হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের সময় ও মানুষ : আমিনুর রহমান সুলতান

শ্রদ্ধার্ঘ্য : হুমায়ূন আহমেদ
হুমায়ূন আহমেদ
৬৬তম জন্মদিনের স্মরণ
হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের সময় ও মানুষ
আমিনুর রহমান সুলতান
উপন্যাস জীবনঘনিষ্ঠ ও জীবনসংলগ্ন শিল্প। আর এই জীবনঘনিষ্ঠতা সমকালীন সমাজের মনস্তত্ত্ব তথা অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দায়বদ্ধতাকে স্বীকার করে রচিত হয়। এ প্রসঙ্গে আহমদ শরীফের মন্তব্য উল্লেখযোগ্য- তাঁর সংকট : জীবনে ও মননে গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি তুলে ধরছি-
‘উপন্যাসের নোঙ্গর গেঁথে থাকে ব্যক্তি মানুষের জীবন যা তার প্রাতিস্বিক সত্তার গভীরে। কিন্তু উপন্যাস ব্যক্তিসত্তার কাহিনি হলে কী হবে, অনেক সময় উপন্যাস প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষভাবে বহন করে চলে সমাজ এবং রাজনীতির অভিজ্ঞান।’
তাই তো স্বাধীনতাপূর্ববর্তীকালের রাজনৈতিক উপন্যাসের যে ঐতিহ্য সে নিরীখে বাঙালি তাঁদের বৈচিত্র্যময় আত্মঅন্বেষণের পথ খুঁজে পায় মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসের মধ্য দিয়ে। এক্ষেত্রে শওকত ওসমান, রশীদ করীম, সৈয়দ শামসুল হক, রাবেয়া খাতুন, হাসনাত আবদুল হাই, রিজিয়া রহমান, মাহমুদুল হক, আবুবকর সিদ্দিক, রশীদ হায়দার, সেলিনা হোসেন, জুলফিকার মতিন, মঈনুল আহসান সাবের, ইমদাদুল হক মিলন, মঞ্জু সরকার এবং হুমায়ূন আহমেদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
সূর্যের দিন কিশোর মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসসহ হুমায়ূন আহমেদ মুক্তিযুদ্ধের সমকালীন পরিপ্রেক্ষিতে লিখেছেন আরও কয়েকটি উপন্যাস। উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলো হচ্ছে শ্যামল ছায়া, ১৯৭১, সৌরভ, আগুনের পরশমণি, অনিল বাগচীর একদিন, জোছনা ও জননীর গল্প ইত্যাদি। হুমায়ূন আহমেদ মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসে একাত্তরের রক্তাক্ত সময়ের সমাজচিত্র এমনভাবেই তুলে ধরেছেন যে, সেখানে কেবল যুদ্ধকালীন দুর্গত বাংলাদেশের ছবিই নয়, পাশাপাশি প্রত্যক্ষ করা যায় স্বপ্নময় ও নতুন মূল্যবোধের সাহসী ও প্রতিবাদী মানুষের মুখচ্ছবি।
অবশ্য তাঁর উপন্যাসের সৃষ্টি সাহসী ও প্রতিবাদী মানুষেরা আপাতদৃষ্টিতে কোন রাজনৈতিক ভাবাদর্শ থেকে উঠে আসেনি। যদিও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পেছনে আছে রাজনৈতিক ঘটনার ধারাবাহিকতা। আলোচ্য উপন্যাসসমূহের চরিত্রের মধ্যে হুমায়ূন আহমেদের মানবিক মূল্যবোধ বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে। যা রাজনৈতিক শিল্পচেতনায় উত্তীর্ণ হয়ে যায়। কেননা জীবন সংগ্রামের মূর্ত ঘটনাবলিই তো রাজনৈতিক হয়ে ওঠে। অভিধা পায় রাজনৈতিক অনুষঙ্গে।
