ল্যাটিন আমেরিকার ১৫ লেখকের অনূদিত গল্প : আজ ভোরে : পেদ্রো মাইরাল : অনুবাদ : নাহার তৃণা

বাবার সদ্য কেনা সেকেন্ড হ্যান্ড মেরুন পোজো ৪০৪ এ চেপে আজ ভোরের দিকে আমরা রওনা দিলাম। উইন্ডশিল্ডের পাশের জায়গাটা বরাবরই আমার পছন্দ, সিট পেরিয়ে সেখানে গিয়ে সটান শুয়ে পড়লাম।
সেখানে বেশ আরামে থাকি। পেছনের জানালার কাচে ঠেস দিয়ে শুয়ে থাকাটা আরামদায়ক। ঘুম এসে যায়। সপ্তাহান্তে গ্রামের বাড়ির খোলামেলায় গিয়ে সময় কাটাতে আমার খুব ভালো লাগে। শহরে, অ্যাপার্টমেন্টের সামনে গ্যারাজের উপরের ছোট্ট গর্তটাকে নিশানা করে টেনিস বল নিয়ে উঠোনে খেলা বাদে, সারা সপ্তাহ আমার করার তেমন কিছুই থাকে না। অ্যাপার্টমেন্টের উঠোনের চারপাশ বেশ উঁচু দেয়ালঘেরা, দেয়ালগুলো চিমনি থেকে নির্গত কালিঝুলির দাগে ভরা। আমি যখন ওদিকে তাকাই মনে হয় উঠোনটা বুঝি একটা চিমনির ভেতর; আমি চিৎকার করলে শব্দ তৈরি হয় ঠিকই, কিন্তু সেটা চৌখুপি আকাশটাকে একদমই স্পর্শ করে না। গ্রামের বাড়ি যাওয়াটা আমার কাছে এই গর্তটা থেকে বের হওয়ার মতো। ব্যাপারটা আমাকে মুক্তির আনন্দ দেয়।
পথে তেমন যানজট নেই। শনিবার, ছুটির দিন বলে হয়তো কিংবা বুয়েনস আইরেসে এখনও গাড়ির সংখ্যা তেমন মাত্রা ছাড়ায়নি। আমি সাথে করে একটা খেলনা গাড়ি, পোকামাকড় ধরার জন্য একটা বয়াম, আর আকার অনুযায়ী সাজান একবক্স ক্রেয়ন নিয়ে এসেছি। ক্রেয়নগুলোতে কোনওভাবে রোদের আঁচ লাগতে দেওয়া যাবে না, কেননা রোদের তাপে সেগুলো গলে যাবার ভয় আছে। একেবারে পেছনে উইন্ডশিল্ডের পাশে এভাবে আমার শুয়ে থাকাটা যে নিরাপদ নয় সেটা নিয়ে কারও কোনও মাথাব্যথা নেই। পেছনের জানালার পাশে নিরাপদ কোন্টায় যেখানে জিনিসপাতি রাখা হয় ওটা আমার সবচে’ পছন্দের জায়গা। আমি পথে চলন্ত গাড়িগুলোর সামনের দিকটা দেখি, সেগুলো দেখতে মানুষের মুখের মতো লাগে। হেডলাইটগুলোকে চোখ, ফেন্ডার হলো গোঁফ, গ্রিলগুলো মুখ আর দাঁত। কোনও কোনও গাড়ির মুখ বেশ মায়াভরা। কিছু গাড়ির মুখ দেখতে বদের হাড্ডির মতো। আমার এই পেছনে বসাটা আমার ভাই বোনের খুব পছন্দের। ওরা সামনে অনেকটা জায়গা নিয়ে হাত পা ছড়িয়ে বসতে পারে। পরে অবশ্য আমি এই সিটে বসতে চাইতাম না। গরম লাগত, আর আমিও বড় হয়ে উঠলাম, ঠাসাঠাসি মালপত্রের ভেতরে জায়গাটা একদমই আরাম দিত না। এখন আমরা একটা দীর্ঘ সড়কপথ পেরোচ্ছি। প্রচুর ট্রাফিক সিগন্যালের কারণে কি না জানি না, আমাদের গাড়ি বেশ ধীর গতিতে যাচ্ছিল। অনেক বছর ব্যবহারের কারণে পোজোর আর আগের তেজ নেই, তার অবস্থা এখন কিছুটা কাহিল; এক্সস্ট পাইপ আলগা হয়ে ঝুলছে, গাড়ির ভেতর এখন বেশ গলা তুলে কথা বলতে হয় নইলে কেউ কিচ্ছু শুনতে পায় না। এছাড়াও পেছনের একটা দরজা একপাশে হেলে পড়েছে, মা মিগুয়েলের ঘুড়ির সুতো দিয়ে সেটা বেঁধে রেখেছে।
ভ্রমণটা আসলেই খুব দীর্ঘ। বিশেষ করে যখন থেকে রাস্তার ট্রাফিক সিগন্যাল আর সন্নিবদ্ধ নেই। জানালার পাশে বসবার জন্য আমাদের মধ্যে গুঁতোগুঁতি শুরু হয়; কেউ মাঝখানে বসতে রাজি না। জেনারেল পাজ এভিনিউতে মোড় নিতেই আমরা জানালা দিয়ে মুখে বের করে দিই, হাতও বাইরে রাখি, চোখে ভিকির সাঁতারের গগলসটা পরেছি যেন বাতাসের ঝাপটায় চোখে জল না আসে। বাবা-মা একটা শব্দও উচ্চারণ করেন না। কেবল পুলিশের কাছাকাছি এলে আমাদের চুপচাপ ভদ্র হয়ে বসে থাকতে বলেন। একবার আমরা যখন রেনো ১২তে চড়ে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ করেই মিগুয়েলের যক্ষের ধন জমানো পেশাদার কুস্তিগীরদের বেশ কিছু ছবি জানালা দিয়ে উড়ে যায় এবং বাবা পথের এক কোনায় গাড়ি থামিয়ে ছুটে সেগুলো কুড়োতে যান। না গিয়ে উপায় ছিল না, কারণ মিগুয়েল পাগলের মতো চিৎকার জুড়ে দিয়েছিল। দু’জন সৈন্যকে হঠাৎই আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখি, তাদের হাতের মেশিনগানগুলো আমাদের দিকে তাক করে জানায় যে, আমরা সামরিক এলাকায় ঢুকে পড়েছি। তারা বাবাকে অনেক প্রশ্ন করে, অস্ত্র নামিয়ে বাবার কাঁধে হাত চাপড়ায়, তারপর বাবার কাগজপত্রগুলো খুঁটিয়ে দেখে আমাদের ছেড়ে দেয়। আমরা দ্রুত জায়গাটা ত্যাগ করি, পেছনে পথের উপর বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে থাকে মিগুয়েলের শখের ছবিগুলো, যার একটিতে মার্টিন ক্যারাডাগিয়ানের স্বাক্ষর রয়েছে।
বাবা রেডিওতে ক্লাসিক্যাল গানের স্টেশন খুঁজতে খুঁজতে একসময় সোড্রে স্টেশনের নাগাল পেয়ে যান। পেছনের সিটে আমরা যখন মনের সুখে লাথালাথিতে মত্ত, বাবা হঠাৎ রেডিওর ভলিউম বাড়িয়ে বলেন, ‘অ্যাই বাঁদরেরা এটা শোনো’। আমাদের কুংফু কারাত মাঝপথেই থেমে যায় এবং চুপ করে ঢিমে তালের একটা গানের কিছুটা শুনতে হয়। পরে যখন ক্যাসেট প্লেয়ারের যুগ এল তখন থেকে ভ্রমণের পুরোটা সময় মোৎসার্টের দখলে চলে যায়। আমাদের গাড়ি সামনে এগোতে থাকলে পেছনে পড়ে থাকা প্রসারিত রাস্তাগুলো দেখি আমরা, আরও দেখি সারিবদ্ধ আলু বোখারার গাছ, গাছগুলোর গোড়ার দিকের বেশ খানিকটা সাদা রং করা, গাড়িতে বাজতে থাকা