কবিতা

মাকিদ হায়দার
আশা
যদি কোনদিন লাহিড়া পাড়ায়
বেড়াইতে আসেন, তাহা হইলে
ভুল করিয়া হইলেও হরিতলায়
আসিয়া আমাদের বাড়িতে
আপনার পদধুলি
দিয়া যাইবেন।
সাত আট বছর আগে যে হরিতলা
আপনি দেখিয়া গিয়াছিলেন, তাহা এখন
আর নাই,
দেখিতে অনেকটাই হইয়াছে
ঢাকা শহরের মতো।
আপনি আমাকে
নয় দশ বছর আগে যেমন
দেখিয়া গিয়াছিলেন
সেই আমি এখন আর বালিকা নই
গত পরশু বাইশে পা দিয়াছি
আগামী ফালগুন মাসের আঠারো তারিখে
আশা করি
তেইশে পা দিবো।
আমাকে দেখিলে হয়তোবা আপনার
চিনিতে একটু অসুবিধা হইলেও
ঠিকই চিনিয়া লাইতে পারিব
লাহিড়ী পাড়ার
দীবাজ লাহিড়ী
কিছুদিন যাবত মনে হইতেছিল
আপনাকে একটি কথা, না জানালেই নয়,
নয়তো বা
একদিন বলিবেন সুমিতা লাহিড়ী
আমাকে তো বলো নাই কোনওদিন।
কথাটি হইলো
আমাদের পাড়ায় রবি লাহিড়ী
কারণে অকারণে আমাদের বাড়ির
সামনে দিয়া সারাদিনই
ঘুরঘুর করে।
তাছাড়া ভয়ে জানালা খুলিতে পারি না
দরজা জানালা খুলিলেই
দেখি
দাতাল শুয়োর দাঁড়াইয়া আছে বাড়ির সামনে।
দিন কয়েক আগে জানিতে পারিলাম
রবি লাহিড়ীকে
পড়ায় এক নেড়ি কুকুর কামড় দিয়াছে,
কাথাটি শুনিবার পর মোটেই ভালো লাগে নাই
মনটা খাবাপ হইয়া গিয়াছে
এমনকি,
আমার ভীষণ ভয় করিতেছে
রবিকে যদি জলাতঙ্ক রোগে ধরিয়া বসে
তাহা হইলে ঘুরঘুর করিবার মতো কেহই
থাকিবে না।
হরিতলা
রবি লাহিড়ীর ঘন কলো চুলে কোনদিন
তেল দিতে দেখে নাই আমি,
এমনকি,
তিনি কোনদিন বাজারে গিয়া মাছ, মাংস
কিনিয়া বাড়ি ফিরিবার পথেই
তাহাকে কুকুর
কামড় টামড় দিয়াছিলো কিনা
সে কথা আমার জানা নাই।
গত পরশু জানিতে পারিলাম
আপনি নাকি সরকারি চাকুরিতে যোগ দিবার
পরপরই
ফিলিপাইন
গিয়াছিলেন, সেই দেশের―ধান গবেষণাগারে
কোন্, কোন্ মাসে কোন ধানের অধিক ফলন কি পাবে
আমাদের বাংলাদেশে বাড়িবে
তাহা জানাই নাকি ছিলো আপনার লেখার
বিষয়বস্তু।
সেই রাতে
আমার গভীর ঘুম হইয়াছিলো অনেকদিন পরে
যাহা বহুদিন হয় নাই।
শুনিলাম
এখন আপনি ঢাকায় আসিয়াছেন
সেই হেতু আমি
কিছুদিন আগেই রোপা ধানের
চাষাবাদ করিয়াছি
বাড়ির উঠানে।
আজকাল,
আমার মনে হইতেছে ধানের কচিপাতাগুলি
আপনার হাতের পরমা পাইলে তাছাড়া
সারাজীবন মনে রাখিবে আপনাকে।
আমি সেই আশায় দিনরাত বসিয়া থাকি
বাড়ির উঠানে।

হাবীবুল্লাহ সিরাজী
রূপসী পাণ্ডুলিপি
অনেক দূরে চিলের ধূসর ডানা
ঘষা আলোয় জীবন হ’য়ে ওড়ে
বাবু, একটু কলম সরান
আকাশখানি ফর্সা ক’রে লিখি
মেঘের সাথে ছায়ার মিলনভূমি
ধানসিঁড়িতে জীবন-জোয়ার দেখে
বাবু, একটু কলম থামান
নদীখানি ছায়ার ভেতর আঁকি
বন ছিলো যে গোলপাতা-মৌ মিল
ক্যাম্পে পোড়ে জীবনবোধের গান
বাবু, একটু কলম নামান
সবুজ হাওয়ার মান-অভিমান শুনি
মন খোলা আর নগর গাঁয়ের সন্ধি
পুব-পশ্চিমে দ্বন্দ্বে জীবনধারা
বাবু, একটু কলম গোছান
বরিশাল কী কলকাতাকে বুঝি
আপনার ওই চিল পাহাড় থেকে আসে
আপনার ওই মেঘ মালয় বাতাসে
আপনার ওই বন ঘাইহরিণীর পাশে
আপনার ওই মন বাংলাদেশে ভাসে

মুহম্মদ নূরুল হুদা
চন্দ্রাবতী
চন্দ্রসতী চন্দ্রাবতী জ্যোতি অগণন
স্বগুণ অগুণ কথা শোনো দিয়া মন।
মাতা সুলোচনা, পিতা দ্বীজ বংশী দাস
কবিজন্মে কবিকন্যা কবিতানিবাস।
ফুলেশ্বরী নদীতীর, শিবের মন্দির,
রাম-সীতা কাব্যকথা, অমরাবতীর।
‘মলুয়া’র কিংবদন্তি লিখেছেন তিনি,
‘দস্যু কেনারাম পালা’, চিনি তাকে চিনি।
ষোড়শ শতকে জন্ম, ধাত্রী মহাকাল,
নয়ানচাঁদের ছন্দে চন্দ্র-মায়াজাল।
ছন্দবিৎ চন্দ্রাবতী, গ্রাম পাতুয়ারি
জয়চন্দ্র শাস্ত্রবিৎ সুন্ধা গ্রামে বাড়ি;
পুষ্পবনে দেখা দুয়ে শিবের পূজায়
শৈশবের সেই স্মৃতি ভোলা নাহি যায়।
ছন্দে শাস্ত্রে কায়াসনে চিত্তে দরাদরি
ছায়ায় ছায়ায় মায়া দিব্য-বিভাবরী।
বুঝেও বোঝে না চন্দ্র লুকোচুরি খেলা,
কে কখন আসে যায় উদয়াস্ত বেলা।
কৈশোরেই সত্য যদি প্রেমের বন্ধন,
যৌবনে হঠাৎ কেন বিরহ-ক্রন্দন ?
পুরুষ চঞ্চলমতি, ফুলে ফুলে যায়
সব মুখে মুখ রেখে বুকে নিরুপায়।
নিরুপায় জয়চন্দ্র পরিণয় ক্ষণে
ভুলে গিয়ে মোহগ্রস্ত অন্য নারীমনে।
নারীই নারীর বাধা, নারী মন্ত্র-ফাঁদ,
জগৎ মায়ার খেলা, মোহের আবাদ!
জয়চন্দ্র বুঝলো না প্রেম আর মোহ,
চন্দ্রাবতী বুঝেছিলো সত্যপ্রেমদ্রোহ।
কাঁদলো না হাসলো না মুখে নাই বাণী,
সতত সুন্দরী কন্যা মুহূর্তে পাষাণী।
পিতার আদেশ মেনে শিবের মন্দিরে
সাধনায় সিদ্ধ অতি ফুলেশ্বরী তীরে।
আপন আগুনে কন্যা পুড়ে পুড়ে সোনা
অনঙ্গ মিলন-বীজ নিজবুকে বোনা।
কালে খায় ধীরে ধীরে, দেখা নাহি যায়
সে বোঝে কালের মার, যাকে কালে খায়।
কালচক্রে জয়চন্দ্র মানে পরাজয়,
প্রেম আর মোহ কিন্তু এক কথা নয়।
অগত্যা অনতিকাল পরেই বিচ্ছেদ
মোহমুক্ত জয়চন্দ্র, মনে শুধু খেদ;
অনন্তর সন্ধ্যাবেলা ফুলেশ্বরী তীরে
জয়চন্দ্র ডাক পাড়ে শিবের মন্দিরে।
ডাক তার শুনলো না চন্দ্রাবতী, ধ্যানী,
তপস্যায় মগ্ন সেই পুজারিণী, জানি।
সন্ধ্যামালতির রং লালবর্ণ হয়,
তাতে জয় লেখে নিজ বাণী-পরাজয়:
‘শৈশব-যৌবন-সঙ্গী , ক্ষমো চন্দ্রাবতী,
চির-অপরাধী আমি রতির আরতি
করেছি অযোগ্য পাত্রে, এ আমার দায়;
এ-জন্মে হলো না দেখা; বিদায়, বিদায়!’
পরদিন নদীজলে নাই তো সন্দেহ,
জলের ওপরে ভাসে জয়চন্দ্র-দেহ।
সুদর্শন সেই দেহ চাঁদের লাহান,
আপনা যৌবন বৈরী, শরীর নিষ্প্রাণ।
তাকে দেখে লেখে সতী ক্ষণজন্মকথা,
পঞ্চভূতে মুক্ত যার জলাঙ্গী বারতা।
চিরবিরহিনী সতী চন্দ্রাবতী নাম
নারীজন্মে মিটিল না মর্ত্য-মনস্কাম।
অনন্তর সর্বজন্ম ধনধান্য বুকে,
সর্বপ্রাণবাদে জ্ঞানী, ধ্যানী সুখে-দুখে।
আত্মা তার সৌরশিখা, জ্যোৎস্না-শরীর,
মুহূর্ত সপ্রেম সুধা কামনা মদির।
কলসে কলসে তাকে ধরে ফুলেশ্বরী,
অঙ্গের অনঙ্গ তরী, শবর-শবরী।
এক অঙ্গে সব অঙ্গ, সর্বশৃঙ্গধর;
প্রাণের প্রযত্নে প্রাণী, প্রাণ-মনোহর।
তটিনীর বুকে সেই চন্দ্রাভাস ভাসে
ডালে ডালে ফুলপাখি পরিযায়ী আসে।
দিন নাই রাত নাই সময় বহতা
কবিতা কবির বুকে প্রেমার্দ্র মমতা।
সেই মর্ত্য প্রেমকথা ভনে চন্দ্রাবতী―
সমর্পণে প্রেম সত্য, শক্তিধর্মে সতী।
কবিতা অনঙ্গ কথা, অমর্ত্য আরতি :
সমর্পণে প্রেম সত্য, বিসর্জনে সতী।
সেই থেকে চন্দ্রাবতী অনন্ত অমরা
ধরার অধরা তুমি, অধরার ধরা
ধরার অধরা তুমি, অধরার ধরা
ধরার অধরা তুমি, অধরার ধরা

