লিটল ম্যাগ : বইমেলা ২০২০ ও লিটলম্যাগ : একটি বিশ্লেষণ : আনোয়ার কামাল

প্রচলিত ধ্যান-ধারণাকে ভেঙে প্রথাগত ধারার বাইরে নতুনের কেতন ওড়ানোর মানসিক বিন্যাসে ছোটকাগজের জন্ম হয়ে থাকে। সেই ছোটকাগজটি কালের আবর্তনে ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে, আবার বেশিরভাগ কালের গহ্বরে হারিয়ে যায়। এই টিকে থাকা আর হারিয়ে যাওয়ার ভেতর দিয়ে ছোটকাগজ তার অমিত স্পর্ধার জানান দিয়ে যায়। ছোটকাগজ স্বনামে বেড়ে উঠলেও এখনকার ছোটকাগজগুলো কিন্তু আর আদৌ ছোট নয়। তার ব্যাপ্তি দেশ থেকে দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়ছে। আমি যদি বিশেষ করে বাংলাভাষাভাষির কাগজের কথাই বলি, সেখানে দেখতে পাবো আমাদের অগ্রজ-অনুজ-সমবয়সী বন্ধুরা পরবাসে বসেও বাংলা ভাষার কাজগগুলোকে বিশ্বায়নের এই যুগে ছড়িয়ে দিচ্ছে। আবার সেই পুরোনো ধ্যান-ধারণা থেকে অনেকটা অগ্রসর হয়ে বছরের পর বছর পত্রিকাটি টিকিয়ে রাখছেন। বর্তমানে যেমন প্রযুক্তির সহজলভ্যতার সুযোগ রয়েছে, তেমনি রয়েছে লেখা সংগ্রহ ও সংরক্ষণেরও। এসব কারণে বেশ বড় বড় আকার আকৃতির ওজনদার পত্রিকাও বের হয়ে আসছে হরহামেশা।
সেই ছোটকাগজ বর্তমানে তার শরীরে মাংস বৃদ্ধির মতো ফুলে ফেঁপে ঢাউস আকারের অনেক কাগজ আমরা হাতে পাচ্ছি। বাণিজ্যিক কাগজের সাথে ছোটকাগজের রয়েছে যোজন যোজন দূরত্ব। বণিজ্যিক কাগজের যেখানে রয়েছে মত প্রকাশের সীমাব্ধতা, সেখানে ছোটকাগজ অনেকটা বেপরোয়া। এই কারণেই বেপরোয়া লাগামহীন বলছি যে, তাকে আটকানোর, তার মত প্রকাশে বাধা দেওয়ার মতো প্রাতিষ্ঠানিক বিধিনিষেধ নেই; বা তার কোমরে দড়ি দিয়ে পিছনমুখে টেনে ধরে রাখবে এমনটি হওয়ার নয়। আবার ছোটকাগজের সাহসী সম্পাদকেরা এসবকে তোয়াক্কাও করেন না। ফলত, লাগামহীন-বাধাহীন খাপখোলা তলোয়ারের মতো নতুন লিখিয়েদের কলমের খোঁচায় তরতরিয়ে বেড়ে ওঠে ছোটকাগজগুলো।
ছোটকাগজ বা লিটল ম্যাগাজিনের আন্দোলন মূলত প্রচলিত ধ্যান ধারণার বাহক ‘প্রতিষ্ঠান’-এর পাঁচিলকে ভেঙে নতুনকে আহ্বান, নতুন সৃষ্টি, নতুনে অবগাহন। আবার নতুনকে ভেঙে আরেক নতুনে প্রত্যাগমন। লিটল ম্যাগাজিন সংশ্লিষ্ট সকলের মধ্যে মতবিনিময়, চিন্তার আদান-প্রদান, প্রকাশনার সংকট ইত্যাদি নিয়ে এ মেলায় বিস্তর আলোচনার অবকাশ তৈরি করেছে বলে আয়োজকরা জানান। এ ছাড়া লিটল ম্যাগাজিন কর্মীরা মিলিত হতে চায় একটি পরিসরে, পরস্পরকে চেনাজানার জন্য এবং পাঠককে জানানোর জন্য যে, এই আমরাই গড়ে তুলেছি আজ এবং আগামীর সাহিত্যের নন্দন; আমরাই প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যের পাশাপাশি আমাদের বিকল্প সৃষ্টির