চারণ কবিদের বিশ্লেষণে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ- ‘জাতির সাথে জাতির পিতার কথোপকথন’: সাইমন জাকারিয়া

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি জীবনের শুরু থেকে এদেশের লোকায়ত সংস্কৃতি বিশেষ করে চারণ কবিদের রচিত গানের বিষয়ে বিশেষ সচেতন ছিলেন। তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর শুরুতেই এ-কথার প্রমাণ মেলে। তিনি অসমাপ্ত আত্মজীবনীর প্রথমভাগে নিজের বংশ পরিচয়ের ইতিহাসের বর্ণনা দিতে গিয়ে ‘চারণ কবিদের গানে’ প্রতিফলিত শেখ বংশের ইতিহাস সম্পর্কে তথ্য দিয়েছেন। সেই সাথে তাঁর চতুর্থ পূর্বপুরুষ শেখ কুদরতউল্লাহ ওরফে কুদু শেখের ইংরেজ বিরোধী তৎপরতার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে লিখেছেনÑঅত্যাচারী ইংরেজ মি. রাইন সাহেবের অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে গিয়ে তাঁর চতুর্থ পূর্বপুরুষদের মধ্যে শেখ কুদরতউল্লাহ আদালতে মামলা করেন। মামলার বিচারে শেখ কুদরতউল্লাহ-র জয় লাভ হয়। আদালত কুদরতউল্লাহকে মি. রাইন সাহেবের কাছ থেকে জরিমানা চেয়ে নিতে বললে, কুদরতউল্লাহ ইংরেজ সাহেবকে অপমান করার জন্য মাত্র আধা পয়সার জরিমানা করেন। এই ঘটনার পর চারণ কবিরা মুখে মুখে ‘কুদরতউল্লাহ শেখের আধা পয়সা জরিমানা’র গান বেধেছিলেন বলে বঙ্গবন্ধু তথ্য দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে বঙ্গবন্ধুর সংগীত প্রীতি এবং সুফি-সাধকদের মাজারে গিয়ে গান শোনার অভিজ্ঞতার বয়ান লাভ করা যায়। এছাড়া, বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক জীবনে কীভাবে সংগীতশিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন এবং কোন প্রাকৃতিক পরিবেশে তাঁর সংগীতের রসাস্বাদন করেছিলেন, এমনকি কতটা শ্রদ্ধার সাথে তিনি নিষ্ঠাবান একজন সংগীতশিল্পীর নির্দেশনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছিলেন সে-কথা জ্ঞাত হওয়া যায়। উল্লেখ্য, এ সকল সূত্র ধরে বাংলাদেশের সংগীত-সংস্কৃতির সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও রাজনীতির সম্পর্ক আবিষ্কার করতে গিয়ে বিস্মৃত হতে হয় যে, এদেশের নাগরিক পরিমণ্ডলের শিল্পী-কবি বা সাহিত্যিকদের বহু আগেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রথম গান রচনা ও পরিবেশন করেছিলেন সুনামগঞ্জের সাধক কবি শাহ আবদুল করিম। এ সম্পর্কে শাহ আবদুল করিম তাঁর ‘আত্মস্মৃতি’ শীর্ষক আত্মপরিচয়মূলক দীর্ঘ একটি বর্ণনাত্মক সংগীতের বাণীতে উল্লেখ করেছেন যে, ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে যখন পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয় লাভ করে তখন আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন সরকার গড়ে তোলে। বঙ্গবন্ধু সেই সরকারের মন্ত্রিত্ব পেয়ে সুনামগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুস সামাদ আজাদের সাথে সুনামগঞ্জ সফরে যান এবং জনসভায় অংশগ্রহণ করেন। সে সময় একটি জনসভায় শাহ আবদুল করিম গান গাইতে ওঠেন এবং ভবিষ্যৎদর্শী সাধক কবির চোখে তিনি শেখ মুজিবকে নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে মুখে মুখে বেঁধে একটি সংগীত পরিবেশন করেন, গানটি হলো :
