কবিতা


নাসির আহমেদ
গোধূলিবেলার সৈকতে
খণ্ড খণ্ড ভাঙাকাচ পড়ে আছে সমুদ্রসৈকতে ঝিকিমিকি
গোধূলির সোনারং ঝলমল করছে ওই জলের ওপর
শাদা কাচের খণ্ডগুলো জুড়ে- তুমি বলবে শিল্প বটে
যেন দক্ষশিল্পীর ইজেল ছড়িয়ে আছে গোধূলিবেলার সৈকতে!
আমি এই জলজ ধূসর নীল সমুদ্রের কাছে এসে
যখন দাঁড়াই, তখন আমার চোখে পড়ে না শিল্পের
কোনো ছায়া; বরং ক্রন্দনরত সমুদ্রের মর্মলোক থেকে
আমার ভেতরে দ্রুত সংক্রমিত হয় জীবনের গোপন গোঙানি।
এই হু হু কল্লোলের মধ্যে আমি শুনি লালনের
অধ্যাত্ম বেদনাময় বিরহসঙ্গীত আর সহস্র বছরব্যাপী
মানুষের স্বরচিত নিঃসঙ্গতার ভয়াবহ অন্তহীন নির্জনতার গান
অনন্ত নীরবতার কুয়াশায় অকস্মাৎ ভিজে ওঠে মন।
সন্ধ্যার সমুদ্রে ক্রমে রহস্যময়তা দানা বাঁধে, শিল্পী তুমি সেই
রহস্যময়তা নিয়ে ছবি এঁকে হয়তো-বা পুরস্কৃত হবে, আমি এই
আধো-অন্ধকারে নান্দনিকতার কোনো দৃশ্য সাজাতে পারি না
বরং আমার অনুভূতিময় জমা হয় পলিহীনতার নোনাবোধ।
সমুদ্রের নিঃসঙ্গতা এবং নির্জনতা হাজার বছর ধরে এই পৃথিবীতে
মানুষেরই মর্মজ্বালা রচনা করছে নানা ধ্বনিতে, প্রতীকে।

মাহমুদ কামাল
ডিমের কুসুম থেকে
ডিমের কুসুম থেকে উঁকি দেয়া চাঁদের মতোই
প্রথম প্রকাশ…
যতটা আড়াল ছিল ততটাই আলো আর আলো
প্রথম সকাল…
প্রতিদিন জন্মদিন প্রতিদিন লবঙ্গলতিকা
যেন লাউডগা…
চাঁদের শরীর থেকে আলো নিয়ে সৌন্দর্যের দ্যুতি
ভরা বরষায়…
শরীরে ঋতুর যুদ্ধ ষড়ঋতু রিপুর দহনে
স্রোত জেগে ওঠে…
ডিমের কুসুম থেকে উঁকি দেয়া সেই চাঁদমুখ
হৃদয়ে শরীরে…

গোলাম কিবরিয়া পিনু
জলপাইয়ের তেল
জলপাইয়ের তেল মেখে- আমিও আমার শুষ্ক
ত্বক মসৃণ রাখি, এখনো কোনো টিউব
খুলে ক্রিম মাখার অভ্যাস হয়নি, আর
অভ্যাস হয়নি বলেই ছোট ছোট ভূখণ্ডের
শাসনকর্তা- নিজেদের নেপোলিয়ন ভাবে
যারা, ক্ষমতার অ্যালুমিনিয়াম নিয়ে ঘর তৈরি
করে আছে যারা, তাদের মুখে তেলসিক্ত
স্যান্ডউইচ তুলে দিতে পারছি না, পারব না
বলেই তেলের কৌটা হাতে নেই, অতিরিক্ত
তেলও নেই!

