কবিতা : এখনো দাঁড়িয়ে ভাই : কামাল চৌধুরী

ঠায় প্রতীক্ষায় আছি- পুত্র নই, রাজপুত্র নই- তবু দ্যাখো
তোমার মতোই এক স্থিরনেত্র বিংশতি বৎসরের যুবা
অধীর দাঁড়িয়ে থেকে গুণে যাচ্ছি মুহূর্তের সবগুলো সাঁকো
কখনো আকাশ জুড়ে দেখা দিলে নিশীথের দীপ্ত দীপাবলি
ভাবি এই বুঝি ফুরালো প্রহর। সমুদ্রের দিকে চেয়ে থেকে
আমার কাটে না দিন; দূরাগত জাহাজের বাঁশি অপেক্ষার
তন্ত্রীজুড়ে কখনো তোলে না কোনো সুখপ্রদ রাতের মর্মর
জানি, এখানে সমুদ্রে নেই আমাদের জন্যে কোনো সুখবর।
শুধু এই কালোরাত্রি, দুষ্টক্ষত এই গাঢ় অসহ্য তমসা
কখন পড়বে চাপা আলোকিত দুপুরের নিচে, নির্নিমেষ
দেখি তাই ব্যস্ততম মানব বসত। কখন জ্বলবে আলো?
আমি তাই লোকালয়ে রাত্রিদিন মেলে রাখি ধূসর দু-চোখ
ছয়টি বছর ধরে। টেলেমেকাস, কখনো জানবে না তুমি
আমার প্রতীক্ষা কত দীর্ঘ, কত দীর্ঘ এই বিনিদ্র সময়?
আমি যেন সেই অপেক্ষার ইথাকা যুবক, রসাতলে যাচ্ছে
দেশ, চতুর্দিকে বসে আছে বাউন্ডুলে মাতব্বর সব, দ্যাখো
গোলায় তুলছে তারা সবকিছু আমাদের নধর গৌরব।
শুধু এক মাতাদেশ গোপনে লুকিয়ে কাঁদে, বিশাল শূন্যতা
দেখে হু হু করে বুক; নিভৃতে একাকী বোনে হৃদয়ের কাঁথা।
এদেশ ইথাকা নয়, ইথাকার মতো মুগ্ধ সবুজে শ্যামলে
মাখা ক্ষুদ্র এক সমতলভূমি, পঞ্চান্ন হাজার তার বর্গ
জুড়ে শান্তস্থিত নদ-নদীদের স্বপ্নময় অথই কল্লোল
দক্ষিণে সমুদ্র তার ফুঁসে ওঠা আদিগন্ত বিশাল জলধি
উত্তর ও পূর্বে তার আসাম ও জলপাইগুড়ি, প্রতিবেশী
বার্মার চিরহরিৎ বৃক্ষপূর্ণ উষ্ণ উষ্ণ আর্দ্র পার্বত্য এলাকা
পশ্চিমে হৃদয় থেকে কেটে নেয়া একখণ্ড পরিচিত ভূমি
এইতো আমার দেশ- মা আমার, গরিয়সী প্রাণের সবুজ।
ধনধান্যে পুষ্পেভরা হায়; অন্তরালে এই দেশ সর্বাধিক
দারিদ্য পীড়িত। স্মরণকালের মধ্যে তার মতো আর কেউ
এত বেশি প্রতারিত হয়নি কখনো। পরাজিত হয়েছে সে
বহুবার, নিজহাতে চক্রান্তের বেড়াজালে নিজেকে জড়িয়ে।
এভাবে হারাল তাঁকে যার নামে স্রোতস্বিনী দক্ষিণের ঢেউ
উথালপাথাল নেচে প্লাবিত করেছে এই ক্ষুব্ধ জনপদ
সমুদ্র সাঁতরে এসে যে দিয়েছে ক্লান্তিহীন তীব্র জাগরণ
আপাত সুখদ ঘুম যে কুঠার দীর্ঘদিন কেটেছে দুহাতে
তর্জনিতে যে মানুষ সরিয়েছে শিলীভূত নেশার আস্তর
তাঁকেই হারাল দেশ উত্থানের পরবর্তী কয়েক বছরে।