পূর্ণচন্দ্রে উজ্জ্বল ধরা
চৌদিকে নক্ষত্রঘেরা
জনগণের নয়নতারা
শেখ মুজিবুর রহমান
জাগ রে জাগ রে কৃষাণ ॥
এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যমতে, ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের জনসভায় পরিবেশিত শাহ আবদুল করিমের উপর্যুক্ত গানটিই শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে সাধক কবিদের প্রথম রচনাকর্ম। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এ ধরনের রচনাকর্মের ধারাবাহিকতা খুঁজে পাওয়া যায় ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের ৬দফা প্রস্তাবের সময় এবং ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদানের পর থেকে সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত।
বাংলাদেশের সাধক কবিদের মধ্যে অনেকেই ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ৭ই মার্চে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। যাঁদের মধ্যে এখনও কেউ জীবিত রয়েছেন, যেমন- মানিকগঞ্জের সাইদুর রহমান বয়াতি, ঢাকার শাহজাহানপুর এলাকার ইউসুফ মিয়া প্রমুখ।
উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণকে কেন্দ্র করে পুথিকাব্য থেকে শুরু করে বাউল-সুফিধারায় বহু গান রচিত হয়েছে। পুথিকাব্যের ধারায় রচিত ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ শীর্ষক পুথিতে গোপালগঞ্জের সাধক কবি শেখ মিজানুর রহমান লিখেছেন- ‘শেখের ব্যাটার এক ভাষণে স্বাধীন বাংলাদেশ।’ এই বাক্যটির ভেতর দিয়ে কবি ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ৭ই মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের অসাধারণ একটি মাহাত্ম্য আরোপ করেছেন, যাতে প্রতিফলিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও রাজনীতির সারকথা। বিস্তৃতিতে পুথিকার কবি বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণকে রেসকোর্স ময়দানে রচিত ‘গীতিকাব্য’ হিসেবে শনাক্ত করেছেন। তিনি বর্ণনা করেছেন :
উনিশশো একাত্তর সালে সাতই মার্চের দিনে
গীতিকাব্য রচিত হয় রেসকোর্স ময়দানে।
জাতির পিতার মুখের বুলি ভাষণ কথকতা
ইতিহাস রচিল বিশ্বে পেলো অমরতা।
কথা কি আর সকল সময় কথার কথা হয়
কিছু কথা যুগে যুগে অমর হয়ে রয়।
আলো ফোটে যখন ওঠে গগন পাতে ভানু
ফল হয় মিশলে ফুলের সাথে ফুলের পরাগ রেণু।
সাতই মার্চের ভাষণ বাংলার স্বাধীনতার নাম
ঐতিহাসিক ভাষণ বাংলার ভাগ্যের পরিণাম।

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন ও পাকিস্তানি শাসকদের পরাধীনতা থেকে বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রাম সূচনার যুগসন্ধিক্ষণের অতি আকাক্সিক্ষত ঘটনার কথা এই পুথির কাব্যিক বুননে ইঙ্গিতপূর্ণ ব্যঞ্জনায় বর্ণিত হয়েছে, যাতে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের সুগভীর দূরদর্শিতাকে কবি গ্রন্থন করেছেন। যেমন−পুথির বর্ণনাতে রয়েছে :
জালিম পাকির অত্যাচারে বাংলা জরজর
অসন্তোষের আগুন সবার বুকের ভেতর।
স্বাধীনতার স্বপ্ন চোখে করে আনাগোনা
ঐতিহাসিক ভাষণে হয় স্বপনের বীজ বোনা।
ধারাবাহিক রাজনৈতিক আন্দোলনের পটে
জাতির মুক্তির কাব্যগীতি পিতার মুখে ফোটে।