শাহীন ভূঁঞা
শরতের রাত
কী সুন্দর এই রাত যেন স্নিগ্ধ মায়াবী জ্যোৎস্নার
কুমারী চাদরে ঢাকা পড়ে আছে আমার আবাস;
কাশফুল চারদিক, চোখে ছায়া যেন পড়ে কার,
বাসনার বক্ষমাঝে প্রণয়ের তৃষ্ণার্ত প্রকাশ।
দখিনা জানালা খুলে দেখি শিউলি ফোটা বাগান
সুপ্রসন্ন হাসি হেসে ফুটে আছে সহস্র সম্ভার;
যেন আজ বাজে মনে সুমধুর কোনো প্রিয় গান
সেতারের তারে তারে প্রায়াসন্ন শব্দের ঝংকার।
স্নিগ্ধতার পূর্ণতায় কেটে যায় এ জ্যোৎস্নার রাত,
শিশিরের ফোটা ঝরে সুডৌল সবুজ দূর্বাঘাসে;
হৃদয়ের অন্ধকার ভেঙে ফেলে নীলাম্বরী চাঁদ
ছড়াল নাচের মুদ্রা ব্যাকুল বাসনার বাতাসে।
যৌবন উঠল জ্বলে এই নিমীলিত দুই চোখে,
বক্ষের ভেতর বাজে বিশুদ্ধ বাতাসের নূপুর;
স্বর্গ থেকে নেমে এলো প্রেমের দেবতা হাসিমুখে
কামনার শিহরণে বাজায় মনে সিম্ফনি সুর।

মনসুর হেলাল
বিব্র্রত আঁধার
বিদায় বিদায় বলে, প্রস্থানে উদ্যত যতই পা
না, না চিৎকারে ততই উঠছে মেতে
পাত্র সভাসদ।
নিঃসংকোচ প্রকাশে যতই বলি
আর নয়, আর নয়
ততই উঠছে ফুঁসে পথের দ্রাঘিমা।
ধীর লয়ে উঠে আসে অব্যর্থ পীড়ন
কেউ গতি রোধ করে
কেউবা খামচে ধরে সমূহ বসন।
মঞ্চের পর্দা নেমে আসলেই
কুশীলবরা ছুটে যাবে যে যার গন্তব্যে।
বিব্রত আঁধারে ছেয়ে যাবে প্রতিটি আসন
মিলনায়তন জুড়ে শুরু হবে লোকশূন্য
শোকের মচ্ছব। বন্ধ হবে তার প্রতিটি দুয়ার
তীব্র হুইসেলে দ্রুত বিদায়ের তাড়া দেবে
বয়স্ক প্রহরী।
নিঃসঙ্গ আক্রোশে যতই বলি না, না
স্থিতিস্থাপকের বাহুল্যতা ছুঁবে না তোমাকে
গমনাগমন নির্ধারিত;
তোমাকে যেতেই হবে।

ভাগ্যধন বড়ুয়া
নিঝুম সন্ধ্যায়
সূর্য ফেরার পথে আলোটা দু’হাত বাড়িয়ে প্রসারিত করে দেয়, মোলাকাত সেরে নেয় বৃক্ষ, বুড়োপ্রাসাদ, মসজিদ মিনার,নদীর তীর আর সমুদ্রচরের ঝাউয়ের সঙ্গে। পশ্চিমে মুখ করে সূর্যের তাড়া দেখে অনেকেই আলোরেখা ধরে ঘরে ফেরে, কেউ যায় পূর্বে কেউ বা বিপরীতে, গতিপথে যদি আঁধার নামে তবে মুসাফির হবে রাত প্রভাতের অপেক্ষায়!
এ বেলা ও বেলা করে একটা দিন কিংবা ঠিক-বেঠিক সংশয়ে পাঁজরে বোনা একটি স্বপ্ন যুক্ত হতে থাকে সূর্যগোলকের চারপাশে আর সব নিয়ে আজকের মতো সমাপ্তি ঘোষণা করে কালের গোলক!
আমিও ঢোলক হয়ে বোল তুলি নিঝুম সন্ধ্যায়…

পিয়াস মজিদ
জীবনবাদাম
ঘণ্টাফুল থেকে ঝরে পড়ে
আলোর সময়।
আর তুমি মরমি মঞ্জিলে বসে
দ্যাখে থাকো
রক্তমাংসের কতটা রঞ্জন
বিচ্ছুরিত হয় দূরের দরোজায়।
যেখানে মরণময়ূর থাকে,
সাথে নিয়ে পরমপেখম।
এই মানুষজনমে
পরিদের যৌন অভিজ্ঞান আহরণের
আনন্দ-আর্তিতে
ঊন থেকে হই
ক্রমশ সম্পন্ন।
প্রজাপ্রোজ্জ্বল জীবনে
রাজভোজসভায়
যখন উপচার থাকে
শুধু আনন্দবাদাম।
আমাদের উদ্ধার ও বিনষ্টি
খেতে না পারা
সেই বাদামের খোসায়;
যেখানে
মহা ও মুহূর্তের অলীক সংরাগ।
ক্ষুধাখাদ্যের আভায়
এইমতো চলেছে জীবন-যুযুধান।

