গল্প : জন্মদাগ : সাঈদ আজাদ

সাঈদ আজাদ ।।
একটু বর্তমান
আজও খুব বৃষ্টি। কালা একাই পানি সরানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে দু’দিন ধরে। ছোট ছোট নালা কেটে জমির পানি খালে নামিয়ে দিতে পেরেছে গতকালও। আজ পানি সরছে না। সরার উপায় নেইও আসলে। খালের পানি জমির পানির সমানে উঠে এসেছে। তাহলেও কালা প্লাস্টিকের গামলা নিয়ে পানি সেঁচে খালে ফেলার চেষ্টা করেই যাচ্ছে। যদিও কালা জানে, এতে আসলে কোনো লাভই হবে না। উপর থেকে যে হারে পানি ঝরছে তাতে কার সাধ্য পানি সেঁচে কুলিয়ে ওঠে! তাও একা একা।
সকাল থেকে ভিজে ভিজে গায়ে কাঁপুনি ধরে গেছে। আর পারছিল না কালা। শরীরটা টলছে। জ¦রই এলো কিনা! খিদেটাও লেগেছে জবর! হাঁটু পর্যন্ত কাদায় ডুবে আছে। কাদার ভেতরে হাঁটতেও খুব কষ্ট হয়।
ক্রমশ অগ্রসর বিন্দুটা বড় হচ্ছে। বোধহয় আসছে আদুরিই।
ঝাপসা বৃষ্টির মধ্যেও দেখা যায় মাথায় কালো মতো কী যেন। ছাতাই হবে। তবে ছাতা নিয়েছে বৃথাই। এমন বৃষ্টিতে ছাতায় শরীর বাঁচে নাকি! আর অই ছাতায় যা ফুটো! মাথাও বাঁচবে না। তা আদুরি গতকালও খাবার নিয়ে এসেছিল। বাড়িতে টুকটাক কাজ করে যে ছেলেটা, সে বোধহয় কোথাও গেছে। আদুরি তেমনই বলেছিল। তাই খাবারটা আদুরিই নিয়ে আসছে দু’দিন ধরে।
ক’দিন ধরেই বৃষ্টিটা পড়ছে। ধারাপাতের বিরাম নেই একমুহূর্তের জন্য। ঝরছে, মুষলধারায়। আকাশ বোধহয় তার সমস্ত জমা পানি ঢালছে রাত-দিন।
কালা উদাস চোখে তাকিয়ে ছিল ধানক্ষেতের দিকে। বৃষ্টির পানিতে শীষগুলোও প্রায় ডুবু ডুবু। সপ্তাহটা ঘুরলেই ধান কাটার সময় হতো। বৃষ্টি যদি এখনই না থামে তো ধানক্ষেত রাতের আগেই তলিয়ে যাবে। পানি যে সরবে তেমন পথ তো নেই। যাহোক ছিল একফালি খাল, তাতেও উপচানো পানি। তা পানি তো উপচাবেই, খালের কি আর সে যৌবন আছে! একসময় অবশ্যি ছোটখাটো নদীর মতোই স্রোত ছিল খালে। জোয়ারভাটাও হতো নিয়মিত। গস্তি নৌকা, গয়নার নৌকা, কেরায়া নৌকা, ইঞ্জিনের নৌকা- সবই চলত। বলতে কী এক সময় নদীই তো ছিল এই অঞ্চলের চলাচলের একমাত্র পথ। বেশিদিন আগের কথাও নয়, কালা তার শৈশবেও নদীপথে যাতায়াত করেছে। কচুরিপানা জন্মে, কচুরিপানা মরে, পচে, নলখাগড়া আর হোগলার বনে, খাল গেছে ভরাট হয়ে। এখন একটু বৃষ্টি হলেই খালে পানি উপচায়।
এবার ধানের ফলনটা হয়েছিল বড্ড। ক্ষেতের যেদিকে তাকাও শুধু সোনা রঙের ধান। আহা, অমন ধান দেখলেও চোখ সার্থক হয়। সব খাবে পানিতে। বৃষ্টি থামার তো কোনো লক্ষণই নেই। এবার ধানে মার খেলে মানুষজন আর উঠে দাঁড়াতে পারবে না।
গত বছরও বৃষ্টি হয়েছিল খুব। মৌসুমের শেষের দিকে। আর তাতে ক্ষতিটাও বেশি হয়েছিল। টানা সতেরো দিনের বৃষ্টিতে মাছের ঘের খাল নদী সব এক হয়ে গিয়েছিল। যেন সব মিলে একটা বিশাল সমুদ্র। সেই সমুদ্রে ছড়িয়ে গিয়েছিল তৈরি হওয়া সব মাছ। যে যেভাবে পারে ধরেছে মাছ। বেশিরভাগই গলদা। ছিল রুই, কাতলা, মৃগেল, তেলাপিয়া, সরপুঁটি আর শিং, আর কিছু দেশি মাছও। জাল লাগেনি, মানুষ হাত দিয়েই মাছ ধরেছে। আর মাছ কেনার ক্রেতা কই, মাছ কিনবেই-বা কে! অত মাছ খাওয়ার লোক এই এলাকায় আছে নাকি! অন্য জেলা থেকে লোকজন এসে বস্তা বস্তা মাছ নিয়ে গেছে পানির দরে। বলতে কী পানির চেয়েও কম দরে। লবণ পানির এই অঞ্চলে মিঠা পানির দাম বড় কম নয়!