গণসঙ্গীত, সিম্ফনি, পিয়ানো কনসার্ট আর অপেরা শুনতে শুনতে আমরা পথ পেরোতে থাকতাম। গাড়িতে দীর্ঘ সময় বসে থাকার কারণে ভিকি হঠাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠত এবং আমাদের প্রিয় সোপ্রানোদের গান ওয়েডিং অফ ফিগারো বা দোন জিওভান্নি কে নকল করে ছড়া কাটত ‘আমরা খাব, আমরা খাব মাটি মোড়া শুকনো রক্ত।’ পরে অবশ্য ভিকি ভ্রমণে বই নিয়ে আসতে শুরু করে এবং সবাইকে উপেক্ষা করে চুপচাপ বইতে ডুবে থাকত। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আসতে হয় বলে সে রেগে থাকত। শেষমেশ সাপ্তাহিক ছুটিতে তার বন্ধুদের সাথে সিনেমাতে যাওয়ার আর শহরে থাকার অনুমতি পাওয়ার পর তার রাগ নামত, মেলা বন্ধুবান্ধব ভিকির। ভিকির অনুপস্থিতিতে আমি আর মিগুয়েল আরাম করে জানলার পাশে বসতে পারি, সাথে আমাদের কোনও বন্ধু থাকলেও সমস্যা হয় না।
এত দীর্ঘ ভ্রমণ, মনে হচ্ছে আমরা বুঝি গন্তব্যে কখনও পৌঁছাব না। পথে গাড়ি থামিয়ে বহুক্ষণ অপেক্ষা করিয়ে মা গাছের চারা বা বাগানের জন্য সরঞ্জাম কেনাকেটা করেন। কাজে আটকে বাবা বাড়িতে রয়ে যাওয়ায় মা এসব কেনাকাটার সুযোগ নেন। পেছনের সিটে আমি আর মিগুয়েল কে কতক্ষণ শ্বাসবন্ধ রাখতে পারে সে খেলায় মত্ত থাকি। আমরা পালা করে একজন অন্য জনের নিঃশ্বাস নেবার নলে মুখ দিয়ে রাখি, যেন কেউ চোট্টামি না করতে পারে। অথবা প্যাডেল বল না থাকায় কাগজ এবং সুইম ফিন দিয়ে নিজেদের মতো করে আমরা প্যাডেলবল খেলি। আমাদের গাড়ি এত দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকে যে এক পর্যায়ে তানিয়া ঘেউ ঘেউ শুরু করে, ফ্যালকন রুরাল গাড়ির পেছনে দীর্ঘক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা বেচারা তানিয়ার জন্য কষ্টকর। মা গাছের চারা, বাগানের জন্য কোনও সরঞ্জাম নিয়ে হাজির হন, সেগুলো গাড়ির ছাদে বেঁধেছেঁদে আমাদের গাড়ি আবার সামনে এগোয়।
মিগুয়েল একের পর এক তার বন্ধুদের দাওয়াত দেয়। ব্যাপারটা বিস্ময় আর আতঙ্কজনক, উদ্বেগ নিয়ে দেখতে থাকি, আমি জানি, আমরা যখন পৌঁছাব তারা (বন্ধুরা) মিগুয়েলের নিয়মমাফিক পাতা ফাঁদে হুমড়ি খেয়ে পড়বে। মেহমানের রবারের জুতোর ভেতর মরা ইঁদুর, চালার নিচে ভূত, নকল খুনে শুয়োর, গাছের ডালপালা দিয়ে ঢেকে রাখা খাদ, ইত্যাদি হলো সেসব ফাঁদ। ভরবেলার যানজটের ভিড়ে আটকে থাকা গাড়িতে বসে আমি মিগুয়েলের বন্ধুদের কথা ভেবে শয়তানির প্রথম পাঠ উপভোগ করতে থাকি। এসব ক্ষেত্রে ওর বেয়াড়া আর দাম্ভিক বন্ধুদের আমার পছন্দ, আমি বেশ বুঝতে পারি ফাঁদে পড়ে তারা কতটা অপদস্থ হবে, যেটা আমার জন্য উপভোগ্য; মিগুয়েলের পাতা ফাঁদে তারা যেন ধরা খায় সে বিষয়ে আমি যথাসাধ্য সচেষ্ট থাকব। যারা একবার মিগুয়েলের বদমাইশিতে ভরা ফাঁদে পড়ে তারা আর দ্বিতীয়বার এমুখো হয় না।
