প্রথম বধ্যভূমি : রাবেয়া খাতুন

আবার পড়ি : রাবেয়া খাতুনের গল্প
আজকাল প্রায়ই টকটকে চোখ নিয়ে বাড়ি ফিরত শাহেদ। ক্লান্ত শরীর নিয়েও। দুপুরে একটু ঘুমিয়ে আবার বেরুত। রাত জেগে পোস্টার লেখা, সেগুলো লাগানোর ব্যবস্থা করা। কাজের নাকি শেষ নেই। কথাগুলো কবে কখন বলেছিল শাহেদ ? মনে করতে চেষ্টা করে আকাশের দিকে তাকালেন সাবের সাহেব।
ফ্যাকাশে নীল আকাশে চক্কর দিয়ে বেড়াচ্ছে যে পাখিগুলো, পায়রা মনে হয়েছিল প্রথম দৃষ্টিতে। ভুল ভাঙল কয়েক মিনিটের ভেতর।
উত্তেজিত পায়চারি করতে করতে থেমে দাঁড়ালেন সাবের সাহেব। পায়রা কোথায় ? সূর্যের কম আলো আর ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসা চোখের চাউনি দায়ী এই ভ্রান্তির জন্য।
হাওয়ায় পাতা উল্টে যাওয়া কোলের বইটার দিকে তাকালেন। দূর-মনা হয়ে গেলেন। ইতিহাস কথা বলে না। কিন্তু পুনরাবৃত্তি ঘটায়। যুগ থেকে যুগে। এর মধ্যে আবার এক একটা সময় আসে নিদারুণ অস্থিরতা, অনিশ্চয়তার অধিকার নিয়ে। সিরাজদৌলা থেকে বাহাদুর শাহ। কোম্পানির আমল থেকে মহারানির যুগ। প্রায় দু’শো বছর পরাধীন একটি জাতির জন্য নানা দুর্দিনের, অপমানের—
ওমা, মাগো দেখ এসে কত লম্বা মিছিল।
তোরাই দেখ বাপ, চুলায় আমার রান্না।
রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছিল ভুনা পোলাওর চালের ঝাঁজ মিষ্টি গন্ধ। খিচুড়িতে গরম পানি ঢেলে জলির কথার জবাব সেরে আয়শা বানু স্বামীর উদ্দেশে বলল, তুমি কি ঐ ইজি চেয়ারে বসেই দিনটা পার করবে নাকি ?
কাজ কিছু থাকে তো বলো।
গোসল করতে হবে। বেলা কত গড়াল খেয়াল আছে।
উম্।
শব্দটা মুখের। কিন্তু ওঠার কোনো গরজ দেখালেন না।
আসলে জমে আছে সারা শরীর, জাগতিক সমগ্র চৈতন্য। কি করে, কেমন করে বলবেন কথাটা। অথচ বলতে হবেই।
বাবা, বাবা, রাস্তার লোকজন সব দৌড়াচ্ছে।
দৌড়াচ্ছে নয়, পালাচ্ছে।
জলি শেলির কথার মধ্যে বিরক্তি প্রকাশ করলেন আয়শা বানু—ঐ এক নতুন রোগে ধরেছে তোদের। রাস্তার মানুষ দৌড়াচ্ছে কি পুলিশের তাড়া খেয়ে পালাচ্ছে, তাতে তোদের কি বাপু ? যা না গোসল সেরে আয় চটপট।
মায়ের ধমক খেয়েও কুয়োতলার দিকে নড়ল না ওরা দু’জন। বরং বারান্দার নিচে দাঁড়িয়ে বলল, চলো না বাবা বাইরে গিয়ে দেখে আসি কি হচ্ছে। আমাদের ক্লাসের মনিটর বলছিল আজ নাকি গণ্ডগোল হতে পারে। বেশি দূরে তো যাব না, এই গলির মুখে।
স্বামী কিছু বলার আগে চুলার ধার থেকে আয়শা বানু বললেন, খবরদার এক পা বাড়িয়েছিস তো টেংরি ভাঙব। বেশি দূর নয় গলির মুখ! একজন তো এই কথা বলে বেরিয়েছে। সেই কোনকালে। ফিরবার নামটি নেই এখনও। হ্যাঁ গো, শাহেদ ফিরবে কখন ? কিছু বলে গেছে ?
