ঘর সংসার : হোসেনউদ্দিন হোসেন

আমার ছাত্রজীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল মূর্তাজা আহমেদ। দুজনে একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত পড়েছি। একই হলে একই কক্ষে দুজনে। আমাদের অন্য বন্ধুরা আমাদের নিয়ে হাস্যরসিকতা করত। বলতো মানিকজোড়। কোথায়ও কোনেআ প্রয়োজনে বেরুলে দুজনে একই সঙ্গে বেরোতাম।
মূর্তাজা আহমেদ আর আমি কর্মজীবনে এসে আলাদা হয়ে গেলাম। আমি চলে গেলাম বিদেশ মন্ত্রণালয়ে একটি চাকরি নিয়ে। মূর্তাজা থেকে গেল দেশে। মাঝে মাঝে চিঠি-পত্রের মাধ্যমে তার সঙ্গে যোগাযোগ করতাম। একদিন সেই যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গেল। বিদেশে দূতাবাসে কূটনৈতিক দায়িত্ব ছিল আমার। নানারকম ব্যতিব্যস্ততার মধ্যে দিন কাটত। এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বন্ধু মূর্তাজার সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করতে পারিনি। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সম্ভব হয়নি। অর্থাৎ ঘটনাটি এমনি হয়ে উঠেছিল যে, আজ আমি প্যারিসে কাল চলে গেলাম লন্ডনে সেখান থেকে মস্কো। মস্কো থেকে ওয়াশিংটন। এই করতে করতেই জীবনের একটা বৃহৎ অংশ আমার কাটাতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত জাপান থেকে সোজা ঢাকায় এসে এক বছর হলো অবসর নিয়েছি। এখানেই আছি। ঘোরাফেরা করছি। একমাত্র সঙ্গিনী উষসি। তাকে নিয়ে কতটুকু ঘোরা যায়? বিদেশে আমার সঙ্গে থেকেও সে আমার ইদানীংকালের ছটফটে অবস্থা দেখে হাসিমশকরা করে। বলে, কোথায় আর ঘুরবা? পুরনো ঢাকা, নতুন ঢাকা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যাম। এ কোথায় আছি?
উষসি বাঙালি মেয়ে। কিন্তু তার বাবা মা থাকে লন্ডনে। সেই সূত্রে সে নিজেকে বলে লন্ডনি। এই লন্ডনিকে বিয়ে করে আমি অনেকটা বিদেশিভাবাপন্ন হয়ে উঠেছি। ঠিক বাঙালি হয়ে চলতেও ঠোক্কর খেতে হচ্ছে। চালচলনে ঢাকায় এসে কারও সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে নিতেও পারছি না। আমাদের দুটি পুত্র সন্তান আছে। তারাও থাকে বিদেশে। একজন নিউইয়র্কে। আর একজন লন্ডনে। যেহেতু দুজনেই লন্ডনে জন্মেছিল, সেহেতু দুজনেই লন্ডনের নাগরিক। বাংলাদেশে থাকতেও তারা রাজি নয়। উষসিও এদেশে থাকতে চায় না। এ বিষয়টি নিয়ে তার সঙ্গে আমার ঝগড়াঝাটি হয়। ওই পর্যন্তই, কী করব? এই কারণে মনের অবস্থাও আমার ভালো নেই।
মাস দুয়েক হলো, হঠাৎ করে ডাক বিভাগের পিয়ন এসে একটা চিঠি দিয়ে গেল আমার হাতে। খামের ওপরে খুব সুন্দর করে লেখা আমার নাম। প্রাপক জনি আহমেদ, বাড়ি নং-০০০, সড়ক-২২, তেজগাঁও, ঢাকা। বাম পাশে প্রেরকের নাম মূর্তাজা আহমেদ, ইলশেপুর।
‘মূর্তাজা আহমেদ’ নামটি পড়েই মনের মধ্যে একটা খুশির ঢেউ খেলে গেল। কতকাল আগেকার কথা। বহুকাল মূর্তাজাকে দেখিনি। আমার প্রিয় বন্ধু মূর্তাজা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। দুজনেই ইংরেজি বিভাগের ছাত্র। কতই বা বয়স? পাশাপাশি বসতাম। স্যাররাও রসিকতা করতেন, এই যুগল এসে গেছে।
শ্রেণিকক্ষে হাসির রোল উঠত। স্যার, মানে জগদীশ স্যার, বলতেন, স্টপ। এবার ওয়ার্ডসওয়ার্থ পড়ানো হবে। ডেফোডিল। এই, মূর্তাজা, বলো, অ্যাট এ, গ্লান্স কী? ব্যাখ্যা করো?
মূর্তাজা উঠে দাঁড়িয়ে নিজের উপলব্ধি প্রকাশ করত।
স্যার বলতেন, তুমি খুউব সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছ।
এই জনি, বলো, রোমান্টিক বলতে কী বুঝায়?
ইংরেজি কবিতার ধারার বিবরণ দিয়ে রোমান্টিক কবিতার মর্মবস্তু অত্যন্ত সাবলীলভাবে প্রকাশ করতাম।
স্যার খুশি হতেন। দুজনেই আমরা ছিলাম স্যারদের প্রিয় ছাত্র।
পরীক্ষায় আমরা দুজনেই প্রায় সমান সমান ফল পেয়েছিলাম। আমি হয়েছিলাম প্রথম। মূর্তাজা হয়েছিল দ্বিতীয়। দুজনের ইচ্ছে ছিল, একই চাকরিতে ঢুকব। মূর্তাজা দেশে ফিরে গিয়ে একটা নামকরা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হয়েছিল। আমি, সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় পাস করে বৈদেশিক মন্ত্রণালয়ে কূটনৈতিক দপ্তরে যোগদান করে দীর্ঘকাল বিদেশে কাটিয়েছি।
মূর্তাজার নামটি পড়েই আমার মনটা অভাবিত আনন্দে শিহরিত হয়ে উঠল। চিঠিটা খাম থেকে বের করে পড়লাম।
মূর্তাজা লিখেছে প্রিয় বন্ধু আমার। শুভেচ্ছা।
কেমন আছো? বহুকাল দেখা হয়নি। তোমাকে দেখার জন্য মনটা উতলা হয়ে আছে। লোকমুখে শুনেছি, তুমি অবসর নিয়েছ। আমি খুব ভালো নেই। শরীরটা নড়বড়ে হয়ে গেছে। হাঁটু দুর্বল। হাঁটতে পারিনে।
বহুকাল বিদেশে কাটালে। আমি গ্রামের মানুষ। গ্রামেই আছি। আমার অনুরোধ, আমার গ্রামটি একটু দেখে যাও। কেমন আছি। দেখে যাও। আসবে তো?
চিঠিটা পড়ে যেমন ভালো লাগল, তেমন একটু বিষণ্ন হয়ে উঠল আমার মন। ওর যুবক বয়সের চেহারাটা আমার মানস নয়নে ভেসে উঠল। পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি লম্বা। স্বাস্থ্যবান দোহারা গড়ন। হাঁটত লম্বা লম্বা পা ফেলে। ঘনকালো চুল। চোখ দুটো বড় বড়। বেশ আকর্ষণীয় চেহারা। পথে বেরুলেই মেয়েরা আড়চোখে তাকাত। আমাদের এক মেয়ে বান্ধবী ছিল। নাম রুবি। সে প্রায়ই ওর কাছে ‘ভালোবাসি’ বলে চিঠি লিখত। সেই ভালোবাসার চিঠি পড়ে আমরা দুজন হাসাহাসি করতাম। ওকে বলতাম, বিয়ে করবি?
ও বলত, পরে ভেবে দেখা যাবে।
এখনি বল। ঝুলিয়ে রেখে কী হবে?
হো হো করে হাসত মূর্তাজা।
পরীক্ষাও শেষ হয়ে গেল। একদিন রুবি এসে বলল, মূর্তাজা, আমি তোমাকে বিয়ে করব। তুমি আমার শ্রেণি বন্ধু। কোনো সমস্যা নেই। সরাসরি বলো। বাড়ি থেকে মা-বাবা বলেছে, তোর জন্যে ছেলে ঠিক করা হয়েছে। আমি রাজি হয়নি। মূর্তাজা, আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই।
মূর্তাজা বলল, বিয়ে তো আমিও করতে চাই। কিন্তু সমস্যা আছে একটা।
কী সমস্যা?
সমস্যাটা খুব জটিল। আমার পারিবারিক অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়। অরণি নামের একটা মেয়ের বাবার টাকায় আমি পড়াশোনা করছি। সেখানেই আটকে রয়েছি।
রুবি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এলো।
আমি মূর্তাজার চোখের দিকে তাকালাম। তার চোখেও জল নেমে এসেছে। এসব বিষয় আমার জানা ছিল না। মূর্তাজাও কোনোদিন আমাকে জানায়নি। শুনে মনটা দারুণ খারাপ হয়ে গেল।
রুবি কিছু না বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
মূর্তাজা বিমূঢ় হয়ে একইভাবে দাঁড়িয়ে রইল।
বললাম, মূর্তাজা, রুবি তোকে সত্যিই সত্যিই ভালোবাসে।
মূর্তাজা বলল, রুবি যে আমাকে ভালোবাসে, তা আমি জানতাম। এটা আমার জীবনের একটা বিয়োগান্তুক ঘটনা। কিন্তু উপায় নেই। ওর বাবা টাকা না দিলে আমার লেখাপড়া হতো না। তিনি আমাকে কোনো অভাবের মধ্যে রাখেননি। প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকা দিয়ে থাকেন। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো মূর্তাজার নাসারন্ধ্র দিয়ে। কী করব বল? তুই বল?
আমি বললাম, তোর বিশ্বাসকে আমি শ্রদ্ধা করি মূর্তাজা । তুই লোভ লালসার ঊর্ধ্বে। যে তোকে সাহায্য করেছে, তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।
মূর্তাজা বলল, অরণির বাবাকে আমি বাবা বলে ডাকি। সে-ই এখন আমার বাবা। আমার অভিভাবক, তিনিই আমার চোখে আলো জ্বেলে দিয়েছেন।
আমি বললাম, অরণি কী লেখাপড়া জানে?
সে এবার উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছে। মূর্তাজা বলল, কলেজে পড়তে চায়। জানতে চেয়েছে সে ভার্সিটিতে ভর্তি হবে কিনা। এর অর্থ হলো, সে এখন আমার। অন্য কারও নয়।
দেখতে কেমন?
এক কথায় বলায় যায় সুন্দরী। খুউব সুন্দরী।
হো হো করে হাসলাম। বুঝেছি, সব বুঝেছি। তো এতদিন বলিসনি ক্যান?
প্রয়াজন পড়েনি।
যাক, এবার বিয়ে করে ঘর সংসার কর।
এরপর মূর্তাজার সঙ্গে দেখা হয়নি আমার। চিঠি দিয়েছিল কয়েকবার। আমি তখন প্যারিসে। জবাবও পাঠিয়েছিলাম। সে আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিল, এটা আমি কখনও ভুলিনি। বহুদিন পর মূর্তাজার চিঠি পেয়ে আমি অভিভূত হয়ে গেলাম। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, একবার বাড়িতে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করে আসব।
রাত্রেই উষসিকে বললাম, আমরা তো জীবনে বহুদিন বিদেশে ছিলাম। পৃথিবীর প্রায় সব দেশের প্রধান প্রধান নগরে গিয়েছি। এবার চলো একটু আমরা আমাদের দেশের গ্রাম দেখে আসি।
উষসি আকাশ থেকে পড়ল। কী বলছ তুমি?
