গল্প : কিষান চরিত্র সম্পর্কে হঠাৎ কৌতূহলী কয়েকজন মানুষ : হামিদ কায়সার

হামিদ কায়সার ।।
কিষান নিজের সম্পর্কে আজকাল প্রকাশ্যে এমন সব কথা বলে বসে যে, বুদ্ধিমান লোকেরা সচরাচর যা বলে না। কিষান বলে, মুখ ফসকে যে বলে, তা নয়; বলার সময় ওকে যথেষ্ট আত্মপ্রত্যয়ীই মনে হয়। এবং এমন দৃঢ়কণ্ঠ এবং স্পষ্ট স্বর যে, কথাগুলোকে কোনোক্রমেই আর হেঁয়ালির মতো লাগে না। মনে হয় যে, একটি গভীর সত্য কথাই ও উচ্চারণ করল এবং যে-কথার জন্য ওকেই মূল্য দিতে হবে সবচেয়ে বেশি। যেমন ধরুন, কিষান বিয়ে করছে না কেন, কেউ যদি এমন প্রশ্ন হেলাফেলায়ও ওকে করে বসে, তার উত্তরটা ও এমনভাবে হয়তো দিলো, যা শোনার পর, যে শুনল সে তো বটেই, যারা শুনল না তারাও যদি চৌদ্দগুষ্টি ধরে শতহাজারসহস্র মাইল দূর থেকেও যদি তার ছিটেফোঁটাও টের পায়, ওর কাছে মেয়ে বিয়ে দেওয়া তো দূরের কথা, ধারেকাছেও ঘেঁষবে না। এই যেমন ও হয়তো মাথা চুলকাতে চুলকাতেই বলে বসল, ধুর! আমার কাছে কে মেয়ে বিয়ে দেবে! যন্ত্র চলে কিনা তারই নেই ঠিক! মেয়েমানুষ কি এতই সস্তা, না গাবায়?
এই যে ও কথাটা বলল, ভেবে বলল নাকি না ভেবে, এই কথার প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, এসব নিয়ে ওর কোনো ভাবনা-চিন্তা নেই! যা মাথায় আসবে বলবে! এখন যদি কেউ ধরে নেয়, প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর হতে চলল, যে-ছেলের নিজেরই সংশয় তার যন্ত্র চলে কী চলে না, তার কাছে কি কোনোভাবে মেয়ে বিয়ে দেওয়া যায়, না সম্ভব? ধরলাম, যন্ত্র চলেই, কিন্তু তা এমন ঢাকঢোল পিটিয়ে বলার কী আছে? তা কথাটা যেমনভাবেই নেওয়া হোক, তার একটা নেগেটিভ ইমপ্যাক্ট তো থাকবেই! যে ছেলে প্রকাশ্যে এমন কথা বলতে পারে, সে যে বিয়ের পরও ভাষ্য দেবে নাÑ বউ ওকে নিয়ে তৃপ্ত কী অতৃপ্ত! সেটার গ্যারান্টি কে দেবে?
কেউ হয়তো কিষানকে শুধরে দিতে চেষ্টা করল, এ-ধরনের কথা ও কেন বলে? এমনভাবে বলার মানে কী? এতে যে ওর ব্যক্তিত্ব থাকে না সেটা কি ও বোঝে। তার উত্তরটাও হয়তো ও এমনভাবে দেয়, সবাই ধরেই নেয়, ছেলেটার মাথা বিগড়েছে, যাকে বলে উচ্ছন্নে যাওয়া অথবা একেবারেই কাণ্ডজ্ঞানহীনতা; আর এমন একজন মানুষের সঙ্গে চলাফেরা করাটা বা কোনোভাবে নাম জড়ানোটাও তো বিপজ্জনক! তারচেয়ে ওকে বাপু এড়িয়ে চলাই ভালো! সেটা সামাজিকভাবে যেমন-তেমন, ফেসবুকে তো আরও। কেননা, ফেসবুক এখন হয়ে উঠেছে সমাজের মুখপত্র! সেখানেও তো বেফাঁস কথার অন্ত নেই কিষানের- অন্তত নিজের সম্পর্কে! কিন্তু সব সময় তো আর কথাগুলো নিজের থাকে না, ইমপ্যাক্টটা কমবেশি অন্যদের ওপরও পড়ে; তখনই তৈরি হয় বিব্রতকর অবস্থা, যা এড়িয়ে চলা হয়তো ভুক্তভোগী বা সংশ্লিষ্ট কারও পক্ষেই সম্ভব হয় না। এই যেমন অফিস ঘিরে এখন যে-ঘটনাটা ঘটছে। এমন লাগামছাড়া কথাবার্তা বলার জন্যই মূলত অফিসে একরকম একঘরে থাকা কিষান অফিসের বার্ষিক রিভিউ মিটিংয়ে এমন একটা কথা বলে ফেলল যে, তা নিয়ে বাতাসেই শুধু সরব ফিসফাস উঠল না, জায়গা-বেজায়গায় মানে অফিস-সংলগ্ন আর কি, প্রায় সবখানেই সিরিয়াস কথাবার্তা শুরু হয়ে গেল। যার রেশ যেন সহজে কাটবে বলে মনে হচ্ছে না।
