গল্প : জনক ফিরে এলেন : ইভান অনিরুদ্ধ

বর্ষণসিক্ত আগস্ট মাস। থেমে থেমে আগে দুইবার হালকা বৃষ্টি হয়েছে। রাত সাড়ে এগারোটা বাজে। এখন আবার টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। ঘরের টিনের চালের ওপর পড়ে সেই বৃষ্টির আওয়াজ হাসানের মনটাকে বেশ ভার করে দেয় কোনো এক অজানা কারণে। হাসান শুয়ে শুয়ে বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইটা পড়ছিল। গতকালই সে বাংলা একাডেমির বিক্রয়কেন্দ্র থেকে কিনে এনেছে এটি। বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করা বই। এই বইটিই জাতির জনকের জীবনদর্শনের অন্যতম প্রতিচ্ছবি। বঙ্গবন্ধুর নিজের লেখা ডায়েরিকে এক অনন্য সাধারণ বইয়ের আদল দেওয়া হয়েছে। এক টানে বইটির অর্ধেক পড়া শেষ হয়েছে মাত্র হাসানের। এদিকে পাড়ার ক্লাবঘরে বেশ জোরে মাইকে বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের সেই কালজয়ী ভাষণটা বাজছে―এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম!
আর কিছুক্ষণ পরেই ক্যালেন্ডারের পাতায় পনেরই আগস্ট শুরু হয়ে যাবে! আহা, সেই পনেরই আগস্ট জনকের হত্যা দিবস, জাতীয় শোক দিবস! হাসান কেমন যেন ঘোরের ভেতর চলে যায়! মনে হলো কেউ একজন তার শোবার ঘরের জানালায় মৃদু আওয়াজ তুলে ঠক ঠক করছে। হাসান ভেবেছে হয়তো দমকা বাতাসের আওয়াজ। কিন্তু শব্দটা যখন আরও একবার হলো তখন সে বিছানা থেকে নেমে, লাইট জ্বালিয়ে জানালা খুলে বাইরে উঁকি দিল। দেখল আধাভেজা হয়ে সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা দীর্ঘদেহী একজন বয়স্ক লোক দাঁড়িয়ে আছেন। লোকটির মুখে গোঁফের আড়ালে মৃদু হাসির আভা। তারপর হাসানকে অবাক করে দিয়ে, বেশ ভরাট গলায় তিনি হাসানের দিকে তাকিয়ে বললেন―কী রে, এ রকম হাঁ করে কী দেখছিস? চিনতে পারছিস না? আমি শেখ মুজিব বলছি! তাড়াতাড়ি দরোজাটা খোল, এভাবে বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থেকে ভিজে তো জবজবা হয়ে গেলাম। কিন্তু হাসানের মুখ দিয়ে ভালো করে কোনো আওয়াজই বের হচ্ছিল না। বিস্ময়ে সে যেন বোবা হয়ে গেছে! তবু সে অস্ফুট উচ্চারণে বললো―বঙ্গবন্ধু! আপনি সত্যি বঙ্গবন্ধু! কিন্তু এটা কী করে সম্ভব? কেমন করে আপনি আমার কাছে এলেন? বঙ্গবন্ধু হালকা ধমক দিয়ে বললেন―কী গাধার মতো কথা বলছিস! এতে অবাক হবার কী আছে? আমি কি তোর কাছে, তোর বাড়িতে আসতে পারি না? আমি কি তোদের দূরের কেউ? হা, হা, হা। অনেক কথা বলে ফেলেছি, এখন তাড়াতাড়ি দরোজাটা খুলে দে।
হাসান এক লাফে বারান্দায় গিয়ে দরোজা খুলে দিল। বঙ্গবন্ধু ভেজা শরীর নিয়ে এক ঝটকায় ঘরের ভেতরে চলে এলেন। হাসানকে বললেন―একটা গামছা দে, শরীরটা ভালোমতো মুছে নিই। নয়তো জ্বর চলে এলে আরেক ঝামেলায় পড়ব। জ্বর আমার শরীরে একদম সহ্য হয় না। সারা শরীর এলোমেলো হয়ে যায়, কী যে বিরক্তি লাগে তখন! হাসান পরম মমতায় তার গামছাটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল―ভালো করে গা-মাথা মুছে নিন। লুঙ্গি দিচ্ছি, আপনি ভেজা কাপড় চেঞ্জ করে আরাম করে বিছানায় উঠে বসেন। আপনার নিশ্চয়ই খুব খিদে পেয়েছে! আমি ঝটপট আপনার জন্য চুলায় ভাত চড়িয়ে দিচ্ছি। বঙ্গবন্ধু হাতের ইশারায় হাসানকে বারণ করলেন। বললেন―তোর এসব ঝামেলা করতে হবে না, আমার একদমই খিদে নেই। বরং ঘরে চা থাকলে, কড়া লিকারের এক কাপ আদা চা বানিয়ে আন আমার জন্য। ভিজে যাওয়া শরীরটা চাঙ্গা হোক।
দুই.