বললাম, ঠিক বলছি।
পাল্টা প্রশ্ন করল উষসি, তোমাদের কী গ্রামে কোনো কালে বাড়ি ছিল? কই কখনও তো বলোনি? তুমি তো এতকাল বলে এসেছ তোমাদের পূর্ব পুরুষরা নারিন্দায় বাস করত। সে তো অনেককাল আগের কথা। তোমার দাদার আমলের ব্যাপার। তোমার বাবা তো চাকরি সূত্রে কলকাতায় ছিলেন। দেশভাগের সময় ঢাকায় এসে ধানমন্ডিতে একটা ফ্ল্যাট বাড়ি তৈরি করেছিলেন। সেখানেই তোমার জন্ম। ভার্সিটিতে ঢুকে সলিমুল্লাহ হলে থাকতে, তাই না?
আমি বললাম, হ্যাঁ, তাই।
তবে গ্রামে যাওয়ার ইচ্ছাটা হলো কী করে?
বললাম মূর্তাজার কথা। ইচ্ছে করলে, এ দেশের প্রশাসন বিভাগে সে সহজেই ঢুকতে পারত কিংবা আমার মত বিদেশ মন্ত্রণালয়ে চাকরি জুটিয়ে নিতে পারত। কোনোটাই সে করেনি। গ্রামে ফিরে গিয়ে সে একটা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হয়েছিল। কয়েক বছর হলো অবসর গ্রহণ করেছে। পর পর দু’বার দেশের লোকের অনুরোধে ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হয়েছে। দেশের জন্য কাজ করেছে। মানুষের সেবা করেছে। সে আমন্ত্রণ জানিয়েছে, তার এলাকাটা দেখে আসার জন্য। ইদানীং সে কিছুটা অসুস্থ। খুুুুউব বেশি হাঁটাহাঁটি করতে পারে না। বলেছে, টাটকা সবজি আছে, মাছ, বিভিন্ন প্রকারের মাছ আছে। চারদিকে খোলামাঠ। হুহু করে বাতাস আসে। বিল, বাঁওড় আছে। দারুণ একটা মজার জায়গা। চলো যাই। অনেককাল তো গ্রাম দেখিনি। এবার দেখে আসিগে। উষসি কথা বলল না। ঝিম মেরে শুনল।
পরপর আরও তিনদিন উষসিকে গ্রামে যাওয়ার কথা বলেছি। দেখো, ঢাকা শহরে আবহাওয়া স্বাস্থ্যকর নয়। রাস্তায় ধুলোবালি। ময়লার দুর্গন্ধ। যানবাহনের চলাচল বিদঘুটে। গাড়ির কর্কশ হর্ন। কালো ধোঁয়াÑজ্যাম। শরীরে নানা রকম ব্যাধি। এর থেকে একটা দূরত্বে গিয়ে ফুসফুসে পরিচ্ছন্ন হাওয়া ভরে আসি। শরীরও চাঙ্গা হয়ে উঠবে।
উষসি জবাব দিয়েছে, প্রায় তো খবরে কাগজে দেখি, গ্রামগুলো নিরাপদে নেই। শহরের চেয়েও নাকি বিপজ্জনক। খুনোখুনি মারামারি লেগেই আছে।
আমি কোনো ক্রমেই রাজি করাতে পারিনি উষসিকে। একটার পর আর একটা যুক্তি খাড়া করে বিব্রত করে তুলল। শেষ পর্যন্ত বলল, আমার কোমরে ব্যথা। বুকটা ধুকধুক করে। পায়ের মাংসে ব্যথা তুমি যেতে চাও যেতে পার। আমাকে নিয়ে টানাটানি করো না। উষসির কথা শুনে বিরক্ত লাগল। কেমন যেন বিষণ্ন হয়ে উঠল আমার মন।
এ নিয়ে আর কোনো কথা বলিনি। বেশি কথা বললে হয়তো বাড়াবাড়ি হতে পারে। গৃহে একটা অশান্তি দেখা দিতে পারে। উষসি একটু বদমেজাজি এবং আবেগপ্রবণ। রাগের মাথায় কখন যে কী করে বসে তা সে নিজেও জানে না। বিছানার আসবাবপত্র ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে এদিক ওদিক ছুঁড়ে ফেলা তার বহুদিনের অভ্যাস। এমনকি ঘটি বাটিও ছুঁড়তে পারে। ক্রোধ মাথায় করে ছুটে এসে কিলঘুসিও মেরেছে কয়েকবার আমাকে।
রাগের বশে উল্টো কোনো ব্যবস্থা কখনও নেয়নি। মাথাটা ঠান্ডা রেখে উষসির সামনে থেকে সরে গিয়েছি।
তারপর উষসির মেজাজ স্বাভাবিক হয়ে এলে আমি আস্তে আস্তে ঘরে ঢুকে স্ত্রীর কাছে ক্ষমা চেয়েছি।
বলেছি, তোমাকে উত্তেজিত করে তোলা আমার উচিত হয়নি। ভুল করেছি। আর করব না।
আচ্ছা। ঠিক আছে। মনে থাকে যেন। আমি তো তোমাকে বহুদিন বলেছি, আমার ওপর কথা বলবে না। এতে মেজাজটা আরও গরম হয়ে যায়। সংসারটা তো তুমি চালাও না আমি চালাই।
বললাম তো ভুল হয়েছে।
আবার তর্ক করছ তুমি?
না না না। কোনো তর্ক নয়।
ঘরে বউ নিয়ে বাস করা ঝুট ঝামেলার ব্যাপার। ইউরোপে ঘরের বউরা বনের বাঘিনীর মতো। স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর বনিবনা না হলে বউ কলা দেখিয়ে ঘর ছেড়ে চলে যায়। থানায় গিয়ে স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ জানায়। পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যায় স্বামীকে। বিচ্ছেদ হলে ক্ষতিপূরণ দিতে দিতে স্বামী ফতুর হয়ে যায়। নিজের চোখেই দেখেছি এ ধরনের কাণ্ড।
উষসিও বেশ এসব কাজে অভ্যস্ত। তর্কবিতর্ক করলে রেহাই নেই। বাঘিনীর মত স্বভাব। একবার তো এরকম একটা ঘটনার মুখোমুখি হয়েছিলাম। অফিস থেকে ঘরে এসে দেখি একজন অপরিচিত যুবক নিয়ে একই বিছানায় শুয়ে আছে উষসি।
মাথাটা গরম হয়ে উঠেছিল।
উষসি বলল, জনি, তোমার সঙ্গে পরিচয় করে দিচ্ছি, ইনি হলেন মি. অস্টিন, আমার বন্ধু। ওয়েস্ট মিনিস্টার থেকে দেখা করতে এসেছে।
ক্ষোভে দুঃখে চোখ দুটো লাল হয়ে উঠল। ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে রইলাম। কার সঙ্গে ঘর করছি? ঘেন্নায় শরীর জ্বলতে লাগল।
অস্টিন সামনে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, গুড ইভিনিং। হাউ আর ইউ?
বললাম, দেখতেই তো পাচ্ছো, কেমন আছি।
ওর মুখে মদের গন্ধ। উষসির মুখ থেকেও মদের গন্ধ বেরিয়ে আসছে। অস্টিন ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। উষসি দরোজাটা পার হয়ে ফুটপাথ পর্যন্ত ওকে এগিয়ে দিয়ে এলো।
বাঘিনীর মত ওর নোখ দিয়ে আমার বুকের জামাটা একটা টান মেরে ছিঁড়ে ফেলল। ইউ সাট আপ। আমার বন্ধুকে তুমি অপমান অপদস্ত করেছ। ব্লাডি, নুইসেন্স ডগ, আমি তোমার বিরুদ্ধেÑ
আমি বললাম, দোষটা আমি করেছি না, তুমি করেছ?
হোয়াট? বিড়ালের মত লাফ মেরে ও আমার বুকের মাংস খামছে ধরলো। ইচ্ছে হচ্ছিল মেঝের উপর ফেলে পা দিয়ে মাড়িয়ে ওর গতরের হাড় মাংস আলাদা করে ফেলি।
কপাল ভালো, রাগের বশবর্তী হয়ে উষসিকে খুন করে ফেলিনি। মেজাজটা গরম ছিল বটে কিন্তু ধৈর্যের বাঁধ ভাঙেনি। আশ্চর্য রকমভাবে আমি সংযম রক্ষা করেছিলাম। তা না হলেÑ
উষসির অভদ্র আচরণ মাঝে মাঝে সীমা অতিক্রম করে। ওর স্বভাবটা এই রকমের। এইভাবেই তো দীর্ঘকাল ঘর সংসার করে এসেছি। এখনও করতে হচ্ছে। না করে করব কী। অন্য কেউ হলে, ডিভোর্স হয়ে যেত। আর একটা মেয়ে মানুষ এনে লাভ কী। মেয়ে মানুষ তো পণ্য হয়ে উঠেছে। বাজারে গেলেই খরিদ করা যায়। লোকলজ্জার ভয়ে ওপথে পা বাড়াইনি। এখন বয়স হয়েছে। মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছি চিন্তাটা।
কয়েকদিন হলো আমি উষসিকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছি। মনে মনে ভাবছি, আমি কোথায় যাব আর না যাব, সেটা আমার ব্যাপার। উষসির সঙ্গে আলোচনা করার কী দরকার। একই ঘরে থাকছি। কিন্তু মনের কথা খুলে বলছি না। উষসিও বাড়াবাড়ি করছে না।
দুদিন হলো, আর একটা চিঠি পেয়েছি মূর্তাজার। সে লিখেছেÑ
‘জনি, তোর কথা বার বার মনে পড়ছে। লোকে বলতো হরিহর আত্মা। আসলে তাই। তুই বিদেশে চলে গেলে আমি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ি। দারুণ একটা অস্থিরতার মধ্যে কাটিয়েছি।
এখন শেষ জীবন। তোর সঙ্গে কয়েকদিন কাটাব। আমার গ্রামটা খুব নির্জন। অপূর্ব নিসর্গ। মনটা ভালো হয়ে যাবে। আয়, অরণি তোকে দেখতে চায়। সে খুব ভালো মেয়ে এবং মিশুক। বার বার তাগিদ দিচ্ছে। একবার দেখে যা। আমরা কেমন আছি। তোর বউকে নিয়ে আয়। বল, কবে আসবি?
