প্রবন্ধ : সত্তরের প্রজন্মের এগারো জন কবি : সরকার মাসুদ

বাংলাদেশের সত্তরের প্রজন্মের অগ্রগণ্য কবিরা আজ মূলধারার অন্তর্ভুক্ত। প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে তারা কাব্যচর্চা আরম্ভ করেছিলেন। তাদের ভেতর কয়েকজন প্রয়াত, কেউ কেউ লেখা ছেড়ে দিয়েছেন। এখনও যারা সৃষ্টিশীল আছেন তারা সংখ্যায় অল্প এবং আজও নিয়মিত কবিতা প্রকাশিত হচ্ছে এমন কবির সংখ্যা গুটিকয়েক।
সত্তরের প্রজন্মের কবিতা সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্যই বেশি শোনা যায়। এটা কূপমন্ডূকতাগ্রস্ত নিন্দুকদের কাণ্ড। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যারা ঢালাওভাবে নিন্দা করে চলেছেন তারা কেউই এই প্রজন্মের কবিতা নিবিষ্টচিত্তে পাঠ করেননি। ফলে সত্তরের প্রধান এবং গৌণ কবিদেরও সাহিত্যকৃতি তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। কবিতা অনেক রকমের। ভালো কবিতাও অনেক ধরনের। অসফল কবিরা কদাচিৎ তা বোঝেন এবং এরাই চিরকাল অন্য কবিদের দোষ-ত্রুটি অনুসন্ধান করে সান্ত¦না পান।
ইতোপূর্বে দেশি-বিদেশি সাহিত্যের আলোচনা প্রসঙ্গে আমি সত্তরের প্রজন্মের ৫/৬ জন কবির কথা বলেছি। এ বছরের গোড়ার দিকে দৈনিক আমাদের সময় এ প্রকাশিত ‘আবিদ আজাদ ও সত্তরের প্রজন্ম’ শিরোনামের প্রবন্ধেও ৬/৭ জন কবিকে আলোচনায় এনেছি। কয়েক মাস আগে আমি ‘সত্তরের প্রজন্মের কবিতা’ নামে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছি যা এখনও অপ্রকাশিত। ওই রচনাটিতে কমপক্ষে ৩৫ জন কবি আলোচিত হয়েছেন। বর্তমান প্রবন্ধটি ওই লেখারই সংক্ষিপ্ত রূপ।
সমস্ত ত্রুটি-বিচ্যুতি ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আবিদ আজাদ সত্তরের প্রজন্মের উজ্জ্বলতম কবি-ব্যক্তিত্ব। তার কবিতার প্রধান শক্তি অসাধারণ কবিকল্পনা ও বর্ণাঢ্য চিত্রকল্প। তার প্রধান দুর্বলতা বেশি কথা বলার প্রবণতা। আবিদ আজাদের ভালো কবিতার সংখ্যা অন্যদের তুলনায় বেশি হবে। এর অর্থ এই নয় যে, অন্যান্য কবিদের প্রত্যেকের উৎকৃষ্ট কবিতা মোটে আট/দশটি বা তারও কম। আবিদ ছাড়াও দশ/বারো কবি আছেন যারা সৃজনশীলতার বিচিত্র বর্ণবিভা ছড়াতে সক্ষম হয়েছেন। কল্পনা-ভাবনায় নিজত্ব তারাও কম-বেশি দেখিয়েছেন। এবং খুঁটিয়ে পড়লে দেখা যায় গৌণ কবিদেরও অল্প কিছু কবিতা নিজ-নিজ বৈশিষ্ট্যে আলাদা, শুধু অন্যদের থেকে নয়, তাদের নিজেদেরও অসংখ্য দুর্বল কবিতা থেকে।
