি কী শুনেছো?
গ.
শরৎ বিবসনা মায়াবিনী নয়
শরৎ নীলাম্বরির সিক্ত অনুরণনে
জীবনে প্রবেশ করে
শরৎ ফিনফিনে জাফরানি ওড়না গায়ে
কিংবদন্তীর নরোম কুয়াশায় হেসে ওঠে
শরৎ কোনো কৃপণতা ছাড়া
ঘুঙুর বেঁধে খোঁপা খুলবে
শরৎ লোকস্নাত শেফালির সুরভিতে
মননসিদ্ধির চারা বুনতে চায়।
ঘ.
শরৎ মনমগ্ন উন্মুখ উচ্চারণে
ঐতিহ্যপ্রীতি হতে চেয়েছে,
নিসর্গের শাশ্বতিক শত নায়ে
আমাদের ভাসিয়ে নিয়েছে
নির্মেঘ আনন্দের কাব্যিক সম্ভাষণে-
শরৎ ফিরে, শিউলি-শৈশবে;
চিহ্নিত ভোরের সরিষার সমাচারে
শরৎ, চার-দেউরি মহলে ঘ্রাণ ছড়িয়ে-
আপন সত্যের ঋণ শোধে
ঋতুর বাঁক-মোহনায় চঞ্চলতা
অথবা চঞ্চলতার যৌথযাত্রা
আমাদের ভাদ্র-আশ্বিন
বিবর্তন
ভাদ্র আশ্বিনের অথৈ উচ্ছ্বাস, বুক ছুঁয়ে বয়ে যায়-
শিশিরের ঘ্রাণমাখা ভোরে, অরণ্যের সঙ্গী হয়ে ফুরফুরে গান গায়।
শরতের পোশাকেতে বিভোর হয়ে শপথ পাঠে গোপনে দরজা খোঁজে।
সূর্যের হাসিতে বেড়ে ওঠা নীলের সম্ভ্রান্ত পরিধি টুপটাপ ধোঁয়াশা ভাষাতে
খোঁজে জলরঙে আঁকা পঠিত হৃদয়; অতঃপর শতবর্ষী স্বপ্নঘোরে
ঘনিয়ে আসে বিনিদ্র শুভস্নানের শরৎ সূত্র।
শরতের মন
কাশফুলের শরৎ জেঁকে বসে মেলেছে যে দৃষ্টি
হিমেল হাওয়া এসে স্বপ্ন দেখায় পূর্ণতা ঘিরে;
জীবনধারার জ্যোতি বোধনের সমষ্টিতে ফিরে-
জমিয়েছে নানাবিধস্নিগ্ধতার মনোযোগ সৃষ্টি।
দৃশ্যত নৃত্যের ঢঙে শিউলির চঞ্চলতা বাড়ে,
নিজের অজান্তে শুধু শিশিরের মুখোমুখি হয়
পেলবতা গোপন রাখে জল্লাদ বিষয়-আশয়;
অঢেল সুষমা সঁপে-‘অনুভব’ কান পাতে দ্বারে।
দীপ্তিমান শেকড়ের অবিলাস মৃত্তিকার সুরে
অভাবিত মুগ্ধতার ঐশ্বর্য যে। ধূসরতার গান
সকল জড়তা ভেঙে করে যেন-হাজার আহ্বান
প্রণয়িনী সমাহারে জলরং যায় নাকো দূরে।
বৈধতা আসছে ধেয়ে গোছগাছের এই তো ক্ষণ,
সতেজ সত্যেও ভিড়ে খুঁজি তাই শরতের মন।
বৃষ্টিদের শরৎশৈশবে
একটা নীল পাড়ের শাড়ি ফেলে গিয়েছিলে তুমি। বলেছিলে-
পাঠিয়ে দিও আকাশের কুঞ্জঠিকানায়। অথবা উড়িয়ে দিও
ঠিক ঢেউয়ের সমান্তরালে- যদি কোনোদিন সমুদ্রের দেখা পাও।
আমি সেদিন থেকেই সমুদ্র খুঁজতে নগরে বেরিয়েছিলাম। উপত্যকার
কাছে জানতে চেয়েছিলাম সমুদ্রের উৎসকাল। কিংবা কোন সকালে,
রবীন্দ্রনাথ কাশফুল আঁকতে তাকাতেন আলোর দিকে,
গাইতে চেয়েছিলাম সেই শারদসন্ধ্যার গানও।
বৃষ্টিদের শরৎশৈশবে যে বৃন্ত চিহ্নিত দাগ আমরা গায়ে
মেখে নিতাম তা’ও ফেলে গিয়েছিলে তুমি।
প্রতিটি ঋতুবার্ষিকী এলেই আমি সেই দাগের দিকে
আরেকবার তাকাই। পা বাড়াই ভেঙেপড়া একটি
ডাকঘরের দিকে
যাচ্ছো কোথায়, মেঘ
শাদা জলের ভেতর ডুবে যাচ্ছে লালমেঘ। ডুবে যাচ্ছে ঘুম,ফুলের
সবটুকু দেনা-পাওনাদার ভোর দীর্ঘ অপেক্ষায় কাটাচ্ছে কাল-
নিচ্ছে নিশ্বাস,সকল শুভ্র বেদনা বুঝিয়ে দেবে বলে নদীও ছুটছে।
ভাদ্রের ভেদকথা পড়ে একদিন যে প্রেমিকা,তার প্রেমিকের জন্য
পাপড়ি কুড়াতে বেরিয়েছিল ডুবে যেতে চাইছে সে-ও।
মাঝে মাঝে পাহাড় ডুবে গেলে, পাঁজর এসে শুনতে চায় তার
দুঃখের কাহিনি,
মাঝে মাঝে-
উড়ে যাওয়া মেঘের দু’পাশেই নুয়ে থাকে বিশ্বাসের একান্ত কষ্টঘর।
পথতীর্থের গান
আমি সবুজের সহোদর হয়েই থাকি। লিখি পত্র তোমার সমীপে।
দ্বীপে কিংবা দ্বীপান্তরে উঁকি দেয় যে আশ্বিন,তার দিকে তাকিয়ে
ধার করি রং। এবং বিলিয়ে দিতে চাই সবটুকু প্রাণের উদ্দাম।
শ্যাম-শরতের ধ্যানে যে পাখি তার সাথী খোঁজে,কাছে ডাকি তাকে।
লিখে প্রণয়ের বন্দনাগীতি, সুর দিতে তোমার কাছে পাঠাই। সানাই
আর সারিন্দার ঘোরে নেমে আসে মেঘের প্রদেশ। আবেশ স্থির থেকে
শুধু-ছিটিয়ে যায় যে শিউলির কণা,তাকেই বলি আমি পথতীর্থদেশ।
পু®পতান্ত্রিক হাওয়াময় দিন
সজল শতাব্দীর ভেতর আমি লুকিয়ে রাখছি যে অভিমান,
তা বৃষ্টির মতোই ছিটিয়ে দেবো তোমার গায়ে। চূড়া থেকে
নেমে এসে যে ঝরনা আমাদের সাথী হয়েছিল- তার কাছ
থেকে ধার নেবো আরও কয়েকটি শরতের ঘুম। তোমার-
আমার চারটি চোখে সেই ঘুম পরে নিয়ে সযত্নে সাজাবো
আমাদের আগামী আশ্বিন।
তারপর শান্তিদেবী’কে বলবো-
তুমি স্পর্শ করো আকাশের হাত, ছুঁয়ে দেখো
তুলতুলে চাঁদের গণ্ডদেশ।
সকল মনুষ্যের জন্য ছিটিয়ে দাও ভোর-
বিছিয়ে দাও পুষ্পতান্ত্রিক হাওয়াময় দিন।
শারদীয় সুরগুচ্ছ
কখনও সমুদ্র ছুঁয়ে, আলোর উঠোনে
জ্বেলে রাখো এই স্মৃতি, করুণ রাগিণী
আমিও অতিথি ছিলাম, রাগ-বৃন্দাবনে
আঙুলের তারে তারে বাজবে তা জানি।
পুজোর প্রত্যুষে যে’জন বাজাবে সরোদ
রোদের জ্যোতিতে তার নিবন্ধিত চোখ
থাক না আমার হয়ে কালের মণ্ডপে
আরো কিছু প্রেম শুধু অপেক্ষায় থাকুক।
লাল-শাদা শাড়ি পরে মেঘের উৎসবে
যে সন্ধ্যা আমার গানে দিয়ে যায় সুর
তার হাতে সমর্পিত থেকে যেতে যেতে
দু’পায়ে পরিয়ে দেবো সবুজ নূপুর।
তারপর তোমাদের এই নৃত্যমহলে
দেখবো কেমন করে পূজারীরা গায়
আঁধারের আদিকাল ক্ষয় হয়ে গেলে
কাশফুল উড়ে চলে সফেদ বিভায়।
তোমার বরফের হাত
আর কত নৈবেদ্য দেবো তোমাকে!