মানবিকতাবোধ থেকে তাঁর উপন্যাসের সাধারণ ব্যক্তি হয়ে ওঠে অসীম সাহসী ও বিদ্রোহী। কোনো রাজনৈতিক আদর্শের মাপকাঠিতে এসব চরিত্রগুলোকে পরিমাপ করা যাবে না। আমরা জানি, মানুষের মন স্বভাবত প্রতিবাদপ্রবণ। শৈশবে শাসন-নিষেধ অগ্রাহ্য করার মধ্যেই বিদ্রোহী চেতনার প্রকাশ ঘটে। বৈষম্য অসঙ্গতি অত্যাচার দেখলেই মানুষ তাই প্রতিবাদমুখর হয়। এই প্রতিবাদ প্রবণতাই সময়ের ব্যবধানে বিক্ষোভ এবং তারও পরে বিদ্রোহে বিস্ফারিত হয়।
শ্যামল ছায়ার কাহিনির পটভূমি খুব বিস্তৃত নয়। একটি থানা অপারেশনের কাহিনি নিয়ে এই উপন্যাস গড়ে উঠেছে। কয়েকজন তরুণ গেরিলা এই অপারেশনে অংশ নেয়। থানা অপারেশনে যাত্রাকালে জাফর, হুমায়ূন, হাসান আলী, মজিদ, আনিস প্রমুখের ভাবনা-চিন্তা এবং যুদ্ধকালীন দুর্গত বাংলাদেশের চিত্র উঠে এসেছে খণ্ড খণ্ড স্মৃতিচারণের মধ্য দিয়ে। বিস্তৃত হয়েছে তরুণ গেরিলাদের দুঃসাহসিক যুদ্ধযাত্রা। এই উপন্যাসের আরও একটি বিশেষ লক্ষণীয় দিক হচ্ছে কেরামত মওলা ও হাসান আলীর মতো রাজাকারের অভাব ছিল না।
হুমায়ূন আহমেদ দেখিয়েছেন এমন কিছু রাজাকার ছিল যারা স্বাধীনতা-বিরোধিতা করার জন্য রাজাকারে নাম লেখায়নি। অভাবের তাড়নায় কেউ কেউ পা বাড়িয়েছিল সে পঙ্কিল পথে। যেমন লেখকের ভাষায় গ্রন্থের উদ্ধৃতি থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যায়-
চেয়ারম্যান সাব কইলেন, ‘হাসান আলী রাজাকার হইয়া পড়। সত্তর টাকা মাস মাইনা, তার সাথে খোরাকি আর কাপড়।
চেয়ারম্যান সাব আমার বাপের চেয়ে বেশি নেকবক্ত পরহেজগার লোক। তাঁর ঘরে খাইয়া এত বড় হইলাম। আমার চামড়া দিয়ে চেয়ারম্যান সাহেবের জুতা বানাইলেও ঋণ শোধ হয় না। তাঁর কথা ফেলতে পারি না। রাজাকার হইলাম।’
এই সব রাজাকার আবার কখনও কখনও মুক্তিযোদ্ধার ভূমিকায় অংশ নিয়েছে এবং মৃত্যুকে অকুতোভয়ে বরণ করে নিয়েছে। হাসান আলীর অভিব্যক্তি থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া হলো –
‘মনডা খারাপ হইল। কামডা বোধ হয় ভুল হইল। তখনও আমরার গ্রামের মধ্যে রাজাকার- দল হয় নাই। আমরা হইলাম পরথম দল। সাতদিন হইল ট্রেনিং লেফট রাইট, লেফট রাইট।… গুলি চালাইতে শিখলাম, মিলিটারিরা যত্ন কইরা সব শিখাইল। তারা সব সময় কইত ‘তুম সাচ্চা পাকিস্তানি মুক্তিবাহিনী একদম সাফা কর দো।’ মনডার মধ্যে শান্তি পাই না বুকটা কান্দে। রাইতে ঘুম হয় না। আমরার সাথে ছিলো রাধানগরের কেরামত মওলা। সে আছিল রাজাকার কমান্ডার। তারা ফেরেস্তার মতো আদমি।… যখনই হিন্দুর ঘরে আগুন দেয়া শুরু হলো, কেরামত ভাই কইলেন, ‘এইটা কী কাণ্ড! কোনো দোষ নাই, কিচ্ছু নাই, ঘরে কেন আগুন দিমু? ওস্তাদজী কইলেন…‘ওতো ইন্দু হ্যায়, গাদ্দার হ্যায়।’
কেরামত ভাইয়ের সাহসের সীমা নেই। বুক ফুলাইয়া কইল, ‘আগুন নেই দেঙ্গা। তার লাশ নদীতে ভাইস্যা উঠল।… মিলিটারি যা করে, তাই করি। নিজের হাতে আগুন লাগাইলাম সতীশ পালের বাড়ি, কানু চক্রবর্তীর বাড়ি। …ইস, মনে উঠলেই কইলজাটা পুড়ায়।’
