বিস্মরণ : দীপেন ভট্টাচার্য

চারশ কিলোমিটার ওপর থেকে রাতের আঁধারে হীরের অলঙ্কার বলে ভাবতাম আমি পৃথিবীর শহরগুলোর আলোমালাকে। আমার সবচেয়ে প্রিয় ছিল লন্ডন, উজ্জ্বল মণি, হীরের টুকরোর মতো জ্বলজ্বল করত শহরটি। তারপর একদিন অন্যান্য শহরের মতো লন্ডনের সব বাতি নিভে গেল। মস্কোর কাছে করালিওভ স্টেশন থেকে বহু আগেই বার্তা আসা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। দু’খানা সোয়ুজ মহাকাশযান আমাদের আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনটিতে ডক করা ছিল। ঠিক করা হলো কমান্ডার রিটা ম্যাকিন্টায়ার এবং আমি পইস্ক মডুলে লাগানো সোয়ুজ যানটি নিয়ে পৃথিবীতে ফিরে যাব, অন্য দুই রুশ নভোচারী ফিরবে জেভজদা মডুলে লাগানো যানটি নিয়ে। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম কাজাখস্তানের পূর্বনির্ধারিত জায়গাটিতে অবতরণ করব না, বরং মার্কিন দেশের একটা জায়গায় নামব। আমাদের রুশ সঙ্গীরা প্রথমে একটু আপত্তি করেছিল, হাজার হলেও আমাদের সমস্ত প্রশিক্ষণ হয়েছে কক্ষপথ থেকে কাজাখস্তানে কী করে নিরাপদে নামা যায় সেইভাবে। কিন্তু পৃথিবী থেকে কোনো নির্দেশনা না পেয়ে যে কোনো সিদ্ধান্তই নেওয়া যেত।
কী ধরনের পৃথিবীতে ফিরবে সেটা আমাদের জানা ছিল না। কোনো এক অদৃশ্য ফাঁদে আটকা পড়েছিল আমাদের গ্রহ। যেদিন সব শুরু হয় সেদিন আমার স্ত্রী ফোন করেছিল, হিউস্টন থেকে, গভীর রাত ছিল ওই শহরে তখন। ও বলল, ‘প্রিয় আমার, সন্ধ্যা থেকে প্রচণ্ড মাথাব্যথা করছে, হাসপাতালের জরুরি বিভাগে গিয়েছিলাম, সেখানে লোকে লোকারণ্য, সবারই একই অবস্থা। আমাদের বাসায় চলে যেতে বলল, বলল একটা ঘুমের ওষুধ খেয়ে নিতে। কিন্তু ঘুম আমার আসছে না।’ স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিয়ে ফোন ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু পরদিন থেকে ওর সাথে আর যোগাযোগ সম্ভব হয়নি। শুধু ওর সাথে নয়, মহাকাশ স্টেশনের অন্য কেউই তাদের বাড়ির সঙ্গে আর যোগাযোগ করতে পারল না। করালিওভ স্টেশন আরও দুদিন চালু ছিল, সেখানকার কর্মীরাও কিছু একটাতে আক্রান্ত হয়েছিল, তারা তাদের শারীরিক বা মানসিক অবস্থা গুছিয়ে বলতে পারল না।
এর এক সপ্তাহ পরে পৃথিবীর রাতের আলো নিভে যেতে থাকল। আমরা অনুমান করলাম বৈদ্যুতিক পাওয়ার স্টেশনগুলো চালু রাখার জন্য কেউ ছিল না। নভোচারীদের মানসিক অবস্থা খারাপ হতে শুরু করল। পৃথিবীতে তাদের প্রিয়জনদের, বলতে গেলে সবাইকে আর জীবিত দেখব না এ রকম একটা নৈরাশ্য আমাদের ধীরে ধীরে গ্রাস করল। আমরা তখনই ঠিক করলাম ফিরে যাবার যদিও আমাদের আরও ছ’মাস থাকার কথা ছিল। আমি বললাম, ‘ক্যানসাস?’ কমান্ডার রিটা বলল, ‘ক্যানসাসকে যত সমতল ভাবি তা আসলে নয়, আমরা ইলিনয় বা নর্থ ডাকোটা বাছতে পারি।’ অবশেষে নর্থ ডাকোটায় নামা ঠিক হলো। রিটা একটা নতুন ট্র্যাজেকটরি কম্প্যুটার দিয়ে তৈরি করল। সাড়ে তিন ঘণ্টা লাগবে মহাকাশ স্টেশন থেকে বিযুক্ত হয়ে মাটিতে পৌঁছাতে। রুশ নভোচারীরা আমাদের তিন কক্ষের সোয়ুজ যানে ঢুকতে সাহায্য করল, আমরা ভেতরের হ্যাচ বন্ধ করে মধ্যের মডিউলে বসলাম।
সোয়ুজ যানটি খুব নিঃশব্দে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন থেকে। গ্রাউন্ড কন্ট্রোল থেকে এই সময় সোয়ুজের কম্প্যুটারে ট্র্যাজেকটরির প্রোগ্রাম আপলোড করা হয়, কিন্তু এখন করালিওভ কন্ট্রোল নীরব। আমাদের সব নিজ হাতে করতে হবে, নির্দিষ্ট সময়জুড়ে ইঞ্জিন চালু রাখতে হবে। আমাদের গতিবেগ এখন ঘণ্টায় ২৮,০০০ কিলোমিটার, সেটা থেকে গতি কমিয়ে আনতে হবে। ঠিক কখন এবং কতটুকু সময় ইঞ্জিন চলবে তার ওপর নির্ভর করবে আমরা পৃথিবী পৃষ্ঠে পৌঁছাতে পারব কিনা, অল্পক্ষণ চললে আমাদের গতিবেগ খুব একটা কমবে না, তাহলে বায়ুমণ্ডল থেকে ধাক্কা খেয়ে ওপরে উঠে যাব, আর বেশিক্ষণ চললে খুব বক্র একটা পথে বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করব, তাতে একদিকে আমাদের ওজন নয়গুণ বেড়ে আমাদের মেরে ফেলতে পারে, অন্যদিকে বায়ুর ঘর্ষণে বেশি তাপে পুরো যানটিই গলে যেতে পারে। হাত দিয়েই সোয়ুজ যানের এই নিয়ন্ত্রণগুলো আমাদের করতে হলো। কিছুক্ষণ পর আমাদের ভরশূন্য অবস্থা চলে গেল, ওজন অনুভূত হতে লাগল। ভূমি থেকে ১৪০ কিলোমিটার ওপরে সোয়ুজের মাথার দিকের আর পেছনের মডিউলটিকে আমরা বোতাম টিপে বিচ্ছিন্ন করে ফেললাম। আমাদের ওজন প্রায় চারগুণ বেড়ে গেল, আমরা সিটের সঙ্গে সেঁটে গেলাম। আর আট কিলোমিটার ওপরে বিশাল প্যারাশুটটা খুলল। ভূমিতে আঘাত করার ঠিক আগে, এক মিটার ওপরে রেট্রো রকেট গর্জে উঠল, তারপর বেশ বড় ধরনের ধাক্কা খেয়ে জমিতে থামল আমাদের যান। আমি ভেতর থেকে একটা বোতাম টিপে প্যারাশুটটাকে যান থেকে আলাদা করে দিলাম।
হেলমেট খুলে মিনিট পাঁচেক বসে রইলাম যানের ভেতরে। দুজনের কেউই বাইরের পৃথিবীকে যেন দেখতে আগ্রহী ছিলাম না। ছোট জানালা দিয়ে বাইরের দিনের আকাশটা দেখা যাচ্ছিল। এতদিন ভরশূন্য থেকে হঠাৎ ভারী হয়ে গিয়ে নিজেদের সিট থেকে ওঠাতে কষ্ট হচ্ছিল। উঠতে গিয়ে আবার বসে পড়লাম। রিটারও একই অবস্থা। এরকম ১০ মিনিট গেলে কিছুটা ধাতস্থ হলাম। গড়িয়ে পাশের হ্যাচটা খুললাম, রোদ এসে ভেতরটা উজ্জ্বল করে দিল। অন্য সময় হলে পাঁচটা মানুষ আমাদের চ্যাংদোলা করে যান থেকে বের করে বাইরে ইজিচেয়ারে বসিয়ে দিত। এখন সেরকম হবার কোনো সম্ভাবনা নেই। আমাদের এই আকাশ থেকে নামাটা কি ডাকোটার কোনো মানুষই দেখতে পায়নি?