কত আর গাইতে হবে তোমার বন্দনাগীত!
চাটুবাক্যে পটু নই জানো।
ভক্তি সর্বরূপিনী- যার রূপে মাতোয়ারা তামাম দুনিয়া-
তার সঙ্গে অধমের হলেও হতে পারে দেখা সহস্র আলোকবর্ষ পরে!
জবান আড়ষ্ট ছিল জন্মাবধি। এখন কর্কট নিয়েছে দখল তার
ভূমিদস্যুর মতো- যেন-বা খাসা কোনো জলাশয় বা নদী।
তবুও বন্দনা চাও তুমি!
রবীন্দ্রসংগীতের মতো ভেসে যায় শরতের মেঘ; কদাচিৎ
বৃষ্টি হয়ে ঝরে কালিদাসের অমর পঙ্ক্তিমালা।
কাগজের নৌকার মতো তাতে ভেসে যায় কলেজগামী
একজোড়া কিশোর-কিশোরী। জলের শেকল ছিঁড়ে আচমকা
এমনভাবে মাছটি লাফিয়ে ওঠে- ঝলসে যায় মাছরাঙার তীক্ষ্ণ চোখ।
অপার বিস্ময়ে মেয়েটি ছেলেটিকে দেখে, ছেলেটি মেয়েটিকে।
দেহের কলসজুড়ে এত জল- তবু কেন মাছেরা লাফায়?
যদিও তুমি থাকো অন্তরালে- কোথায় না প্রসারিত তোমার বরফের হাত!
এখন নদীও অনল বর্ষণ করে
কাশবন দীর্ঘশ্বাস ফেলে-
বুকে তার খা-বের দাহ।
পাশে একনদী ছিল- শাদা মেঘ পাহাড়ি বালিকা;
তার টানে পাথরের খাঁচা ভেঙে ছুটে আসত কত যে জলের অমৃতধারা।
এখন নদীও অনল বর্ষণ করে।
সে আগুনে ঘৃতাহুতি দেয় দীর্ঘশ্বাস।
সীমানা পেরিয়ে যাবো- ভেসে যাবো নিরুদ্দেশ মেঘের ডানায়-
ঠুকে যায় মাথা দীর্ঘশ্বাসের দেয়ালে।
অগ্নিযজ্ঞ- ইঁটের ভাটার মতো শুধু অগ্নিযজ্ঞ-
দেখে দেখে কেটে গেল কত ক্রান্তিকাল!
ইচ্ছে হয়, দু’দণ্ড তোমাকে দেখি- বসি মুখোমুখি;
কাশবন দীর্ঘশ্বাস ফেলে-
শাদা মেঘ শুধু অনল বর্ষণ করে।
ভল্লুকের থাবায় তুমি ওত পেতে থাকো
যদি বলি সর্বত্র তোমাকেই দেখি- সাগর ক্রুদ্ধ হবে জানি। বৃক্ষবন্ধন হবে বনে বনে। কাঠবিড়ালির চঞ্চল পায়ে চকিতে উঠবে বেজে তাচ্ছিল্যের নূপুর।
…এমনকি ঘাসের ডগায় পৃথিবীর অষ্টমাশ্চর্যের মতো বেজে ওঠে যে শিশিরের গান- তাতেও অস্পষ্ট নয় তোমার গর্জন। বেহুলার পাশে তুমি শুয়ে থাকো লোহার বাসরে। পতপত করে ওড়ে তোমার পতাকা সপ্তডিঙার দর্পিত মাস্তুলে।
তারপরও বিবাদ থামে না। ভল্লুকের থাবায় তুমি ওত পেতে থাকো- তাতে কি থেমে যায় স্যামনের সমুদ্র বিহার? হাজার বছর ধরে ক্লান্তিহীন তোমার দশ হাত রুধিরে রাঙাতে চায় শরতের মেঘ আর হাকালুকির জল।
ভোরের আকাশ তবু ভেসে যাচ্ছে নবজাতকের সদর্প সংগীতে।
ঘাসফুলটি হাসে
কী রাজসিক তোমার উদযাপন! রক্তগালিচার ওপর দিয়ে নাঙা তলোয়ার হাতে ধেয়ে আসছে তোমার অশ্বারোহী বাহিনী। তোমাকে কে দেখে? দেখে শুধু ধাবমান ধূলিঝড়। আর তাকে বিদীর্ণ করা তরবারির বিদ্যুৎ। তবু গোলাপের পাপড়ির মতো অবিরাম বর্ষিত হচ্ছে কাটা মুণ্ডের অর্ঘ্য।
তোমার অপেক্ষায় সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে থাকে কবন্ধ কাফেলা। কারও হাতে গঙ্গাজল। কেউ-বা ধরে আছে চন্দনের বাটি। যেন উৎসব! আছেন অতীশ দীপঙ্কর। গেরুয়া বসনে তাঁর কৃষ্ণ কারুকাজ। অদূরে অর্জুন- বর্মাবৃত। ফোরাতের দুই পাড়ে ধ্যানমগ্ন বকের মতো শুভ্র আলখেল্লার বাহার। কোনটা কারবালা আর কোনটা কুরুক্ষেত্র- তোমার তাতে কীই-বা আসে যায়!