জাতির পিতার কাব্যকথা শুনিবার আশায়
সাত মার্চে আমজনতা প্রহর গুনে যায়।
জয় বাংলা ধ্বনিতে কাঁপে আকাশ বাতাস
মিছিলে মিছিলে চলে বাধভাঙা উল্লাস।
অটল এক হিমালয় এসে জনতার সম্মুখে
শিকল ভাঙার বীজমন্ত্র গেঁথে দিলো বুকে
মহাকবি কাব্যগীতির সুরে দিল টান
সোনার বাংলায় বেজে ওঠে স্বাধীনতার গান।
বহুদিনের বহুকালের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ
পিতার মুখে ফোটে যেন কামানেরই তোপ।
ভাষণেতে দিলেন পিতা স্বাধীনতার ডাক
জাতির পিতার বজ্রকণ্ঠে বিশ্ব হতবাক।
উদ্দীপ্ত হয় মুক্তিকামী বাঙালিদের প্রাণ
ভাষণ নয়, ভাষণ নয়, স্বাধীনতার উপাখ্যান।
ভাষণ ছিল অতীত ভবিষ্যতের সংমিশ্রণ
দ্বারে ছিল রাষ্ট্রের জন্ম মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ।
আবেগ আর মমতা মাখা আশ্বাসের কাহিনি
আদেশ, নিষেধ, উপদেশের সতর্ক বাণী।
আঠার মিনিটের কাব্য অমৃত বচন
জাতির সাথে জাতির পিতার কথোপকথন।
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণকে কবি ‘জাতির সাথে জাতির পিতার কথোপকথন’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন, একইসঙ্গে কবি এই ভাষণকে ধারাবাহিক আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করে বলেছেন− ‘ধারাবাহিক রাজনৈতিক আন্দোলনের পটে/জাতির মুক্তির কাব্যগীতি পিতার মুখে ফোটে।’ পুথির ভাষ্যে বঙ্গবন্ধুকে ‘মহাকবি’ হিসেবেও শনাক্ত করা হয়েছে এবং অতীত- ভবিষ্যতের সংমিশ্রিত ভাষণকে ‘শিকল ভাঙার বীজমন্ত্র’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।
পুথির ভাষ্যে বর্ণিত বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মাহাত্ম্যের কথা বলেই কবি থেমে থাকেন নি, সেই ভাষণের সূত্র ধরে দীর্ঘ ৯ মাসের স্বাধীনতা সংগ্রামের রক্তক্ষয়ী ও আত্মত্যাগী মুক্তিযুদ্ধে বাঙালিদের বিজয় প্রাপ্তির কথাও তিনি বর্ণনা করেছেন। কবির ভাষ্যে রয়েছে :
এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম পিতা গেয়ে যায়
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার জাতি বুঝে নেয়।
দুর্গ গড়ো ঘরে ঘরে পাড়া মহল্লায়
মুক্ত করবো বাংলার মানুষ, যা করে আল্লায়।
রক্ত দিছি, আরো দেব, যত প্রয়োজন
সইব না আর মথুয়াদের জুলুম নির্যাতন।
ভাষণ ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের মূলমন্ত্র
বাঙালি হয় ঐক্যবদ্ধ স্বাধীন স্বতন্ত্র।
আমজনতা শুনে পিতার স্বাধীনতার গান
অকাতরে বাঙালি দেয় জীবন বলিদান।
মুক্তির শক্তি সাহস ছিল ভাষণেতে মাখা
ভাষণ হলো স্বাধীন বাংলার জাতীয় পতাকা।
নয়টি মাসের যুদ্ধে পাকির হলো পরাজয়
সোনার বাংলায় হলো মুক্তির নতুন সূর্যোদয়।
যেসব ভাষণ বিশ্বের মাঝে প্রখ্যাত বিখ্যাত
অনন্য সাতই মার্চের ভাষণ জগত সমাদৃত।
প্রস্তুতি ছিল না পূর্বে না ছিলো তা লেখা
ভাষণ ছিলো পিতার বুকে রং তুলিতে আঁকা।
বাঙালির অহংকার ভাষণ ভুলিতে কি পারি