অসীম সাহা
বীজের জন্য মাটি
আমার হাতের একটি ছোট্ট বীজ আমি পুঁতে রাখবো
এই পৃথিবীর কোনো এক নদীতীরের পলিমাটির এমন কোথাও,
যা আমার জন্যে এখন পর্যন্ত বরাদ্দ করা হয়নি। আমি ভেবেছিলাম,
আর কোথাও না হোক, অন্তত আমি যাকে আমার মাতৃভূমি ভেবে
এই এতোটা বছর ধরে মনে মনে এক বিভোর স্বপ্ন দেখে এসেছি,
সেও যে এমন করে আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, আমি তা
কখনো ভাবতেই পারিনি। আর এখন যে মৃত্তিকায় আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি,
সে তো মরুভূমির উত্তপ্ত বালুর বহর―আমি তার যেদিকেই তাকাই,
শুধু ধু-ধু প্রান্তর ছাড়া সেখানে আর কিছুই দেখতে পাই না।
আমি তাই আমার কাক্সিক্ষত বীজের উদ্গমের ভেতর থেকে
আমার সেই বৃক্ষের ক্রমাগত বেড়ে ওঠার স্বপ্ন দেখতে থাকি।
কিন্তু যেখানে পৃথিবীর এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত অবধি আমার জীবন্ত
একটি বীজ বপনের জন্যে সামান্যতম উর্বরা মাটির ব্যবস্থা পর্যন্ত নেই,
সেখানে আপাতত অসীম শূন্যতার নীল মাটিতে বীজ বপনের জন্যে
অসহায়ভাবে স্বপ্ন দেখা ছাড়া আমার আর কীই বা করার আছে?
অবশ্য খুব নিভৃতে থাকলে আমি কেবলি একা একা ভাবি :
যদি আমি মানুষ না হয়ে শুধু একটি ক্ষুদ্রকায় পাখিও হতে পারতাম,
তা হলে অন্তত কোনো দূর শূন্যতায় উড়তে উড়তে সংগোপনে
ফেলে আসতে পারতাম আমার হাতের এই অঙ্কুরিত বীজ―
আর তা থেকে কোনো না কোনো একদিন একটি বৃক্ষের জন্ম হতোই হতো।
অথচ মিথ্যে আশায় আমি যেমন করে সূর্যোদয়ের জন্যে নদীর তীরে
অপেক্ষায় অপেক্ষায় সারাজীবন বসে থেকে থেকে ভাবলাম, ওপারের
মাঝি নিশ্চয়ই আমার সেই আকুতিকে বুঝতে পেরে তার খেয়াটিকে
এপারে এনে ভেড়াবে―কিন্তু আমার সেই আশা কোনোদিন পূর্ণ হলো না।
ওপারের খেয়া কোনোদিন আমাকে নেয়ার জন্য এপারে এসে ভিড়লো না,
তেমনি এপারও আমার কাছে হয়ে রইলো অন্তহীন পাথারের মতোই অধরা!
অতএব, আমার জন্যে আসলে এপার-ওপার বলে সত্যিই কিছু নেই।
আমি এখন শুধু এক অকূল দরিয়ার মাঝি হয়ে নিজেই খুঁজে ফিরছি
এক টুকরো পা রাখবার জমি, যাতে আজ না হোক, অন্তত কাল
আমার পক্ষে বপন করা সম্ভব হয় একটিমাত্র স্বপ্নের বীজ, যা থেকে
একদিন না একদিন জন্ম নেবে মৃত্তিকাভেদী স্বপ্ন-শেকড়ের উন্মীলিত শাখা;
আর তখন হয়তো দেখবো, আমাকে মহাশূন্যতার মধ্যে ফেলে রেখে তোমরা কখন যেন
এই দীর্ঘতর নদীপথে কোন্ সুদূরের পানে পালিয়ে গিয়েছো দূরে, বহু দূরে!

রবীন্দ্র গোপ
চিত্রকলা
হঠাৎ মাঝরাতেই ঘুম ভেঙে যায়
শিরশির হাওয়া যায় যে বয়ে যায়
চেয়ে দেখি আলুথালু চুলে কে যে
জানালা ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঠিক তুমি।
কাঁকন পরা মেহেদী রাঙ্গা হাত
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠচিত্রকলা, কোন বিখ্যাত
জাদুঘরে চাঁদটা হাসছে মুচকি মুচকি
এ এক অচেনা ঈশ্বরের খেলা ছলাকলা।
আমি বোকা পৃথিবীর অথর্ব কোন প্রাণী
নিজের মাঝেই নির্বাসনে বন্দিঘরে।
চাঁদকে দেখেছি,বিরহ বিধুর চিত্রকলা
ঠিক তুমি, মুখশ্রী লেগেছে চাঁদে।
তোমাকে সামাজিক দূরত্বে রেখে চাঁদ
খেলা করে অন্য চাঁদের সাথে অন্তরে,
অন্তরে উথালপাথাল শতযুগ
হাজার বছর স্পর্শহীন চুম্বনহীন।
অচেনা কোন নাইট কুইন নেচে যায়
স্নিগ্ধরাতে ফুলের গন্ধের দূরত্বে শুধুই
তুমি আমি স্পর্শহীন পাষাণ অহল্যা
নিজের মাঝেই নির্বাসনে বন্ধিঘরে।

নাসির আহমেদ
মর্মার্থহীন
তুমি হাঁটছো, ছায়া হাঁটছে।
তুমি যাচ্ছ, কই যাচ্ছ পথ চিনেছ ?
কেন যাচ্ছ, কিছু জানো না। শুধু যাচ্ছ!
তুমি হাঁটছো পদশব্দ সাথে হাঁটছে, শুধু হাঁটছে।
এই শব্দ এই ছন্দ, এই পুষ্প এই গন্ধ
সবই যাচ্ছে কার সঙ্গে ? তুমি জানো কি ?
জানি জানো না, ঘ্রাণ পাও না নাক বন্ধ
তবু যাচ্ছ, শুধু যাচ্ছ―কী যে ভ্রান্তি!
পাতা ঝরছে, ছায়া সরছে, ছায়া থাকে না।
দেখো বাগানে কী ঘন ছায়া!
তা-ও রাখে না ওই সূর্য, সে-ও সহসা
দিনরাত্রি খেলা খেলছে, শুধু ঘুরছে।
কেন ভাসছো! তুমি শ্যাওলা যাবে হারিয়ে! মজাপুকুরে ?
কিছু স্বচ্ছ ধারণা থাকা ছিল কর্ম।
কিছু বলছো, তুমি জানো না কাকে বলছো!
এ জীবন কি শুধু ভ্রান্তি করো প্রশ্ন তুমি নিজেকে।
এই শব্দ এই ভাষারা এই আমাকে
আর তোমাকে কত কথা যে
শুধু শেখালো!
জানা হলো না তার মর্ম!

ফারুক মাহমুদ
(উৎস: জীবনানন্দ দাশ)
দেখা, কবির সঙ্গে
আমার কলকাতা মানে নির্জন কবির সঙ্গে দেখা হওয়া
একবার দেখা হল ল্যান্সডাউন রোডে
নিমগাছঅলা একতালা বাড়ি
আমাদের দেখে, দূরে যেতে যেতে ম্লান হয়ে যাওয়া
ঢেউয়ের রেখার মতো ছোট্ট করে হেসে
বারান্দার শেষ প্রান্তে বসালেন স্নিগ্ধ আমন্ত্রণে
মুখে কোনো কথা নেই। লাজুকতা। বনানীর অবশিষ্ট ছায়া…
ঘোলা কাচের চশমাটি খুলে
মৃদু করে যেই তাকালেন
মনে হল আকাশের চোখজুড়ে অনেক আকাশ
কল্পনার আনন্দের মতোন
মনে তার হাসি হাসি শত শত জল!
শূন্যতায় ভরে ওঠা বিরহী যক্ষের একাকীত্বের মতোন
বিখ্যাত গড়ের মাঠে কতদিন কবিকে দেখেছি…
যে-অপেক্ষা কোনোদিন ফুরায় না, তার হাত ধরে
ঘাসে ঘাসে আরো বেশি ঘাস হয়ে বসে থেকেছেন
কতদিন তার সঙ্গে হেঁটে গেছি―রসারোড
সার্দন এভিনু হয়ে গোল পার্ক, চাকুরিয়া লেক
যেতে যেতে পৌঁছে গেছি টালিগঞ্জ ব্রিজে
খাটো ধুতি, ঢিলেঢালা খাদির পাঞ্জাবি
ক্ষয়িষ্ণু পাম্প-সু পায়ে, হাতে কোনো বই
জাদুকরের মতো ক্ষিপ্র দক্ষতার মতো
বগলের ছাতাটিকে মেলে ধরেছেন
সূর্যের উত্তাপ নয়, চেনামুখ আড়ালের চেষ্টা
পিচের রাস্তায় দ্রুত পা-ফেলে হাঁটেন―
উপরাস্তা, এর মৃদু ঘাসে
থেমে থেমে হেঁটে যেতে তার ছিল বেজায় আমোদ…
আহা রে রাজবিহারী স্ট্রিট !
অন্ধ মহিষের মতো এসেছিল ডাউন টালিগঞ্জ ট্রাম!
হাঁপাতে হাঁপাতে থেমে গেল
ট্রামটির বিকট গর্জন
চারপাশে ব্যথিত উৎসুক ভিড়
এলোমেলো কথা―
দুর্ঘটনা না! আত্মবিসর্জন !!
একবার, লোকটার জ্ঞান ফিরেছিল
ব্যথিত বুদ্বুদ ঠোঁটে, ‘বাড়ি যাব, বাড়ি…’
শম্ভনাথ পণ্ডিত হাসপাতালের বেডে
কবির সাথে শেষ দেখাটি :
উন্মুক্ত ওয়ার্ড। লৌহমলে ঢাকা ভাঙাচোরা খাট
মাথার সামান্য পাশে কাত হয়ে আছে
কবেকার পরিত্যক্ত তাক
শিশি, তুলো, ঠোঙা, কালোরক্ত, অতিশয় বিবর্ণ চাদর
রোগী, রোগীদের লোক-ঠাসাঠাসি ভিড়
চ্যাচামেচি, আর্তনাদ, গোঙানির শব্দ
সর্বাঙ্গ পুড়েছে কারও
বিকৃত ঠোঁটের কষে অবিরল লালা
ইদুঁরের আনাগোনা, মাছি
জেলের আসামী-রোগী―বেড়ি-কড়া আছে
এদের প্রহরী যারা, বিরক্ত পুলিশ
কখনও ঝিমুনি ভেঙে খৈনি টেপে হাতের চেটোয়
পাশের শয্যায় মড়া, কখন সরানো হবে কারো জানা নেই।
নাকে নল, হাতে পায়ে জড়ানো ব্যান্ডেজ
রক্তচিহ্ন ছোপ ধরে আছে
না-ঘুম-না-জাগরণ। মাঝে মাঝে ঠোঁট নড়ে ওঠে―
‘কালো পেঁচা, ধূসর আকাশ…’
কুয়াশার সাদা সরে ঢেকে আছে কবির শরীর
বিষণ্ন চাঁদের মতো ডুবে যেতে যেতে
পৃথিবীকে শুনিয়ে গেলেন―
‘হৃদয় ব্যথিত হয় জেগে থেকে, তাই বুঝি ঘুমানোই শ্রেয়’