সহস্র বছর ধরে গ্রহাণুর মতো তুমি ছুটছো। পেছনে করোটির দীর্ঘ মিছিল কদাচিৎ ঢেকে দেয় সূর্যের সপ্রতিভ মুখ। গুহারা সদলবলে প্রমোদভ্রমণে যায় জার্মানির জল্লাদখানায়। পোল্যান্ডের পতিত জমিতে পরিত্যক্ত করোটির ভেতরে বসে ঘাসফুলটি হাসে। সান্তা ক্লজের তুষারশুভ্র শ্মশ্রুর মতো মিষ্টি মেঘেরা খুনসুটি করে তার সঙ্গে।
চেয়ারটি তখনো থাকবে বসে একা
যখন-তখন তুমি রেগে ওঠো।
পিন খুলে ছুঁড়ে দাও যুগল গ্রেনেড।
হয়তো নিজেই তুমি তোমার ভেতরে
নিয়ত বেড়াও বয়ে সেই বিস্ফোরণ।
সে তো বলবেই :
উড়ে যাক, তছনছ হয়ে যাক সব।
তুমি কেন- কেউ তাকে থামাতে পারি না।
থামাতে পারি না।
তবু আমি হাসি।
একদিন সত্যি সত্যি উড়ে যাবো-কেউ
টেরও পাবে না। পায়ে তীব্র ব্যথা নিয়ে
নিরাশ্রয় চেয়ারটি নিশ্চিত থাকবে বসে একা।
ক্লান্ত চোখ দুটি তার তখনো নিবদ্ধ কম্পিউটারের স্ক্রীনে।
জানি, আস্তিক-নাস্তিক বাম-ডান কোনো সংঘই নেবে না তাকে।
একদা যাদের আমি বিনাশ চেয়েছি
কিংবা রাখতে চেয়েছি ধরে তীব্র বাহুর বন্ধনে-
চুম্বনে চুম্বনে-
তারাও গিয়েছে উড়ে ঠিক দৃশ্য কিংবা দৃশ্যাতীত কোনো ঝড়ে।
আমি আজ তাহাদের খুঁজি- সেই ঘৃণা সেই ভালোবাসা- স্প্রিন্টারের মতো
মর্মে বিদ্ধ সেই উপেক্ষার ধূলি। এই গোধূলি বেলায়
গলায় গরল রক্ত তুলে বলি : ‘তোরা ফিরে আয়’।
তুমিও বলবে। স্কুল-বালিকার মতো দুরন্ত মেঘেরা আকাশ মাতাবে।
চেয়ারটি তখনো থাকবে বসে একা।
এখানে কোনো শরৎ নেই
এখানে কোনো শরৎ নেই শরৎচন্দ্র ছাড়া
ঋতুরা যায় ঋতুরা আসে কিসের যেনো তাড়া
পেঁজাতুলোর মেঘ দেখা যায় কালেভদ্রে ছাদে
হঠাৎ ধরা পড়তে পারে ডিসএন্টেনার ফাঁদে
কাশবনের শ্মশ্রুশাদা দিগন্ত নেই বটে
কিন্তু সেসব যাচ্ছে দেখা শিল্পীর আঁকা পটে
শিউলি কিংবা শেফালি ফুল পচে না কারো ঘরে
কারণ সেসব প্লাস্টিকের-সাজানো থরে থরে
তালের পিঠা ঝালের পিঠা ভাদ্রে খাওয়ার ধুম
আসতো যখন নতুন জামাই- শহুরে কুটুম
এখন গেস্ট তৃপ্ত ভীষণ কাবাব ও বার্গারে
সংস্কৃতির টানাপড়েন প্রতিটি সংসারে
কাশবনের কপালজুড়ে উঠছে মডেল টাউন
খুন হয়েছে শরৎবুড়ো রক্তে ভেজা কাউন।
শরতের রাত্রি
শরতের এ রাত্রি আরো গভীর হলো গানে
রবীন্দ্রসঙ্গীতও ছিলো, আকাশের উদ্যানে
চাঁদের সভায় শ্রোতা ছিলো সহস্র জোছনারা
বাউল ছিলো বৃক্ষরা আর তারারা একতারা
হারানো দিন উঠলো কেঁদে শিশিরাশ্রু জল
ভিজিয়ে দিলো মনের মাটি স্মৃতিরা সম্বল
কোথায় কবে ছেলে বেলা নদীতে ঝাঁপ দিতো
সারা বিকেল পাখির ডানায় পূর্ণ সমর্পিত
ছবির প্রিয় নায়িকাগুলো উঠলো জেগে ফের
মিললো যেন স্বীকৃতি আজ নিশব্দ প্রেমের
প্রথম দেখা রাজকন্যার পরীর মতো রূপ
আজকে হঠাৎ স্মৃতির চোখে তীব্র অপরূপ
রক্ষপুরীর ডাইনীগুলো পাথর হয়ে কাঁদে
এসব কথা জানলো সবাই সঙ্গীত সংবাদে
রাত্রি কত, রাত্রি কত- গীতবিতান জানে
শরতের এ রাত্রি আরো গভীর হলো গানে
শহরে দেবদূত
যেদিন শহরে শরতের সাদা মেঘ
ভেসে এসেছিলো এরোপ্লেনের মতো,
সেদিন অনেকে ফটকে ফ্লাটের ছাদে-
হাত উঁচু করে হয়েছিলো সমাগত।
যেনো কতদিন শহরের কালো বুক
ইলেকট্রিকের মায়াজালে বিক্ষত;
সেখানে এসেছে সুবর্ণ দেবদূত
মুখ তার ভরা ভাদরের কিংশুক ।
ভুরু অগণিত কাশফুল দিয়ে ঢাকা,
চিবুকে গ্রীবায় রহস্য মেদুরতা;
চুল যেন তাঁর অসীম উপত্যকা,
দেবদূত নাকি শোনাবে সুখের কথা।
এ-শহরে তবে শান্তি আসবে ফিরে
গ্রাম থেকে আসা অনাহারীদের ঢেউ
ফিরে যাবে নীল দুপুর বিছানো পথে,
পাথুরে কান্না শুনবে না আর কেউ?
দেবতার খোঁজে শরৎ রাত্রে যারা
উড়ে গিয়েছিলো নক্ষত্রের দিকে;
দেবতা এসেছে সেই সংবাদে তারা
ভালোবাসবে কি ব্যথিত শহরটিকে?
শরৎ পর্ব
সবাই তাকে চেয়েছিলো গভীর অন্তপ্রাণে,
একাকী গাছ যেমন থাকে শোভিত উদ্যানে।
গাছের ছায়া ছিটিয়ে দেয়া ভালোবাসার বীজ,
অঙ্কুরিত বোধন চেনে বর্গী-পর্তুগীজ।
সবাই তাকে ডেকেছিলো বাইরে এসো ফের,
মুক্ত করো সূর্যে সেঁকা শরৎ প্রভাতের।
কিন্তু তাকে কোথায় পাবো পথের পরে পথ,
ছড়িয়ে রাখে অহর্নিশি অনন্ত দ্বৈরথ।
কোথাও তার চিহ্ন নেই মাতৃগর্ভ খুঁজে,
পাওয়া গেলো ভোরের ভ্রুণ দিগন্ত- তরমুজে।
এতটা লাল রক্ত নয়, স্বপ্ন নাকি স্বেদ,
জানতে গিয়ে নিঃশ্বেষিত গীতা পুরাণ বেদ।
ইতিহাসের অভিজ্ঞতা প্রণম্য সব বাণী,
তর্কজলে তলিয়ে গেলো বিখ্যাত রাজধানী।
সবাই তাকে চিনলো যখন রাত্রি এলো ঘোর,
পুত্রশোকে তিথোনাসের মুমূর্ষু ঘরদোর।
উষাদেবী আসলো রথে অশ্রুটলমল,
বললো লোকে এইতো শরৎ শিশিরকরোজ্জ্বল।
এখানে মাসগুলো এখানে দিনগুলো
এখানে মাঘ মাসে প্রখর তাপদাহ
ঘাসেরা মরে যায় জলেরা বাঘ খায়।
এখানে ফাল্গুনে ফুলেরা প্রজাপতি
প্রায়শঃ মেরে ফ্যালে; চৈত্রে মাঠে-মাঠে
সবুজ সমারোহ মেঘের অভিসার।
এখানে বৈশাখে পিঁপড়ে নির্ভয়,
শীতের মতো তার রয়েছে সঞ্চয়
বাতাস বেগহীন আকাশ ধু ধু নীল;
এখানে জ্যৈষ্ঠের বন্ধ্যা দিনগুলো
দেখে না ডালে ডালে ফলের পাখিদের,
কেবল অবনত গাছেরা কেঁদে ওঠে।
এখানে আষাঢ়ের ধূসর বুক জুড়ে
তুমুল ধূলিঝড় বরফ কাঁপা শীত।
শ্রাবণ কন্যারা তৃষ্ণা কাঁখে নিয়ে
কোথায় চলে যায় গভীর কোন বনে;
পথেরা পিপাসায় ছড়ায় হাহাকার।
এখানে ভাদ্রের ভাতের শানকিতে
পাথর কাঁকরের অবাধ বিচরণ।
এখানে আশ্বিনে শিমুল পলাশের
প্রবল উত্থান, ঘরের চারদিকে
গেরুয়া শাড়ি পরে পরীরা নেচে ওঠে।
এখানে কার্তিকে কোকিল গান গায়;
অগ্রহায়ণ এলে অঘোর বৃষ্টিতে
নদীতে বান ডাকে ব্যাঙেরা জেগে ওঠে।
পৌষে পিঠা নয়, আকাশে মেঘ ডাকে,
শেকল ছেড়া ঝড় নামায় বিদ্যুৎ।
এখানে দিনগুলো রাতের মতো আর
রাতেরা রাত নয় সূর্যখর দিন।
এক
সোনালি পাতাটি সবুজ রোদের আরশী পরশে
হয়েছে বিভোর আজকে আবার অচেনা আলসে
সেজেছে নতুন মায়া কিন্নরী মুগ্ধ কবিতা
হেসেছে কোমল স্নিগ্ধ সজল ও অপরাজিতা
তুমি কি পেয়েছো তোমার বীণাটি ফেরত আবার
বুঝেছো কি আছে কোথায় তোমার অলকাবাহার?