আমরা গড়িয়ে গড়িয়ে বাইরে বের হলাম। এতদিন ভারশূন্য হয়ে ছিলাম, হঠাৎ ওজন ফিরে পেয়ে দাঁড়াতে পারছিলাম না। কোনোরকমে প্রেশার স্যুট থেকে নিজেদের মুক্ত করে দাঁড়ালাম, দাঁড়াতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম। দূরে দিগন্তে মিলিয়ে গেছে বন্য ধূসর ঘাসের মেলা, তার মধ্যে চরছে একদল বাইসন।
‘কেউ আমাদের এত বড় প্যারাশুটটা দেখল না?’ রিটাকে জিজ্ঞেস করি আমি। রিটা এক হাত কপালে রেখে সূর্যকে আড়াল করে চোখ থেকে। তারপর ফোনটা বার করে পকেট থেকে, বলে, ‘নেটওয়ার্ক নেই, কিন্তু জিপিএস কাজ করছে, আমরা অন্তত জানি কোথায় আছি এখন। পুবদিকে কয়েক মাইল হাঁটলেই কিছু খামার পড়বে, ওদিকে কিছু তেলের খনিও আছে।’
সূর্য পশ্চিমে নেমে যাচ্ছে দ্রুত। রিটা বলল, ‘আজ আমরা কোথাও যেতে পারব না। দু-পা ফেলতেই কষ্ট হচ্ছে। খাবারের রসদ তো আমাদের প্রচুর, আজ রাতটা এখানেই থাকি, ঠান্ডা লাগলে প্রেসার স্যুট নাহয় আবার পরে নেব। নতুন ওজনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হবে, আমাদের বিশ্রাম দরকার।’
পরদিন সকালে বাইসনের পাল এড়িয়ে ঘাসের ওপর হাঁটি, কয়েক মাইল যাবার পরে একটা বড় হ্রদ পড়ল, তার পাড় ধরে দক্ষিণ দিকে আরও মাইল দশেক হাঁটলাম। অবশেষে একটা বড় খামার দেখা গেল। অন্তত তিনশ একরের খামার, সয়াবিন চাষ হচ্ছে। চাষ-জমির শেষে কিছু সারি দিয়ে দেবদারু গাছ। সেটা পার হয়ে খামার বাড়ির শস্য রাখার উঁচু সাইলো ঘর, গোলাঘর, শস্য নিয়ে কাজ করার কয়েকটা ট্র্যাক্টর ও কম্বাইন। পাশে একটা দোতলা কাঠের বাড়ি। সেই বাড়ির সামনে যখন আমরা দাঁড়িয়ে তখন সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিমে, আমাদের লম্বা ছায়া পড়ে বাড়ির দরজায়। আমরা ইতস্তত করি, এখানে জীবিত কি কেউ আছে? পৃথিবী নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। এই বাড়ির ভেতর রয়েছে হয়তো মৃতদেহ। যে রোগে তারা মরেছে সেই রোগ কি ছোঁয়াচে নয়? আমরা একটা কাপড় মুখে বেঁধে নিই। হঠাৎ দুটো কুকুর দৌড়ে আসে, শেপার্ড, কিন্তু তারা ঘেউ ঘেউ করে না, দাঁত খিঁচায় না, লেজ নাড়ায়, এমন যেন এই খামার বাড়ির প্রতি তাদের কোনো দায়িত্ব নেই।
কুকুরগুলো যখন আছে তখন ভেতরে লোকও আছে। তারা কি আমাদের পর্যবেক্ষণ করছে, বন্দুক নিয়ে অপেক্ষা করছে? দরজায় টোকা দিই আমি। কয়েক মিনিট চলে যায়, কিছুক্ষণ পরে দরজা খোলে বছর পঞ্চাশেক বয়সের এক পুরুষ, হাতে শটগান, ওপরে চেক-কাটা জামা, নিচে জিন্স, বুটজুতো, মাথার ওপরে সোনালি চুল, মুখে খোঁচা দাড়ি। চোখে সন্দেহ। আমাদের মুখ রুমাল বাঁধা দেখে হয়তো আরও বেশি সন্দেহ, মুখ থেকে রুমাল খুলে নিই। পেছন থেকে একজন নারীর মাথা উঁকি দিল। ‘আপনাদের কী সাহায্য করতে পারি?’ পুরুষটি বলে। আমাদের দুজনের পরা টিউনিক, বুকের একদিকে ঘঅঝঅর বড় চিহ্ন। আমি বললাম, ‘আমরা দুজন নভোচারী। এখান থেকে কিছু দূরে আমাদের মহাকাশযান ল্যান্ড করেছে। আপনারা কেমন আছেন?’
‘আমরা ভালোই আছি।’ এটুকু বলে পুরুষটি চুপ করে থাকে। মনে হলো সে আমাদের বিশ্বাস করছে না। রিটা এবার বলল, ‘কী হয়েছে পৃথিবীর?’ পুরুষটি দরজার ওপারে নিশ্চুপ থাকে। এবার নারীটি পেছন থেকে বের হয়ে সামনে আসে। ‘কী হয়েছে জানেন না? আপনারা কোথায় ছিলেন এতদিন?’ নারীটির দুটো বাদামি বিনুনী সামনে চেক-কাটা ফ্লানেল জামার ওপর বুকের দুদিকে ঝোলানো। আন্দাজ করলাম তার বয়স বছর পঁয়তাল্লিশ হবে।
আমি হাত উঠিয়ে আঙুল দিয়ে আকাশের দিকে নির্দেশ করতে যাই, রিটা আমার হাত ধরে ফেলে নামিয়ে দেয়। বলে, ‘আমরা ঘঅঝঅর নভোচারী, আন্তর্জাতিক মহাকাশযানে ছিলাম। গত এক মাস পৃথিবীর সঙ্গে আমাদের কোনো যোগাযোগ ছিল না। একটা সোয়ুজ যান নিয়ে ফিরে এসেছি। পৃথিবীতে কী হয়েছে সে সম্বন্ধে আমরা কিছুই জানি না।’
ঘঅঝঅর নভোচারী শুনে তাদের অভিব্যক্তি বদলাল না, বরং একে অপরের দিকে চাইল। এর মধ্যে ক্লান্তিতে রিটা মাটিতে পড়ে যায়। এবার দুজনই ভেতর থেকে বের হয়ে এল। পুরুষটি বন্দুক নিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে থাকল, নারীটি ও আমি রিটাকে ধরে তুললাম, বুঝলাম রিটা ইচ্ছা করে মূর্চ্ছার ভাব করছে। ওদের বাধ্য হয়ে রিটাকে ভেতরে নিতে হলো। রিটাকে ভেতরে নিয়ে একটা সোফায় শুইয়ে দিলাম আমরা। আমার নাম বললাম, রিটার পরিচয় দিলাম। পুরুষটি নিতান্ত অনিচ্ছাস্বরে বলল, ‘জিম।’ নারীটি বলল, ‘মার্থা।’
বললাম, ‘আমরা ভয় পেয়েছিলাম যে, পৃথিবীর কাউকে দেখতে পাব না।’
জিম বলল, ‘কেন?’ জিমের প্রশ্নে যে খুব আশ্চর্য হয়েছিলাম বলাই বাহুল্য। কী করে এটার উত্তর দেব ভাবছিলাম, এর মধ্যে রিটা উঠে বসল। রিটা বলল, ‘আপনাদের সেল-ফোন কাজ করে?’
‘না,’ উত্তর দেয় জিম।
‘ইন্টারনেট?’
‘না।’
‘আগে কাজ করত?’
‘মনে হয়, এটা কী ধরনের প্রশ্ন?’
‘তাহলে, পৃথিবী আগের মতো নেই, তাই না?’ বলে রিটা।
অন্ধকার হয়ে আসে ঘর। জিম উত্তর দেয় না, ভেতরের ঘরে যেয়ে শটগানটা রেখে আসে। হাতে একটা লণ্ঠন, সেটা ঘরকে অল্প আলো দিতে পারে। মার্থা বলে, ‘আপনারা ক্ষুধার্ত নিশ্চয়? আসুন টেবিলে বসুন।’ আমরা খুবই ক্লান্ত ছিলাম, একটু শুতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু এদের কথা অমান্য করলাম না।
টেবিলে বসলে মার্থা আলু আর মাংসের স্টেক পরিবেশন করল। ভাবলাম, এগুলো কি আমাদের পেট নিতে পারবে, কিন্তু কিছু বললাম না। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হয়েছিল? পৃথিবীর আর সবাই কেমন আছে?’
জিম উত্তর দিল, ‘তা তো জানি না, আমরা ভালো আছি এটুকু বলতে পারি।’
‘কিন্তু অন্য মানুষেরাÑ নিউইয়র্ক বা ক্যালিফোর্নিয়ার মানুষরা? তারা কি বেঁচে আছে?’