মাহবুব বারী
কল্পনা!
এইভাবে
তোমাকে আর আমাকে পৃথক করা যাবে না
যেমন বাতাস যেমন পানি। মাতাল জীবনের কোলাহল
যদিও আছড়ে পড়ছে জানালার শার্সির গায়ে।
জানো তো
ভালোবাসা যেমন মুক্তি দিতে পারে
আবার পায়ের বেড়িও হতে পারে।
তবু ঈগল পাখি যতদূর যায়
তার চেয়ে অনেক দূরে মন চলে যায়―
তোমাকে পাখির ছানার মতো ঠোঁটে করে
নিয়ে চলি শূন্যে। তখন টানটান তারের মতো
কী একটা যেন কাঁপতে থাকে বুকের ভেতর―
এই কি মিলনের কম্পন
এই কি এক তারে বাঁধা সংগীতের সংরাগ
এই কি উড়ে-চলা পাটভাঙ্গা আকাশের নীলে
এই কি বিচ্ছেদের বিপরীতে মিলন―
নাকি কল্পনা!

শামীম আজাদ
বিনির্মাণ
তখন
ছিলাম, দারিদা আর বোদলেয়ারে বুঁদ
ছিলাম, তাঁতের শাড়িতে বেপরোয়া অদ্ভুত
তখন
রোদে―কী রোদে
হিমে―কী হিমে
ভিজে―কী ভিজেই না
গলে গলে হয়েছিলাম মাখন
তখন
এই তরকারি হাতে, এ দু’খানা করতলে
ক্যাটাকম্ব ডিস্কোয়, নাচের তালে তালে
মাল্টার গ্রটো গভীরে, শব্দ প্রতিসরণে
যতদূর দেখা যায় কিংবা না যায়
আনুভূমিক ছুঁয়েছিলাম পরস্পর
তখন
তুমি বলেছিলে,পাখিকে আকাশ চেনাতে হয় না
আর মীনকে মিহি জলরাশি, বলেছিলাম আমি।

আসাদ মান্নান
ঘুমের কবিতা
ঘুমের ভেতরে গতরাতে
আমার একটি কবিতার খাতা চুরি হয়ে গেছে।
চোরটাকে খুঁজতে গিয়ে
খুঁজতে খুঁজতে
আমি একসময় খাতাটা খুঁজতে থাকি;
খাতাটা খুঁজতে গিয়ে দেখি
কয়েকটা মৃত কাঁকড়া বালুচরে পড়ে আছে;
আমি ভয়ে চিৎকার করে ওঠি―
ঘুম ও মৃত্যুর ব্যবধান কী তা পরিমাপ করি।
বসন্তের শেষ রঙ থেকে সময়ের অন্তিম নিঃশ্বাস
গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে; এ কেমন দুঃসময় এল
বাতাসের ঘাড়ে বসে নদী উড়ে যাচ্ছে শূন্যতায়―
কোকিলের সবুজ সংসারে দেখি কাকের বসতি!
মাঝরাতে ঘুম ভাঙলে কখনো কখনো টের পাই
ঘুমের ভেতরে আমি এতকাল যাকে ধরে রাখি
সে এখন সমুদ্রের গল্প শুনছে অনিদ্রার কানে;
যে যাবার সে তো যাবেই―স্বপ্ন ছাড়া অন্য কিছু
অন্য কেউ তাকে আর ফেরাতে পারে না ;
আমাদের ভালোবাসা বিরহের গল্প করতে করতে
ঘুমিয়ে পড়েছে; কেউ তাকে আর জাগাতে পারে না;
তাকে যে আড়াল থেকে সারাক্ষণ পাহারায় রাখে
তার সঙ্গে যুদ্ধ করে আমি শীতে আগুন জ্বালাই।

ইকবাল হাসান
বিমান বন্দরে
বিমান উঠছে বিমান নামছে
যেন এক একটা পরী
আমার উড়াল কখন হবে
অনিশ্চয়তায় মরি!
হঠাৎ এসে নামলো শেষে
ইন্দোনেশিয়ার গেরুদা
সারাটা পথ সাথে থাকবেন
চিলিয়ান কবি নেরুদা।
ডানা মেলে দিলো ক্যাথে প্যাসিফিক
হংকং থেকে টোকিও
বিরতিকালের স্মৃতিটুকু শুধু
হৃদয়ে গোপন রাখিও।
যেন কোনওদিন সেই কথাটি
জানতে পারে না কেউ
ট্রানজিটে কেন উথলে উঠল
অবাধ প্রেমের ঢেউ!

বিমল গুহ
সেই নক্ষত্র শহর
দৃঢ় পদবিক্ষেপে আমার সময় হাঁটে সমান্তরাল
নুড়ি ও দঙ্গল কুড়োতে কুড়োতে চলেছে এখনো দীর্ঘপথ―
তবুও কি আয়ত্তে এসেছে সময় আমাদের ?
ঊনিশশ বায়ান্ন সাল নতুন রোদের রঙে বিচ্ছুরিত আলো
চেতনার নবীন উন্মেষ!
মগজের কোষে দ্রুত রক্তের শিরায় ধমনিতে
ঢুকে গেছে সময়-শাসন।
বড় হতে হতে দেখি-ব্যবহৃত পথঘাট
সেতু-কালভার্ট
নৌকোর মাস্তুল
রৌদ্র-ঝিলিমিলি জল
চেতন-অচেতনের মাঝে সোনালি রোদ্দুর
উঁকি দেয় একেলা নির্জনে,
কখনো আবার গ্রামের সীমানা-ছুঁয়ে পোষা কবুতর কী সহজে
লগিটানা কবিতার সুউচ্চ মাস্তুলে গিয়ে বসে!
তুচ্ছ করে সময়-শাসন বেজে ওঠে ঘণ্টাধ্বনি রক্তের ভেতর
কান পেতে শুনি সারাবেলা মিছিল-স্লোগান;
স্লোগানে মাতিয়ে রাখে সমস্ত এলাকা ওপাড়ার তরুণ ছেলেরা
মুঠোহাত ঊর্ধ্বে তুলে রাজনীতির পাঠ নিতে শিখেছে তখন কেউ কেউ
জেগে ওঠে গ্রামাঞ্চল, জেগে ওঠে আমাদের পথের সীমানা!
আমরা কি এখনো-পৌঁছোতে পেরেছি সেই শপথের কাছে ?
কবিতার শব্দ কি ধারণ করেছে সবকিছু-
ছয়-দফা, পোস্টারে মুদ্রিত সেই সূর্যমানব
বিচ্ছুরিত সনদের আলো!
আমরা কি অদ্যাবধি পৌঁছোতে পেরেছি সেই নক্ষত্র শহরে-
কিসের ঘণ্টাধ্বনি শুনি আজ অহোরাত্রি আমার শিথানে ?

অঞ্জনা সাহা
শান্তিজল
অনবদ্য শব্দেরা নিঃশব্দ কোলাহলে আত্মাকে জাগিয়ে রাখে
অনুভবের আশ্চর্য বাগানে।
অজস্র ভালো লাগা সব ভালোবাসা জমা থাকে একান্ত গোপনে।
সেখানে আলোকলতার চাষ হয়, ফুলও ফুটে থাকে
হৃৎকমলে বেজে ওঠে আনন্দভৈরবী।
তাই সে-ও মেনে নেয় লাঞ্ছিত ক্ষতের গ্লানি,
চলে যায় দূর থেকে বহু বহু দূরে,।
চোরাস্রোত টেনে নিয়ে যায় দ্বিধার পাহাড় ঠেলেÑ
যেইখানে শান্তিজল ভাসিয়ে নেয় নীল নীল ঢেউয়ের খেলায়।
এইখানে ভেসে গেছে মনস্তাপের বিষ;
পড়ে আছে অন্ধকূপে কুনোব্যাঙ এক।
মন ভেসে চলে গেছে ভৈরবীর সুরে-
সে কি ফিরে আসবে আর অন্ধকার শূন্য যক্ষপুরে ?

