কবিতা

শুশুমনি
মাকিদ হায়দার
সাঁতার শেখাবো ভেবে কেটেছি পুকুর
গতকাল জনিয়েছি পাড়ায় পাড়ায়
ঢাকা শহরের কোথাও নেই কোনো জলাশয়
যদি কেউ শিখতে চায় শখের সাঁতার তখুনি
আসবেন চলে আমার পুকুরে।
দিন যায়, মাস যায়, যায় আষাঢ় শ্রাবণ।
সাঁতার শিখতে কেউ এলো না যখন
আমি রাগে অভিমানে পুকুর ভরাট করে
বানিয়ে দিয়েছি নাচ ও গানের স্কুল।
লাহিড়াপাড়ার শৈলেশ সান্যাল শেখাবেন তবলা,
যার নাম ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে
ঢাকা, কলিকাতা।
বাঁশিতে শংকরদা
রাধা নগরের সকলেই জানেন―কাশি বাবু,
ধ্রুপদী নৃত্যে খুবই খ্যাতিমান, যার খ্যাতি
বিশ্বজোড়া।
আকাশ পাতাল।
তিনি শেখাবেন মনিপুরা ছ-তলার ছাদে।
শুধু সেতার শেখাবো আমি।
দিন কয়েক পরেই এসেছিল ডি সি সাহেরের মেয়ে
‘শুশুমনি’
তিনি শিখবেন ঝুমুর নাচ আমার স্কুলে।
মেয়েটির অনুরোধে একদিন কেটেছিলাম শখের
পুকুরÑ তখন কথাছিল
পুকুরের টলোমল জলে
কাটবো সাঁতার
আমরা দুজন।