‘বেঁচে থাকবে না কেন?’ বলে জিম। জিমের কথা পুরো বিশ্বাস না করলেও একটু আশার আলো দেখি, আমি ও রিটা একে অপরের দিকে তাকাই।
রিটা বলল, ‘আপনাদের বিদ্যুৎ নেই, সেলফোন যোগাযোগ নেই। ইন্টারনেট নেই। এটা কি ভালো থাকা?’
জিম বা মার্থা কেউই উত্তর দেয় না। লন্ঠনের মৃদু শিখায় আমাদের ছায়া দেয়ালে নড়ে। রিটা ও আমি চুপ করে থাকি, এই নতুন পৃথিবীর মানুষদের চিনতে পারি না। খাবার শেষে জিম শটগানটা আর লণ্ঠন হাতে আমাদের নিয়ে যায় মূল বাড়ির পাশে গোলাবাড়িতে। সেখানে দেখলাম দুটো খাট দুদিকে পাতা। জিম দরজার কাছে লণ্ঠনটা রেখে বলল, ‘শুভরাত।’ তারপর বেরিয়ে দরজাটা বাইরে থেকে ভেজিয়ে দেয়, পর মুহূর্তে সেটাতে তালা দেবার শব্দ শুনি। আমি দ্রুত দরজার কাছে গিয়ে দরজাটা খোলার চেষ্টা করি, না, আসলেই বাইরে থেকে তালা দেওয়া হয়েছে। আমরা আশ্চর্য হয়ে একে অপরের দিকে তাকাই। রিটা বলল, ‘ডাকোটায় নেমে আসাটা ভুল হয়েছিল।’ আমি সায় দিলাম, কিন্তু পৃথিবীর কোথায় নামাটা সঠিক হত সেটাও আমাদের মাথায় এলো না। কী হয়েছে পৃথিবীর? সারা পৃথিবী কি জিম ও মার্থার মত মানুষে পরিণত হয়েছে।
লণ্ঠনের মৃদু আলোয় দেখি গোলাঘরের এক কোনায় ছিটিয়ে ছিড়িয়ে রাখা কিছু পুরোনা খবরের কাগজ, পত্রিকা। সেগুলির শিরোনাম দেখিÑ ‘পৃথিবীর দুঃসময়’, ‘ভাইরাসে আক্রান্ত কোটি কোটি মানুষ সেরে উঠছে, কিন্তু ইচ্ছাশক্তি হারাচ্ছে,’ ‘ভাইরাসে মানুষের মানসিক মৃত্যু,’ ‘ভাইরাসে বিস্মরণ।’
‘আমাদের প্রিয়জনরা হয়তো এখনও জীবিত আছে,’ আমি বলি। দু-হাজার কিলোমিটার দূরে, হিউস্টনে, আমার স্ত্রী ও দুই ছেলেমেয়ে হয়তো অপেক্ষা করছে। রিটা সায় দেয়, বলে, ‘আমাদের এখান থেকে পালাতে হবে।’ আমাদের পোশাকের একটা পকেটে অত্যাবশকীয় কিছু জিনিস থাকে, তার মধ্যে একটা করে সুইস আর্মি নাইফ। আধঘণ্টা চেষ্টা করে আমরা গোলাঘরের একদিকের একটা কাঠের জানালা পুরো খুলে ফেলতে সমর্থ হই। তারপর রাতের আঁধারে, পা টিপে টিপে মূল বাড়ির রান্নাঘরের জানালার নিচে যেয়ে দাঁড়াই। ভেতর থেকে জিম ও মার্থার কথোপকথন ভেসে আসছিল।
‘এই মানুষ দুটো এমন মিথ্যে কথা কেমন করে বলতে পারে,’ বলে জিম। ‘আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন? হুঁ, এমন যেন মানুষ আকাশে গেছে?’
‘আমি এরকম একটা স্টেশনের কথা একবার টেলিভিশনে দেখেছিলাম মনে হয়।’
‘তাই? টেলিভিশনের কথা আমার মনে পড়ে না। ওসব ভুয়া খবর, প্রপাগান্ডা। চাঁদে মানুষ নেমেছে এ রকম কথাও তো শুনেছিলাম, আবছাভাবে তাও মনে পড়ছে, কিন্তু সেগুলোও গুজব। যত্তসব। এই লোকদুটোকেও মনে হয় কর্তৃপক্ষ থেকে পাঠানো হয়েছে আমাদের ওপর গোয়েন্দাগিরি করতে।’
‘ওদের নিয়ে তাহলে কী করতে চাও, জিম?’
