নাসির আহমেদের দীর্ঘ কবিতা

কালের সীমানা পার হয়ে
পঞ্চাশ বছর আগে তোমাকে আমার মনে হয়েছিল সেই
হ্যামিলন শহরের বংশীবাদক: যার জাদুর বাঁশিতে
শহরের সব শিশু নিয়েছিল তার পিছু…. তারপর.. নেই…
তুমি ঠিক সে-রকম তোমার দেশকে প্রেমে মুগ্ধ করেছিলে।
জীবন সায়াহ্নে এসে আজ মনে হয়
তুমি তারও বেশি পিতা তুলনারহিত, চারপুরুষের প্রিয় মহান মুজিব!
সেই কবে ছাপান্নতে চার বছরের শিশু পিতৃকাঁধে বসে
তোমাকে দেখেছে জনসভায় বিমুগ্ধ চোখে, বাবা মগ্ন শ্রোতা!
তারপর সেই শিশু তুমুল কৈশোরে তার ছেষট্টি সালেই
ছয় দফা দাবি নিয়ে মিছিলে ঘুরেছে তুমি ডেকেছিলে বলে।
সেই থেকে বাংলাদেশ আর তুমি একাকার,
তীব্র ঊনসত্তরে
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পেয়ে ‘বঙ্গবন্ধু’ তুমি।
সেই থেকে মুগ্ধতার তুমুল যৌবনে
সত্তরের নির্বাচনে নৌকার মিছিলে যায়, প্রথম ভোটার হয় বিমুগ্ধ যুবক।
তারপর ষড়যন্ত্র ভুট্টো-ইয়াহিয়া মিলে পণ্ড গণরায়!
ফুঁসে ওঠে বাংলাদেশ, স্তব্ধ হয়ে যায় সব উত্তপ্ত হরতালে।
সেই যে যুবক যায় গ্রাম ছেড়ে শহরের কঠিন মিছিলে,
অসহযোগের ডাকে সাড়া দেয় বাবা-ছেলে আর সারাদেশ।
সাতই মার্চের সেই গনগনে রাজপথে-রেসকোর্সে লাখো মানুষের
কেন্দ্রবিন্দু বঙ্গবন্ধু তুমি ডাক দিলে: ঘরে ঘরে
দুর্গ গড়ে তোলো,
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম..
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল তো সেদিন থেকে দুর্গ হয়ে যায়!
পঁচিশে মার্চের ভয়াবহ গণহত্যাও তো থামাতে পারে না আর
তোমার অমোঘ ডাক!
সেই ডাকে সাড়া দিয়ে যুদ্ধে নামে দেশ।
রক্তের প্লাবনে ভেসে তোমার সোনার বাংলা যুদ্ধ করে যায়!
যুদ্ধে যায় বাবা-ছেলে,
যুদ্ধে যায় প্রতিবেশী বাঙালি স্বজন,
ধর্মবর্ণ ভেদ ভুলে তোমার ডাকেই মুক্তিযুদ্ধে যায় দেশ।
লাখো শরণার্থী কাঁদে
সব দুঃখ ভুলে কেবল তোমার জন্য,
যুদ্ধে লড়ে মুক্তিযোদ্ধা ‘বজ্রকণ্ঠ’ মনে রেখে দৃপ্ত প্রেরণায়।
সেই যে তোমার জন্য তীব্র আকুলতা এই দেশের হৃদয়ে
আজও অনির্বাণ শিখা সূর্যের দীপ্রতা নিয়ে জ্বলে ভালোবাসা।
তোমাকে বিস্ময় মানি, তুমি পিতা হয়ে আছো আমার বাবার,
তুমি পিতা আমারও তো, আমার সন্তান সে-ও তোমারই সন্তান!
তুমিতো জাতির পিতা, তুলনাবিহীন,
অন্য কোনো দেশে নেই
এমন প্রগাঢ় বোধ
হবে না কখনও আর অন্য কারও বেলা,
আমিতো নিশ্চিত কোনো
শেখ মুজিব পৃথিবীতে আসবে না আর
—জীবন-যৌবন সব জলাঞ্জলি দিতে তার স্বদেশের জন্য!