ঝাপসা বিন্দুটা আরও বড় হয়েছে। আদুরির আদল আন্দাজ আসে এখন। ঘেরের আল ধরে পা টিপে টিপে হাঁটছে। দেখে একটু শঙ্কিত হয় কালা। আবার না পা পিছলায়! ক’দিনের বৃষ্টিতে আঠালো মাটি থকথকে হয়ে আছে। আল ভর্তি তো ভাঙা শামুক। শামুকে পা কাটলে চামড়া একেবারে ফাঁক হয় যায়!
নাহ, আদুরি অভ্যস্ত পায়ে ঠিকই এসে পৌঁছায়। টংয়ের পাটাতনে হাতের টিফিন ক্যারিয়ারটা রেখে, এক হাতে ছাতা সামলে আরেক হাতে শাড়ি উঁচু করে ঘেরের পানিতে দু’পায়ের গোড়ালি ধুয়ে ছাতা গুটিয়ে টংয়ে উঠতে উঠতে বলে, এমন দুর্যোগে কেমন করে এখানে থাকো তুমি! আরেকটু বৃষ্টি হলে তো তোমার ঘরের পাটাতনও পানিতে ডুববে।
হুম, বৃষ্টিটা চিন্তায়ই ফেলে দিল। পানি তো ধানের আগায় গিয়ে ঠেকেছে। এবার বুঝি আর ধানটা ঘরে তোলা হলো না।
আমি কই কী, আমার সারিন্দা বোঝে কী! …তোমার সাথে কথা কইতে গেলে মেজাজই খারাপ হয়। কোথায় নিজেকে নিয়ে ভাববে, তা না, উনি চিন্তা করছেন পরের ধান ঘরে তোলা নিয়ে। এক ছটাক ধানও যদি ঘরে না ওঠে, তো তাতে তোমার কী ক্ষতি? আর বস্তা বস্তা ধান পেলেই-বা তোমার লাভ কী? তুমি যে পেটে ভাতের কামলা, সে কামলাই থাকবে। …অত উল্টাপাল্টা চিন্তা বাদ দিয়ে বাড়ি চলো। বৃষ্টির সাথে যেভাবে দমকা বাতাস ছেড়েছে, তাতে রাতে তোমার টংঘর না উড়ে যায়। আমি আর এমন বৃষ্টিতে খাবার নিয়ে আসতে পারব না।
এমন কাজ করা যায়! ঘেরের কাছাকাছি থাকলে প্রয়োজন হলে ক্ষেতের পানি সরানো যাবে। …তোকে আর খাবার নিয়ে আসতে হবে না আদুরি। আমার কাছে চিড়া আছে। খেজুরের গুড় আছে। তাতে এক দুই দিন চলে যাবে। … চেয়ারম্যান সাহেব অত নির্ভর করে আমার উপর, এই সময় আমি বাড়ি গিয়ে আরাম করলে হবে? তাছাড়া ঘেরের পগারে (ঘের, দক্ষিণ অঞ্চলে অগভীর পানিতে চিংড়ি চাষের পুকুর। পগার, ঘেরের অপেক্ষাকৃত নিচু জায়গা। যেখানে সবসময় পানি থাকে। বর্ষার শুরুতে পগারে পোনা ছাড়া হয়। যখন পানিতে ঘের পরিপূর্ণ হয়ে যায়, তখন পোনা ছড়িয়ে যায় পুরো ঘেরে।) আগাম কিছু রেণুপোনা ছাড়া আছে। সেগুলো জাল দিয়ে না আটকে রাখলে ভেসে যাবে। চেয়ারম্যানের সম্পত্তি তো আমাদেরই সম্পত্তি।
হ্যাঁ সেই সম্পত্তির ভাগও তো তুমি পাবে। বাপের সম্পত্তি কিনা! যতসব হাবার মতো কথা।
ভাগ পেতেও তো পারি। কে বলতে পারে!
