ফারুক মাহমুদের দীর্ঘ কবিতা

ঝরাপাতার আলো
চালাকির ধূপকাঠি ক্ষয়ে ক্ষয়ে শেষ হয়ে যায়
দম্ভধোঁয়া একদিন দূরে সরে বাতাসে মিলায়
কীর্তির সৌরভগাথা স্বস্থপ্রদ সামান্যও হোক
তিলেক হবে না বৃথা; বহুদিন ছড়াবে আলোক
বিষের কাঁটায় যদি অহরহ মন ঢেকে থাকে
কোলাহল ডুবে যাবে ঘৃণাঘূর্ণি পূতিগন্ধ পাঁকে
ঝরা পাতার আলো♦
নতজানু গোলাপর চেয়ে
শক্তদাঁড়া বিষকাঁটা ভালো
দহনের অপচেষ্টা শুধু―
সে আগুনে আমার কী কাজ
দূরে রাখি―যার নেই এতটুকু আলো
কারও শ্রী(!) দেখে ঈর্ষান্বিত-হয়ে-লেখা পদ্য ♦
তুমি হলে সেই হাসি―সব ঠোঁটে রং ধরে থাকো
যে-নামে যে-জন খুশি―তাকে তুমি সেই নামে ডাকো
বাতাসের মওকা বুঝে পাল ধরো ডানে কিংবা বামে
তোমার মুখস্থ সব―কোন গাড়ি কোন দ্বারে থামে
নিজস্বতা বলতে নেই। ছোট বড় চেপ্টা গোলাকার
যখন যে-পাত্রে ঢোকো পেয়ে যাও অবয়ব তার
তোমার তুলনা তুমি। নানা ভঙ্গি। ব্যাজ ভাঁড় সাজো
নটির নূপুর হয়ে ছদ্ম ছন্দে পায়ে পায়ে বাজো
করুণার বর্জ্য ঘাটো―খুদকুঁড়ো মেলে যদি কিছু
আহা রে জীবনপাত! হেঁটে যাও ক্ষমতার পিছু
বুজুরকি তোমার শিল্প―বোধ্য নয়―কী যে ছবি আঁকো
তুমি হলে সেই হাসি―সব ঠোঁটে রং ধরে থাকো
পদ্যবীজ♦
উপায় কী করি!
করি কী উপায়!!
আমার তো নেই
শৈলচূড়া প্রেমের সঞ্চয়
যা-দিয়ে তোমাকে
যথাযথ ভালোবাসা যায়
তবু এসো, প্রেমে-প্রেমে ঘুরি
যে বাতাসে শব্দ নেই, শুধু
নির্ভরতার সৌরভ থাকে
নতুন আনন্দ নিয়ে মন মেলে উড়ি…
দেখা যাক, দেখি―
হৃদয়ের মুগ্ধ টানে যদি কিছু হয়!
পদ্যবীজ♦
বেঁচে থাকা শেষ হয়ে এলো
মনের জানালা তবু হাট ক’রে খোলা
প্রবীণ বৃক্ষের শাখা… আপেক্ষায় স্থির হয়ে আছে―
নতুন বাতাসে যদি লাগে প্রেমদোলা
বোধ♦
কে রয়েছি কার প্রেমে! তুমি কি আমার
না-কি আমি ধরে রাখি তোমার প্রণয়!
হে প্রসন্ন মৃত্তিকা আমার
আমাকে রেখেছ বুকে। আমি ছুঁয়ে-থাকি
চিরায়ত তোমার চরণ
কবিকথা!♦
স্তূতি-শব্দে যা-ই লেখা হোক―
হয়ে যাবে শব্দশব, ঝুরাছন্দহাড়
কবিতায় দীর্ঘ কবিতা কোথায়!
সবই দেখি তেতো ফেনা, উলুখাগড়া, দৃষ্টিহীন চোখ
অবজ্ঞার কালিঝুলি নিয়ে পড়ে আছে―
ভাঙা সেতারের ছেঁড়াখোড়া তার
এমন সময় এলো―এ কী!