নেলসন ম্যান্ডেলাসহ বহু দেশপ্রেমী-বীর নমস্য এখনও,
মুজিবের মতো নেই তবু অন্য কেউ পৃথিবীতে, তিনি তো একজনই।
তাই তো বিমুগ্ধ মন অবচেতনায় বলে সেই অনুভূতি:
তোমার মতন আর একজনও কেউ জানি আসবে না পিতা।
তুমি খুব প্রিয় ছিলে আমার পিতার, আমারও হৃদয়ে পাতা তোমার আসন,
সন্তান আমার ভোট দিতে যায়, সে-ও নাম জপে প্রাণপ্রিয় নেতা জাতির পিতার;
তার শিশু-সন্তানেরও প্রিয় আজ তুমি—
আধো আধো বোলে বলে যায় পিতা তোমার ভাষণ সেই সাতই মার্চের!
কী বিস্ময় তুমি পিতা চির বহমান!
তুমি পাঁচ বছরের শিশুটিরও স্বপ্নে রাজকুমার!
তুমি আমার বাবার তারুণ্যের নিত্যসঙ্গী ছিলে ভাবনায়-বোধে।
এই শিশু বড় হচ্ছে দাদার আদর্শ নিয়ে, দেয়ালে তোমার ছবি দেখে,
তুমি আমার জীবন-যৌবন পার হয়ে
সায়াহ্ন বেলায়ও স্থির ছবি!
তোমার সাহসে আর মানবিক বোধে খুব অভিভূত হয়ে
তোমার জন্য কত কান্না করেছেন আমার বৃদ্ধ দাদি, নানি,
তুমি পাকিস্তানে বন্দি,
নানি বলতেন: আহা, ছেলেটাকে ওরা মেরে ফেলবে নির্ঘাত!
দাদি বলতেন : আহা, এমন সোনার ছেলে হবে এই দেশে কোনোদিন!
ম্লান মুখে মা আমার
মানত করেন রোজা
মুজিবের নামে:
হে আল্লাহ মুক্ত করো সোনার মানুষটাকে, পূর্ণ হোক এই স্বাধীনতা।
দশই জানুয়ারি সারা বাড়িতে আমার
সে কী কান্না আনন্দের!
ছন্দে নামা বৃষ্টি যেন তুমি এলে কল্লোলিত শহর ও গ্রাম,
তুমি এলে অকস্মাৎ বাংলাদেশ ভেসে যায় আনন্দ-বন্যায়!
তুমি এলে পুত্রহারা জননী চোখের অশ্রু মুছে হেসে ফেলে,
তুমি এলে স্বাধীনতা পরিপূর্ণ শক্তি পেয়ে বিশ্বময়ী হয়।
সেই তুমি পৃথিবীর উচ্চতম পর্বত শৃঙ্গের মতো
আকৃষ্ট করলে সারা পৃথিবীর মুগ্ধ দৃষ্টি!
জাতিসংঘে প্রাণপ্রিয় মাতৃভাষায় তুমি বক্তৃতা করলে
সে কী দীপ্র উচ্চারণে!
গৌরব-সৌরভ দিলে ছড়িয়ে বিশ্বময় বাংলা ভাষার!
রবীন্দ্রনাথের আত্মা প্রবাহিত হয়ে গেল
লাল-সবুজের বুকে উড্ডীন বাতাসে,
স্বয়ং নজরুল এসে গৌরবে গাইলেন তার রণসংগীত ‘মার্চের গান’।
লাজুক জীবনানন্দ দাশ তার প্রিয় রূপসী বাংলার
মহাকাল-জয়ী নেতা মুজিবকে দেখলেন সগর্ব বিস্ময়ে!
আমি কি জানতাম এই জীবনে তোমাকে তিনবার দেখার স্মৃতি
তিনটি মহাকাব্যের উচ্চতা-প্রাপ্ত স্মৃতি হবে একদিন!
সেই তুমি তোমার আপন মৃত্তিকায় নৃশংসভাবে খুন হলে
পঁচাত্তরে আগস্ট-রাত্রির অন্তিম প্রহরে!