আকাশের বুকে রঙিন তারারা হয়েছে উছল
শরতের দিনে মনের আঙ্গিনা শুভ্র ধবল
চারদিক জুড়ে হৃদয়ের সুরে হাওয়ারা গায়
মোহনার গান স্বপ্ন উজান- খেয়ালি দোলায়।
টলিডো ২০১৬
দুই
সন্ধ্যা ছায়ায় নির্জনতায় ছায়ামূর্তিরা চুপ নিশ্চুপ
দূর কুয়াশা মেঘ ধোঁয়াশা যেন পুড়ছে নীরবে ধূপ
দৃষ্টি ভাঁজে গন্ধরাজে কারা যে আসে জোনাকি
মন গহিনে নীল রঙিনে আমারই বন্ধু তারা কি?
জানা নেই তা, চঞ্চলতা তবুও মনে কি যে তোলপাড়
তাদের কাছে হয়তো আছে ফেলে আসা সেই দিন আমার
এই যে আঁধার এই হাহাকার তার যে এমন আকুলতা
কেন যে সে, বুকে এসে হারিয়ে ফেলে তার কথা
ছিল তার মুখ পূর্ণিমা সুখ সুরেলা বাঁশির নদীটা
আমার সকল স্বপ্নকুশল, খুঁজে ফিরি তার ছবিটা।
টলিডো ২০১৬
তিন
ওই দেখো সাদা ঘাস, কাশফুল, সবুজ মেঘ
একদিন পথে যেতে যেতে
আমি যখন
টলমল কালোজল ঘরে
দেখছি চোখের সায়াহ্ন সাজ,
খুঁজছি মার্বেল বাড়ি
তখন তুমি
সেই তুমি
এসেছিলে রংমাখা পাতাবাহারি
নিখাদ সোনালি শরৎ
এসেছিলে কাছে
বসেছিলে পাশে
বলেছিলে কিছু
কি বলেছিলে?
মনে পড়ে?
ভুলে গেছো?
ও
আমি কিন্তু ভুলিনি
আমি ওই দিন, ওই ক্ষণ
সবকিছু এঁকে নিয়েছিলাম
যে রঙ মোছে না সেই হৃদয় রঙে
আমি ওই দিন ওই ক্ষণ গুন গুন গেয়েছিলাম
যে সুর ক্লান্ত হয় না সেই হৃদয়সুরে
যদিও তুমি
বোঝোনি কিছুই
ভাবোনি কিছুই
কারণ
আকাশের গায়ে বৃষ্টির আলপনা
ওই যে রংধনুটা
ওটা আঁকার আগেই তুমি চলে গিয়েছিলে
কথা তুমি রাখোনি
ফিরে তুমি আসোনি
আমি কিন্তু সব
জমা করেছি
মগজের সিন্দুকে
রেখেছি তাদের নিঃসময় দিয়ে মুড়িয়ে
ক্ষতি নেই তুমি না এলে
তারা আছে
ওই দেখো সাদা ঘাস, কাশফুল, সবুজ মেঘ।
টলিডো ২০১৬
চার
আমি আসি জানালায় ক্লান্ত ক্লিষ্ট তিয়াসা আকাশ
প্রতিদিন ভোর, দুপুর, সন্ধ্যে, রাত
অহর্নিশ আমি ঘুর ঘুর করি
বেনোজল হাভাতে ধুলোবালি কাদা
গায়ে পড়ে ইচ্ছে করেই আমি ছ্যাঁচড়
তুমি হাসো আমিও হাসি
এবং মানি
আমি জানি
আমার দরখাস্তটা
সেটা পড়ে থাকবে নির্বাক আঁকিবুঁকি
বৃত্তাকার কাটাকুটি
এবং এভাবেই প্রতিদিন আমার অপেক্ষা
তোমার উপেক্ষা
এবং এভাবেই প্রতিদিন আমি জল
আমি মেঘ আমি বৃষ্টি
এবং এভাবেই প্রতিদিন
তুমি দূরে
অ-নে-ক দূরে
আমার চোখের কার্নিশে
বসে থাকো ডানামেলা খোলাচুল… রিনি ঝিনি, রিনি ঝিনি।
টলিডো ২০১৬
পাঁচ
শরতের মেয়ে হাসিটা তোমার রং বাহারিস্নিগ্ধ
পাতায় পাতায় যাচ্ছো লিখে ওই কবিতাগুচ্ছ ঋদ্ধ
আমি ছায়া মেঘ যাই ঘুরে ঘুরে যদিবা পাই দেখা
বসে আছো বেশ চোখ ঢুলু ঢুল ভীষণ উদাসী একা
দৃষ্টি তোমার আকাশের নীল, নীলাভ তুমি নিরুপম
তুমি যে অপার, তুমি যে অসীম তুমি যে সুন্দরম।।
টলিডো ২০১৬
রাইতের নীল ডহরে
আমারে তুইলা নায়ে রাইতে কারা লয়া যায় বিলে?
খোমাটোমা কিছু নাই। তেনাদের চউখ-মুখ নাই।
মুখের বদলে দেখি, শাদা কাপড়ের তিনখান ত্যানা
লড়েচড়ে আলগা বাতাসে। আর, আজগুবি নাও
নীল ডহরের জলে চেলচেলায়া কলকলায়া চলে।
খাগড়ার আড়ালে এক কুড়া পাখি লেঞ্জা উঁচায়া কারে ডাকে!
ছড়াগুলির লাহান মাছেরা বেবাক ছিটকায়া-লাফায়া যায় দূরে
পশ্চিমে জাঙ্গাল আর দক্ষিণে গোপাট; বুগলে বাইদের জলে
গোপনে সিনান করে লেংটা চান্দের গোল খুবসুরত খোমা;
এইসব তেলেসমাতি দেইখা ভাবি : আমি ক্যান এইখানে আইজ?
হুমুন্দির পোলারা ক্যান মাইঝ রাইতে
তুইলা আনলো এই নীল ডহরে আমারে?
পথভুলাইন্যা কানাঅলা? পরীটরি নাকি এরা পেরতের দল?
শইল্যে হাতায় কেডা?
অজাগায়-বেজাগায় লড়ে কার হাত আর খবিস আঙুল?
ডর পায়া বোবা হয়া মিচকা মাইরা থাকি আমি চুপ!