মূর্তাজার চিঠি পড়ে মনটা আমার চঞ্চল হয়ে উঠেছে। অরণি যেতে বলেছে। খুব নাকি ভালো মেয়ে। গ্রামের মেয়েতো। উষসির মতো নয়। গেলেই বুঝা যাবে মূর্তাজার বউয়ের মন ও মানসিকতা। আমার বউয়ের মত নয়। আমার ঘর এবং ওর ঘর এক রকম হতে পারে না। আমি লন্ডনিকে নিয়ে কী খুব সুখি? কিন্তু মূর্তাজা বলছে, ভিন্ন কথা। তার চিঠির ভাষায় কৃত্রিমতা নেই। বউয়ের সঙ্গে তার অন্তরের সম্পর্ক খুব গভীর। এই কারণে অরণিই মূর্তাজার কাছে বিশাল হয়ে উঠেছে।
আমি মূর্তাজার চিঠি পাওয়ার পর মূর্তাজার গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে ফেললাম। কবে যাব, দিন তারিখ উহ্য রেখে একটা চিঠি পাঠালাম।
‘মূর্তাজা, তোর চিঠি পড়ে মুগ্ধ হলাম। অরণি যেতে বলেছে, আমি যাবই। কয়েকদিন থাকব। তোর গ্রাম দেখব। বিল বাঁওড় দেখব। ফাঁকা মাঠ দেখব। সবুজ নিসর্গ দেখব। খোলা আকাশে পাখি ওড়া দেখব। মন টানছে। আমার লন্ডনিকে নিয়ে যাব না। একা একা যাব। সামনের মাসেই যাব। দিনক্ষণ তারিখ না জানিয়েই যাব। অবশ্যই যাব। ভালো করে দেখে আসব গ্রাম। তোর অরণিকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।
উষসিকে ঘুণাক্ষরেও জানালাম না এই বিষয়টি। জানালে, নানারকম প্রতিক্রিয়া দেখা দিত। হয়তো বলতো, যেতে পারব না। এই সময়টা কারও জন্যে ভালো নয়। আপদ বিপদের কথা বলত। কিংবা ব্যঙ্গ করত, বুড়ো বয়সে ভিমরতি ধরেছে। তার সঙ্গে আলোচনা করা নিরর্থক। তাই সবসময় আমার ভ্রমণের বিষয়টি গোপনে রাখছি।
আমার বুক শেলফে ভ্রমণ বিষয়ক অনেক গাইড বই আছে। দীর্ঘদিন আমি স্বদেশে অনুপস্থিত থাকায় বাংলাদেশ আমার কাছে অপরিচিত হয়ে উঠেছে। নদীনালার দেশ। বিল বাঁওড়ের দেশ। রাজধানী থেকে নৌপথ এবং রেলপথে গমন করলে কোথায় কীভাবে পৌঁছানো যায়, তা আমার জানা নেই। আমার ইচ্ছা, শুধু মূর্তাজার বাড়িতে নয় যাওয়ার পথে দর্শনীয় যেসব জায়গা আছে, তা একবার করে চলতি পথে দর্শন করা। এতে লাভ হবে এই যে, ইদানীংকালের বাংলাদেশ কেমন আছে, সেটা চাক্ষুষ উপলব্ধি করা।
আমার শেলফে বাংলাদেশ পর্যটন বিভাগের একটা গাইড বই আছে। আমি সেই গাইড বইটি বের করে রেলপথ ও নৌপথ কেন্দ্রিক পর্যটন স্থানগুলোর স্থান সম্পর্কে যে বিবরণ আছে, তা রীতিমত পাঠ করছি।
আমার পরিকল্পনা এক বা দুদিনের জন্য নয়। দশদিনের পরিকল্পনা। রেলপথ কোথা থেকে কোথায় গিয়েছে, শেষ হয়েছে এবং নৌপথ কোথা থেকে কোথায় গিয়েছে, শেষ হয়েছে, তা খুটিয়ে খুটিয়ে বের করা। ভাবলাম কিছুটা নৌপথে যাব এবং কিছুটা রেলপথে যাব। মূর্তাজার বাড়িতে পৌঁছানোর জন্য নৌপথ নেই। আছে রেলপথ। নৌপথে গেলে নারায়ণগঞ্জ হয়ে চাঁদপুর। চাঁদপুর থেকে গোয়ালন্দ ঘাট। আবার নৌপথে বরিশাল। বরিশাল হয়ে খুলনা। খুলনা থেকে রেলে করে যাওয়া যাবে সিংড়া স্টেশনে। সিংড়া স্টেশন থেকে মূর্তাজার গ্রামের দূরত্ব আড়াই মাইল। যাতায়াতের মাধ্যম ভ্যান রিকশা এবং অটো। রাত দশটা পর্যন্ত এইসব যানবাহন থাকে। দশটার পরে হাঁটা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। আমি সদরঘাটে গিয়ে যাওয়ার সুযোগ সুবিধার ব্যাপারে খোঁজখবর নিলাম। উদ্দেশ্য হলো বরিশাল। বরিশাল থেকে স্টিমারে উঠে খুলনা থেকে সিংড়া। নদী দেখাও হবে। স্থলপথও দেখা হবে। ফিরবার পথে নৌপথ নয় রেলপথে ঢাকায়। সোজাসুজি হিসাব। রথও দেখা হবে কলা বেচাও হবে।
উষসি বলল, কয়েকদিন থেকে দেখছি, সকালে বেরোও বিকেলে ফেরো। ব্যাপারটা কী? বললাম, বহুদিন ঢাকায় ছিলাম না। এখন নতুন শহর গড়ে উঠছে। কোথায় কী গড়ে উঠেছে, তাই দেখতে যাই।
লাভ কী?
লাভ আবার কী। পুরনো কেমন ছিল, নতুন কেমন হচ্ছে, সেটা জানা।
বাহ, কোনো মেয়ে টেয়ে সঙ্গে থাকে নাকি?
উষসির প্রশ্ন শুনে অবাক হয়ে যাই।
এসব প্রশ্ন কেন?
তুমি বুঝতে পারো না? ছুকরি নিয়ে ঘুরে বেড়াও। দুপুরে হোটেলে খাও।
স্বপ্ন দেখছো নাকি?
দেখো, আমার কথার ওপর কথা বলবা না। যা সত্যি, তাই বলেছি।
এই প্রৌঢ় বয়সেও তুমি হেনস্তা করবা?
রাখো তোমার প্রৌঢ় বয়েস, তুমি যে কি চিজ, আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। এই বয়সে ছুকরি নিয়ে ঘুরে বেড়াও, মোটা টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে, এসব আমার জানা।
আমার চোখ দুটো লাল হয়ে উঠল। কোনো রকমভাবে ক্রোধটা দমন করলাম।
দেখো, ভবিষ্যতে যেন কোনো ছুকরি নিয়ে ঘুরবা না।
আমি ওর হালচাল জানি। বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করে ভালো জিনিসকে ও মন্দ জিনিস করার ব্যাপারে ওস্তাদ। এরপর মুখে যা আসবে, গালাগালি দেয়া শুরু করবে। জঘন্যতম ওর মুখের ভাষা। এত নোংরা ভাষা যে কীভাবে ও ব্যবহার করতে শিখেছে, তা বুঝতে কষ্ট লাগে আমার।
আমি মুখ বুঝে ওর সামনে থেকে সরে আসি। মাথাটা ঝিনঝিন করতে লাগল। মনটা মরে যাচ্ছে। বাঁচতে ইচ্ছে করে না আমার। এ রকম আপদ নিয়ে আমি সংসার করছি।
রাত্রে ঘুম হলো না। একটা দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে রাতটা কেটে গেল আমার। ভোর বেলা উঠে স্নান করলাম। স্নান করার ব্যাপারটাও ওর কাছে দোষের বিষয় হয়ে উঠল।
উষসি ওর ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। স্নান ঘর থেকে আমি বেরিয়ে এলাম। দরোজায় হাত রেখে আমার সর্বাঙ্গ চোখ বুলিয়ে দেখল।
এই, এত ভোর বেলা স্নান কেন?
আমি জবাব দিলাম না।
কোথাও কি রাত্রে গিয়েছিলে?
কেন?
তবে ভোর বেলা স্নান করলে কেন?
আমি ওর ব্যবহারে আশ্চর্য হয়ে যাই।
বলো, রাত্রে কার কাছে গিয়েছিলে?
আমাকে জেরা করতে লাগল উষসি।
রাত্রে কোথায় যাব? ঘরেই তো ছিলাম।
সাট আপ। আমি কচি খুকি, না? কোন মাগির ঘরে গিয়েছিলে?
স্বপ্ন দেখছ নাকি?
সাট আপ। জবাব দাও। কোনো প্রশ্ন করবে না। যা জানতে চাই, তার জবাব দাও।
বাজে কথা বলো না।
হোয়াট? তুমি তলে তলে ডুব দিয়ে পানি খাও। আমি কি কিছুই বুঝিনে? বলো, বলো, সত্যি কথা বলো, কোন মাগির কাছে যাও? কাইচি দিয়ে এখনি তোমার ওটার গোড়া পর্যন্ত কেটে দেব।
আমাকে তুমি ভেড়া বলে মনে করো নাকি? আমি তোমার হুকুমের দাস?
সাট আপ? আর একটা কথাও নয়।
রাগের মাথায় আমিও দু’একটা বোলচাল ওর দিকে ছুড়ে দিই। বলি, আমার জীবনটা তো তুমিই বরবাদ করে দিয়েছ। বিদেশেও তো তুমি কিছু ঘটনা ঘটিয়েছিলে। ঘটাওনি?
সাট আপ। আমার সম্পর্কে তুমি একটা কথাও বলবা না? ভালো হবে না বলছি।
আলবত বলব। একশ বার বলব। হাজার বার বলব। তোমারও তো পুরুষ বন্ধু ছিল? ছিল না?
হ্যাঁ, ছিল, তাতে হয়েছে কী?
তবে আমারও দু’একজন মেয়ে বন্ধু থাকতে পারে। এটা নিয়ে কি জন্য গালি গালাজ দাও। আমি তো কোনো মেয়ে কে নিয়ে বিছানায় শুইনি।
সাট আপ। তবে মেয়েলোকের পেছনে ঘোরো ক্যান? দামড়া কোথাকার
মুখ সামলে কথা বলো, উষসিÑ
উষসি আরও ক্ষেপে উঠল। সে ঘরের মধ্যে ছুটে গিয়ে নিজের পরিধানের সালোয়ার কামিজ ছিঁড়তে লাগল। ড্রেসিং টেবিলের আয়নাও ভেঙে ফেলল। দেয়ালে টাঙানো ছিল আমাদের বিয়ের সময়ের যুগল ছবি। টেবিলের ওপরে দাঁড়িয়ে ঝুলানো ছবিটা হ্যাঁকছা টান দিয়ে মেঝের উপরে ফেলে দু’পায়ে চটকাতে লাগল। তার পা দাপানোর শব্দ শুনলাম। চিল্লিয়ে পরিবেশটা নোংরা করে দিচ্ছে। আশপাশের বাড়ির মেয়ে এবং পুরুষরা ঘরের জানালা খুলে উঁকি মেরে রয়েছে আমাদের বাড়ির দিকে। কি বিদঘুটে ব্যাপার। এই তল্লাটের বাসিন্দারা আমাকে সবাই শ্রদ্ধা ও ভক্তি করে। আমি যে একজন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নামজাদা কূটনীতিক ছিলাম, তা সকলেই জানে। তারা ভাববে কী?
লজ্জায় মাথা আমার নত হয়ে আসতে লাগল। মাঝে মাঝে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আমাকে উদ্দেশ্য করে এক নাগাড়ে গালি ঝাড়তে লাগল উষসি।
শুয়োরের বাচ্চা, তোর খোয়াড়ে জন্ম হয়েছিল। তাই শুয়োরের মতো মাগিদের পেছনে ছুটিস। আমার জীবনটা ধ্বংস করে দিয়েছে এবং এখনও দিচ্ছে, আমি আজকেই তোকে ডিভোর্স করছি।
আমি অসীম ধৈর্যসহকারে শুনলাম এবং কিছুই বললাম না। মনে মনে আওড়ালাম ওকে আমার বিয়ে করাটা ঠিক হয়নি।
আমার জীবনে সবচেয়ে বড় ভুল হলো উষসিকে বিয়ে করা। বিয়ের আগের কিছু স্মৃতি আমার মনে ভেসে উঠল।
আমি পুরো তিন মাস ছিলাম পেমব্রিজে। উষসির সঙ্গে একটি ডিনারে আমার পরিচয় হয়। হালকা পাতলা ছিপছিপে শরীর। আকর্ষণীয় চেহারা। পরিধানে কোট প্যান্ট। মাথায় হ্যাট। আমার ডান পাশে বসেছিল সে।
আমার দিকে ডান হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আমি উষসি, অক্সফোর্ডে অনার্স করেছি। ইস্টহামে বাবা মা থাকেন। এখানকার নাগরিক।
আমি আমার পরিচয় দিলাম। বাংলাদেশ হাই কমিশনে সদ্য যোগদান করেছি। প্যারিসে ছিলাম এক বছর। বদলি হয়ে এসেছি।
তা হলে তো ভালো হয়েছে। আমিও বাঙালি।
তাই?