এসে যাবে।
জবাব দিয়ে আবার দূর-মনা হয়ে গেলেন সাবের সাহেব। চোখের ওপর আজ সকালটায় ঘুম ভেঙেছিল আজানের শব্দে নয়, পাখির স্বরেও নয়, বহুকণ্ঠের সেøাগানে—রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই—
আজকাল প্রায়ই হচ্ছে এমন। সময়ে অসময়ে। দেশ দু’ভাগ হয়নি, স্বাধীনতাও হয়েছে।
নতুন ভূখণ্ডের নাম হয়েছে পাকিস্তান। কিছুদিন আগেও ওরা প্রতিষ্ঠা দিবস চৌদ্দই আগস্ট উৎসাহের সঙ্গে পালন করেছে। জাতির জনক কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলি জিন্নাহকে দেখার জন্য লালন করেছে আগ্রহ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ময়দানি জনসভায় বক্তৃতারত মানুষটিকে দেখে অবাক হয়েছে। কাঠ কাঠ শরীর। রোগা রোগা মুখ। এই লোকটি নেতৃত্ব দিয়েছেন হাজার হাজার মানুষের। মুগ্ধ নিবিড় আবেশ কাটল বিদ্যুৎ ভূমিকম্পে। জিন্নাহ প্রথমবারের মতো এদেশে এসেই বলেন, রাষ্ট্রভাষা উর্দু হবে। দেশের বৃহৎ জনসংখ্যা যেখানে বাংলায় কথা বলছে, সেখানে অন্য ভাষা প্রাধান্য পায় কি করে ? চারদিকে উঠল রকমারি গুঞ্জন।
ওটা যে ওদের মাতৃভাষা।
পাকিস্তান হবার জন্য নানাভাবে যুদ্ধ করলাম আমরা সবাই। আর যেই পাকিস্তান হলো, উনি মনে করে নিলেন এটা তার পৈতৃক সম্পত্তি। নইলে জনমতের তোয়াক্কা না করে এমন কথা বলেন কি করে ? প্রকাশ্য ঘোষণার সাহস পান কোথায় ?
শাহেদরা বলত, এটা মানা যায় না। আমরা হাফপ্যান্ট পরা অবস্থায় স্কুলে পিকেটিং করেছি, ফুলপ্যান্ট পরা অবস্থায় প্রতিবাদ করব।
মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ জাতির জনক খেতাব পেয়েছিলেন, কিন্তু পিতার দায়িত্ব পালনে উদার নীতি অবলম্বন করেননি। পল্টনের খোলা ময়দানে বক্তৃতা দিয়ে উড়ে গিয়েছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানে। সেখান থেকে আরও দূরে মৃত্যুর খেয়ায়। কিন্তু যে ঢেউ ফাঁকা মাঠে তুলে গেছিলেন, ক’টা বছরের ভেতর রাজপথ থেকে পথে, পথ থেকে গলিতে ছোটাছুটি করতে লাগল অস্থির প্রতিবাদী গতিতে। বিপরীত দিক থেকে আসছিল মারাত্মক হুমকি। তবু প্রবহমান রয়েছে আন্দোলন।
সকালে আয়শা বানু ছেলেকে বেরুতে দেখে বলেছিলেন, কাজ নেই শাহেদ আজ তোর বাইরে গিয়ে।
শাহেদ পাঞ্জাবির বোতাম লাগাতে লাগাতে বলেছিল, কলেজে যাচ্ছি মা, বাইরে নয়।
ওমা যেন ঐ গণ্ডির ভেতর দাঁড়িয়ে থাকবার ছেলে তুই।
জবাব না দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেছিল শাহেদ। আয়শা বানু তাকিয়ে ছিলেন স্বামীর দিকে ভুরুজোড়া খাড়া করে—তুমি যে বল্লে না কিছু ?