আচ্ছা, এমন ধারা কথা তুমি আগেও বলেছ। … চেয়ারম্যান তোমার আপনজন… চেয়ারম্যানের সম্পত্তি তোমারও সম্পত্তি। এসব কথার মানে কী বলতো?
মানে তো সোজাই। জীবনভর যার নিমক খেলাম, তার সব কিছু তো নিজেরই মনে হয়।
আচ্ছা, চেয়ারম্যানের তো ছয় ছয়টা মেয়েই। এতসব সম্পত্তি কে খাবে?
সে আমি কি জানি। খাবে মেয়েরাই। মেয়েদের জামাইরাই। কালা একটু কেঁপে ওঠে। বোধহয় ঠান্ডাতেই।
একটা ছেলে যদি থাকত তাও সব সম্পত্তি পরের ছেলেদের ভোগে লাগত না। আদুরি হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির পানি ছোঁয়।
কেন, মেয়ের জামাইরা কি আপন না?
কী জানি! আপনই মনে হয়।
আচ্ছা আদুরি, একটা কথা বলি তোকে। …ধর চেয়ারম্যানের যদি কোনো ছেলে থেকে থাকে, কেমন মজার হয় না বিষয়টা?
কী সব পাগলের মতো কথা বলছ! ছেলে থাকলে চেয়ারম্যান ছেলেকে কই লুকিয়ে রাখবে? বেচারার ছেলের আশায়ই তো অতগুলো মেয়ে হলো।… তোমার মায়ের অবস্থা তো বেশি ভালো না। মাকে দেখতে হলেও একবার বাড়ি চলো।
চেয়ারম্যান বাড়িতে মায়ের খুব অনাদর হয়, না আদুরি?
পরের বাড়িতে দাসি-বাদীর কাজ করে কে আর কবে সুখে থাকে!
হুম, পরের বাড়িই তো! …আচ্ছা, খাবার কী এনেছিস দে খেতে।
আমার দেওয়ার ঠেকা পড়েছে। টিফিন বাটি রেখে গেলাম। নিজে বের করে খেয়ে নিও।
এই বৃষ্টিতে যাবি?
আসলাম তো বৃষ্টির মধ্যেই। যেতেও পারব। আমার কথা ভাবতে হবে না তোমার। খাও তুমি।
ছাতা মেলে, আদুরি বৃষ্টির মধ্যেই হাঁটা শুরু করে। আদুরির অবয়ব ঝাপসা হতে হতে একসময় হারিয়ে যায়। কালা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে খেতে শুরু করে।
একটু অতীত
ঘেরের এক পাশে ছোট টংঘরটাতে থাকে কালা। দিনমান ঘেরে বা ক্ষেতে কাজ করে, সন্ধ্যার পর থেকে ছোট টংঘরটাতে শুয়ে-বসে সময় কাটে। সৌরবিদ্যুতের আলো শেষ হয়ে আসে সন্ধ্যার কিছু পরেই। তার পরেই চরাচরে শুধুই নিকষ আঁধার। চাঁদনি রাত না হলে কৃষ্ণপক্ষে দুই হাত দূরে গিয়েই দৃষ্টি আটকে যায়।
নামে কালা হলেও, একসময় হয়তো অতটা কালো সে ছিল না। তবে এখন রোদে পুড়ে পুড়ে রংটা যথার্থই কালো হয়ে গেছে। তাকে দেখলে এখন আর কেউ স্বীকার করবে না, এক সময় তার গায়ের রং কী কোমল আর ফর্সা ছিল। হয়তো রোদে পুড়ে পানিতে ভিজে কালো হয়ে গেছে ত্বক। ত্রিশ বিঘা ঘের বলতে গেলে একাই সামলায় কালা। মাঝে মধ্যে কাজ বেশি পড়ে গেলে অবশ্যি কামলা-কিষান নেওয়া হয়। অই ধান লাগানো বা কাটা বা মাছ ধরার সময়টায়। নচেৎ অন্য সময় কালা একাই ত্রিশ বিঘা ধানের ক্ষেত কি মাছের ঘের সামলাতে পারে? বিনিময়ে ঘেরের ছোট ঘরটাতে থাকে আর তিনবেলায় খোরাকির ভাত পায়। বছরে দুইটা লুঙ্গি ও একটা গামছাও বরাদ্দ। পায় দুইটা শার্টও। চাইলে আরও কিছু দেবে চেয়ারম্যান। কিন্তু কালার বেশি চাহিদা নেই।