আয়োজন মেলে ধরতে চাই। মেকি সাহিত্য-কারবারিদের ভিড়ে আমরা হারিয়ে যাইনি; আমরা আমাদের হট্টগোলকে ডুবতে দিইনি। এখানেই এ মেলার সার্থকতা রয়েছে। রয়েছে অনিবার্য স্বকীয়তা। মেলা সার্থক হয়েছে বলে অংশগ্রহণকারীরা জানান। এবার বই মেলায় বেরুনো ছোটকাগজগুলো নিয়ে কিছু আলোকপাত করবার চেষ্টা করব। প্রতি সংখ্যায় দুই থেকে তিনটি করে কাগজ নিয়ে ধারাবাহিক একটি লেখা হবে, যা পাঠককে নিশ্চয় একটি ছোটকাগজ নিয়ে কিছুটা হলেও চিন্তার খোরাক জোগাবে, ভাবনার জগৎকে প্রসারিত করবে, উসকে দেবে।
এবারই প্রথম বাংলা একাডেমির বহেরাতলা থেকে মূল মেলা প্রাঙ্গণের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লিটলম্যাগ চত্বর নিয়ে আসা হয়েছে। যা ইতোপূর্বে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বহেরাতলায় ফিবছর স্টল বরাদ্দ দেওয়া হতো। এবার সর্বাধিক ১৫৬টি স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়। গত অমর একুশে গ্রন্থমেলাকে কেন্দ্র করে অনেকগুলো লিটলম্যাগ বেরিয়েছে। আবার কেউ কেউ মেলার আগেভাগেই বের করেছে। কেউবা মেলা চলাকালীন বের করেছে। মেলা ঘুরে দেখা এবং সংগ্রহ করা ম্যাগাজিনগুলো হলো : বইকথা, শঙ্খদ্বীপ, মাটি ও বাংলা, শব্দকুঠি, ভ্রমণগদ্য, বুনন, উদ্যান, ঘুংঘুর, উজান, লেখমালা, হাইফেন, ছায়া, দৃষ্টি, ব্যাটিংজোন, রূপান্তর, পাতাদের সংসার, জীবনানন্দ, ৎ (খণ্ড ত), আবেগ, শিং, পালকি, চর্যাপদ, পরাগ, ঝিনুক, অনুরণন, শব্দ, অনুভূতি, দ্রষ্টব্য, লোক, জল, চিহ্ন, মগ্নপাঠ, কবিতাপত্র, ঈক্ষণ, নিসর্গ, এবং মানুষ, একবিংশ, মুক্তগদ্য, ভিন্নচোখ, বর্ণিল, বিরাঙ, চিহ্ন, হস্তাক্ষর, যমুনা প্রভৃতি। অপর দিকে দুটি সাহিত্য পত্রিকা সংগ্রহ করেছি তা হচ্ছে অনুপ্রাণন ও সরোবর।
চর্যাপদ
সম্পাদক আযাদ নোমান। শিল্প- সাহিত্যের এ ছোটকাগজটি দীর্ঘ তেত্রিশ বছর যাবত বেরুচ্ছে। এবার বইমেলাকে কেন্দ্র করে বের করেছে ১৩তম সংখ্যা। মহান ভাষা শহিদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে এ সংখ্যায় কবিতা, কবিতা বিষয়ক আলোচনা, কয়েকজন কবির পাঠমূল্যায়ন, প্রবন্ধ, গল্প, অনুবাদপর্ব দিয়ে সাজানো হয়েছে।
‘ফ্রাঞ্জ ফাঁনোর (ঋৎধহঃু ঋধহড়হ) চিন্তা ও দর্শন’ শিরোনামে মইন কবির একটি দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পর উপনিবেশ বিরোধী ও বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনে যে ক’জন বুদ্ধিজীবী চিন্তা ও লেখনী দিয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ফ্রাঞ্জ ফাঁনো তাঁদের মধ্যে অন্যতম। মাত্র ছত্রিশ বছরের জীবনে ইষধপশ ঝশরহ, ডযরঃব গধংশং (১৯৫২ সালে প্রকাশিত) এবং ডৎবঃপযবফ ড়ভ ঃযব ঊধঃয (১৯৬১ সালে প্রকাশিত) চড়ংঃ ঈড়ষড়হরধষ চিন্তা জগতে বিপ্লব এনে দিয়েছিলেন। যার প্রভাব অদ্যাবধি বিরাজমান। ইউরোপ, আমেরিকা ও আফ্রিকার রাষ্ট্রিক ও সামাজিক জীবন পরিবর্তনে এবং মনোজগৎ গঠনে ফাঁনো অসাধারণ অবদান রেখেছেন।