কি বলব ? ছেলে তোমার বড় হয়েছে। ভালোমন্দ বুঝতে শিখেছে। এখন বাধাই বা কেন দেবে। আর দিলেই বা সে কেন মানবে ?
মানবে না মানে ? মাথার ওপর তবে বাপ মা থাকে কেন ? যদি খেয়াল খুশি মতই চলবে তো…
স্ত্রীর কথার ভেতর কথা গুঁজলেন সাবের সাহেব। বল্লেন, আহা! খেয়ালখুশি বলছ কেন। আজ কি ও একা বাইরে যাচ্ছে ? ওর মতো হাজারো যুবক…
থামলেন হঠাৎ। স্বর, দৃষ্টি, মুখের রেখা বদলে নিয়ে আবার বল্লেন, থাক ওসব কথা।
আয়শা বানু বল্লেন, কিন্তু এটা মনে রেখো যদি ছেলে মাথার ইট পাটকেল বা হাতে রাইফেলের গুঁতো নিয়ে বাড়ি ফেরে, তোমার সঙ্গে আমার লণ্ডভণ্ড কাণ্ড হয়ে যাবে।
লম্বা লম্বা পা ফেলে রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে পেছনে রেখে গেলেন আরও কিছু কথা—ছেলেটা ক’দিন থেকে ভুনা খিচুড়ি খেতে চাইছে। তা এমন একটা কোমর ভাঙা স্কুলে চাকরি করো, যেটায় আর গুণ নেই কিন্তু চারগুণ ঠিকই আছে। এদিকে বড়ো বড়ো লেকচার, ওদিকে মাইনে দেবার বেলা রাজ্যির অনিয়ম। কাল টাকা পেলে, তড়িঘড়ি আজ যাও বা ভালো খাবারের জোগাড় করলাম তো ছেলে চলল মিছিল করতে। এখন অবেলায় এসে খাক ঠাণ্ডা বিস্বাদ খিচুড়ি। তোমার কি ?
শুনে খানিকটা হাসির মতোই কিছু ফুটেছিল ঠোঁটের ভাঁজে। এখন তো শাহেদের পা দুটো বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনে গিয়ে পৌঁছেছে। সাতচল্লিশের আগে একদিন স্কুলে গিয়ে প্রধান ফটকে লম্বা হয়ে শুয়ে থাকতে দেখেছিলেন শাহেদকে। কতই বা বয়স তখন ? প্রথমে চমকে উঠেছিলেন। শহরের স্কুলে স্কুলে পিকেটিং-এর ধুম। কিন্তু তার মধ্যে তার ছেলে থাকবে ? বাড়ি ফিরে স্ত্রীর কাছে বলেছিলেন, তোমার ছেলের জন্য এবার যাবে চাকরিটা। ষষ্ঠ জর্জের আমলারা আর যা-ই সহ্য করুক, স্কুল মাস্টারের ছেলের বাড়াবাড়ি সহ্য করবে না।
ছেলেকে প্রথমদিকে তিনি শাসাতেন। যে রাজার রাজ্যে সূর্য অস্ত যায় না, এইসব নিরামিষ অসহযোগ আন্দোলন করে তাড়ানো যাবে তাদের ? মাঝখানে নগদ লাভ জুটবে নানা গঞ্জনা।
শাহেদ খুব একটা কানে তুলত না। কখনও বলত, এখন আমরা ছাত্ররা মিছিলে যাচ্ছি, তোমরা মাস্টাররা বাধা দিচ্ছ। এমন একটা সময়ও আসতে পারে যখন তোমরাও মিছিল করে রাস্তায় নেমে আসবে নিজেরই প্রয়োজনে।
এরপর ছেলেকে খুব একটা ঘাঁটাতেন না। এ পোড়া দেশে শিক্ষকদের অভিযোগ চিরকালই আছে। কিন্তু তা নিয়ে রাস্তাঘাটে নামার কথা ভাবা যায় না। যেমন ভাবা যায়নি ইংরেজ রাজতন্ত্র খতম হবার ব্যাপারটা।