আবিদ আজাদ ছাড়া বাকি কবিদের ভেতর যারা এগিয়ে আছেন বলে মনে করি সেরকম এগারো জন কবিকে নিয়ে আজকের এই রচনা। শুরু করা যাক ইকবাল আজিজকে দিয়ে। আনুমানিক ৩৭ বছর বয়সে প্রকাশিত হয়েছিল ইকবালের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রতীকের হাত ধরে অনেক প্রতীক’ (১৯৮৭)। প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে জানি, সে বছর একুশের বইমেলায় ওই গ্রন্থ বেশ বিক্রি হয়েছিল, বিক্রেতাদের ভাষায় ‘পাঠ্যপুস্তকের মতো’। অনেকখানি প্রস্তুতি নিয়ে অনেক দেরিতে বই প্রকাশের কারণে ইকবাল প্রথম গ্রন্থেই বেশ খানিকটা কাব্যসামর্থ্য দেখাতে সক্ষম হয়েছিলেন। পরবর্তী বইগুলোতেও তা কমবেশি অক্ষুণ্ন ছিল। ইকবালের কবিতা কখনও প্রগলভ, কখনও শব্দসংযমী। তার আবেগী উৎসারনের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন, ‘এ কোন জীবন আমি বেছে নিলাম প্রভু’ শিরোনামের কবিতাটি। এ রকম কবিতা তার অনেকগুলো আছে। অন্যদিকে ‘তুমি কি পাগল’, ‘কেরানীর মেয়ে’, ‘মৃত্যুপতঙ্গ’ প্রভৃতি লেখায় তিনি আশ্চর্য সংযম ও লিপিকুশলতার স্বাক্ষর রাখতে পেরেছিলেন। যথাসম্ভব অল্প কথার মাধ্যমে ভাব-নিবিড়তা ফুটে উঠেছে এসব কবিতায়। এ জাতীয় রচনাগুলোই তার শ্রেষ্ঠ কবিতা। ইকবাল আজিজ একইসঙ্গে ছন্দে বাধা ও ফ্রি-ভার্সের স্বাধীনতা ভোগকারী― দুরকম কাব্যেরই চর্চা করেছেন। ইকবাল আপাদমস্তক রোমান্টিক কবি। রোমান্টিকতার নানা অনুষঙ্গের পাশাপাশি মধ্যবিত্তের বিচিত্র প্রবণতা ও সঙ্কটকেও যথাসাধ্য তুলে এনেছেন।
সত্তরের প্রজন্মের প্রধান কবিদের একজন কামাল চৌধুরী। কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশের পরবর্তী পনের/বিশ বছরের ভেতর তিনি তেমন মুনশিআনার পরিচয় দিতে পারেননি। নব্বই-এর দশকে তাঁর কবিতা লক্ষণীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়ে যায়। প্রথম কাব্যগ্রন্থ মিছিলের সমান বয়সী এবং তার পরের আরও একাধিক বইয়ে তাঁর কবিতা ছিল অনেকটাই সরাসরি, কিছুটা উচ্চকণ্ঠী। বোধ করি সেজন্য ওই সময়টাও দায়ী ছিল। সদ্য স্বাধীন একটা দেশের আশা-আকাক্সক্ষা, স্বপ্ন, টানাপড়েন প্রভৃতিকে ধারণ করতে গিয়ে রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, জাহাঙ্গীর ফিরোজ, মোহন রায়হান প্রমুখের মতো কামাল চৌধুরীও সহজ ও চড়াসুরের পথ ধরলেন। কিন্তু আধুনিক কবিতা তো আড়ালপ্রিয় শিল্প। আমার ধারণা কামালের ওই ভুল ভেঙেছে উত্তরকালে। ফলে তাঁর কবিতা আর আগের মতো থাকল না। লক্ষ করেছি, কবি কামাল চৌধুরীর পরিণত বয়সের কবিতায় ভাবাবেগ থিতু হয়েছে। শব্দ ও বাক্য প্রয়োগে সংযম এসেছে। শব্দের সঠিক প্রয়োগের ব্যাপারেও তিনি অনেকখানি সচেতন এখন। খুব