ফাঁনোর আজন্ম বিশ্বাস ও দর্শনের রূপরেখা যেন সামগ্রিমভাবে সকল উপনিবেশাধীন মানুষের বিশ্বাস ও দর্শন। কালো মানুষের রক্ত ও ঘামমিশ্রিত শ্রম ছিল তাঁর কাছে ‘ৎবংঁষঃ ড়ভ ড়ৎমধহরুবফ ঢ়ৎড়ঃবপঃবফ ৎড়ননবৎু নু ঃযব যিরঃব ঢ়বড়ঢ়ষব’ কালো মানুষের প্রতি গভীর দরদ নিয়ে তিনি উচ্চারণ করেছিলেন―ও ধস নষধপশ হড়ঃ নবপধঁংব ড়ভ ধ পঁৎংব ড়ভ ধ পঁৎংব, নঁঃ নবপধঁংব সু ংশরহ যধং নববহ ধনষব ঃড় পধঢ়ঃঁৎব ধষষ ঃযব পড়ংসরপ বভভষাঁরধ. ও ধস ঃৎঁষু ধ ফৎড়ঢ় ড়ভ ংঁহ ঁহফবৎ ভৎবব বধৎঃয. লিউকোমিয়ায় আক্রান্ত ফাঁনো হয়তো শেষ নিঃশ্বাস ছেড়েছিলেন সেই আইভরি কোস্টের কালো কবি ইবৎহধৎফ উধফরব এর বিখ্যাত সেই কবিতা এরাব ুড়ঁ ঃযধহশং সু এড়ফ―এভাবেই মইন কবির তাঁর আলোচনায় ফ্রাঞ্জ ফাঁনোর চিন্তা ও দর্শনের এক অনুপুঙ্খ আলোকপাত করেছেন।
‘কবিতার কলা-কৌশল এবং দিশা’ শিরোনামে ফরিদ আহমদ দুলাল তাঁর প্রবন্ধে লিখেছেন―‘কবিকে নির্দিষ্ট ছকে চলতে হয়, নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে কবিতা লিখতে হয়। তবে কি কবি নিয়মের নিগড়ে শৃঙ্খলিত? যে শৃঙ্খল অদৃশ্য শৃঙ্খলকে ভাঙা সহজ নয়। কবিকে তাই শৃঙ্খলকে জীবনের সাথে সমন্বয় করে চলতে হয়; কিন্তু শৃঙ্খলের যন্ত্রণা কবিকে সর্বদা পীড়িত করে এবং আমি আমার অভিজ্ঞতার আলোকে বুঝি, শৃঙ্খলকে সমন্বয় করে নেওয়াই যোগ্যতা। প্রচলিত প্রকরণ ভাঙার অধিকার কবির নিশ্চয় থাকে, তবে তা অর্জন করে নিতে হয় অনুশীলন-পাঠ ও চর্চায়।’ “কবিতার কৌশলটা বুঝে নিতে সচেষ্ট হচ্ছি কবিতা ‘প্রচারেই প্রসার’ নয়। মিডিয়ার অনুগত নয় কবি; কিন্তু মিডিয়া চায় কবিতাকে শৃঙ্খলিত করতে। প্রচার মাধ্যমকে গ্রহণীয় উচ্চতায় রাখতে যে কোনো প্রচার মাধ্যমকেই পাঠক-দর্শক- শ্রোতার কাছে প্রয়োজনীয় প্রমাণের আবশ্যিকতা আছে; এবং সে আবশ্যিকতা আছে বলেই পত্রিকা-টেলিভিশন বা বেতারে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির বিভিন্ন অনুষঙ্গের সাথে ‘কবিতা’ উপস্থাপনের প্রয়োজন পড়ে।”―কবিতা বিষয়ক এ আলোচনাটি কবিতাকর্মীদের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সুখপাঠ্য হয়েছে বলে আমার কাছে মনে হয়। অগ্রজ এ কবির গদ্য লেখায় আমি মুগ্ধ এক পাঠক, এ লেখাটিতেও তার ব্যত্যয় হয়নি। কবিতা বিষয়ক দীর্ঘ এ প্রবন্ধে কবিতার সাথে যাদের বসবাস তাদের সবারই পাঠ করা উচিত।