মৃণাল সরকার
করোনাকালের ইশতেহার
১.
এই যে মানুষ, শুনেছো!
কক্সবাজার কলাতলী সৈকতের জলসীমায় জমে উঠেছে
ডলফিনের জলকেলি। আহা, কতকাল ছিল নিষিদ্ধ তারা
তাদেরই সীমান্তে; নদীতে নির্বংশ-প্রায়;
সমুদ্রেও তাদের আতঙ্ক-বসবাস।
এই যে মানুষ, দেখেছো,
ইদানীং লাল কাঁকড়ারা সৈকতজুড়ে বিছিয়েছে
লালগালিচা; তোমাদের পদভারে এতদিন
লুকোতো তারা বালির গভীরে!
ভেনিসের নালা আর খালে দেখা যাচ্ছে স্বচ্ছতোয়া জল;
সেখানেও ফিরে আসছে ঝাঁকে ঝাঁকে বর্ণালী মাছেরা।
বেইজিং আর দিল্লির ছাতে ক্রমশ পষ্ট হচ্ছে নীলাকাশ―
তোমরাতো ভুলেই যাচ্ছিলে আকাশের রঙ মূলত নীল!
তোমরাও কি টের পাচ্ছ ফুসফুসে বিশুদ্ধ বাতাস?
এই যে মানুষ, দেখেছো?
চঞ্চল হরিণী নগরীর রাজপথে ভ্রমণে বেরোয় নিরাপদ;
লোকালয়ে হানা দেয় বুনো হাতি; বুঝে নিতে
কী কারণে ঘাতক মানুষেরা অদৃশ্য সকলে!
২.
কী এমন ঘটে গেছে পৃথিবীতে আজ?
ধরণীর তাবৎ প্রাণিকুল, ফুল ফল প্রজাপতি
মাছরাঙা গিরগিটি জল-ডুবি ডাহুক
আমাজন থেকে সুন্দরবন নিঃস্বর্গ প্রকৃতি,
একযোগে মেতেছে আজ অদম্য উৎসবে;
হায়! শুধু এক মানবকুল ছাড়া!
তবে কি প্রকৃতির নাড়ি থেকে ছিন্ন আজ মনুষ্য প্রজাতি?
তবে কি মানুষেরা মূলত বন্দি বলে
মুক্ত আজ বিপুলা ধরণী?
এই যে দাপুটে মানুষ;
তুমিতো গিয়েছো ভুলে তোমারও আদি জন্ম
প্রকৃতি-আশ্রয়ে; একদিন তোমারও আবাস ছিল বটে
গুহার গহিনে; তোমারও স্বস্তি ছিল সূর্যোদয়ে শ্বাপদ সংকুলে;
তোমারও অভয় ছিল পূর্ণ-চাঁদ রাতে;
তবু তুমি নির্বিচার ধ্বংস করেছো প্রকৃতির
আপন বৈভব; আঘাত করেছো তুমি তার
অন্তর্গত স্বভাবের মূলে; প্রকৃতিকে তুমি নিয়েছো লুটে
বিনিময়ে তার দাওনি কিছুই; তোমার
আগ্রাসী আধিপত্যে ক্রুদ্ধ আজ বিপন্ন প্রকৃতি!
৩.
হে মানুষ,
অদৃশ্য এক অণুজীব করোনায় তুমি বিপর্যস্ত আজ।
কী আশ্চর্য, এত সব প্রযুক্তির জাদু-কাঠি,
এত সব জয়ডঙ্কা; পরমাণু বিধ্বংসী ভাণ্ডার―
সব কিছু অকেজো আজ আগন্তুক করোনার কাছে।
এই করোনা তোমাদের সৃষ্ট
ধনী গরিবের শ্রেণিভেদ মানে না; শাসক মানে না
শাসিত মানে না রাজা মানে না প্রজা মানে না;
মসজিদ মন্দির গির্জা মানে না।
আবার, অবাক বিস্ময়ে দেখি
করোনা আতঙ্কে তোমাদের ভেতরে
শ্রেণিভেদহীন এক অভূতপূর্ব সাম্য:
সংক্রমণের ভীতির সাম্য, অসহায়ত্বের সাম্য,
স্বেচ্ছা বন্দিত্বের সাম্য, মরণের ভীতির সাম্য।
রাতদিন শশব্যস্ত মানুষগুলো গুটিশুটি ঘরে,
কারখানার সাইরেনও ভাবে এ-সময় মৌনতাই শ্রেয়,
এতটা সর্বভুক ভোগান্ধ মানুষ; এত সব ঝলমলে পণ্যের লোলুপ;
দিন নেই রাত নেই, নিরন্তর ছোটাছুটি…
সব আলো নিভে গেছে আজ,
ব্যস্ততম সড়ক-সব ঝিমোয় ঘুমোয়,
লক্ষ কোটি যন্ত্রযান তবু যেন কুলোয়নি মানুষের―
ইদানীং ঘুরছেনা চাকা; নেই বিমানের পাখা মেলা এখন তখন,
গৃহে ফেরার উদগ্রীব মানুষেরা এখন
নিয়ত গুনছে প্রহর কবে তারা নির্মল নিঃশ্বাস নেবে
খোলা আকাশের নিচে; নির্ভয়ে খুলবে তারা গৃহের কপাট!
৪.
হে মানুষ,
তোমার কি কাটছে উদ্বেগের নিদ্রাহীন রাত,
শঙ্কা হয় কে-কখন যোগ দেবে মৃত্যুর মিছিলে?
তোমার শ্রেষ্ঠত্বের অহংকার বুঝি ধুলোয় লুটায়?
তবে তুমি কি অনুতপ্ত অতীত অনাচারে? নাকি অপেক্ষা
শুধু ভ্যাকসিনের; এসে গেলে ভুলে যাবে সব?
যদি আন্তরিক অনুতপ্ত হও; দগ্ধ হও স্বার্থান্ধ দীনতায়,
যদি মনে করো গ্রহটিকে সাজাবে নতুন সমঝোতায়,
তবে একটিবার প্রার্থনায় দুহাত বাড়াও;
নদীর কাছে ক্ষমা চেয়ে বলো:
তুমি বয়ে যাও আপন স্বভাবে,
সাগরের কাছে ক্ষমা চেয়ে বলো:
সমুদ্র হবে না আর বর্জ্যরে ভান্ডার; প্লাস্টিকের আঁস্তাকুড়,
তুমি ফিরিয়ে দেবে তার সুনীল জলরাশির বিপুল অহংকার!
হিমালয়ের মুখর মৌনতার কাছে,
আমাজনের অসীম অরণ্যের কাছে ক্ষমা চেয়ে
প্রকাশ করো তোমার একান্ত অঙ্গীকার:
মানুষ ফিরবে তার মানবিক স্বভাবে;
মানুষ ফিরবে তার মনুষ্যত্বে,
মানুষ সুখী হবে জন্মজন্মান্তরে
যদি সুখী হয় জগতের সকল প্রাণী!
এপ্রিল ২০২০
———————-