সাতচল্লিশে তারা যখন সত্যি সত্যি চলে গেল, আপন সন্তানের ওপর এক ধরনের বিশ্বাস এলো। তাই স্ত্রী যখন শাহেদের মিছিল, স্লোগান ইত্যাদি নিয়ে চেঁচামেচি করেন, তিনি শুধু বলেন, ভালোভাবে ফিরে আসিস।
আজ সকালেও বলেছেন। কিন্তু…
বাবা বাবা, কাদের বাড়িতে যেন আগুন লেগেছে।
জলি শেলির জোর চিৎকারে সজাগ হলেন। এই চৈত্রমাসে আগুন ? শুকিয়ে সব খটখটে হয়ে আছে না। লাগল কোন্ দিকে ? উঠে দাঁড়ালেন। কুণ্ডলি পাকানো কালো ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। দিক ঠাহর করা যাচ্ছে না। মূল শহর থেকে থাকেন অনেকটা দূরে। নগর প্রাণের স্পন্দন কখন কত ডিগ্রি চড়ল, ধরা যায় না ঠিক মতো। তবে এটা সত্যি গত কিছুদিন থেকে মাথার ওপর অভাবিত কোনও ঝড়ের আশংকা নিয়ে থমথম করছে গোটা ঢাকা শহর। এ প্রেক্ষাপট তার চোখে চেনা নয়। সিপাই বিদ্রোহের বিপ্লবীদের আন্টা ঘরের ময়দানে প্রকাশ্য ফাঁসির কথা তিনি শুনেছেন। কিন্তু দেখেছেন পরবর্তী সময়ে স্বদেশীরা কোর্টে চালান হলে তাদের এক পলক দেখার জন্য আদালত প্রাঙ্গণে জনারণ্যের উত্তাল ধারা।
কলিজা কাঁপানো দাঙ্গা দেখেছেন কয়েকবার। দেখেছেন দিনের পর দিন দমবন্ধ করা কারফিউ। পাকিস্তান হবার পর স্বাধীনতা লাভের উৎসবমুখর রাজপথ। এই রাজপথে আবার আর কিছু দেখতে হবে, তাও মাত্র পাঁচ ছ’বছরের ভেতর, একেবারে ভাবতে পারেননি। বর্তমানের ঢাকাকে, বায়ান্নর ঢাকাকে কখনও মনে হচ্ছে মশাল নগর, কখনও শোকাচ্ছন্ন সমাধি-শহর…
সমাধি-শহর ? চমকে উঠলেন। আজ থেকে মনে হবে শোকাচ্ছন্ন সমাধি-শহর। ওরা ছাত্র জনতার গায়ে গুলি ছুঁড়েছে। সরকারি ১৪৪ ধারা অমান্য করে যে মিছিলটি এগুচ্ছিলো অস্থায়ী সংসদ ভবনের দিকে, সেখানে চলছিল তখন বাজেট অধিবেশন। ছাত্র-জনতার স্রোত মেডিকেল কলেজ ছাত্র নিবাসের কাছে পৌঁছা মাত্র ছুটে এলো ঝাঁক ঝাঁক গুলি। বাঙালি মন্ত্রীর হুকুম পালিত হয়েছে পাঞ্জাবি চিফ সেক্রেটারির তত্ত্বাবধানে। ঘটনাটা যেন বিশ্বাসযোগ্য নয়। কিন্তু বুলেটে ছিন্নভিন্ন হয়েছে মানুষের শরীর। সেই সঙ্গে ছিটেছান হয়েছে স্বাধীনতা নামের দেশের লোকের আস্থা ও বিশ্বাস নামক সমুদয় হৃদয়বৃত্তির।