কবিতা বিষয়ক আরও একটি লেখা ‘কবিতার পাঠ প্রসঙ্গে’ লিখেছেন― মেহেদী মাহমুদ চৌধুরী। কবিতা পাঠ প্রসঙ্গে তার একটি গোছালো সমৃদ্ধ লেখা কবিতাপাঠ করে বোঝেন না বা কবিতার প্রতি যাদের অগাধ আস্থা বা বিশ্বাস জন্মেছে, তাদের জন্য সময়োপযোগী একটি লেখা। তিনি লিখেছেন―‘কবিতা পাঠের তৃপ্তি কেমন তা অনুধাবন করাও খুব জরুরি। কিন্তু এই তৃপ্তি মানবনিরপেক্ষ নয়। শব্দের সাথে শব্দ মিলিয়ে তৈরি হয় বাক্য। তৈরি হয় অর্থ-ব্যঞ্জনার। তা ঘটে মানুষের কারণেই। আমি এর সাথে তুলনা করব দাবা খেলার। দাবার ঘুঁটিগুলো আপাতত দৃষ্টিতে নিষ্প্রাণ-নিশ্চল। কিন্তু যারা দাবা খেলেছেন তারা জানেন যে, এই নিষ্প্রাণ-নিশ্চল ঘুঁটিগুলো কল্পনা-বুদ্ধির জগতে যে কী আলোড়ন তুলতে পারে। শব্দের জগৎও একই রকম। এমনিভাবে তিনি উপমার সাথে কবিতা পাঠের আনন্দময় অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন।
কবিতা পাঠ প্রসঙ্গে একটি মূল্যবান লেখা স্থান পেয়েছে এখানে। লিখেছেন―মেহেদী মাহমুদ চৌধুরী। যারা বলেন কবিতা বুঝি না। যাদের কাছে কবিতা পাঠ করলে দুর্বোধ্য মনে হয় তাদের উদ্দেশ্য করে লেখক প্রবীণ-নবীন কবিদের কবিতা উদ্ধৃত করে ব্যাখ্যা করেছেন। এ থেকে কবিতা পাঠক অনেকটা উপকৃত হবেন। তাদের জানার দুয়ার উন্মোচিত হবে।
সৈকত হাবিব ‘শহীদ কাদরী : স্মৃতিই যেখানে নায়ক’ শিরোনামে লিখেছেন, ‘কবি শহীদ কাদরী তো আগেই চলে গিয়েছিলেন মানসিকভাবে দূরে পরবাসে। এবার গেলেন শারীরিকভাবেও, চিরপরবাসে।’ সৈকত হাবিবের ভাষায়―‘যে শহীদ কাদরীর মূর্তি আমাদের মগজে আছে, তিনি কেবলই এক ধূসর স্মৃতি। আমাদের প্রজন্মের কাছে তিনি শারীরিকভাবে অচেনা, আমাদের কৈশোরে তিনি স্বেচ্ছানির্বাসিত―প্রথম জার্মান দেশ, পরে মার্কিন মুল্লুকে। অনেকটা নির্বাসিত ছিলেন কবিতা থেকে। ফলে আমাদের প্রজন্মের কাছে তিনি বইপত্রে, গল্পে, আড্ডায় ও সতীর্থদের স্মৃতিচারণ সূত্রেই সজীব।’ এভাবেই তিনি শহীদ কাদরীকে না পাওয়ার বেদনা ব্যক্ত করেছেন এ প্রবন্ধে।
এ সংখ্যায় গল্প লিখেছেন―মুন্সী রফিক হাসান, নূর কামরুন নাহার ও নাহিদ হাসান রবিন। তিনটি গল্পই ভালো লেগেছে। পাঠকরা এ গল্পগুলোতে নতুন নতুন আস্বাদন অনুভব করবেন।
এ সংখ্যায় কবিতা লিখেছেন―মাহমুদ কামাল, শিহাব শাহরিয়ার, হামিম কামরুল, আইউব সৈয়দ, বেনজিন খান, অলোক বিশ্বাস, বদরুল হায়দার, আযাদ নোমান, কামরুল বাহার আরিফ, উমাপদ কর, আশিক আকবর, মুজিব মেহেদী, অনিকেত শামীম, রহমান হেনরী, আমিনুল ইসলাম, মাসুদ পথিক, বীরেন মুখার্জী, আয়শা ঝর্না, সমর চক্রবর্তী, রাহমান ওয়াহিদ, মাসুদার রহমান, রাসেল আশেকী, রেজা রাজা, আনোয়ার কামাল, আসাদ উল্লাহ, মাসুদ মুস্তাফিজ, শাহীন তাজ, মাহবুবা ফারুক, মাহফুজ মুজাহিদ, ফিরোজ আহমেদ, মোহাম্মদ হাসানুর রহমান, তুষার প্রসূন, রিজোয়ান মাহমুদ, বনি ইসরাইল, দালান জামান, নবনিতা রুমু সিদ্দিকা, সানাউল্লাহ সাগর, রহিমা আফরোজ মুন্নি, অনু ইসলাম, বঙ্গ রাখাল, শাহিন লতিফ, তিথি আফরোজ, দীপংকর মারডুক, ফরহাদ নাইয়া ও আতিকুর রহমান হিমু।
