আমাদের মুক্তিযুদ্ধ : আমাদের কবিতা : খালেদ হোসাইন

প্রচ্ছদ রচনা
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ : আমাদের কবিতা
খালেদ হোসাইন
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জীবন-বাস্তবতায় অভূতপূর্ব রূপান্তর নিয়ে এসেছে- বস্তু-পরিপার্শ্বে যেমন, তেমনই চেতনা-জগতে। জীবনের, অতএব শিল্পের প্রতিটি আঙ্গিকে এর চিহ্ন সমাকীর্ণ হয়ে আছে। কবিতায় তো অবশ্যই। সম্প্রসারিত অর্থে মুক্তিযুদ্ধের কবিতা লেখা শুরু হয়েছে দেশ-বিভাগের পর থেকেই। আর তা অব্যাহত আছে এবং থাকবে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কবিতা লেখেননি, এমন কবি বোধ করি খুঁজে পাওয়া যাবে না। কারণ, স্বাধীনতা, এই মহত্তম এ অর্জনটি সহজভাবে আসেনি- এসেছে ত্রিশ লক্ষ শহিদের রক্তের বিনিময়ে, দুই লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে, অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার পঙ্গুত্ব বরণের বিনিময়ে। দেশবাসী এমন এমন-সব দুঃসহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছে, যা ছিল অচিন্ত্যপূর্ব। পঁচিশে মার্চের দিবাগত রাত্রে ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ দিয়ে যার সূচনা তা আমাদের জন-জীবনকে পর্যুদস্ত করে তুলেছিল, দীর্ঘ নয় মাস। নিরীহ দেশবাসীর ওপর এমন মর্মান্তিক আক্রমণের কোনো নজির দেখেনি বিশ্ববাসীও। আর পাকিস্তানিদের অত্যাচারের শুরু তো দেশ-বিভাগের সঙ্গে সঙ্গেই। ভাষা আন্দোলনে আমরা আমাদের বীরত্বের পরিচয় দিয়েছি বুকের রক্তের বিনিময়ে মাতৃভাষার সম্মান রক্ষার মধ্য দিয়ে। ভাষা আন্দোলন তাই আমাদের সংগ্রামী চেতনার অনিঃশেষ অনুপ্রেরণা হয়ে আছে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি- জাতির ভবিষ্যতের রূপরেখা নির্মাণ করে দিয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানিদের অর্থনৈতিক শোষণ কেবল ভারসাম্যহীন ছিল না, যেকোনো বিবেচনায়ই তা ছিল বিবেকহীনও। ষাটের দশকের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা অগ্রসর হয়েছি স্বাধীনতার পথে। আমরা রবীন্দ্র-বর্জনের নিন্দনীয় ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করেছি, প্রতিরোধ করেছি নজরুলের সাহিত্যকে বিকৃত করার পরিকল্পনা। ১৯৬৬ সনের ছয়দফা আন্দোলন একটি স্বাধীন স্বদেশের মায়া-অঞ্জন এঁকে দিয়েছিল দেশবাসীর বুকে, আর ’৭০-এর নির্বাচন তাকে নিয়ে এসেছিল বাস্তবতার দ্বারপ্রান্তে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানিদের অপরাজনীতি নানা টালবাহানার মধ্য দিয়ে দেশে যে নৈরাশ্যকর অবস্থা সৃষ্টি করল, তা অসহনীয় ও অতুলনীয়। ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন, যার যা আছে তা-ই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করার জন্য তৈরি হলো দেশবাসী। ৭ই মার্চের সেই ভাষণ নিয়ে অসাধারণ একটি কবিতা লিখলেন নির্মলেন্দু গুণ, ‘স্বাধীনতা শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো’ :
একটি কবিতা লেখা হবে
তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে
লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে
ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে-
‘কখন আসবে কবি?’

মুক্তিযুদ্ধের কবিতার বিষয়টি এলে আমার মনে পড়ে শামসুর রাহমানের যুগল কবিতা ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা’ আর ‘স্বাধীনতা তুমি’। ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা’ কবিতাটির শুরুতে স্বাধীনতার জন্য কবি-হৃদয়ের যে হাহাকার, তা সমগ্রদেশবাসীরই, আর পরিসমাপ্তিতে যে নির্ভার নিশ্চয়তা, তা-ও তা-ই।
তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা
তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?
আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন?
…
পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জ্বলন্ত
ঘোষণার ধ্বনি প্রতিধ্বনি তুলে
নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগি¦দিক,
এই বাংলায়
তোমাকে আসতেই হবে, হে স্বাধীনতা। (তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা)
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কবিতা লিখেছেন তখন জসীমউদ্দীন কিংবা সুফিয়া কামালও। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিপন্ন ও বিপর্যস্ত বাংলাদেশের মুখচ্ছবি জসীমউদ্দীনের মনকে ভেঙে দিলেও শেষাবধি তিনি থাকেন আশাবাদেই উজ্জীবিত :
এ সোনার দেশে যতদিন রবে একটিও খানসেনা,
ততদিন তবে মোদের যাত্রা মুহূর্তে থামিবে না। মাঠগুলো পুনঃ ফসলে ফসলে পরিবে রঙিন বেশ,
লক্ষ্মীর ঝাঁপি গড়ায়ে ছড়ায়ে ভরিবে সকল দেশ।
মায়ের ছেলেরো হবে নির্ভয়, সুখ হাসিভরা ঘরে,
দস্যুবিহীন এ দেশ আবার শোভিবে সুষমা ভরে।
(মুক্তিযোদ্ধা)

অভিন্ন প্রত্যাশারই শব্দ-বাস্তবায়ন আমরা লক্ষ করি সুফিয়া কামালের কবিতায়, কাব্যভাষাকে অতিক্রম করে তাঁর অন্তরের বাণীই আমাদের কাছে মুখ্য হয়ে ওঠে :
পুঞ্জীভূত ঘৃণাধুম্র আকাশ আচ্ছন্ন করি জমে,
যেথা হতে দাবানল নামি আসি ক্রমে
অসুর শক্তিরে করি নাশ
আবার নতুন সূর্য পুবের আকাশ…
(উদাত্ত বাংলা)
কত মর্মন্তুদ ঘটনা, উপঘটনা পার হয়ে আমরা অর্জন করেছি এ স্বাধীনতা। স্বাভাবিক জীবন কী নিষ্ঠুরভাবেই না বিপর্যস্ত হয়েছে উপর্যুপরি। ২৭শে মার্চের একটি ভোরের খণ্ডচিত্রই হৃদয়কে কীভাবে মুচড়ে দিতে পারে তার নমুনা পাই শহীদ কাদরীর নিষিদ্ধ জার্নালে’র সূচনায় :
ভোরের আলো এসে পড়েছে ধ্বংস্তূপের ওপর।
রেস্তোরাঁ থেকে যে ছেলেটা রোজ
প্রাতঃরাশ সাজিয়ে দিত আমার টেবিলে
তে-রাস্তার মোড়ে তাকে দেখলাম শুয়ে আছে রক্তাপ্লুত শার্ট পরে।
জাতির দুর্বিষহ দুর্দিনে দেশের দামাল ছেলেরা মুক্তির এ যুদ্ধে অমিত বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়বে, এটাই স্বাভাবিক, কোনো পিছুটানই তাদের আটকাতে পারবে না। ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার অনেক উপরে দেশ-মাতৃকার প্রতি দায়বোধ। ঘরের কিশোর-তরুণ সন্তান মৃত্যুর পরোয়ানা হাতে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। দেশের কথা, দেশের মানুষের কথা ভেবে, স্বাধীনতার প্রতি অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণের তীব্রতায় সন্তানের সেই অনাকাক্সিক্ষত সম্ভাব্যতাকে মেনে নিয়েছেন বাবা-মা, ভাই-বোন। আবুল হোসেন সেই চালচিত্রই নির্মাণ করেন তাঁর কবিতায় :
তোমরা যেতে চাও, যাও। প্রশ্ন আর
করব না। চাইনে জানতে কিছু। যাবে যাও, যার
ইচ্ছে। বারণ করব না। কে শুনবে নিষেধ এখন?