কিন্তু স্ত্রীর কাছে কি জবাব দেবেন তিনি। বারান্দা থেকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন পরম নিশ্চিন্তে বাটিতে সালাদের ব্যঞ্জন কাটছেন আয়শা বানু। শাহেদ খিচুড়ির সঙ্গে খেতে পছন্দ করে। ঠিকা ঝি’কে শ্রোতা বানিয়ে যেসব কথা বলছেন, তাও কানে আসছে—বুঝলে চিনির মা, মায়ের দুঃখ ছেলেমেয়েরা তলিয়ে দেখতে চায় না। আজও শুনেছিলাম কলেজ হবে না।
হইব না ক্যান আম্মা।
ছেলেরা করবে না। তাই বললাম যা শাহেদ একবার মুন্সীগঞ্জ গিয়ে দুলিকে দেখে আয়। বুঝলে গো আদর করে পয়লা সন্তানের নাম রেখেছিলাম দুলারি। তো কপাল দোষে পড়েছে এমন সব মানুষের ঘরে, ওর সব চিঠিতেই আমার চোখের পানি ঝরে।
ক্যানগো আম্মা, আমগোর মাইয়াগোর মতন আপনেগো ভদ্দরলুকের মাইয়াগোও জ্বালান পোড়ান অয় নিহি পরের ঘরে ?
তা আর হয় না! মেয়েটা আমার যেমন মাটির মতো, সাউড়ি মাগি তেমনি আগুনের মতো। হাড়হাড্ডি চিবিয়ে কিছু রাখল না। তো শাহেদকে সেই কবে থেকে বলছি নিয়ে আয়। ক’টা দিন দুলি নাইওর থেকে পরান ঠান্ডা করে যাক। আজ যাই, কাল যাই করে ছেলের আমার যাবারই সময় হচ্ছে না।
কলেজ যাইব না আম্মা ?
তাই বলে আর কিছু বুঝবে না। বুঝবে না ও ছাড়া আমার কি আরও একটা ছেলে আছে যে তাকে পাঠাব ? থাকার মধ্যে রোগা পটকা ঐ মানুষটা। অশক্ত শরীর নিয়ে সে ইস্কুল করবে, না নদীর ওপার যাবে ?
ওরা হয়তো আরও কিছুক্ষণ এমনি কথা বলে যাবে। এক সময় হয়তো আয়শা বানু এমন মন্তব্যও রাখবেন, মেয়েটাকে তেমন দিতে থুতে পারেননি বলেই শাশুড়ি জ্বালায় বেশি। ওরা মাস্টারের মেয়ে যেমন চেয়েছে, তেমনি চেয়েছে নিজেদের ছেলের সাধের দু’চারটা সামগ্রী। এ জীবনে স্বামী যা পারেনি, তার মেধাবী পুত্র বড়ো চাকরি করে তা পারবে। সঙ্গে সঙ্গে শ্বশুর বাড়িতে বেড়ে যাবে দুলারির দাম।
কিন্তু যার জন্য এত কথা, সে এখন কোথায় ? কেমন করে তিনি বলবেন ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা হোক’-এর আন্দোলনে যোগ দিতে গিয়ে পুলিশের নির্মম গুলিতে নিহত হয়েছে তাদের একমাত্র পুত্র সন্তান।
আয়শা বানু হয়তো কান্নার আগে প্রশ্ন করে বসবে, মাতৃভাষার জন্য মানুষ জীবন দেয় এ আবার কেমনতর কথা।
ছোট্ট এই প্রশ্নটি তার দিকে ছুটে এলে কি জবাব দেবেন, জানা নেই। বুদ্ধিতে নেই। সকালে যে বেরিয়ে গেছে একদল যুবকের সঙ্গে, সন্ধ্যায় সেই দল হয়তো ফিরে আসবে। তাদের ভেতর নিজের ছেলেকে না দেখে স্ত্রী আর কারু নয় তার দিকেই তাকাবে। আর্তস্বরে তুলবে চিলচিৎকার,
ওগো সবাই ফিরে এলো, এলো না শুধু সে। কেন, কেন ?