ভাষণ বিশ্বের মুক্তিকামী জনতার দিশারি।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণে বলা ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’সহ অন্যান্য নির্দেশনামূলক কথামালাকে পুথিকার-কবি পুথির ছন্দে রূপান্তরিত করে বলেন− ‘ভাষণ ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের মূলমন্ত্র’ এবং সেই সূত্রে বর্ণনা করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাঙালির বিজয়গাঁথার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। এই ইতিহাসকে স্মরণ করার পাশাপাশি পুথিতে কবি একথাও স্মরণ করিয়ে দেন যে, ৭ই মার্চের ভাষণের কোনো লিখিত রূপ ছিল না, তা ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক অভিযাত্রার অভিজ্ঞতা থেকে উৎসারিত এবং ভাষণটি বাংলাদেশের মানুষের জন্য চিরদিনের অহংকার ও মুক্তিকামী মানুষের দিশারি হয়ে রয়েছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও রাজনীতিকে উপজীব্য করে পুথিকাব্য রচনা করে সমূহ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন সাধক কবি দারোগ আলী। গবেষক জানিয়েছেন যে, বৃহত্তর ঢাকা জেলার রায়পুরা থানার সাহাপুর গ্রামের অধিবাসী দারোগ আলী ১৩৩৪ বঙ্গাব্দে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি একজন বিখ্যাত পুথি পাঠক, জারিগানের গায়ক এবং অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা।
তিনি ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে রচনা করেন বঙ্গবিষাদ পুথি, যার রচনাকাল ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দ। দারোগ আলী তাঁর বঙ্গবিষাদ পুথির ‘১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ তারিখে বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা’ অংশে লিখেছেন :
হেথায় মুজিব মাওরা দলের বাহানা দেখিয়া।
রমনার মাঠে বাঙালিদের আনিল ডাকিয়া॥
বজ্রকণ্ঠে বঙ্গবন্ধু বলে সবাকারে।
শুনো যত বঙ্গবাসী বলি তোমাদেরে॥
খানের দলে মোদের সাথে করেছে টালবাহানা।
জনগণের অধিকার সহজে দিবে না॥
অসহযোগ আন্দোলন কর আজ হইতে।
দেখিব ক্ষমতায় কিসে থাকে মাওরা জাতে॥
আমি যাহা বলি তাহা মানিবে তাবৎ।
মাওরা গোষ্ঠী তাড়াইতে কর শপথ॥
খাজনা-ট্যাক্স যত আছে কিছু নাহি দিবে।
মিলের শ্রমিক কেহ কাজে নাহি যাবে॥
দেশের যত চাকুরিয়া চাকরি ছেড়ে দাও।
খানের দলের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও॥
স্কুল-কলেজ যত আছে সব বন্ধ দিয়া।
সব মিলে যাও তোমরা সংগ্রাম করিয়া॥
বাংলাদেশ আছে যত শহর-গ্রাম।
এক সমানে চালাও সবে জোরেতে সংগ্রাম॥
এবারের সংগ্রাম জেনো মুক্তির সংগ্রাম।
স্বাধীন করিব এবার বাংলা তামাম॥
আরও বলি শুন সবে রাখিবেক মনে।
আমি যদি নাহি থাকি তোমাদের সনে॥
তবে না ডরিবে কেহ পশ্চিমার ভয়ে।
হাতের কাছে যাহা পাও দাঁড়াবে তা লয়ে॥
আজ হতে এক সমানে সংগ্রাম চালাও।
জয় বাংলা বলিয়া জাতির নিশান উড়াও॥
উপর্যুক্ত উদ্ধৃতিতে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ৭ই মার্চ ঢাকার রমনার রেসকোর্স ময়দানে [বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে] প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের মূলকথা ও নির্দেশনাগুলি ধৃত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষ স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে এগিয়ে যেতে দ্বিধা করে না। আসলে, এ ধরনের পুথিকাব্য গ্রন্থনের ভেতর দিয়ে সাধক কবি দারোগ আলী ইতিহাসের প্রকৃত সত্যকেই প্রতিষ্ঠা করেছেন।