মিছিল খন্দকার
আমি যে তখন কাকে
একদিন মোজোর বোতলে মদ ভরে নিয়ে বেরিয়ে পড়ব, না ফেরার তরে।
কিছুদূর অতিক্রমের পর মনে হবে, যে কোনো যাওয়াই মূলত ফেলে যাওয়ার
বেদনাবোধ বহন করে সাথে। পথে সন্ধ্যা আসবে রাতের পূর্বাভাস নিয়ে। কোনো
নামহীন নদীর পাড়ে, ঝাউ বা কেওয়ার বনে আবহমান জোনাকিরা একই রকমভাবে
জ্বলবে নিভবে জ্বলবে নিভবে জ্বলবে।
চরাচরের শব্দহীনতাকে সন্দেহজনক মনে হলে, অস্থিরতা আরও চাপা হয়ে অস্থির
হয়ে ধরা দেবে। বৃষ্টি আসবে ধেয়ে, চরাচর শূন্য শূন্য শূন্য করে দিয়ে। বর্ষার
চাঞ্চল্যে পাশের পুকুরে, কোলায়, নদীতে পানির ফুর্তি দেখে দেখে দেখেÑ আমি
যে তখন কাকে ঘুম থেকে টেনে তুলতে চাইব গিয়ে ডেকে!

আতিকুর রহমান হিমু
নির্জন কোলাহল
মুমূর্ষু সন্ধ্যারা পাঠ করে রৌদ্রের রঙÑ
পাখি জন্মের ডানা নিভে গেলে
মৃত্যুর ঘ্রাণে মনোযোগী হয় জীবন;
এভাবেই দৃশ্যের ভিতর দৃশ্যায়ন হয় আত্মা
অসুখ সমেত হাসপাতাল।
বিষণ্ন ভায়োলিনের সুরে শরীর নত হয়
বিমূর্ত অন্ধকার আঁকে পূর্ণদৈর্ঘ্য জীবন।

মাহমুদ নোমান
জ্বরে কারও হাত লাগে
কয়েকদিন যাবত ভীষণ জ্বর
তোমার অনেক গোপন নামে
চোখের তারায় ফুটতে থাকা
এক আকাশ দীর্ঘশ্বাসে,
ভাঙা সাঁকোয় থমকে দাঁড়াইÑ
অংকের খাতায় টিকটিকির লেজ,
দূরের পাড়ায় নোওকা ভিড়ে
ঘোলাজলে ভেসে আসে-
মেক্সিপরা রমণীর কোলে
তড়পড়ানো বাতাস খেলে,
গায়তে বলে প্রাচীন সুরে…

জারিফ এ আলম
একটি মেয়ে ও বাজপাখির গল্প
নিজস্ব অনুবাদে রোদ চেটে খায় ছায়ার শরীর,
তপ্ত মাটির বুক ভেদ করে উঠে আসে বাজপাখি।
মেয়েটি এখন নিজের কথা বলে একটানা
উদ্বেগের ইশারা বোঝ না; চোখে লেগে থাকে
পরপুরুষের ভয়! সম্পর্কের বিশ্বাস নিয়ে তাই
মেয়েটির যত দাবি-দাওয়া।
মুছে যাওয়া স্মৃতি। ঘরে ফেরার তাড়া। বিচিত্র ঘোর!
দিকশূন্য এই সময় ব্যক্তিগত সঞ্চয়ে
কখনও মলিন মুখের দিকে চেয়ে, আলো-হাওয়াতে
হৃদয়ের নির্জন কোনো কোলাহলে নিজেকে খুঁজে পায়,
উজানে তখন না ফেরার প্রবণতা, পিপাসায়
কণ্ঠ যখন শুকিয়ে গেছে আজ; যখন মগ্ন হয়ে
আকাশ দেখার শখ; তখন নিঝুম কোলাহলে
মেয়েটি খেয়ে ফেলে সকল ক্ষতিকারক।
সেই বাজপাখি প্রতিযোগী এখন দুরন্ত গতির,
কিন্তু, মেয়েটি গতি ফিরে পায় না আর
কোথায় উৎস তার সমূহ ক্ষতির!