বলি আজ তোমার হয়েছে কি ?
সজাগ হলেন। সামনে দাঁড়িয়ে আয়শা বানু, খাবে না ?
খাবো ?
ওমা, যেন নতুন শুনলে শব্দটা।
তা নয়।
তবে কি ভাবছ শাহেদ ফিরলে একসঙ্গে বসবে! আমিও তো তাই ভেবে বেলা কম বাড়ালাম না। কিন্তু দিন ছোটো। তার ওপর তোমার ঐ শরীর। অবেলায় খাওয়া একেবারে সহ্য হবে না। তাছাড়া জলি শেলির কথা ভাবো। ওদের খুব খিদে পেয়েছে। কখন থেকে খ্যানখ্যান করছে খাবার জন্য।
ঠিক আছে, চলো বসছি। আজ আর গোসল করব না।
সাবের সাহেব উঠে দাঁড়ালেন।
আয়শা বানু খাবার পরিবেশনের এক ফাঁকে শাহেদের ঘরে গিয়ে ঠিক করে রেখে এলেন চটি জোড়া। পাশে লুঙ্গিটা। না জানি কত খিদে পেটে নিয়ে ফিরবে। যাবার সময় তাড়াহুড়োর মধ্যে নাস্তা পর্যন্ত খেয়ে যেতে পারেনি। অভিযোগ করেছিলেন বলে এক পলকের জন্য থেমে গিয়ে শাহেদ বলেছিল, দেরি করব না। খিচুড়ি রাঁধবে বলছ, ওটা হতে না হতে দেখবে এসে গেছি। নাস্তার ক্ষতিপূরণটা তখনই করে নেব।
লুঙ্গির পাশে গামছা রেখে ফিরে এসে দেখলেন, স্বামী হাত ধুচ্ছেন। তাকালেন একটু অবাক চোখে। শাহেদের মতো ওর বাপও যে খিচুড়ি খুবই পছন্দ করে। ভয় পেয়ে বলেন, কিগো শরীর খারাপ লাগছে ?
না। তুমি খেয়ে নাও। আমি একটু গলির দিকটা ঘুরে আসি।
স্ত্রীর হাত থেকে পান নিতে ভুলে গেলেন। আয়শা বানু এগিয়ে এসে খিলিটা ধরিয়ে দিয়ে বল্লেন, বাপ ব্যাটা সমান মনভুলো হয়েছ। দেখা হওয়া মাত্র আজ একটু বকবে। কিন্তু কেমনতর আক্কেল। এত বেলাতেও ঘরে ফিরছে না ? আমি দুশ্চিন্তায় থাকি না। আজকাল লাঠিসোটার বাড়ি খেয়ে রাস্তায় পড়ে থাকলে পুলিশ নাকি আরও বেশি করে মারে। ভাবতেও কলজের পানি শুকিয়ে যায়।
লম্বা নিঃশ্বাস লুকোলেন সাবের সাহেব। এর বেশি আয়শা বানু ভাবতে পারেন না। আজকালকার মা বলে এটুকুও স্পষ্টভাবে বলতে পারছে। স্ত্রীর উদ্দেশ্যে মনে মনে বল্লেন, হে বিদ্রোহী পুত্রের জননী তোমায় আরও স্পষ্ট শক্ত হতে হবে। সামনে বড়ো দুঃসময়, হয়তো আজ সূর্যাস্তের আগেই তোমাকে মুখোমুখি হতে হবে সেই সময়ের। তুমি তৈরি হও।
গলির মুখে ছড়ানো ছিটানো পাড়ারই কিছু মানুষ। ভীত, আতংকিত। তার ভেতরই চলাচল করছে ছেঁড়া ছেঁড়া সংলাপ—পুলিশ কিছু লাশ একদম গুম করে দিয়েছে… কিছু লাশ নিয়ে দু’দলের মধ্যে অসীম যুদ্ধ হয়েছে… আগ্নেয়াস্ত্র, আর্তনাদ, ধোঁয়া, গর্জন, সব কিছুর শেষে জায়গাটাকে মনে হচ্ছে বিরান বধ্যভূমি…
চাচাজান ?