আমার মুক্তিযুদ্ধ
মাহমুদ কামাল
আমার একাত্তর স্বজন-হারানো
হারিয়ে পেয়েছি কত নতুন স্বজন
পেয়েছি সমগ্র রবীন্দ্রনাথ
নজরুল তো স্বশরীরেই
সেই সাথে রূপসী বাংলার কবি।
আমার একাত্তর এই রূপসী বাংলা
আমি যুদ্ধে যেতে পারিনি
৭ই মার্চের ভাষণ শুনেছি
আমি যুদ্ধ দেখেছি
মুক্তিযোদ্ধার হাতে অস্ত্র দেখেছি
নওল-কিশোর আমি
পারিনি যুদ্ধে যেতে
তার মানে এই নয়
যুদ্ধের প্রতিটি দিনে হৃদয়-নদীর ঢেউ নিস্তরঙ্গ ছিল।
কিশোরের শিরায় শিরায় তখন নতুন রক্তস্রোত
নতুন পতাকা পেতে আমিও যুদ্ধে গেছি
আমিও যুদ্ধে গেছি আলোড়ন আমার হৃদয়
মন ও মনন ব্যাপে এই যুদ্ধ এখনও চলছে।

আইউব সৈয়দ
বাঙালির বাতিঘর
ক.
সমষ্টির কল্যাণে
ঋণ শোধের রূপকার,
স্বরূপ সন্ধানেও
জ্বলজ্বল উত্তরাধিকার।
ভাষা ও মূল্যবোধে
ঋদ্ধবান,
মননশীলতার মধ্যমণি
আনিসুজ্জামান।
খ.
তত্ত্বের উদ্ভাসে মননের বটবৃক্ষ
ঘটান দূরদৃষ্টি,
নন্দিত প্রবর বাঙালিতে
মাঙ্গলিক সৃষ্টি।
মুক্তবুুদ্ধির সংস্কারে
প্রীতিতে চলমান,
বিশ্ব ভূগোলে বাতিঘর সে যে
তিনিই আনিসুজ্জামান।
———————-

তমিজ উদ্দীন লোদী
পদ্য
ক.
এবার তবে রাত্রি যাপন
মফস্বলে, গ্রামে
এবার থেকে চড়া নেই
বাসে কিংবা ট্রামে ।
দিন যাচ্ছে শুকনো রোদে,
হলুদ ঝিঙে ফুলে
হাওয়া বইছে হিম ছড়ানো,
পাতাগুচ্ছ দোলে।
উড়ছে ফেঁসো, উড়ছে ধুলো,
শিমুল ফুলের তুলো
হৃদয় খুলে দাঁড়িয়ে আছে
গ্রামের মানুষগুলো।
খ.
এখানে রাত এখানে দিন
হাওয়ার ভেতর লোটে
চাঁদনী রাতে ছাতিম ফুল
সুবাস নিয়ে ফোটে
মানুষগুলো দিলদরিয়া
পরাণ খুলে হাসে
হৃদয় যেন ঝর্ণাধারা
কাতলা মাছের পাখনা হয়ে ভাসে।
প্রেম হলো সরের মতো
পুরাকালের রাধা
যেন একতারা এক,
তারগুলো সব সঠিক ছড়ে বাঁধা।
শিশির ঝরে পাতায় পাতায়,
শিশির ঝরে ঘাসে
মানুষগুলো ঋদ্ধ থাকে শান্তি ও সন্ত্রাসে।
————————–