নেত্রকোনার পুথিকবি আবদুল হেলিম বয়াতির ১৯৭১-এর স্বাধীনতার পুথি-র মূল অংশ শুরু করেছেন ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ৭ই মার্চের ভাষণ থেকে, শুরুতেই পয়ার ছন্দ-সুরে গ্রথিত পুথির ভাষ্যে রয়েছে :
১৯৭১-এর ৭ই মার্চের শোনেন ঘটনা
শুনিলে হৃদয় বিদরে করিতেছি বর্ণনা॥
এহিয়া ক্ষমতা নিয়া করে তালবাহানা
সেই কারণে কি হইল শুনেন ঘটনা॥
শেখ মুজিবর রেসকোর্স ময়দানে করিলেন বর্ণনা
বিশাল জনসমুদ্রে দেন দিক-নির্দেশনা॥
নাটকীয় ভঙ্গিমায় কবি দর্শক-শ্রোতাদের ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের কথাটিকে ‘ঘটনা’ বলে উল্লেখের মাধ্যমে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন সে কোনো সাধারণ ঘটনা নয়, বরং তা শুনলে ‘হৃদয় বিদরে’, অর্থাৎ হৃদয় শিহরিত হয়ে ওঠে। এরপর তিনি বর্ণনার মধ্যে নাটকীয়তা সৃষ্টিতে স্বৈরাচারী ও ক্ষমতা লোভী ইয়াহিয়া খানের ‘তালবাহানা’র কারণে রেসকোর্স ময়দানে বিশাল জনসমুদ্রে দেওয়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘দিক-নির্দেশনা’ তথা ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের বর্ণনা দিতে উদ্যত হয়েছেন। তবে যে-সময় এবং যাঁদের সামনে কবি তাঁর বর্ণনা বিস্তার করেছেন সে-সম্পর্কে তিনি অত্যন্ত সচেতন, তাই খুব স্বাভাবিকভাবে তিনি রেসকোর্স ময়দানের বর্তমান পরিচয় দিয়ে নিয়েছেন এভাবে :
বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বলিয়া
নামকরণ করা আছে শোনেন মন দিয়া॥
আবদুল হেলিম বয়াতি তাঁর এই পুথিটি মূলত দর্শক-শ্রোতাদের সামনে উপস্থাপন করার নিমিত্তেই রচনা করেছেন বলে আমাদের ধারণা। কেননা, তিনি পুথির সুর-ছন্দের মধ্যে বারবার শ্রোতাদের আকৃষ্ট করেছেন। উপরের উদ্ধৃতি অংশে তার প্রমাণ রয়েছে। শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে তিনি ‘শোনেন মন দিয়া’ বলে পুথির মূলবর্ণনায় প্রবেশ করেছেন। এক্ষেত্রে কবি খুব সংক্ষেপে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের প্রধান প্রধান কথাগুলি বর্ণনা করে লিখেছেন :
দৃঢ় কণ্ঠে শেখ মুজিব বাঙালিদের কয়
স্বাধীনতা আনিতে হবে জানিবেন নিশ্চয়॥
এবারের সংগ্রাম হবে বীরত্বের সংগ্রাম
স্বাধীন করিব এদেশ প্রতিজ্ঞা করিলাম॥
প্রস্তুতি নিয়া যাও বাংলাবাসীগণ
ঘরে ঘরে দুর্গ গড় শুনহ দিয়া মন॥
যা কিছু সম্বল আছে তাই হাতে নিয়া
স্বাধীনতা সংগ্রামে পড়িবে ঝাঁপিয়া
শত্রুর মোকাবেলা যাইব হইয়া॥
আরও বলেন রক্ত দিয়েছি আরও দিব ভাই
তবু দেশকে মুক্ত করিবারে চাই॥
এ আহ্বান জানাইয়া ক্ষান্ত না থাকিয়া
অসহযোগ আন্দোলনের ডাক গেলেন দিয়া॥
উপর্যুক্ত বর্ণনার মাধ্যমে পুথিকবি ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের প্রধান কয়েকটি ঘটনার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের মূলকথাগুলি সুন্দরভাবে গ্রন্থন করেছেন।
কক্সবাজার জেলার পুথিকবি মাস্টার শাহ আলমের পুথিকাব্যে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান শীর্ষক পুথির পয়ার ছন্দে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের প্রসঙ্গ টেনে লিখেছেন :
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পূর্বে ৭ তারিখ মার্চ।
ঐতিহাসিক ভাষণ দিলেন পূর্ব বাংলার রাজ॥
