প্রচ্ছদ রচনা : হাসনাত আবদুল হাই―সৃজনশীল-মননশীল বহুমাত্রিক লেখক : হাসনাত আবদুল হাই : জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী

হাসনাত আবদুল হাই পেশায় আমলা ছিলেন, নেশায় বরাবর সাহিত্যিক। এ পরিচয়ের আরও কয়েকজনকে আমি চিনি বা চিনতাম, হাসনাত তাঁদের মধ্যে শুধু একজন নন, বিশিষ্ট। আমলা পরিবারে হাসনাত আবদুল হাই যতদূর উঠবার, উঠেছেন এবং আমার জানা মতে, ওই পরিবারে তিনি রীতিমতো সার্থক। সেটা আমার বিবেচনার বিষয় নয়। তাঁর সাহিত্যিক পরিচয় দেব, তারও যোগ্যতা আমার নেই। তিনি বিচিত্র বিষয়ে লিখেছেন এবং লেখক জীবনের শুরুতে ছোটগল্প, উপন্যাস ও ভ্রমণকাহিনিএই ত্রিবিধ উদ্যোগ আমি লক্ষ করেছি তাঁর মধ্যে। যখন তিনি এ কাজ করেছেন ও আমি সেই সূত্রে তাঁকে চিনেছি, সে আজ থেকে অনেক বছর আগের কথা।
হাসনাত আবদুল হাইয়ের সাহিত্যকর্মে যে বিষয়টি আমার কাছে বিশেষ আকর্ষণীয় ও উল্লেখযোগ্য মনে হয়েছে, সেটা সাহিত্যের বিভিন্ন আঙ্গিকে তাঁর অবাধ ও স্বতঃস্ফূর্ত বিচরণ। যে তিনটি আঙ্গিক দিয়ে শুরু করেছিলেনছোটগল্প, উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনি কোনোটিই তাঁকে নির্ধারিত গণ্ডিতে ধরে রাখতে পারেনি। এক সময় তিনি পরপর কয়েকটি বাস্তব জীবনভিত্তিক উপন্যাস রচনা করেন। কাজটি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ ছিল, কারণ, সুলতান, আরজ আলী মাতুব্বর, নভেরা, এঁদের কেউ দূর অতীতের মানুষ নন, একালের মানুষ। নভেরা ও সুলতান যাপন করেছেন শিল্পীসুলভ এক ব্যতিক্রমী জীবন। একজন উপন্যাস শিল্পীর জন্য এদের চরিত্র ও জীবন অত্যন্ত আকর্ষণীয়। অন্যদিকে আরজ আলী মাতুব্বরও এক ব্যতিক্রমী জীবনযাপন করে গেছেন। এদের জীবনের জানা-অজানা সংবাদ আহরণ করে, সেই খণ্ডগুলোকে একত্র করে একটা স¤পূর্ণ মানুষের প্রতিকৃতি গড়ার কাজটি, আমার ধারণায় অত্যন্ত যোগ্যতার সঙ্গেই করেছিলেন ছোটগল্প ও উপন্যাস রচনায় অভিজ্ঞতাস¤পন্ন হাসনাত আবদুল হাই। উপন্যাসে কখনও কখনও ঐতিহাসিক চরিত্র দেখা দিয়ে থাকে, যেমন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস-ত্রয়ীতে দেখা দিয়েছে। সেভাবে অনেকের মধ্যে একজন হিসেবে দেখা দেওয়া, আর উপন্যাসের মূল চরিত্র হিসেবে দেখা দেওয়ার মধ্যে তফাৎ আছে। প্রশ্ন হতে পারে, কেন এই তিনটি চরিত্রকেই বেছে নিয়েছেন হাসনাত আবদুল হাই ? এর উত্তর তিনি কীভাবে দেবেন, সেটা তিনিই জানেন। আমার কাছে যে উত্তরটা আছে, তা হল মানুষের মামুলি পরিচিত রূপের বাইরে যে মৌলিক বা স্বতন্ত্র রূপ, যে প্রথা-বিরুদ্ধ রূপ, তিনি বিশেষ আকর্ষণবোধ করেছেন সেই মৌলিকতার প্রতি, সেই স্বাতন্ত্র্যের প্রতি। আরজ আলী মাতুব্বর, নভেরা, সুলতানকেউ সামাজিক মানুষের চেনা কাঠামোয় ধরা দেন না। জীবনাচারণে তাঁরা নিজেদের পথ নিজেরা তৈরি করে নিয়েছেন। তাঁরা এক বিশেষ অর্থে সৃজনশীল, যেমন তাঁদের কর্মে, তেমনি তাঁদের জীবনাচরণে। এই তিনটি বাস্তব জীবন-ভিত্তিক উপন্যাস রচনায় হাসনাত তাঁর নিজের সৃজনধর্মিতার স্বাক্ষর রেখেছেন। তাঁর ব্যতিক্রমী আঙ্গিক ব্যবহার এই সব জীবনী উপন্যাসগুলোকে অনন্য করেছে। লেখার ভঙ্গিতে তিনি প্রচলিত প্রথার বিরুদ্ধে তো বটেই, একই শ্রেণির লেখায় নিজের পুনরাবৃত্তিতেও যাননি, এটা বেশ ¯পষ্ট। তিনটি জীবনী উপন্যাস রচনার আঙ্গিক ভিন্ন, যার জন্য অবশ্যই তাঁকে বিশেষভাবে চিন্তা করতে হয়েছে। সৃজনশীলতার মধ্যেও তিনি পরিকল্পনা প্রয়োগ করেছেন সুস্থির হয়ে, যা কথা-সাহিত্যিক হিসেবে তাঁকে একটা বিশেষ পরিচিতি দিয়েছে। কথা-সাহিত্যের পাশাপাশি তিনি ট্রাভেলগ বা ভ্রমণ সাহিত্যের দিকে ঝুঁকেছেন। পরিব্রাজক জীবনে যখন যে দেশে গিয়েছেন, যা কিছুর মুখোমুখি হয়েছেন, ট্যুরিস্ট-সুলভ দৃষ্টিতে নয়, অনুসন্ধিৎসু গবেষকের দৃষ্টিতে দেখেছেন, এখানেই তাঁর বৈশিষ্ট্য। এজন্য তাঁর ভ্রমণ শুধু ক্যামেরা হাতে বেরিয়ে পড়া নয়, রীতিমতো প্রস্তুতি নিয়ে, প্রশ্ন তৈরি করে, কৌতূহলের সঙ্গে সব দেখা-শোনা। তাঁর স¤পর্কে এ কথা নিশ্চয়তার সঙ্গেই বলতে পারি, আমাদের ভ্রমণ-সাহিত্যে তিনি এক নতুন মাত্রা যোগ করেছেন, এই মাত্রাকে তিনি গভীরতা দিয়েছেন। যতদূর মনে পড়ে, একটি বই উৎসর্গ করার সময় তাঁকে আমি ‘ট্রাভেলগের রাজা’ বলেছিলাম। মনে হয় খুব অত্যুক্তি নেই সেই অভিধায়। শুধু সংখ্যার বিচারে নয়, গুণগত উৎকর্ষেও হাসনাতের ভ্রমণকাহিনি বাংলা সাহিত্যে উল্লেখযোগ্যভাবে মূল্যবান সংযোজন।

মানুষ হাসনাত সরব সামাজিকতা থেকে দূরে, একটু নিভৃতচারী। স্বভাবত স্বল্পবাক, তবে যখন কিছু বলেন, খুব মনোযোগের দাবি রাখেন, কারণ কথা বলার জন্য তিনি কথা বলেন না, কিছু বক্তব্য আছে বলেই কথা বলেন। মননশীলতা তাঁর মজ্জাগত, বিভিন্ন ও বিচিত্র বিষয়ে তাঁর আগ্রহ প্রায় সীমাহীন যার পরিচয় তিনি রেখেছেন তাঁর জাপানি কাব্যরীতি হাইকু চর্চায়। শিল্প-সাহিত্য- সংস্কৃতির অঙ্গনে তিনি বিচরণ করেন একাকী পথিকের মতো, প্রায় দৃষ্টির অগোচরে। নিজের উপস্থিতি প্রায় বুঝতেই দেন না। এভাবেই তাঁর সৌজন্য ও শালীনতামণ্ডিত বিচরণ, আমার নজরে পড়েছে। তাঁর সঙ্গে পরিচয় আমার অনেক দিনের, তবু মনে হয় তাঁকে জানা স¤পূর্ণ হয়নি।