রওনক আফরোজ
কিশোরী ও জানালা
সে-বছর বসন্ত ছিল অন্যরকম।
কৃষ্ণচূড়ার ডালে ডালে ছড়িয়েছিল ভয়ঙ্কর আগুন!
আর দেশটা ভীষণ কাঁপছিল, আসন্ন পরিবর্তনের তুমুল হুংকারে।
উত্তাল সারাদেশ; ‘শোষকের বিনাশ চাই; চাই স্বাধীনতা!’
মুক্তির প্রচণ্ড ক্ষুধা, গণজাগরণ ছাড়া নেই কোনো পথ,
গ্রামে গ্রামে জ্বলছে দাবানল; ধর্ষণ, গণহত্যা, লুণ্ঠন;
শহর কী গ্রাম; সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে নিষ্ঠুর হানাদার।
সমগ্র দেশটাই যেন কনসেনট্রেশন ক্যাম্প, বিভীষিকাময় ধ্বংসের কারাগার।
এলোপাতাড়ি ছুটছে গুলি, উড়ছে বারুদ-ধোঁয়া।
জীবন-মৃত্যুর দোলাচলে সময়ের নির্মম আসা-যাওয়া!
অলিখিত কারফিউঘেরা মফস্বলের এক বাড়িতে বিষণ্ন এক সন্ধ্যায়
হঠাৎ ঠকঠক কড়ানাড়া,অতর্কিত বজ্রপাত!
ভাঙ্গা দরজায় বাবার ভয়ার্ত মুখ
আর উর্দিপরা রাইফেলধারী পাকবাহিনী; ‘আপকো যানা হোগা হামারা সাথ’;
হঠাৎ করেই শেষ থেকে শুরু একজীবনের স্তব্ধ-কাহিনি।
সময় অমোঘ, বড্ড বলবান, যুদ্ধ শেষ
মনের মুঠোয় একখণ্ড সবুজ বাংলাদেশ, স্বাধীন জন্মভূমি।
মাথায় রক্তধোয়া সুবর্ণ তাজ;
লাঙলের ফলায় নাচে মুক্তদিনের ঝকমকে আলো
চারিদিকে জয়োৎসব; পরিবর্তন পরিবর্ধনের উচ্চকিত আওয়াজ!
তারপর কেটে গেছে চারটি দশক
এত বছর পর; আজও আকাশ দেখা জানালায় বড় হওয়ার সুতীব্র অপেক্ষায়
রুদ্ধশৈশব, আহত চিরকিশোরী নিথর দাঁড়িয়ে থাকে।
স্মৃতিতে অম্লান বাবার চলে যাওয়া বিবশ ক্ষণ রাত্রিশেষের বিক্ষত সকাল,
জানালায় আকাশ ছিল না, আজও নেই,
ছিল বারুদগন্ধা বাতাস আর দৃশ্যমান বধ্যভূমিতে,
বাবার বুলেট-বিক্ষত রক্তাক্ত লাশ।
————————-

নাসরীন নঈম
উড়তে চাই
মাঞ্জা দেয়া সুতোর মতো ধারালো শরীরটা
নিয়ে ঘুড়ি হয়ে পুরনো শহরের আকাশে
উড়ে যেতাম―এ ছাদ থেকে এক লাফে ঐ ছাদে
হাতে লাটাই।
জিন্না ভাই, বাবুল মুশতাক আর রেবার মামার
সাথে আমার শাদা ঢাউস ঘুড়িটার কাটাকাটি চলে
ঘণ্টা ধরে। কোনো ভয় ডর নাই―নাই করোনার আতঙ্ক
সবাই খুব আনন্দে জানলা খুলে দেখতো।
মুখে মাস্ক নেই হাতে গ্লাভস্ নেই
ছোঁয়াছুঁয়ির তোয়াক্কাও করি নাই, শুধু
দৃষ্টি ছিল মধ্য আকাশে ঘুড়ির সুতায়
খালি পায়ে ছুটতে থাকি, উড়তে থাকি।
ঐভাবে ওড়াউড়ি আজ বন্ধ
চোখের কোনায় কুয়াশার চাদর
মধ্যরাস্তায় দাঁড়াতে পারি না এখন
জানালা দিয়ে আকাশ দেখি।
কবে শেষ হবে এ বন্দিদশা
ঘুড্ডির মতো উড়বো কবে?
——————-