জাহিদ হায়দার
লাশকাটা ঘরের জানলা
লাশকাটা ঘরের জানলা পার হয়ে
আমাদের ঘরে
সকালে রৌদ্র-নিয়ম আসে।
মেঝেতে শিকের ছায়া বড়ো বড়ো ছুরি।
কর্পূরের গন্ধমাখা সূর্য
নতুন পৃথিবী খোঁজে।
আমরা মেঝেতে বসে বোধোদয় পড়ি।
ছুরি কাটে চোখ, মুখ। জোড়া দেয়।
বোধের পৃষ্ঠা উলটাই।
কাটছে হৃদয়।
সঙ্গ উপভোগ করে।
মুণ্ডু কাটে,
ঘিলুর বিবর খোঁড়ে,
ওই যে যুদ্ধ
প্রেম নেই
রূপতৃষ্ণা ছিল।
পেট কাটে
ক্ষুধার অতলে শুধু ঢেউ।
ডিম্বানু, শুক্রাণু কাটে
আগামীদিনের সত্য শিশু খোঁজে।
চোখের দীপ্তি কাটে না
যদি আবার স্বপ্ন দেখতে চায়।
কষ্ট কাটে না,
আর্তনাদের শীতলতা বেঁচে থাক।
বিচ্ছিন্নতার ধমনী কাটে না,
চেতনাচিহ্ন রেখে দেয়।
কণ্ঠের ভেতর চির তিমিরের
দু’একটি তরঙ্গ রেখে দেয়।
যতবার বাসা বদলাই
লাশকাটা ঘরের জানলা
আমাদের ঘরের পূর্বদিকেই পড়ে।

গোলাম কিবরিয়া পিনু
আমাদের অস্তিত্বের মূল-ভূগোলের আলো
আমি কবি হলেও-বাবা আমার কৃষক
মা আমার-জাঁতায় শস্যদানা পেষণ করেন
গরম ভাত খাওয়ান,
উঠান ঝাঁট দেন
জানালা ও দরোজাটা খুলে দেন
যেন আলোবাতাস ঘরে ঢোকে!
পিতা আমার-
লাঙলের ফলায় ধানচাষের জমি তৈরি করতে করতে
আগামীবারের শস্য রোপণেরও স্বপ্ন দেখেন,
বাড়ির চারপাশে মরসুমী ফলগাছ
লাগানোর পর-
সেইসব গাছে-পাখির উড়াউড়ি দেখেন
কিচিরমিচির শব্দ শোনেন-আনন্দ পান,
যে গাভীটা দুধ দেয়
তাকে কী যে আদর করেন,
বাড়ির পাশে স্রোতস্বিনী-
তার জলে গোসল করান-আনন্দিতচিত্তে,
এখনো ঘর থেকে নীলাকাশ দেখেন
উঠানে বসে বাতাসে গা জুড়ান;
সেই পিতা এখনো অমিত শক্তি নিয়ে
কর্মের স্বাধীনতা নিয়ে
একজন উৎপাদক,
তাকে আপন শক্তিতে শ্বাস নিতে দিন।
তাকে তার নিজের কণ্ঠে গান গাইতে দিন।
তার গৃহস্থালি নিয়ে-
ফসলের মাঠ নিয়ে
নিজস্বতায় থাকতে দিন,
খুব ভোরবেলায় হাঁটতে দিন।
তিনি যেন উথালপাথাল অন্ধকারে
হারিয়ে না যান-
সে তো শস্যভাণ্ডার তৈরিতে এখনো ভূমিকা রাখছেন।
কী গভীরভাবে চাষাবাদে তিনি যুক্ত আছেন বলেই
শস্যের সৌন্দর্যে জীবন দোলে-
সন্তানদের রাতে গভীর ঘুম হয়,
ক্ষুধা নিয়ে জুয়াড়িরা ঘরের নিকটে হট্টগোল করতে পারে না
ক্ষুধায় রোদন শুনতে হয় না!
আমরা এখনো শ্বাস নিতে পারছি-
সে তো আমাদের অস্তিত্বের মূল
আমাদের ভূগোলের আলো,
চোখ বুঁজে বলতে পারি-
তারই ঘাম, শ্রম আর স্বপ্নের কারণেও
বেঁচে আছে মানবিকতার সুঠাম বন্ধন।
তার পুকুর-জলাশয়, ভূঁই-জমিন
মাটির অধিকার নিয়ে নিজের ঘরে
পিদিম জ্বালিয়ে থাকতে চান-তার ঝাড়বাতি লাগবে না!
তিনি তো কৃপা ও করুণা চান না-
ক্ষেতের ফসলের সৌন্দর্য ও প্রসন্নতা চান।
ঝোড়ো বাতাসের মধ্যে মাঠ ও প্রান্তরে একাই হাঁটতে পারেন
আকাশের গুড়ুম ও বজ্রপাতে ভয় পান না,
তিনি তো চারাগাছ ও অঙ্কুরের প্রতিপালক হয়ে থাকতে চান
অঙ্কুরোদগম ও পত্রোল্লাসে তিনি আনন্দ পান,
ফল ও ফসলের উন্মীলনে-পুনর্জীবন লাভ করেন
তার দীনদুনিয়া-তার কাছে সবসময়ে দীপ্ত ও আলোময়।
তার মাটি, কালপাত্র, জন্মস্থান, বাসভূমি, স্বগ্রাম ও দেশ
এতটা কাছে থাকে-
তা থেকে তিনি কখনো দূরে সরে যান না;
সেই তো আমার কৃষক পিতা-
জীবনদাতা-প্রাণদায়ী
উৎপিপাসু-উৎপাদক;
যার উৎপাদন ক্ষমতায় ও মমতায় আমরা বেঁচে আছি!

মাহমুদ কামাল
বেঁচে উঠি বিষণ্ন বিকেলে
যতটুকু অভিনয় ততটুকু বাঁচার সংলাপ
স্বকীয়তা বলে তবে কিছু নেই!
সরব নীরব হলে ভাষাবৃক্ষ মরে যেতে থাকে
আঙ্গিকসর্বস্ব হয়ে যে ধ্বনি বিবৃত ঠোঁটে
তার কোনও ভিত্তিমূল নেই।
যতটুকু অভিনয় ততটুকু বাঁচার সংলাপ
মৃত্যু হতে হতে অবশেষে এই আমি
বেঁচে উঠি বিষণ্ন বিকেলে
এই যে আপোষকামীতা এই যে বেঁচে থাকা
মৃত্যুরই মতো যেন অবিশুদ্ধ ছবি।

তমিজ উদ্দীন লোদী
দহনের চেয়ে বড় নয় বাহ্যিক আগুন
আমার দুয়ার থেকে উড়ে যায় কত যে ফাগুন
জানি দহনের চেয়ে বড় নয় বাহ্যিক আগুন
খসে পড়ে উল্কার মতন
ভেতরের তোলপাড়, প্রাণশক্তি, প্রাণের স্পন্দন
রাত্রি আর দিনের শপথ
কিভাবে ভঙ্গুর হয় উপছায়া, পঙ্কিল দ্বৈরথ
ধ্বস্ত হয় ‘মূক অন্ধ মৃত্তিকার স্তর’
সারসার লাশবাহি বিমূর্ত কবর
অতঃপর তুমি যাবে বৃন্দাবনে ?
আকস্মিক পাড়ি দেবে নির্বাণ সন্ধানে ?
কিংবা যাবে ধ্যানে, শুভ্রবস্ত্র মনোবিকলনে
দেখবে যা কিছু অন্তর্লীন, অন্তর্দৃষ্টি খুলে!

মিনার মনসুর
ধূলিকাব্য
৪
অক্ষরকে বলি-উড়ে যাও বৃত্ত ভেঙে
সে তবু ঘড়ির কাঁটা-খাঁচাপ্রিয় মধ্যবিত্ত পাখি
শুধু কি পাঁজর ভাঙে ?-মাটিও উড্ডীন
ধূলির দাপটে-কোথায় তোমাকে রাখি!
৫
মাত্রাজ্ঞান থাকা ভালো;Ñক্ষুধার্ত হাঙর
সে কি মাত্রা বোঝে ? নাকি বৃত্ত ? Ñসত্য শুধু
অ্যাকুরিয়ামের উষ্ণ জলে তুমি মুখোমুখি তার
তবু তুমিই বাল্মিকীÑভাবে নিধুয়া প্রান্তর ধু-ধু!
৬
স্বরকে চড়তে দাও মগডালেÑবৃত্ত খুঁজে নিক
কোনো দুর্বৃত্ত আশ্রম; ভেঙে যাক মেলা
মৌচাক পড়ুক ভেঙে পরিতৃপ্ত শব্দের বাসরে
ভাঙনের গর্ভে জন্ম নিক চির নতুনের খেলা।

জাফর সাদেক
তবুও কাঁধে তীর-ধনুক
ঘর থেকে বেরিয়ে ওই যে বনভূমির দিকে যাচ্ছে যে-জন
সে অর্জুন কি না, জানে না কেউ, তবে কাঁধে তীর-ধনুক
বলা যায় মঙ্গলগ্রহ নিয়ে স্বপ্ন দেখেনি আদৌ কোনোদিন
কিন্তু স্বপ্ন তাকে তো দেখতেই হয়Ñশতপ্রশ্নে খুঁজতে হয়
বিদিশার রাত্রির অরণ্যে একলব্যের পথ
শরীরের আগুনে হাত রেখে ভাবতে মনে হয়
সবকিছু ধ্বংসের জন্য উত্থান বা সৃষ্টির জন্য ঝড়
কিছু নীড়ে ফেরা পাখির ডানায় সূর্যাস্তের মুখ দেখে
কবিতা নামক জখমে ওষুধ লাগিয়ে তুমি যখন মধ্যরাত
তখন অগণন স্বপ্নবাজ বৃত্তের বাইরে দাঁড়িয়ে দেখছে
ভিন্ন ভিন্ন গ্রহ হয়ে ছুটছে মানুষÑপ্রতিটি মুখ নাইটিঙ্গেল
এবং সবার হাতে নিজস্ব বীণায় উড়ছে নিজের সুর-তাল

সোহরাব পাশা
প্রতিশ্রুতি : প্রিয় ছায়াগণ
প্রতিদ্বন্দ্বী-সে
দুপুর বিস্মৃত নিঃস্বতার
বুনোপ্রেম
বিনিদ্র রাত্রির ভিড়ে
পৃথিবীর পাঠ নিঃসঙ্গতার বিদীর্ণ
আদিম কবিতা
অন্ধ-খুচরো গলির মোড়ে
বিষণ্ন অসুখ
আকাশের কার্নিশে ঝুলছে
জলশূন্য মেঘের বাদুড়
ঘরগুলো ঘরে নেই বহুদিন
শূন্যতার অদ্ভুত ঐশ^র্য
আগুন সভ্যতায় মূর্ছিত ছায়াগণÑ
নিদ্রা নিহিত আঙুল
‘কেবল ঝরতে থাকে’ বেদনা অপার
গভীর গোপনে,
প্রিয় ছায়াগণ প্রতিবার ভঙ্গ করে
প্রতিশ্রুতি