(পুত্রদের প্রতি)

অনেক ত্যাগ-স্বীকার না-করলে স্বাধীনতার মতো বিশালায়তন মহার্ঘ ঐশ্বর্য অর্জন যায় না। এর মাহাত্ম্য বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। নানাজন নানাভাবে এর মর্মরস আস্বাদন করেন। আমরা দেখি, স্বাধীনতা এক মনোহর স্বপ্ন বাস্তবতা হয়ে দেখা দিয়েছে আহসান হাবীবের কবিতায় :
মানুষকে ডেকে ডেকে বলি, এস
স্বাধীনতা স্বাধীনতা বলে
আমরা সোচ্চার হয়ে আকাশকে সচকিত করে তুলি
আর হাওয়ায় ছড়াই কিছু নতুন গোলাপ,
দেখি জানালায় ঝুলে আছে নীলাকাশ
সামনের বাগানে
গোলাপ। বুকের মধ্যে
তুমি
মনোহর শব্দমালা।
(স্বাধীনতা)
আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি হয়ে উঠেছিল মানবমুক্তির বীজমন্ত্র। এই শব্দপুঞ্জ আমাদের অন্তরে তীব্র করে তুলেছিল সাহস ও শৌর্য, ঐতিহ্যের প্রতি আকর্ষণ আর প্রাকৃত এই বাংলা ভূখণ্ডের প্রতি ভালোবাসা। বেলাল চৌধুরীর কবিতায় প্রতিফলিত হয়েছে সেই চেতনা :
জয় বাংলা আছে একদিন চিরদিন দুর্জয় এক সাহসের নাম
জয় বাংলা আছে একদিন চিরদিন দুর্নিবার এক সংগ্রামের নাম
জয় বাংলা আছে একদিন চিরদিন আট কোটি কোকিলের সম্মিলিত ঐক্যতান
জয় বাংলা আছে একদিন চিরদিন কল্লোলিত সমুদ্রের উত্তাল গর্জন
জয় বাংলা আছে একদিন চিরদিন পদ্মা মেঘনা যমুনা ধরেশ্বরী কালবৈশাখীর আভাস
(একদিন চিরদিন জয় বাংলা)
আমাদের সমাজ-ইতিহাসের বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাক্রমকেই ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন কবি আহমদ রফিক। আমাদের ভাষা-আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর সক্রিয় সম্পর্কের কথাও আমাদের জানা। তাই তাঁর মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের চেহারা বা অন্তর্লোক পর্যবেক্ষণ তাৎপর্যময়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ‘চতুর সমাজ-নীতি স্বার্থবুদ্ধি লোভের বেসাতি’ ঘনীভূত বেদনা নিয়ে পর্যবেক্ষণ করে আহমদ রফিক। আহমদ রফিকের কবিতায় মুক্তিযুদ্ধকালীন স্বদেশের বাস্তবতা, যেন ‘রক্ত শব্দের ভয়াবহ ইতিহাস’ :
চতুর সমাজ-নীতি স্বার্থবুদ্ধি লোভের বেসাতি
নীরবে এগিয়ে যায় পাশব হত্যার
বীভৎস দৃশ্যের ছায়া পাশে ফেলে,
একচক্ষু হরিণের সোনালি মায়ায়
অতিদূর দিগন্তের দিকে,
অথচ শ্যামল ভূমি জনপদ বিষণ্ন শূন্যতা
কিমাকার ছায়া হয়ে দোলে-
শুধু নদী লিখে রাখে রক্ত শব্দের ভয়াবহ ইতিহাস
ক্ষেতে ও খামারে
শান্ত চর খড়োঘরে নগরে বন্দরে।
কিন্তু হুমায়ুন আজাদ রণক্ষেত্রের তারুণ্যকে, রক্ত-ক্ষতাক্ত বাস্তবতাকে স্বপ্নিল বাস্তবতায় উপলব্ধি করেছেন। শত্রুর আগ্নেয়াস্ত্রের চেয়ে শক্তিশালী যে মানবিক চেতনার বিস্ফোরণ, তা রবিজয় সম্ভাবনার অনিবার্যতা তাই বাক্সময় করে তুলেছেন তাঁর কবিতায় :