মহাসড়কের প্রথম প্রান্তটা পেরিয়ে যখন টোল এলাকায় ঢোকা হয় তখন যানজট বেশ পাতলা হয়ে আসে। ভিকি বন্ধুদের গাড়িতে নিজের মতো ভ্রমণ করছে। বাবা আর আগের মতো আমাদের সঙ্গে আসেন না। মা যখন র্যাটেলট্র্যাপ রুরালটা চালান, মিগুয়েল তখন আমার আঁকার খাতাটা নিয়ে বুদ্ধি পাকায়, আর পরিকল্পনা আঁটে ভিকির বন্ধুরা যখন কাপড় বদলাবে তখন সে কীভাবে তাদের উপর গোয়েন্দাগিরি করতে পারে। মিগুয়েলও আজকাল আর খুব একটা আসে না, যেকারণে আমার ঘুমানোর জন্য পেছনের পুরো সিটটাই পড়ে থাকে, আমি দিব্যি ঘুমিয়ে পড়ি। মা গাড়ি থামিয়ে আমাকে ওঠান, রেডিয়েটরে পানি দেবার জন্য, ওটা ফুটো হয়ে ইঞ্জিনকে আগুনের মতো গরম করে ফেলেছে। পথে আমরা একটা তরমুজ কিনি।
ট্রেন ক্রসিং গেটগুলোর কাছে আগে গুটিকয়েক ফেরিওয়ালা দেখা যেত; এখন সেখানে অসুস্থ-বিকলাঙ্গ ভিখারির দল আর প্রচুর ফেরিওয়ালা দেখা যায়, যারা পত্রিকা, বল, কলম, পুতুল ইত্যাদি সরঞ্জাম বিক্রির পসরা সাজিয়ে বসে। শহরের ট্রাফিক সিগন্যালগুলো পেরোবার সময় অনেকেই ভাংতি চায় অথবা ফুল বা কোমল পানীয়ের ক্যান কেনার জন্য পীড়াপীড়ি করে। বাবার কোম্পানি থেকে দেওয়া ফোর্ড সিয়েরা গাড়িতে পাওয়ার লক আছে, এবং যেহেতু খুব বেশিদিন হয়নি মিগুয়েল ছিনতাইকারিদের খপ্পরে পড়েছিল, মা তাই আমাকে দিয়ে গাড়ির দরজাগুলো লক করান এবং মায়ের ফেরিওয়ালা-ভীতি থাকার কারণে ট্রাফিক সিগন্যালের কাছাকাছি এলে আমি জানালার কাচ তুলে দিই। ফেরিওয়ালাদের যন্ত্রণায় মা ভীষণ বিরক্ত, জিনিস কেনার জন্য জ্বালাতন করে মারে, তাছাড়া, ডিউকটা ক্ষেপে গিয়ে তাদের কামড় বসাতে পারে। জানালা বন্ধ থাকায় এয়ারকন্ডিশন চালাবার সুযোগটার সদ্ব্যবহার করে আমরা সামনের দিকে এগোতে থাকি। গাড়িটা তার সংরক্ষিত ছোট্ট গণ্ডিতে একটা নিরাপদ ক্যাপসুলে পরিণত হয়। বাইরে রাশি রাশি আবর্জনা আর অজস্র রাজনৈতিক ইশতেহারের স্তূপ এড়িয়ে গাড়ির ভেতর নতুন স্টিরিওতে পরিষ্কার গানের মূর্চ্ছনায় আমরা বুঁদ থাকি। মা ধৈর্য ধরে একের পর এক আমার সংগ্রহের সোডা স্টিরিও বা পুলিশ ব্যান্ডের টেপগুলো স্টিরিওতে গুঁজে দেন।
গাড়ি বেশ দ্রুতই এগোতে থাকে এবং বরাবরের মতো আমার মনে হয় আমরা এখনই গন্তব্যে পৌঁছে যাব। বিশেষ করে আমি যখন ড্রাইভিং সিটে থাকি, মা বুঝতে পারবে না এমন কায়দায় গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিই; প্যাসেঞ্জার সিটে মা শান্তভাবে বসে থাকেন এবং এক মনে আয়নায় তার সদ্য করা ফেসলিফ্টিং খুঁটিয়ে দেখেন। বাবার মৃত্যুর পর মা মিগুয়েলকে দিয়ে গাড়ি চালানোয় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন; উড়নচণ্ডী মিগুয়েল লক্ষ্মীমন্তের মতো ঘরে ফিরে এসেছে, সে-ই এখন বাড়ির হর্তাকর্তা। ভিকি এখন বস্টনে থাকে। পেছনের পথ ক্রমশ অপসৃয়মাণ হতে থাকে, আমি চিনোর বাবার হলুদ টরাস গাড়িটা চালাই। আমরা জানালার কাচ তুলে দিই, ডাকাতির ভয়ে নয় অবশ্যই, গাড়িতে ঘন হয়ে থাকা মারিজোয়ানার ধোঁয়াটা যেন নিস্তেজ না হয় সেজন্য।
আমরা ওয়ার্ল্ড হর্সেস শুনি, সে-ই সঙ্গীতের কিছু অংশে এমন কিছু আধ্যাত্মিক ভাব আছে যেটা মনোমুগ্ধকর বিস্তৃত প্রান্তরের মাঝ দিয়ে চলতে চলতে আমাদের অন্তর্জগৎকে স্পর্শ করে। পরে আমি গাব্রিয়েলার মায়ের গাড়িটা চালাই, যা ভাগ্যক্রমে ডিজেলে চলে, তাই আমরা দুজনে যখন একান্ত সময় কাটাতে কয়েক দিনের জন্য দূরে কোথাও যাই তখন ট্যাকে খুব বেশি চাপ পড়ে না। লোকজন বাজেয়াপ্তকরণের কথা বলাবলি করছে, তবে এ নিয়ে কেউ তেমন আতঙ্কগ্রস্ত নয়। কেননা, ব্যাপারটা ঘটতে আরও দুটো সরকারের ক্ষমতায় আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করা লাগবে।
গ্যাব্রিয়েলার পরনের ছোটখাটো পোশাক আমাকে অসংযত হতে প্ররোচিত করে, আমি তাই একহাতে স্টেয়ারিং ধরে অন্য হাতটা তার ঊরুতে রাখি, ক্রমশই হাতটা ওর হাঁটুর উপরে উঠতে থাকে, গিয়ার না বদলে ইঞ্জিনকে হাই গিয়ারেই থাকতে দিই, গ্যাব্রিয়েলা কানের কাছে ফিসফিসিয়ে শান্ত করতে চেষ্টা করে আমাকে, গন্তব্যে না পৌঁছান পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকার কথা বলে। এর আগে পথটাকে এত দীর্ঘ মনে হয়নি। গ্রামের বাড়ির পথ যেন দুস্তর, নাগালের বাইরে।
গ্যাব্রিয়েলার পেট ক্রমেই স্ফীত হতে শুরু করে, আমরা একটা সুখী পারিবারিক জীবনের খোঁজে একসাথে ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ি। ওর ভাইয়ের কাছ থেকে চেয়ে নেওয়া ভক্সওয়াগন নিয়েই আমরা বেরিয়ে পড়ি। আজকাল আমরা সিটবেল্ট ব্যবহারে বেশ সচেতনতা দেখাই। মৃত্যু নিয়ে আমাদের মধ্যে ভয় ছায়া ফেলে, গন্তব্যে পৌঁছাতে আর অল্প কয়েক মাইল বাকি।