জুয়েল মাজহার
মর্কটচালিত রথে
এমন খোয়াব দেখি যার কোনো আগা-মাথা নাই;
ফিচেল বান্দরে আইসা ফুল গোঁজে তোমার খোঁপায়
ফ্যাল ফ্যাল চায়া দেখি
তোমার রাতুল দুই গাল
ভরে যায় মর্কটের আবিল চুমায়
মরালগ্রীবাটি নেড়ে তুমিও কি দাওনি সম্মতি ?
দাও তাতে ক্ষতি নাই
ক্ষণে আমি রাজা, ফের, ক্ষণেকে কাঙাল
কী আর বলবো সখী, আমার এমন বদনসিব
লরেলমুকুট থিকা কিলবিল দাঁত নাড়ে পোকা!
আতকা খোয়াব যদি শ্যাষ হয়া যায়
আজগুবি খোয়াবের রেশ তবু রয়ে যায় পরান-গহিনে;
তিসিকালো মটকায় সিদলের ঘ্রাণের মতন
যেরকম ঝড়ের পরেও বহুকাল
ঝড়ের চড়ের কালো দাগ
গ্রামজুড়ে লেপটায়া থাকে
খোয়াবের কাঁকড়ার কামড়ে আহত হয়া আমি
দেখি তুমি চলে যাও মর্কটচালিত রথে চড়ে
আমাদের ঘোরলাগা উজাগর চোখ
আমাদের থ্যাঁতলানো-থ্যাবড়ানো মুখ
আমাদের হৃৎপিণ্ড, পাঁজরার চুরমার হাড়
আমাদের কাটামুণ্ডু মাথার ঝাঁপিতে ভরে চুপে
ঢুকে পড়ো অন্ধকারে শ্মশানের কালো চিতা জ্বেলে
ঢুকে পড়ো আলিশান তাঁবুর লাহান এক
মাকড়ের জালের ভিতরে

সরকার মাসুদ
নকিব চলে গেছে
জেটির অনুজ্জ্বল আলোয় ভেসে আসছে
বুক-ভাঙা-গান
সন্ধ্যা নেমেছে সদর ঘাটের রাস্তায়
নোঙর ফেলা লঞ্চের পাটাতনে
কয়েদির জামা পরে ঘুরছি এদিকে
নকিব চলে গেছে দখ্খিন বাংলায়
পানি থেকে ওঠা চাঁদ গাছে উঠছে
আওরাবুনিয়ায় !
বিষাদের ডালপালা ছড়িয়ে পড়েছে দিকেদিকে
বুড়িগঙ্গার পানিতে তাপ রেখে, বিষাক্ত ঢেউয়ে
ইঞ্জিনের গর্জন মিশিয়ে ছেড়ে যাচ্ছে জলযান
নকিব চলে গেছে বহুকাল-
দখখিন সমুদ্রের উত্তাল ছবি দেখি
নারকেলবনের চাঁদ-দেখি সৈকতের কামান
নকিবের দীর্ঘ ছায়া, ম্লান হাসি পড়ে আছে
উদ্যানে, লেকের পাশে, রৌদ্রদগ্ধ ঘাসে ঘাসে !

মারুফ রায়হান
কোভিড বনাম ডেভিড
নিউইয়র্কের হাসপাতালটির দেয়াল ও ছাত ফুঁড়ে
বেরোতে চাইছে সারিবদ্ধ লাশের দুর্গন্ধ
অথচ সুদৃশ্য কফিন তা আটকে রাখছে ছিপিবদ্ধ বোতলের বৈশিষ্ট্যে
ভেন্টিলেশনে চিৎপাট ডেভিডের কিছুই দেখবার কথা নয়, তবু
চোখ বুজে সে একইসঙ্গে দেখছে সদ্য সরবরাহকৃত কফিন
এবং দূর সমাধির নির্জনতম নিঃসঙ্গ শীর্ণ পথ
সে কি শেষমেশ শোবে ওই কফিনে, আর
তার যাত্রা প্রত্যক্ষ করবে তরতাজা তুষার কিংবা পরাবাস্তব মেঘ
ঠিক ওই সময়টায় জার্মানির নিবিড় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে
পি পি ই পরতে দেখা গেল এই ডেভিডকেই
চব্বিশ ঘণ্টায় প্রতিদিন চার ঘণ্টা করে বিশ্রাম,
এভাবেই কেটেছে তার টানা একশ বত্রিশ দিন!
মানবের জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে যে কমপ্রেস্ড
ব্রহ্মাণ্ড নিয়ে আস্ত একটা পৃথিবী থাকে পোরা
ডেভিড এখন আর তা বিশ্বাস করে না
জীবন ও মৃত্যুর ভেতর আজ পার্থক্য শুধু সময়ের কয়েকটা ডট,
আর শয্যাবদল, এবং আইসিইউ থেকে কুচ্ছিৎ কফিন
কে ফিরবে ঘরে কে কবরে,
তা কী করে জানবে বলুন ঈশ্বরদূত ডেভিড,
হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে গোরস্তান থেকে শ্মশানে
তার কী কাজ আমরা এখনও স্পষ্ট জানি নে
ঢাকার সর্বউত্তরপ্রান্তে ডেভিডের সঙ্গে আমার সাক্ষাতের গল্পটা বলছি
করোনাকরুণ শয্যায় দশম রাত্রিতে আমি তখন পীড়নে টানাপড়েনে
একেকটি প্রশ্বাস গ্রহণ যেন এক এক ধাপ খাড়া পর্বতারোহণ
প্রতিটি মুহূর্ত আবার অনিঃশেষ আশার শিখা
মৃদু আলো গিলে খেতে ওৎ পেতে আছে বিকট অন্ধকার
তার ভেতর স্পষ্ট দেখলাম ডেভিডকে হেঁটে আসতে
আঁটোসাটো বিছানায় আমাকে ঈষৎ ঠেলে সরিয়ে বসলো সে
বললাম, ওহ্, তুমিই তাহলে আমাদের আজরাইল, এসে গেছ ?
ছায়ামূর্তি উত্তর দিল: না, আমি ডেভিড;
রাতভর তোমাকে ছুঁয়ে থাকবো, ভেবো না,
কাল ভোরে সূর্যটা যে উঠবে শুধু তোমারই জন্যে!

রেজাউদ্দিন স্টালিন
আত্মার আগুন
তোমার জীবনের সমস্ত বিষয় যদি
কবিতার উপজীব্য করি
আমার সামান্য জীবনে
যেটুকু কালির সঞ্চয়
তা দিয়ে দীর্ঘসূত্রী কাহিনির সমাপ্তি হবে নাÑআর পৃথিবীতে সময় দুর্মূল্য
কত তুমি তো জানোই
সেই বৃদ্ধ মায়ের কথা ভাবো
তিনি সময়কে অতিক্রম করেছেন
অনেক আগেই
সারাদিন প্রার্থনার পাটিতে তোমার
কল্যাণ ছাড়া কিছুই চান না
এতদূর নগরের অবাক পাথরে
তার আত্মার আগুন কোনোদিন ধ্বনিত হবে না
তবু সে বিলাপ শুনে কেঁদে ওঠে
ঝাড়বাতি রেস্তোরা নগরভবন
হয়তো তুমিও কাঁদো তোমার গোপনে
আর তোমার স্বার্থপর বন্ধু আমি
জানি না কি করে ক্ষুদ্র কবিতার হাতে
তুলে দেবো বিশাল জীবন
আমাদের গলায় আত্মহত্যার দড়ি
টান টান বাঁধা
মাথার উপর ঘন হচ্ছে আণবিক মেঘ
মৃত্যুর ঢেউ এসে কেড়ে নিচ্ছে গ্রাম
যদি পারো এসে দেখো
এশিয়ার সবকটি ঘরে সন্ত্রাস নিত্যপণ্য
জীবনের এইসব টুকরো টুকরো ছবি
কবিতার কঠিন কোলাজ
ভালোবাসি বলে হৃদয়ের ক্ষতে ছিটাবো না নুনের চিৎকার
তবু সত্যের শাসন অমান্য করতে গিয়ে হাত কাঁপছেÑঠোঁট

মারুফুল ইসলাম
আমার বর্ণমালা
আমার বর্ণমালা এক অলৌকিক বাগান
এক একটা বর্ণ এক একটা প্রস্ফুটিত ফুল
অ যদি হয় অপরাজিতা
ক তবে কদম কিংবা করবী
এবং ব তাহলে বকুল
রঙে রূপে ঘ্রাণে বর্ণমালা আমার প্রাণের পুষ্পমালা
আমি স্বরবর্ণের বাগানে দেখি থরে থরে ফুটে আছে
অলকানন্দা আকন্দ উদয়পদ্ম একাঙ্গী
ব্যঞ্জনবর্ণের বাগিচা আলো করে আছে
কলাবতী গন্ধরাজ চন্দ্রমল্লিকা জবা টগর নয়নতারা পদ্ম মহুয়া রঙ্গন রজনীগন্ধা সন্ধ্যামালতী
সেই কবে থেকে আমার বাংলা বর্ণমালা আমার মনে ও মননে
গুচ্ছ গুচ্ছ ফুল হয়ে ফুটে আছে

মোহাম্মদ মল্লিক
বৃষ্টি
একা।
পতন সত্য কথা বলে।
কথা ভাবতে শেখার সুদূর অভ্যাসে
তারই সাথে দেখা।
কেউ কখনো নেয় না কারো
ব্যথা ভেজা জামা।
নৌকা ভেসে থাকে,
কষ্টের কল্লোল শুনছে না কেউ।
বাড়ালে হাত শূন্যতা কেঁপে ওঠে।

সৌমনা দাশগুপ্ত
যমডাকিনী
ঈষৎ-ময়ূর যেন বসে আছে জারুলের ডালে
গুঁড়ো গুঁড়ো ভেঙে পড়ে কেকা
ও রং ও রং তুমি ফাগুয়া তিথির মেয়ে
চাবুক সপাং
পাতলা কোমরজলে ঢেউ
সেপথে হেঁটেছে গল্প
পায়ে তার গুলালের দাগ
ভাসন্তী কুমারী
অস্থানে চুম্বন ঝরে যায়
আমি তার নড়াচড়া দেখি
দেখি ওই পড়ে আছে শাদা শাড়ি
পাড়টি এলানো
রুপোলি জরির থেকে উঁকি দ্যায় শ্মশানভৈরব
চোয়াল-কবজা খুলে সে দেখায়
উখোর ধারালো
ঠা-ঠা হেসে ফেটে যায় ঝুনো নারকেল
বমিতে চোবানো খুলি
তমসাখেতের মাঝে একক জোনাকি
সে তো বুদবুদ ছিল হঠাৎ-হাওয়ায়
মহাপয়ারের পথে এসে পড়া বারুদবালক
রাত শুধু পাখিডাক
যমডাকিনীর ঠোঁটে মৃত্যুআভাস
ফেনা ওঠে গল্প-গেলাসে