কে ?
চমকে তাকালেন। শাহেদের বন্ধু আলমগীর। গলার কাছটা দলা পাকানো। ভাষা উঠে আসতে চাইছে না। নিজের ওপর অসম্ভব জোর খাটিয়ে তবু বলেন,
লাশ পেলে ?
জ্বি না। ওরা শুধু প্রাণে মারেনি। দেহটাকেও কেড়ে নিয়ে গেছে। শাহেদ শেষ নিঃশ্বাস নিয়েছিল আমার কোলেই। সান্টু আহত হলো তখনি। ওকে রেখে সান্টুর কাছে যাবো, শুরু হলো টিয়ার গ্যাসের ঝড়, তার ভেতর…
আলমগীর মুখ নামিয়ে নিলো। কয়েক পলক, আবার সরাসরি তাকিয়ে বল্লো, ওরা ভেবেছে ডাণ্ডা ঘুরিয়ে জিতে গেছে। এটা কি যুদ্ধ যে হারজিৎ থাকবে। এটা একটি জাতির নিজস্ব আত্মিক দাবি। যতক্ষণ সে দাবি না মিটবে, আগুন জ্বলবেই। আপনি কি আমাদের সঙ্গে আসবেন ?
কোথায় ?
গায়েবানা জানাজায়।
যাবো। কিন্তু তার আগে তোমার চাচিকে… থেমে প্রায় স্বভাব বিরুদ্ধ ভঙ্গিতে চেঁচিয়ে উঠলেন, তাকে আর কতক্ষণ অন্ধকারে রাখব ? কতক্ষণ ?
সান্টু এসেছে আমার সঙ্গে। সে বাড়ির ভেতর গেছে চাচিকে সব কথা জানাতে।
আমরাও সব জেনেছি সাবের সাহেব। মৃত্যুকে তো থামানো যায় না, সময় মতো সে আসবেই। তবে আজ বৃহস্পতিবার। বড়ো ভালো দিনে গেছে আপনার ছেলেটা। গোর আজাব একদম মাফ।
প্রতিবেশী শমসের আলিকে যেন তার জবাবে আবার বলছে, থামুন মিয়া ভাই। লাশই গায়েব, আর আপনি করছেন গোর আজাবের চিন্তা ভাবনা।
সাবের সাহেবের কানে কিছু ঢুকছিল না। আলমগীরের কথা শেষ হতেই তিনি রওনা দিয়েছিলেন বাড়ির দিকে। এখন তিনি পুত্রশোক ভারাক্রান্ত পিতা নন। সন্তানহারা জননীর স্বামীও। আচমকা ঘুরে দাঁড়ালেন—সান্টু ছাড়া তোমার চাচির কাছে আর কে আছে ?