হ্যাঁ। তাই।
বাবা, মা কি করেন?
হোটেল ব্যবসা। বেশ বড় ধরনের হোটেল। শতাধিক টেবিল।
কতদিন থেকে আছেন?
অ্যাবাউট থার্টি ইয়ার। আমার জন্ম অবশ্য বাংলাদেশে। আমি ব্রিটেনে আছি বিশ বছর। লেখাপড়া এখানে। অর্থনীতিতে অনার্স করেছি। এখানকার বাঙালি কমিউনিটির সকলেই আমাকে চেনে।
আমি লন্ডনে তখন পুরোদস্তুর একজন সাহেবের মত চলাফেরা করতাম। কথা বলতাম সাহেবদের মত। কণ্ঠে যদিও বাঙালি টান ছিল, তাতে বুঝার উপায় ছিল না আমি কোন দেশি। আমার শরীরের চামড়াটা ছিল ফর্সা। হঠাৎ করে কেউ বুঝতে পারত না যে, আমি বাংলাদেশি, না অন্য কোনো দেশি।
পরে বাঙালি কমিউনিটির সঙ্গে আমি যুক্ত হয়ে যায়। কারণ হলো, হাইকমিশনের একটা বড় দায়িত্ব ছিল বাঙালি সংস্কৃতিকে ব্রিটেনবাসীর নিকট পরিচয় করিয়ে দেওয়া। বাঙালিরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করত। সেইসব অনুষ্ঠানে হাই কমিশনারের সঙ্গে প্রায়শ যেতে হতো। কখনও কখনও আলোচনায় অংশগ্রহণ করতাম। কয়েক মাসের মধ্যে ব্রিটেন প্রবাসী সকল বাঙালিদের নিকট আমি খুব পরিচিত ব্যক্তি হয়ে উঠেছিলাম। উষসিও সেইসব অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করত। তাদের ইস্টহ্যামের বাসায়ও আমি মাঝে মাঝে যেতাম। আমার সঙ্গে ওর একটা গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। যাকে সোজা কথায় বলা হয় প্রেম। এই প্রেম প্রেম খেলা করতে গিয়ে ওর ফাঁদে পা দিলাম। শেষ পর্যন্ত বিয়ে করতে হলো।
বিয়ের পর টের পেলাম ওর আরও পুরুষ বন্ধু রয়েছে। ব্রিটেনের অনেক যুবকের সঙ্গে সে মেলামেশা করেছে। অনেকেই তার যৌনসঙ্গী ছিল। এসব ঘটনা ও-দেশের নারী পুরুষের মধ্যে কোনো দোষণীয় বিষয় নয়। অহরহ ঘটছে। কেউ এসব বিষয় নিয়ে লাঠিবাজি করে না। হৈচৈ করে না। বয়স্ক বয়স্কারা ইচ্ছেমত ইচ্ছা পূরণ করে। এটা তাদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা। কারও হস্তক্ষেপ করার শক্তি নেই।
উষসিকে বিয়ে করে কয়েক মাস পর আবার প্যারিসে চলে গেলাম। ও আমাকে এত করে ভালোবাসতে লাগল যে, আমাকে ছাড়া একদণ্ড একা থাকতে পারে না। আমি যতক্ষণ ঘরে ফিরে না আসি, ও-ততক্ষণ দরোজায় দাঁড়িয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করত। দুজনে রাত্রে প্যারিস শহর ঘুরে ঘুরে দেখতাম। ক্যাফে গিয়ে আড্ডা মারতাম। হালকা মদও দুজনে পান করতাম। দুপুর রাত্রে বাসায় এসে জড়াজড়ি করে ঘুমোতাম।
দুজনের মধ্যে ভালোবাসা তীব্র হয়ে উঠল। প্যারিসের জীবনটা ছিল উচ্চ ও মধুময়। এখানে থাকতে থাকতে উষসি গর্ভবতী হলো। আমরা জীবনের আর একটা বাঁকে এসে দাঁড়ালাম। আমি হবো বাবা। উষসি হবে মা। দুজনের মনের মধ্যে দারুণ একটা চাঞ্চল্য।
উষসি বলল, এবার আমাদের নতুন ভাবনাচিন্তা। প্যারিসে থাকব, না, লন্ডনে থাকব?
তোমার পছন্দ কোথায়?
আমার মনে হয়, এতদিন তো উড়ে উড়ে বেড়ালাম, আর এভাবে নয়।
বলো না, কোথায় তোমার ইচ্ছে?
বুঝেছো মিস্টার, এখন ঘর সংসার করতে চাই। বাড়ি দরকার।
আগে বাচ্চাটা হোক, তখন সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। হয় লন্ডন, নয় প্যারিস। উড়ো পাখিরও তো একটা ঠিকানা থাকে। আমরাও সেইভাবে ঠিকানা একটা স্থায়ী করে নেব।
ঠিকতো?
হ্যাঁ, ঠিক।
আমি কিন্তু পেটটা খালাস করব লন্ডনে। প্যারিসে না।
আমি হো হো করে হাসলাম।
তোমার যে ইচ্ছা আমারও তো একই ইচ্ছা।
ছমাস দুজনের আনন্দের মধ্যেই কেটে গেল।
ওর পেটটা আস্তে আস্তে উঁচু হয়ে উঠছে। মা হওয়ার প্রবণতা ওর চলনে বলনে ফুটে উঠছে।
আমি বললাম, এর পরে শরীরটা আরো ভারী হয়ে উঠবে। হাওয়ায় জাহাজে যাবে, না, ডোভার পার হয়ে যাবে?
মনে হয় হাওয়াই জাহাজে যাওয়া ভালো। কোনো ঝুঁকি থাকে না। হিথরে থেকে আমি একাই যেতে পারব। তোমাকে যেতে হবে না।
ঠিক আছে। তাই যাও।
বিমানের টিকিট কিনে উষসির হাতে দিলাম।
উষসি লন্ডনে চলে গেল।
এই প্রথম উপলব্ধি করলাম, বিচ্ছেদের বেদনায় আমার বুকটা ভেঙে যাচ্ছে। মনে হলো, আমার জগৎ আলাদা হয়ে গেছে। উষসি রয়েছে এক জগতে এবং আমি রয়েছি ভিন্ন আর এক জগতে।
গভীর এক বেদনায় আমার চোখ বেয়ে অশ্র“ গড়িয়ে পড়তে লাগল।
তিন মাস পর খবর পেলাম উষসি পুত্র সন্তানের মা হয়েছে। আমি হয়েছি বাবা।
সন্ধ্যা বেলা খবরটি শুনেছিলাম। শুনে মানসিক আনন্দ তুঙ্গে উঠল। বাচ্চাটার একটা ছবিও পাঠিয়েছে। হাত পা নাড়াচ্ছে। আনন্দ করে দু’ পেগ মদ খেলাম। হুররে আমার একটা বাচ্চা হয়েছে। ফুট ফুটে সুন্দর বাচ্চা। বাচ্চাটা কোলে করে বসে আছে উষসি। হা হা করে হাসছে। ওর কাছে থাকলে কী ভালোই না লাগতো। হুররেÑ
কয়েকদিন পর ছুটি নিয়ে বাচ্চা দেখতে গেলাম। নেড়েচেড়ে দেখলাম। উষসির শরীরটা তখন দুর্বল। তবুও সে বিছানা থেকে উঠে এসে আমার গলা জড়িয়ে চুমু খেতে লাগল।
খুশি হয়েছ? বলেছিলাম না ছেলে হবে?
আমিও চুমু দিলাম ওর গালে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে চলল আমাদের চুমু খাওয়া-খাওয়ি।
প্রায় এক সপ্তাহ ছেলে আর বউয়ের সান্নিধ্যে ছিলাম। উষসি বলল, ছুটিতো আরও কয়েকদিন বাড়িয়ে নিতে পারতে। এই সময় তুমি কাছে থাকলে আমার মনটা আরও চাঙ্গা হয়ে উঠত। জনি, তুমি চলে গেলে আমি খুব একাকী হয়ে যাব।
ওর চেহারাটা দেখলাম পাণ্ডুর হয়ে গেল। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম ওর দিকে। ছুটি বাড়াতে পারিনি। প্যারিস থেকে জানানো হলো, মস্কোয় আমাকে বদলি করা হয়েছে।
একদিন পরেই প্যারিতে চলে গেলাম। বারবার বাচ্চা আর উষসির কথা মনে পড়তে লাগল। মনপ্রাণ পড়ে থাকল লন্ডনে, আমি চলে গেলাম প্যারি থেকে মস্কোয়। উষসি টেলিফোনে বলল, তুমি ছাড়া এই জীবন বৃথা।
কী বলব? এর কোনো জবাব নেই। বুক যেন ভেঙে যেতে লাগল।
বললাম, ছমাসের আগে কোনো ছুটি নেই।
উষসি কাঁদল, আমি যে কীভাবে আছি, তোমাকে বুঝাতে পারছি না।
ওই সময় রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে মস্কোয় কনফারেন্স হচ্ছিল। রাষ্ট্র প্রধানদের আন্তর্জাতিক কনফারেন্স। একটা ব্যস্ততা, একটা উদ্বেগ নিয়ে সময় কাটছে। অন্যকিছু নিয়ে যে একটু ভাবব, সে সময়টুকুও নেই।
এদিকে ঘনঘন টেলিফোন করছে উষসি। কী ব্যাপার, একেবারে ভুলে গেলে নাকি? জবাব দিই, আরে না, না, না। খুব ব্যস্ততার মধ্যে আছি। দেশের রাষ্ট্রপ্রধান এসেছেন, পরে কথা বলছি।
টেলিফোনটা রাখতে না রাখতেই আর একটা টেলিফোন বেজে ওঠে। তারপর আর একটা। তারপর আর একটা। সচিব। মহাপরিচালক। রাষ্ট্রদূত। বিভিন্ন রকম তথ্য। মাথাটা গড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে।
ওদিকে উষসি বারবার রিং দিচ্ছে। এককানে রিসভিারটা ধরে অন্য আর একটা টেলিফোনে কথা বলতে হচ্ছে।
তারপরও উষসিকে বলছি, সংক্ষেপে বলো, কথা বলার সময় কম।
রাগ করে উঠেছে উষসি। রেখে দাও তোমার ধান্দাবাজি। সবকিছু বুঝি।
রাগ করো না, বলো, কী বলতে চাও বলো?
তুমি যে কি করছ, তা আমার জানা। রুশ মাগিদের নিয়ে ফষ্টিনষ্টি করে বেড়াচ্ছ। হারামির বাচ্চা, ভদ্কা খাচ্ছ, মাগিদের বুক চাটছ, আর কত মাগি মানুষ ভোলাবা?
আরও অনেক কিছু বলে গালি দিতে শুরু করল। কান ঝালাপালা হয়ে গেল ওর অভদ্রসুলভ বাক্যবাণে।
বাধ্য হয়ে টেলিফোনটা রেখে দিই। এছাড়া কী করার আছে?