সম্প্রতি ‘প্রতিবিম্ব’ নামের একটা কবিতা পড়লাম। মাত্র নয়টি পঙ্ক্তি ব্যবহার করেছেন তিনি। ছোট্ট গভীর কবিতা। একটিও অপ্রয়োজনীয় শব্দ নেই। প্রথম চার লাইন এ রকম : ‘ভেঙে ফেলার পর খুঁজে দেখব আবার তোমাকে/দরোজার পাশে লেগে থাকা চুরমার অশ্রু কণায়/যেখানে দালান উঠছে তার নিচে সিঁড়ি ভাঙছে কেউ/তোমার হাঁটার শব্দে খুঁজে ফিরবো ভাঙা কাচ!’ এই কবিতারই অষ্টম পঙ্ক্তি হচ্ছে ‘গোলকধাঁধার তীরে প্রতিবিম্বের আলো ও চিৎকার!’ যা লেখাটিকে গভীর তাৎপর্যে উন্নীত করেছে। সুদীর্ঘকালের অনবচ্ছিন্ন চর্চা ও উত্তরপর্যায়ের সচেতনতা কবি কামাল চৌধুরীকে এ রকম জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে। তবে এও ঠিক, ভাবের এ জাতীয় ঘনবদ্ধতা ও প্রতীকের এমন সার্থক প্রয়োগ তাঁর খুব বেশি কবিতায় নেই।
মৃগয়ায় যুদ্ধের ঘোড়া কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে নাসিমা সুলতানা আবির্ভূত হয়েছিলেন দীপ্ত ভঙ্গিতে। তার কবিতায় আমরা লক্ষ করেছি মেধাসচ্ছলতা ও স্বতস্ফূূূর্ত কবিকল্পনা। নানারকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়া মানুষের ভেতর-ছবি, বিপদাপন্ন, বিষণ্ন কিংবা আনন্দিত মুহূর্তের চমৎকার উদ্ভাস পাওয়া যায় তার কাব্যে। খুব বেশি বছর কাব্যচর্চা করতে পারেননি নাসিমা। পঞ্চাশপূর্তির অনেক আগেই মৃত্যু তাকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। কাঁচা আবেগ, অতিকথন এবং নারীসুলভ কমনীয়তা থেকে তার কবিতাকে সযত্নে দূরে রাখতে পেরেছিলেন নাসিমা সুলতানা। তার কাব্যের প্রকাশরীতি ধারণ করেছে এক ধরনের ঋজুতা। তিনি এমনকি যখন প্রেমের কিংবা অপ্রেমের কবিতা লিখেছেন তখনও বজায় থেকেছে শব্দসংযম ও সুরুচি নিয়ন্ত্রিত গাম্ভীর্য।
ফারুক মাহমুদ কাব্যের বিশুদ্ধতায় বিশ্বাসী। ছন্দ ও ছন্দসম্মত শব্দ বা শব্দবন্ধ প্রয়োগে গোড়া থেকেই সতর্ক এই কবি। অচরিতার্থ প্রেম, নিঃসঙ্গতা, মনের বিহ্বল দশা, জীবনের নানা রকমের সংকট তার কবিতায় ঘুরে ফিরে আসে। লক্ষণীয়, তার প্রজন্মের অধিকাংশ কবিই যেখানে কথার ফোয়ারা তৈরি করতে অভ্যস্ত, ফারুক মাহমুদ সেখানে প্রশংসনীয় সংযম প্রদর্শনে সক্ষম। তার অপেক্ষাকৃত ছোট কবিতাগুলোতেই তিনি বেশি সফল। দীর্ঘ কবিতাসমূহে লেখক তেমন দক্ষতা দেখাতে পারেননি। কিছুকাল আগে প্রকাশিত কাব্য আগুনে আপত্তি নেই তেও প্রাগুক্ত সাফল্য-ব্যর্থতা বিদ্যমান। সবকিছু বিবেচনায় রাখলে মনে হয়, ফারুক তার কাব্যসামর্থ্যরে উন্নত স্তরে আছেন এখন। তা সত্ত্বেও আমার ধারণা, ছন্দের শাসন থেকে অনেকখানি মুক্ত হতে পারলে তার কবি-ইমেজটি আরও বলিষ্ঠ হতো। ইকবাল আজিজের মতো তারও বেশ কিছু কবিতায় স্বতঃস্ফূর্ত দার্শনিকতা চোখে পড়ে।