টোকন ঠাকুর
দুপুর আর দুপুর রইলো না
দুপুর আর দুপুর রইলো না, দুপুর দগ্ধ হতে চাইল! দুপুর দগ্ধ হতে চলল। মাটি ফুঁড়ে অঙ্কুরিত হলো উদ্ভিদ। আমি তৃণলতার সন্তান হয়ে, অসম্ভব বনযাপনের অভিপ্রায় ব্যক্ত করি। প্রার্থনা কবুল হয়। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা আকাশ অথবা পাতা-পোড়ানোর অধিকার-বাসনার মধ্যদিয়েই, আমি তীর্থ এক দিগবলয়ের দিকে হেঁটে যাই। হাঁটতে হাঁটতে, যেখানেই যাই―দেখি, এক দিব্যমরুভূমি। তখন দুপুর! কিন্তু দুপুর আর দুপুর রহে না, দগ্ধ হতে চায়। দুপুর ঝাঁ ঝাঁ হতে চায়। প্রচ্ছন্ন, তুমি তো জানোই―অদ্যাবধি দুপুরের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমি দুপুর হয়ে যাচ্ছি, ঝাঁ ঝাঁ করছে দুপুর, আমি ঝাঁ ঝাঁ হয়ে যাচ্ছি। এদিকে, খেয়ালই নেই―ঋতুর পরে ঋতু চলে যায়, ঋতু ফিরে আসে কিংবা ঋতু আর কখনওই ফেরে না। আমি ঠায় দুপুর হয়ে, দুপুরের ঝাঁ ঝাঁ হয়ে, মহাভুবনের ঘূর্ণিচক্রে বহুকাল অনড় একটি ঘড়িকাঁটা হয়ে―ধরিত্রীর সান্ধ্যসিঁড়িতে বসে থাকি। কখন যেন ঝিঁঝিঁ ধরে বসে। ঝিঁঝিঁর মধ্যে বসা, ফের দাঁড়াতে গেলেই পা’দুটো কেমন অসহায় হয়ে পড়ে! দাঁড়াতে পারি না। সে এক মুহূর্ত আসে। আহা কালের সন্ধ্যার ঝিঁঝিঁমুহূর্ত! তারপর, ঝিঁঝিঁমুহূর্তের এপিটাফ লিখব বলে, তাকিয়ে দেখি―ব্ল্যাকআউটের বেলেভূমি উত্থাপিত অগ্নিরাত্রি পেরিয়ে আবার তাক করে আসে দুপুর; দুপুর ঝাঁ ঝাঁ করে, সন্ধ্যা ঝিঁঝিঁ করে, ঝাঁ ঝাঁ করে, ঝিঁঝিঁ করে, ঝাঁ ঝাঁ করে, ঝিঁঝিঁ… ঝাঁ ঝাঁ… ঝিঁঝিঁ… ঝাঁ ঝাঁ… ঝিঁঝিঁ

ফকির ইলিয়াস
প্রাচীন পৃথিবীর দিকে মুখ ফিরিয়ে
অনেকগুলো একক বৃক্ষের পাশে নিজের ছায়া জমা
রাখতে রাখতে দেখি,একটি চিতাবাঘ হা করে আছে
সূর্য’টা-কে গিলবে বলে! একটি অন্ধকার কবর খুব
সাবধানে এগিয়ে আসছে বড় পরিচিত সমুদ্রের দিকে।
আর একটি টিকটিকি পাহারা দিচ্ছে চাঁদের ঘরবাড়ি,
কেউ যাতে লুটে নিতে না পারে এইসব আলোর বৈভব!
আমি আজীবন নিজেকে পাহারাদারই ভেবেছি একটি আয়ু’র।
ভেবেছি, এর আগেও এই সেতু পার হয়েছে যারা তারা
কেউ অন্ধ ছিল, কেউ পঙ্গু ছিল, কেউ ছিল মহামারী পার
হওয়া অনাথ অশ্রমের বাসিন্দা। তাদের পাঁজরে ছিল প্রাণÑ
মূলত এই প্রাপ্তিতে অনায়াসে তারা ছিল সমান এবং সারথি।
সাম্যবাদ এই পৃথিবীতে কোনোদিনই উজ্জ্বল কোনো অধ্যায়
ছিল না। যা ছিল; তা সমাজবিজ্ঞানের লিখিত ধারা, মানুষকে
বোকা বানানোর অলিখিত অস্ত্র। যা দিয়ে বানোয়াট গল্প
বলা যায়। যা দিয়ে আবেগি কবিতা লেখা যায়। অভিনয়
করা যায় সিনেমাতেও, সাদা-কালো ধুতি কিংবা পাঞ্জাবি পরে।
প্রাচীন পৃথিবীর দিকে মুখ ফিরিয়ে আমি আর যা যা দেখেছি-
তার লিখিত বিবরণ রেখে গেলে মূলত মাটিই লজ্জিত হবে
আমার কাছে! আর আদিম শ্মশানগুলোও ভেসে যাবে নদীতে!

সুহিতা সুলতানা
এক কৃতঘ্ন মাতাল
তারপরও কিছু থাকে না না মায়া না অপেক্ষা
তোমাকে অন্ধ করে দিয়েছে এক চক্ষু ঈগল
এই যে বেলাভূমি নিঝুম দ্বীপের অখণ্ড সূর্যাস্ত
রক্তিম গোধূলিলগ্নে অশীতের যাতনা কতটা
অস্বস্তির ভেতরে ফেলে দিয়েছে দ্যাখো, এক
কৃতঘ্ন মাতাল শ্যাওলার মতো আঁকড়ে ধরেছে
গুপ্তধন। বারবার রক্তাক্ত হতে থাকে অ্যাভিনিউ
ছককাটা বেওকুব ধারালো জিহ্বা দিয়ে চেটে
খায় গ্রন্থের হৃৎপিণ্ড। দু’দণ্ড দাঁড়াবার জায়গা
কোথাও নেই সর্বত্র পথের ধুলো আর হু হু
ক্রন্দন। মনের ভেতরে থেঁতলে যাচ্ছে মন
ও মনপুরা কত জলের কাতরতা তোমার
বুকের ভেতরে তুমি জানো ? দূর হতে যেটুকু
দেখা যায় কেবল দূরত্বের ছদ্মবেশ আর
জলের খেলা। ক্রমশ আমরা নিঃসঙ্গ হতে হতে
একা হয়ে যাচ্ছি। শিল্পের নামে অশিল্পের দাহ
কেবল ক্ষত আর লোপাট হবার গল্প চৌদিক
আঁধার করে রাখে। সততার একরত্তি মূল্য নেই
শোকাচ্ছন্ন অন্ধকারে বামনের কৃত্রিম হাসির
শব্দে পিকাসোর আমার শহরের গল্প খুলে খুলে
পড়ে। এক মিথ্যেবাদী ভণ্ডামীর শেকড় চারিয়ে
দিয়েছে কেন্দ্রের নাভির ভেতর! এই দুঃসহকালে
এই হলো বেঁচে থাকার ইতিহাস। মৌনতার দহন

কাজী জহিরুল ইসলাম
তুমি এবং আমি, সে
আমরা ও তোমরা, তুমি এবং আমি, সে
মিশে আছি লাউ, কচু, শিং, কৈ আমিষে।
ত্রিপিটক, গীতা আর বাইবেল, কোরানে
লেখা প্রেম যেন থাকে মানুষের পরানে।
ঈদ, পূজো, বড়দিন আমাদেরই উৎসব
এতখানি সম্প্রীতি পৃথিবীতে দুর্লভ।
তেঁতুলিয়া থেকে ধারা নেমে যায় টেকনাফ
পাখা মেলে সন্দীপ, মনপুরা দেয় লাফ।
কামার, কুমার, জেলে, শ্রমিক, মজুর চাষা
জড়াজড়ি করে বাঁচি বুক ভরা ভালোবাসা।
দোয়েল, শালিক, টিয়া, কাক, চিল, টুনটুনি
সারাদিন কান পেতে পাখিদের গান শুনি
ডেকে ডেকে ডাহুকীর রক্ত গলাতে ওঠে
তবেই না শাবকেরা বের হয় ডিম ফুটে
কোথাও কী পৃথিবীতে দেখেছ এমন পাখি
শিশুর জন্ম দিতে রাতভর ডাকাডাকি ?
এ-বিশাল পৃথিবীতে একটিই জাতি আছে
জীবনের দাম খুবই তুচ্ছ ভাষার কাছে
রক্তের দাম দিয়ে কিনেছে মায়ের ভাষা
গল্প, কবিতা, গানে ভাষাখানি আছে ঠাসা।
এ-জাতির ছিল নেতা মওলানা ভাসানী
ভালোবাসে নাই তাকে কে এমন পাষাণী
তার হাত ধরে আসে বীর চূড়ামণি এক
আকাশে ও ঘাসে তার নাম আছে উল্লেখ
জাতির জনক তিনি মুজিবুর রহমান
তার ধমনীতে ছিল স্বাধীনতা বহমান
মার্চের উত্তাল রেসকোর্স ময়দানে
কোটি জনতার ঢল মুখরিত জয়গানে।
জনতার মঞ্চতে তিনি উঠে দাঁড়ালেন
মুহূর্তে যেন তিনি আকাশটা ছাড়ালেন
মুক্তির ডাক দিয়ে বলে দেন শেষ কথা
সেই থেকে নিশ্চিত বাংলার স্বাধীনতা।
যুদ্ধের নয় মাস রক্তের বন্যা
সম্ভ্রম দিলো দুই লক্ষটি কন্যা
এভাবেই স্বাধীনতা পেয়েছিল এই জাতি
রক্তের দামে কেনা আসেনি এ-রাতারাতি।
সেই দেশে ভালোবেসে তুমি এবং আমি, সে
চলো মিলেমিশে থাকি নিরামিশ ও আমিষে।

পারভেজ আহসান
বৃক্ষের গল্প
দুটো বৃক্ষ বেড়ে ওঠে পারস্পারিক নির্ভরতায়
তাদের ডালপালা বিস্তৃত হয় নিবিড় আত্মীয়তায়
পাতারা সবুজ হয় এ দুটো বৃক্ষের প্রাণরস খেয়ে
এক মধ্যরাত্রিতে আগুন ঝড় আসে
একটি বৃক্ষের ডাল ভাঙে
ভাঙে তার দেহ খণ্ড
মাটির গভীর থেকে ওঠে আসা শেকড় ও গ্রন্থি
ফসিল হয়ে ঘুমায় মৃত্তিকার ওমে
অতঃপর এক উজ্জ্বল সকালে নিঃসঙ্গ বৃক্ষের দেহ থেকে
মৃত বৃক্ষের সবুজ কাণ্ড বেড়িয়ে আসে
সে কাণ্ডটি ক্রমাগত বেড়ে ওঠে ভালবাসার পাঠ শেখাবে বলে।