আখেরে মালুম হয়: এইটা হৈল রাইতের লিলুয়া বাতাস
এই চান্নি রাইত, এই ফুরফুরা মিহিন বাতাসে কত-শত
কাঁইপা ওঠে সরালির-মরালীর ছতরের উদলা পশম।
জলের কৈতরগুলা পাঙ্খা নাড়ে বৈতলের মতো;
পাখনার আওয়াজে তারা ভইরা তোলে সাত আসমান।
কি কারণে কালবাউস, তিতপুঁটি, খইলসা, কই, উগোল,মাগুর
পানি থিকা ফাল মারে। মিশ্যা যায় পানিতে আবার!
শরতের চান্নি রাইতে মাছগুলা কী কারণে হৈল বেচইন?
মাছ দেইখা আহে উদ, আহে গুই গাতুম-গাতুম,
আহে ফেউ একলা আর দল বাইন্ধা খাটাশের দল;
গর্ত থিকা…হুক্কা হুয়া-খেঁকশিয়াল লাঙুল উঁচায়া খেমটা নাচে!
ঘুরায়া-বেঁকায়া ঘাড় পেঁচা চায়া দ্যাখে;
কড়ুই গাছের উপ্রে বইসা এক ভেটেরান চিল
মাথার ভিত্রে তার প্রি-এম্পটিভ স্ট্রাইকের ভয়ানক ছক আঁইকা চলে;
তারা যেন অন্য কোনো মহাভারতের যুদ্ধের ভিতর থিকা
জন্ম লইতে থাকে ধীরে ধীরে; জন্ম লইতে লইতে নিজেগোর
বেশুমার আগামী যুদ্ধের ভিত্রে বইসা ধীরে নিশানা সাজায়
অর্জুনের তীর হয়া, অব্যর্থ আয়ুধ হয়া, কিরাতের বাঁকনল হয়া
শানদার ঠোঁটে-নখে কখন যে নাইমা আসবে তারা
ফাল-পাড়া মাছেদের ঝাঁকে আচানক!
অহনে অনেক রাইত। একলা আমি তেনাদের লগে
নাও-ভাসা হয়া চলি। কই যাই কোন দিকে কিছুই জানি না
জানি এই আজিব রাইতের ভিত্রে আছে আরো রাইত;
আমার ভিত্রে আরও কতো কতো আমি
বাইদের ভিত্রে আরো কতশত বাইদ রয়া যায়!
নাই শুরু নাই শেষ।এক আলাহিদা শুরু ও শেষের ভিত্রে আমি;
একা আর শত শত আমি। শত শত বিলে-বাইদে, শত শত
হাওরে-সায়রে আমি শত শত ‘আমি’ হয়া ভাসি।
সেইসব নায়ে মাঝি নাই। আমি আর আমার বুগুলে তিনজন;
তেনাদের খোমাটোমা কিছু নাই। চউখ-মুখ নাই।
মুখের বদলে দেখি, শাদা কাপড়ের
তিনখান ত্যানা খালি লড়েচড়ে আলগা বাতাসে!
শিরোনামহীন শরৎ
১
এখনো কেয়ার গুচ্ছে কিছ ুফুল আর আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ
আমার ভুল কিনা জানি না, সত্য করে বল তো কে করেছে এ রহস্য? তুমি?
তুমি তো বৃষ্টিমাখা শাল্মলি তরুর সাথে সখ্য রাখনি
করোনি বিলাস বুনো ফুলের সাথে অথবা শাদা জামদানি পরা আকাশের ক্যানভাসে
তোমার কিছু পঙ্ক্তি ছড়িয়ে রাখনি যক্ষের জন্য।
আমার চোখে বিকেলের ঘাস আরো উত্তেজিত হয়ে ওঠে
বহু দূর থেকে আমি ছবি তুলে রাখি; কয়েকটি ঘুঘু ঘুঘ ুরবে চলেছে অলস হেটে সোজা দক্ষিণে
আমি বৃষ্টি যাপনের ছবি মনে করে বিরহী হয়ে উঠতে পারি তোমার সম্মতি থাকলে
জানি তুমি বিলাসি তব ুকবিতার হাত ধরে যেতে পারো না বেশিদূর
আপাতত শরৎ আমাকে সেতারে সংগীত মূর্চ্ছনা এনে দিচ্ছে তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে
তুমি প্রস্তুত থাকলে আসতে পারো।
২
দোপাটি ফুলের সাথে কথা হয়েছিল সে আর বৃষ্টিকে সহ্য করবে না কোনোমতে
আমার মৃদু আপত্তি ছিল; সে বলেছিল প্রজাপতির দিকে চেয়ে দেখ
আমি মাধবীলতার ফুলের সাথে কৌতুকে মেতে থাকা দুটো প্রজাপতির দিকে তাকালাম
আর ঠিক তার ওপর দিয়ে বিকেলে ভ্রুকুটি করা আকাশ আমাকে খানিকটা বিব্রত করে
এই সব অনুযোগের সুর আমাকে নিয়ে যায় বাতাস আর রঙের কার্নিভালে
আমি বসে থাকি বিকেলের লনে যেখানে সবুজ তার রাজত্ব ছড়িয়ে বসে আছে বাংলার নিজস্ব নিয়মে
অকালে বোধন পাওয়া কবির কীবা করার আছে এই নরোম কোরক আলো আর রঙের প্রলয়ে না মিশে
আমি শুধু তোমার কথা একবার মনে করতে পারি, তুমি কী শ্বেতশুভ্র শাড়িতে কোন বিজন বনে বসে আছ?
অথবা তোমার সামনে ঝাঁকে ঝাঁকে পায়রা উড়ে যাচ্ছে হুটোপুটি করে শুভ্র আকাশের সাযুজ্য মেখে?
তোমার কি মনে হচ্ছে বৃষ্টিবন্দনার রাত পেরিয়ে আমরা চলে এসেছি শরতের মোহন আদরে?
অথবা নাগরিক চাঁদের আলোয় মেঘ জোছনার বন্যায় ভেসে যাবার আগে তুমি খুলে নিচ্ছ তোমার খোঁপা?
এসো আকাশ সমুদ্রের বর্ণিল ইশারায়
৩
তোমার মুখে কতটুকু সূর্যের আলো বিকেলের পাতা ছুঁয়ে গেলে হিরন্ময় হয়ে ওঠে তুমি কি জানো তার অনুপাত?
খুব ভোরে কাশ বাঁশি বিষের বাতাসে কতটা চঞ্চল হতে পারে তোমার মন তুমি কী তা জেনে নিতে পারবে নদীর কাছে?
অথবা নক্ষত্ররাতে জোনাকির আলো কতটুক ুপ্রলোভন দেখাতে পারে নতুন প্রেমিকাকে অভিসারে যাবার আগে?
তুমি কী জানো আড়মোড়া ভেঙে শরতের বাংলা আজ কতটা শিশির বুকে করে নিসপিস করে চলেছে ভোরে?
বারবার নদীর আঁচলে ঢেউ তুলে যে বাতাস ফিরে যায় উত্তরে তার কোন নাম তুমি দিতে পারবে কী?
আমি নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকি দীঘল বাঁকের কাছে যেখানে মাঝি আমাকে ঈশারা করে প্রত্যহ
আমি ছুটে চলেছি প্রান্ত ভেদ করে ভোরের যমুনা ছুঁয়ে কাঠাল সারির নিচে শিশিরের সমুদ্রে
আমার কাছেও কোনো উত্তর নেই সখা,আমিও প্রসন্ন বিস্ময়ে জীবনের পাঠ নিতে চলেছি শারদীয় শোভায়
তোমার সময় হলে দেখে যাও কত প্রাণ নতুন করে জেগেছে দিকেদিকে।
ভালো আছি, নেই
আমার তিন বছরের ছোট ছেলে, অনিরুদ্ধ, যদি কেউ তাকে জিজ্ঞেস করে ‘কেমন আছো?’ তবে বলে ‘ভালো আছি, নেই।’
বিস্মিত হয়ে ভাবি, তবে কি সে সময়ের ভাষা জানে? জানে আমাদের হৃদয়ের কথা, যাপিত জীবনের আশা-নিরাশা? আর কে
না জানে, শিশুরা তো দেবদূত। তাদের শুদ্ধ আত্মা নাকি ভূতভবিষ্যৎ অনুভব করে। আমি এসব বিশ্বাস করি বা না করি
তাতে কী যায় আসে। অন্তত আমার ছেলে তার বাপের ভাষা বোঝে, হয়তো বোঝে তার ভূগোলের ভাষা ও বেদনা কিংবা
সময়…। নইলে কী করে সে বলে…?