কাজের বিনিময়ে এসব যে কম, জানে কালা। তবে, কাজটাকে সে তার দায়িত্ব মনে করেই করে। এ ছাড়াও কারণ আছে আর একটা। সেটা লোকে জানে না।
এত কমে বোধহয় কালা ছাড়া আর কেউ এত কাজ করতে রাজি হবে না। কিন্তু কালার কোনো অভিযোগ নেই। বা বাড়তি চাহিদাও নেই। এই নিয়ে মাঝে মাঝে কথা শোনায় আদুরি।
তুমি কী বলতে?
কী! আমি আবার কী করলাম?
সেই আজান দিলে ঘুম থেকে ওঠো। তারপর থেকেই তো কাজ আর কাজ। রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে কাজ করে যাও। তার বদলে কোনো বেতনও দেয় না। না ভালো কোনো থাকার জায়গা। তোমার জায়গায় অন্য কেউ হলে কাজ করত?
কী জানি। আমি তো করি।
হাবা গাধা বলেই করো।
তা আমি তো একটু গাধাই আছি। কালা হাসে।
অই গাধা হয়েই সারা জীবন থাক। আমি খাওয়া পরা বাদে কত পাই জানো?
কত?
দুই হাজার।
দুই হাজার! অনেক টাকা।
বলেছে তোমাকে। এখন দুই হাজার টাকা কোনো টাকা হলো। তাও তো আমি রাতে থাকি না। তোমার মতো জোয়ান মানুষ চাইলে দিনেই এক হাজার টাকা রোজগার করতে পারে।
ওরে বাবা, বলিস কী! দিনে এক হাজার টাকা। তোর মুখে দেখি কিছু আটকায় না।
ভুলটা বললাম কী! তা এক হাজার না হোক, পাঁচশ’ তো পাওয়া যায়ই।
যাক, তবুও অর্ধেকে নামলি। …আসলে আমি ভাবি কি আদুরি, একা মানুষ আমি বেশি টাকা-পয়সা দিয়ে কী করব? খাওয়া-পরার তো চিন্তা নেই। অসুখ-বিসুখে চেয়ারম্যান দেখে। থাকার ঘরও আছে। আমার দিন চলে যাচ্ছে ভালোই।
থাকার ঘর! এটাকে থাকার ঘর বলছ? টংঘরে কোনো সুস্থ মানুষ থাকে! এমন বিজন প্রান্তরে একা একটা মানুষ থাকো। দশ মাইলের মধ্যে একটা মানুষ দূরে থাক গরু-ছাগল পর্যন্ত থাকে না। বিপদ-আপদে ডাক দিলেও তো কেউ আসার নেই।
তুই খামাখা ভাবছিস। আমার তো এখানে থাকতে খারাপ লাগে না। …সকালে উঠে কাজ শুরু করি, সন্ধ্যায় খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়লে এক ঘুমেই রাত কাবার হয়ে যায়।
এভাবেই তোমার দিন যাক, তাই তুমি চাও? বিয়ে-শাদি করতে হবে না? ভবিষ্যৎ নেই তোমার?
বিয়ে? আমি বিয়ে করব কেন?
বয়স হলে পুরুষ মানুষ বিয়ে করে না?