পারভেজ আহসান
সুন্দরের নিরুদ্দেশ যাত্রা
বরফ ভেজা ডানায় বাতাসের দেহ ভেঙে
পরিযায়ী পাখিরা ঠিকানা খোঁজে উষ্ণ সরোবরে
পদ্ম বিলের শরীর জুড়ে লাবণ্য ফোটে
রুপালি রাতে স্নায়ুর তন্ত্রীতে এক বিস্ময় জাগে
জলের কম্পন কাব্য কথায় নিস্তব্ধতা ভাঙে ।
একদিন সেও এসেছিল পরিযায়ী হয়ে
গোপন সুন্দর ফুটেছিল জোছনার জলে
অতঃপর সবার অলক্ষ্যে মিশে গেল
গন্তব্যহীন মেঘের পালকে
অচেনা পথ নিয়ে গেল তারে বহু দূরে।
——————————

ভাগ্যধন বড়ুয়া
পাতাজন্ম ও ঝরা পাতা
পাতা জন্মাতে দেখিনি; পাতা ঝরা দেখেছি
ঝরাপাতার রঙ কী? ক্ষয়ে যাওয়া অবশেষ
বনের গভীরে যারা যায় তারা চিনে
রঙ নেয়া ঝরাপাতা।
ঝরাপাতা উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে আসে
পড়ে থাকে মাটিলগ্ন, নিজের খেয়ালে
প্রজাপতি সঙ্গে উড়ে;
উড়ে উড়ে প্রজাপতি কই যায়?
প্রজাপতির ঘর কই?
পাতারা সংলগ্ন থাকে মায়ের বুকে
প্রজাপতি উড়ে এসে ঠোঁটে দেয় চুম
ঝরাপাতা উড়ে হয় প্রজাপতি সখা…
কখনও পাতা হয় প্রজাপতি পাখা
কখনও পাখা হয় রঙ করা পাতা
মিলে যায় অবলীলায় অদৃশ্য লীলায়
শরীর নিখোঁজ হয় চেতনা গভীরে…
কারও জন্ম পথে-ঘাটে, কারও ঘর নেই
দেখা হয় অকারণে, কারণও খোঁজে
পাতা জন্মাতে দেখিনি;
চারা বের হলে পড়ে থাকে বীজের খোলস…
———————–

শামীম রফিক
আলো
এক.
রক্তে আগুন তোর লাল হলেও ক্ষতি নেই
রকেটের গতি শব্দের গতির থেকেও বেশি
কতটা দীর্ঘ হলো রাত, রাতের আঁধার-
তবে কি দেখবো না ভোরের আলো, সূর্যের লাল?
তোমাদের মৃত্যুর অন্ধকার তোমরাই সাজিয়েছো
তা না হলে মুক্তোর দানায় ভরে যেত আমাদের ইতিহাস।
বিনম্র শ্রদ্ধায় মেনে নিলেও নতমুখী তরু থেকে বেরিয়ে আসে হোলি
তারা ফোটাবে ক্ষতচিহ্নের উপর আরাধ্য মানব।
অপেক্ষার ক্রমাগত প্রহর, দুর্যোগের মতো ওড়ে
সেই কথা, স্পর্শ করে অনন্ত আলোয়
এখনও কাটছে প্রহর দিনমান গুনে
অনেকেই স্পর্শিত হয়েছে, দৃষ্টি এখনও ফোটেনি।
দুই.
সকলেই পৌঁছোয় না শিখরে। কেউ কেউ পৌঁছায়।
পথের ভিন্নতা থাকে, থাকে বন্ধুরতা
এই নিঃশব্দ সময়ের শেষে, মানুষেরা হেঁটে যাবে ঘরে
বাইরে সুনসান নীরবতায় প্রাচীন সতর্কতা
স্তব্ধতাকেই মারণাস্ত্র ভেবে তাতেই দিয়েছি শান
এখন অর্বাচীনেরা ভিটামিন-সি নিয়ে ব্যস্ত হয়েছে
তাদের সামনে রমণীরা লেবুর সৌরভ নিয়ে অসংখ্য প্রকোষ্ঠে বিভক্ত।
কতটা নিশ্চুপ থাকবো, কতটা মুখর হলে পৃথিবী :
মুখরিত হবে মানুষের চিৎকারে
পাথরেরা কথা বলবে
আর কতটা বাক্সময় হয়ে উঠবে রিক্ত এই পৃথিবীর উচ্ছ্বাস?
ঘুমাবার অভিনয়ে এতদিন বন্ধ রাখা চোখ থেকে
এক ঝটকায় বেরিয়ে আসবে অশ্রু আর নীরবতার আলো।
তিন.
আমি কি জন্য এসেছিলাম
আজ আর মনে নেই-
মনে নেই, যারা নিরীহ তাদের এই বিষণ্ন লোকালয়ে
প্রতিশ্রুত আমার অন্তরাত্মা যে আলো পেয়েছিল তার
বিনিময়ে বলাই হয়নি দুঃস্বপ্নের নিঃসঙ্গতা
কিন্তু পাথরের নিচে চাপা থাকা সকল মর্যাদা
যেখানে নোঙর করবে সেখানে সমুদ্র নয়
পতনের শব্দই প্রধান।
তবুও উঠতে হবে নিরীহ উৎসব শেষে
শব্দের শিখরে
মানুষের শান্ত উৎসবে
ক্ষুধার মিছিলে
এই অন্ন যারা ভাগ করে নেয় তাদের জন্য মৃত্যুদণ্ডের
মতো বর্ণমালা খুব বেশি প্রয়োজন। নির্মূল করতে হবে
এইসব তিক্ততা, লোভের উৎসব।
আমার জন্মভূমি, এই বাংলার সামনে স্নিগ্ধ ভালোবাসার
প্রয়োজন রূপসি নারীর উলঙ্গতার চেয়েও বেশি কাক্সিক্ষত
তোমরা জান না, আমার ভেতর গোপনে জন্মেছে যে আলো
তা দেশের জন্য ব্যয় করা ছাড়া আর কোন রমণীয় প্রয়োজন নেই।
————————-