‘আমি এখন কোন সিদ্ধান্ত নিচ্ছি না। কাল জেমসটাউনে যেয়ে বাদবাকি লোকদের সাথে কথা বলতে হবে। ওরা যা বলে তাই করব।’
শেপার্ড কুকুর দুটো আবার দৌড়ে আসে, কিন্তু আগের মতোই তারা জিভ বের করে লেজ নাড়ায়। এই পৃথিবীতে কুকুরেরাও তাদের দায়িত্ব ভুলে গেছে। আমরা আর দাঁড়াই না। প্রথমে বাড়ির সামনে পার্ক করা দুটো গাড়ির সব ক’টা টায়ার আমাদের সুইস নাইফ দিয়ে ফুটো আর ফালাফালা করে দিই। এরা এখন সহজে আমাদের পিছু নিতে পারবে না। তারপর গোলাঘর, ট্র্যাক্টর, কম্বাইন, সাইলো পার হয়ে বাড়ির সামনের রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করি। রিটার জিপিএস তখনও কাজ করছিল। ও বলল, ‘আমি পথ নিরূপণ করেছি, হিউস্টনে যাবার দক্ষিণের পথ। মিসিসিপি নদীর ধার ধরে হাঁটব। নিশ্চয় আমরা অন্য লোকেদের সাক্ষাৎ পাব যারা এদের মতো পাগল নয়। চিন্তা কোরো না, তোমার পরিবারের সঙ্গে শীঘ্রই তোমার দেখা হবে।’
চাঁদের আলোয় আমরা দুই নভোচারী বড় রাস্তা ছেড়ে দিয়ে সয়াবিন ক্ষেতের মধ্য দিয়ে হাঁটি, সয়াবিন পার হয়ে পড়ে ভুট্টা ক্ষেত। দিগন্তে কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ ওঠে বিরাট বায়ুকল স্তম্ভের ওপর থেমে-থাকা বড় প্রপেলারের পেছন দিয়ে। ক্ষেত পেরিয়ে আসে ছোট ছোট পাহাড়, তারপর প্রেইরি ঘাসের প্রান্তর। সারা রাত ধরে আমরা হাঁটি, আকাশ থেকে পৃথিবীর বুকে নেমে, ক্লান্ত হয়ে। পুবে ওঠা আকাশের তারা হেলে যায় পশ্চিমে। হাঁটু সমান ঘাসে যখন হাঁটি তখন সূর্য উঠে আসে পুবে, তার রাঙা আলোয় রিটা হঠাৎ দাঁড়িয়ে যায়, ফোনের জিপিএস স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আমি বুঝতে পারছি না এই স্ক্রিনের সংখ্যাগুলোর মানে কী? ভুলে গেছি জিপিএস কীভাবে কাজ করে। আমাদের হিউস্টন যাওয়া সহজ হবে না।’ আমি রিটার মুখমণ্ডলের দিকে তাকিয়ে থেকে বুঝতে চাই ও কী বলতে চাইছে। বিড় বিড় করে বলি, ‘হিউস্টন? আমরা হিউস্টন যাচ্ছি কেন, কী আছে সেখানে?’
কম্যান্ডার রিটা গভীর বিস্ময়ে আমার মুখের দিকে তাকায়, তারপর তার জি.এপ.এস. ফোনের দিকে। বলে, ‘ক্যাপটেন অ., আমার নামটি কি আপনার খেয়াল আছে?’ রিটার নামটি ভোলার কোনো কারণ নেই, কেন সে কথাটা জিজ্ঞেস করছে বুঝতে পারলাম না, কিন্তু অন্য একটা কিছু আমার মনে থাকার কথা, কী সেই কথাটা? মনের গভীর পরতে তা হারিয়ে যেতে থাকে।
রিটা আপন মনে বলে, ‘হিউস্টনে যারা আছে তারাও কী আর কিছু মনে রেখেছে? তবু আজ যতটুকু পথ আমার স্মৃতির সিঁড়ি বেয়ে যাওয়া সম্ভব যাওয়া যাক। কে জানে কাল আমি কী মনে রাখব?’
প্রেইরির ওপর সকালের শীতল বাতাস বইতে থাকে ঘাসকে আন্দোলিত করে, দূরে দিগন্তে বায়ুকলগুলো দাঁড়িয়ে থাকে সান্ত্রীর মতো, ওপরে আকাশ আরও নীল হতে থাকে।
সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