আমাকে কে বিয়ে করবে? বাপ ভাই কেউ নেই। নিজের জমিজমাও নেই।
কতজনই করবে। মেয়ে হলে না হয় অসুবিধা ছিল। তুমি কি সারাজীবনই এখানেই পড়ে থাকবে নাকি? আমার পরামর্শ শুনলে কাজে দেবে। অন্য জায়গায় গিয়ে কাজের চেষ্টা করো।
ও বাবা তা কি হয় নাকি? সবাই জানে আমি চেয়ারম্যানের বাঁধা কামলা। আমাকে কেউ কাজে নেবে না।
এখানে না নিক অন্য জায়গায় যাও। অন্য জেলায় যাও। জোয়ান পুুরুষের কাজের অভাব?
নারে আদুরি। এই জায়গা ছেড়ে কোনোখানে গিয়ে আমি থাকতে পারব না।
কেন পারবে না। এইখানে কী মধুটা!
না তেমন কিছু না। ছোটবেলা থেকে আছি। কেমন একটা মায়া। এই আকাশ, জমি-খাল, চারপাশের পরিবেশ- এসব ছেড়ে মন টিকবে না।
মায়া! মায়া আবার কিসের? এমনভাবে বলছ যেন এসব ক্ষেত-ঘের তোমারই। তা তো নয়। তুমি তো চেয়ারম্যানের কামলা ছাড়া কিছু না। বাঁধা কামলা। শুধু খেতে দেয় আর পরতে দেয়।
আমার কথা বাদ দে তো। তোর কথা বল।
আমার আর কথা কী! মেয়েমানুষের জীবন হলো কুত্তা বিলাইয়ের জীবন। কোনো রকমে দিন যায়।
ছেলে দুইটা কই?
শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাদের রেখে দিয়েছে।
আসে টাসে না ওরা?
যে চামার লোকজনের কাছে থাকে, আসতে দিলে তো! মেয়ে হলে আমার ঘাড়েই চাপিয়ে দিত। ছেলে বলেই…
তা তোর তো আবার সংসার শুরু করা উচিত। তেমন বয়স তো হয় নাই।
তুমি বলছ এ কথা! নিজের জীবনেরই তো হিসাব নাই তোমার।
আমার আর তোমার জীবন এক হলো!
এক ভাবতে দোষ কী!
না আদুরি, তুই মেয়েমানুষ। একা একা জীবন কাটানো তোর সাজে না। পুরুষ মানুষ একা জীবন কাটাতে পারে। মেয়েমানুষ পারে না। …তোর বয়স তো বেশি না। অল্প বয়সী সুন্দরী নারীর মাথার উপর কত কাক-শকুন ওড়ে। সুযোগ পাইলেই ঠোকর দিতে চায়।
অইসব কাক শকুন ছোটবেলা থেকেই সামলে এসেছি। কিন্তু, তুমি কথাটা কী বললে?
কোন কথা!
আমি সুন্দরী!
কেন সবাই তোকে সুন্দরী বলে না?
তা সবাই আমার গতরের প্রশংসা করে অবশ্য। কিন্তু রূপের কথা কেউ বলে নাই।
আমি বলছি তুই সুন্দরী। যার দেখার চোখ আছে, সে-ই বলবে তুই সুন্দরী।
তুমি-ই বা আমাকে দেখলে কোন সময়? আমার দিকে তাকাতে দেখি নাই তো কোনো দিন!
দেখতে হলে সারাক্ষণ তাকিয়ে থাকতে হবে- এই কথা তোকে কে বলেছে? যে দেখে, সে একবারেই দেখে।
আদুরি আর কথা বলে না। হঠাৎ কেমন চুপচাপ হয়ে যায়। উদাস চোখে তাকিয়ে থাকে ঘেরের পানির দিকে।
অতীত আর বর্তমান
আজও আদুরি খাবার নিয়ে আসে। খাবার বেড়ে দিয়ে কালাকে জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা একটা সত্যি কথা বলবে?
খেতে গিয়ে হঠাৎ থেমে যায় কালা। তোকে আবার কবে মিছা কথা বলেছি!
তোমার মাকে তুমি ঠিক পছন্দ করো না, না?
কালা সাথে সাথে প্রশ্নের জবাব দেয় না। চুপচাপ খেতে থাকে। খাওয়া শেষে হাত ধোয়। লুঙ্গিতে হাত মোছে, নিচু হয়ে মুখ মোছে। তারপর বলে, তোর এই ধারণার কারণ কী আদুরি?
কারণ নেই কোনো। আমি জানি তুমি তোমার মাকে পছন্দ করো না। অসুস্থ মাকে অন্যের বাড়িতে রেখে এখানে একা পড়ে থাকো, তাতেই বোঝা যায়।
হুম।
হুম বললে কী বুঝবো?
আচ্ছা বল তো, আমার মা কতদিন ধরে চেয়ারম্যানের বাড়িতে কাজ করে?
তা বলতে পারব না। আমি তো অই বাড়িতে কাজ করি চার বছরও হয়নি। এই ক’দিন তো দেখছিই।
আমার জন্মের আগে থেকেই। ত্রিশ বছর।
ত্রিশ বছর! কী বলো! তোমার মাও দেখি তোমার মতোই।
হুম। ত্রিশ বছর যখন সমস্যা হয়নি, এখনও হচ্ছে না।… তুই এখন যা আদুরি। বৃষ্টিটা নেই হয়তো। আবার শুরু হয় কখন!
আমার যাওয়া নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না। তোমার মাকে নিয়ে তুমি আলাদা একটা বাড়িতে থাকলে পারো না?
বাড়ি কই পাবো আমি! আর তাছাড়া মা চেয়ারম্যানের বাড়ি ছাড়া অন্য জায়গায় থাকতে চায় না।
ও। আচ্ছা, তোমার বাপ কি খুব ছোটবেলা মারা গেছে? বাপের কথা তো কোনোদিন কিছু বলো না।
বাপের কথা আমার মনে নেই। মা বলে, আমি পেটে থাকতেই বাপ নিরুদ্দেশ হয়েছে। জন্ম থেকেই দেখছি, মা চেয়ারম্যান বাড়িতে কাজ করে। …আচ্ছা আদুরি, আমি যদি তোকে বিয়ে করতে চাই, তুই কি রাজি হবি?
বিয়ে! আমাকে বিয়ে করলে তোমার বদনাম হবে না?
বদনাম কীসের! আইন মতে বিয়ে করব।
বদনাম যে কী, তা তুমিও জানো। অভিভাবকহীন মেয়েমানুষের কত বদনাম থাকে! সে বদনামের কালি তোমার গায়েও লাগবে।
সেসব নিয়ে ভাবি না। আর আমি-ই বা কোন ধোয়া তুলসী পাতা।
তা বিয়ে করে আমাকে নিয়ে গিয়ে চেয়ারম্যান বাড়িতে উঠবে বুঝি?
কেন এই ঘেরে থাকতে পারবি না? দিনমান দু’জনে কাজ করব, আর রাত হলে চাঁদের আলোয় দু’জনে নৌকায় করে ঘুরব।
চাঁদ কি প্রতিদিনই থাকবে? চাঁদেও তো অমাবস্যাও থাকে!
থাকে তো। জীবন কি চিরকাল সুখে কাটে? কষ্ট আর আনন্দ নিয়েই জীবনরে আদুরি। … আসলে চেয়ারম্যান বাড়ি ছাড়া আর কোনো বাড়িকে আমার নিজের বাড়ি মনে হয় না। জন্মের পর থেকেই থাকি তো। তা তুই চাইলে না হয় আমরা আলাদা বাড়িতে ঘর তুলব। চাইলে চেয়ারম্যান আমাকে বিঘা দুয়েক জমি অবশ্যি দেবে। বললে ঘরও তুলে দেবে।
এত দরদ চেয়ারম্যানের তোমার প্রতি!
দরদ! তা দরদ একটু আছে বলতে পারিস। এতদিন অই বাড়িতে মায়ে-ছেলে আছি। একটা মায়া হয়তো পড়ে গেছে।
বলতে বলতে কালা কেমন অন্যমনস্ক হয়ে যায়। ওর আবছাভাবে কী যেন মনে পড়ে যায়। তখন ও খুব ছোট। ঠিক বাস্তব কিনা সে বলতে পারবে না। হয়তো যা মনে পড়েছে তা নিতান্তই ওর কল্পনা। কোনো একটা পুরুষকে কালা দেখেছে মায়ের সাথে এক বিছানায় শুয়ে থাকতে। সেটাই কি ওর বাবা? কি জানি। বড় হওয়ার পর তো তাকে আর কখনও দেখেনি।
কী ভাবো?
কী যে ভাবি, নিজেও জানি না।
বাপের কথা মনে পড়ে?
