কবিতায় উপদেশ, উপদেশের কবিতা : মোরশেদ শফিউল হাসান

প্রচ্ছদ রচনা : সেরা ১২ বইয়ের ডালি
কবিতায় উপদেশ, উপদেশের কবিতা
মোরশেদ শফিউল হাসান

শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ তৈরি করা। সরলভাবে বললে চরিত্র গঠন করা। ছোটবেলায়ই গৃহে বাবা-মা বা অন্য অভিভাবক ও গুরুজন এবং বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের সদুপদেশ দ্বারা খানিকটা এবং বাকি পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে সাধারণত এই কাজটি সম্পন্ন হয়। যুগ ও সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মূল্যচেতনায় কিছুটা পরিবর্তন আসতে পারে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির আলোকে তার পুনর্বিচার ও মূল্যায়নেরও প্রয়োজন দেখা দেয়। সমাজের প্রচলিত ধ্যানধারণার মতো পুরনো প্রতিষ্ঠিত কিছু মূল্যবোধেরও পরিবর্তন হয়তো সেক্ষেত্রে বাঞ্ছনীয় হয়ে পড়ে। কিন্তু তার পরও বেশকিছু বিশ্বাস বা মূল্যবোধ আছে যার গুরুত্ব ও আবেদন শাশ্বত, সর্বজনীন। সবকালে সব সমাজেই যার চর্চা অত্যাবশ্যক। আর একেবারে শিশু বয়সেই মানবমনে যার বীজ বপন করতে হয়। ধর্ম এই মূল্যবোধের একটি বড় উৎস নিঃসন্দেহে। কিন্তু ধর্মের সবটাই যেমন মূল্যবোধ নয়, তেমনি ধর্মশিক্ষার পথেই যে কেবল মানব মনে মূল্যবোধের ধারণা সঞ্চার হয় তাও নয়। সাহিত্য-সংস্কৃতিও এক্ষেত্রে একটা বড় ভূমিকা পালন করে। প্রাচীনকাল থেকেই সব জাতি বা জনগোষ্ঠীর পুরাণ, লোককাহিনী, আখ্যান বা গাথাকাব্য, ছড়া, রূপকথা, ব্রতকথা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে নীতিশিক্ষা বা উপদেশের মতো করে মূল্যবোধ প্রচারের এই কাজটি করে আসা হচ্ছে। কখনও তা করা হয় সরাসরি বা খুব স্পষ্টভাবে আবার কখনও হয়তো খানিকটা প্রচ্ছন্নভাবে।
এক সময় আমাদের পাঠ্যপুস্তকগুলোতে নীতিশিক্ষা বা উপদেশমূলক পদ্য ও গদ্যরচনা একটা উল্লেখযোগ্য স্থান জুড়ে থাকত। এভাবেই আমরা আমাদের বালকবয়সে মদনমোহন তর্কালঙ্কার, কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার, কুসুমকুমারী দাশ, শেখ ফজলল করীম প্রমুখ অনেকের রচনার সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। সত্যেন দত্তের অনুবাদে পড়েছি শেখ সাদীর কবিতাও। আমাদের চেতনা বিকাশ ও মূল্যবোধ গঠনে যার প্রভাব এখনও অনুভূত হয়। কিন্তু সাম্প্রতিককালে আধুনিক বা যুগোপযোগী শিক্ষা প্রবর্তনের নামে, তথাকথিত বাস্তব জীবনমুখি বা কর্মোপযোগী শিক্ষাক্রম চালুর কথা বলে আমরা শুধু যে আমাদের পাঠ্যপুস্তকগুলোকে অনাকর্ষণীয় ও আনন্দহীন করে তুলছি তাই নয়, পাঠ্যপুস্তক খেকে মূল্যবোধসঞ্চারী রচনাগুলোকেও কোণঠাসা করতে করতে একেবারে নির্বাসনে পাঠাবার আয়োজন সম্পন্ন করে এনেছি। আজকের দিনে ইংরেজি মাধ্যম বা মাদ্রাসায় পড়া একটি বালক বা বালিকার তো বটেই, এমন কি দেশের সাধারণ বা মূলধারার শিক্ষার্থীর সঙ্গেও ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি’, ‘পারিব না এ কথাটি বলিও না আর’, কিংবা ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে’র মতো রচনার পরিচয় ঘটার সুযোগ নেই