প্রতিদিন চলতে লাগল টেলিফোনের মাধ্যমে আমাকে অপদস্থ করা। একটা মানসিক যন্ত্রণায় আমি ভুগতে লাগলাম।
হঠাৎ করে লন্ডনে যাওয়ার একটা সুযোগ পেয়ে গেলাম। পি. এম আসছেন। লন্ডনে যেতে হবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নির্দেশ দিয়েছে পি.এম.কে কূটনৈতিক বিষয়ে আলোচনায় সহযোগিতার জন্য জনি আহমেদকে মনোনীত করা হয়েছে।
খুবই খুশির খবর। আমি বিষয়টা উষসিকে জানালাম না। ভাবলাম, নীরবে নিভৃতে লন্ডনে গিয়ে আকস্মিকভাবে দেখা করব উষসির সঙ্গে।
বলব, এই যে এসেছি, এবার যত পার গালাগালি দাও। অপরাধী কাঠগড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে।
আমি কনফারেন্সের তিন দিন আগে লন্ডনে পৌঁছালাম। হাইকমিশনে গিয়ে হাজিরা দিলাম। সেখান থেকে সরাসরি চলে এলাম ইস্টহামে। এসে দেখলাম ছেলে আছে। উষসি নেই।
শাশুড়ি বললেন, উষসি তার কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে অকল্যান্ডের হোয়াইট হাউস স্টেটে চলে গেছে। কয়েকদিন পরেই ফিরবে। টেলিফোনে কথা বলতে পার।
আমি টেলিফোনে কথা বলিনি। ইচ্ছেও হয়নি। বাচ্চাটা কোলে নিয়ে ঘরের মধ্যে ঘুরে বেড়ালাম। তার জন্যে রুশ দেশ থেকে এনেছিলাম কিছু খেলনা ও শার্ট প্যান্ট।
বাচ্চাটা হাঁটতে শিখেছে। হ্যাঁ, হু, বোলও শিখেছে। শরীরটা বেশ গোলগাল। স্বাস্থ্যবান। গিয়েছিলাম দুপুরের আগে। সন্ধ্যায় ফিরে এলাম দূতাবাসের ভাড়া বাড়িতে। মনে হতে লাগল, ওর মা নেই, মা মরা বাচ্চা। বাচ্চাটাকে ফেলেই চলে গেছে উষসি পুরুষ বন্ধুদের সঙ্গিনী হয়ে।
পি.এমের কনফারেন্সের পর আবার ছেলেটাকে দেখতে গেলাম। কোলে নিয়ে আদর জানালাম। ছেলেটা আমার বুকের ওপরে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল।
শাশুড়ি বললেন, উষসিকে তোমার কথা বলেছি। এখন আসতে পারবে না। বলেছে, আসতে দেড় সপ্তাহ লাগবে।
শুনলাম, কোনো জবাব দিলাম না।
তিন দিন ছেলেটাকে নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ালাম। ছবি তুললাম। ওর হেঁটে বেড়ানো ছবি, বসে থাকার ছবি। ঘুমোনোর ছবি। ছবিগুলো তুলে মনে হলো, আমি আমার আত্মার ছবি তুলেছি। ছেলেটাকে পেয়ে মনে একটু সান্ত্বনা এলেও মনের মধ্যে একটা চাপা ক্রোধ। মাথাটা বিগড়ে দিচ্ছিল। ক্রমান্বয়ে ক্রোধ বাড়ছিল। পেটের সন্তান ফেলে কোনো মা কি এভাবে বাইরে কাটাতে পারে? এটা একজন পুরুষ কি বরদাশত করতে পারে? রাগে আমার বুক ফেঁটে যাচ্ছিল।
শাশুড়ি বললেন, কী করব বাবা, ওর বন্ধুরা এসে বলল, অমনি গাড়িতে উঠে চলে গেল।
বললাম, এটা কি উচিত হয়েছে মা?
ওর মা বলল, বললাম ছেলেটাকে সঙ্গে নিয়ে যা। কিছুতেই নিয়ে গেল না ও। জিজ্ঞেস করলাম, বন্ধুদের মধ্যে কে কে এসেছিল?
গাড়িতে ছিল দুজন। অস্টিন ও আব্রাহাম।
মনটা খারাপ হয়ে গেল। দুজনের চরিত্র সম্পর্কে আমি জানি। দুজনেই মাতাল। দুজনেই ড্রাগ সেবন করে। দুজনেই ভ্রষ্ট। তবে দুজনেরই বাবা ধনাঢ্য। ঘেন্নায় আমার বমি আসতে লাগল। এইসব পাঁড়মাতালদের সঙ্গে ওর ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব। জীবনে কি ভুলই না করেছি ওকে বিয়ে করে। একটা অনুশোচনায় আমি ভুগছি। বাচ্চাটার গালে একটা শেষ চুম্বন দিয়ে মস্কোয় চলে এলাম। বাচ্চাটা একাকী পড়ে থাকল লন্ডনে।
তিনদিন পর উষসি ফোন করল, হাহা করে হাসল, কী করতে এসেছিলে লন্ডনে?
বললাম, তুমিই তো জানতে চাওনি, এখন প্রশ্ন করে কী হবে?
হো হো করে হাসতে লাগল উষসি।
বলো, মস্কোয় কবে নিয়ে যাবা? তোমার ছেলেটাকে একটা হোমে পাঠিয়েছি। দারুণ বিরক্ত করছিল বাচ্চাটা। ছেলেটার জন্যে বছরে দশ হাজার পাউন্ড খরচ হবে। খুউব সুন্দর পরিবেশ।
কতদিন হোমে থাকবে?
এডাল্ট না হওয়া পর্যন্ত। মনের আনন্দে সময় কাটানো যাবে। বলো, কবে মস্কোয় নিয়ে যাবা? ওখানে বাচ্চা নিয়ে যাব না-থাকব কেবল তুমি আর আমি। অঢেল সময় কাটাতে পারব। হো হো করে অনেকক্ষণ হাসল উষসি।
আমি কোনো জবাব দিলাম না। ঝিম মেরে রইলাম।
এই, রাগ করেছ নাকি?
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। মনের ভেতরে অভিমান ছিল, রাগ ছিল, আস্তে আস্তে তা স্তিমিত হয়ে আসতে লাগল।
এই, কথা বলছো না কেন? বলো, কবে নিয়ে যাবা?
তুমি সত্যি সত্যিই আসবে?
হ্যাঁ, সত্যি সত্যিই যাব। কোনো সন্দেহ আছে নাকি?
আচ্ছা, ঠিক আছে পরে জানাব।
আমাকে আনতে হয়নি। দশদিন পর উষসি নিজেই মস্কোয় চলে এলো।
বললাম, কী ব্যাপার জানালে না কেন?
ও বলল, তুমি যেভাবে আমকে না জানিয়ে লন্ডনে গিয়েছিলে, আমিও ঠিক সেইভাবে তোমাকে না জানিয়ে মস্কোয়, চলে এলাম। গলা জড়িয়ে ধরে গালে কড়া একটা চুমু দিয়ে হাসতে লাগল, কী, রাগ কমেছে তো?
কী আর করা? সবকিছু ভুলে গেলাম। আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠলাম। ছুটির দিন রাশিয়ার বিভিন্ন স্থানে দুজনে গিয়ে ঘুরেফিরে আসি। লেনিন গ্রাদে বেশ কয়েকবার গিয়েছি। লেনিনের মর দেহটা যে যাদুঘরে শোয়ানো রয়েছে, তাও দেখে এসেছি।
দু’একজন রুশ মেয়ের সঙ্গেও উষসির বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। তারাও মাঝে মাঝে উষসির কাছে এসে গল্প করে যায়। সবাই মিলে ভদকা খায়। বেশ হৈ হুল্লোড় করে সময় কাটে উষসির।
কখনো কখনও বলি, মায়াকোভবা, জাকিয়েভবাকে তোমার চোখে কেমন মনে হয়?
ঠোঁট টিপে হাসে উষসি।
কেন, এ কথা জিজ্ঞাসা করছ কেন?
আরে বলো না, ওরা কেমন?
খুউব ভালো। তোমার পছন্দ হয় নাকি?
আমিতো ওদের সঙ্গে কখনও মেলামেশা করিনি।
তাহলে অন্য কেউ আছে নাকি?
দূর।
তবে আমি মস্কোয় আসার আগে কাদের সঙ্গে তোমার ভাব হয়েছিল?
কারও সঙ্গে নয়।
মিথ্যা কথা বলছ তুমি। মেয়ে মানুষ ছাড়া একাকী থেকেছ নাকি?
হ্যাঁ, তাই।
মোটেই না। তুমি যে কতটুকু সাধু তা আমি জানি। আমার মাথার চুল ছুঁয়ে বলো কার সঙ্গে রাত কাটাতে তুমি।
কারও সঙ্গে নয়।
তোমার অফিসে যে মেয়েরা আছে, ওদের তুমি চুমু খাওনি?
বলো কী?
হ্যাঁ, খেয়েছ, বুকও চুষেছো। তাই না?
আমি ওর চোখের দিকে তাকাই। সন্দিহান চোখ। বেড়ালের মত চোখ। এমনি একটি ভাব যে সবকিছু ওর জানা। যা কখনও ঘটেনি। তাও সে জেরা করে করে টেনে বার করে এনে সত্য বলে চালানোর অপচেষ্টা করছে।
বললাম, তুমি কি আমাকে হেয়প্রতিপন্ন করছ?
না, তা নয় তুমি যে সাধু নও, তুমি যে ভণ্ড, এটাই জানতে চাই। লুকাচ্ছ কেন? ওর চোখ দুটো ক্রুর হয়ে উঠেছে। বেশি কথা বললে, উত্তেজিত হয়ে লাফিয়ে এসে নোখ দিয়ে সারা শরীরটা হাঁচড়ে দেবে।
আমিও তো মাগি মানুষ। আমাকেও তুমি যেভাবে টেস্ট করেছ, ওদেরও তুমি একইভাবে টেস্ট করোনি?
বললাম, বিশ্বাস করো, আমি নারী লোলুপ নই। কাউকে ওভাবে ব্যবহার করিনি।
রাখ তোমার বিশ্বাস। পুরুষকে আমি চিনি। সব পুরুষের একই রকম স্বভাব। মেয়ে লোক কোলের মধ্যে পেলেই কুকুর হয়ে যায়।
লজ্জায়, আমার মাথা নত হয়ে এলো। কী বলছে উষসি?