বার্মিজ লোকসাহিত্য নিয়ে অনূদিত গল্প বিভাগে লিখেছে―হাসান চৌধুরী। ঝরঝরে লেখায় অনূদিত গল্পটি পাঠ করে বার্মিজ লেখকদের সাহিত্য সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ হলেও ধারণা পোষণ করা গেল। ভালো লেগেছে। ধন্যবাদ হাসান চৌধুরীকে।
১৭৬ পৃষ্ঠার দুইশত টাকা মূল্যের নান্দনিক কাগজ ‘চর্যাপদ’; প্রকৃতপক্ষেই একটি ভিন্ন আমেজে উপস্থাপিত হয়েছে। সম্পাদক আযাদ নোমানের মুন্সিয়ানায় এর লেখক তালিকা ও অঙ্গসৌষ্ঠব দেখে সব ধরনের পাঠককে কাছে টানবে বলেই আমার বিশ্বাস। কাগজটি ব্যাপক প্রচার ও পাঠকপ্রিয়তা পাক, এ কামনাই রইল।
একবিংশ
সম্পাদকীয়তে শেষে এসে সম্পাদক জানান দিচ্ছেন―‘চারদিকে প্রবল প্রকট হয়ে উঠছে ভিন্ন এবং বিরোধী ধারা, বিরোধী শক্তি।’ হ্যাঁ। অত্যন্ত খাঁটি কথা উপযুক্ত সময়েই বলেছেন। আমাদেরও শক্তিশালী হয়ে উঠতে হবে, নেতিয়ে পড়লে চলবে না। শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে হবে। এ কারণেই আপনার মতো সম্পাদকের বড্ড বেশি প্রয়োজন। সেই সাথে ‘একবিংশ’কেও সাহসী উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে নিতে হবে ঝড়-ঝঞ্ঝা ভেদ করে।
এ সংখ্যায় মুবিন চৌধুরী ‘দক্ষিণ এশিয়ায় অধ্যয়নের ভবিষ্যৎ’ শিরোনামে আইজাজ আহ্মদ এর অত্যন্ত সাবলীল ভঙ্গিতে অনূদিত লেখাটি পাঠককে আকৃষ্ট করবে। তিনি লিখেছেন, ‘বৈশি^ক ভাষা হিসেবে ইংরেজি অপ্রয়োজনীয় হবে না তবে সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের ভাষা হিসেবে এটি অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠতে পারে। তবে একে অপ্রয়োজনীয় হতে হলে ওই ভাষার জ্ঞান বা তার বিশেষ সম্পত্তি তাকে নিজস্ব ভাষায় নিয়ে আসতে হবে। কিন্তু হিন্দি বা অন্যান্য ভাষার পিছিয়ে পড়া বুদ্ধিবৃত্তি দিয়ে তা সম্ভব নয়।’ এ প্রবন্ধে মূলত সাহিত্যে শ্রেণি বিরোধের বস্তুগত ক্ষেত্র নিয়ে বিশদভাবে আলোকপাত করা হয়েছে।