তোমার রাইফেল থেকে বেরিয়ে আসছে গোলাপ
তোমার মেশিনগানের ম্যাগজিনে ৪৫টি গোলাপের কুঁড়ি
তুমি ক্যামোফ্লেজ করলেই মরা ঝোপে ফোটে লাল ফুল বস্তুত দস্যুরা
অস্ত্রকে নয় গোলাপকেই ভয় পায় বেশি
তুমি পা রাখলেই অকস্মাৎ ধ্বংস হয় শত্রুর কংক্রিট বাংকার
তুমি ট্রিগারে আঙুল রাখতেই মায়াবীর মতো জাদুবলে
পতন হয় শত্রুর দুর্ভেদ্য ঘাঁটি ঢাকা নগরীর
(মুক্তিবাহিনীর জন্যে)
হেলাল হাফিজও রক্তময় যুদ্ধের প্রাঙ্গণে অবশ্য আগ্নেয়াস্ত্রকেই বন্ধুত্বে মর্যাদায় সমুন্ত করেছেন :
মারণাস্ত্র মনে রেখো ভালবাসা তোমার আমার।
নয় মাস বন্ধু বলে জেনেছি তোমাকে কেবল তোমাকে।
বিরোধী নিধন শেষে কতদিন অকারণে
তাঁবুর ভেতর ঢুকে দেখেছি তোমাকে, বারবার কতবার।
… … … … … ……
অথচ তোমাকে আজ সেই আমি কারাগারে
সমর্পণ করে, ফিরে যাচ্ছি ঘরে
মানুষকে ভালবাসা ভালবাসি বলে।
যদি কোনদিন আসে আবার দুর্দিন,
যেদিন ফুরাবে প্রেম অথবা হবে না প্রেম মানুষে মানুষে,Ñ
ভেঙে সেই কালো কারাগার
আবার প্রণয় হবে মারণাস্ত্র তোমার আমার।
(অস্ত্র সমর্পণ)
ভবিষ্যতের এক মমতাময় দেশবাসী ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধে, ছড়িয়ে পড়েছিল নানা জায়গায়, আশ্রয় গ্রহণ করেছিল দেশান্তরে, উদ্বাস্তু শিবিরে। প্রণয়ও তখন গ্রহণ করেছিল অচেনা এক অবয়ব। বহুদিন পরে উদ্বাস্তু শিবিরে প্রেমিকার সঙ্গে দেখা হওয়ার অনুভূতি অভিব্যক্ত হয়েছে মুজিবুল হক কবীরের কবিতায় :
তোমার আমার এই উষ্ণ দীর্ঘশ্বাস,
কতো তুচ্ছ; হৃদয়ের লেনদেন সব
ভুলে গেছি, এই বুকে এখন জমেছে
ক্লেদ, ঘৃণা, বিবমিষা, ভালোই হয়েছে
বহুদিন পর দেখা উদ্বাস্তু শিবিরে।
(উদ্বাস্তু শিবিরে)
শোষণে-অপমানে জর্জরিত দেশের ম্লান মুখচ্ছবি কবিহৃদয়কে বেদনা-ভারাতুর করে তোলে। তাই অপরিমেয় মূল্যে অর্জিত স্বাধীনতা হাসান হাফিজুর রহমানের কবিতায় এসেছে দুঃখ ভোলানিয়া গান হয়ে :
এবার মোছাব তোমার মুখ আপন পতাকায়।
হাজার বছরের বেদনা থেকে জন্ম নিল
রক্তিম সূর্যের অধিকারী যে শ্যামকান্ত ফুল
নিঃশঙ্ক হাওয়ায় আজ ওড়ে, দুঃখভোলানিয়া গান গায়।
মোছাব তোমার মুখ আজ সেই গাঢ় পতাকায়।
(তোমার আপন পতাকা)
পরাধীনতার গ্লানিমুক্ত দেশের সন্তান হতে পারার আনন্দ অনিঃশেষ। হাবীবুল্লাহ সিরাজী যুদ্ধের বীভৎস স্মৃতি সাঁতরে স্বাধীন স্বদেশের সেই আনন্দকেই ব্যক্ত করেন তাঁর কবিতায় :
পৌষ শুধু পৌষ নয়, এ মাস ঘ্রাণের
এ মাস নিজের কাছে নিজের ফেরা
পিঁপড়েও ফিরেছে ঘরে, প্রিয় ঘাসের পিঠে বসে
ঘৃণাভরে দেখেছে রক্তাক্ত বুট আর অস্ত্রের ধার
সমর্পণের কি লজ্জা- থু!
মার্চ থেকে ডিসেম্বর
দীর্ঘ এক নদী হ’য়ে,উদার আকাশ হ’য়ে
রেসকোর্সের মাটি ছুঁয়ে বলে :
এ দেশ আমার!