২
আমরা এমন সময়, স্বদেশ ও পৃথিবীতে আছি, কোনো সদুত্তর নেই। কোনো সারল্য নেই। কঠিন প্রশ্নের নেই সহজ উত্তর-
হ্যাঁ কিংবা না। কেউ কি এখন ভিতর-বাহির মিলিয়ে বলি : আছি, ভালো আছি কিংবা নেই, একেবারে ভালো নেই। থাকা-না
থাকার কিম্ভূত রসায়নে জাড়িত হতে হতে, তাড়িত হতে হতে ভুলে যাই কী আছে কী নেই কিংবা স্বয়ং আমিই আছি বা নেই!
৩
তাই ডুবে যাই, ভেসে উঠি, মরে যাই, বেঁচে উঠি। আর ভাবি এই তো আছি, আবার নাই।
আমিও তাই সপুত্র কোরাস গাই : কেমন আছি? ভালো আছি, নাই।
জন্মদিন
এক-একটা জন্মদিন মানে স্বপ্নিল শৈশব থেকে
আরো একটু দূরে সরে আসা;
জীবনের কদর্য-পঙ্কিলতার ভেতর আরো একটু
ডুবে যাওয়া
আর
মৃত্যুর মহান গান আরো একটু নিকট থেকে শোনা।
তবু জন্মদিন আহা জন্মদিন,
মনে হয়
জীবন তবু অন্তহীন,
নতুন স্বপ্নে দিয়ে ভর
হই আবারও
অমলিন!
মানুষ, বৃক্ষ হও
মানুষ, তুমি বড় মহান, মহান শয়তান কিংবা দেবদূত। তুমি নাকি সেরা সৃষ্টি ঈশ্বরের, দেবতাপুত্তুর। অথচ দ্যাখো, পৃথিবীর সব প্রাণ বাঁচে প্রাণে ও প্রণয়ে। তাদের হত্যা কেবল ক্ষুধা ও তৃষ্ণায়, অস্তিত্বযাপনে। আর তুমি মানুষ, অমৃতপুত্র, তুমি কী করো? তোমার হাতে লাঞ্ছিত ভূমণ্ডল, শঙ্কিত যত পাহাড় ও সাগর; তুমি হত্যাকারী যত নদী ও নিসর্গের; পাখিরা রক্তাক্ত তোমার শখের শিকারের; কী এক আজব বিকারে তুমি হত্যা করে চলো মানুষ : সকল প্রাণের বিনাশে তুমি মদমত্ত, উল্লসিত ও আপ্লুত; কেবল হত্যার জন্য তুমি নির্মাণ করো কিম্ভূত মারণাস্ত্র; আর তুমি মৃত্যুর বাণিজ্যলিপ্ত, লোভী, রক্তমুখো মুনাফাখোর।
ব্রহ্মাণ্ডে তুমি এত তুচ্ছ-ক্ষুদ্র, তবু নিজেকে ভাবো ঈশ্বরের তীর, মানবখুনের বিনিময়ে তুমি হও মহাবীর। অমরত্ববিলাসী তুমি লুপ্ত হও ছাই ও ধুলোয়। জানি, তোমার আছে অক্ষর, তুমি জেনেছো গণিত ও সুর। আর তাই এত অহঙ্কার করো। মৃত্যুর বাগান রচে, ধ্বংসের হিমালয় গড়ে নিজেকে করে তোলো অসুর।
অথচ তোমার কোনো প্রয়োজন ছিল না পৃথিবীর, প্রকৃতির। ভেবো দ্যাখো, মানুষবিহীন পৃথিবী কী সবুজ, কী কোমল, কী সুন্দর।
বৃক্ষেরা বাঁচে নিখিলের ঐক্যে, জানে হাওয়ার গান, নিজের পল্লবে পৃথিবীকে করে রাখে সজল-শ্যামল। আর তোমার অস্তিত্বের সে তো পিতা প্রবীণ ও গুরু নিঃশব্দ, এত যে জ্ঞানী তুমি, কেন একটু শেখো না! এ কি তোমার মদ, মগজ ও মজ্জার দোষ!
মানুষ, তুমি আরো একটু মানুষ হও, আরো একটু মানবিক। বৃক্ষের মতো হও আনত, সহজ ও সবুজ…
ফোনবালিকা
এই নির্জনগহন রাতে, আজ, সেই বালিকাটির কথা মনে পড়ছে। কণ্ঠ তার এত সজীবপ্রাণ,
এত ভেতরের ভেতর থেকে চেনা, তাকে যে দেখিনি কখনো, সে কথা মনেই থাকে না-
বালিকা সে আমার চিরকালের, যদিও গূঢ়স্বচ্ছতা আছে তার যোনী ও স্তনের…
গোপনগভীর রাতে, আমার, সেই ফোনবালিকার কথা মনে পড়ে-
কথা তার স্পষ্ট ও উদার, স্বচ্ছ জলাধার, হিমোষ্ণ স্নানাগার
ফোনের ভেতর দিয়ে সরু এক ধারা হয়ে ঝরে আর ঝরে
এই শীতোষ্ণ রাতের গভীরে, আমার, বালিকাটির কথা কেবলই মনে পড়ছে।
ফোনের ভেতর দিয়ে কথা তার ঝরনা হয়ে ঝরে, আমার বুকের গহন স্নানাগারে…
দেবী ও মানবী
আমার মানবীদেবী তুমি, দেবী ও মানবী
পৃথিবীর ভিড়ের ভিতর থেকে
তুলে নিই যখন তোমাকে
একরত্তি নারী শুধু তুমি
মনে হয়
আবার যখন ছুঁই তোমার হৃদয়
থাকো তুমি দূরনীলিমায়
আমার মানবিক শরীর থেকে দূরে, না-শরীরী
রক্তের ভেতর কী যে স্বপ্ন-স্বপ্ন ঘ্রাণ তোমার
যখন ছুঁতে চাই, আমিও স্বপ্নে মিলাই
ঝাপসা হয়ে আসে
ঝাপসা হয়ে আসে সবুজ- আবার মনে করিয়ে
দেয়- আমিও ছিলাম ওইখানে; ওই পাতায়, ঘ্রাণে;
আনত মুখের কিনারে সলজ্জ সেই প্রথম আভা-
সবুজে সবুজ তুমি- আমাকে নিয়ে যাও একটানে।
বুঝি না কিছু। সব বিভ্রম-ভ্রান্তি বলে বোধ হয়-
বানানো তুমি! নাকি বাস্তবেও ছিলে কোনো একদিন!
কেবল সবুজ স্পর্শে যখন ডুবিয়ে দাও- মর্মমূলে
ভিজে যাই সুতীব্র আবেগে। নিশ্চিত প্রেমের চিরঋণ।
বোঝা না বোঝার মাঝখানে থাকো তুমি, অনশ্বর-
সহস্র বছর পরেও একই রকম ঝলমলে সবুজ,
সুন্দর। শুধু আমি- দুর থেকে আরও দুরে যাই-
পাই না তোমাকে ছুঁতে। বালক এক, দুরন্ত-অবুঝ!