রান্নাঘর থেকে দুই কাপ কড়া লিকারের চা বানিয়ে হাসান শোবার ঘরে ঢুকল। এদিকে বঙ্গবন্ধু বেশ আরাম করে দুই পা তুলে বিছানায় বসে আছেন। তার কোলের ওপর তার সেই বইটি। তিনি হাত বাড়িয়ে হাসানের কাছ থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে বেশ লম্বা করে চুমুক দিলেন। বললেন―বাহ, চা’টা বেশ ভালো হয়েছে। এই আদা চা আমার খুব প্রিয়। হাসু কত যে আমাকে আদা চা বানিয়ে খাওয়াত! তারপর চায়ের কাপটা বিছানার ওপর রেখে বইটার দিকে তাকিয়ে বললেন―আমার এই লেখা শুধু শুধু পড়ে কী লাভ যদি কেউ তা নিজের ভেতর ধারণ না করে! হাসান চুপ করে থাকে, তারপর অনুযোগ আর অভিমানের সুরে উত্তর দেয়―আমি তো সামান্য একজন। আপনার দলের ভেতরের বড় বড় অনেক নেতাই তো এখন পর্যন্ত এই অমূল্য বইটির পাতা উল্টিয়েও দেখেনি! বঙ্গবন্ধু তার কালো তামাকের পাইপে ছোট একটা টান দিয়ে বলেন―জানি, জানি, আমি সবই জানি! আমি এখন যতটুকু আছি তা কেবল এদের মুখেই আছি, অন্তরে নেই! হাসান খুব সহজ ভঙ্গিতে চেয়ারটা টেনে বঙ্গবন্ধুর মুখোমুখি হয়ে কিছুটা ঝুঁকে বসে। বঙ্গবন্ধুও আরাম করে বিছানায় গা এলিয়ে দেন।
হাসান গাঢ় গলায় বলল―আগামীকাল আমাদের জাতীয় শোক দিবস, আপনার শাহাদাতবার্ষিকী! বঙ্গবন্ধু নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে পাইপে আয়েশি টান দিয়ে হাসেন―হুম, জানি― আই নো ভেরি ওয়েল! রক্তাক্ত আগস্ট, দুঃসহ বেদনার আগস্ট! কথা বলতে বলতে তাঁর গলা ধরে আসে, চোখের কোণ ভিজে আসে। আনমনে বললেন―আবার আসিব ফিরে আমি আমার সোনার বাংলায়! তারপর কান্না জড়ানো কণ্ঠে বললেন―আমি নেই, আমাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। জানিস, এর জন্য আমার বিন্দু পরিমাণ আক্ষেপ নেই! কিন্তু খুব কষ্ট হয়, আমার বুকটা ফেটে যায় যখন ভাবি―আমার কলিজার টুকরা, সাত রাজার ধন রাসেলকেও ওরা হত্যা করল! কী করে পারল এরা আমার মাসুম বাচ্চাটার বুকে গুলি চালাতে? এরা কত জঘন্য, কত পাষণ্ড! অথচ এদের চেহারা অবিকল মানুষের মতো, তাই না? ঘরে পিনপতন নিস্তব্ধতা! হাসানের চোখ ঝাপসা হয়ে গেছে। সে নীরবে বঙ্গবন্ধুর হাতের ওপর তার হাতটা রাখে। এক অব্যক্ত কষ্টে সে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। বঙ্গবন্ধু হাসানের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন পরম মমতায়। এতে তার বুকের ভেতর জমে থাকা কষ্টটা কিছুটা দূর হয়।
তিন.
