বইকথা : মানবজীবন : একজন সংগ্রামী মানুষের দিনলিপি : রিপন আহসান ঋতু

বাংলাদেশের মানুষের বর্তমান জীবন, জীবনের বহিরাঙ্গন, বহিরাঙ্গনের সংকট, অন্তর্জগতের কথা প্রকৃতি ও প্রকৃতিলগ্ন জীবনের রূপ-রূপান্তর, সমাজের অন্তর্দেশে বয়ে চলা মানবহৃদয়ের ফল্গুধারা, মানুষের স্খলন-পতন, রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার, মনস্তাত্ত্বিক দোলাচল-দ্বন্দ্ব- সংশয়, নিম্নবর্গীয় মানুষের চিরকালীন দুর্দশা, গ্রাম ও শহরের সমাজ এবং মানুষের পরিবর্তন, সর্বোপরি মানবিক সংকট মোস্তফা কামালের মানবজীবন উপন্যাসে জীবনশিল্প হয়ে উঠেছে। মানব জীবনের বৈচিত্র্য তাঁর এই উপন্যাসের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। উপন্যাসের অধিকাংশ বর্ণনা গ্রামের প্রেক্ষাপটে লেখা কিন্তু প্রসঙ্গ ভিন্ন, সংকট আলাদা, চরিত্রাবলি স্বতন্ত্র। নাগরিক প্রেক্ষিত থেকে লেখা উপন্যাসের সাধারণ প্রকৃতি এই বিচিত্রতায় প্রাণবন্ত। হালকা মেজাজে শুরু হয়ে উপন্যাস প্রবেশ করেছে জীবনের এক গভীর সংকটে। লেখক শেষ পর্যন্ত উত্তরণ ঘটান জীবনকেন্দ্রিক প্রাসঙ্গিকতায় ও ব্যঞ্জনাময় সমাপ্তিতে। অন্যদিকে প্রকৃতির অবারিত উপাদানের অঙ্কনে ও জীবনের সঙ্গে তাকে সংযোগ ঘটিয়ে লেখক মূলত জীবনের অর্থময়তা বা অনর্থময়তার ব্যাপ্তি ঘটান সযতনে এবং সচেতনে।
দুনিয়ার সব সাহিত্য হচ্ছে আর্থ- সামাজিক ও রাষ্ট্র জীবনের ইতিহাস। ইতিহাসবিদ ঘটে যাওয়া ঘটনাকে প্রতিবেদনের আকারে প্রকাশ করেন। কথাশিল্পী অবশ্য তেমনিভাবে প্রকাশ করেন নাÑ তিনি প্রকাশ করেন একটু ভিন্নভাবে। এই জিনিসটি হচ্ছে শিল্প। এই কারণেই বলা হয় সাহিত্যের মধ্যে থাকে লেখকের প্রকাশক্ষমতা, দৃষ্টিভঙ্গি এবং কল্পনাশক্তি। সবকিছু মিলিয়ে তিনি আরেকটি রসময় জগৎ সৃষ্টি করেন বলেই আমরা তাকে অভিহিত করি সাহিত্যস্রষ্টা হিসেবে। বাস্তবকে সাহিত্যে রূপ দেওয়া কঠিন ব্যাপার। যিনি রূপ দিতে পারেন তিনিইি রূপকার। আমাদের সমাজের রূপান্তর নিয়ে ঔপন্যাসিকরা যা সৃষ্টি করেন তা অধিকাংশই যে উপন্যাস হয়ে ওঠে তা নয়। উপন্যাস হতে-হতে দেখা যায় উপন্যাসের রূপ পায়নি। প্রকাশক্ষমতা এবং কল্পনাশক্তির অভাবে পুরোটাই প্রতিবেদন হয়ে উঠেছে। তবে ঔপন্যাসিক মোস্তফা কামাল ব্যতিক্রম। সাম্প্রতিক সময় আমি এই লেখকের উপন্যাস মানবজীবন পড়েছি। পড়তে গিয়ে আমাকে কোনো রকমের হোঁচট খেতে হয়নি। মনে হয়েছে তার উপন্যাসের বিষয়বস্তু কষ্টকল্পিত নয়। অতিসাধারণ মানুষই তার গল্পের বিষয়বস্তু। এই মানুষগুলো বাস্তব মানুষ। বাঙালি সমাজের অতি পরিচিত মানুষ। এই বাস্তব মানুষের সুখ-দুঃখ জীবনযাপন, আশা-আকাক্সক্ষা, স্বপ্নভঙ্গ ও যন্ত্রণার বিষয়ই খুব সহজ বর্ণনা করে গেছেন তার মানবজীবন উপন্যাসে। লেখক লিখতে গিয়ে উপন্যাসের মানুষগুলোকে দুর্বোধ্য করে তোলেননি এটাই তাঁর স¦কীয়তা। উপন্যাসের একটা জায়গাতে তিনি বলেছেন; ‘আমার আবেগ এবং আত্মসম্মানবোধ স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি। আমি কোনোরকম জটিলতা-কুটিলতা পছন্দ করি না। প্যাঁচগোছ বুঝি না। ঝগড়া-ঝাটি একদম ভালো লাগে না। আমার সঙ্গে কেউ দুর্ব্যবহার করলে তো বটেই জোরে কথা বললেও আমি কেঁদে ফেলি। আবার কোনো অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করতে না পারলে অনুশোচনায় ভুগি।’
এভাবেই সহজ সরল অথচ পরিশীলিত ভাষায় অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে লেখক তাঁর পুরো উপন্যাসকে বিদগ্ধ পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেছেন। মানবজীবন উপন্যাসে লেখক স্বাধীনতা- উত্তর বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার বাস্তবচিত্র অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের নানা বিষয় নিয়ে তিনি এই উপন্যাসে বিস্তারিত বলার চেষ্টা করেছেন :
‘চৈত্র মাস। তপ্ত রোদ। চারদিক কেমন খাঁ খাঁ করছে। এমনিতেই অনাহারে মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত। তার ওপর প্রকৃতির বিরূপ আচরণ! সময়টা উনিশশ’ চুয়াত্তর সাল।
দেশে ভয়ানক দুর্ভিক্ষ চলছে। অনাহারে হাজার হাজার মানুষ মানুষ মারা গেছে। লাখ লাখ মানুষ অনাহারে কষ্ট পাচ্ছে। দিনে এক বেলাও খেতে পারছে না তারা। গ্রামের মানুষেরা কচুপাতা, হেলেঞ্চা শাক, কলার থোড় খেয়ে কোনোমতে প্রাণটা বাঁচিয়ে রেখেছে। আমাদের আন্ধারমানিক গ্রামে একটি লঙ্গরখানা খোলা হয়েছিল। সেটি তিন দিনের মধ্যে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে মানুষের মধ্যে বিস্তর আলোচনা। তারা বলছেন, সেলিম মেম্বার রিলিফের সব মাল গোপনে বিক্রি করে দিয়েছে। এই খবর এলাকায় চাউর হয়ে যাওয়ার পর মানুষ তার ওপর চাপ সৃষ্টি করেছেন। তারা বলেছেন, রিলিফ না দিলে কপালে মাইর আছে। বিপদ সামাল দিতে তিনি তাহের শিকদারের কাছ থেকে কয়েক বস্তা মাল এনে বিলি করেছেন। তারপর গা ঢাকা দিয়েছেন।’
উপন্যাসের এই বর্ণনাগুলো প্রমাণ দেয় বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থানের বাস্তব চিত্র কতটা নির্মোহ। দেশের যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় মানুষের পুনর্বাসনের নামে বিদেশ থেকে যে দ্রব্যসামগ্রী সাহায্য হিসেবে এসেছে তা সুবিধাবাদীরা কুক্ষিগত করে আরও বিত্তবান হয়েছে। হয়েছে দেশসেবক এবং রাজনৈতিক দলের চেলাচামুণ্ডা।