বললেই চলে। সভা-সেমিনার-বক্তৃতা মঞ্চে দাঁড়িয়ে আজ যখন আমরা মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কথা বলি, সমাজ-রাষ্ট্রের অনেক সমস্যা-সংকট-বিপর্যয়ের জন্য মূল্যবোধের এই অবক্ষয়কেই দায়ী করি, তখন কি আমাদের শিক্ষার এই ঘাটতির দিকটি আমাদের চোখে পড়ে? শিক্ষাব্যবস্থার এই ঘাটতি পূরণ করতে পারত যে বিকল্প ক্ষেত্রগুলো তাও আমাদের কোনো আশার আলো দেখায় না। শিশু-কিশোরদের জন্য তেমন ভালো পত্রিকা আজ দেশে নেই। যাও বা আছে তারাও দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিকদের চরিত্র গঠন বা তাদের মধ্যে নীতিবোধ বা মূল্যচেতনা সঞ্চারের কর্তব্যটিকে হয়তো প্রয়োজনীয় মনে করে না। এ অবস্থায় স্রোতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে একজন-দুজন লেখকের কেবল আপন কব্জির জোরকে সম্বল করে এবং শুভ ও কল্যাণবোধ তাড়িত হয়ে কিছু করার চেষ্টা নিশ্চয়ই অভিনন্দনযোগ্য।
আখতার হুসেন আমাদের একজন অগ্রণী শিশুসাহিত্যিক। দীর্ঘ পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি সংগঠক হিসেবে (এক সময় জাতীয় শিশু-কিশোর সংগঠন ‘খেলাঘর’-এর সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন তিনি) এবং আপন লেখালেখির মাধ্যমে এদেশের শিশু-কিশোরদের মনন বিকাশে তাঁর ভূমিকা রেখে আসছেন। শুধু ছোটদের আনন্দদানই নয়, তাদের মূল্যবোধসম্পন্ন এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও একজন লেখক হিসেবে তিনি তাঁর দায়িত্ব এড়িয়ে যাননি। এখানেই আমাদের অন্য অনেক শিশুসাহিত্যিকের সঙ্গে তাঁর পার্থক্য। ইতিপূর্বে তাঁর সম্পাদনায়ই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত হয় বাংলা সাহিত্যের সেরা উপদেশমূলক কবিতা সংকলন-পুস্তকটি। যাতে ঈশ্বরগুপ্ত থেকে সাম্প্রতিককাল অবধি পঁয়ত্রিশজনের মতো কবির নীতিকথাধর্মী বা উপদেশমূলক কবিতা সংকলিত হয়েছে। তারপর সেই একই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তাঁর নিজের লেখা উপদেশমূলক কবিতার সংকলন সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি। দীর্ঘ দু-যুগ ধরে লেখা অর্ধ শতের মতো ছোটো-বড়ো কবিতা এতে সংকলিত হয়েছে। এই কবিতাগুলোর মধ্য দিয়ে আখতার হুসেন বাংলা কবিতার একটি লুপ্তপ্রায় ধারার পুনরুজ্জীবনই কেবল ঘটালেন না, সে-ধারার উত্তর প্রজন্মের একজন বলবন্ত প্রতিনিধি হিসেবেও নিজেকে তুলে ধরেছেন।