শেষমেষ মিলিটারিরা শরাফত সাহেবের বড়ো পুলাডারে ধইরা আনল। আমার মাথায় গণ্ডগোল হইয়া গেছে। কী করতাম ভাইব্যা পাই না। শেষকালে ছেলেডা আমার দিকে চাইয়া কইল, ‘হাসান বাই আমারে বাঁচান।’ ‘ক্যাপ্টেন সায়েবের পাও জড়াইয়া ধরলাম। লাভ হইল না। আহা ভাইরে আমার। কইলজাটা পুড়ায়। আমি একটা কুত্তার বাচ্চা। কিছু করবার পারলাম না।… সেই রাইতেই গেলাম মসজিদে। পাক কোরআন হাতে লইয়া কিরা কাটলাম এর শোধ তুলবাম। এর শোধ না তুললে আমার নাম হাছান আলী না। এর শোধ না তুললে আমি বাপের পুলা না। এর শোধ না তুললে আমি বেজন্মা কুত্তা।’
ঔপনিবেশিক শাসকদের বৈষম্য বহু যুগ থেকেই দেখে এসেছে বাঙালি। পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসকের অত্যাচারও দেখেছে। কিন্তু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় যে অত্যাচার, অবিচার, গণহত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করেছে তা এর আগে কখনও দেখেনি। ফলে মুক্তিযুদ্ধকালীন দুর্গত বাংলাদেশের যেকোনো বাঙালি প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছিল এটাই স্বাভাবিক। আর এই স্বাভাবিকতা হুমায়ূন আহমেদের মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসে নতুন মাত্রা এনেছে সন্দেহ নেই। হুমায়ূন আহমেদের সাধারণ চরিত্রগুলো বিদ্রোহী হয়ে উঠার পেছনে যে মানবিকতাবোধ কাজ করেছে এবং বৈষম্য থেকে প্রতিরোধের জন্ম দিয়েছে এরও একটা সাক্ষ্য মেলে হুমায়ূন আহমেদের জবানিতে-
‘আমার বাবা পুলিশ অফিসার ছিলেন। উনিশশ’ একাত্তর সনের পাঁচই মে তাঁকে দেশপ্রেমের অপরাধে পাক আর্মি গুলি করে হত্যা করে। সে সময় আমার ছোট ভাইবোনদের নিয়ে বরিশালের এক গ্রামে লুকিয়ে আছি। কী দুঃসহ দিনই না গিয়েছে। বুকের ভেতর কিলবিল করছে ঘৃণা, লকলক করছে প্রতিশোধের আগুন। স্বাধীনতা টাধীনতা কিছু নয়, শুধু ভেবেছি, যদি একবার রাইফেলের কালো নলের সামনে ওদের দাঁড় করাতে পারতাম।
ঠিক একই রকম ঘৃণা, প্রতিশোধ গ্রহণের একই রকম তীব্র আকাক্সক্ষা সেই অন্ধকার দিনের অসংখ্য ছেলেকে দুঃসাহসিক করে তুলেছিল। তাদের যুদ্ধের কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। না, কোনো সহায়সম্বল ছিল না। কিন্তু ছিল শ্যামল ছায়ার জন্য গাঢ় ভালোবাসা।’
শ্যামল ছায়ার একজন মুক্তিযোদ্ধার জবানি থেকেও তা উপলব্ধি করা যায়। যেমন-
যে জান্তব পশুশক্তির ভয়ে পরী ছোট ছোট পা ফেলে ত্রিশ মাইল হেঁটে গেছে আমার সমস্ত ক্ষমতা ও শক্তি তার বিরুদ্ধে আমি রাজনীতি বুঝি না। স্বাধীনতা টাধীনতা নিয়ে সে রকম মাথাও ঘামাই না। শুধু বুঝি ওদের শিক্ষা দিতে হবে।

১৯৭১ উপন্যাসের কাহিনি নির্মিত হয়েছে বাংলাদেশের একটি হতদরিদ্র গ্রাম নিয়ে। দরিদ্র শ্রীহীন ত্রিশ-চল্লিশ ঘরের একটি বিচ্ছিন্ন জনপদ এটি। এই গ্রামের পাশে রয়েছে জঙ্গলা। এছাড়া রয়েছে সবচেয়ে সম্পদশালী ব্যক্তি কেবল জয়নাল মিয়া। দু’জন বিদেশি লোকের মধ্যে একজন নীলগঞ্জ মসজিদের ইমাম সাহেব, অন্যজন নীলগঞ্জ প্রাইমারি স্কুলের আজিজ মাস্টার। পাগল ও আরও কতিপয় চরিত্র। নীলগঞ্জ যে দিকটার জলাভূমি একদল কৈবর্ত থাকে সেদিকে। নীলগঞ্জে হঠাৎ মিলিটারি ঢোকে। মিলিটারিদের ধারণা মুক্তিবাহিনীর একটি দল নীলগঞ্জের জঙ্গলময় স্থানে ঢুকে পড়েছে। মুক্তিবাহিনী নির্মূল করা তথা মুক্তিবাহিনীকে আটক করা বা কোথায় লুকিয়ে আছে তারা, এই সত্য উদ্ঘাটন করা মিলিটারিদের উদ্দেশ্য থাকলেও নিরীহ গ্রামবাসীদের একের পর এক নির্মূল করার প্রয়াসে লিপ্ত থেকেছে এরা। আজিজ মাস্টারের মতো সাধারণ মানুষকে অমানুষিক নির্যাতন করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে, হত্যা করেছে গ্রামের নীলু সেনকে। অনেকের বাড়িঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। ধর্ষণ করতে দ্বিধা করেনি সফর উল্লাহর স্ত্রী ও বোনকে। মিলিটারিরা গ্রামে প্রবেশের সাথে সাথে রফিক নামের সহচর খানসেনাদের পক্ষে কাজ করলেও উপন্যাসের সমাপ্তিতে রফিককে একজন প্রকৃত সাহসী ও প্রতিবাদী দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কাজ করতে দেখা যায়। ফলে মিলিটারির মেজর এজাজ সন্দেহভাজন হয়ে ওঠে- এ সময় রফিককে গুলি করার জন্য খালের বুক পর্যন্ত পানিতে দাঁড় করায় এবং গুলি করে হত্যা করে। হত্যার পূর্বে রফিকের সাহসিকতা ও প্রতিবাদের একটি উদাহরণ-
মেজর এজাজ আহমেদ পাড়ে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর পাশে ডানদিকে চাইনিজ রাইফেল হাতে দু’জন জোয়ান এসে দাঁড়িয়েছে। রফিক নেমেছে বিলে।
বিলের পানি অসম্ভব ঠাণ্ডা। রফিক পানি কেটে এগোচ্ছে। কি যেন ঠেকল হাতে। মনার ছোট ভাই হিরু। উপুড় হয়ে ভাসছে। যেন ভয় পেয়ে কাছে এগিয়ে আসতে চায়। রফিক পরম স্নেহে হিরুর গায়ে হাত রেখে বলল ভয় নাই। ভয়ের কিছুই নাই।
পাড়ে বসে থাকা মেজর সাহেব বললেন, কার সঙ্গে কথা বলছ রফিক।
: নিজের সঙ্গে মেজর সাহেব
: কি বলছ নিজেকে?
: সাহস দিচ্ছি। আমি মানুষটা ভীতু।
অবশ্য রফিককে বুক সমান পানিতে দাঁড় করিয়ে, রফিককে গুলির মুখে ছেড়ে দিয়ে লেখক গুলি করে হত্যার সরাসরি ইঙ্গিত না করলেও, রফিক যে সাহসী মানসিকতায় স্বদেশের মমত্ববোধে মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছে এর প্রতীকী উপস্থাপন লক্ষ্য করা যায়। বাঙালির রক্তাক্ত সময় ও সাহসী মানুষের প্রতিবাদ এবং স্বাধীনতার সম্ভাবনাকে হুমায়ূন আহমেদ মেজর এজাজের উপলব্ধির মধ্য দিয়ে উদ্ভাসিত করেছেন। যেমন-
কৈবর্তপাড়ায় আগুন ছড়িয়ে পড়ছে। আলো হয়ে উঠেছে চারদিকে। রফিককে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে এবার। ছোটখাট অসহায় একটা মানুষ। বুক পানিতে দাঁড়িয়ে আছে। মেজর সাহেব বললেন রফিক তুমি কি বেঁচে থাকতে চাও? রফিক শান্ত স্বরে বলল, চাই মেজর সাহেব। সবাই বেঁচে থাকতে চায়। আপনি নিজেও চান। চান না?
মেজর সাহেব চুপ করে রইলেন। রফিক তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, মেজর সাহেব, আমার কিন্তু মনে হয় না আপনি জীবিত ফিরে যাবেন এ দেশ থেকে।
মেজর এজাজ আহমেদ সিগারেট ধরালেন, কৈবর্তপাড়ার আগুনের দিকে তাকালেন। পশতু ভাষায় সঙ্গের জোয়ান দুটিকে কি যেন বললেন, গুলির নির্দেশ হয়তো। রফিক বুঝতে পারল না। সে পশতু জানে না।
হ্যাঁ, গুলির নির্দেশই হবে। সৈন্য দুটি বন্দুক তুলছে। রফিক অপেক্ষা করতে লাগল।
বুক পর্যন্ত পানিতে পা ডুবিয়ে লালচে আঁচে যে রফিক দাঁড়িয়ে আছে মেজর এজাজ আহমেদ তাকে চিনতে পারলেন না। এ অন্য রফিক।
মুক্তিযুদ্ধে ধ্বংসষজ্ঞ চলেছে বাংলাদেশের সর্বত্র। এ যুদ্ধে পাকিস্তানিরা গ্রাম আর শহর উভয় স্থানের জনজীবনকে করে তুলেছিল আতঙ্কগ্রস্ত। বাঙালিকে করে রেখেছিল অবরুদ্ধ। বাংলাদেশকে করে তুলেছে দুর্গত। এই দুর্গত এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনী দ্বারা হিন্দু এবং মুসলমান উভয়েই ক্ষতিগ্রন্ত হয়েছে। হিন্দু হোক আর মুসলমান হোক বাঙালি বলে নির্যাতন চালিয়েছে তারা। তবে মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে যারা স্বাধীনতার বিপক্ষে কাজ করেছে, সেজেছে পাকিস্তানিদের দোসর, তাদের কিছুটা বিশ্বাস করে, বাকি সব মুসলমানদের তারা সন্দেহের চোখে দেখেছে, দেখেছে সংশয়ের চোখে এবং চালিয়েছে নির্যাতন। আর হিন্দু সম্প্রদায় একেবারেই তাঁদের আস্থাভাজন হতে পারেনি। ফলে বাংলাদেশের প্রত্যেক জায়গায় হিন্দুরা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নির্যাতিত হয়েছে। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়ার ফলে হারিয়েছে ভিটেবাড়ি। অনেকেই আশ্রয় নিয়েছে ভারতের শরণার্থী শিবিরে। সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিচেতনা থেকে পাকিস্তানি সৈন্যরা যে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর অকথ্য ও নির্মম অত্যাচার করেছে তার জ্বলন্ত চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে হুমায়ূন আহমেদের অনিল বাগচীর একদিন উপন্যাসটিতে।
পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী এবং সৈনিকদের আশ্রয়স্থল ছিল কেবলমাত্র ধর্মীয় কৌশল। ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে বাঙালিকে আরও অধিককাল পরাধীন ও শোষণের যাঁতাকলে রাখার নিরন্তর চেষ্টা চলছিল প্রতিনিয়ত। কিন্তু বাঙালিরা দেশমাতৃকার জন্য যে মৃত্যুকে তুচ্ছ জ্ঞান করে প্রতিবাদী হয়ে উঠবে, প্রতিরোধের পরিবেশ সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে তা একচক্ষুবিশিষ্ট পশ্চিমাদের দৃষ্টিতে ধরা পড়েনি।
এক রক্তাক্ত সময়েরই প্রতিনিধিত্বকারী এ উপন্যাস। কেননা অনিল বাগচীর বাবা সুরেশ বাগচী একজন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক হয়েও হিন্দু সম্প্রদায়গত বলে মিলিটারিদের হাত থেকে রক্ষা পাননি। আইয়ুব আলি শত চেষ্টা করেও মিলিটারিদের হাত থেকে বাঁচাতে পারেনি অনিলকে। অনিলের অপরাধ সে হিন্দু।