বজ্রকণ্ঠে কহিলেন সংগ্রাম স্বাধীনতার।
বজ্রকণ্ঠে কহিলেন মুক্তি চাই এবার॥
যার যাহা আছে নিয়ে করো মোকাবেলা।
পশ্চিমারে ভাতে মার নাহি করি হেলা॥
শুধু এই বাণীর মধ্যে সীমায়িত নয়, মাস্টার শাহ আলম বঙ্গবন্ধুর সমগ্র জীবনকেই পুথিকাব্যে গ্রন্থন করেছেন।
মানিকগঞ্জের সাধক কবি সাইদুর রহমান বয়াতি ‘মুজিব পরিচিতিনামা পুথি’র একটি পর্বে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ সম্পর্কে লিখেছেন :
…এসব দেখে শেখ মুজিবর সইতে না আর পারে
৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বিরাট মিটিং করে
মনে হল সারা দেশে যত মানুষ আছে
শেখ মুজিবের ডাকে সবাই হাজির হয়ে গেছে
যত রকম দুঃখ ছিল বাঙ্গালিদের মনে
সকল দুঃখ হাজির হল রেসকোর্স ময়দানে
পাগলা ঘোড়া খেপেছে যেমন কিছুই নাহি শোনে
তেমনি মতো শেখ মুজিবর বলছে খোলা মনে
সবাই বলছে এমন কথা কভু শুনি নাই
দুঃখের সাগরে যেমন শান্তির আভাস পাই
মুজিব বলে দিয়েছি আরও রক্ত দেব
তবু আমায় বাংলাদেশকে মুক্ত করে নেব
যার যা আছে তাই নিয়ে শক্ত হাতে দাড়াও
চোর ঢুকেছে বড় ঘরে বাইরাইয়া তাড়াও
এসব কথা শুনে সবাই শক্তি-সাহস পাইল
প্রতি জনের বুকে যেন হাতির শক্তি এল॥…

এখানে সাধক কবি সাইদুর রহমান বয়াতি নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের অন্তর্গত শক্তি ও উদ্দীপনার কথা ব্যক্ত করেছেন। তবে, তাঁর রচিত পুথিকাব্যে তিনি মূলত বঙ্গবন্ধুর জীবনের নানা পর্যায়কে বর্ণনা করেছেন। অধিকাংশ পুথিকবিই বঙ্গবন্ধুর সামগ্রিক জীবনকে তাঁদের পুথিকাব্যে স্থান দিতে তৎপর হয়েছেন। এই ধারার অন্যতম আরেক কবি হলেন পাবনার ফকির আবুল হাশেম। তিনি পুথিকাব্যের ধারায় যেমন বঙ্গবন্ধুর জীবনকে চিত্রিত করেছেন, তেমনি বহু গান লিখে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের মাহাত্ম্য প্রচার করেছেন।
এভাবেই পুথিসাহিত্যের ঐতিহ্যিক ধারায় বাংলাদেশের প্রায় সকল অঞ্চলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণকে বিষয়বস্তু করে বহু পুথিকাব্য রচিত হয়েছে, যার ভেতর দিয়ে ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ বহুমাত্রিকভাবে ব্যাখ্যাত ও বিশ্লেষিত হয়েছে। একই সাথে এই ভাষণের সূত্র এদেশের সাধক কবিগণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা হিসেবে স্পষ্টত ঘোষণা করেছে। উল্লেখ্য, ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ ছাড়াও বঙ্গবন্ধুর জীবনের বিভিন্ন পর্ব ও মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অনেক পুথিকাব্য রচিত, প্রকাশিত, পঠিত ও গীত হয়েছে।
এ ধরনের পুথিকাব্য যথাযথভাবে সংগ্রহের উদ্যোগী হয়ে তাতে প্রতিফলিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও রাজনীতি বিষয়ে যেমন আরও বিস্তৃত গবেষণার সুযোগ রয়েছে তেমনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জনসাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতার বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। ভবিষ্যতে নিশ্চয় অনেকে এ ধরনের গবেষণায় ব্রতী হয়ে সাধক কবি ও পুথিকারদের রচনায় প্রতিফলিত জাতির পিতার প্রতিকৃতি এবং মুক্তিযুদ্ধের নানা ঘটনার বিশ্লেষণ করবেন।
লেখক : লোকসংস্কৃতি গবেষক