(প্রিয় স্বাধীনতা)
স্বাধীনতা প্রসারিত এক ভুবন এনে দেয় সিকদার আমিনুল হককে, ‘কোন এক দগ্ধ দিনে’ও তাঁর মনে হয় :
স্বাধীনতা, আমার মাতৃভাষা ছাড়া কোনদিন
বিমুগ্ধ ইন্দ্রিয় জেগে ওঠে না। এমন যে নির্দোষ চুম্বন, তারও আগে আমি চাই কণ্ঠস্বর :
স্বাধীনতা আমি বাউলের গান চাই, চাই
বিসমিল্লাহ্-র সানাই আর নৈশ কীর্তনের নানা রঙ
হতাশাকে….
বিজয় ছিল আমাদের অনিবার্য। অযুত-নিযুত প্রাণের বিনিময়ে হলেও, সময়পর্ব প্রলম্বিত হতে পারত কিন্তু অনন্ত তো নিশ্চয় হতো না। বিজয়ের এ অবশ্যম্ভাবিতার রূপায়নও ঘটেছে কামাল চৌধুরীর কবিতায় :
তোদের অসুর নৃত্য… ঠাঠা হাসি… ফিরিয়ে দিয়েছি
তোদের রক্তাক্ত হাত মুচড়ে দিয়েছি নয় মাসে
চির কবিতার দেশ… ভেবেছিল অস্ত্রে মাত হবে
বাঙালি অনার্য জাতি, খর্বদেহ… ভাত খায়, ভীতু
কিন্তু কী ঘটল শেষে? কে দেখাল মহাপ্রতিরোধ
অ আ ক খ বর্ণমালা পথে পথে তেপান্তরে ঘুরে
উদ্বাস্তু আশ্রয়হীন… পোড়াগ্রাম… মাতৃ অপমানে
কার রক্ত ছুঁয়ে শেষে হয়ে গেল ঘৃণার কার্তুজ।
(সাহসী জননী বাংলা)

মুক্তিযুদ্ধে হারিয়েছি আমরা অনেক। স্বাধীন স্বদেশে আমাদের স্বাচ্ছন্দ্যময় চলাচলের জন্য যারা জীবন দিয়েছে, তারা দৃশ্যের আড়ালে গেলেও মনের আড়ালে চলে যেতে পারে না। তারা মিশে আছে আমাদের জীবন-যাপনের আনন্দ-বেদনায়, রক্তরাঙা জাতীয় পতাকায়। আবুল হাসান তাঁর ‘উচ্চারণগুলি শোকের’ কবিতায় এঁকে রেখেছেন সেই মর্ম-বাস্তবতা :
অনেক যুদ্ধ গেল
অনেক রক্ত গেল
শিমুল তুলোর মতো সোনা-রুপো ছড়াল বাতাস।
ছোট ভাইটিকে আমি কোথাও দেখি না,
নরম নোলক পরা বোনটিকে আজ আর কোথাও দেখি না।
কেবল পতাকা দেখি
কেবল পতাকা দেখি
স্বাধীনতা দেখি!
স্বাধীনতা অর্জন কঠিন। তারচেয়ে কঠিন তাকে রক্ষা করা। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বারবার হুমকির মুখে পড়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, রুদ্্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ তখন পেয়েছেন, ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’:
আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই
আজো আমি মাটিতে মৃত্যুর নগ্ন নৃত্য দেখি,
ধর্ষিতার কাতর চিৎকার শুনি আজো আমি তন্দ্রার ভেতরে-
এদেশ কি ভুলে গেছে সেই দুঃস্বপ্নের রাত, সেই রক্তাক্ত সময়?
না, ভুলে যায়নি সেই দুঃস্বপ্নের রাত, সেই রক্তাক্ত সময়। স্বাধীনতার ৪২ বছর পরেও তাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আর সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে তারুণ্যের স্পর্ধিত গর্জনে কেঁপে ওঠে কেবল ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল নয়, সারা বিশ্ব, পুনর্বার সচকিত হয় এদেশের মানুষ আর সংগ্রামী চেতনায় সৃষ্টি করতে থাকে কবিতার পর কবিতাÑমুক্তিযুদ্ধের কবিতা।