কী নির্মম এই সত্য মেনে নিতে হয়!
তুমি নিহত হবার পরে
মুছে গেল এ দেশের সমস্ত গৌরব,
দুঃখী মানুষের মুক্তিপথ
সমাজতন্ত্রের সম্ভাবনা মুছে গেল!
অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ হারিয়ে ফেলল তার সব উজ্জ্বলতা।
তোমাকে হত্যার পর ধসে পড়ল বাঙালির গৌরবের একেকটি সিঁড়ি।
তুমি যদি গৃহবন্দি হতে
অথবা থাকতে কারাগারে
একদিন মুক্ত হতে, আমাদের সম্ভাবনার বাতিগুলো
জ্বলে উঠত পুনর্বার, তুমি হতে আমাদের সাহসের উদ্দীপনা।
আমরা তোমার বিরুদ্ধে জমে ওঠা সকল কুৎসা মুছে
প্রকৃত তোমাকে দেখতাম।
আজ মনে পড়ে পিতাÑ তোমাকে হত্যার পর
কত নেতার উদয়-অস্ত,
কত বক্তৃতা-বিবৃতি, তোমার বিরুদ্ধে কত মিথ্যে অপবাদ-প্রচারণা!
বাকশাল অচ্ছুত যেন! অথচ চেয়েছো তুমি সব দলমতের মিলনে
এক মহাপ্ল্যাটফর্ম-ভেদাভেদহীন।
শুরু করতে চেয়েছিলে সমতার সমৃদ্ধ পথ।
আমলা আর পুঁজিপতি মহাজন, ঘুষখোর- মুনাফাখোরেরা একজোট,
আর সেই চিরশত্রু সাম্রাজ্যবাদীরা বেঁধে নিয়েছিল শক্ত জোট,
ঘরের শত্রু যে বিভীষণ, মীরজাফর
তারা তো ছিলই,
তোমার মহান উদারতা আর সরল বিশ্বাস-ভালোবাসার সুযোগ নিল ওরা।
বিশ্ব সমাজের কথা এবং দেশের কথা সম-মমতায় ভেবেছিলে তুমি পিতা,
চেয়েছিলে বাঙালির জাগরণ হোক মহান গৌরবে বিশ্বময়!
ব্যক্তিগত নোটবুকে তুমি লিখেছিলেÑ
‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানব জাতি নিয়েই আমি ভাবি।
একজন বাঙালি হিসেবে যা-কিছু বাঙালিদের সাথে সম্পর্কিত
তা-ই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়।
এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা,
যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’
শুধু বাংলার গৌরব নও, তুমি তাই বিশ্বের গৌরব।
দুঃখী মানুষের আশা-ভালোবাসা ছিলে তুমি পৃথিবী সমান,
তুমি যদি অকালে না চলে যেতে ঐশ্বর্যে উঠত ভরে দেশ বহু আগে
কারণ তোমার ছিল গভীর মানবপ্রেম আর দেশপ্রেম।
যে তীব্র দেশপ্রেম-শক্তি নিয়ে তুমি দেখেছো স্বদেশ মৃত্তিকাকে
সেই শক্তি আর কারও ছিল না, যে-শক্তি দিয়ে জয় করা যায়
মানুষের ভালোবাসা আর জয় করা যায় পৃথিবীর উন্নত সভ্যতা!
অসীম শক্তিময় দেশপ্রেম নিয়ে তুমি অকালে মধ্যাহ্নে
অস্তমিত সূর্য পিতা!
সভ্যতাবিরোধী হিংস্র ঘাতক অন্ধকারেই হত্যা বেছে নিল।
ঘাতকেরা জানতো না ভালোবাসা হত্যা করা যায় না কখনও।
তোমার তো মৃত্যু নেই, তুমি ভালোবাসা পিতা,
টুঙ্গিপাড়ার ছোট্ট ‘খোকা’ থেকে ভালোবাসা তোমাকে করেছে
‘বঙ্গবন্ধু’ জাতির জনক।
তুমিতো ছড়িয়ে গেছো অভিন্ন বাংলায় আর মুক্তিকামী মানুষের মনে
পৃথিবীর নানা প্রান্তে।
তোমাকে হত্যার আগে-পরে কত নেতা এই দেশ-উপমহাদেশ জুড়ে!
