ল্যাটিন আমেরিকার ১৫ লেখকের অনূদিত গল্প : দ্বৈত সত্তা : হুয়ান গ্যাব্রিয়েল ভাস্কেস : ফরাসি ভাষা থেকে ইংরেজি অনুবাদ : আনে ম্যাকলিন : অনুবাদ : বেগম জাহান আরা

আমি আর্নেস্তো উলফ। ক্লাস তালিকায় আমাদের বংশ-নাম ছিল ‘প্রতিবেশী’। কারণ আমার পরে কলম্বিয়ায় আর বেশি বংশ-নাম বা সারনেইম ছিল না (যদি কোনও বিদেশি বা কৌতূহলবশে কেউ খোঁজে, তাহলে পাবে : ইয়ানেজ বা জাপাতা, ইয়াম্মারা বা জুনিগা)।
লটারির দিনে আমাদেরকে সেনাবাহিনীতে পাঠাবে কি পাঠাবে না, সেটা অনিশ্চিত থাকলেও একটা বর্ণানুক্রমিক নির্দেশনা ছিল, যার মানে আমি তার আগে বলটা তুলে নেব। একটা গাঢ় লাল-বেগুনি রঙের ভেল্ভেটের ব্যাগের মধ্যে দুটো বল ছিল। একটা নীল, একটা লাল। অথচ একটু আগেই সেখানে সেনাবাহিনীতে যাওয়ার যোগ্য সেই বছরের ছাত্রদের জন্য ছিল প্রায় পঞ্চাশটা বল। লাল বলটা তুলে নিলে আমাকে সেনাবাহিনীতে পাঠাবে। আর আমার বন্ধুকে পাঠিয়ে দেবে অন্যজন। নিয়মটা ছিল খুব সহজ।
ঘটনাটা ঘটেছিল ‘তিয়াত্রো পাত্রিয়া’-য়। এই ভবনটা অশ্বারোহী সৈনিকদের প্রশিক্ষণ স্কুলের পাশেই অবস্থিত। সেখানে তারা এখনও বাজে মুভি দেখায়। কদাচিৎ দেখায় একটা কমেডি, নিরস কনসার্ট বা জাদুর খেলা। তবে জাদুর খেলাটা ছিল লটারির মতো। হাই স্কুলের শেষ বছরের সমস্ত ছেলে কিছু শিক্ষকের সহায়তায় দর্শকের ভূমিকায় অভিনয় করেছিল। মঞ্চে ছিল, তিনজন অভিনেতা। জেল দিয়ে বিশেষভাবে সজ্জিত চুলওয়ালা একজন লেফটেন্যান্ট (হয়তো তিনি একজন লেফটেন্যান্ট ছিলেন, আমি নিশ্চিত নই; আমার সত্যিই মনে নেই তাঁর কাঁধে বা ল্যাপেলে বা বুক পকেটে কি লেখা ছিল ? সে যাই হোক, আমি কখনও পদবি মনে রাখতে পারি না), একজন ইউনিফর্ম পরা অ্যাসিস্ট্যান্ট এবং একজন স্বেচ্ছাসেবক অনিচ্ছাকৃতভাবে জাদুর খেলায় অংশগ্রহণ করতে মঞ্চে এসেছিলেন। স্বেচ্ছাসেবককে এখানে একটা ছোট বল তুলে নিতে হবে যার জন্য তাঁর সামাজিক জীবন বঞ্চিত হতে পারে বছর খানেকের জন্য।
ন্যাপথলিন শুঁকে লটারির বলগুলো তুলে ধরলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট। ভেতরে হাত ঢুকিয়ে নীল বলটা আমি প্রায় ছিনিয়ে নিলাম এবং কিছু ভাবার আগেই আমার বন্ধুর নিন্দা জানালাম। বন্ধুটি মঞ্চ দাপিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিলেন, অফিসারকে রাগান্বিত করতে এবং অ্যাসিস্ট্যান্টের জটিলতা তথা দুর্বলতাকে অনৈতিকভাবে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। তাঁর চোখে ছিল নীলচে মেক-আপ। ছুটোছুটির ফলে একেবারে লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিল তার চোখের পাতার নীল সাজ।
সৈন্যটা, লেফটেন্যান্ট হতেও পারে অথবা না, তার ‘কিলোমেট্রিকো’ বলপয়েন্ট পেন দিয়ে হাতির দাঁতের মতো সাদা এমবসড কাগজে সই দিলেন। তারপর কাগজটাকে তিন ভাঁজ করে আমার হাতে এমনভাবে দিলেন যেন একটা গন্ধযুক্ত কম্বলের টুকরো তুলে দিচ্ছেন। প্লাস্টিকের সাদা পেন-ক্যাপটা দাঁত দিয়ে চেপে রেখেছিলেন সেই সময়। সেই ক্যাপের যা ছিরি হয়েছিল! মুখের লালায় একেবারে একাকার। পেছনের হলুদ দাঁতের বিপরীতে চকচক করছিল সেটা। আর্নেস্তো এবং মহিলাটি নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন। তাঁর লাল বলটা আনতে চাইছিলেন না তিনি। সেটাই ছিল শেষ বল। খেলার পদ্ধতির কারণেই সেটা আনতে হবে। কিন্তু সৈন্যটা গুরুত্ব দিচ্ছিলেন না পদ্ধতির। যেন সেটা বাড়তি কিছু। তাই দর্শকদের জন্য সম্ভাব্য চমকটা আসছিল না। হাই স্কুলের অধিকাংশ ছাত্র বিনোদনের বিষয় হিসেবে বেশ উপভোগ করছিল। অবস্থা এমন হলো, খেলাটা শেষ করার জন্য পাশেই তার পরবর্তী একজনকে ডাকতে হবে। কিন্তু মহিলাটি এবং হয়তো মহিলাটির সাজসজ্জা দেখেই তিনি নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন যে, এগিয়ে গিয়ে বলটা তিনি নিতে পারবেন।
পরদিন লাঞ্চের সময় বেজে উঠল আমার ফোন, ‘শরীর বটে একখানা মহিলার ভাই’, আর্নেস্তো কর্কশ গলায় বললেন আমাকে।
‘ইউনিফর্ম পরে এমন মন্তব্য করতে পারেন না আপনি।’