ভ্রান্তি হোক যতÑ তবু তোমাকেই স্পর্শে চাই।
সবুজে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাবো দিগি¦দিক-পাই বা হারাই।।
আড়াল
তোমার কাছে পৌঁছুবো- এটাই স্বাভাবিক !
ঐ সুন্দর স্মিত হাসি, ঐ ঝরঝরে অনর্গল কণ্ঠস্বর
তোমার চোখভরা খুশি; যেকোনো কথার চটপট উত্তর।
বুদ্ধিদীপ্ত ঠোঁট, সহাস্য চুল- তোমার কাছে আমি
যাব না তবে কার কাছে যাব?
আড়ালের সহস্রমুখ নাগপাশ
বহুবিধ শেকল; তোমার কাছ থেকে
নিরন্তর দূরে সরিয়ে রাখে আমাকে।
– জি, কেমন আছেন?
– দিনকাল ভালো যাচ্ছে তো!
– সব ঠিক আছে …
– তো আপনার কাজ কেমন চলছে?
– দেশের যে কি অবস্থা!
…এইসব আমড়াগাছি কথাবার্তা!
তোমার কাছে যাব; ওষ্ঠ-কণ্ঠ-চক্ষু-চুল-গ্রীবা
সব একসঙ্গে হেসে উঠবে পরস্পর।
আমরা একে অপরের চোখের ভেতর ডুবে যাব
এক লক্ষ বছরের জন্য…
আড়ালের সকল আবরণ ছিড়ে দৃষ্টি
বিনিময় সরব হবে- ঠিক যেমন মনে মনে চাই।
তোমাদের মনুষ্য ভদ্রতা আকীর্ণ সমাজে
এ’রকম কখনই হবার নয়; না?
ঘুমের বাড়ি
চোখ-ভরা ঘুম বেলা কি অবেলায় আমাকে হেলে
পড়তে ইশারা দেয়। চোখে মরিচের গুঁড়ো জমে থাকে
অহর্নিশ। জ্বলতে থাকে অবিরত। হেলে পড়বার জন্যে
আমি একটা অবলম্বন হাতড়ে ফিরি, খুঁজতে থাকি।
নিরালম্ব ডাকঘরে কার চিঠি পড়ে থাকে আজও।
চিঠি এখনও আসে তবে? ঘুমও ডাকে নিরিবিলি।
শূন্য ঘরে কার ছায়া নিশ্চিন্তে পাশে বসে, চুল টানে;
সবই তবে ঘুমের ঘোর। অফিসে যাবে না? নরম স্বর
জিজ্ঞেস করে। কোথায় অফিস, কার অফিস, কিসের অফিস…
তুমুল রোদের ভেতরে, তুমুল বৃষ্টির ভেতরে, অনর্গল
বেঁচে থাকবার উৎসবের ভেতরে
আমি কেবল নিবিড় ঘুম-ঠিকানার দিকে
পা বাড়াতে চাই। কিশোরের মতো
নিষ্পাপ সেই ঘুম; হাতের শিরাটিও কাঁপবে না তখন!…
নিঃস্বপ্ন, মিহি ঘুমের দানা আমার তৃষ্ণার্ত মুখ, চোখ
জড়িয়ে ধরে রাখবে তোমাদের যুদ্ধের নগরে-
রাতদিন আত্মগোপনে বিধ্বস্ত-বিপন্ন
খরতাপদগ্ধ এই মুখে তখন শিশিরের মতো
ঘুমের হিম দানা।
খেলে খেলে ক্লান্ত বালকটির মতো তারপর আমি ঘুমিয়ে পড়ি…।
নীলপদ্ম
যখন প্রথম এলে তুমি; তখন আমি অস্থির নৌকায়-
টলোমলো পায়ে বিস্মিত-বিহ্বল তাকিয়ে ছিলুম খানিক;
আত্মার অংশ তুমি কোথা থেকে এলে? জানি না তা-
কেবল তাকিয়ে আশ মেটে না; হাসো শুধু ভুবন ভুলানো-
তারপর নেচে নেচে যাও চারপাশ দুলিয়ে; বেচে উঠি আবার;
নতুন আনন্দে নতুন গানে ভরে দিলে চারপাশ সৌরভে!
নিখুঁত চলচ্চিত্র তুমি; অন্ধ-হতে-চলা আমার আঁখি তারায়;
কষ্টকর ঘুম আর সুদীর্ঘ জাগরণে তুমি অফুরান শক্তি-দময়ন্তী।
সেই যে রাস্তাটি
সেই যে রাস্তাটি-
ডানদিকে ঢুকে বাঁক নেয় উদাস পূর্বদিকে। শেষ মাথায়
একটা লাল দালান।
দালানে বসবাসরত আনন্দময়ী- তুমি। লালাভ মুখে
পুরো পৃথিবীর রূপ স্থির হয়ে আছে তোমার মুখে চুপে!
সারা শরীরজুড়ে তোমার জন্যে ঝিমঝিম ঝিমঝিম…
১৯ বছয় বয়সে এমনই হয় বুঝি!
লাল দালান তেমনই আছে আজও।
দালানের ভেতর ছিলে যেজন- সেই লালাভ মুখ
নিয়ে, পৃথিবীর সব হৃদয় নিয়ে কোথায় যে তুমি!…
১৯ বছর আর নাই জীবনে;
কত দুঃসহ ১৯-এর থাবায় সব এলোমেলো….
তবু আজও তোমাকেই খুঁজি। শুধুই খুঁজি।
পাপচিহ্ন
আজলাভরে জলে ধুয়ে নেব পাপচিহ্নমাখা মুখ
কই পাবো সেই জল; রোদন ভরা ঘন আষাঢ়ে-
বন্ধ চোখে কত আর ভোলানো নিজেকে! সুখ
দূরে থাকে দুইশ মাইল; যেন ঘুরি মু-হীন ঘাড়ে!
পাপ! পাপ! ঘামে ভেজা মুখজুড়ে দেখি পাপ!
একলা দাঁড়িয়ে থাকা! পালিয়ে থাকার প্রাণান্ত
চেষ্টা- সবই পাপ। নিজেরে নিশ্চিন্তি খোঁজা-
মরছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র- শাপান্ত
করে না কেউ! এভাবে বাঁচা যায়? আপন দেশে?
নাকি এদেশ আমার নয়? পরবাসী- যে যার বৃত্তে!
কোনোক্রমে খাই-ঘুমাই- ঘাড়গুঁজে বাঁচি-ডালেভাতে-
আর প্রাণভয়ে লুকোই একলা- একা ইঁদুরের গর্তে!
নিঃশব্দ অশ্রুপাতে- একা- বেঁচে থাকার কী মানে-
আকাশের ওপারে আরও আকাশ- সভ্যতার সন্ধিক্ষণে।।
আক্রান্ত
আমার ভেতরে বিচ্ছিন্ন যে নাগা সন্ন্যাসী প্রায়ই
কলরব করে
তার ভেতরে আমিও বসে থাকি
চুপচাপ
ক্ষণমাত্র;
দেখতে পাই, পৃথিবী কম্পনসূত্রে
বাঁচিয়ে রেখেছে আমায়, দাসের
ভূমিকায়, ক্ষুদ্র সফেদা গাছের সাথে।
বেঁচে থাকো
আর
বিজ্ঞানীরা বলে যদি, ‘ঘড়ি হও তো…মিনিট-সেকেন্ডের
কাঁটায় উন্মাদ…আহারে ফাঁস লাগিয়ে
হাসো’;
হাসতে হাসতে ঘড়ির ভেতর
এরপর
রক্ত দেখে ফেলা,
ছয় থেকে বারোটার কাঁটায় পৌঁছুতে
আক্রান্ত আমার চক্ষু কী গভীর লাল
স্থির, গলা জড়িয়ে মৃত্যুর মতো
গল্প করে
পাশ ফিরে অনর্থ ভাষায় চোখ খোল অনুকূল…
সহসা দুয়ারে
গভীর পথের ভার। পরিস্রুত ছায়ারা বলেনি এ পথে এসো না। আলো হলো দুধ, আকাশে ছিটিয়ে দেখো। ঘন অবতরণে নামছে গগনরক্ষী, উন্মাদ। বাতাসের পাগলা অরণ্যে পথ হারিয়ে এই বড় লাভ: হাওয়াকে উধাও করে একাকী দাঁড়িয়ে থাকা। সব কিছু জুয়া। জাদুর প্যান্ডরাবাক্সে ধবল পাথর ঠুকে যারা আয়ত্ত করেছ কামাক্ষ্যার বিদ্যা, সাড়া ফেল, কে আগে দৌড়াতে পারো দেখি।
যাত্রাদেবী জুলেখার কিস্সা জাগিয়ে আগেভাগেই চলে গেছ, তুমি! দুপুরের জলপুকুরসমেত ভেঙে পড়ার মতো এ জীবন চেয়েছ, চেয়েছিলে-ভিখারিনি মেয়েটির হাতে সোনার বাটির খোঁজ রেখে?