শোনো, মিথ্যা কথা বলো না। আমার কাছে সাধু সেজো না। আমিও সতী মাগি নই। তবুও পুরুষ মানুষকে আমি ভালোবাসি। এদেশের মেয়েরাও পুরুষের সঙ্গ নেয়। পুরুষ ছাড়া চলতে পারে না। তারা যে তোমার বিছানায় শোয়ইনি, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়।
এই ধারণাটা তোমার অলীক ধারণা। আমি সে রকম চরিত্রের লোক নই।
হো হো করে হাসল উষসি। ওর হাসি আর থামে না। গলা টানা হাসি। তবে তুমি সাধু লোক? বাহ্।
আমি তর্কে জড়াতে চাইনি। মানসিকভাবে কিছুক্ষণ চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লাম। এ কার সঙ্গে কথা বলছি? কার সঙ্গে আমি ঘর করছি? একি আমার স্ত্রী? না, অন্যকোনো নারী? মনেমনে অনেককিছু ভাবলাম। ওর ভেতরে একটা পাপবোধ আছে। ও যেটা করে, সেটাকে রক্ষা করার জন্যে অন্য ব্যক্তিত্বের ওপর আঘাত করে নিজেকে খাঁড়া রাখতে চায়। আমি ভালো না তুমি ভালো এটা সে পছন্দত করে না। তার দৃষ্টিতে আমিও যেমন মন্দ, তুমিও তেমন মন্দ। ব্যস।
আমি ওর যুক্তি শুনে মর্মাহত হলাম। ভালো মানুষের মত নয় ক্রোধ সংরবণ করে বারান্দায় এসে বাইরের পৃথিবী দেখতে লাগলাম। চারদিকে ধূসর। ঝির ঝির করে বরফ পড়ছে। রাস্তা ঢেকে আছে কুচিকুচি বরফে। শীতের হাওয়া। বারান্দা থেকে ঘরে ঢুকে দরোজা জানালার কপাট লাগিয়ে দিলাম।
উষসি টেবিলে মদের বোতল এনে গেলাসে ঢেলে চুকচুক শব্দ করে গলায় ঢালতে লাগল। আমাকে দেখে বলল, এই নাও, তুমি তো সন্তু মানুষ গলাটা একটু ভিজিয়ে নাও। চলো, বিছানায় শুয়ে একটু কাতুকুতু করি। বড্ড ইচ্ছে হচ্ছে।
কয়েক পেগ একরকম পেটে ঢুকিয়ে আমাকে বুকে জড়িয়ে চুকচুক করে চুমু খেতে লাগল।
ধবধবে শাদা কম্বলের মধ্যে নিজের দেহটা ঢুকিয়ে দিয়ে আমিও ওর ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়ে বুকের মধ্যে টেনে নিলাম।
মনটা ভালো ছিল না। ওর দেহের উষ্ণতা পেয়ে মনটা কিছুক্ষণের মধ্যে চাঙ্গা হয়ে উঠল।
বলল, তুমি যে বোকা মানুষ নও, তাও আমি জানি। তবে আমার কাছে তুমি ভালো মানুষ সাজার চেষ্টা কর, এটাই আমার দুঃখ। কেন, আমি তোমার খায়েশ পূরণ করি না? কখনও তো তোমাকে ঘাড় ধরে বার করে দেবার কথা কি বলেছি?
না।
তবে আমার কাছে সবকিছু লুকাও কেন? আমিতো সবসময় বলে আসছি, আমার কথার উপরে তুমি একটা কথাও বলবে না। বলো, বলিনি?
হ্যাঁ, বলেছ।
বলো, আর বলব না।
আর বলব না।
ঠিক তো?
হ্যাঁ, ঠিক।
মনে থাকে যেন।
হ্যাঁ, মনে থাকবে।
উষসি আমার মাথায় আর বুকে হাত দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিল। আমি ঘুমের অন্ধকারে ডুবে গেলাম।
মস্কোর দিনগুলো বেশ ভালোভাবেই কাটতে লাগল। কোথায় কোন কাফে আছে এখন ওর মুখস্থ হয়ে গেছে। কোন কাফেতে গিয়ে কোন কোন মদ পাওয়া যায়, আমার চেয়ে উষসি বেশি জানে। আমি এ ব্যাপারে আনাড়ি। কূটনৈতিক ব্যাপারে কোন কোন অনুষ্ঠানে গিয়ে ভদ্রতা রক্ষার খাতিরে একটু একটু মদ গিলেছি। তবে কখনও নেশাগ্রস্ত হইনি। কেউ আমার বোগল ধরে মাতাল অবস্থায় সিঁড়ি থেকে নামিয়ে গাড়িতে তুলে দেয়নি। মুখেও কখনও খিস্তি করিনি।
উষসি মদ্য পানে পারঙ্গম। ককটেল ছাড়া আর কিছু পছন্দ করে না। যেখানেই খায় সেখানে সে প্রাণ ভরে খায়। মদ পান করে আবোল তাবোল কথা বলে। কেন এত খায, আমি বুঝতে পারি না। ওকে পাঁজাকোলে করে কখনও কখনও আমি গাড়িতে তুলে বাসায় এনেছি। ভীষণ খারাপ লাগে। মনটা চুপসে যায়। হাজার হোক ঘরের বউ। তারও তো উচিত সামলে সমাজে চলা। ওকে আমি বহুবার মাতাল হতে নিষেধ করেছি।
বলেছি, এরকম আর কোরো না। প্রেস্টিজ হ্যাম্পার হয়।
আরে ছেড়ে দাও তোমার প্রেস্টিজ। তুমি একটা আনকালচারড। মূর্খ। কপাল গুনে ফরেন সার্ভিসে ঢুকেছ? ডু ইউ নো, হোয়াট ইজ দ্য মডার্ন লাইফ? লাইফ অনলি ফর ইনজয়েইং।
আমি ওর কাণ্ড দেখে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ি।
উষসির মন ঘরমুখী নয়। ঘরের মানুষেরা এরকম কাণ্ড ঘটাতে পারে না। বুঝানোর চেষ্টা করেছি। বুঝতে চায়নি। ড্যাম কেয়ার মনোভাব।
প্রায় এক বছর কেটে যাচ্ছে আমাদের এখানে। মস্কোর জীবনটা কখনও সুখে, কখনও দুর্ভাবনার মধ্যে কেটে যেতে লাগল। বাইরে থেকে বুঝার উপায় নেই, আমরা কেমন আছি। বন্ধুরা বলেন, সুখি দম্পতি। যেখানেই যাচ্ছি। এক সঙ্গে যাচ্ছি। অর্থাৎ আমরা সুখি দম্পতি।
হঠাৎ করে ওর শরীরটা অসুস্থ হয়ে উঠল। ঘনঘন বমি। খাওয়ার প্রতি রুচি নেই। আমাদের এম্বাসির মহিলা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। তিনি পরীক্ষানিরীক্ষা করে হেসে বললেন, শুভ সংবাদ, নতুন অতিথি আসছেন।
বাসায় এসে উষসি মনোক্ষুণ্ন হয়ে শুয়ে পড়ল।
আমি ওর মাথার কাছে বসে আদর করতে লাগলাম।
উষসি বলল, আর একটা ঝামেলার মধ্যে পড়লাম।
ঝামেলা ক্যান?
ঝামেলা না তো কী?
খুশির খবর তো।
আমার খারাপ লাগছে। কিসের খুশি?
আমি ওর মুখের দিকে তাকালাম। চোখ মুখ লালচে হয়ে উঠেছে। এই ঝামেলাটা তুমি বাঁধিয়েছ। আমার পেটে ঝামেলটা ঢুকিয়ে দিয়ে খুব খুশি হয়েছ? এর নাম খুশি?
কোন জবাব দিলাম না। অহেতুক কথা বাড়িয়ে লাভ কী।
উষসি রাগারাগি করতে লাগল। আমার ওপর ওর যত রাগ। শারীরিক অসুস্থতা ক্রমে বাড়তে লাগল। আমি নিয়মিত ওকে ডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে যেতে লাগলাম। মেজাজটা আরও খিটখিটে হয়ে উঠেছে।
একদিন বললাম, তুমি যদি অস্বস্তি মনে কর, তবে ফেলে দিতে পার।
তুমি কী বল?
এটা তোমার ব্যাপার।
আমার ব্যাপার মানে?
কোনো রকম উত্তেজিত হয়ো না। একটু বুঝার চেষ্টা কর।
আমার ইচ্ছে করছে, তোমাকে চাবকাই।
আমি চুপ করে গেলাম। মেজাজটা ওর উগ্র হয়ে উঠছে। দাঁত খিচিয়ে বকবক করতে লাগল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চেহারা দেখতে লাগল। চেহারাটা দিন দিন বদলে যাচ্ছে। চুলও অবিন্যস্ত। চোখ, মুখ, গলা, বুক, পেট আগের মতো নেই। রাতের বেলা ঘুম হয় না ওর। বিছানায় শোয়ার আগে কয়েক পেগ মদও খায়। এতেও ঘুম আসে না উষসির।
বিষয়টি ডাক্তারের কাছে বলেছি। ডাক্তার ওষুধ দিয়েছেন। তবুও দেখি ঘুম হয় না ওর। একদিন সকালবেলা উষসি আমাকে বলল, আমি ভাবছি লন্ডনে চলে যাব।
আমি সহজভাবে বললাম, পাঁচ মাস চলছে।
আমি চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
কবে যেতে চাও? বলো?
আব্রাহাম টিকিট পাঠিয়েছে।
কে পাঠিয়েছে?
আব্রাহাম।
আব্রাহাম টিকিট পাঠাল কেন?
এরও কৈফিয়ত দিতে হবে নাকি?
ও, এই কারণেই বুঝেছি, কেন তোমার ঘুম হয় না।
সাট আপ।
সাট আপ কেন? খারাপ কথা কী বলেছি?
ইউ সাট আপ। নইলেÑ
তুমি উত্তেজনা প্রকাশ করছ কেন? কোন ড্রাগ খাও নাকি?
উষসি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল, তুমি একজন অভদ্র জানোয়ার। তোমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখব না। আই শ্যাল গিভ ইউ ডিভোর্স ব্র“ট, আমার পেটে একটা বাচ্চা ঢুকিয়ে দিয়ে তামাশা করা শুরু করেছ, তাই না? আই অনট সেপারেশন। কুইকলি এই যাচ্ছি। আর কখনো ফিরব না। ব্লাডি, ননসেন্স। ফুল। হ্যাঁগার্ড। থুÑ
সকালবেলাটা অশুভ হয়ে উঠল। এ কোন মেয়ে মানুষের পাল্লায় পড়লাম। পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলতে লাগল। আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। সমস্ত শরীর কাঁপছে। অফিসে এসে ভাবতে লাগলাম, কী করণীয়। ও আমাকে তালাক দিতে চেয়েছে। তার আগে কী আমি ওকে তালাক দেব? মনটা অশান্ত। অস্থির। উদ্বেগাকুল। মাথায় কোনো কিছু ঢুকছে না। কী করব আমি। একবার চেয়ারে বসছি। আর একবার পায়চারী করছি। মাথার মধ্যে কোনকিছু ঢুকছে না।
তারপর শরীরটা আস্তে আস্তে এলিয়ে আসতে লাগল। আমি ঝিমমেরে বসে রইলাম। ভাবতে লাগলাম, ঝোঁকের বশবর্তী হয়ে কোনো কাজ করা উচিত নয়। এত তাড়াহুড়ো করে লাভ কী। আরও কয়েকদিন অপেক্ষা করি। অবস্থাটা কোনদিকে যায়।
সন্ধ্যেবেলা ঘরে এসে দেখি উষসি নেই। দরোজা বন্ধ।
কেয়ারটেকার এসে বলল, মাদাম নেই। ঘরের চাবিটা রেখে গেছেন।
আমি দরোজাটা খুললাম। আলো জ্বালালাম। বেড রুমে গিয়ে দেখলাম বালিশের পাশে একটা চিঠি।
উষসি লিখেছে, বিকেলে ফ্লাইট। লন্ডনে যাচ্ছি। আর হয়ত কখনও দেখা হবে না। বিদায়। ইতি-উষসি।
আমার মনটা উদাস হয়ে উঠল। ভাবলাম, সুখের আশায় ঘর বেঁধেছিলাম, সেই ঘরটা শেষ পর্যন্ত অনলে পুড়ে গেল। শুধু ঘরই যে পুড়েছে তা নয়, আমাকেও পুড়িয়ে দিয়ে গেল। একটা মানসিক বেদনায় আমার অন্তর দগ্ধ হতে লাগল। ভিতরে ভিতরে একটা অস্থিরতা অনুভব করতে লাগলাম।
বারবার মনে হতে লাগল, উষসি আমাকে এতকাল কী প্রতারণা করে এসেছে? হ্যাঁ, আমিই ছিলাম তার প্রতারণার শিকার। আমি প্রতারিত হয়েছি। একবার নয় বহুবার। ওর সঙ্গে আমার সকল সম্পর্ক ছিন্ন করা উচিত।
আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, একটা কিছু আমাকে করতেই হবে। আমি ভেবেছিলাম হয়ত উষসি আমাকে বিচ্ছেদের কাগজপত্তর পাঠাবে। কারণ সেইতো আমাকে তালাক দিতে চেয়েছে। আমি অপেক্ষায় থাকলাম। তিন মাস কেটে গেল। আমি বদলি হয়ে চলে এলাম ওয়াশিংটন।
উষসির বিষয়টি নিয়ে আর ভাবনাচিন্তা করি নি। যে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা ছিল ওয়াশিংটনে এসে তা মাথা থেকে একেবারে ঝেড়ে ফেললাম। উষসি নামে কেউ যে আমার ছিল, এটা আমি একরকম ভুলে গেলাম। দূতাবাসের কাজ নিয়ে সময় কাটতে লাগল।
হঠাৎ করে একদিন দুপুর বেলা অ্যাম্বাসেডর তার কক্ষে ডাকলেন, তিনি বললেন, মিস্টার জনি, আপনার জন্য একটা সুখবর আছে।
আমি তার দিকে চেয়ে রইলাম।
তিনি হাসলেন। বললেন, মিস্টার জনি, আপনার একটা পুত্রসন্তান হয়েছে। কিছুক্ষণ আগে আপনার শ্বশুর আমার নিকট টেলিফোন করেছিলেন। যদি ছুটি চান, তবে যেতে পারেন।
নবাগত সন্তানের কথা শুনে আমি বিগলিত হয়ে উঠলাম। মনটা উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। আবার আমি আরও একটি সন্তানের বাবা হয়েছি। বাবা, বাবা, বাবা। কী অসাধারণ ব্যাপার। আমি বাবা হয়েছি।
অ্যাম্বাসেডর বললেন, আপনার শ্বশুর আমাকে অনুরোধ করেছে, আপনাকে ছুটি দেওয়ার জন্যে।
আমি বললাম, আমি আপনাকে পরে জানাব।
আমি আমার কক্ষে এসে বসতেই কয়েকজন সহকর্মী এসে আনন্দ প্রকাশ করলেন। মনটা হাসিখুশিতে ভরে উঠল। বাবা হয়েছি বলে ওরা অভিনন্দন জানাচ্ছে। ওইদিন সন্ধ্যার পরে সহকর্মীদের নিয়ে একটা হোটেলে গিয়ে বাচ্চার জন্মোৎসব পালন করলাম। হৈহুল্লোড় করে বন্ধুদের সঙ্গে শেরি পান করলাম। বাবা হওয়ার আনন্দে আমি ভাসতে লাগলাম।
রাতে ঘরে এসে নিরুদ্বিগ্ন চিত্তে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখলাম, বাচ্চাটা আমার বুকের মধ্যে তার নরম মাথাটা গুঁজে দিয়ে শুয়ে রয়েছে। পরদিন শাশুড়ি সরাসরি আমার কাছে টেলিফোন করলেন, জনি, তোমার ছেলেটাকে একবার দেখে যাও। উষসি বারবার তোমার কথা বলছে। তোমাকে দেখতে চায়। চলে এসো। আসবে তো?