কিষান কথাটা বলেছিল গত বৃহস্পতিবার। সেদিন প্রায় সারা দিন ঢাকার এয়ারপোর্ট সন্নিকটস্থ প্রায়-পাঁচতারা একটি হোটেলের গালিচা বিছানো ছাদে অনুষ্ঠিত হয়েছিল অফিসের এই বার্ষিক রিভিউ মিটিং। দেশের অন্যতম প্রধান ওদের বিজ্ঞাপনী সংস্থা ‘পান্থজনা’র বার্ষিক রিভিউ মিটিং কক্সবাজার সমুদ্র-সংলগ্ন একটি হোটেলে হওয়ার কথা থাকলেও, দেশের উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে যা রাজধানী ঢাকাতেই সারতে হলো। তো সেই রিভিউ মিটিংয়ে অফিসের কর্তাব্যক্তিদের স্বাগত ভাষণের পর শুরু হলো বিভাগীয় প্রধানদের পর্যালোচনা বক্তব্য। যাতে প্রতিটি বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধানরা স্ব স্ব বিভাগের কার্যক্রম তুলে ধরে নিজের কর্মদক্ষতারও আলোকপাত ঘটাচ্ছিলেন। ব্যাপারটা এমনভাবে বলছিলেন যে, অফিসের লাভালাভের জন্য মুখ্যত তার বা তাদের ভূমিকাটাই অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। বিভাগীয় প্রধানরা ছাড়াও যাদের অফিসের একটু সিনিয়র বা কাজেকর্মে গুরুত্বপূর্ণ ভাবা হয়, তাদেরও বক্তব্য প্রদানের সুযোগ দেওয়া হচ্ছিল। তারই ধারাবাহিকতায় কিষান ক্রিয়েটিভ বিভাগের একজন সিনিয়র এমপ্লয়ী হিসেবে বিভাগের কার্যক্রমের কথা বলতে গিয়ে আকস্মিকভাবে নিজের সম্পর্কেই বলে বসল যে, গত বছর ও অফিসের জন্য কোনো ভূমিকাই রাখতে পারেনি। অফিসের টাকা নিয়েছে বসে বসে। কথার সঙ্গে আরও যুক্ত করল, আমার জন্য যদি অফিসের অগ্রগতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কোম্পানি যেন স্ব-স্বার্থে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করার, তা করে। অকপটেই করে।
কথা নয়, যেন বোমা ফাটাল ও। বিশাল ধ্বংসযজ্ঞের পর যেমন বিস্ময়বিমূঢ় নিস্তব্ধতা নেমে আসে, ওর কথার পর রিভিউ মিটিংয়ের অবস্থাও যেন তাই হলো। একটা স্যাঁতসেঁতে অস্বস্তিকর অনুভূতি খেলে গেল অধিকাংশর মনের মধ্যে। অনেক প্রশ্নই কথার পিঠে উত্থাপিত হতে পারত। নিজের সম্পর্কে এমন আত্মসংহারক কথা ও কেন বলছে! অথবা নিজেই যখন বুঝতে পেরেছে ওকে দিয়ে কোম্পানির কোনো লাভ হচ্ছে না, তবু কেন ও চাকরিটা করে যাচ্ছে! প্রতিমাসে কেন মোটা অংকের বেতন নিচ্ছে বসে বসে?
কিন্তু কোনো প্রশ্নেরই সম্মুখীন ওকে হতে হলো না। সবাই চুপচাপ শুধু শুনে গেল এবং কেউ কেউ না শোনারও ভান করল। মুখ দেখেও বোঝা গেল না কারও সঞ্চালক মনোভাব। অনুষ্ঠানের অনুঘটক ফয়েজউল্লাহ ফয়েজ যথারীতি কিষানের পর মিডিয়া বিভাগ প্রধান আনোয়ার হোসাইনকে কথা বলার জন্য ফ্লোর দিলেন। কিষানের পূর্ববর্তী বক্তাদের মতো তিনিও একই ভঙ্গিতে নিজের ডিপার্টমেন্টের কার্যক্রমের মহা ফিরিস্তি তুলে ধরলেন। বিশেষ করে, অফিসের জন্য নিজের অবদানের বিশদ বর্ণনা প্রদান করলেন এবং সভার মনোযোগ ওর দিকেই ধাবিত হলো- এবং এরপর অন্যান্য বিভাগীয় প্রধানরাও নিজেদের কর্মযজ্ঞের কথা যথা বিস্তারিত সবিশেষ তুলে ধরলেন এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষও সেসব সার্বিক দিক বিস্তৃত পর্যালোচনা করে আগামী বছরের বাণিজ্যিক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে বার্ষিক রিভিউ মিটিংয়ের সমাপ্তি প্রদান করলেন। এরপর অবশ্যি বেশ মদ্যপান এবং খানাপিনা সহযোগে এবং যৎকিঞ্চিৎ নৃত্যাবিষ্টতার মাধ্যমে পুরো অনুষ্ঠানটির পরিসমাপ্তি ঘটানো হলো এবং স্ব^ভাবতই কিষান এবং ওর বক্তব্যের প্রসঙ্গ সেদিনকার মতো চাপা পড়ে গেল।
কিন্তু শুক্র ও শনি দুই ছুটির দিনের বিরতি-শেষে রোববার অফিস খোলামাত্রই চাপা পড়া আগ্নেয়গিরির হঠাৎ উদগিরণের জ্বলন্ত বুদবুদের মতোই যেন কিষানকে নিয়ে কথা অফিসের চার দেয়ালে, চার দেয়াল ভেদ করে নিচের লেকের পাশের চায়ের দোকানে, বিড়ি-সিঁড়িতে টগবগ করে ফুটতে লাগল। কিষান চরিত্র নিয়ে শুরু হলো বিশ্লেষণ-পাল্টা বিশ্লেষণ। এবং এভাবেই কিষান হয়ে উঠল চরম কৌতূহল উদ্রেককর চরিত্র। অফিসের সিইও আফজালুর রহমান আর সিওও হোসেনউদ্দিন হোসেন শুধু পার্টনার নন, জানি দোস্তও। আফজালুর রহমান সাতসকালে অফিসে এসেই হোসেনউদ্দিন হোসেনের রুমে ঢুকে টেবিল চাপড়ে দিয়ে শুরু করলেন- কী দোস্ত কিষান তো সেদিন ফাটিয়ে দিল!
হোসেনউদ্দিন হোসেনকে ততটা উৎসাহিত মনে হলো না, আমার কিন্তু মনে হয়েছে ছেলেটার মাথায় ছিট আছে।
আমার তা মনে হয় না। অপোজ করার চেষ্টা করেন আফজালুর রহমান।
ধুর! নিজের সম্পর্কে কেউ এরকম বলে?
বলে বলে। অনেস্টি থাকলে বলতেই পারে!
তুই কি বলতে চাস নিজের সম্পর্কে যে অভিযোগগুলো ও এনেছে তা ঠিক?
অ্যাবসুলেটলি রং! অফিসে একমাত্র কিষানই সবার আগে আসে এবং সবার পরে অফিস থেকে বের হয়।
সেই তো আমার কথায়ই আসলি। ও অফিসকে কতটুকু দিচ্ছে তাই বল-
কম কি! গত বছর তো ওর বেশ কয়েকটা প্ল্যান-
আই নো… আই নো। সে জন্যই তো ওকে কিছু বলিনি। যদি ওর কথা ডিনাই করি তাহলে বেতনটা বাড়াতে হয় আর যদি ওর কথা মেনে নিতাম তাহলে ওকে ছাঁটাই করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকত না, কী দোস্ত, অ্যাম আই রং? বলেই হো হো অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন আফজালুর রহমান।
ছাঁটাই করতে যাবে কেন। একটা মাথা খারাপ ছেলে! হোসেনউদ্দিন হোসেন সমস্ত স্নেহরস উগরে দিতে চান।
আমারও তাই মনে হয়… ওর মাথায় একটু গণ্ডগোল আছে…
তোর এখনও সন্দেহ!
হা…হা… হা… হা… দু’জন আবারও অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন। হাসতে হাসতেই বললেন হোসেনউদ্দিন হোসেন, কত বছর হলো চাকরি করছে খেয়াল করেছিস? অথচ ওর কোনো প্রমোশন হচ্ছে না। ওসব নিয়ে কোনো মাথাব্যথাও নেই। কত জুনিয়র ওকে টপকে গেল! নো টেনশন। ওর কোনো হোদালই নেই। আমি তো চিন্তা করছি সামিরাকে ওদের ডিপার্টমেন্টের হেড বানিয়ে দেব। তুই কী বলিস? কী চৌকস ইংরেজি বলে মেয়েটা! আর মাথা কী শার্প!
হোসেনউদ্দিন হোসেনের কথায় উৎসাহিত হয়ে ওঠেন আফজালুর রহমান, অ্যাকসিলেন্ট দোস্ত! অ্যাকসিলেন্ট! এত সুন্দর প্রানানসিয়েশন তো আমি মনে করি ঢাকা শহরেই আর কারও নেই! মেয়েটার হেডমও সেই রকম। ক্লায়েন্টের সঙ্গে মিটিংয়ের সময় খুব কাজে লাগবে। আর কিষানকে কি প্রোমোশন দিবি? ও তো ক্লায়েন্টের সামনেই যেতে চায় না।
হোসেনউদ্দিন হোসেনও চনমনে হয়ে ওঠেন, যাবে কী! কথাই তো বলতে পারে না। কোনো ভিশন নেই ছেলেটার। আবে শালা! খালি মাথা ডুবিয়ে কাজ করলেই হলো? কাজের সাথে তো আরও কিছু দরকার, নাকি? মেনি মেনি থিংস আছে! সেসব কোথায়? কাজ করতে করতে ওর শালা মাথাটাই তো নিচু হয়ে গেছে। কেমন গুঁজো হয়ে থাকে। দেখেছিস!
ও কাজ করতে করতেই মরবে। টেবিলেই মরে থাকবে, বলে দিলাম।
হ্যাঁ, সামিরাকে আমাদের ওপরে তুলে আনতে হবে দোস্ত!
হু-ম-ম! মেয়েটা ভালো করবে! ডেফিনেটলি! যোগ্যতা আছে। ড্যাম স্মার্ট। কে কী বলল তোয়াক্কা করে না! খাঁটতেও জানে!
কিন্তু আমতা আমতা করে হোসেনউদ্দিন হোসেন, ও তো অফিসে জয়েন করল এক বছরও হয়নি-
তাতে কী! কোন শালায় কী বলবে গুলি করে দেব না?
ভাগ্য ভালো যে তোর পিস্তলটা আঙুলের!
আবার হো হো অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল যেন পুরো অফিস!
এক্সিকিউটিভ রুমে সকাল থেকেই বাতচিত, অফিসিয়াল ট্যুরে মুম্বাইতে পনেরো দিনেরও বেশি একটি শিশুদুগ্ধ-পণ্যের বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাণ তত্ত্বাবধান শেষে ফিরে আসার পর ক্লায়েন্ট সার্ভিস এক্সিকিউটিভ মিসেস শর্মিলা রহমান কিছুতেই আর নিজের পয়োটাকে দামি চেয়ারটায় ধরাতে পারছে না, চেয়ারটাকে পাল্টাতেই হবে দেখছি, উপলব্ধি করতে করতে বলে উঠল, যাই বলিস- এটা কিষানের একটা স্টান্টবাজি।
একমত হয় না আরেক ক্লায়েন্ট সার্ভিস এক্সিকিউটিভ পারভেজ সারোয়ার, কিসের স্টান্টবাজি। বসগো একটু তেল মারলো আর কি, বুঝস না! আরে বেটা তর মধ্যে উইকনেস আছে, তুই অফিসরে কিছু দিতে পারস না, ভালো কথা! তাইলে তুই অফিসের মধ্যে বইয়া রইছস ক্যা? চইলা গেলেই পারস।
শর্মিলা রহমান হেসে উঠল, সেটাই তো বলছিলাম। উনি সবার কাছে অনেস্ট এবং দায়িত্ববান সাজতে চাইছেন। শর্মিলা আরও যোগ করে, বেশ চালাক কিন্তু! মুখ দেখে বোঝা যায় না। চেহারাটা বোকা মার্কা।
পারভেজ সারোয়ারও সায় দেয়, আরে বোকা না বোকা না। ভাব লয়। মনে করছস কিষান কোনো হিসাব ছাড়াই ওইসব কথা কইছে? দ্যাখগা সামনেই তো ইনক্রিমেন্ট! অর অবস্থাটা কী হয়!
শর্মিলা রহমান হঠাৎ সন্দিগ্ধ, কিন্তু ইনক্রিমেন্টের টার্গেট থাকলে তো নিজেকে আরও জাহির করার কথা।
মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে পারভেজ সারোয়ারের বিশেষজ্ঞ অভিমত, প্যাচাইয়া কইল আর কি। বুঝলি না? ‘আমি কলা খাই না’র মতো!
শর্মিলা রহমান কাজে মন দেওয়ার চেষ্টা করতে করতে বলল, কী জানি! অদ্ভুত ক্যারেক্টার!
বাদ দেও। এসব ফালতু আইটেম নিয়ে চিন্তা করে লাভ আছে? একটা ভোগাস, ডিজগাসটিং ক্যারেক্টার! সিনিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিসেস ওবায়েদুল রানা এতক্ষণ কথা বলেননি, এবার যতি টানতে চান। কিন্তু রসদ এত উপভোগ্য যে, টানা চলতেই থাকে, শর্মিলা রহমান পাল্টা বলল, ভোগাস বলছেন কি? ও তো কথাই বলতে জানে না। মিটিংয়ে শুধু হাঁ করে বসে থাকে। মাগো! সেদিন যে ক্লায়েন্টের সামনে কী হলো! দুই ঘণ্টার মিটিংয়ে একটা টুঁ শব্দ নেই।
নেও কেন ছাগলটারে। আমি তো কোনোদিনই ডাকি না।
পারভেজ সারোয়ারের উষ্মা, বোম মারলেও মিটিংয়ে কথা বাইর হয় না।
কাজ কিন্তু ভালোই করে। শর্মিলা রহমান বলার চেষ্টা করল।
কাজ দিয়া কি ফালাইবি! মিটিংয়ে যদি কথাই বলতে না পারল! আমার অফিস হইলে শালারে কবে ঘাড় ধাক্কা দিয়া বাইর কইরা দিতাম! মেজাজ আর কিছুতেই ঠিক রাখতে পারে না পারভেজ সারোয়ার।
শর্মিলা রহমান যেন তাতে আর একটু ঘি ঢেলে দিতে চায়, পার্টিতে নিয়া যাস না কেন? একটু স্মার্ট বানা।
পারভেজ সারোয়ার হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারে না। রাগ তখনও তুঙ্গে, ওইসব পার্টিতে যাইতে হইলে অরে আরও চৌদ্দবার জন্ম লইতে হইব বুঝলি! একটা গেঁয়ো ভূত!
ভুঁড়িটা নিয়া যখন নাচব! ওহ্ কী দৃশ্য!
ওহ! ভুঁড়ি হইছে নাকি?
হ। একটু!
তর তো সবদিকেই খেয়াল আছে, অ্যা!
হি হি করে হাসতে হাসতে প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে শর্মিলা রহমান, মাগো! একটা সার্কাস!
জিনিসপত্রও তো মনে হয় কিছু নাই। খোঁজ নিয়া দেখিস তো!
যাহ্! ফাজিল! শর্মিলা রহমান কপট লজ্জা পাওয়ার ভান করে, কিন্তু হাসির উচ্ছ্বসিত ধারায় ওর লজ্জা কোথায় ভেসে যেতে চায়। সে-হাসির ধারাকে কিছুতেই আর থামাতে পারে না। পারভেজ সারোয়ার ওকে থামানোর চেষ্টা করে, এই থামবি। মার দেব কিন্তু! এত হাসস ক্যা?
শর্মিলা রহমান হাসতে হাসতেই ওর দিকে তাকিয়ে ঘনিষ্ঠ স্বরে বলল, মারবি? মার!
হ। মারুম নে তরে। আগে খবরটা আইনা দে।
কী খবর?
কিষানের জিনিস আছে, না নাই?
বাইত যা ফাজিল। তুই খবর নিতে পারস না?
আরে ক্যামনে নিমু? আমি কি হোমো?
ও যদি হোমো হয়? আমারে তো পাত্তা দিব না।
তুইই পারবি। সিরিয়াসলি। তোর সাথে ফেসবুকে আছে না? ইনবক্সে যা। বুঝলি? ছবি দিতে কইবি।
যা। তুই বাইত যা। ফাজিল একটা। শর্মিলা রহমান সিরিয়াস হওয়ার চেষ্টা করে। কাজে মন বসাতে চায়। কিন্তু পেটের মটকা ফুটে হাসি ঠেলে বেরিয়ে আসে। পারভেজ সারোয়ারও নিজেকে নিবৃত্ত রাখতে পারে না।
অ্যাই! তোমরা কী শুরু করছ। বলতে বলতে ওবায়দুল রানাও হাসিতে ফেটে পড়ে।
মালিক পক্ষের পর অফিসে যারা টপ লেভেলে, সেই ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর কলকাতার প্রসূন দত্ত এবং সিনিয়র ভিজ্যুয়ালাইজার মাসুদ রহমান কিষানের ব্যাপারটা অফিস আওয়ারে এড়াতে পারলেও লাঞ্চ করতে যখন একটা সেমি চাইনিজে একত্রিত হলো, অনিবার্যভাবেই যেন কিষান প্রসঙ্গটা এসে পড়ল। প্রসূন দত্তের মধ্যে একটা বাড়তি বাকুম বাকুম ভাব লক্ষ্য করা যায়। সিগারেটের প্যাকেট মাসুদ রহমানের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, সেই জন্যই বলি, বেশি বাড়াবাড়ি ভালো নয়।
মাসুদ রহমান তার বিশেষ কায়দায় সিগারেটে আগুন ধরিয়ে জানতে চায়, কার কথা বলছ?
ওই যে বোকচোদ! কাল মিটিংয়ে যে নাটক করল!
ওহ কিষান! মাসুদ রহমান শিস দেওয়ার ভঙ্গিতে মুখ গোল করে সেই সরু গলিপথে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ব্যাপারটাকে উড়িয়েই দিতে চায়, কিন্তু নাটক তো জমাতে পারল না।
ও জমাবে নাটক! কী বলছ! একটা হোপলেস! কী করতে যে এসব লোকজন অফিসে রাখে, প্যাথেটিক!
তোমাকে তো দেখি অসম্ভব রেসপেক্ট করে। মাসুদ রহমান অফেন্স খেলে।
উপরে উপরে। ধরতে পারবি না। ইনোসেন্ট একটা ভাব নিয়ে থাকে।
মাসুদ রহমান, তাই!
প্রসূন দত্ত, তাই মানে? আমার ওপর দিয়ে মাখন খাওয়ার চেষ্টা করছে। ওই তো হায়দার বক্সিকে পরিচয় করিয়ে দিছে আফজাল বসের সাথে।
কী যে ফিল্ম বানাইব হায়দার বক্সি তা তো আমার জানা আছে। মাঝখান থেইকা আমাদের পার্সেন্টেন্সটাই লস। বলতে বলতে যেন ভেতরের জমে থাকা খেদ মুছে ফেলতেই হেসে উঠল মাসুদ রহমান। সে-হাসিতে হারাতে হারাতেই প্রসূন দত্তের আফসোসের ঢি ঢি, মুম্বাই ট্রিপটাও তো মিস হয়ে গেল! রঞ্জিত কাল রাতেও কল দিছিল।
আহারে বেচারা!
সব ট্রুপস ট্রপস স্টুডিও রেডি করে বসে ছিল!
এইসব হাবিজাবিরে কেমনে সাইজ করন যায় কও তো প্রসূনদা।
অফিসেই রাখা ঠিক না।
ক্যামনে কি?
লম্বা টান দিয়ে সিগারেটের সুকাটা এসট্রেতে মুড়ে দিয়ে প্রসূন দত্ত দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, দ্যাখ কী করি!
তার ছিঁড়া। তার ছিঁড়া। অফিসের পিয়নরাও এভাবেই শনাক্ত করল কিষানকে। কেউ-বা ব্যঙ্গ করে বলল, সুস্থ! সুস্থ!
কিন্তু নিজের সম্পর্কে কেন কিষানের এন্তার অভিযোগ? তার কোনো সন্তোষজনক জবাব খুঁজে পাওয়া যায় না। সে প্রসঙ্গটি তোলেই না কেউ। ও যে অস্বাভাবিক কিংবা ধড়িবাজ বা চালাক তাও প্রমাণিত হয় না। অন্তত বিহেবিয়ার অ্যাটিচ্যুড এসবের কারণে। অফিসের উপরি স্তর থেকে নিম্ন স্তর পর্যন্ত প্রতিটি সদস্য ওর প্রতি একধরনের গভীর পর্যবেক্ষণে কাটায়। কিন্তু ওরা কিষানকে বুঝতে ব্যর্থ হয়। বোধ হয়, কিষান নিজেও যে এ বিষয়ে নির্মোহ সে কারণে। আর স্বাভাবিকভাবেই বার্ষিক রিভিউ মিটিংয়ে ও কী বলেছে না বলেছে, তা নিয়ে উত্তেজনাও ক্রমশ ঝিমিয়ে আসে। কিন্তু কিষান বলে কথা। এর দশ কি বারো দিন পর আবারও পুরো অফিসটা ওর প্রতি আগের মতোই কৌতূহলী হয়ে ওঠে টেলিফোন অপারেটর কাম অফিস ইনচার্জ, ফ্রন্ট ডেস্ক মুশতারি বেগমের কারণে।
এটা সত্য যে মোবাইল ফোন আসার আগে মুশতারি বেগমের যে-রকম দাপট ছিল, অফিসের মধ্যে, তার অনেকটাই আজ ভাটা পড়েছে। কেউ এখন আর তার-তরঙ্গে কথা বলার জন্য ওর ওপর নির্ভরশীল নয়। এক দু’বার হয়তো লাইনটা চাওয়ার পর নিজেদের কথাবার্তা মোবাইলেই সেরে নেয়। তা সত্ত্বেও টেলিফোন অপারেটিংয়ের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি অফিস ইনচার্জ ইন ফ্রন্ট ডেস্কের অতিরিক্ত দায়িত্ব নিয়ে নিজের গুরুত্ব অনেকটাই পুনরুদ্ধার করেছে মুশতারি। এই যেমন পিয়নরা কে কোথায় কখন কোন ডিউটিতে যাবে না-যাবে তা তদারকি করা, কোথায় গেল না-গেল, ওর কাছে থাকা খাতায় সাইন না-করে যেতে পারবে না। অফিসের অন্যান্য কর্মকর্তার জন্যও একই ব্যবস্থা বলবৎ করা রয়েছে। তাই চল্লিশোর্ধ সুন্দরী স্মার্ট মুশতারি বেগমকে মোটামুটি সবাই একধরনের সমীহ করেই চলে। সেই মুশতারি বেগমই হঠাৎ একদিন লাঞ্চ আওয়ারে ক্রিয়েটিভ সেকশনের আন্দালিব রহমানকে ঠাট্টা করেই বলল যে, আপনাদের রুমের মানুষগুলো জানি ক্যামবা ক্যামবা।
কেন কী হইছে! আমাদের ডিপার্টমেন্টের কেউ কি কোনোদিন আপনার পাতের ভাগ থেকে কোনো মাছ উঠিয়ে নিছে নাকি আপনার পাকা ধানের ক্ষেতে মই দিছে। এই কথা বলতে বলতে আন্দালিব সত্যি সত্যি মুশতারি বেগমের পাত থেকে ইলিশ মাছের ভাজাটি ভেঙে অর্ধেক নিজের পাতে তুলে নেয়।
আরে পুরাটাই নেন না, পুরাটাই নেন।
না না। মুশতারি আপা, ইলিশ মাছ আমি খাই না। অ্যালার্জি।
আরে নেন নেন। একদিন খেলে কিছু হবে না। বেশ কিছুক্ষণ জোরাজুরি করতে করতে শেষে মুশতারি বেগম শুরুর কথায় ফিরে আসে, আপনাদের কিষানের কী হইছে, বলেন তো?
ক্যানো কিষান ভাইয়ের আবার কী হবে?
দ্যাখেন গা, খোঁজ নিয়া। একসাথে বসেন। কোনো খবর রাখেন না।
ক্যান কিষান ভাই তো ঠিকই আছে। আমার কাছে তো সেই রকমই লাগতেছে!
মোবাইলে কল দেন তো!
কেন?
দেন না কল।
খাওয়ার মধ্যেই জোর করে আন্দালিবকে দিয়ে কল করায় মুশতারি বেগম। কলটা কিষানের মোবাইলে ঢোকে না। কিছুতেই না। বারবার চেষ্টায়ও।
আজ কয়দিন ধরেই তো মোবাইল অফ। প্রমাণসাপেক্ষে কথাটা জানান দেয় মুশতারি।
নিজের অজ্ঞতায় লজ্জা পায় আন্দালিব। ও একটা যুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা করে, একসাথে বসি তো, কল দেওয়ার প্রয়োজন হয় না।
ফেসবুকও তো ডিঅ্যাকটিভ, আপনার সাথে আছে না?
হ্যাঁ। আছে তো।
আবার একসাথে বসেন। কোনো খবরই রাখেন না।
আন্দালিব রহমান মাথা চুলকায়, খবর নিতে হয় তো।
হ হ। খবর নেন। ওদের আশপাশে থাকা অন্যান্য কলিগরা, যারা এতক্ষণ কথা শুনছিল, তারাও ঝাঁকি খায় এবং নতুন করে কিষানকে নিয়ে কৌতূহলী হয়ে ওঠে। ব্যাপারটা কী? ফেসবুক মোবাইল ফোন সব অফ করে রেখেছে কেন ছেলেটা। আবার নতুন করে ফিসফাস শুরু হয়ে যায় অফিসের রুমে রুমে, বিড়ি-সিঁড়ি, নিচের চায়ের দোকানে।
বিড়ি-সিঁড়ি চত্বরে কথাটা ফ্লোর পেতে সময় নেয় না। সবাই লিফটেই চলাফেরা করে বলে সিঁড়িমুখে তেমন কেউ একটা যায় না। চারতলা এবং পাঁচতলা জুড়ে পান্থজনা অ্যাডভার্টাইজিংয়ের যে মানুষগুলো সিগারেট খায়, অথবা পাঁচ বা দশ মিনিটের জন্য ছোট্ট একটা ব্রেক নিতে চায়, তারা চারতলার সিঁড়িতে আর সিঁড়িমুখে বসে সিগারেট টানে, ধোঁয়ার আড্ডায় ক্ষণকালের জন্য ভেসে যেতে চায়। ক্রিয়েটিভের ছেলেরা ‘বিরিশিরি’র আদলে জায়গাটার নাম দিয়েছে বিড়িসিঁড়ি। সেখানেই একজনের সঙ্গে আরেকজনের কথোপকথনে চাউর হয় যে, কিষান তো নিজেরে একেবারে কানা কইরা রাখছে। মোবাইল, ফেসবুক সব বন্ধ করে রেখেছে। এদিকে-সেদিকেও যেন কম যায়। কম কী, কোথাও কোনো অনুষ্ঠানে আড্ডায়ও তো ওকে আজকাল একেবারেই দেখা যায় না। কারণটা কী? কারণটাও কেউ বের করতে পারছে না। রুমের কলিগরা বহু চেষ্টা করছে। এত যে কিষান নিজের সম্পর্কে ফ্রি স্টাইলে উল্টাপাল্টা কথা বলে বেড়ায়, সেও এ-বিষয়ে মুখে একেবারে কুলুপ এঁটে বসে আছে। ব্যাপারটা নিয়ে কৌতূহল যখন উত্তুঙ্গ হয়ে ওঠে এবং বাড়বাড়ন্ত হয়, তখন মুশতারি বেগমই একদিন তাতে যেন আরও ঘি ঢেলে দেন। আবার লাঞ্চ আওয়ারেই সে বোমা ফাটায়।
পারভেজ ভাই। হট নিউজ।
ভাত-ভরা চামচটা আর মুখে ঢোকানো হয় না পারভেজ সারোয়ারের। গভীর কৌতূহলে জানতে চায়, কার? সানি লিওনের?
আপনে তো আছেন এক তালে।
চামচের ভাতগুলো মুখে থুয়ে, চামচটা আবার প্লেটে এনে মুরগির পিস থেকে একটু পিস বের করে ঝোলসমেত মুখের ভেতর থুয়ে আসা ভাতের সঙ্গে ভরিয়ে চিবুতে চিবুতে পারভেজ জানতে চায়, কেন কী হইছে? কার হট নিউজ?
আপনাদের কিষান ভাইয়ের।
ক্যান, ওর আবার কি হইলো? ও তো নাকি সব মেশিনপত্র বন্ধ করে রাখছে।
কোন জায়গার একটা ছেড়ি বারবার আমারে কল দেয়। কিষানরে খোঁজে।
খুঁজতেই পারে। অসুবিধা কী?
সেখানেই তো কবি নীরব। কিষান তো কোনোভাবেই মেয়েটার সাথে কথা বলবে না। উল্টা আমারে ধমকানি। কীভাবে মেয়েটা অর অফিসের নাম্বার পাইল? আচ্ছা, পারভেজ ভাই বলেন তো, আমি ক্যামনে কমু, মেয়েটা নাম্বার কীভাবে পাইছে? আমার কী জানার কথা?
তারপর? খুব ইন্টারেস্টিং মনে হইতেছে।
ওদিকে মেয়েটা তো আমার মাথা নষ্ট করে ফেলল- কিষানরে দেন কিষানরে দেন। কিষানও তো সেই রকম। কথা বলবেই না। এখন নায়িকা তো অফিসে আসতে চায়।
ওয়েলকাম। আসতে দেন। আমরা একটু দেখি। কী বলো সরফরাজ।
সরফরাজ খাওয়া ছেড়ে ওদের কথা শুনছিল। খ্যা খ্যা করে হেসে উঠল। হ। ভালাই তো হয়। পারভেজ ভাইয়ের পছন্দ হইলে মডেলিংও করান যাইব।
মালটা কেমন? পারভেজ সারোয়ার মুশতারি বেগমের দিকে তাকিয়ে সিরিয়াস হয়ে উঠল।
আপনে আছেন মিয়া আপনার তালে।
না না, কন না, কেমন? কচি?
আমি কি দেখছি নাকি? আমার সাথে কথা হয় ফোনে।
আরে মুশতারি আপা। আপনি নিজেরে আপডেট করেন তো। এসব জিনিসের সাথে কথা কইবেন ভিডিওতে। বুঝলেন?
জি না। আমি এত বেশি বুঝতে চাই না।
আচ্ছা। ভিডিওতে কথা বলার দরকার নেই। কাল আসতে কন অফিসে। সামনাসামনি দেখি।
মিঠু ভাইয়ের কথা মনে নাই? জিন্নাহ ভাইয়ের কথা?
পারভেজ সারোয়ার হো হো অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। হাসির ধকল সামলাতে সামলাতেই বললেন, মনে না থাইকা উপায় আছে। অফিসের যারা পুরনো তারাও মজা পায় পারভেজ আর মুশতারির কথায়। তারাও মজা পেয়ে ওদের সঙ্গে হাসিতে মেতে ওঠে। আর যারা জানে না, অফিসে জয়েন করেছে পরে, তারা কিছু না বুঝেই হাসে, কেউ ফ্যালফ্যাল করে বোকার মতো শুধু তাকিয়ে থাকে। অগত্যা আর কি, মুশতারি আর পারভেজ সারোয়ার দু’জনকেই বিশদ ভেঙে বলতে হয় যে, মিঠু আর জিন্নাহকে নিয়ে অফিসে কী হয়েছিল, কেমন কেলেঙ্কারি!