পরে কয়েকবার তাঁর সাথে দেখা হয়েছে আমার। এরপর আরও কয়েকবার দেখা হয়েছে। আসলে দেখা হওয়াটা আমাদের ওপর নির্ভর করত না। অসাধু উদ্বিগ্নতার ভান করে এবং বিসদৃশরকম নম্রতার সাথে আর্নেস্তো উলফ টলেমাইদার দশম ব্রিগেডের ‘আয়াচুছো’ কোম্পানিতে, আগস্টের শেষ দিকে গিয়ে যোগ দিলেন। কোম্পানি ‘আয়াচুছো’র নামটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না তাঁর কাছে। প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময় কেবল নামটাই শুনে এসেছিলেন। তেমন স্বছ ধারণা ছিল না ‘আয়াচুছো’ সম্বন্ধে।
আর্নেস্তো একজন বিদেশির নাতি, যাঁকে গুরুত্বপূর্ণ এক দৈনিক কাগজে একবার দেশপ্রেমিক নয় বলে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। তবে আর্নেস্তো এমন এক পিতার সন্তান, কোথায় তিনি বেড়ে উঠেছিলেন এবং সত্যিই কোথাকার মানুষ তিনি, সেই ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন না। যদিও তিনি খ্রিস্টান বিশপদের দ্বারা প্রথাগতভাবে ব্যাপ্টাইজড হয়ে নাম পেয়েছিলেন। মানে, তিনি বাইরের কেউ নন। তবু আয়াচুছো সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানতেন না, বিশেষ করে স্বাধীনতা যুদ্ধগুলো সম্বন্ধে তেমন কিছুই জানতেন না। আমি ভাবলাম, বন্ধুত্বের সুবাদে আমার কিছু দায় আছে তাঁকে সাহায্য করার ব্যাপারে। বিশেষ করে দেশাত্মবোধ সম্বন্ধে তাঁকে কিছু জানাবার ব্যাপারে। কোনও এক রবিবারের সকালে উঠে জাতীয় বীরদের মনুমেন্টের সাদামাটা কিছু ছবি নিয়ে টলেমাইদাতে গেলাম।
আয়াচুছো
পিছিনছা
চারাবোরো
জাতীয় স্বাধীনতার পাথরের স্তম্ভের গায়ে আঁকাবাঁকা ডিজাইনে দুটো বিশ্রী এলোমেলো ভাব এবং একটা লুকোন অপমান-ভাব খচিত ছিল। পাথরগুলো খুব মূল্যবানও ছিল না। সেই ছবিটাই আমি দিয়েছিলাম ছাত্র উলফের হাতে। সময়টা ছিল আগস্ট মাস। বাতাস এরই মধ্যে ঠান্ডা হতে শুরু করেছিল। মনুমেন্টের চারপাশের ঘাসগুলো কেটে ছেঁটে লোকেরা লাইন করে সাজাচ্ছিল এলাকাটা। সেখানে তারা বাঁশের কাঠির সাথে জ্যামিতিক টিসু কাগজের (কাগজে কিছু আঁকিবুকি থাকে) ঘুড়ি বিক্রি করছিল। পাহাড়ি এলাকার একটা দমকা বাতাসও সহ্য করতে পারবে না সেগুলো। তবে টলেমাইদা পাহাড়ি এলাকা নয়। নিচের দিকে ট্রপিক্যাল আবহাওয়া। বাতাস নেই সেখানে। টলেমাইদাতে বাতাস চলাচলই কম। মনে হয়, বাতাস কখনও এখানে খোলামেলাভাবে বইতে পারেনি।
ল্যান্স করপোরাল জারামিলো প্রাণীখেকো একটা বড়ো সাপ ঢিলেঢালাভাবে তাঁদের কাঁধে জড়িয়ে দেবেন। কতক্ষণ এই সাপ কাঁধে জড়িয়ে রাখা হবে, তা নির্ভর করবে ব্যক্তির আপত্তির ওপর। ল্যান্স করপোরাল জারামিলো প্রাণের হুমকিতে হোক বা বিরক্তিতে হোক, গ্রামীণ এলাকার কোয়ার্তো বোলাস-এর অন্ধকূপ সম্পর্কিত একমাত্র শহুরে কিংবদন্তির কাহিনি শুনিয়েছিলেন। যেখানে খুবই কালো একজন বিদ্রোহী মানুষকে অন্যায় পদ্ধতিতে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল।
আর্নেস্তো উলফ প্রায় বছরখানেক ধরে ল্যান্স করপোরাল জারামিলো সম্বন্ধে অনেক গল্পই শুনিয়েছিলেন যা তিনি আগে আর কাউকে বলেননি। তিনি বলেছিলেন, ল্যান্স করপোরাল জারামিলো বদ্ধ বাতাসের জন্য দায়ী। বাহিনির প্রশিক্ষণের সময় সৈন্যদের হাতে রাইফেল বহনের জন্য ফোস্কা পড়া, জ্বরজারি ইত্যাদি অসুস্থতা দেখা দেয়, সে দায়ও তাঁর। তাঁরই কারণে অল্পবয়ষ্ক ছাত্রদের চোখে অশ্রু ঝরত (যাদের বয়স মাত্র পনের বছর, নামি স্কুলের ক্যাডেট ওরা), গুদামঘরে বা বাথরুমে লুকিয়ে থাকত। আর রাতের বেলায় ঘুমাত বালিশে মুখ চেপে। ল্যান্স করপোরাল জারামিলোর প্রথম নাম কি তা আমি জানতাম না। আমি তাঁকে দেখিওনি কখনও। তবুও তাঁর প্রতি ঘৃণা জন্মাতে থাকল আমার।