২.
একাকিত্ব সোনায় মোড়ানো, দুর্ধর্ষ নিজাম ডাকু হয়ে নামছে গম্ভীর শাদা কাগজে। অক্ষরে অক্ষরে বহতা রক্তজগৎ আর রাঙা জাদুকরি আভা হা-রে-রে-রে ডাকাত দলের আসা-যাওয়ার পথে প্রগাঢ় লালগালিচা মেলে রাখে। অভ্রদানা লুণ্ঠনের কালে পরাক্রমী তরবারি নম্র কুলবধূ সাজে দাঁড়ায় না কোনোদিন। মানুষ কেবলি তাই টলমল। ভয়ে ভেঙে মিছরির মতন গলে। মিষ্টি পানি নাকি হয়ে যায় সবাই হে!
চেঙ্গিস খানের পৃথিবী রক্তাক্ত বকুল ফুলে ভরা। কাটা মাথা। আর্তনাদ। কণ্ঠ-ছিন্ন গায়কের সুরে সন্ত্রস্ত অক্ষর। কাঁপে আজ। একা। দুর্ভাগা নিজাম ডাকু নিশি হয়ে আসে
৩.
সব কিছু লিখে রাখতে ইচ্ছে করে। গানের মোহরগুলো মদের ওপাশে পাহাড় বাজায়- মাটি! গাছের আড়ালে পর্দাঘেরা আচ্ছন্নতায় কখনও লেখা হবে না ‘আমার সকল কয়েদি সুধা’। কার পায়ের বিবর্ণ আলতায় অস্ফুট কথাটি মোম-গলে পড়ল! সহসা দুয়ারে বনমালি বাঁশি নিয়ে এসো, সেই মূর্ছনায় মাটির বাক্সে নির্বাক সমুদ্র এসে বসুক
স্তব্ধতা বরাবরই মসৃণ, পাপ ডেকে আনে। তার মধ্যে ডুবে যায় খুনি, লেখার আঙুল…
লীলা
ফেরার পথে অর্ধযতি
কুহকজোড়া সত্য নাকি!
গন্ধ ভেঙে চোখের মণি
দেখাল এই অববাহিকা।
প্রশ্ন হয়ে মুখের শেষে
রয়েছি রাই পূর্বাপরে;
অমৃত কে লীলার দেশে!
খসে পড়ছি, একাকিনী গো…
গোধূলিসহ রাতের পাশে
বিজলি নেই, অজপাড়াগাঁ।
বজ্রপাতে ভস্ম হতে
এলাম কেন? পাহারা আছে
এ তল্লাটে। পথচলতি
নীরবতায় পথের কাঁটা
বিছিয়েছিলে, আমি পুষ্প
পরজন্মে ঐ উঠোনের…
নৈঃশব্দ্যের হাসি
চলে যাব ভাবি। তবু দেখি
পথ রোধ করে বিষবাঁশি
বুঝতে পারছি- এই সুর
আমাকে এনেছে এত কাছে
বুঝতে পারছি- ধীরে ধীরে
সুরের কুহকে যেন আমি
হারিয়ে ফেলছি বর্মকল
ধর্ম, জ্ঞান, চেতনাসংসার।
বুঝতে পারছি- বাঁশি নয়
অন্য এক সুরের সাম্পান
ভেসে আছে গভীর তরঙ্গে
কান পেতে শুনি- একে একে
লুপ্ত হচ্ছে শব্দের পুরাণ
জন্ম নিচ্ছে- নৈঃশব্দ্যের হাসি!
পাখিনীর বাসা
আকস্মিক এল ঘূর্ণিনাচ
দেহভঙ্গিমার রূপ নিয়ে
ঝরে গেল পাখিনীর বাসা
উড়ে গেল নাগিনীকেশর।
নারীর কোমরসন্ধি- জানি
লতাময়- চূড়ান্ত, গভীর
নিধুবনে- কেউ কি এখন
পাখিনীর মতো ধ্যান-ভাঙা?
যদি পালকের ছায়া নিয়ে
জেগে ওঠে দূরবীক্ষণের
চতুরতা, ঘূর্ণির চিৎকার
তাহলে মৃত্যুর কথা হোক
কেননা নৃত্যের তালে তালে
জন্ম নেবে পাতা ও বাকল।
বল্লমের হাসি
পূর্বপুরুষের মাটি ছুঁয়ে
জেগে ওঠে মৃত্যুর প্রস্তর
কেননা বাতাস ধূলিময়
পাতাগুলি- উন্মুখ, উদ্বাস্তু
পিতামহ, তোমার ধনুক
লক্ষ্যহীন- ছুঁয়েছেনে দেখি
তিরশীর্ষে- তবু তরতাজা
শতছিন্ন ডানা, উষ্ণ রক্ত।
শিকারির ফাঁদ নয়, ভাবি
মনের মর্মরে বাজে বাঁশি
যেন তার সুরে ছুটে চলে
রক্তের আস্বাদ- কাম, ক্রোধ
ধরিত্রী জঠরে- আজ তবে
জন্ম নিক বল্লমের হাসি!
অব্যক্ত আঙুল
কামরূপ-কামাখ্যার দিকে
উড়ে গেছে বাঘিনিশেকল
রয়ে গেছে তার তীব্র ঘ্রাণ
ঘ্রাণ শুঁকে শুঁকে- যেন আজ
জেগে ওঠে ত্রস্ত শিহরন
বনভূমি থেকে লোকালয়ে
জলাভূমি থেকে ফুটপাতে
বুঝে নিতে চাই সেই ঘ্রাণ।
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস পাড়ি দিয়ে
এসেছি গভীর লোকালয়ে
দেখি এক নৃমৎস্য নারী
দাঁড়িয়েছে পথে- নখ তার
নোঙরের ছয়টি আঙুল
গেঁথে আছে বুকের পাঁজরে।
পরিচয়পর্ব
কতদূর যাব আর ছুটে?
পিছনে তাকিয়ে- মনে হয়
বহু তেপান্তর পাড়ি দিয়ে
বেঁকে গেছে মন-মনুমেন্ট
জানি না লজিক, প্রেমসন্ধি
জানি শুধু- হঁটে যেতে যেতে
একদিন গলির মাথায়
দেখা হয়ে যাবে আমাদের।
কতদূর যাব আর হেঁটে?
হঠাৎ হোঁচট খেয়ে দেখি
মায়াময়- ভিজে গেছে দেহ
আকস্মিক রক্তপাতে আজ
দেখা হলো তোমার আমার
কেননা রক্তের আলোড়ন
তোমাকে এনেছে এত কাছে!