‘আব্দুল হকের চিন্তাচর্চা : কাল থেকে কালান্তরে’ শিরোনামে মাহবুব বোরহান আব্দুল হকের জন্মশতবর্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়ে লিখেছেন। বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিসত্তার সাথে গভীর এক সম্পর্কসূত্রে আবদ্ধ আব্দুল হক (১০ অক্টোবর ১৯১৮ থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭)। আব্দুল হকের সাহিত্য সাধনা, কলমসৈনিক, সর্বোপরি তিনি যে একজন চিন্তাবিদ ছিলেন তারই এক অনুপম আলোচনা উঠে এসেছে। ব্যক্তিজীবনে স্বপ্রতিষ্ঠিত এই মানুষটি পাহাড়-সমান প্রতিকূলতার মধ্যেও মুহূর্তের জন্য নিজের নৈতিক বিবেচনা ও স্থির সত্যনিষ্ঠা থেকে বিচ্যুত হননি। জন্মগ্রহণের একশত বছর পরেও তিনি আমাদের দেশ, জাতি, ভাষা সর্বোপরি বিশ্বমানবতার জন্যও অত্যন্ত গভীরভাবে প্রাসঙ্গিক এবং প্রয়োজনীয়। মানুষের সার্বিক শুভবোধ, শাশ্বত ন্যায়পরায়ণতা ও সর্বমানবীয় কল্যাণ চেতনার বিকাশে কাল থেকে কালান্তরে আব্দুল হকের চিন্তা পাথেয় হয়ে থাকবে। কারণ, আমরা তো ভুলে যাচ্ছি আমাদের অগ্রজদের যারা আমাদের মননে প্রোথিত হয়ে থাকবার কথা। একটি সুখপাঠ্য প্রবন্ধ উপস্থাপনের জন্য মাহবুব বোরহানকে ধন্যবাদ দিতেই হবে।
জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতার ‘সাহিত্য এবং জাতীয় চেতনা’ শিরোনামের লেখাটি ভাষান্তর করেছেন লিটন চক্রবর্তী মিঠুন। ‘ধর্ম ও সাহিত্য বিষয়ক এক সিম্পোজিয়ামে টি.এস. এলিয়টের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রবন্ধে বলা হয়েছে, ‘সাহিত্যের প্রতি উদারবাদী দৃষ্টিভঙ্গি কাজে লাগবে না’। তার মতে মহৎ সাহিত্যের উচিত প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক জীবনের চেয়ে অতিপ্রাকৃতিক জীবনকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া। অন্য কথায়, সাহিত্যকে হতে হবে জীবনদর্শন, কোন উত্তরণমূলক তাৎপর্যের দৃষ্টিস্বরূপ। তিনি আরও বলেছেন, ‘আমি এমন একটা সাহিত্য চাই যেটা ইচ্ছাকৃত ও জবরদস্তিমূলক হওয়ার চেয়ে বরং অবচেতনভাবেই খ্রিস্টীয় হবে।’ অনেক জ্ঞানগর্ভ আলোচনা তুলে ধরেছেন জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা তাঁর প্রবন্ধে আর চমৎকার ঝরঝরে অনুবাদ আমাদের পাঠে সহজবোধগম্য করে উপস্থাপন করেছেন লিটন চক্রবর্তী মিঠুন। ভালোলাগা একটি প্রবন্ধ পাঠককে নিশ্চয় আনন্দ দেবে, চেতনায় টোকা দেবে।
রণজিৎ মল্লিক ‘জীবনানন্দ দাশের প্রবন্ধাবলি’ নিয়ে তথ্যসমৃদ্ধ একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছেন। এখানে জীবনানন্দ দাশের (১৮৯৯-১৯৫৪) প্রধান পরিচয় কবি হলেও তিনি যে বেশ সমৃদ্ধ কিছু প্রবন্ধ লিখেছেন তারই এক আলেখ্য উঠে এসেছে আলোচ্য প্রবন্ধে। জীবদ্দশায় তিনি কবিতার পাশাপাশি গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, এবং বেশ কিছু চিঠিপত্র লিখেছেন। জীবনানন্দের যেসব গদ্য রচনাবলি আবিষ্কৃত ও প্রকাশিত হয়েছে, (যদিও অনেক