রবিবারগুলোতে ‘এসকিওলা দ্য ল্যান্সেরস’, মানে বগোতায় উলফদের বাড়িতে ভিজিটের সময় আর্নেস্তো শুকনো ঘাসের ওপর বসে থাকতেন। টলেমাইদার ভিজিটে এমনটাই ঘটত। আর বগোতায় হলে টেবিলের মাথায় বসে তিনি গল্প করতেন। সামনে বসে খেতে খেতে আমি উলফ এবং তাঁর বাবা মায়ের দিকে তাকাতাম এবং একসাথে ল্যান্স করপোরাল জারামিলোর প্রতি ঘৃণা ব্যক্ত করতাম। এখন মনে করি, আমিই ভুল ছিলাম। তাঁর বাবা আন্তনিও শুধু রবিবারেই, ছুটির দিন বলে, উপস্থিত থাকতেন। তিনি কখনও ‘এসকিওলা দ্য ল্যান্সেরাসে’র সীমানার মধ্যে পা রাখতেন না। ভাবখানা এই, যেন তিনি কখন ‘তিয়ার্তো পাত্রিয়া’য় প্রবেশ করেননি।
কোনও এক রবিবারে, আমরা অপেক্ষা করছিলাম বাসের জন্য, ছুটি পেলে যে বাসটায় টলেমাইদা থেকে আর্নেস্তো আসত। শক্তভাবে বন্ধ করে রাখা জানালার একটা গাড়ির সাথে ধাক্কা খেয়ে সেই বাসটা দাঁড়িয়ে যায় (‘পুয়েনতে আরান্দা’ শহরে সে কি ধূলো আর গোলমাল)। আন্তনিও উলফ তখন আমাকে পছন্দ করতে শুরু করেছিলেন। তিনি অপ্রত্যাশিত আকস্মিকতায় বলে উঠলেন : ‘কিন্তু তোমরা এটা চাইতে পারো না।’ একটা অসমাপ্ত বাক্যের মতো বলে উঠলেন তিনি। ব্যাভারিয়ান কৃষক সম্প্রদায়ের প্রাচীন বক্সারের মতো শক্ত হাতে হুইল ধরে রেখেছিলেন। তাঁর হাতগুলো নবীন আগন্তুকের মতো লাগছিল না। যদিও তিনি অভিবাসী ছিলেন না, অভিবাসী ছিলেন তার বাবা। আমার দিকে না তাকিয়েই কথাগুলো বলেছিলেন তিনি। কারণ গাড়ির ভেতরের লোকেরা সাধারণত পরস্পরের দিকে তাকায় না। গাড়ির কাচের মধ্য দিয়ে মানুষ বাইরের দৃশ্যই দেখে থাকে, যেমন করে মানুষ আগুন বা সিনেমা দৃশ্য দেখে।
‘কি হলো ?’ আমি বললাম।
‘এভাবেই যাক না কিছুক্ষণ’, তিনি বললেন, ‘চুপ করে বসে থেকে সময় নষ্ট করো। আর্নেস্তো যেতে চেয়েছিলেন। কারণ কি ? কারণ, তিনি চেয়েছিলেন মূর্খের মতো আনুগত্যের শপথ নেয়া শিখতে এবং এমন এক রাইফেল চালাতে, যা সারা জীবনে আর কোনওদিন দেখবেন না।’
আমার তখন আঠার বছর বয়স। কিছুই বুঝতে পারলাম না এইসব কথার। শুধু বুঝতে পারলাম যে, আন্তনিও উলফ একজন মানুষ, তাঁকে আমার সম্মান করতেই হবে। আমার সাথে তিনি খুব খোলামেলাভাবে কথা বলেছিলেন। সম্ভবত তিনিও সম্মান করতেন আমাকে। কিন্তু তাঁর প্রতি সেই সম্মান আমার আসছিল না। এটার একটা সুযোগ থাকা দরকার ছিল, ধারণা বা নীতি শুধু নয়। মানে ব্যাপারটা এমন নয় যে, শুধু সম্মান দেখানোর কারণে আমাকে সেই হুজুগে অর্বাচীন জায়গায় আনুগত্যের শপথ নেয়ার জন্য আসতে হবে। সেখানে শপথ বাক্যের কিছু কথা শেখা হবে। শুধু একটা রাইফেল শুটিং হবে, যে রাইফেল জীবনে আর স্পর্শ করা হবে না। সবচেয়ে বড় কথা হলো, সময়ের অপচয় করলেন তাঁরা। আমাদের নিজেদের সময় এবং বাবা মায়েদের সময়। জীবন যেখানে থমকে থাকে।
উলফের জীবনও থমকে গেল সেখানে। সেনা জীবনের চাকরি শেষ হওয়ার ষোলোদিন আগে একটা কসরত দেখানোর সময় আর্নেস্তো মারা গিয়েছিল। কি যে সেই খেলা বা কসরত, আমি তার নাম জানি না। একটা টানা দড়ির ওপর খেলা দেখানোর সময় আর্নেস্তো আটকে যায় এবং পড়ে যায় দুই পাহাড়ের মধ্যে, নব্বই ফুট নিচে। ঘণ্টায় পঞ্চাশ মাইল গতিতে পথরের ওপর পড়ায় আর্নেস্তোর শরীর ভেঙেচুরে ভর্তা হয়ে যায়। সবাই একমত হয়েছিলেন, উপত্যকার সমতলে পড়ে আর্নেস্তো ইতোমধ্যেই নিশ্চয় মারা গেছেন। সেখানে একটা ঝরনা ছিল। জায়গাটা বেশ মনোলোভা। কিশোর কিশোরীরা সাধারণত এই জায়গায় আসে শরীরী সম্পর্কের মজা করতে।
অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠানে যেতে পারতাম আমি, কিন্তু যাইনি। আমি একটা ফোন করলাম, দেখলাম উলফদের ফোন ব্যস্ত। আমি সেভাবেই রেখে দিলাম। একগুচ্ছ ফুলের সাথে একটা নোট পাঠালাম এই মর্মে যে, আমি ‘বারানকুইলায়’ ছিলাম। এটা ছিলও নির্জলা মিথ্যে কথা। মনে আছে, খুব মুশকিলে পড়েছিলাম শহরের নাম নিয়ে। বারানকুইলা না ক্যালি-র নাম বলব ? ক্যালি-র নাম বললে আমার অনুপস্থিতি নিয়ে সন্দেহ আরও কম হতে পারত।
পরে আমি জানার চেষ্টাও করিনি যে, উলফরা আমার ডাহা মিছে কথা বিশ্বাস করেছিল কি না। তাঁরা আমার নোটের উত্তরও দেয়নি, আমিও সেই দুর্ঘটনার পর কখনও দেখতে যাইনি তাঁদের। আমি আইন বিষয় নিয়ে পড়তে শুরু করে দিলাম। ডিগ্রির মাঝামাঝি এসে মনে হলো, আমি তো কোনও দিন প্র্যাক্টিস করব না। কারণ আমি ছোটগল্প লিখব, বই প্রকাশ করব এবং সারাজীবন আর কিছুই করব না।