স্নিগ্ধা বাউল
ডাকনাম
বিষণ্নতায় ঢেকে যায় যে পাহাড় শস্যের উদগম হয়ে নারীর মতো শরীর লয়ে
ডিঙিয়ে তার বিভ্রান্ত উচ্চতা নেমে আসি উপত্যকায়; ইচ্ছের অবাধ মৃত্যুর
আগে নদীর পাশে দাঁড়াই আমার নির্জনতার অধিকার পৃথিবীর নিজস্বতার
শব্দে তার দূরত্ব দেয়ালে লেগে আছে বহুদিন কলকলিয়ে বয়ে বেড়াচ্ছি
উপলব্ধির স্রোত― পাহাড়ের মতো দূরে নোঙরে বেনামে ডেকেছো কেন নদীর
পিপাসায় ডুবতে যাই যখন।
———————-

আফরোজা সোমা
ভুলো না আমায়
একটি তারার দিকে চেয়ে
যদি তার রাত ভোর হয়
যদি সে আঁধারে শোনে
একটি কোকিল
ডেকে ডেকে
ডেকে ডেকে
ক্লান্ত হয়ে যায়
তারে তুমি বাড়িয়ে দিও
কল্পিত রুমালখানি।
রুমালে থাকুক লেখা:
বাঁশের পাতা নড়েচড়ে
তোমার কথা মনে পড়ে।
রুমালে না থাক লেখা:
গাছটি হলো সবুজ বন্ধু
ফুলটি হলো লাল
তোমার আমার ভালোবাসা
থাকবে চিরকাল।
চিরকাল থাকে না কিছুই
না প্রেম
না হিংসা
না এই অহমের সংসার
কিছুই রবে না চিরদিন;
চিরদিন বলে কিছু নেই
‘চিরদিন’ একটা ভ্রান্তি
‘চিরদিন’ একটা ছলনা
‘চিরদিন’ এক প্রবোধের নাম।
তবু ডেকে ডেকে ডেকে ডেকে
একটি কোকিল
আঁধারে একা
যদি না থামে
একরোখা স্বরে
ডেকে ডেকে
যদি সে ভাঙায় তোমারে,
তার প্রতি তুমি কোনো রাগ নিও না।
পৃথিবীতে মুছে যায় রুমালের দিন
মুছে যায় গাছে লেখা
নামের পাশে নাম।
সব মুছে গেলে
যা নিয়ে মানুষ বাঁচে
তার নাম স্মৃতি
স্মৃতিরই অপর নাম ‘চিরকাল’;
স্মৃতিতেই মানুষ পোষে
না-পাওয়া রুমালে লেখা:
ভুলো না আমায়।