পনেরই আগস্টের সকাল। সকাল থেকেই মেঘলা আকাশ। হালকা ঝিরঝির করে বৃষ্টি ঝরছে। ক্লাবঘরের মাইকে বাজছে সেই গানটা- ‘যদি রাত পোহালেই শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই…!’ আহা, হাসান যেন আবার ঘোরের ভেতর চলে যায়! তার মনে হল বঙ্গবন্ধু আজ আবার ফিরে এলেন! তিনি বঙ্গভবনে না গিয়ে সরাসরি বত্রিশ নম্বরে চলে এসেছেন। তিনি যে আবার ফিরে আসবেন, আসতে পারেন―এটা কারও মাথায় একদমই ছিল না। কিন্তু তিনি আবার ফিরে এলেন এই দেশে, এই বাংলায়, এই মধ্য আগস্টের বৃষ্টিস্নাত ঢাকায়!
বত্রিশ নম্বরে সংক্ষিপ্ত গার্ড অব অনার গ্রহণ করে তিনি দোতলায় চলে গেলেন দৃপ্ত পায়ে। পাইপে তামাক পুরে, ড্রয়ার থেকে দিয়াশলাই বের করে আগুন ধরালেন। আহা, কত দিন যে তাঁর এই প্রিয় তামাক আর পাইপ একাকী পড়েছিল এই টেবিলের ওপর! তিনি এক বুক হাহাকার নিয়ে দোতলার সবগুলো ঘর ঘুরে ঘুরে দেখলেন। তারপর নিজেকে কিছুটা শান্ত করে তিনি একে একে সবাইকে লাল টেলিফোন থেকে ফোন করলেন। সবার নম্বর তো তাঁর মুখস্থ। খন্দকার মোশতাক, জেনারেল জিয়া, জেনারেল শফিউল্লাহ, ফারুক, রশিদ, ডালিম থেকে শুরু করে সবাইকে তিনি ডেকে পাঠালেন বত্রিশ নম্বরে। তিনি আরও যাদের প্রয়োজন মনে করলেন, আরও যারা সেদিনের ঘটনার সাথে ছিল―সবাইকে ডেকে পাঠালেন।
বঙ্গবন্ধুর টেলিফোন পেয়ে প্রথমে কেউ বিশ্বাস করেনি গলার স্বর। কিন্তু ভয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো এরা সবাই আসতে বাধ্য হলো বত্রিশ নম্বরে। তিনি দোতলার বারান্দায় সাদা ধবধবে পায়জামা-পাঞ্জাবির ওপর মুজিবকোট পরে দাঁড়িয়ে আছেন। একে একে সবাই চোরের মতো, অপরাধীর মতো, বজ্রাহতের মতো, অভিসম্পাতে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার মতো বত্রিশ নম্বরের বাড়িটির গেইটের সামনে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াল। তিনি এদের সবার এই অসহায় অবস্থা দেখে মনে মনে হাসলেন। তারপর ঘৃণার একদলা থুতু খুব জোরে দোতলা থেকে নিক্ষেপ করলেন এদের দিকে! আরেকবার তিনি কালো তামাকের পাইপে আগুন ধরালেন। তারপর খুব ধীর, শান্ত আর ভারী পদশব্দে সুরভিত তামাকের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে সিঁড়ি দিয়ে নেমে সারিবদ্ধ দাঁড়ানো মুখগুলোর মুখোমুখি দাঁড়ালেন!
তিনি প্রথমে মোশতাকের দিকে তাকিয়ে একটা করুণার হাসি দিলেন। মোশতাকের পা কাঁপছে। বঙ্গবন্ধু হাসতে হাসতে বললেন―মোশতাক, মীরজাফরও মনে হয় তোর মতো এত বেঈমান, বিশ্বাসঘাতক ছিল না রে! মোশতাক বঙ্গবন্ধুর দুই পা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে- মুজিব ভাই, আমারে মাফ কইরা দ্যান, আমারে মাফ কইরা দ্যান! যে অন্যায় আর বেঈমানি আমি করেছি তার কোনো ক্ষমা নাই! তবু আপনে আমারে মাফ কইরা দ্যান মুজিব ভাই! বঙ্গবন্ধুর চোয়াল শক্ত হয়ে আসে―চুপ, বেঈমানের বাচ্চা! তোর স্থান হাবিয়া দোজখেও যেন না হয়!
উফ, কী সেই দৃশ্য! কী সেই মুহূর্ত! তারপর তিনি এগিয়ে গেলেন বাদবাকি খুনিদের দিকে! তিনি তর্জনী নিক্ষেপ করতে লাগলেন সেই আজন্ম বিশ্বাসঘাতকদের অভিশপ্ত মুখগুলোর দিকে রাগে, ক্ষোভে, ঘৃণায়!
সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