মেটাতে পারেনি তৃষ্ণা আম-জনতার!
বাংলার মানুষ ছুটে গিয়েছে তাদের কাছে তৃষ্ণার্ত বারবার।
মানবপ্রেমের সেই হীরকোজ্জ্বল দ্যুতি তুমি তো অক্ষয়।
তুমি আছো সর্বত্রই মিছিলে-সভায় আর পোস্টারে-ফেস্টুনে,
আছো তুমি কত স্থাপনায়! বিলবোর্ডে সভা-সেমিনারে টিভির পর্দায়
আর তারও বেশি আমাদের হৃদয়ের
গভীর নির্জনে।
তবু ধুধু তৃষ্ণা জ্বলে, শূন্যতা তোমার প্রায় অর্ধশতাব্দীর!
সতের মার্চের নানা আয়োজনে তুমি আসো প্রিয় জন্মদিনে,
শোকের আগস্ট মাসে সারাদেশ তুমিময় শোকে মুহ্যমান।
সাতই মার্চে রেসকোর্স পর্দায় জীবন্ত হয় তোমার প্রদীপ্ত আগমনে!
কোনো কিছুতেই তবু তোমার শূন্যতা মুছে ফেলতে পারি না।
জন্ম-মৃত্যুর দুটি ছুটির দিনকে দেখি নাতি-নাতনিরা
স্কুল বন্ধ পেয়ে আনন্দে লাফায়, ফিরে আসো তুমি।
হঠাৎ তাকিয়ে দেখি আমার বৃদ্ধ বাবা নীরবে তোমার জন্য কাঁদছেন।
আমার দাদি ও নানি অশ্রুপাত করতে করতে কবরে গেছেন সেই কবে-
চল্লিশ বছর প্রায়! বিজয় দিবস আর স্বাধীনতা দিবসেও আসো তুমি স্মৃতি হয়ে,
কেঁদে ওঠে এই মাটি, সবুজ প্রকৃতি আর কাঁদে নদনদী,
কান্নার প্লাবনে আসে বন্যা ও টর্নেডো-ঝড় ভাঙে ঘরবাড়ি।
তোমাকে হত্যার পর ধসে গেছে গৌরবের একেকটি সিঁড়ি,
ধর্মের আলখাল্লা পরে এলো বোমা-গ্রেনেডের ভয়াল তাণ্ডব!
জঙ্গিবাদ ছুটে এলো এ কে ফোরটি সেভেন রাইফেলসহ,
একুশে আগস্ট আসে নিশ্চিহ্ন করার পোড়ামাটি নীতি নিয়ে।
তোমার শূন্যতা পিতা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে আজ
যদি তুমি থাকতে এখন, নিশ্চিত ধর্মের প্রতি অনুরাগী তুমি
আসর নামাজ শেষে রেসকোর্সে গিয়ে বজ্রকণ্ঠে ডাক দিতেÑ
ধর্মান্ধ মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ নিশ্চিহ্ন করে দাও! এই দেশ সব মানুষের।
দুর্নীতি-তাণ্ডব দেখে গর্জে উঠতে তুমি। ঘুষখোর-লুটেরা
দমনে কঠোর তুমি নিশ্চিহ্ন করে দিতে, থাকতো সেই শুদ্ধ রাজনীতি।
ভায়েরা আমারÑ বলে আবার গর্জন করে যদি ডাক দিতে
তাহলে তোমার প্রিয় আত্মজা হাসুমনি কি উন্নয়নে এত বাধা পায়?
ফিরে যদি আজ তুমি আসতে একবার পিতা,
দেখতে কীভাবে প্রিয় তোমার স্বপ্নের দেশ বুনছে মগ্ন হয়ে
সেই গৌরবের নকশি-কাঁথাটা।
সচিত্রকরণ : নাজিব তারেক