সত্তরের কবিতায় এক বহুল উচ্চারিত নাম শিহাব সরকার। ছিদ্রান্বেষীদের কেউ কেউ বলেন, তার কবিতা অসম্পূর্ণতা দোষে দুষ্ট। তারা টোটালিটির দোহাই দেন। আমার মনে হয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী আধুনিক কবিতা সম্পর্কে ওই নিন্দুকদের ধারণা খুবই অপ্রতুল। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রচিত শিহাবের কিছু কবিতা পড়ে যদি কারও মনে হয়, লেখাটা এভাবে শেষ হলো কেন বা লেখক আরও কিছু বলতে পারতেন সেটা পাঠকের নিজস্ব মত। আমি বলব, ওই-যে এমন একটা জায়গায় এসে লেখক কবিতাকে থামিয়ে দিলেন; এগুতে পারতেন আরেকটু কিন্তু আর এগোলেন না, এটাও তার একটা স্টাইল। কে বলেছে কবিতাকে সর্বদাই নিখুঁতভাবে শেষ হতে হবে? হ্যাঁ, নিখুঁতভাবে, সুন্দরভাবে বা পাঠকের প্রত্যাশিত উপায়ে শেষ হওয়া কবিতাও তার অনেক আছে। সন্দেহ নেই শিহাব সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি আধুনিক। তিনি গভীরাশ্রয়ী বিষয়- আশয়কে কবিতার উপজীব্য করে থাকেন। বিষয়বৈচিত্র্যও নিশ্চয় চোখে পড়বে। যারা তোমার ক্ষত্রিয়, কলিযুগ ও অন্যান্য কবিতা নামের বই দুটো পড়েছেন, আশা করি মানবেন যে, নিজের একটা ভাবজগত নিজের রুচি ও জ্ঞানসম্মত উপায়ে গড়ে নেওয়ার জন্য তিনি সদা তৎপর। প্রথম কাব্যগ্রন্থ লাল যৌবন দিন এর মাধ্যমে বহুকাল আগেই অগ্রজ কবি ও শিল্পসন্ধানী পাঠকের আস্থা অর্জন করেছিলেন শিহাব। পরবর্তী চল্লিশ বছরের নিরবচ্ছিন্ন চর্চায় তার ওই প্রাগুক্ত ভাবনাজগত একটা শক্ত ভিত পেয়েছে মনে হয়।

প্রতিবিশ্বের মমি (১৯৮৫) কাব্যগ্রন্থটির মাধ্যমে আবিদ আনোয়ার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছিলেন ওই সময়। তার সাত বছর পর ১৯৯২ এ প্রকাশিত হয় মরা জোছনায় মধুচন্দ্রিমা। আবিদ প্রথম থেকেই সচেতন কবি এবং সতর্কভাবেই সিরিয়াস বিষয়-আশয়কে গ্রহণ করেছেন। ছন্দানুগ এই কবি ফ্রি-ভার্সেও কবিতা লিখেছেন। যেসব লেখায় খুব হিসেব করে শব্দ বা শব্দবন্ধ ব্যবহার করেননি সেগুলোতেই তার ক্ষমতা বেশি টের পাওয়া যায়। ১৯৯২ এর পর আবিদ আনোয়ারের আরও কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে। পরের দিকের কবিতায় আগের মতোই আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকলেও লেখার স্টাইলে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন নেই। অবশ্য বিষয়ের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য