নিরাপত্তা ও শান্তির জন্যে অস্ত্র কেনা হল, যার সাথে
মিশে আছে শ্রমিকের স্বেদবিন্দু, শস্যকণা, স্বদেশের প্রেম
দুমুঠো অন্নের দামে, সীমান্ত রক্ষার নামে যাকে কেনা হল
তাতেই ঝরল মৃত্যু, বিশাল হৃদয় এক মানবিক বুকে।
এখানে করুণ মৃত্যু নামে ঘাতকের ঘৃণ্য হাতে অকস্মাৎ
ঋতুবদলের মতো বারবার ফিরে আসে পরাজিত মুখ
আমরা হারাই তাঁকে যাকে পেয়ে দেশ পেল ভোরের সুষমা।
তবুও কি নুয়ে থাকি? ঘাড় মাথা তুলে রাখি বিদীর্ণ স্বদেশে
নিজেকে প্রস্তুত করি গোপনে হৃদয়ে বাড়ে বিক্ষুব্ধ শাখারা
আমাদের কষ্ট বাড়ে, মৃত্যু বাড়ে, তবু বাড়ে পথের স্বজন
প্রতীক্ষায় থাকে তারা একা নয় লক্ষ লক্ষ মানব মিছিলে।
এখানে জনতা আজ ক্ষিপ্রহাতে প্রতিদিন করছে সেলাই
মোহন নকশি কাঁথা, যার প্রতি সূত্রে মাখা একুশের ভোর
সাত ও সতেরই মার্চ, নবান্নে ভাতের ঘ্রাণ, পহেলা বৈশাখ
প্রতিকূল বাতাসের মুখে মাঝিদের স্বপ্নমুগ্ধ ভাটিয়ালি
মানব মুক্তির স্বপ্ন, ব্রহ্মপুত্র যমুনার জলের কল্লোল
রবীন্দ্রনাথের গান আর ম্লান মুখ মানুষের বিশ্বাসের
জাতীয় পতাকা; আর সে নকশি কাঁথা ভালোবেসে নিদ্রাহীন
লিখে যাচ্ছে স্বদেশের সমার্থক প্রিয় এক মানুষের নাম।
অধীরে দাঁড়িয়ে আছি জানি, কখনো ফিরবে না সে সশরীরে
তাহলে কীসের জন্যে লোকালয়ে রাত্রিদিন অপলক মেলে
রাখি তৃষিত আঁখিকে? আমি কি ভোরের জন্যে প্রতীক্ষায় আছি?
তোমার সাম্রাজ্যে তবু পুনর্বার ফিরেছিল ভোর, প্রতুষ্যের
বার্তাবহ দুহাতে সরিয়ে সব অরাজক ঘুটঘুটে রাত
দেবতার অনুগ্রহে নেমেছিল পৌরাণিক প্রাজ্ঞ ওডিসাস।
আমরা দাঁড়িয়ে আছি; এই দেশ তার লজ্জানম্র হৃদয়ের
পরে জ্বেলেছে আগুন; তুষের মতোন গাঢ়, পরিব্যাপ্ত সর্ব
সাধারণে! তাকেই জ্বালাতে চাই, আর একবার জ্বলে যাক
এই প্রিয় ভূখণ্ড আমার, এই প্রিয় ক্ষুব্ধ ভূখণ্ড আমার
অপেক্ষায় আছি তাই দেশবাসী, কাঁধে কাঁধে মেলানো শরীর।
নেত্রপতনের শব্দে দ্যাখো, আমার অগ্নি ও বিষবাষ্প ঝরে
আমি সে বিষের বাঁশি বাজিয়ে নোয়াতে চাই গোক্ষুরের ফণা
এই বঙ্গ সমতট বরেন্দ্র ভূমিতে পুনর্বার ফিরে চাই
অমিত মানুষ। বৃক্ষের নিষ্পত্র শাখে পেতে চাই পঞ্চমীর
বসন্ত কূজন; ভোরের আজান থেকে সুপ্তিভঙ্গ, অনুকূল
বায়ে ছোটা স্বচ্ছজলে গতিময় মাঝিদের অফুরন্ত দিন
এখনো দাঁড়িয়ে ভাই- বাংলাদেশ পৌরাণিক ইথাকা আমার।
১৯৮১