আগেই সেসবের কিছু কিছু প্রকাশিত), তবু এখনও অবদি বাঙালি পাঠক সমাজের এক বড় অংশ জীবনানন্দের গদ্য রচনা থেকে এক প্রকার বিমুখ রয়েছে বলেই মনে করা যায়। বাংলাদেশে জীবনানন্দকে নিয়ে আব্দুল মান্নান সৈয়দ গবেষক হিসেবে সুকৃত, সুখ্যাত ও সুপারিচিত হয়েছেন। জীবনানন্দ গবেষক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী প্রকাশ করেছেন ‘জীবনানন্দ দাশের প্রবন্ধসমগ্র’। ইদানীং জীবনানন্দ দাশের গল্প উপন্যাস নিয়ে অনেকের মধ্যে আগ্রহের সৃষ্টি করলেও প্রবন্ধাবলি নিয়ে সেরকম তেমন কোনো আলোচনা দেখা যায় না। অথচ জগৎ, জীবন, সমাজ-সাহিত্য-কবিতা ইত্যাদি বিষয়ে জীবনানন্দের চিন্তা-ভাবনার অনেক অনির্ণিত দিক ও সেসবের গভীরতা সম্পর্কে অনেকখানি সহজ ধারণা পাওয়া যেতে পারে তার প্রবন্ধাবলিতে। অনেক তথ্য সংবলিত এ প্রবন্ধটি জীবনানন্দ দাশের ভক্ত-অনুরাগীদের উপকারে আসবে বলেই আমার বিশ্বাস। লেখককে সাধুবাদ দিতেই হবে, তার এ সুখকর রচনাটি উপহার দেওয়ার জন্য।
‘পুরস্কার-প্রীতি’ শিরোনামে সাইফুল ইসলামের ভিন্নমাত্রার একটি লেখা আমরা এ সংখ্যায় পড়তে পারি। তিনি শুরুতেই বলেছেন, বাংলাদেশের অভিজ্ঞতায় আমাদের পরিচিত সাংস্কৃতিক অঙ্গনের একটি বিশেষ প্রবণতার নাম পুরস্কার-প্রীতি। যিনি কবিতা লেখেন তিনি পুরস্কার পেতে চান, যিনি গল্প-উপন্যাস লেখেন, তিনি পুরস্কার পাওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন। যিনি বিদেশি ভাষা থেকে গল্প, উপন্যাস কিংবা অন্য কোনো বিষয় অনুবাদ করেন, তিনিও পুরস্কার পাওয়ার জন্যে চাতকের মতো চেয়ে থাকেন। অপরদিকে যিনি গান করেন, ছবি আঁকেন, ভাস্কর্য নির্মাণ করেন, নাচ দেখান, আবৃত্তি করেন, নাটকে কিংবা সিনেমায় অভিনয় করেন, এঁরা প্রত্যেকেই পুরস্কারের জন্য মনে মনে একটা নিঃশ্বাসহীন বাসনা জিইয়ে রাখেন।
পুরস্কার-প্রীতি―দুদিক থেকেই বিপদজ্জনক। সরকার যখন কাউকে পুরস্কার দেয়, মনে করে রাখা ভালো, তার অর্থমূল্যটা জনগণের অথচ সরকার সেটা নিজের কাজে খাটায়! অপরদিকে যিনি পুরস্কার গ্রহণ করেন, তাঁরও ভেবে দেখা দরকার, পুরস্কারের টাকাটা সরকারের নয়। কাজেই তাঁর পুরস্কার নেওয়ার দায়টা স্বীকার করতে হয় জনসাধারণের কাছে, সরকারের কাছে নয়। এটাই তাঁর ন্যায্য দায়। এ দায় যদি সত্যি সত্যি স্বীকার করা হয়, তবে সঙ্গে সঙ্গে দুটো মৌল প্রশ্ন ওঠে। প্রথম প্রশ্ন এই যে, সাহিত্য রচনার জন্য আমি যদি জনগণের কাছ থেকে পুরস্কার নিই, তবে সে তা এক ধরনের বিনিময়মূল্য, এর সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক কোথায়? ভালোবাসার কি কোনো বিনিময় মূল হয়? দ্বিতীয় প্রশ্নটি