আখতার হুসেনের ক্ষীণকায় কবিতা সংকলনটি শুরুই হয়েছে ছোট্ট এই কবিতাটি দিয়ে : ‘হোক না সে বই ক্ষুদ্র যতই/ক্ষীণ কলেবর,/থাকে যদি সার ছোট সে আধার/বিশাল সাগর।’ (‘হোক না সে বই’)। কিংবা আরেকটি ছোট কবিতা : ‘যে-গুরু বলেন, আমি যা-ই বলি/চরম সত্য তা-ই,/প্রশ্ন কোরো না, আমার ওপরে/কোনো কথা আর নাই!/তেমন গুরুরা তোমাকে কেবল/পুতুল বানাতে চায়,/পুতুল না হলে গুরুগিরি তার/টিকে থাকা বড় দায়।’ (‘পুতুল না হলে’) সংকলনভুক্ত ছোট ও বড় নিটোল সুন্দর কবিতাগুলোর প্রতিটিই আলাদাভাবে আমাদের মনোযোগ দাবি করে। উদ্ধৃতি দিতে গিয়েও কোনটাকে বাদ দিয়ে কোনটির কথা বলব, ঠিক করা মুশকিল। আখতার হুসেনের রচনার সঙ্গে যাঁদের পরিচয় আছে তাঁরা জানেন, গভীর কথাকে সহজ-সুন্দর করে বলার ক্ষমতা তাঁর করায়ত্ত। এই সংকলনের কবিতাগুলোয়ও সে নৈপুণ্যের প্রকাশ ঘটেছে। সংকলনে এমন দু-চারটি কবিতা আছে যার মূল ভাব বা বিষয়বস্তু তিনি কোনো মহাগ্রন্থ বা মনীষীবাক্য থেকে গ্রহণ করেছেন (যথাস্থানে তার স্বীকৃতিও দিয়েছেন)। কিন্তু রচনা হিসেবে সেগুলোও মৌলিকতায় ভাস্বর। যেমন বাইবেলের বাণী অনুসরণে লেখা : ‘শুয়ে-বসে কাটে যার রাত আর দিন/হাতে আর কাজ আছে, তবু কাজহীন/দারিদ্র্য তার দিকে দ্রুত অবিরত/ ধেয়ে আসে ঠিক যেন দস্যুর মতো।’ (‘দারিদ্র্য তার দিকে’) কিংবা চাণক্য শ্লোক অবলম্বনে : ‘যারা যত বেশি জ্ঞান আহরণ করে/যত বেশি করে দান,/জ্ঞানী তো তারাই, প্রকৃতই জ্ঞানী/তত বেশি মহীয়ান।/জ্ঞান আহরণ করে করে যারা নিজ ভাণ্ডার ভরে,/অন্যকে দান করে নাকো যারা;/কৃপণের মতো মরে।’ (‘জ্ঞানী তো তারাই’)
প্রধানত কিশোর বা তরুণদের জন্য লেখা হলেও, এই সংকলনের এমন অনেক কবিতাই আছে পরিণত মননের কাছেই যার আবেদন হবে সমধিক। মাত্র চার লাইনের কবিতা : ‘দেহে বড় নয় সাড়ে তিন হাত/তবুও মানুষ শক্তিতে সেরা,/এর মূলে তার ভাবনার ধার/যার কাছে হার মানে দানবেরা।’ (‘তবুও মানুষ’) কিংবা ‘কেন?- এই জিজ্ঞাসা যত ছোট হোক/ অন্ধ-আঁধারে জ্বলে জ্ঞানের আলোক।/এই ছোট জিজ্ঞাসা জেগে থাকে বলে/মানুষ তো গতিমান, সম্মুখে চলে।’ (‘কেন?’) -বলা কি যাবে এগুলো শুধু কিশোরদের জন্য লেখা? বাণী বা সাহিত্যমূল্য কোনদিক দিয়ে আমরা এ রচনাগুলোকে উপেক্ষা করতে পারি? উপদেশ বা নীতিকথার ব্যাপারে যাঁদের স্বভাববিরূপতা আছে তাঁদেরও হয়তো কিছু মানবিক বোধ ও জিজ্ঞাসার সামনে দাঁড় করাবে এই কবিতা-সংকলনটি। বইটির গোড়ায় আমাদের দেশের আরেকজন বিশিষ্ট শিশুসাহিত্যিক (সদ্যপ্রয়াত) সুবলকুমার বণিকের লেখা একটি নাতিদীর্ঘ ভূমিকা সংযোজিত হয়েছে, যাতে তিনি যথার্থই মন্তব্য করেছেন- ‘ভালো হয়ে ওঠার এই প্রতিজ্ঞার কথা এ যুগে এরকম উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করার জন্য একজন কবি প্রস্তুত রয়েছেন, এটা একটা ঘটনা বটে! আখতার হুসেন একজন আপাদমস্তক আধুনিক মানুষ, কিন্তু প্রাচীনগন্ধী নীতিকবিতা রচনাতে তাঁর কোনো অরুচি কিংবা অনাগ্রহ নেই। কেননা, তিনি জানেন, শুভচিন্তা ও মূল্যবোধের কোনো কালাকাল নেই, বরং তা জগৎ ও জীবনের সর্বকালীন মূল্যবোধকে ধারণ করে আছে।’ (‘দুটো কথা’)
এই নষ্ট-ধ্বস্ত সময়ে, মূল্যবোধের এই মহামারির কালে আমরা বইটির বহুলপ্রচার কামনা করি।
মোরশেদ শফিউল হাসান : লেখক