বছরগুলো চোখের পলকে চলে যায়। রাস্তায় এখন আগের তুলনায় প্রচুর গাড়ি, সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে টোলের সংখ্যা। হাইওয়ের নির্মাণের কাজ দ্রুত শেষ করার লক্ষ্যে শ্রমিকেরা খেটে চলে।
একটা সার্ভিস স্টেশনে থামি আমরা এবং যথারীতি নিজেদের মধ্যে তর্ক জুড়ে দিই। গ্যাব্রিয়েলা বাথরুমে গিয়ে কাঁদে; আমি ওকে বেরিয়ে আসতে অনুরোধ করি। এরপরে দু’জনে পছন্দ করে ভিওলেতার জন্য একটা কার সিট কিনি। আমাদের ছোট্ট মেয়েটা পেছনের সিটে ঘুমে ঢুলে পড়ে, সিট বেল্টে বাঁধা থাকে সে। আমরাও সিটবেল্ট পরেছি; আমরা তিনজনই যেন একটা বলয়ে বাঁধা পড়ে থাকি।
গ্যাসের জন্য গাড়ি থামাই, সময়মতো আমাদের লাঞ্চটা হয়ে যাক সেটাও চাওয়া ছিল আমার। কিন্তু গ্যাব্রিয়েলার তাতে আপত্তি, তার মত, দেরিতে খেলেও কিস্যু যায় আসে না, আমরা বরং ম্যাকডোনাল্ডসে থেমে খেয়ে নিতে পারি। এই নিয়ে আবার আমাদের তর্ক শুরু হয়। গ্যাব্রিয়েলা আমার দিকে অবজ্ঞাভরে তাকায়। আমি চোখে কালো সানগ্লাসটা পরে নিই এবং তড়িঘড়ি গাড়ির গতি বাড়াই। এই ভ্রমণে আমি রেডিওর ডেমো এবং জিঙ্গেল শুনেই কাটিয়ে দিচ্ছি। এসকার্ট গাড়ির স্টিয়ারিং হুইলটা চেপে ধরি। আমরা প্রায় পৌঁছে গেছি। গ্যাব্রিয়েলা গাড়ির গতি কমাতে বললেও পাত্তা দিইনি আমি; এরপর থেকে সে আসা বন্ধ করে দেয়। প্রতি সপ্তাহান্তে ভিওলেতাকে নিয়ে ও মায়ের কাছে যায়। আমি এখন একাই গাড়ি চালাই এবং সিডির নিখুঁত সাউন্ডে মোৎসার্টের পিয়ানো কনসার্ট শুনি। ৪ী৪ এর ইঞ্জিনটি শব্দহীন ভাবে নিজের কাজ করে যায়। হাইওয়ের কাজ শেষ হয়ে গেছে, সেখানে লোক চলাচল ঠেকাতে দুপাশে কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা আছে।
আমি প্রথম লেনে গাড়ি চালাই। স্পিডোমিটারে তাকিয়ে দেখি ঘণ্টায় ১০০ মাইলে বেগে যাচ্ছে গাড়ি। খুব শিগগিরই আমি নির্ধারিত জায়গায় পৌঁছে যাব। দূর থেকে তিনটি তাল গাছ দেখি, এবং সেগুলো এক সারিতে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করি। তারা কাছে আসে, আমিও আরও কাছে পৌঁছে যাই, যতক্ষণ না প্রথম গাছটার আড়ালে অন্য দুটো গাছ ঢাকা পড়ে আর আমি বলে উঠি ‘এখানে’। আমার মনে হয় আমি বুঝি চিৎকার করছি, আসলে আমি খুব মৃদুস্বরে কথা বলছি। বাজেয়াপ্ত হওয়ার এবং বাড়িটা ভেঙে ফেলার আগে যে জায়গায় ছিল, ঠিক সে জায়গায় পৌঁছে বলি, ‘এটা এখানেই’; বাড়িটা ভেঙে তার উপর এখন সদ্য নির্মিত হাইওয়ে গজিয়েছে।