দীর্ঘ কবিতা লেখার নামে ছদ্ম কবি উগরে দিচ্ছে অজীর্ণ আহার
ঝরা পাতার আলো ২♦
আকাশ কুড়িয়ে রাখি, একদিন কাজে আসতে পারে
জীবন জড়িয়ে রাখি, একদিন ছুড়ে ফেলতে হবে
মানুষের ঘরেফেরা―হৃতস্নিগ্ধ―মন ভালো থাকে
আগুনে আলোর রেখা―হেসে ওঠে গভীর গৌরবে
প্রতীক্ষা জানে না―ওর জেগে থাকা কত প্রসারিত
কোনো স্পর্শে ফুল ফোটে, ঝরে যায়―আমি অবহিত!
পদ্যছড়া♦
কত নামে কত যে ফুল
ফুটে থাকে লতা-গাছে
কোনো ফুলে গন্ধ মাখা
কোনো ফুলে ছবি আঁকা
অন্ধ (!) যারা তারা খোঁজে
কোনো ফুলে অবিশ্রান্ত মধু জমে আছে…
দুই গাধা♦
জ্যেষ্ঠ গাধা বলছে হেসে―
“আমরা হলাম বুদ্ধিজীবী
‘হরিলুটের বাতাসা’ যা
আমি নেব, তুই-ও নিবি”
ছোট গাধা গদগদ―
‘আপনি হলেন বড় দাদা
দুজন মিলে সাধব গলা
সা রে গা মা নি সা পা ধা’
সদ্যপদ্য♦
না-হয় হলেনা সন্ত; শান্ত হতে বাধা কিছু আছে!
নেই-নেই, নেই-নেই বলে
দীর্ঘশ্বাস, ঊর্ধ্বশ্বাস কেন?
আক্ষেপে আনন্দ নেই। খেদ ভুলে যাও
ভালোবাসা যত পারো মন ভরে নাও
যতনে জড়িয়ে রাখো পাঁজরের কাছে
সুদূরে-অদূরে দেখি বহুবিধ স্মৃতি―
কবি যদি ছুঁয়ে দেয়―ফুল ফোটে আধ-পোড়া গাছে
সদ্যপদ্য♦
দু’পায়ে অশান্ত চাকা। সারাদিন এখানে-ওখানে
ফিকিরের নানা ধান্দা। বাঁকা-কীর্ণ―সব বিদ্যা জানে
লোল-জিহ্বা। শত প্রাপ্তি। আরো চাই। কাটেনা খোঁয়ারী
সন্ধ্যা হলে ভিন্ন রূপ। শব্দচালে জটিল জুয়ারি।।
সদ্যপদ্য♦
ছিলেন সুযোগ্য কবি। ক্রমান্বয়ে হ’তে হ’তে হ’তে
হয়েছেন কবিদের মাননীয় পির
কী যে মনোহর!
কী যে মুগ্ধ কর!!
শিষ্য ভক্ত অনুসারী চারপাশে যুক্তকরে ক’রে থাকে ভিড়
কবিতার নামে তিনি চালাকী লেখেন
সত্য-মিথ্যে সবই তিনি বিবর্ণ দেখেন
স্বেচ্ছায় নিলেন কাঁধে পদক ও খেতাবের দুরারোগ্য ভার
স্থানকালপাত্রভেদে হয়ে যান তামাশার অতিশয় ভাঁড়
হায় পরিণতি!
আহা পরিণতি!!
এই হলো ভূতপূর্ব কক্ষচ্যুত মহামতি কবিসমাচার!
সদ্যপদ্য♦
কিছু ঘোড়া ইচ্ছাকৃত গাধা হয়ে যায়
বক্র হাসে। ভৃত্যনৃত্য করে
পা দিয়ে ঠেকাতে চায় দূরের আকাশ
অতঃপর ঘোড়া-গাধা মিলে
বিপুল আনন্দ নিয়ে আঘাটার কাদাজল ঘাঁটে
ভাগেজোগে খেতে থাকে করুণার লতাপাতাঘাস
ক্ষমতার আলো নিবে গেলে―
আস্তাবলে জেগে থাকে…, মহাতৃপ্তির জাবর কাটে
সদ্যপদ্য♦
যেকোনো নামের আগে থাকে যদি অযাচিত রুগ্ন বিশেষণ―
প্রতিভার কীর্তিরেখা হয়ে যায় ক্ষুদ্র-খিন্ন-বাঁকা
স্বঘোষিত ‘শ্রেষ্ঠ’ কেউ হলে
অতিবৃদ্ধ ঘোটকের মতো
অন্যের করুণা চেটে―লোলচর্মসার
শুধু যাবে মূল্যহীন বেঁচেবর্তে থাকা!!
সচিত্রকরণ : নাজিব তারেক