আমি প্যারিসে চলে গেলাম এবং সেখানে প্রায় তিন বছর থাকলাম। এরপর আমি বেলজিয়াম গেলাম এবং এগার মাস কাটালাম আর্ডেনেসের একটা গ্রামে, যে জায়গার নাম উচ্চারণ করা আমার পক্ষে অসম্ভব। জায়গাটা বেলজিয়াম থেকে মাত্র দশ মিনিটের পথ। ১৯৯৯-এর অক্টোবরে আমি গেলাম বার্সেলোনায়। সেই বছরের ডিসেম্বরে ‘বগোতা’য় আমার পরিবারের সাথে ছুটি কাটানোর সময় এক জার্মান মহিলার সাথে আমার দেখা হলো। তিনি ১৯৩৬ সালে কলম্বিয়ায় এসেছিলেন। আমি তাঁর জীবনের কাহিনি জানতে চেয়ে প্রশ্ন করেছিলাম, কীভাবে তিনি এবং তাঁর পরিবার নাতসি বাহিনীর কবল থেকে পালিয়ে এসেছিলেন ? এবং কলম্বিয়ায় এসে তিনি কেমন পরিবেশ পেয়েছিলেন ? একেবারে খোলা মনে উত্তর দিয়েছিলেন মহিলা। সেগুলো আমি ছোটো চৌকোনা নোটে প্যাডে লেখে রেখেছিলাম। এই কাগজের কোনায় একটা লোগো ছাপা ছিল (এই রকম কাগজের জন্য ইতালিয়ান একটা ফ্রেজ ব্যবহার করা হয় : গুয়ারদাতি দালুওমো দি উন সোলো লিব্রো (Guardatti dalluomo di un solo libro) অনেক পরে সেই সাক্ষাৎকারের তথ্যগুলোই, মানে সেই জীবনই, ব্যবহার করেছিলাম আমার উপন্যাসে।
উপন্যাসটা ২০০৪ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত হয়। কাহিনিটা জার্মান অভিবাসীকে কেন্দ্র করে, যিনি দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের শেষ দিকে ‘হোটেল সাবানেতা’য় অবরুদ্ধ ছিলেন। এই বিলাসবহুল হোটেলটাকে কলম্বিয়া সরকার যুদ্ধ বন্দিদের, যারা শত্রুদেশের নাগরিক (রুজভেল্টের শত্রু, হিটলার বা মুসৌলিনির প্রতি সহানুভূতিশীল), জন্য অস্থায়ী শিবির করেছিলেন। এই উপন্যাসের কাহিনি বিশ্লেষণ খুব কঠিন ছিল। কারণ কিছু কিছু বিষয় তখনও ছিল স্পর্শকাতর। শুধু তাই নয়, বগোতা-র জার্মান সমাজে অনেক জার্মান পরিবারের জন্য সেগুলো ছিল নিষিদ্ধ বিষয়। সেই কারণেই এটা আমার জন্য ছিল বেশ আইরনিক। উপন্যাসটা প্রকাশ হওয়ার পর অনেকে আমার কাছে এসে তাদের কাহিনি শোনাতে চেয়েছিলেন। এখন আমি তাদের কাহিনি বলব।
কয়েক মাস অতিবাহিত হওয়ার পরও আমি জার্মানদের বা তাদের সন্তানদের কাছ থেকে ই-মেইল পেতে থাকি। তারা বইটা পড়ে কোনও কোনও জায়গার নিপাট সংশোধন পাঠিয়েছিলেন। যেমন; দেয়ালের রঙ কেমন ছিল, কোনও বিশেষ গাছ কোনও বিশেষ জায়গায় ছিল, ইত্যাদি। এবং তারা কিছু নিন্দামন্দও করেছিলেন। আমাকে এটাও বলেছিলেন, পরবর্তী গ্রন্থে ভালো করে জেনে শুনে যেন তাদের কাহিনি উপস্থাপন করা হয়। আমি খুব ভদ্রভাবে রেখে ঢেকে উত্তর দিয়েছিলাম (সেটা এখানে বলতে চাই না, তবে তাঁদের কোনও কথা শোনামাত্র আমি প্রত্যাখ্যান করিনি)।
কয়েক সপ্তা পর আর একটা ই-মেইল এসেছিল একজনের কাছ থেকে। তিনি জানালেন, এমন একজনকে তিনি চেনেন, যিনি হোটেল সাবানেতায় ছিলেন। আমি চাইলে বা প্রয়োজনে তিনিও তথ্য দিতে পারবেন। ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমি একটা চিঠি পাই। দেখলাম, খামের পেছনে জার্মান নাম লেখা। এতে আশ্চর্য হইনি আমি। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে চিনতে পারলাম যাঁর নাম, তাঁকে। বাড়ির প্রবেশপথে দুই তিন সিঁড়ি ওঠার পরই নামের সাথে একটা মুখের ছবি আমার স্মৃতিতে এলো। সিঁড়িতে চিঠিটা খুলে চলন্ত সিঁড়িতেই পড়তে শুরু করলাম এবং আমার অ্যাপার্টমেন্টের রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে শেষ করলাম পড়া। ব্রিফকেইসটা তখনও ঝুলছিল আমার কাঁধে। সামনের দরজা হাঁ করে খোলা। দরজার তালায় চাবিটা পর্যন্ত খোলা হয়নি, তালার সাথেই ঝুলছিল সেটা।
চিঠিতে লেখা, খুব আশ্চর্য না ? তোমাকে বিশেষায়িত করার মতো কোনো শব্দ স্প্যানিশ ভাষায় নেই। যদি তোমার স্ত্রী মারা যান তাহলে তোমাকে বলা হবে বিপত্নীক। যদি তোমার বাবা মারা যান, তাহলে তোমাকে বলা হবে এতিম। কিন্তু তোমাকে কি বলা হবে যদি তোমার ছেলে মারা যায় ? তোমার সন্তানের জন্য মারা যাওয়াটা এতই অদ্ভুত, কোনও ভাষায় যা প্রকাশ করা যায় না। এই সব সন্তানহারা লোকদের কি বলা যায় ?। তবু চিরদিন সন্তানেরা পিতার সামনে মারা গিয়েছে, এবং পিতারা চিরদিন কষ্ট পেয়ে এসেছে তাদের সন্তানের মৃত্যুতে। আমি তোমাদের ধারা দেখে আসছি (চিঠিতে আমাকে বলা হচ্ছে), কিন্তু এখন পর্যন্ত এই ব্যাপারে কিছু করার সিদ্ধান্ত নিইনি। তোমার কথা ভাবতে চাইনি। তোমাকে লিখতে চাইনি।
কেন তা জানো ? আমি তোমাকে ঘৃণা করেছিলাম। এখন আর করি না। সে একদিন ছিল যখন ঘৃণা করতাম। প্রতি মুহূর্তে ঘৃণা করতাম। ঘুম থেকে জেগে উঠে তোমার মৃত্যু চাইতাম। কখনও চাইতাম, তোমার সন্তানেরাও মরে যাক, যদি থেকে থাকে। কোনও দিন আবার এসব ভাবতাম না। চিঠিতে এইভাবে লেখার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। আসলে এমন সব কথা বেঁচে থাকতেই, ব্যক্তিগতভাবে, মুখোমুখি বলা উচিত। সেটা এখন হচ্ছে না। কারণ তুমি থাকো বার্সেলোনায়, আর আমি ‘ছিয়া’য় ছোট্ট একটা বাড়িতে। স্বামীর সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পর এই বাড়িটা কিনেছিলাম। আমার ছাড়াছাড়ির ব্যাপারটা তুমি জানো। আমার ধারণায়, বগোতায় সেই বছর সারাটা সময় এই বিষয়টাই ছিল সবচেয়ে আলোচিত প্রসঙ্গ। সমস্ত কুৎসিত বিষয়গুলো বেরিয়ে এসেছিল আলোতে বিস্তারিতভাবে।
সে যাই হোক, ওসব কথায় আমি যেতে চাই না। বিষয় হলো আমি স্বীকার করছি, আমি তোমাকে ঘৃণা করেছিলাম। ঘৃণা করার কারণ, তুমি আর্নেস্তো নও। কিন্তু একটু হলেও তুমি আর্নেস্তো হতে পারতে, যদিও তুমি আর্নেস্তো ছিলে না। তোমরা দুজনে একই স্কুলে পড়েছ, একই বিষয় জেনেছ, একই ফুটবল টিমে খেলেছ, একই সারিতে ছিলে সেদিন ‘তিয়ার্তো পাত্রিয়ায়’। অথচ লটারির বলের ব্যাগটা তুমিই প্রথম পেলে। ঐটা পাওয়া উচিত ছিল আর্নেস্তোর। তুমিই তাকে টলেমাইদাতে পাঠিয়েছিলে। কথাটা কিছুতেই আমার মাথা থেকে দূর করতে পারি না। সেদিন যদি তুমি আর্নেস্তোর বদলে আরাঙ্গো কিংবা বারেরা-কে ডাকতে, তাহলে আমার ছেলে আজও বেঁচে থাকত। জীবনটা হাতের মধ্যে ধরে রাখতে পারতাম। কিন্তু হায়! আমার ছেলে এখন মৃত। সে কি একটা জঘন্য বংশনাম পেয়েছিল এবং সেই জঘন্য বংশ-নামের জন্যই সে মারা গেল। আর সেই জঘন্য নামটা তার কবরের প্রস্তরফলকে উঠেছে। আমাকেই সেই প্রস্তরফলকের নাম লেখাতে হয়েছে বলে নিজেকেও আমি ক্ষমা করতে পারব না।
প্রশ্ন হলো, কেন আমি এত কথা বোঝাতে চাইছি তোমাকে (চিঠিতে বলা হয়েছে আমাকে) ? তোমার আজীবনের বন্ধুর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশগ্রহণের জন্য কবরস্থানে গিয়ে ‘গুড বাই’ বলার সাহসই তো তোমার হয়নি। তখন তুমি তো সেখানেই ছিলে, আমার দেশ থেকে অনেক দূরে। যখন একজন মানুষ সেনাবাহিনীতে চাকরি করে, আরামদায়ক জীবন যাপন করে, এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশগ্রহণে উপস্থিত হয় না, তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, এর মানে কি ? আসলে তোমার জন্য এটা কোনও বিষয় ছিল না। আর্নেস্তোর মৃত্যুতে তোমার কিছু আসে যায়নি। বন্ধুর মৃত্যুর পর থেকে যখন তুমি নিজেকে আড়াল করেছ, একটা বিধ্বস্ত পরিবারের সামনে তোমার সত্যিকার অশ্রুহীন মুখ দেখাতে চাওনি, সেই পরিবারটা তো তোমার হতে পারত। দৈবক্রমে তা হয়নি। তোমার কিসের ভয় ছিল ? এইদিন একদিন তোমার জীবনেও আসবে, এই ভয় ? এটা হবে (চিঠিতে আমাকে উদ্দেশ করে বলা), শপথ করে বলছি, একদিন এমন সময় তোমার জীবনে আসবে। তখন তুমি বুঝবে যে, কোনও কোনও সময় মানুষ মানুষকেই চায়। সেই কাক্সিক্ষত সময়ে যদি তোমার চারপাশে মানুষ না থাকে, কেয়ামত হয়ে যেতে পারে মানুষের জীবনে।
অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার দিন যদি আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরে ‘ধন্যবাদ’ বলতে পারতাম, তাহলে আমার জীবনে কী হতো, আমি জানি না। অথবা তুমি সপ্তায় একদিন আমাদের সাথে খেতে, যেমন আগে করতে। মানে, যখন আর্নেস্তো চাকরিতে ছিল এবং ছুটিতে থাকত। আমরা সাধারণত কর্পোরাল জারামিলো সম্পর্কে কথা বলতাম। আর্নেস্তো আমাকে সেই অন্ধকূপ সম্বন্ধে বলেছিল। বলেছিল, বাধ্যতামূলকভাবে ক্যাডেটদের কাঁধে করে সাপ বহনের কথাও। কখনও মনে হয়েছে, সব কিছুই আমি তোমাদের চেয়ে বেশি সহ্য করতে পারতাম, যদি তোমাদের সাথে বসে শোনা টেবিলের আলাপগুলো মনে রাখতে পারতাম। আর্নেস্তো তোমাকে ভালোবাসত। তুমি তার সেই রকম বন্ধু হতে যাচ্ছিলে যারা সারাজীবনের জন্য সঙ্গী হয়ে থাকে। তুমি আমাদের অনেক প্রিয় হয়ে থাকতে পারতে। আমরা তোমাকে ভালোবেসেছিলাম (আমাকে উদ্দেশ করে লেখা), আর্নেস্তো যে তোমাকে ভালোবাসত, সেটা আমরা শেয়ার করতাম। কিন্তু এখন (চিঠিতে আমাকে বলা হয়েছে), সমস্ত পানি ব্রিজের নিচে চলে গেছে। বরবাদ হয়ে গেছে সব। তোমার অবস্থান আর সেখানে নেই। তুমি আড়াল নিয়েছ এবং নিজের আরামের জন্য অস্বীকার করেছ আমাদেরকে। বাড়িতে সব কিছুই খুব খারাপ হতে থাকল এবং এক সময় হুমড়ি খেয়ে পড়ল সব।
সেটা ছিল খ্রিস্ট মাসের সময়। দশ বছর হয়ে গেছে। সময় কীভাবে উড়ে যায়! আসলেই আমার মনে পড়ে না যে কী হয়েছিল। পরে আমাকে লোকে বলেছিল, আমি মহিলাকে টেবিলের চারপাশ ঘুরে ধাওয়া করেছিলাম। সেই ‘পিলার’ সম মোটা মহিলাটি বাধ্য হয়েছিল বাথরুমে লুকিয়ে থাকতে। আমার কি আর মনে থাকবে বলো ? যা মনে আছে তা হলো, পার্টি ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য একটা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম। গন্তব্য না-জেনেই ছুটেছিলাম। এক জায়গায় পার্ক করে বুঝতে পেরেছিলাম, জায়গাটা ‘পুয়েন্তে আরান্দা’। এই পার্কিং-এ টলেমাইদা-র বাস থামত। বুঝলাম, এটা সেই জায়গা, যেখানে কখনও কখনও তুমি আর আমি আর্নেস্তোর জন্য অপেক্ষা করতাম। সেখানে তোমার সাথে একবার আমার বেশ অনেক কথাবার্তা হয়েছিল। আমি কখনও ভুলব না সেগুলো।
চিঠিতে লেখা ছিল এই সব কথা আমার জন্য। আমার মনে হয়, তিনি অসুস্থ। গুরুতর অসুস্থ, মারা যাচ্ছেন। মনে হয় খুব তাড়াতাড়ি মারা যাবেন। সেজন্য দুঃখ বা স্মৃতি কাতরতা অথবা রাগ নয় (যদিও আন্তনিও-র অভিযোগে ন্যায়সঙ্গতভাবে একটু রাগ হয়েছিল)। চিঠিটার কোনও উত্তর দিইনি আমি। খামের পেছনে দেখলাম, নিশ্চিত হলাম প্রেরকের ঠিকানাট সম্বন্ধে; ছিয়া-র সেই ছোট্ট বাড়ি, তখন সম্পূর্ণ হয়েছিল। চিঠি এবং খামটা আমার স্টাডিরুমের বুকশেলফে মেয়েদের দু’টি ফটো অ্যালবামের মাঝখানে রেখে দিলাম। এই মেয়েদেরকে হুমকি দিয়েছিল আন্তনিও উলফ। হয়তো চিঠিটা প্রত্যাখ্যান করার জন্যই এই জায়গায় রেখেছিলাম। চিঠিটা যেন নিজেই প্রত্যাখ্যানকে উসকে দেয়। সন্দেহ নেই, আমি সফল হয়েছিলাম। কারণ এরপরে বছরের পর বছর গেছে, আমি অ্যালবামে রাখা আমার মেয়েদের ছবি দেখেছি, কিন্তু কখনও সেই চিঠিটা আবার পড়িনি। সম্ভবত আর কোনও দিনই পড়তাম না, যদি না ২০০৭ সালে আন্তনিও উলফের মৃত্যু সংবাদ পেতাম।
কোনও এক সোমবার, খুব শীতের সকালে জেগে উঠে আমি ই-মেইল চেক করলাম। সেখানে একটা চিঠি ছিল স্কুলের এলুমনি অ্যাসোসিয়েশনের লেখা। চিঠিতে কিছু শব্দ লেখা ছিল যা আমি খুব অপছন্দ করেছিলাম। সেটা হলো, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার তারিখ এবং সময় এবং সেই সংক্রান্ত শব্দগুলো, যেগুলো আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয় সেই মৃত ব্যক্তির কথা, যিনি গ্র্যাজুয়েট সন্তানের পিতা। কিন্তু এমন কথা বলে না যে, সেই সন্তান মারা গিয়েছে অনেক বছর আগে।
তিন মাস পর যখন আমাকে বগোতা-য় যেতে হয়েছিল, তখন কাগজপত্রের সাথে চিঠিটাও নিলাম। কারণ আমি নিজেকে ভালো করে চিনি। আমি জানি, আমার মনের প্যাঁচঘোচ এবং বাতিকের কথা। আমি জানি, এই সুজোগটা হারালে আমাকে পস্তাতে হবে। যদিও আন্তনিওর বাড়ি থেকে, যে বাড়িতে শেষ যে বছর সে ছিল, এবং যে বছর সে মারা যায়, অনেক দূরের পথ। সেই বাড়িতে আন্তনিও উলফ মারাত্মক আক্রমণাত্মক চিঠিটা লিখেছিলেন। চিঠিটা একই সাথে ছিল খুব অন্তরঙ্গ। এমন চিঠি আগে কখনও পাইনি তাঁর কাছ থেকে। বগোতায় পৌঁছোনোর পর কয়েক দিন যেতে দিলাম। তৃতীয় দিনে আমি চিঠিটা নিয়ে একটা গাড়ি ধার করে, প্রায় কুড়ি মাইলের মতো পথ ড্রাইভ করে ‘বগোতা’ থেকে ‘ছিয়া’য় গেলাম।