আছে। তার কবিকল্পনায় অভিনবত্বও লক্ষণীয়― ‘ভরবিকেলে আমরা দোঁহে মগ্ন চখাচখি/পার্কে বসে ভালোবাসায় দিচ্ছি জোড়াতালি,/ সোনালী রোদ হাসছে যেন/কেউ দিয়েছে দিগন্তকে দারুণ কাতুকুতু’ (একটি ঝরাপাতার দর্প)। তার সেরা কবিতাসমূহ ধারণ করে আছে নানারকম অভিজ্ঞতার নির্যাস। মানুষের ভেতরের মানুষ উঠে এসেছে অব্যর্থ প্রতীকী ভাষায় : ‘প্রায়শ রাস্তার মোড়ে দেখা হলে জনৈক, গণ্ডার/‘কেমন আছেন’ বলে হাসিমুখে কুশল শুধায়।’ (বসবাস)
নিভৃতচারী কবি জরিনা আক্তারকে কাব্যরসিক মহলে পরিচিত করে তোলেন কবি-গল্পকার, সাহিত্যপত্র সম্পাদক আনওয়ার আহমেদ। জরিনার প্রথম কাব্যগ্রন্থ কালো ময়ূরের ডাক এর প্রকাশকও আনওয়ার আহমেদ। তার রূপম প্রকাশনী থেকে বইটি বের হয় ১৯৮৬ সালে। এমন নয় যে এই প্রকাশনা সুধী সমাজে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিল। তবে গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই পাঠকসমাজ বুঝতে পারে, একজন জাত কবির আবির্ভাব ঘটেছে। ইনি খ্যাতিলাভের জন্য দৌড়ঝাঁপ করেননি কখনওই। নীরবে, আপন প্রতিভার উপযোগী বিষয়-আশয় নিয়ে কাজ করেছেন আন্তরিকভাবে। খানিকটা সুফলও পেয়েছেন। এই কবি এখনও লেখায় সক্রিয় তবে খুবই অনিয়মিতভাবে। তার পরের দিকের তিনটি কাব্যগ্রন্থের নাম যথাক্রমে এই ছুরিই আরশি (১৯৮৯), সেগুন, মেহগনি ও অন্যান্য কবিতা (১৯৯৩) এবং জলের আরশিতে নির্নিমেষ চেয়ে থাকা একটি হিজল গাছ।’ শেষোক্ত বই দুটি লেখকের পরিপক্ব কল্পনাভাবনার ফসল বলেই মনে হয়। জরিনা আক্তারের একটি অসাধারণ কবিতার নাম ‘মিমার জন্য একটি কবিতা’। নতুন জামা না পেয়ে আত্মহননকারী একটি শিশুর মনোবেদনা ও অভিমানকে তিনি চমৎকার সংবেদনশীলতায় ফুটিয়ে তুলেছেন এখানে―‘তবু এই শীতার্ত রাতে/আমার সমস্ত উত্তাপ দিয়ে জড়িয়ে/নিদ্রাহীন রাত্রে স্বপ্ন-সুষমা দিয়ে/আর ভোরের সংবাদপত্র থেকে খুঁটে খুঁটে তুলে আনা রাশি রাশি/বেদনার মুক্তো দিয়ে/ খুব যত্ন করে তৈরি হবে একটি জামা’। অনেক কিছু নিয়ে লিখেছেন তিনি। গ্রামীণ নিসর্গ থেকে নাগরিক নির্বেদ, ব্যক্তিক বিপন্নতা থেকে সামষ্টিক সংকট―বহুকিছুই ধরা দিয়েছে তার সহমর্মী, সংবেদী কলমে।
আমাদের তরুণ বয়সে যাদের কবিতা নিয়মিত পত্রস্থ হতে দেখেছি তাদেরই একজন নাসির আহমেদ। এখনও মনে পড়ে তার ‘আকুলতা শুভ্রতার জন্য’ ‘পাথরগুলো, দুঃখগুলো’, ‘বীথির প্রতীকে প্রিয় নাম’ এসব কবিতা। এগুলো তার প্রথম পর্যায়ের কাব্যচেষ্টা। সে হিসেবে, এখন মনে হয়, ওইসব রচনা একেবারে মন্দ ছিল না। ‘পাথরগুলো, দুঃখগুলো’ ধারণ করে আছে তরুণ কবিসুলভ ভাবাবেগ ও উচ্চাকাক্সক্ষা। উত্তরকালে স্বাভাবিকভাবেই নাসিরের লেখায় বিবর্তন ঘটেছে; বিচিত্র অভিজ্ঞতা যুক্ত হয়েছে কবিতায়। ভালো-মন্দের মাত্রার তারতম্য নিয়েই উপস্থিত হয়েছে অসংখ্য রচনা। তিনি যেমন একদিকে ছন্দের নিপুণ নিগড়ে বেঁধেছেন শব্দ ও বাক্য, অন্যদিকে আবার অনেক কবিতায় বেশ স্বাধীনতাও নিয়েছেন। তার কবিত্ব নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই; কিন্তু আমার সবসময়ই মনে হয়েছে, কবিতার শরীরে বাক্যবিস্তার কিছুটা কম করতে পারলে আরও ভালো হতো। তুলনামূলক বিচারে প্রেমের কবিতায়ই নাসির বেশি সফল। ‘বৃক্ষমঙ্গল’ সিরিজে তার জীবনব্যাপী সাধনার স্বাক্ষর স্পষ্ট। এই কবিতাসমূহ তুলে ধরেছে লেখকের প্রাজ্ঞ উপলব্ধি। কবি এখানে অল্প কথার মাধ্যমে অনেক কিছু বলতে পেরেছেন।
সত্তর-প্রজন্মের আরেক কবি ময়ূখ চৌধুরী। বিষয়বস্তু নির্বাচনের ক্ষেত্রে তিনি সতর্ক ও বহুমুখী। একটা অন্তর্মুখী মৃদু উচ্চারণভঙ্গি তাঁর কবিতাকে বিশিষ্টতা দিয়েছে। কয়েকটি দৃষ্টান্ত:
(ক) তোমার বিছানা জুড়ে/ অসহ্য নরম আর দীর্ঘ কালো রাত/ ঘুমহীন অজগর/ ঝিনুকের মতো শাদা ঘুমের বড়িরা নড়েচড়ে। (পরিপ্রেক্ষিত; ধনধন্য, ধনধান্য)
(খ) ট্রেনের চাকায় গোল কবিতা, শব্দপোকার গানে/ কান পেতেছো জাল পেতেছো বুকেরই মাঝখানে। / কোথায় তোমায় রাখি! (শব্দের রানি ও প্রজা)
(গ) কোলকাতার ম্যাচবাক্সে কাঠির মতন লোকজন,/ তাদের কেউ কি জানে―/ কোন বাড়িটার ছাদে হাস্নুহেনা কাঁদে/ প্রতিপক্ষ চাঁদের অসুখে?
‘এই কবির কবিতাগুলো রোমান্টিকতার সুর মেশানো। এই প্রবণতা অনেক সময় গ্রাস করে ফেলে তার কবিতাকে। কিন্তু ভাবাবেগ যেখানে নিয়ন্ত্রিত এবং বলবার বস্তু যথাসম্ভব যোগ্য ভাষায় পরিবেশিত, সেখানে ফলেছে শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলো। দেখা যাচ্ছে, ব্যতিক্রমী বিষয়কেও তিনি সাধ্যমতো কবিতা করে তুলেছেন। তেমনই একটি রচনা হচ্ছে: ‘ইস্পাতে তৈরি দুই পঙ্ক্তির কবিতা।’ ময়ুখ চৌধুরীর খুব বেশি কাব্যগ্রন্থ নেই। কালো বরফের প্রতিবেশী ও তোমার জানালায় আমি জেগে আছি চন্দ্রমল্লিকা বই দুটোতেই তিনি সর্বোচ্চ ক্ষমতা দেখিয়েছেন।
মাহবুব বারী তার হ্যাংগার (১৯৮৫) কাব্যগ্রন্থটির মাধ্যমে আলোচনায় এসেছিলেন। ওই সময় কবিতার বইয়ের ওরকম নামকরণ একটু নতুন স্বাদ দিয়েছিল বৈকি। হ্যাংগার একজন তরুণ কবির বেড়ে ওঠার সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হয়েছিল। ছ’বছর পর দ্বিতীয় গ্রন্থ ঈশ্বরের ছবির উপর (১৯৯১) যখন বেরুলো, আমরা পেলাম অভিজ্ঞতাঋদ্ধ ও বেশ পরিণত