আলোচনা : কবিতা―হাসনাত আবদুল হাই : বাংলা হাইকু : আবুল হোসেন

হাসনাত আবদুল হাইয়ের কিওতো হাইকু বইটি পেয়ে আমি একটু অবাকই হয়েছি। তিনি আমাদের একজন প্রধান লেখক। তাঁর গল্প, উপন্যাস, জার্নাল, ভ্রমণকাহিনিএমনকি প্রবন্ধও অনেকদিন থেকে দেখে আসছি। তাঁর জার্নাল এবং ভ্রমণকাহিনি আমার বেশি ভালো লাগে। বাংলায় যাঁরা ভ্রমণকাহিনি লিখেছেন তাঁদের মধ্যে আমি তাঁকে খুব উঁচুতে স্থান দিই। তরুণ বয়সে পথে প্রবাসে, মহাপ্রস্থানের পথে, সত্যি ভ্রমণকাহিনি, দেশে-বিদেশে পড়ে যে আনন্দ হয়েছিল, আবদুল হাইয়ের ভ্রমণকাহিনিতে আমি সেই স্বাদ পাই। তিনি অবশ্য অন্য কারও মতো লেখেন না। তাঁর ভ্রমণকাহিনি পড়ার সময় মনে হয়, আপনিও তাঁর সঙ্গে ঘুরে-ফিরে বেড়াচ্ছেন, চোখ-কান খুলে রেখে যা দেখার শোনার দেখছেন শুনছেন আর উপভোগ করছেন সমস্ত ব্যাপারটি।
সে কথা এখন যাক। যে-বইটির কথা বলতে গিয়ে এইসব কথা উঠে পড়ল, সেই প্রসঙ্গে ফিরে যাই। কিওতো হাইকু কবিতার বই। হাই কবিতা লিখেছেন, এটি সত্যিই খবর। কেননা, এইদিকে তিনি আর আগে কখনও পা বাড়াননি। তবু কবিতায় যখন হাত দিলেন, বাংলা কবিতা লিখলেন অন্য এক দেশের কবিতার ধাঁচে। বইয়ের নাম থেকেই বোঝা যায়, সেই দেশটি জাপান। পৃষ্ঠা ওলটালেই চোখে পড়ে এক বিশেষ ধরনের কবিতা, যাকে জাপানে বলে হাইকু। যাঁরা দেশ-বিদেশের কবিতার খোঁজ-খবর রাখেন, তাঁরা জানেন হাইকু জাপানি ভাষার প্রাচীনতম কাব্যরূপ। এই ধরনের কবিতার আরও একটি নাম ছিল হক্কু। কিন্তু হক্কু আর হাইকু বোধহয় পুরোপুরি এক রকম নয়। হাইকু লিখতে যেসব শর্ত মেনে চলতে হয়, যেমন কবিতাটি তিন লাইন এবং সতেরো মাত্রার হতে হবে আর এই সতেরো মাত্রা আবার তিন লাইনে ভাগ হবে, ৫-৭-৫ মাত্রা হিসেবে। এ তো গেল রচনারীতির কথা, অর্থাৎ বাইরের ব্যাপার। আসল শর্তটি ভেতরের। কোনো না কোনোভাবে কবিতাটির বিষয়ের সঙ্গে প্রকৃতির একটি যোগসূত্র থাকবে। হক্কুতে এতসব নিয়মকানুন মেনে চলতে হয় না। হাইকুর শিল্প ও শৈলী আয়ত্ত করা কী কঠিন, তা সহজেই বোঝা যায়। আবদুল হাই হয়তো হঠাৎ শখ করে শুরু করেছিলেন, কিন্তু কাজটি সত্যি দুঃসাহসিক। বাংলায় হক্কু বা হাইকু কে প্রথম তরজমা করেছিলেন বা লিখেছিলেন, আমার জানা নেই। হাইকু প্রথম পড়ি রবীন্দ্রনাথের কোনো একটি লেখায়। একটি বিখ্যাত হাইকুর অনুবাদ। তরজমার লাইনগুলো ঠিক ঠিক মনে পড়ে না। কবিতাটি এই রকম ছিল : ‘পচাপুকুর/ব্যাঙের লাফ/ঝপাত।’ তবে বাংলায় একটি আস্ত হাইকু বা হক্কু কবিতার বই লেখার কৃতিত্ব সুরেন্দ্রনাথ মৈত্রের। তাঁর বইটির নাম জাপানি ঝিনুক। তিনি বইটি আমাকে উৎসর্গ করেছিলেন। বইটির প্রকাশক বিশ্বভারতী। বের হয়েছিল বোধ হয় ১৯৪০ সালে। আমার কপিটি হারিয়ে গেছে। এখন মনেও করতে পারছি না বইটিতে হাইকুর কোনো তরজমা ছিল কিনা। অথবা সব কবিতাই সুরেনবাবুর নিজের লেখা। তাঁর একটি হাইকু (অথবা হক্কু) ৬৫ বছর পরেও ভুলিনি। ‘বাসা ভেঙে গেছে/যাক না/এ পাখির আছে বাসনা।’ অপূর্ব কবিতা। তবে জাপানিরা একে হাইকু বলে হয়তো স্বীকার করবে না। শুধু লাইন ও মাত্রার অমিলের জন্যেই নয়, মোদ্দাকথা, প্রকৃতির, বিশেষ করে কোনো ঋতুর স্পর্শ নেই কবিতাটিতে। সেই হিসেবে জাপানি ঝিনুককেও হয়তো হাইকুর মর্যাদা দেওয়া যাবে না।
আসলে এক ভাষার বিশেষ রীতি অন্য ভাষায় হুবহু রূপান্তর প্রায় অসম্ভব। গত শতাব্দীর বিশ-তিরিশের দশকে বাংলায় ফারসি রুবাইয়াতের কিছু বীজ (অনুবাদে এবং নিজের লেখায়) ছড়ানো হয়েছিল। কিছু চারাও হয়। এদেশের আবহাওয়ায় সেগুলো আর বাড়ল না। তুলনায়, ইতালীয়-ইংরেজি সনেট বরং বাংলায় বহুদিন টিকেছিল। এখন বিলুপ্তপ্রায়, তবে নির্বংশ হয়নি।
জাপানে এখনও হাইকুর বাজার চলতি। অন্য ভাষাতেও হাইকু লেখা হচ্ছে। নর্টনের আধুনিক ইংরেজি কবিতা-সংকলনের সাম্প্রতিকতম সংস্করণেও কয়েকটি হাইকু জায়গা পেয়েছে। আসলে কিন্তু সেগুলো তিন লাইনের ছোটো কবিতা।
হাসনাত ইংরেজিতে হাইকু লিখে বাংলায় অনুবাদ করেছেন। তাঁর কিছু ইংরেজি হাইকু জাপানের দৈনিক পত্রিকা মাইনিচি ডেইলিতে অন্যান্য বিদেশিদের সঙ্গে ছাপা হয়েছে। বোধ করি তাতেই তিনি উৎসাহিত হয়েছেন এবং হাইকুর চর্চা করেছেন। ইংরেজিতে লেখা তাঁর হাইকু জাপানি ভাষায় অনুবাদ করেছেন কোকো কাতো নামে এক জাপানি হাইকু কবি। তিনটি ভাষায় লেখা হাইকু কবিতার বই খুব সম্ভবত বেশি নেই। একটি পুরো হাইকুর বই লিখে হাসনাত আবদুল হাই তার বীজ বুনলেও, আমাদের এই অতিকথনের কবিতার জমিতে স্বল্পবাক হাইকুর চারা গজাবে মনে হয় না। শুধু জমিই নয়, যে আবহাওয়ায় হাইকু জন্মায় এবং বাড়ে, এদেশে তা দুর্লভ। হাসনাত আবদুল হাইয়ের এ এক নতুন ভ্রমণ। অচেনা পথে তাঁর চকিত অনুভূতি ও হঠাৎ ছবির হাতে হাত ধরে চলায় আমি সানন্দে তাঁর সঙ্গী হতে চেয়েছি এবং দ্বিধা না করেই কবুল করি, সুফল পেয়েছি। পাঠক আমার মুখে ঝাল না খেয়ে নিজেরাই চেখে দেখবেনএই আশা করে আমি কোনো উদ্ধৃতি দিলাম না। আশ্বাস দিতে পারি, তাঁরা ঠকবেন না।