বাড়ি খুঁজে নিতে অসুবিধে হলো না। খুব ছোট্ট শহর ছিয়া। একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে হেঁটে যেতে পনের মিনিটের বেশি সময় লাগে না। রাস্তার নম্বর দেখে আমি গেট দেয়া একটা এলাকার দিকে গেলাম। সেখানে দুই সারিতে পাঁচটা পাঁচটা করে মুখোমুখি সস্তা ইটের দশটা বাড়ি। এলাকাটা ফিকে কমলা রঙের ইটের (বাড়িগুলো যে ইটের তৈরি) বাঁধানো পথ দিয়ে ঘেরা। দেখতে সব সময় নতুন মনে হয়। বাড়িগুলোর মাঝখানে যে জায়গা তার মাঝখানে একটা সকার বল (বলটা নতুন এবং সে-ই বলগুলোর মতো রুপোলি এবং হলুদ রঙের) এবং একটা প্লাস্টিকের থারমস। কয়েকটা বাড়ির সামনে মোটরসাইকেল পার্ক করা ছিল। শেষ মাথায় উদোম গায়ের একজন লোক স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে রেনল্ট-৪ ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেলে উঠে উধাও হয়ে গেল।
তারপর আমি কেয়ারটেকারের কুটিরের পাশের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ালাম। কুটিরের জানালাগুলো গাঢ় রঙের। চোখ কুঁচকে দেখতে চেষ্টা করলাম বাড়ির নম্বরগুলো পড়তে, এবং অনুমান করতে চেষ্টা করলাম, কোনটা আন্তনিও উলফের বাড়ি ছিল। এমন সময় সুপার বেরিয়ে এসে জানতে চাইলেন, আমি কোথায় যেতে চাইছি। লোকটাকে দেখে আমি তাঁর চেয়ে বেশি অবাক হয়েছিলাম। তিনি ঘুরে তাঁর গোলাকার বসার জায়গায় গিয়ে ইন্টারকমে কাকে যেন ডাকলেন। ঘুরে এসে বললেন, ‘সামনে যান’। আমি সামনে যেতে থাকলাম। দশ, বিশ, তিরিশ কদম এগিয়ে গেলাম। লোকজন জানালা দিয়ে এবং পর্দার আড়াল থেকে দেখছিলেন আগন্তুককে। একটা দরজা খুলে গেল এবং একজন মহিলা বেরিয়ে এলেন। বয়স প্রায় চল্লিশ হবে। পরনে ছিল খ্রিস্টমাস অ্যাপ্রোন, যদিও চার মাস আগেই খ্রিস্টমাস উৎসব শেষ হয়ে গেছে। মহিলা তাঁর হাত মুছতে মুছতে আসছিলেন। তাঁর বাহুর নিচে ধরা ছিল একটা করোগেটেড ফোল্ডার, যেটা সহজে খোলা এবং বন্ধ করার জন্য দুটুকরো কাপড় দিয়ে বাঁধা।
মহিলা আমার হাতে ফোল্ডার দিয়ে বললেন, ‘দোন আন্তনিও এটা আপনার জন্য রেখে গেছেন। আপনি যে আসছেন, সেটা তিনি বলেছেন। তিনি আরও বলেছেন, আপনাকে ভেতরে আসতে না-দিতে। এমনকি এক গ্লাস পানি খেতেও নয়।’
মহিলার কণ্ঠস্বরে শুধু প্রত্যাখ্যান নয়, আনুগত্যও ছিল। একজনের হয়ে কোনও কাজ করে দেয়া যে আনুগত্য, সেটা তাঁরা বোঝেন না। মহিলার দিকে না তাকিয়ে আমি ফোল্ডারটা নিলাম। তাঁকে বিদায় সম্ভাষণ জানাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু গুড-বাই বলার আগেই মহিলা ঘুরে দরজার দিকে যেতে শুরু করেছিলেন।
গাড়ির কাছে গিয়ে ফোল্ডারটা চিঠির ওপর রাখলাম। দুটো চিঠির সাথেই আন্তনিও উলফের উপস্থিতি অনুভব করলাম। তাঁর সাথে আমার শেষ দেখা হয়েছিল ষোলো বছর আগে। তারপর এই উপস্থিতি। গাড়িতে স্টার্ট দিলাম। এই বাড়ির সামনে আর থাকতে চাইছিলাম না। কেয়ারটেকারের সামনেও না (একটা অদ্ভুত বিব্রতকর পরিস্থিতির মতো লাগছিল) ছিয়া শহরের কেন্দ্রে বিশাল পার্কিং-এর জায়গায় যাওয়ার কথা ভাবছিলাম, যেখানে কোনও প্রহরী বা গেইট নেই। গাড়ি চালিয়ে আমি কেনাকাটার এলাকায় গিয়ে ‘লস তেরেস এলেফান্তেস’-এর সামনে পার্ক করলাম। তারপর দেখতে লাগলাম, ফোল্ডারের ভেতর কী কী জিনিস আছে। কোনওটাই আমার কাছে বিস্ময়কর মনে হলো না। অথবা বলা যায়, ফোল্ডার খোলার আগেই আমি জানতাম, কী কী পাব এখানে। এটা এক রকম স্বজ্ঞা বা ইন্টুইশন। মাথার ভেতর থেকে আসা জোরালো একরকম ধারণা।