রাজনীতি সচেতন লেখক তার উপন্যাসে, আমাদের দেশের সমাজ, সংস্কৃতি, শিক্ষা ও রাজনীতিতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী হিসেবে কিছু রাজনৈতিক দল এবং সেই দলীয় নেতাদেরকেও চিহ্নিত করেছেন বারবার। তাদের কথাও তিনি তুলে এনেছেন তার উপন্যাসে।
ঔপন্যাসিকের জীবনকেন্দ্রিক বোধ ও উপলব্ধির এক বিস্তৃত ও গভীর পরিচয় লিপিবদ্ধ হয়ে আছে তাঁর উপন্যাসজুড়ে। রাজনীতির পাশাপাশি তিনি তার উপন্যাসে তুলে এনেছেন, বিত্তহীন এবং নিম্নবিত্ত মানুষের জীবন। উপন্যাসের চরিত্রগুলো উঠে এসেছে বাস্তব সমাজ থেকেই। তিনি তার উপন্যাস রচনার প্রেরণা পেয়েছেন মানুষের জীবন থেকে। তিনি অনুসন্ধান করেছেন সমাজ ও মানুষের জীবন। অনুসন্ধান করেছেন বিত্তহীন ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির জীবনযাপনের সীমাবদ্ধতার কারণ।
মোস্তফা কামালের এই উপন্যাসের প্রধান উপজীব্য দক্ষিণ জনপদের গ্রামজীবন। আটপৌরে এই গ্রামজীবন আমাদের অতি চেনা। তারপরেও মোস্তফা কামালের মানবজীবন উপন্যাসে বর্ণিত গ্রামজীবনের স্তরগুলো মোটেই নিস্তরঙ্গ নয়। এখানে অনাবিল সারল্যের পাশাপাশি জটিলতা-কুটিলতার ছবিও নির্মোহ দৃষ্টিতে ফুটিয়ে তুলেছেন। ঔপন্যাসিক মোস্তফা কামালের কলমের ডগায় যেন বা যুক্ত আছে সাংঘাতিক শক্তিশালী এবং অন্তর্ভেদী এক ক্যামেরা। জীবনের অতিচেনা চরাচর থেকে উপন্যাসের প্রতিটি পর্বের জন্য তিনি তুলে এনেছেন জীবন্ত, প্রাণবন্ত এবং সাবলীল ছবি। যেখানে কৃত্রিমতার লেশমাত্র ছোঁয়া নেই। নিখুঁত ছবি। এইখানে তিনি একজন সার্থক শিল্পী। লেখক ১৬৮ পৃষ্ঠার উপন্যাসে বহুমানুষের জীবনের বাস্তবতাকে জোড়া দিতে নিরলস সতর্ক ছিলেন, কিন্তু টুকরো টুকরো সেই ছবিগুলো জোড়া দিয়ে অখণ্ড অবয়ব গড়ে তোলার যে শৈল্পিক প্রক্রিয়া এবং সেই শৈল্পিক প্রক্রিয়ার মধ্যে যে মিস্তিরিপনা আছে, সেই প্রসঙ্গে এসে একটু খানি খটকা লেগেছে আমার; উপন্যাসের কোনো কোনো বর্ণনার মধ্যে জোড়া দেওয়ার দাগটুকু তা অস্পষ্ট হলেও দুর্লক্ষ বা নিশ্চিহ্ন হয়ে ওঠেনি। তবে পাঠক হিসেবে আমার মনে হয়েছে এটা তাঁর ইচ্ছাকৃত ফাঁকি নয় বরং উপন্যাসের নিজস্ব গতির কারণই এমনটা হয়েছে। পরিশেষে বলতে হয়, মোস্তফা কামালের মানবজীবন উপন্যাসে আমাদের পরিচিত জীবনের যে সুর প্রতিধ্বনিত হয়েছে সেখানে জীবন সম্পর্কে লেখকের বিচিত্র অভিজ্ঞতা থাকায় উপন্যাসটি সত্যিকার অর্থে পাঠক-প্রিয়তা পাবে বলে আমার বিশ্বাস।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক