প্রচ্ছদ রচনা : আমার এই লেখাটি শাহানার জন্য : হরিশংকর জলদাস

প্রচ্ছদ রচনা
আমার এই লেখাটি শাহানার জন্য
হরিশংকর জলদাস
বইটা কিনেছিলাম শাহানা কায়েসের টানে নয়, হুমায়ূন আহমেদের টানে। একটানে বইটা পড়া শেষ করেছি। হুমায়ূন আহমেদের আকর্ষণে নয় শাহানা কায়েসের লেখার গুণে। পাঠককে পাঠে মগ্ন রাখতে পারা চাট্টিখানি কথা নয়। বিশেষ করে আমার মতো প্রবীণ পাঠককে। প্রবীণরা হাতের কাছে যা পায়, পড়ে না। বেছে বেছে পড়ে।
বইটার নাম- হুমায়ূন আহমেদের কয়েকটি চিঠি ও একটি ডায়রি।
বইটির নাম বেশ দীর্ঘ। নামের দীর্ঘতায় কারো আপত্তি থাকার কথা নয়, কিন্তু একটি শব্দের বানানের ক্ষেত্রে কেউ কেউ আপত্তি তুলতে পারে। আপত্তিটা ‘ডায়রি’ শব্দের বানানের ব্যাপারে। বাংলা একাডেমির ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে, শব্দটির বানান এরকম- ডায়েরি, ডায়েরী, ডাইরি। লেখার প্রসাদগুণে এই আপত্তিটা ধোপে টিকবে না।
বইটি হাতে আসার একটা ইতিহাস আছে।
২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারির বইমেলায় আমি দু’বার গিয়েছিলাম। একবার প্রথম দিকে, আরবার শেষ দিকে। ফেব্রুয়ারি প্রথম দিকে দোকানগুলিতে ভিড়বাট্টা থাকে না। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বই দেখা যায়, বেছে বেছে কেনা যায়। এ-দোকান ও-দোকান দেখতে দেখতে ‘অন্যপ্রকাশ’-এর স্টলে গিয়েছিলাম। ‘অন্যপ্রকাশ’ তো হুমায়ূন আহমেদের দুর্গ। বইমেলায় গেলে ওই দুর্গে আমি একবার হানা দিই। কারণ হুমায়ূন আহমেদের আবেগে-আবেশে মেশানো লেখা আমি পছন্দ করি। অনেক ইনটেলেকচুয়াল হুমায়ূনের লেখা পড়াকে অর্বাচীনতা মনে করে। আমি ওই অর্বাচীনদের একজন। কারণ ভাঁড়ামিতে ভরা এই বাংলাদেশে অর্বাচীন হওয়ার একটা আনন্দ আছে। হুমায়ূন আহমেদের লেখা উপন্যাসকে কত নামেই না অভিহিত করেছেন তাঁরা- উপ-নাশ, অপন্যাস, অপ-নাশÑ এসব। বক্তৃতায়, লেখায় কারণে-অকারণে তাঁরা প্রমাণ করতে চেয়েছেন- হুমায়ূনের উপন্যাসগুলো আদৌ কোনো উপন্যাসই না, বাঙালির বস্তাপচা আবেগে একটুখানি সুড়সুড়ি। উপন্যাসের শৈলীবিচারে এসব লেখা ভেসে যাবে। আর হ্যাঁ তাঁর লেখা পড়ে কারা? তরুণরা, কিশোর-কিশোরীরা। যারা সর্বদা আবেগে আপ্লুত থকে, তারাই হুমায়ূনের পাঠক। মোদ্দা কথা- কজন বয়স্ক মানুষ তাঁর পাঠক? হাতে গোনা দু’চারজন।
যাঁরা হুমায়ূনের লেখকজীবনকে বারবার হেঁয়ালিতে- উপহাসে- ঠাট্টায় ভরিয়ে তুলেছেন, দেখেছিÑ তাঁর মৃত্যুর পর দু’নয়নের জল বেশি ফেলেছেন তাঁরা। এটাকে কি কুমিরাশ্রু বলে? মৃত্যুর পর হুমায়ূন আহমেদকে যখন ঢাকায় আনা হলো, কফিন ধরে সেই ইনটেলেকচুয়াল লেখকদেরকেই বেশি হাহাকার-কান্নাকাটি করতে দেখেছি। পাক্কা অভিনেতা তাঁরা।
অনেকদূরে চলে এলাম। প্রসঙ্গে ফিরে যাই। স্টলের সামনের তক্তায় বিছানো অনেক বই, অনেকের বইয়ের মধ্যে হুমায়ূন আহমেদের কয়েকটি চিঠি ও একটি ডায়রিকে পড়ে থাকতে দেখলাম। বইটি অনেক উজ্জ্বল প্রচ্ছদের বইয়ের মধ্যে যেন শরমে সংকুচিত। তার গায়ে আবরণ আছে, আভরণ নেই। বিধবার বেশ। গোটা শরীরজুড়ে সাদা শাড়ি। সাদার মাঝখানে কালো কালো ছোপ। ধুতি জীর্ণ হলে যে-রকম হয়। বইটি তেমন পুষ্ট নয়। শরীরটাও তার বিপুলা নয়। চটিবই যাকে বলে, অনেকটা সেরকমই। প্রচ্ছদের অর্ধেকাংশ জুড়ে হুমায়ূন আহমেদের হাতে-লেখা একটা চিঠির কিয়দংশ। ‘মালা’ সম্বোধনে চিঠিটার শুরু। চিঠির মাঝখানে হুমায়ূন আহমেদের তারিখসংবলিত স্বাক্ষর। গ্রন্থনাম এবং চিঠির মধ্যখানে বড় সংকোচে লেখা লেখকের নাম- শাহানা কায়েস। নববধূ ঘোমটার মধ্যে যেরকম সংকোচে নিজেকে গুটিয়ে রাখে, শাহানা কায়েসের নামটিও সেরকম যেন অবগুণ্ঠিত।

বইটি হাতে তুলে নিয়েছিলাম। বলতে কোনোই দ্বিধা নেই যে, শাহানা কায়েসকে আমি চিনি না। তাঁর অন্যকোনো বই আমি পড়িনি। আলোচ্য বইটি ছাড়া শাহানা আর কোনো বই লিখেছেন কিনা, জানা নেই আমার। তাই শাহানায় আমার আকর্ষণ ছিল না, বইটি আমি হাতে নিয়েছিলাম হুমায়ূন আহমেদের টানে, তাঁর লেখা চিঠি পড়বার মোহে। বইটির দাম দেখে দোনামনা যে একটু করি নাই, বললে মিথ্যা বলা হবে। কিনব কি কিনব না- এরকম একটা দ্বিধা কাজ করেছিল আমার মধ্যে। শেষের দিক থেকে প্রথমের দিকে বাম-হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে ফড়ফড় করে একটা টান দিয়েছিলাম। নজর কেড়েছিল হুমায়ূন আহমেদের হস্তাক্ষরগুলো। আমি দ্বিধামুক্ত হয়েছিলাম।
হোটেলে একরাতেই পড়া হয়ে গিয়েছিল বইটি। ভালো লেগেছিল। সেই ভালো লাগাটা অন্য অন্য বইয়ের চাপে ফিকে হয়ে এসেছিল একদিন।
বইটি দ্বিতীয়বার পড়তে হলো আমাকে। শব্দঘর-এর সম্পাদক মোহিত কামাল বইটি আমাকে পাঠিয়ে ফোনে বললেন, ‘দাদা, বইটি নিয়ে লিখুন। যা মন চায়।’ ফোন ছাড়বার আগে খোঁচা দিলেন একটু ‘আপনারা তো আবার স্বল্পপরিচিতদের লেখা পড়েন না।।’
এই কথা বলবার অধিকার মোহিত কামাল রাখেন। তিনি আমার সুহৃদ। হুমায়ূন আহমেদের কয়েকটি চিঠি ও একটি ডায়রি দ্বিতীয়বার পড়লাম। আবেগ ঝেড়ে সমালোচকের দৃষ্টিতে। কোনো বই দ্বিতীয়বার পড়ার মজা আছে। গ্রন্থের ভেতরের খাঁজ-ভাঁজগুলো চোখে পড়ে। প্রথমবার দ্রুত পড়ার জন্য লেখকের বৈদগ্ধ্য, রসবোধ, গদ্যশৈলীর রম্যতা, এমনকি ত্রুটিগুলোও চোখ এড়িয়ে যায়। দ্বিতীয় তৃতীয় পাঠে তা ধরা পড়ে। শাহানার বইটা দ্বিতীয়বার পাঠে আমাকে উদ্বেলিত করেছে। প্যারিস রোড ধরে এক অপরাহ্নে হাঁটতে গিয়ে যে অপার বিস্ময় ও আনন্দে আমি আপ্লুত হয়েছিলাম, সেই রোড ধরে দ্বিতীয়বার হাঁটালেন আমাকে শাহানা। মনে হলো- শাহানা কায়েস ও হুমায়ূন আহমেদের পেছন পেছন আমিও হাঁটছিলাম। একজন পাঠককে লেখকের সঙ্গী করতে পারা মস্ত একটা গুণ। সেই লেখকগুণ শাহানার আছে।
এ-এক চিঠির বই, এ একজন কন্যার বালিকা থেকে নারী হয়ে ওঠার গ্রন্থ। ১৩/৯/১৯৮৪ [এর আগেও একটা চিঠি আছে। তারিখ নেই বলে উল্লেখ করতে পারলাম না] থেকে ১৭/৬/১৯৮৭ পর্যন্ত লেখা হুমায়ূন আহমেদের চিঠিগুলো এই বইতে সন্নিবেশিত হয়েছে। চিঠিগুলো আবেগে তপ্ত দ্বিধায় সংকুচিত। মনের গহিন গোপন বাসনার কথা হুমায়ূন এখানে আবরণে-সংকেতে লিখেছেন।
চিঠি মনের মধ্যে আকুলি-বিকুলি করা বাসনা প্রকাশের মোক্ষম মাধ্যম। দূর-স্থিত একজন মানুষকে চিঠির মাধ্যমে যেন ধরতে পারা যায়, ছুঁতে পারা যায়। লেখক চিঠির মাহাত্ম্য বোঝাবার জন্য শুরুতেই রবীন্দ্রনাথের ‘ছিন্নপত্র’ থেকে কিয়দংশ উপস্থাপন করেছেন :
‘পৃথিবীতে অনেক মহামূল্যবান উপহার আছে, তার মধ্যে সামান্য চিঠিখানি কম জিনিস নয়।… আমরা মানুষকে দেখে যতটা লাভ করি, তার সঙ্গে কথাবার্তা কয়ে যতটা লাভ করি, চিঠিপত্র দ্বারা তার চেয়ে আরো একটা বেশি কিছু পেয়ে থাকি।’
যথার্থই লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ। সেই বেশি কিছু পাওয়ার উপাদান-অনুষঙ্গ ছড়িয়ে আছে শাহানা কায়েসের বইটি জুড়ে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর যাত্রী নামের গ্রন্থে লিখেছেন :
‘চিঠি-পড়াটাই সৃষ্টির স্রোত, যে দিচ্ছে আর যে পাচ্ছে সেই দুজনের কথা এতে মিলেছে, সেই মিলনেই রূপের ঢেউ। সেই মিলনের জায়গাটা হচ্ছে বিচ্ছেদ। কেননা দূর-নিকটের ভেদ না ঘটলে স্রোত বয় না, চিঠি চলে না।’
চিঠির মধ্যে সাক্ষাতের আকাক্সক্ষা যেমন আছে, তেমনি বিচ্ছেদের আর্তনাদও আছে। আজ যাকে সর্বোত্তম আনন্দ বলে মনে হচ্ছে, কাল সে আনন্দে ম্লানতা আসে। মিলন বিরহে রূপান্তরিত হয়। বিরহের যন্ত্রণায় শেষ পর্যন্ত চিঠিই শেষ সম্বল হয়ে ওঠে। মাঝেমধ্যে মান-অভিমানের কথা শাহানার বইটিতে লেখা হলেও প্রায়-গোটা বইজুড়ে প্রাপ্তি আর দেখার শিহরন। কিন্তু শেষের দিকে এই শিহরন পূর্বের মতো থাকেনি। অপ্রাপ্তির আর বিচ্ছেদের বেদনায় থরহরি কেঁপেছে।
এই বইয়ের শেষ শিরোনামÑ ‘এইসব দিনরাত্রি’। ২৮১ শব্দের দেড় পৃষ্ঠার লেখা। বিচ্ছিন্নতার যন্ত্রণা, প্রচণ্ড অভিমান এবং অনেকটা ক্ষোভ এই ছোট্ট লেখাটি জুড়ে। শাহানা লিখেছেন :
‘’৮৭-র পর থেকে আস্তে আস্তে যোগাযোগ কমতে থাকে। ঢাকায় গেলে মাঝে মধ্যে দেখা হয়েছে। কখনো ডিপার্টমেন্টে, নিউ মার্কেটের বইয়ের দোকানে, বাংলা একাডেমীতে।…. আমরা আর কেউ চিঠি লিখে কথা বলি না।’
অভিমানের ব্যথার গুঞ্জরণ কি একটুখানি হলেও শোনা যাচ্ছে, এখানে? হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে শাহানা কায়েসের দূরত্ব সৃষ্টি হবার অন্য একটা কারণের উল্লেখ করেছেন লেখক। সেটাই মোক্ষম বলে মনে হয়েছে আমার।
শাহানা ( ৯৪ নম্বর পৃষ্ঠা) লিখেছেন :
“গুলতেকিন ভাবির সঙ্গে তাঁর (হুমায়ূন আহমেদ) বিচ্ছেদ মন থেকে মানতে পারিনি। তাঁর কাছ থেকে আমরা সুন্দর পারিবারিক জীবনের স্বপ্ন দেখতে শিখেছিলাম- জীবনে সমস্যা যতই আসুক, ভালোবাসা কখনো ফুরাবে না! তাঁর চোখ দিয়েই পরিবারকে, চারপাশের মানুষকে ভালোবাসতে শিখি। তাই তাঁর বিচ্ছেদ শুধু ‘ব্যক্তিগত বিষয়’ হয়ে থাকেনি আমাদের কাছে। বরং স্বপ্নভাঙার কষ্টে আমরা ভীষণভাবে জর্জরিত হই (হয়েছি)।”
এই অভিযোগ পাঠক হিসেবে আমারও। একজন সেলিব্রেটির চারপাশে কত প্রলোভন, কত ফাঁদ। সেই ফাঁদ সম্পর্কে সচেতন থাকতে হয়। স্ব-নামে ধন্য হয়ে যান যাঁরা। তাঁদের নিয়ে তো কত সাধারণ মানুষের স্বপ্ন-বাসনা। ওরকম মানুষরা যখন ভুল করেন, তখন ওই সাধারণ মানুষের আফসোস- হাহাকারের অন্ত থাকে না। আমাদেরও বেদনার অন্ত থাকেনি।
চিঠি প্রসঙ্গে আসা যাক আবার। চট্টগ্রামে একটা গান আছে :
‘অ পরানর তালতো ভাই-
চিডি দিলাম, পত্র দিলাম,
নো আইলা কীল্লাই।’
এই তিনটা লাইন লিখতে লিখতে আরেকটা গান আমার মধ্যে গুনগুনিয়ে উঠল :
‘আঙুল কাটিয়া কলম বানাইলাম
নয়নের জলে কইরলাম কালি…।’
বোঝা যাচ্ছে প্রেমিকের কাছে বেদনাতুর একজন প্রেমিকার চিঠিলেখার প্রস্তুতির বিবরণ।
মানুষের মধ্যে প্রিয় বা প্রিয়া সাক্ষতের হাহাকার যখন থেকে জমা হতে শুরু করেছে, তখন থেকেই চিঠিপত্র লেখার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। কবুতর, মেঘ, ঘোড়া, বাজপাখি চিঠি আদান-প্রদানের বাহক হিসেবে কাজ করেছে। পরে তো ডাকঘর-পিয়ন। কত নরনারী যে ডাক- পিয়নের পথ চেয়ে সকালে-দুপুর- অপরাহ্ন কাটিয়েছে, তার কোনো পরিসংখ্যান নেই আমাদের হাতে।
আজ এক মোবাইলের পর্দা সবকিছু গিলে খেয়েছে। আজকাল আমরা আদালতের সমন আর কোনো কোনো ক্ষেত্রে চাকরিতে যোগদান বা বরখাস্তের কাগজে পত্র ছাড়া আর কিছুই পাই না। আজ আমরা কোনো খ্যাতিমান মানুষের হাতে-লেখা চিঠি পাব না। পাব না সেলিনা হোসেন, আনিসুল হক, জাকির তালুকদার বা মামুন হুসাইনের হাতে-লেখা কোনো গল্প বা উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি। কোনো জাদুঘরে গেলে আমরা আজ রবীন্দ্রনাথ বা নজরুল অথবা সুকান্ত-জীবনানন্দের হস্তাক্ষর দেখতে পাই, ভবিষ্যতের জাদুঘরে বর্তমানের খ্যাতিমান লেখকদের পাণ্ডুলিপি আর দেখতে পাব না। শাহানা কায়েস আমাদের সেই ভবিষ্য-হাহাকারের কিছুটা অপনোদন করেছেন। চিঠি আর ডায়েরি মিলে হুমায়ূনের ৩০টি হাতে-লেখা লেখক তাঁর বইটিতে পত্রস্থ করেছেন। লেখাগুলোর ধরন (আমি প্রকৃতির কথা বলছি না, বলছি অক্ষরের আকৃতির কথা) এক এক চিঠিতে বা ডায়েরির পাতায় এক এক রকম হয়ে গেছে। এটা স্বাভাবিক। শান্ত মেজাজের লেখা এক রকম, ক্ষিপ্ত মেজাজের লেখা অন্যরকম। প্রেমাসাক্ত মেজাজের লেখা একরকম, বেদানার্ত মনের লেখা অন্যরকম। লেখক অলেখক- সবার ক্ষেত্রে এই নিয়মটা খাটে। শাহানার গ্রন্থভুক্ত হুমায়ূনের হস্তাক্ষরের ধরন-ভঙ্গি তারই উদাহরণ বহন করছে।
এই গ্রন্থের বড় পাওয়া হুমায়ূন আহমেদের স্বাক্ষরের নানা ধরন। সন্নিবেশিত স্বাক্ষরগুলো এক জায়গায় এনে পরখ করলে আমার কথার সমর্থন মিলবে। কোনটা তাড়াহুড়া বা অস্থির মনের, আবার কোনটা সৌম্য-শান্ত মানসিকতার, বোঝা যায়।
চিঠিতে ‘শাহানা’ বলে সম্বোধন করেননি কখনো। সবসময় ‘মালা’। ‘মালা’ নামটি হুমায়ূনকে বেশ আকৃষ্ট করেছিল। ‘১৯৭১’ নামের উপন্যাসে নায়িকার নাম দিয়েছিলেন- মালা। ৯/৬/১৯৮৫ তারিখের এক চিঠিতে হুমায়ূন লিখেছেন :
“১৯৭১ নামে একটা উপন্যাস লিখেছি, যার নায়িকার নাম ‘মালা’ হা হা হা।”
চিঠিগুলোতে সম্বোধনে রকমফের দেখা যায়। কোনোটিতে কল্যাণীয়াষু, কোনোটিতে আবার কল্যাণীয়াসু। নারীদের বেলায় বোধহয় ‘কল্যাণীয়াসু’, পুরুষদের ক্ষেত্রে কল্যাণীয়াষু। তাই কী?
এই বইটিতে বড় পাওয়া, সেটাই আমার মনে হয়েছে, শাহানা বা মালা নামের একজন বালিকা থেকে নারী হয়ে ওঠার ইতিবৃত্ত। যদিও অতি সংক্ষেপে। মহানন্দা নদী, জোছনার প্লাবন, আকাশের অগুণতি তারা, খড়ের গাদা, কুঠিঘর- এসবকে নতুন করে ছোঁয়ারÑ দেখার সুযোগ পেলাম। নানাবাড়ি, দাদাবাড়ি, মিতু, ফেরদৌসি, লিপি, পারুল আর ক্যামেলিয়ার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন লেখক। ক্যামেলিয়া নামের বান্ধবীটির জীবনকাহিনি তো আমাকে মথিত করেই ছেড়েছে। মালাকে ১৭টি গোলাপ দেওয়া সেই ক্যামেলিয়ার শাড়ির আঁচলে এখনও কি সংসারের চাবি ঝুলানো? বড় জানতে ইচ্ছে করে শাহানা।
লেখাটার লাগাম টানতেই হচ্ছে। কারণ শব্দঘর-এর পৃষ্ঠাসংখ্যা তো সীমিত। তবে লেখা থামানোর আগে দুটো কথা।
প্রথমটি : লেখাটা বড্ড সংক্ষিপ্ত। আরও বিস্তৃত হলে আমরা রাজশাহী ইউনিভার্সিটি, তার আশপাশের প্রকৃতি- মানুষ-বৃক্ষ-লতা-নদী-ফল-ফুল-পাখিÑ এসবের বহু মানোলোভা চিত্র আর বর্ণনা পেতাম। এতে আমাদের ফেলে আসা গ্রাম জীবন উজ্জীবিত হতো। কীভাবে বয়ঃকনিষ্ঠ আর বয়ঃজ্যেষ্ঠদের ভালোবাসা- শ্রদ্ধা জানাতে হয়, তাও শিখতে পারত অধুনাকালের পাঠকরা।
দ্বিতীয় অভিযোগ : হুমায়ূন আহমেদ ছাড়া এই গ্রন্থের চরিত্রদের পরিচিতি সংক্ষিপ্ত এবং অস্পষ্ট। লেখক বইটি শুরু করেছেন এভাবে-
‘আমার জন্ম পাবনায়। বাবা কমনওয়েলথ স্কলারশিপ নিয়ে লন্ডন থেকে পিএইচডি করে পাবনার নামকরা ঔষধ কোম্পানিতে তখন কর্মরত।’
লেখকের বাবার নাম কী- তাতো জানার কথা নয় সাধারণ পাঠকের। গোটা বইয়ের কোথাও কি তাঁর পিতৃনামের উল্লেখ আছে। তেমনি করে আমরা ‘আপু’কে চিনতে পারি না। দুলাভাই শাহরিয়ার কি আবু হাসান শাহরিয়ার? দোনামনায় থাকতে হয় আমাদের।
শেষে বলতে ইচ্ছে করে- আহা! কী অপূর্ব স্বাদের একটা বই! মালাকে লেখা চিঠিগুলো সন্নিবেশিত হলো, কেন মালার লেখা চিঠিগুলো সন্নিবেশিত হলো না! জানিÑ এ এক অর্বাচীন আবদার। হুমায়ূন আহমেদের হস্তগত মালার সেই চিঠিগুলো কোথায় যে, বইতে দেওয়া হবে? সেই চিঠিগুলোর কি মরণ হয়েছে? গুলতেকিন বা মেহের আফরোজ শাওনের হাতে? বেঁচে থাকলে কোথায় চিঠিগুলো?
এই রকম সহজ, হৃদয়-নিঙরানো লেখা আমি বহুদিন পড়িনি শাহানা। আপনি কি আরেকবার কলম ধরবেন? আমার জন্য, আমাদের মতো সহজিয়াদের জন্য? অন্যকোনো বিষয় নিয়ে?