কী করি। বাচ্চাটা দেখার জন্য মনটা উত্তাল হয়ে উঠেছে।
দশদিন ছুটি পেলাম। পরদিন সকালে ফ্লাইটে লন্ডনে এলাম। শ্বশুর বিমানবন্দরে গাড়ি পাঠিয়েছিলেন। হিথরে থেকে ইস্টহামে এসে দেখি দরোজায় পিঠ রেখে আমার জন্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে উষসি।
গাড়ি থেকে নামতেই উষসি আমাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরল। আমার মনের মধ্যে দীর্ঘদিন যাবৎ মান-অভিমান ও ক্রোধ ছিল, তা মুহূর্তের মধ্যে উধাও হয়ে গেল। কী খুশি। হা হা করে হাসতে লাগল উষসি।
আমার শাশুড়ি ঘরের মধ্যে থেকে নবজাত শিশুকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে আমার কোলে তুলে দিল। ফুটফুটে বাচ্চাটা চোখ মেলে আমাকে তাকিয়ে দেখতে লাগল। আমার চোখ বেয়ে আনন্দাশ্র“ গড়িয়ে পড়তে লাগল। কোমল ফুলের মত সুশ্রী। চোখ দুটো কালো। বারবার পলক নাড়ছে।
শাশুড়ি বললেন, একেবারে তোমার মত হয়েছে তোমার ছেলেটা।
আমি আমার বুকের ওপর বাচ্চাটাকে তুলে নিয়ে কয়েকবার আদর করে চুমু দিলাম। উষসি হাসতে লাগল। মন খোলা হাসি।
আমি আমার নবজাত সন্তানটিকে দেখে অভিভূত হয়ে গেলাম।
আমি সন্তানের বাবা হয়েছি, গর্বে আমার বুক ফুলে উঠল। একটি সন্তানের বাবা নয়, দুটি সন্তানের বাবা।
উষসি হাত ধরে টানতে টানতে ওর ঘরে নিয়ে গেল। ঘরটা মনোরম করে সাজানো গোছানো।
উষসি বলল, কেমন লাগছে ঘরটা?
খুউব সুন্দর।
তুমি আসবে বলে সাজিয়েছি।
বাহ, কী চমৎকার।
উষসির শরীর দুর্বল। তবুও বেশ সতেজ ও ঝলমলে মনে হচ্ছে। ঠোঁটে শুভ্র হাসি। মনে হচ্ছে বিশ বছরের যুবতী। শরীরের ওপর দিয়ে যে একটা ধকল গিয়েছে, তা ওর চোহারা দেখে মনে হচ্ছে না।
উষসি আমার গলা জড়িয়ে ধরে কয়েকবার ঠোঁটে ঠোঁট রাখল।
প্রায় সপ্তাহকাল আমাদের সময় কেটে গেল বাচ্চাটা নিয়ে। ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে ঘনঘন স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো হল। বাচ্চাটা আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। ওর নাম রাখা হলো আমার নাম অনুকরণ করে বনি আহমেদ।
বললাম, অন্য নাম রাখো।
উষসি বলল, এই নামটিই আমার পছন্দ।
আমি বললাম, এখন কী করতে হবে বলো, আমার সঙ্গে কী ওয়াশিংটনে যাবে?
উষসি বলল, বনিরে হোমে রাখতে চাই। ও আর একটু বড় হোক। ওকে নিয়ে এখন ওয়াশিংটনে যাওয়া যাবে না।
ঠিক আছে। এ ব্যাপারে তুমি যেটা ভালো মনে কর, সেটাই হবে।
হঠাৎ করে উষসি আমার কাছে ঘরোয়া মেয়ের মতো হয়ে উঠল। মনে হলো, আগের মতো চালচলন নেই। স্বভাবটা অনেকখানি বদলে গিয়েছে। মনে হলো, ঘর সংসারের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছে। আমার সঙ্গে খুউব ভালো ব্যবহার করছে। আমি যেখানে যাচ্ছি সেখানেই সঙ্গ দিচ্ছে উষসি। আমার যে মত ওরও সেই মত। স্বপ্ন দেখছে আমার দুটি বাচ্চাকে নিয়ে।
উষসি বলল, তোমার বড় ছেলে টনি আহমেদ হতে চায় বিজ্ঞানী। সে রসায়নের উপর ডিগ্রি নিচ্ছে। বনিকে নিয়ে এখন চিন্তা।
আমি ওর কথা শুনে আনন্দ প্রকাশ করলাম।
বললাম, এরা তো দুজনে ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরবে না। ইউরোপ, না হয় ইউএসএ থাকবে। ওদের গড়ে তোলার দায়িত্ব তোমার। আমিতো চাকরি করে কাটালাম। এদেশে সেদেশে।
উষসি বলল, আমার কাছে উত্তম হলো ব্রিটেন। এদেশেই ওরা থাকবে। কী বলো তুমি?
আর কতদিন চাকরি আছে তোমার? উষসি বলল।
ধরো বার বছর।
এই বছরের মধ্যেই ওরা অনেক কিছু জেনে যাবে। জন্মসূত্রে ওরা ইংল্যান্ডীয়। ব্রিটেনের নাগরিক। তুমিই কেবল এখানকার নাগরিক নও। আমরা দুজনেই হো হো করে হাসলাম। রসিকতা করে বললাম, অর্থাৎ তুমি হলে কাক। আমি হলাম কোকিল। বাচ্চা ফুটানোর এবং বড় করার দায়িত্ব তোমার। আমার নয়।
উষসি হাসতে হাসতে আমার বুকের ওপর মাথা রাখল।
বলল, বা চমৎকার। তা হলে বলা যায়, তুমি যে দেশে গিয়েছ, সে দেশেই ডিম দিয়েই ভেগে পড়েছ? এরকম কতবার করেছ? দুষ্ট কোথাকার।
আমি বললাম, স্থায়ীভাবে একটা কাকপক্ষীর বাসাতো আছে আমার ইংল্যান্ডে।
আবার দুজনে মনের খুশিতে হাসাহাসি করলাম।
শাশুড়ি ঘরে ঢুকলেন। তার ঠোঁটেও হাসি।
কীরে, এত হাসাহাসি ক্যান?
উষসি বলল, তোমার জামাইকে জিজ্ঞেস কর, মা।
তোদের দুজনকে আজ আমি বাঙালি খানা খাওয়াব। মাছ, ভাত। ডাল ভাত।
আমি বললাম, বহুদিন খাইনি, মা।
আজ তোমাদের খাওয়াব।
আট দিন ইংল্যান্ডে ছিলাম। মনের আনন্দেই কেটেছে। ছুটি ফুরানোর একদিন আগেই ওয়াশিংটনে চলে এলাম।
এরপর থেকে আমি যেখানেই গিয়েছি, সেখানেই নিঃসঙ্গ। একা। পরিবারসহ বাস করিনি। উষসি ইংল্যান্ডেই থেকে গেছে। আসব, আসব করেও আসেনি। বরং মাঝে মাঝে আমি উষসি ও বাচ্চা দুটোকে দেখার জন্যে ইংল্যান্ডে পাড়ি দিয়েছি।
ওয়াশিংটনে ছিলাম আমি দু’বছর ছ’মাস। সেখান থেকে আমাকে বদলি করে পাঠানো হয় কায়রো। কায়রোয় আড়াই বছর কেটেছে। তারপর জাপান। জাপান থেকে ঢাকায়। সার্কের একটা গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্টিত ছিলাম। চাকরির অবশিষ্টকাল শেষ হয়েছে আমার নিজ শহরে, বিদেশ মন্ত্রণালয়ে।
উষসি বলল, ঢাকায় অবস্থানের জন্য একটা বাড়ি কর। ছেলে দুটো বলছে, পূর্ব পুরুষের দেশ। মাঝে মাঝে অবসর সময়ে ওরা যাবে।
আমি বললাম, তুমি থাকবে কোথায়?
উষসি বলল, যে ক’দিন আছি সে ক’দিন তোমার সঙ্গেই থাকব।
কোনো ব্যতিক্রম হবে নাতো?