তুই কি মনের কথা পড়তে পারিস নাকি? আসলেই আমি বাবার কথা ভাবছিলাম।
যে নাই তার কথা ভেবে কী লাভ?
লাভ! মানুষ কি সবসময় লাভ-লোকসান ভেবে কাজ করে! বলতে বলতে কালা ফের অন্যমনস্ক হয়ে ঘেরের পানির দিকে তাকিয়ে থাকে। শেষ পর্যন্ত ধান রক্ষা করা গেছে। বৃষ্টিটা থেমেছে একেবারে ক্ষেত উপচে পড়বে পড়বে অবস্থায়। এখন দ্রুত পানি কমছে। ধানের শীষ শুকাচ্ছে রোদে। তবে, পাকা বলে পানির তোড়ে প্রায় সব শীষ থেকেই অল্পবিস্তর ধান ঝরে গেছে। তাহলেও, প্রচুর ধান উঠবে ঘরে। চেয়ারম্যানের ক্ষেত বিশাল। কিন্তু আজ যেন ঠিক খুশি হতে পারছে না কালা। মনটা যেন কোথাও কিছু খুঁজে বেড়াচ্ছে।
তুমি আমার কথায় মন খারাপ করলে? তুমি হয়তো জানো না, আমি তোমার জন্মের বিষয়ে অনেক আগেই জানি। জানো তো, আমি চেয়ারম্যানের গায়ে তেল মাখি। তুমি কেন এই এলাকা ছেড়ে, চেয়ারম্যানের বাড়ি ছেড়ে যেতে চাও না আমি জানি। কেন সারাদিন চেয়ারম্যানের সম্পত্তি নিয়ে পড়ে থাকো বুঝি।
বলছিস, চেয়ারম্যানের সম্পত্তি আগলে জীবন পার করাটা আমার ভুল?
ভুলই তো। অই সম্পত্তির এক কণা তুমি পাবে? পাবে না। তাহলে সারাদিন কেন এত গাধার খাটুনি?
আসলে… তুই যা বলতে চাচ্ছিস আদুরি, আমি যে তা বুঝি না, তা না। বুঝি। মা কেন চেয়ারম্যান বাড়ি ছেড়ে যেতে চায় না, সে তুই যেমন জানিস, তেমনি আমিও জানি। একটা সময় মায়ের উপর খুব রাগ ছিল। জানি, বললে তুই বিশ^াস করবি না, মাঝে মাঝে মাকে খুন করতে ইচ্ছে করত। কিন্তু এখন বুঝি, মার আসলে উপায় নাইরে আদুরি। কোনো কোনো জায়গাতে সব মানুষই অসহায়। মা না গেলে আমি কী করে আরেক জায়গায় যাই বলতো? আর এই যে তুই বললি, আমি চেয়ারম্যানের সম্পত্তির জন্য এখানে পড়ে আছি। ভুল বললি। ঠিক সম্পত্তি না। সম্পদের লোভ না। …আসলে ছোটবেলা থেকেই মনে মনে বাপের জায়গায় চেয়ারম্যানকে বসিয়ে রেখেছি। অভিভাবক বলিস, আর বাপ বলিস- ওই চেয়ারম্যানকেই মনে করি।
তোমার পিঠে বড় একটা জড়ুল আছে। তুমি কি জানো? আদুরি হঠাৎ প্রশ্ন করে।
কালা সহসা আদুরির প্রশ্নের জবাব দেয় না। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আদুরির দিকে। খানিকক্ষণ পরে বলে, তুই কী বলতে চাস, বল তো?
তুমি কোনো দিন যা বলবে না, আমি তা জানি। কীভাবে জানি তোমাকে বলবো না। শুধু বলি আমরা উপরে উপরে যাকে ফেরেশতা জানি, সে ভেতরে ভেতরে শয়তান হতে পারে। আমি চেয়ারম্যানের পিঠে একটা জড়ুল দেখেছি। ঠিক তোমারটার মতো।
কালা কিছু বলে না। নির্নিমিখ তাকিয়ে থাকে আদুরির দিকে।
আদুরি খুব নরম স্বরে বলে, মা চেয়ারম্যান বাড়িতে আছে থাকুক। চল, আমরা দূরে কোথাও গিয়ে সংসার পাতি। যাবে?
কালা তাকিয়েই থাকে আদুরির দিকে। জবাব দেয় না।
সাঈদ আজাদ : কথাশিল্পী
#