সবচেয়ে পুরোনো ডকুমেন্ট হলো স্কুলের বার্ষিক-বইয়ের একটা পৃষ্ঠা। সেখানে আমরা, আমরা দু’জন, আর্নেস্তো এবং আমি ফুটবল খেলার সাজ সরঞ্জামের কাছে, আমি বগোতা টুর্নামেন্টের ট্রফি তুলে ধরছি। তারপর ১৯৯৭ সালের এপ্রিলে প্রকাশিত ম্যাগাজিন ‘ক্রমোস’-এর একটা কপি। পাতা খুললেই চোখে পড়ে একটা পৃষ্ঠা, যেখানে পাঁচটা সংক্ষিপ্ত লাইনে লেখা আছে আমার প্রথম উপন্যাস প্রকাশের খবর। হঠাৎ আবিষ্কার করলাম, যাত্রীদের বসার জায়গা পেছনে ঠেলে জায়গা করছি এবং গাড়ির ভেতরে যাবতীয় কাগজপত্র গোছাচ্ছি। ড্যাশবোর্ড, ড্যাশবোর্ডের খোপগুলো, পেছনের সিট, হাত রাখার জায়গা সবখানে। যেন আর্নেস্তো উলফের মৃত্যুর পর থেকে কালানুক্রমিকভাবে আমার জীবনের ঘটনাক্রম ছড়িয়ে দেখছি। সেখানে আমার বইয়ের খবর আছে, রিভিউ আছে, সাক্ষাৎকার আছে, যার সবই কলম্বিয়ান প্রেসে ছাপা হয়েছিল। কিছু ডকুমেন্ট মৌলিক নয়, ফোটোকপি করা। সেখানকার ছবিগুলো হলুদ হয়ে যাচ্ছে। যেন দেরি করে হলেও আন্তনিওকে খুঁজে পাওয়া গেছে এইসব খবরের মধ্যে এবং লাইব্রেরির জন্য এই ম্যাগাজিনটার ফোটোকপি করতেই হবে। অন্যদের ছবির নিচে দাগ দেয়া, পেন্সিলের নয়, সস্তা বলপয়েন্ট কলমের। ঐসব জায়গায় আমি বাচাল বক্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছি অথবা বোকা বোকা প্রশ্নের বোকা বোকা উত্তর দিচ্ছি। আমার উপন্যাস সংক্রান্ত লেখাগুলোতে যেখানে কলম্বিয়ার জার্মানদের সম্বন্ধে বলেছি, সেখানে আরও বেশি দাগ দেয়া। নির্বাসনের ওপর আমার প্রত্যেকটা মন্তব্যের নিচে, অন্য অবস্থার জীবন, অভিযোজনের সমস্যা, স্মৃতি এবং অতীতে আমরা পূর্বপুরুষদের যে ভুলগুলো বংশগতভাবে পেয়েছি, তার নিচেও দাগ দেয়া।
আন্তনিও সম্বন্ধে লেখা লাইনগুলো প্রশংসায় পরিপূর্ণ। সেটা আমাকে খুব অশান্তির মধ্যে ফেলে দিল। আমাকে নীচ এবং নোংরা মনোভাবে আক্রান্ত করে দিল, যেন এই সব কথা আমার জন্য খাটে না। আমার জন্য প্রযোজ্য নয় এসব।
আমি কিছুতেই বুঝে পেলাম না, আমার হাতে ফোল্ডার তুলে দিলেন যে মহিলা, তিনি কে ছিলেন ? সেই সময় অনেক রকম সম্ভাবনার কথা মনে এসেছিল আমার। বগোতায় ফিরে যাওয়ার সময় অনেক রকম ধারণা আমার মনে খেলা করছিল। হাইওয়েতে এলেবেলেভাবে গাড়ি চালাতে চালাতে কল্পনা করছিলাম, আন্তনিও-র অজানা জীবন সম্বন্ধে। পত্রদাতা মহিলা একজন দেহাতি মহিলা হতে পারেন। তিনি হতে পারেন গ্রামীণ এলাকার একজন ল্যাটিন-আমেরিকান-ইন্ডিয়ান কৃষি-মজুর। উলফ তাঁকে পরিবারের জন্য টাকার বিনিময়ে এনেছিলেন (ভাড়া করে)। ক্রমে ক্রমে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, এই মহিলা ছাড়া পৃথিবীতে তাঁর আর কেউ নেই। এই মহিলা স্বাবলম্বী ছিলেন এবং সম্ভবত তাঁর একটি যুবতী কন্যা ছিল। উলফ তাকেও বাড়িতে এনেছিলেন। আমি কল্পনা করতে পারি, দুজন একাকী এবং বিভ্রান্ত মানুষের সম্পর্কের বদল কেমন হয়েছিল। অনুমান করতে পারি অনুশোচনাময় যৌন জীবনের দৃশ্যগুলো, যেগুলো বগোতায় কেমন বদনামের ঝড় তুলেছিল। অনুমান করতে পারি, উলফ বলেছেন যে, তাঁর মৃত্যুর পর মহিলা এই বাড়িতে বসবাস করবেন।
দূরবর্তী ডকুমেন্টের ভিত্তিতে সবচেয়ে বেশি করে অনুমান করতে পারছিলাম, সন্তান বিহনে তাঁর মনে যে শূন্যতার জন্ম হয়েছিল, শক্তি দিয়ে তাকে পূরণ করার জন্য অন্য একজনের জীবনকে একান্তভাবে গ্রাস করেছিলেন। আমি কল্পনা করছিলাম, তিনি বহুদূরে বাস করা লেখক ছেলে সম্বন্ধে ঐ মহিলার সাথে কথাবার্তা বলতেন। আমি আরও কল্পনা করছিলাম, গভীর নিশিথে তিনি সেই বালকের স্বপ্ন দেখতেন, যে তাঁরই ছেলে, বহুদূরে বাস করে এবং বই লেখে। এটাও অনুমান করতে পারি, সেই ছেলেটা যে সত্যি তাঁর, এটা বলার জন্য সম্ভাব্য সব রকম কাল্পনিক গল্প করেছিলেন তিনি। আমি ধারণা করতে পারি, তাঁর জীবনে মিছে কাহিনি বলার সেই সংক্ষিপ্ত মুহূর্তগুলো, যার সবটুকুই ছিল অলীক সুখে পরিপূর্ণ।
মূল গল্প : THE DOUBLE ; Juan Gabriel Vasquez
লেখক পরিচিতি :
হুয়ান গ্যাব্রিয়েল ভাস্কেস (Juan Gabriel Vasquez) : কলম্বিয়ান স্প্যানিশ লেখক। জন্ম : ১ জানুয়ারি, ১৯৭৩। ল্যাটিন আমেরিকার খুব গুরুত্বপূর্ণ এই লেখক সাংবাদিক এবং অনুবাদক হিসেবেও খ্যাত। তাঁর উপন্যাসের সংখ্যা ৭। পুরস্কার : আলফাগুয়ারা পুরস্কার, ইন্টারন্যাশনাল ডাব্লিন লিটারারি পুরস্কার, অর্ডার অব ইসাবেলা দ্য ক্যাথলিক ইন্টারন্যাশনাল বুকার পুরস্কারের জন্য মনোনয়নপ্রাপ্ত।
অনুবাদক : ভাষাবিদ, অনুবাদক, গল্পকার
সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