নৈতিকতার। জনসাধারণের কাছে, সমাজের ওপর আমার কী কোনো দায়বদ্ধতা নেই? জন্ম থেকেই তো আমি সমাজের থেকে গ্রহণ করছি! সমাজকে আমি কী দিচ্ছি? এই বিবেচনায় বলা ভালো―সমাজকে আমরা কেউ কিছু দিতে পারি না। সে চেষ্টাও বৃথা। এই পুরস্কার-প্রীতি আর পুরস্কার প্রাপ্তি নিয়েই তার সরেস এক কাঠি লেখা পাঠককে আনন্দ দেবে। পাশাপাশি কীভাবে পুরস্কার দেওয়া এবং নেওয়া হয়ে থাকে বা হচ্ছে তারও একটি চিত্র এ লেখায় তুলে ধরা হয়েছে। ভালো লাগলো তার এ অনিন্দ্য সুন্দর লেখাটি পাঠ করে।
‘ঔপনিবেশিকতা কি এখনও অস্তিমান?’ এবং ‘সাহিত্যিক উত্তর- ঔপনিবেশিকতার রাজনীতি’ শিরোনামে দুটি সমৃদ্ধ অনুবাদ পাঠকের ভাবনায় টোকা দেবে; আর তার ভেতর দিকে আমাদের উপনিবেশিকতার নানান দিক চোখে আঙুল দিয়ে ধরিয়ে দেবে।
মুক্তভাষ্য বিভাগে অঞ্জন সেন ‘সহজ কমল কথা’ শিরোনামে লিখেছেন। গ্রন্থালোচনা বিভাগে জিললুর রহমান ‘ম্যানগ্রোভ মন, শক্তি আর লাবণ্যঝরা এক কাব্যগ্রন্থের নাম’ শিরোনামে কবি রাজু আহমেদ মামুনের কবিতাগ্রন্থ নিয়ে সুন্দর একটি আলোচনা করেছেন।
এ সংখ্যায় মোট ৩০ জন কবির কবিতা ছাপা হয়েছে। তাঁরা হচ্ছেন―কামরুল ইসলাম, ওমর সামস, রেজাউদ্দিন স্টালিন, ফেরদৌস নাহার, বদরুল হায়দার, দীপঙ্কর মাহমুদ, হাফিজ রশিদ খান, শরীফ শাহরিয়ার, কামরুল হাসান, মোশতাক আহমদ, ফারহান ইশরাক, অরুণিমা নাসরীন, জাহেদ সরওয়ার, তুহিন দাস, সৈয়দ আফসার, অরবিন্দ চক্রবর্তী, ফিরোজ মাহমুদ আহসান, সেঁজুতি বড়ুয়া, হাসান মাসরিফ, নিলয় রফিক, আনিসুর রহমান, সুহিতা সুলতানা, মুক্তি মণ্ডল, দুলাল সরকার, সৌম্য সালেক, আনোয়ার কামাল, নিঃশব্দ আহামদ, সাইয়্যিদ মঞ্জু, মীর রবি ও মালেক মুস্তাকিম।
একবিংশ এ সংখ্যাটি পাঠ করলে মূলত অনুবাদের আদিখ্যেতা লক্ষ করা যায়। ২৫২ পৃষ্ঠার কাগজটিতে প্রায় অর্ধেক পৃষ্ঠাজুড়ে অনুবাদ সাহিত্যে ভরপুর। এ থেকে ভিনদেশি লেখা পাঠের একটা সুযোগ পাঠকদের হাতের মুঠোয় চলে আসবে। আবার মনে হতে পারে কেন এত এত অনুবাদ সাহিত্য। পাঠকের মনে এমন জিজ্ঞাসা আসতেই পারে।
একবিংশ: সম্পাদক কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক : খোন্দকার আশরাফ হোসেন। পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৫২ মূল্য : দুইশত টাকা। প্রকাশ কাল : ডিসেম্বর ২০১৯, প্রচ্ছদের ছবি দেওয়ান মিজান । গুণে-মানে অনিন্দ্য সুন্দর এ কাগজটির ভেতরে সম্পাদনা পরিষদের চোখ এড়িয়ে কিছুটা বানান বিভ্রাট রয়েছে। তার পরেও কাগজটি উন্নত ছাপা-বাঁধাই ও লেখক মানে উন্নীত একটি কবিতা ও নন্দন ভাবনার কাগজ হিসেবে তার স্বাক্ষর রেখেছে। কাগজটির ব্যাপক প্রচার ও পাঠকপ্রিয়তা কামনা করছি।