শাহীন রেজা
নারী দিবস এবং আমার মা
আমার মায়ের চোখে যেমন মেঘ ছিল তেমন সেখানে আমি রোদকেও খেলা করতে দেখেছিÑ
সহজ সরল মা প্রায় সবকিছুই মাথা কাত করে মেনে নিতেন শুধু তার আত্মসম্মানে কেউ আঘাত করলেই তিনি মুখ খুলতেন, রুখে উঠতেন ফুঁসে উঠতেন;
প্রতিবাদী সেই চোখের সামনে সবকিছু ভস্ম হয়ে যেত।
আমার জন্মের সঙ্গে আমার মা, আমার আলো-বাতাস, বেড়ে ওঠা, দুধের সর, ডিম পোচ, বেগুন ভাজা, মুড়ির মোয়া, তালের পিঠা, আদর্শ লিপিÑসবখানে তার শ্যামা হাতের স্পর্শ। মা মানেই আমার জগৎ ভূমি, তীর্থ।
তার প্রয়াণের পর থেকে এ পৃথিবী অর্ধেক হয়ে গেছে, তিনি চোখ বুজবার সাথে সাথে অর্ধেকটা চাঁদের রুটি ফিরে গেছে মেঘ-ইঁদূরের গর্ভে।
মা মানেই তো একটি জলাশয় একটি আকাশ
দৌড়ে মুক্তি খোঁজার এক বিশাল উঠোনÑ
আমি নারী বলতে প্রথমেই আমার মা’কে বুঝি
পৃথিবীর প্রথম আশ্রয় প্রথম স্পর্শ প্রথম চুম্বন;
প্রতিটি মুহূর্ত; প্রতিটি ক্ষণ, অমাবশ্যা পূর্ণিমা, দিন মাস বছর; আমার অস্তিত্ব আমার ঈশ্বর,
একটি দিবসের কী এমন শক্তি তাকে কেড়ে নেয় ?

শতাব্দী জাহিদ
জল : ০৪
চাঁদহীন এক বনের রাত
ঘামহীন এই চৈত্রের দুপুর।
কাশফুলের দিঘল বাগান চুপচাপ দোলনাহীন
পাড়ের সাথে জলের দূরত্ব।
চুলশূন্য বিছানা বালিশ
নিশ^াস উড়ে বেড়ায় পর্দার গা ঘেঁষে,
আকাশ আড়ি কেটেও ঝুলে আছে বারান্দা।

খোকা আলম
স্বদেশ
তোমাকে পুরোনো হতে দিইনি,
ভয় ছিল আমার।
বাইরের শ্রমে যাই,
মুখশ্রী যত্ন করি।
যদি তুমি নও মেঘের নতুন
আমি যে প্রাচীন।

ভাগ্যধন বড়ুয়া
পাতা ঝরার দিন
পথও স্মৃতির মতো স্থির হয়ে থাকে প্রিয়জন হারালে
বসন্তে কোকিল ডাকে অথচ তখনও বৃক্ষের পাতা ঝরে
আমের মুকুল ঘ্রাণ সুরভিত কথা নিয়ে ফিরে
জীবন জলসায় করুণ সুরে বাজে অতীত সানাই!
পথ অবিকল, তবে প্রতিবেশী বৃক্ষরা কিছুটা প্রবীণ
নামফলক নেই, কারা থাকে এ ঘরে এখন?
আমরাও ছিলাম একদা এখানে, কথাটা বলবো;
যখনই হাজির হই ছবির কাছে কিংবা সাক্ষাতে!
কামিনী ফুলের গাছটা কই ? চড়ুইপাখির কিচিরমিচির!
প্রকৌশলে অপসৃত বহু আগে, পাখি আর আসে না ভোরে
বিদ্যুৎ এর তারে কাক বসে, ডাকে, কুহু কদাচিৎ শুনি
পরিচিত চিহ্ন সামনে এলে স্মৃতি ফিরে অনুসঙ্গসহ…
ঝরাপাতার গায়ে পা পড়লেই বেজে ওঠে সমাপ্তির গান!

শামীম হোসেন
পাখিগাছ
প্রতুল দরিয়া থেকে ভেসে আসা হাওয়া জানিয়ে গেছে
এই সঘন রাতে দূরে আছে তার সখা ও শিমুল
ঘরের চৌকাঠে পাপোশে লেগে আছে পাতকের ছায়া
আলো বিগড়ানো অন্ধকারে রক্তঢেউ মেঘের চিক্কুর
পাগল তাড়ানো বিকেলের রোদ শরণের পোশাক পরে
পেরেক ঠুকে দিয়েছে ঘুটঘুটে রাতের বুকের ভেতর
ভাব ও ভরসার নৌকা টলে যাচ্ছে, টলে যাচ্ছে ভীষণ
তার বহুগামী মন মেওয়া-বনে একা একা ঘুরে
পাখিগাছ ঝাঁকিয়ে দিলে ছড়িয়ে যায় ধ্বনির কূজন

আনোয়ার কবির
আশ্চর্য হই না
এখন আর কিছুতেই আশ্চর্য হই না
বুকের গহীনের অন্তরাত্মা যখন
বারে বারে খোলস বদলায়
সুপ্ত আগ্নেয়গিরি দপ করে রং বদলায়
অজানা পাতাল সরোবরে সাঁতার কাটে হরিদাভ রং
এমনি সময়ে নীলাকাশে ভেসে যায় ইচ্ছের ফানুস
অতীত ইতিহাসের ধূসর পাতা বেয়ে
বয়ে যায় আগমনী সময়
ধূসরতম পাতাতে একে বেঁকে থাকা কালো অক্ষর
জানিয়ে যায় মানব জীবনের গোপন অধ্যায়
দেখতে দেখতে পিরামিডের মমি আর স্ফিংসের মতো
স্থানু দৃঢ় ঋজু আর বোধহীন পাথরের মূর্তিতে থমকে যাই
সময়ের বিবর্তন আর আগমনী সময় জানিয়ে দেয় কত কিছু
আশ্চর্য হওয়ার বোধ পরিণত হয় বোধহীনে
আমি রয়ে যাই একাকী
পাণ্ডুলিপি হয়ে যায় ধূসর থেকে ধূসরতম!

তুষার কবির
কোভিড বসন্তে
কোভিড বসন্ত!
হাসপাতালের জানালা থেকে দেখি
মাস্ক-পরা সীমিত আকাশ!
দেখি নার্সের রুমাল উড়ে যায়
দূরগামী হাওয়ায় হাওয়ায়!
কোয়ারেন্টাইন পাখিগুলো
হালকা উড়ছে
নিরুদ্দেশ অজানা ডেরায়!
সঙ্গনিরোধ মেঘেরা ছুটছে
মহাশূন্যের অতল গহনে
সৌরকণা জলের স্ফুরণে!
কোভিড বসন্ত!
হাসপাতালের জানালা থেকে দেখি
মাস্ক-পরা সীমিত আকাশ!

নওশাদ জামিল
বিষাদ শহরে
খুব কাছাকাছি একই শহরে থাকি
বন্ধু, তোমার দেখা নেই কেন বলো
ভুলে যেতে যেতে অন্তরে ওঠে ঝড়
মেঘ এসে বলে বিজলি কি চমকালো ?
দেখা নেই, কথা নেই সারাদিন একা
আমরা দুজন থাকি আমাদের মতো
ভুলে যেতে যেতে বেঁকে গেছে দুটি পথ
পথিক জানে কি পথের সমূহ ক্ষত ?
খুব কাছাকাছি বিষাদ শহরে থাকি
বন্ধু, তোমার কিছু কি বলার বাকি ?

পিয়াস মজিদ
পূর্ণিমা-পটভূমি, আঁধার প্রজ্ঞা
পূর্ণিমা, অন্ধকার তোমার শানিত শোভা। ঘরেতেও এতকাল জ্বলেছে যত লাল ল্যাম্প তা আজ নিভে যাওয়ার অভিলক্ষ্যে যুদ্ধরত। দূর তারার ফ্রন্ট। বেঁচে থাকায় বসে সাজাই যত নিন্দার নন্দন, কঙ্কালের শিরোভূষণ―বেহেস্তের সোনাঝরা বধির বালিতে, জন্মের পূর্বেই তামাদি কালিতে সেইসব সত্যায়িত; বিশ বাই বিশ বিরল বছরের বোবা বাকভঙ্গি। স্মৃতির জয়ন্তী ছাড়া কোন অলীকের জিম্মায় তোমাকে কবিতার কারাগার থেকে ছেড়ে দিতে পারি! মেদুর মাংসাশী হয়েও বাকি থাকে যা কিছু আত্মার আয়রনি; আহত ইমেজগুলো ভরে রাখো সুনসান দোজখের গ্যালারি । মধুপুর যাত্রাপার্টির পঁচিশতম প্রযোজনা ‘সাপ অপেরা’। খোলা ময়দানে আজ রাত থেকে যাও কষ্টেসৃষ্টে; পেতে দিচ্ছি ছুরির ছাউনি। কবরশালার জাতকেরা বুঝিয়ে দেবে জীবন নামের চরম ধাপ্পায় গুম হয়ে মৃত্যু ছাড়া মেলে না কোনো অমৃত ম্যাজিকের মহড়া। শিল্পের ভেতর এত গেরিলা গোলাপ কেন! সশস্ত্র সুরভি ছাড়া এক পাও এগুনো যাবে না। তোমার ওপর আমাদের নিñিদ্র নজরদারি। ফাঁক গলে যদিবা বেরিয়ে যায় একটা উপমা, আধখানা উৎপ্রেক্ষা; তার মূল্য মাপতে হবে অন্নব্যঞ্জনহীন রান্নাবান্নায়। চৈতন্যের আগুনে ঢালো ঢালো যত পারো রাজসভার ঘি। সুন্দর হে সমাপন, সকলি সুন্দর। আবহমান রক্তের রঙ্গালয়; বহুদিন বাদে দর্শনীর বিনিময়ে দেখা যাবে আমাদের দীপালি ধ্বংস।

প্রদীপ্ত মোবারক
বেলা অবেলায়
মাঝে মাঝে অসীম শূন্যতা নিয়ে
বসে থাকে এই বিপন্ন নগর;
থেমে যায় সব কোলাহল।
চারদিকে ঘন অন্ধকার।
এরকম আবরণেও চোখে পড়ে একটাই মুখ।
বহুদিন দেখি নাই জানালার কাচে কুয়াশার জল।
ফুটপাত ঘেঁষে হাজার গল্পের গ্রাফিতি ভরা
আলপনা দেখেও লোভ হয় না আর।
তুমি স্থির তারা হয়ে হঠাৎ করেই জ্বলে ওঠো
আর আমি বেঁচে আছি ধোঁয়া ছাড়া নিঃশ্বাস নিয়ে।
এরপরও চাই থাকো তুমি ভীষণ মুখর
তোমার সমস্ত বেলা অবেলায়।