এক কবিকে। তারও ছ’বছর পর প্রকাশিত হয় অধরা। প্রকৃত কবিতাকে ধরতে পারা সত্যিই খুব কঠিন বা একজন কবি যা লিখতে চান তা সারাজীবন অধরাই থেকে যায়, এমন বোধ থেকেই কি কাব্যগ্রন্থের এমন নামকরণ? এক দশকের বেশি সময় ধরে লক্ষ করছি, মাহবুব বারীর কবিতায় বেশ পরিবর্তন এসেছে। আগের সেই ভাবোচ্ছাস ও অতিভাষিতা একদমই নেই। তার জায়গায় দেখতে পাচ্ছি অভিজ্ঞতাঋদ্ধ গাঢ় উচ্চারণ, গূঢ় সংকেত। অতি অল্প কথায় জীবনোপলব্ধির সারাংশ ব্যক্ত হচ্ছে। কখনও কখনও প্রাচীন ঋষিদের মতো জ্ঞানগর্ভ কথা বলছেন তিনি, অবশ্যই কবিতার মায়া মিশিয়ে।
সৈয়দ হায়দারের কোনো সুখবর নেই (১৯৯৩) পাঠককে দিতে পারেনি কোনো সুখবর। পরে তার আরও এগারটি কাব্যগ্রন্থ বেরিয়েছে। গোড়ার দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করতে না পারলেও চল্লিশোত্তর বয়সে তার কবিতা মোটামুটি গ্রহণযোগ্যতা পায়। উত্তরবঙ্গ (১৯৯৫), বয়স দিচ্ছে তাড়া (১৯৯৬), আগদুয়ারী (১৯৯৮) প্রভৃতি গ্রন্থের কিছু কিছু কবিতায় তার সামর্থ্যের সবটুকু প্রকাশ ঘটেছে। রোমান্টিক এই কবির কিছু কিছু উচ্চারণ ব্যতিক্রমী। যেমন ‘যেদিন বুড়ো বয়স হবে সেদিন আমি তোমার হবো বলেছিলাম।’ (গাঁয়ের মেয়ে), ‘মনের কোথাও কি বেলুনফাটা টুকরো রাবার পড়ে আছে? (কণ্ঠস্বরে এক নদীচর), ‘ঘুম এলো না, সারারাত রাতের কাছে বলি: তুমি পূর্ণিমা না একাদশী? (একাদশী)। হায়দারের কবিতায় নদী, চাঁদ ও বিভিন্ন ঋতুর পৌনপুনিক উল্লেখ দেখা যায়। তবে দেখার ধরনে ভিন্নতা আছে। তিনি বলেছেন যে ‘নদী জীবনের কথা বলে না কাউকে’ অথচ আমরা জানি নদী হচ্ছে জীবনের প্রতীক। ‘নদী ছাড়া’ কবিতায় তিনি বলেছেন, ‘নদী হলে মড়া তাকে বয়ে নিয়ে বেড়াতেই হবে।’ ‘পায়ে মাটি, মাথায় পল্লব’ কবিতায় শীত প্রসঙ্গে কবির উক্তি : ‘ঝরাপাতার নূপুর বাঁধা এ ঋতুর পা’য়।’ ষোল থেকে বিশ/বাইশ পঙক্তির ভেতর শেষ হওয়া কবিতাগুলোতেই (সর্বত্র নয়) তার কবিত্ব সবচেয়ে ভালোভাবে ফুটে উঠেছে।
সত্তরের প্রজন্মের প্রধান কবিরাও, তাদের কবিকৃতি মনে রেখেই বলছি, আধুনিক সাহিত্যের ধ্যান-ধারণা ও কলাকৌশল ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করতে পারেননি। প্রতিভা নিয়ে জন্মেছিলেন অনেকেই। কিন্তু সেই প্রতিভাকে যথার্থভাবে লালন করতে পারেননি তারা। নিজেদের সৃষ্টিশীলতাকে এগিয়ে নেবার জন্য বিস্তৃত পড়াশোনাসহ আরও যা-যা প্রয়োজন সেসবের ঘাটতি ছিল এই কবিদের ভেতর। ফলে তাদের রচিত শিল্পতরুসমূহ যাবতীয় সম্ভাবনা নিয়েও শেষ পর্যন্ত বেঁটেই থেকে গেল; কাক্সিক্ষত উচ্চতায় পৌঁছাতে পারল না।