ব্যতিক্রম হবে ক্যানো? বয়স তো কম নয়, প্রায় পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই। এই বয়সে দুজনেই একই সঙ্গে থাকব। ছেলেদের বিয়ে হয়ে গেলে ওরা থাকবে ওদের মতো। আমরা থাকব আমাদের মতো। ব্যস।
পঞ্চাশ দশকের দিকে তেজগাঁও ছিল বনে জঙ্গলে ঢাকা। আমার পিতা এখানে কয়েক বিঘা জমি কিনেছিলেন। সেই জমির সীমানা পাঁচিলও দেওয়া হয়েছিল। ষাটের দশকে এসে জঙ্গল সাফ করে এখানে জনবসিত গড়ে উঠেছিল। আমার বাবার ইচ্ছা ছিল, তেজগাঁওয়ে, তিনি আলিশান একটি বাড়ি করবেন। বাবার সেই ইচ্ছা পূরণ হয়নি। আমি আমার বাবার ইচ্ছা পূরণ করেছি।
তেজগাঁওয়ে বাড়ি করলাম। ছিমছাম সুন্দর একটা বাড়ি। বাড়ির নাম রাখলাম ‘উষসি’।
উষসি শুনে বলল, তবে আর লন্ডনে কেন? আমার নামের বাড়িটিতেই আমি থাকব।
বাড়িটির ছবি পাঠালাম। সে দারুন উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। প্রশংসা করল। ও বলল, বাহ কী চমৎকার বাড়ি। শ্বেতপাথরে খুদাই করা বাড়িটির নাম। দৃষ্টি আকর্ষণীয় বাড়ি।
এক মাসের মধ্যে চলে এলো উষসি। প্রাচীর ঘোরা বাড়ি। একদিকে ফুলের উদ্যান। চারপাশে সুদৃশ্য গাছগাছালি। বাড়িটির ভেতর ও বাইরে কারুকাজ করা।
তিন মাস পর উষসি কোনো কারণ ছাড়াই আমার সঙ্গে খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে বিতণ্ডা শুরু করে দিল। ও যেখানে ইচ্ছা সেখানেই যাচ্ছে। কিছু বললেই পাল্টা জবাব দেয় উষসি।
সব কথা তোমাকে জানাতে হবে নাকি?
দেখো, রাগ করোনা। এই শহর লন্ডনের মত শহর নয়। যেকোনো মুহূর্তেই একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।
রেখে দাও তোমার দুর্ঘটনা। তুমি কি আমাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাও?
দেখো, এদেশের পরিবেশ ভালো নয়। বুঝার চেষ্টা কর।
এই, তুমি কী মনে কর? আমি মেডসার্ভেন্ট নাকি? আমি কোথায় যাই আর না যাই, কৈফিয়ত দিতে হবে নাকি?
আমি চুপ হয়ে যাই। নীরবে তাকিয়ে থাকি।
উষসি আঙুল তুলে আমাকে সাবধান করে দেয়।
দিস্ ইজ মাই লাস্ট ওয়ার্নিং। ইফ ইউ নেক্সট ট্রাই টু ডিসটার্ব মি, আই শ্যাল গো টু পুলিশ স্টেশন অ্যান্ড কোর্ট।
আমি ওর এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে মর্মাহত হই কিন্তু কিছু বলতে পারি না। মুখ বুজে সহ্য করি। বিষয়টি বর্তমান নৈমিত্তিক হয়ে উঠেছে।
আমার বয়স এখন পয়ষট্টি বছর। এই বয়সে একটু শান্তিপূর্ণভাবে জীবন কাটাতে চাই। পারিবারিক জীবনের প্রতি আমি আস্থা হারিয়ে ফেলেছি। হতাশা ক্রমান্বয়ে আমাকে গ্রাস করছে। বর্তমান এমন একটা অবস্থা যে, সবকিছুর মায়া ত্যাগ করে আমি নিরুদ্দেশে চলে যাওয়ার কথা চিন্তা করছি।
আমি চাইছি একটি অখণ্ড শান্তিময় নির্ঝঞ্ঝাট নিরুপদ্রব জীবন। কোলাহলমুক্ত নির্জন জীবনযাপন। আমি সেই জীবনের উদ্দেশ্যে চলে যেতে চাই। আমার বন্ধু মূর্তাজা, আপাতত, তার ওখানেই আমি যেতে চাই। নগর আমাকে পাশবিক যন্ত্রণায় দগ্ধ করেছে। আমি হতাশাগ্রস্ত। আমি মুক্তি চাই। অর্থবিত্ত নয়। আমি চাই নিরুপদ্রব শান্তিময় জীবন। মূর্তাজা লিখেছেÑ
‘পৃথিবীর কত দেশে গিয়েছিস। আয়, আমার এই গ্রামে আয়। খোলা আকাশ। খোলা ময়দান। নির্মল বাতাস।
তুই, আমি আর অরণি তিনজন মিলে শান্ত নির্জন নিসর্গের মধ্যে হেঁটে বেড়াব। বিল বাঁওড় দেখব। পাখিদের উড়ে যাওয়া দেখব। ফাঁকা মাঠ দেখব। ধানক্ষেত দেখব। পাটক্ষেত দেখব। বিল বাওড়ের রূপালি মাছ দেখব। পাকা ধানের ক্ষেতের ভিতর দিয়ে হেঁটে বেড়াব। হলুদ শস্যের ক্ষেতের ঢেউ খেলানো মনোরম দৃশ্য দেখব। বর্ষার জলের ধারা দেখব। ফাগুনে আমের বউলে মৌমাছিদের গুঞ্জন ধ্বনি শুনব। পাখিদের কলরব শুনব। বিল বাঁওড় আর নদীর তীরে শাদা কাশ ফুলের দৃশ্য দেখব। যেখানেই যেতে চাস, সেখানেই দেখবি প্রকৃতির অপরূপ রূপ সৌন্দর্য।
আমি আর অরণি। একটা শান্তিময় নিসর্গের মধ্যে আছি। তুই যে জীবন উপভোগ করেছিস, সে জীবনের মধ্যে শান্তি নেই। রয়েছ চাহিদা আর চাহিদা। আমাদের দুজনের কোনো চাহিদা নেই। মোহও নেই।
আয়, চলে আয়। জীবনের অবশিষ্ট কয়েকটা দিন আমি, অরণি আর তুই একই সঙ্গে যাপন করব। দেখবি, জীবনটা কত মাধুর্যময় ও সুন্দর।’
আমি ওর চিঠি পড়ে মুগ্ধ হলাম। আমার মনে যে মোহ ছিল, মোহ থেকে মুক্ত হয়ে গেলাম। একটা দলিল তৈরি করলাম। স্ত্রী ও দুই পুত্রের নামে আমার যে সম্পত্তি আছে, তা দ্বিধামুক্ত চিত্তে অর্পণ করলাম। বণ্টননামায় সহিস্বাক্ষর করে আলমারিতে রাখলাম।
কিছু গচ্ছিত টাকা ছিল ব্যাঙ্কে, সেই টাকাগুলো ব্যাংক থেকে তুলে নিজের কাছে রাখলাম। ট্রেনের টিকিট কাটলাম। রাত বারোটায় ট্রেন। উদ্বেগ উৎকণ্ঠা থেকে মুক্ত হলাম। ঘরে ফিরে দুপুরবেলা ঘুমোলাম।
উষসির সঙ্গে কথা বলিনি। সে বিকেল বেলা প্রতিদিন ড্রেসিং টেবিলে বসে সাজগোঁছ করে নিজেকে সাজায়।
সন্ধ্যার পরপরই গাড়ি নিয়ে নিজে ড্রাইভিং করে চলে যায়। কখন ফিরে আসে তাও আমি জানি না।
আমি সন্ধ্যার আগেই বিছানা থেকে উঠে পড়ি। উষসির চলে যাওয়ার দৃশ্য দেখি। হেলে দুলে হেঁটে যায় উষসি। শরীরে সেন্টের উগ্র গন্ধ। সারা ঘরময় হাওয়ায় ভাসতে থাকে। যুবতী মেয়েদের মত সাজসজ্জা। পায়ে হাইহিল জুতো। হর্সস্টাইল চুল। এসব আজকাল আমাকে মুগ্ধ করে না। চোখ দুটো রাখি দেয়ালে। ও চলে যায়। আমি বিছানা থেকে উঠে গিয়ে দোতলার সিঁড়ি বেয়ে নিচেই নামি। উদ্যানে গিয়ে ফুলগাছ দেখি। ডালে ডালে ফুল। সবগুলো ফুল গাছে আমার হাতের আঙুলের ছোঁয়া রয়েছে। বাড়িটিও নির্মাণ করেছিলাম বিদেশি আর্কিটেক্ট এর নকশা নিয়ে। সুরম্য অট্টালিকা। এই শহরের হাজারের মধ্যে অতুলনীয় একটা বাড়ি। পথিকজনেরা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখত। বাড়িটির সৌন্দর্য অঙ্গে অঙ্গে। দুচোখ ভরে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম। এই স্বপ্নের বাড়িটির প্রতি আজ আমার কোনো মোহ নই। কোনো মায়া নেই।
বাড়িটি থেকে আজ রাতে আমাকে ছেড়ে চলে যেতে হবে নীরবে নিভৃতে। কেউ জানবে না, একটি পক্ষীও জানবে না, আমার ছেড়ে চলে যাওয়ার দৃশ্য।
সন্ধ্যার কালো আঁধারের মধ্যে বিদ্যুতের আলো জ্বলে উঠল। আমি আমার কক্ষে গিয়ে প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী গুছিয়ে নিলাম। চারটে পাজামা, চারটি পাঞ্জাবি। চারটে লুঙ্গি। চারটে গেঞ্জি। তিনটে তোয়ালে। লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি পরিধান করে ঘড়ির দিকে তাকালাম। এখন আমি এই শহরের কেউ নই। একজন অতিসাধারণ মানুষ। জনারণ্যে একজন।
এগারোটা বাজল। দেয়াল ঘড়িটি টিক টিক করে বেজে উঠল। আমি ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলাম। পায়ে স্যান্ডেল। শেষ সিঁড়িতে নেমে বাড়িটির দিকে আর একবার তাকালাম। তারপর দ্রুত পায়ে গেটের দরোজা খুলে সদর রাস্তায় এলাম। রাস্তার নিয়নবাতি জ্বলছে। একটা অটো এসে আমার সামনে দাঁড়াল, কোথায় যাবেন? চালক জিজ্ঞেস করল। বললাম, তেজগাঁও রেলস্টেশন।
পঞ্চাশ টাকা।
কোনো দরদাম না করে অটোর আরোহী হলাম। এর আগে কখনও আমি অটোয় উঠিনি। আমার নিজের জন্যে রয়েছে বিলাস বহুল গাড়ি। আজ রাতের বেলা সবকিছু পরিত্যাগ করে অতিসাধারণ একজন হয়ে গেলাম। স্টেশনে বিশেষ ভিড় নেই। ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে প্লাট ফরমে দাঁড়ালাম। একটু পরে লম্বা হুইসেল বাজিয়ে বারোটার ট্রেন এসে থামল। আমি তৃতীয় শ্রেণির একটি কামরায় উঠে বসলাম। ট্রেন ছেড়ে দিল। ঝিকঝিক শব্দ করে ট্রেনটি ছুটতে লাগল। পেছনে পড়ে থাকল আমার অতীত।
আমার চোখ দুটো নিদ্রায় ঢুলতে লাগল। আমার মনে হলো, আমি একটা খোলা মাঠের আলপথ বেয়ে হাঁটছি। আমার এক পাশে মূর্তাজা, আর এক পাশে অরণি। একটু দূরে বিশাল বিল। হুহু করে নির্মল বাতাস ছুটে আসছে। আকাশটা নীল। ঝাঁকঝাঁক পাখি মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। যেন উড়ন্ত পাখিগুলো আমাদের মাথার ওপরে উড়ে দিগন্ত জোড়া সবুজ শ্যামল মাঠ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। মনে হলো, অনাবিল শান্তি। মনপ্রাণ আমার অপার শান্তিতে ভরপুর হয়ে উঠতে লাগল।
আমি চোখ বুজে থাকলাম। ট্রেন চলতে লাগল।
সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