একাত্তরের রক্তাক্ত সময়ে বাঙালি শুধু সাহসী ও প্রতিবাদী হয়নি। প্রতিরোধও গড়েছে। রক্তাক্ত সময়ের ওপর দাঁড়িয়ে বাঙালি অংশ নিয়েছে মুক্তিযুদ্ধে, আকাক্সক্ষা করেছে একটি নতুন ভোরের। এরই যথার্থ প্রতিফলন লক্ষণীয় সৌরভ ও আগুনের পরশমণি উপন্যাস দুটিতে।
এই দুটি উপন্যাসের মধ্যে কাহিনির ঐক্যসূত্র আছে। আছে প্রতিরোধের প্রস্তুতি ও বিকাশের ধারাবাহিকতা। এই উপন্যাস দুটি গ্রামকে ছাড়িয়ে অবরুদ্ধ ঢাকা শহরের প্রেক্ষাপটে রচিত। একদিকে সৌরভ-এর কাদের রফিক, মুক্তিযুদ্ধে ট্রেনিং নিতে যায় আগরতলায়। অন্যদিকে আগুনের পরশমণি-এর আলম, সাদেক, গৌরাঙ্গ মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিয়ে ফিরে আসে যুদ্ধের জন্য এবং তাদের অপারেশনের কারণে ঢাকা যেন ভেতর থেকে কিছুটা নড়ে ওঠে ভিন্নমাত্রার জীবনবোধে।
২০০৪ এ প্রকাশিত হয় হুমায়ূন আহমেদের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মহাকাব্যিক উপন্যাস জোছনা ও জননীর গল্প। পাঁচ শতাধিক পৃষ্ঠার এ বিশালকায় উপন্যাসের আখ্যানভাগ জুড়ে আছে একাত্তরের পটভূমি, এর অনশ্বর অগ্নি ও উত্তাপ। এই উপন্যাস সম্পর্কে লেখক তাঁর ‘পূর্বকথা’য় বলেন-
‘…উপন্যাসে বর্ণিত প্রায় সব ঘটনাই সত্যি। কিছু নিজের অভিজ্ঞতা থেকে লেখা। কিছু অন্যের অভিজ্ঞতা থেকে ধার নেয়া। প্রকাশিত হবার আগেই এ উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি অনেককে পড়িয়েছি। যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখে নি (এই প্রজন্মের পাঠকদের কথা বলছি) তারা পড়ার পর বলেছেÑ উপন্যাসের অনেক ঘটনাই তাদের কাছে কাল্পনিক বলে মনে হচ্ছে, এরকমও কি হয় ?
তাদের কাছে আমার একটাই কথা- সে বড় অদ্ভুত সময় ছিল। স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের মিশ্র এক জগৎ। সবই বাস্তব, আবার সবই অবাস্তব। আমি সেই ভয়ঙ্কর সুন্দর সুররিয়েলিস্টিক সময় পার করে এসেছি। তার খানিকটাও যদি ধরে থাকতে পারি, তাহলেই আমার মানবজীবন ধন্য।’
হুমায়ূনের পূর্বানুমান ঠিক হয়েছে। এই উপন্যাস তার শিল্পকাঠামো ছাপিয়ে উত্তর প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল সময়খণ্ডে নিয়ে চলে যেন। দেশের ঠিকানাহীন অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার কবরের মধ্যে এই উপন্যাসের নাইমুল চরিত্রকে প্রতিস্থাপনের মধ্য দিয়ে হুমায়ূন আহমেদ মূলত কবরভেদী অমর মুক্তিসেনানীদের চিরায়ত ছবিই অংকন করেছেন যারা থাকলে এই দেশমাতৃকার আর কোনো দুঃখ নেই।
মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম- এই স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের ভেতর ভবিষ্যৎ নিয়ে যে স্বপ্নের জন্ম হয়েছিল তা বাস্তবায়নের অপেক্ষায় আজও বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ। আর সে স্বপ্ন বাস্তবায়নও মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসে নতুন মাত্রা পাবে এ প্রত্যাশা আমাদের।