অতনু তিয়াস
দরখাস্ত
এক তা সাদা কাগজ আঁকিবুঁকি শেষে
আমাকে ঘুড্ডি বানিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে
এক খামখেয়ালি কিশোর
সেই থেকে স্বপ্নেরা ওড়ে…
একদিন নাটাইঘুড়ি চাহিদার কাছে
বন্ধক রেখে নিরুদ্দেশ…
আজ নাটাই আপনার হাতে, মাননীয় স্যার
আমাদের আকাশে নীল নেই
কালো কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী
আয়নমণ্ডল ঘিরে সিসা
শ্বাস নিতে কষ্ট হয় খুব!
সবুজ পাতা আঁকতে গিয়ে বারবার এঁকে ফেলি
কচকচে নোট, বাজার সওদা
একটু সচ্ছল জীবন।
চারপাশে আরো আরো ঘুড়ি
মাঞ্জাসুতায় সম্পর্ক কেটে দেয় কেউ!
এবংবিধ অনিশ্চয়তায়
ঘুড়িরা উড়তে ভুলে যায়।
অতএব বিনীত প্রার্থনা, স্যার
সুতাটা আরেকটু ছাড়ুন…

রাশেদ রউফ
অন্ত্যমিল
১.
বদল হলো আবহাওয়ার, গরম পড়ে শীতে
তুমিই আমার মন রাঙালে হাওয়ার বিপরীতে।
ডাগর চোখে সাগর করে মুক্ত বসবাস
ঢেউ খেলে যায় ঝর্ণা-হাওয়ায় শরীরী উদ্ভাস।
আগল ভাঙা পাগল হাওয়া উতলা সংগীতে
আমি তো চাই তোমার কাছে আমার এ মন দিতে।
২.
সবুজ দেখলে অবুঝ হয়ে পড়ি
শরীর থেকে জেগে ওঠে মন
চোখ না পড়লে ফোটে না মঞ্জরি
শরীর না মন, কোথায় আকর্ষণ ?
কোথায় আমার মনের বসবাস
কখন চলে তুমুল বৃষ্টিপাত
কেউ জানে কি আমার কী বিশ্বাস
সঙ্গী কেন বিনিদ্র সব রাত ?
৩.
ভালোবাসা মানে আর কিছু নয়
বুকের ভেতরে সুখ―
টুকটুকে ঠোঁটে হিমছড়ি ফোটে
হেসে ওঠে চিম্বুক।
হাতে হাত রেখে চোখে চোখ রেখে
স্বপ্ন ওড়াবো, তাই―
দুর্দিনে আজ নিতে নব সাজ
তোমাকেই শুধু চাই।

সারওয়ার-উল-ইসলাম
[উৎসর্গ: কিশোরী আর তার প্রিয়মানুষ-কে]
তুই
আহা কিশোরীর তাহার লাগিয়া মনটা কেবল পোড়ে
তাহার লাগিয়া আকাশী ওড়না ঘুড়ি হয়ে হয়ে ওড়ে।
কাছাকাছি হয় বলতে পারে না মনের জমানো কথা
খাতার পাতায় প্রিয়নাম লিখে পার করে নীরবতা।
বেহায়া হৃদয় নানান ছুঁতোয় তাহার সামনে যায়
গোপন কথাটি একদা বলবে মনে সে ভরসা পায়।
ভরসা নিয়েই মাস পার হয় বছরও হয় পার
আহা রে কিশোরী হারানোর ভয়ে বলতে পারে না আর।
ভাবে মনে মনে বলবার পরে যদি বলে দেয়, ‘না রে―
তোর সাথে বল আমার এখন ওসব হতে কি পায়ে ?’
ভয় হয় ফের যদি রাগ করে আর না বলে সে কথা
গুটিয়ে রাখলো নিজেকে যেমন গুটায় লাজুকলতা।
রক্তজবারা লাল হয়ে হয়ে বাগান মাতিয়ে রাখে
সন্ধ্যামালতী কিশোরী হৃদয়ে গোপন কষ্টে থাকে।
ফড়িংয়ের ডানা ঘাসের ডগায় কাঁপে তিরতির করে
কিশোরী হৃদয়ে স্বপ্নেরা শুধু গুমড়ে গুমড়ে মরে।
মায়ের বকুনি উপেক্ষা করে তাহাকে দেখবে বলে
কতদূর থেকে সখীদের নিয়ে কত দূর যায় চলে।
লাল শাড়ি আর লাল চুড়ি পরে তাহার বা’হাত ধরে
ঘুরেছে মেলায়, প্রজাপতি চোখে ওড়ে ফড়ফড় করে।
বাদাম ছিলতে কিশোরী পারে না আহলাদ করে কী যে-
তাহাকে বাদাম ছিলতে বলতো ভাবলে দুচোখ ভিজে।
দুজনে দু’প্লেট ফুচকা নিয়েছে, কিশোরীর প্লেট শেষ
অন্য প্লেটের ফুচকা নিয়েছে থাকতে ঝালের রেশ।
সবুজ পেয়ারা ভেতরটা লাল দাড়িয়ে গাছের নিচে
কত না উদাস দুপুরবেলায় সময় কেটেছে মিছে।
ওড়নার এক কোনায় পেয়ারা পেঁচিয়ে রেখেছে যেই
কিশোরী শরীরে ওড়না সরেছে একটু খেয়াল নেই।
প্রিয়মানুষের নজরে এসেছে ঠিক করে ওড়নাটা
পরতে বলেই চুপচাপ করে দিয়েছে উল্টা হাঁটা।
লজ্জা দ্বিধায় ওড়নাটা শেষে ঠিকঠাক করে পরেÑ
প্রিয়মানুষের পেছনে পেছনে ফিরেছে নিজের ঘরে।
আমের ভর্তা সর্ষে বাটায় জিভে এসে যায় জল
কাঁচা মরিচের ঝাল খেয়ে খেয়ে চোখ করে টলমল।
সেই চোখে দেখে প্রিয়মানুষের মিট মিট করা হাসি
পাতা ঝরে গেছে, বলা তো হয়নি ভালোবাসি ভালোবাসি।
হাঁটতে হাঁটতে উসঠা খেয়েছে ছিলেছে হাঁটুর কাছে
কিশোরী গিয়েছে পাশের বাসায় স্যাভলন তুলা আছে?
প্রিয়মানুষের হাঁটুতে রক্ত তুলা দিয়ে মুছে শেষে
স্যাভলন মেখে ব্যাণ্ডেজ করে দিয়েছিল হেসে হেসে।
কিশোরী বলেছে ক্ষতটা শুকাতে সময় লাগবে ম্যালা
বন্ধ থাকবে ফুটবল আর ব্যাডমিন্টন খেলা।
নইলে ক্ষতটা বড় হয়ে যাবে থাকবে হাঁটুতে দাগ
প্রিয়মানুষের ভঙ্গি-‘ ছেমড়ি, ডাক্তার তুই ? ভাগ।’
ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায় কিশোরী সেই চোখে ছিল কী যে
ভাবলে এখন বরষার মত মন শুধু যায় ভিজে।
জোছনায় ভিজে নৌকা চড়েছে প্রিয়মানুষের পাশে
বসে কি যে সুখ! চোখের তারায় জোনাকিরা শুধু ভাসে।
রিকশায় করে কিশোরী গিয়েছে চন্দ্রিমা উদ্যান
প্রিয়মানুষের পরশ লাগায় মন করে আনচান।
চাইনিজে স্যুপ অন্থন খেয়ে সময় করেছে পার
কিশোরী পারেনি জানাতে কথাটি আহা ভালোবাসবার!
ঘুরতে ঘুরতে টিএসসি আর চাঁদনি চকের সেই
দই লাচ্ছায় সময় কেটেছে চোখে জল আসছেই।
জানালার পাশে দাড়িয়ে কিশোরী দেখায় হাতের চুড়ি
প্রিয়মানুষটি পেয়ারার ডালে দেয় হাতে সুড়সুড়ি-
সুড়সুড়ি পেয়ে হাতটি সরায় ভেঙে যায় চুড়ি দুটি
হাত ফুটো হয় রক্ত বেরোয় হয় মৃদু খুনসুটি।
সেই দাগ আজও রয়ে গেছে হাতে কালো মতো সেই দাগ
কিশোরী বয়সে মনের গভীরে থাকে কত অনুরাগ।
প্রিয়মানুষের জামার বোতাম খুলে পড়েছিল দেখে
সুই সুতা এনে লাগিয়েছে সেটা জামাটা গায়েই রেখে।
আহারে কি সুখ! বোতাম লাগাতে কত কাছাকাছি হওয়া
ছোট একখানা কথা হায় তাকে হয়নি তবুও কওয়া।
বলতে পারে না মনের কথাটি আহারে কিশোরী আর
কিশোরী বয়স পার না হতেই বিয়ে হয়ে যায় তার।
বহুদিন পর কথা হয় সেই প্রিয়মানুষের সাথে
গোপন কথাটি জানায় কিশোরী হাত রেখে তার হাতে।
বুকের ভেতর নড়ে চড়ে ওঠে সেই প্রিয়মানুষের
কিশোরীর চোখে চোখ রেখে তার কেটেছে সময় ঢের।
কিশোরী জানায় ভালোবাসা তার এখনো রয়েছে জমা
এত কাছে থেকে কেন বুঝলো না বানালো না প্রিয়তমা।
অনেক হিসেব জীবনের থাকে সেই হিসেবের ফল
কিশোরীর মন কষ্টে ব্যাকুল চোখ দুটি ছলছল।
আদর সোহাগ যোগ করে করে একে একে হয় দুই
কিশোরী হয়নি প্রিয়তমা আজ হয়েছে এখন ‘তুই’।
প্রিয়মানুষের কণ্ঠে এখন ‘তুই’ শুনে হয় ভোর
দুপুর সন্ধ্যা মাঝরাত্রিরে কাটে না কথার ঘোর।
আহারে কিশোরী তাতে খুশি থাকে আর কিছু না-ই পাক
কত না মধুর প্রিয়মানুষের কণ্ঠে সে ‘তুই’ ডাক!
বেলী ফুল ফোটে বাগানে তাহার ফুটে থাকে ছোট জুঁই
সকাল সন্ধ্যা রাত্রিবেলায় গন্ধ ছড়ায় ‘তুই’।