পাড়ার অনেক মহিলা এসেছেন দেখলাম।
তবে চলো। শাহেদ নয় একজন শহিদ, না না অনেক শহিদের জানাজায় শরীক হতে যাবো আমি।
পরের লাইনটা ভাঙা জমে যাওয়া গলায় উচ্চারণ করলেন সাবের সাহেব—আর যাবো স্বাধীন দেশের সেই বধ্যভূমিটা দেখতে, যে দেশের জন্য দু’শো বছর আমরা নানাভাবে সংগ্রাম করেছি।
বড়ো রাস্তায় লাল পাগড়ির ধকল। অন্ধকারেও তারা চোখ জ্বালিয়ে রেখেছে বনবেড়ালের মতো। যেতে হবে গলি, কানাগলি, গেরস্থঘরের আঙিনা দিয়ে।
ঘোরের মধ্যে এক সময় এসে পৌঁছুলেন পলাশি ব্যারাকে। একটি বাড়ির দেয়ালের দু’দিকে দু’টি মই লাগানো। তা টপকালে মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রাবাসের অস্থায়ী আস্তানায় পৌঁছে যাওয়া যায়।
খোলা উঠোনের মাঝখানে কিছু ছেলে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে। মই পেরুতে কষ্ট হয়েছে সাবের সাহেবের। এখন ধ্বক করে উঠল বুক, আবার নতুন লাশ পড়েছে না পাওয়া গেছে শাহেদকে ?
কাছাকাছি এসে দেখলেন সব ছেলে দাঁড়ানো নয়। কিছু বসেও। ভাঙা কাচ, বুলেটের খোল, টুকরো ইট, খণ্ড কাঠের বিক্ষিপ্ত ক্ষেত্রভূমিতে বসে হাতে হাতে তারা তৈরি করছে চৌকোণ একটা কিছু। সেটা কি, প্রশ্নের আগেই অনেকগুলো বুটের শব্দে চমকে উঠল চারদিক। অস্ত্রধারী, বিশেষ পোশাকে ঢাকা একদল মানুষ। ক্ষ্যাপা হাতে তারা ভাঙছে কৌণিক সেই স্তম্ভটা। বেয়নেটের খোঁচায়, বুটের ধাক্কায় সেটা মাটির সঙ্গে সমান করে দিয়ে চলে গেল বীর ভঙ্গিতে।
কে একটি তরুণ বল্লো, এই নিয়ে তিনবার হলো।
সঙ্গে সঙ্গে বাজল অন্য একটি কণ্ঠ—
কতবার ভাঙবে ? কতরাত জাগবে ওরা ? ওরা হুকুম তামিলের ক্রীতদাস। আর আমাদের পাঁজরে ভাই হারানোর কান্না। ভাঙাগড়ার খেলায় কতক্ষণ টিকে থাকবে ওরা। বন্ধুরা…
আধো আধো আলোর ধোঁয়াটে অলৌকিক জমিতে কোত্থেকে যেন ছায়ার মতো এগুতে থাকল কারা। কারও হাতে ভেজা বালি, কারও ইস্পাতের কর্ণি, কারও বা ইটের চাঁই।
অবারিত আকাশের তলায় আবার বসে গেল একদল স্থপতি। আনাড়ি কিন্তু আন্তরিকতায় উষ্ণ অস্থির হাত।
লম্বা টিন শেডের বারান্দায় একটি খুঁটির কাছে বিহ্বল ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে সাবের সাহেব। আলমগির কাছে এসে আস্তে আস্তে বল্লো, ওরা রাজপথের রক্ত অগ্রাহ্য করে, মৃতদেহ গুম করে আমাদের অস্বীকার করতে চাইছে। আমরা তা দেবো না। তাই এই মৃত্যুকে আমরা অমর করে রাখব ঐ মিনার—শহিদ মিনার তৈরি করে।
বধ্যভূমি দেখতে এসে এ তিনি কি দেখছেন ? সাবের সাহেব খুঁটিটা দু’হাতে আঁকড়ে ধরলেন। রাত কত কে জানে ? তবু এই যুবকদের সঙ্গে এখানেই তিনি জেগে থাকবেন।
লেখক : সদ্য প্রয়াত কথাসাহিত্যিক
সচিত্রকরণ : রাজীব দত্ত