মুহূর্তের জন্য আমার মনে হয় আমি বুঝি সেই পুরোনো বাড়িটার ঘরগুলোর ভেতরে, বিছানার যেখানে আমি আর মিগুয়েল কুস্তাকুস্তি খেলতাম। মায়ের হাতে লাগানোর গাছের পাশে তানিয়া আর ডিউকের কবরের পাশ দিয়ে আমি হাঁটি। একটা সঁ্যাঁতসেঁতে ধাতব গন্ধ আমার সঙ্গী হয়, সেই সাথে অনুভব করি পুলের তলদেশে পড়ে থাকা সবুজ চেরির স্বাদ যার জন্য আমি পুলের মধ্যে ডাইভ দেবো পরে। মনে পড়ে সেই বর্ষণমুখর রাতের কথা যখন আমরা জানালার একমাত্র ভাঙা ফোকরের মধ্য দিয়ে একটা বল ছুড়ে মেরেছিলাম যাতে সেই অজুহাতে টর্চ নিয়ে বাইরে গিয়ে ডোবার ব্যাঙগুলোর সাথে বাঁদরামি করার সুযোগ পাই।
আজ স্মৃতিময় সেই বাড়ির প্রেতাত্মার উপর দিয়ে কেবল ছুটে যাওয়া গাড়ির অবিশ্রান্ত গর্জন শোনা যায়। ঘড়িতে এখন ঠিক দুপুর বারোটা। সূর্যের ঝনঝনে তেজ ঠিকরে পড়ছে পিচের রাস্তায়। স্ত্রী পরিত্যক্ত একজন পুরুষ আমি। একটা বিজ্ঞাপন সংস্থায় কর্মরত। নিজের কাছেই শুধু না অনেকের কাছেই এখন আমি অপরিচিত। সেই অপরিচিত মানুষটা তার ভাইয়ের বাড়িতে প্রথমবারের মতো যাচ্ছে, যে মানুষটা পথ ভুলে গেছে এবং অন্যদের কাছ থেকে হারিয়েই গেছে, যে জানে না কোথায় থেমে পড়তে হয় এবং যে আজ ভোরবেলা যাত্রা শুরুর পর থেকে টানা তার গাড়িটা চালিয়ে যাচ্ছে, বহুদিন আগে যে ছিল ছোট এক বালক, গাড়ির পেছনের উইন্ডশিল্ডের পাশের জায়গাটা ছিল যার খুব পছন্দের; যেখানে শুয়ে সে তার পরিবারের সাথে গ্রামের বাড়ি বেড়াতে যেতে খুব পছন্দ করত।
মূল গল্প : Early This Morning by Pedro Mairal(Spanish) Translated by : Kit Maude
লেখক পরিচিতি:
১৯৭০ সালে বুয়েনস আইরেসে জন্ম, পেদ্রো মাইরাল (Pedro Mairal), আর্জেন্টিনা এবং লাতিন আমেরিকা জুড়ে তাঁর প্রজন্মের একজন অগ্রগণ্য সাহিত্যিক। তিনি একাধারে ছোটগল্পকার, ঔপন্যাসিক এবং কবি। তিনি বিভিন্ন ঘরানার প্রায় চৌদ্দটি বই প্রকাশ করেছেন। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘টিগ্রে কমো লস পাজারোস’ (Tigre como los pájaros /Tiger as a bird, 1996) প্রকাশের পরে তিনি জাতীয় খ্যাতি লাভ করেন। দু বছর পর ১৯৯৮ সালে তিনি তাঁর সারা জাগান উপন্যাস ‘অ্যা নাইট উইথ সাবরিনা লাভ (A Night with Sabrina Love)’ এর জন্য দুনিয়া জোড়া পাঠককুল এবং ক্লার্ন (Clarín prize) পুরস্কার অর্জন করেছিলেন। পেদ্রোর রচনা জার্মান, ইংরেজি এবং ডাচ ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
অনুবাদক : গল্পকার, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক
সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