ইয়া উঁচা লাম্বা একটা ধুমসি মাইয়া বুঝছ সরফরাজ, তার ওপর আবার জিনসের প্যান্টশার্ট পরা, একদিন অফিসে আইসা মুশতারি আপারে বলে কী, মিঠু কি অফিসে আছে? আসতে বলেন তো। তো মুশতারি আপাও কী সুন্দর ইন্টারে কল মারলো। তো মাইয়া আসছে শুইনা মিঠু তো লাফাইতে লাফাইতে ছুইটা আসলো। তারপর বিশ্বাস করবা নারে ভাই, আসামাত্র পোলাটার সেন্টার পয়েন্ট লক্ষ্য কইরা মাইয়াডা এমন একটা লাথথি মারলো, এমন জোরে, পোলাটা এক্কেবারে দশ হাত দূরে গিয়া পড়ছে। তাই না মুশতারি আপা।
কার ওপর পড়লো? সেইটা তো বললেন না।
হ। কার ওপর পড়ছে জানো? সেদিন একজন ক্লায়েন্ট ছিল অফিসে। আফজাল বস গেটের দিকে আসতেছিল সেই ক্লায়েন্টরে বিদায় দিতে। মাইয়ার লাথথি খাইয়া মিঠু পড়ল সেই ক্লায়েন্টের ওপর। বুঝো ঠ্যালা! মিঠুর কি আর চাকরি থাকে? চাকরি নট।
কিন্তু কারণটা কী, এভাবে অফিসে এসে একটা ঘটনা করল? জানতে চায় সরফরাজ।
কারণ তো ওই একটাই। মাইয়া রে ভুলাইয়া ভালাইয়া, বুঝো নাই? তারপর কাট্টি মারছে। মাইয়াও কি ছাড়ে? অফিসে আইসা পাকড়াও করছে। আর জিন্নাহ ভাইয়ের কেসটা মুশতারি আপা আপনে কন।
না না। আপনেই বলেন।
এইটাও পরকীয়া সংক্রান্ত। নায়িকার নামটা কওন যাইব না। কোনো কোনো বোকাচাঁদ থাকে না শুক্র শনি নাই, ছুটির দিনেও অফিসে আইসা বইসা থাকে, রাত দশটা এগারোটা পর্যন্তও তাগো কাম শ্যাষ হয় না। বসরাও খুশি, প্রমোশন বেতন সবই বাড়ে। তো ওই নায়িকা আর জিন্নাহ আপারও ওই কেস। তারপর শোনো, এক শনিবারে জিন্নাহ ভাইয়ের বউ মানে আমগো হাসনা ভাবি অফিসে আইসা হাজির… হি হি… হাসির ধকলে আর কথা শেষ করতে পারে না পারভেজ সারোয়ার। ভাবি তো অফিসে আসল। সেদিন অফিসে মুশতারি আপা ছিল না, শনিবার তো! অফিস ছুটি। আমি ছিলাম আরও চার-পাঁচজন ছিল, তারপর কী হইল, হঠাৎ শুনি ক্রিয়েটিভ রুমে হাউকাউ চিল্লাচিল্লি। হাসনা ভাবি সেই নায়িকারে ধামধুম পিটাইতাছে, চুল ধইরা টানাটানি, বুঝছ। তারপর জিন্নাহরেও কি ছাড়ে? মলাই ধলাই। চিমটি, রামচিমটি। মহিলা যে কি চিমটি দেয়। জিন্নাহ বেচারা তো কয়দিন মুখই দেখাইতে পারে নাই। তারপর থেইকাই তো অফিসে এক্সেস ডোর লাগাইছে। কি ঠিক না মুশতারি আপা, যেন বাইরের কোনো মাইয়ারা আইসা হঠাৎ কাউরে অ্যাটাক করতে না পারে। হি হি হি, মেয়ে গো ডরে বুঝলা! ফিঙ্গার প্রিন্ট নাই তো কী করব! বাইরে দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া আঙুল চোষো।
মুশতারি বেগমও খি খি হাসতে থাকে। হাসতে হাসতে বলে, যাতে আপনারা ভালোমতো পরকীয়া করতে পারেন। খি খি। তারপরই তো আফজাল বস কড়া একখান সার্কুলার দিছে, বাইরের যারে-তারে জানি অফিসে অ্যালাউ না করি।
পারভেজ সারোয়ারের আকুতি তবু থামে না, মুশতারি আপা মেয়েটাকে একটু দেখব না? চেখে না দেখলাম, চোখে দেখি। আসতে কন।
না না। এই মেয়েরে অফিসে আসতে বলা যাবে না। দেখি। আপনার সঙ্গে বাইরে কোথাও ফিট করানো যায় কিনা।
সত্যি?
হুম। সত্যি।
নাহ। মেয়েটা বাইরে বসতে রাজি হয় না। অন্য কারও সঙ্গে তো নয়ই। ওর শুধু কিষানকে চাই। কিষান ছাড়া ও আর কারও সঙ্গে কথা বলবে না। কেন ও কিষানের সঙ্গে দেখা করতে চায়, কী বলতে চায়, এসব নিয়েও উত্তর দেওয়ার ওর কোনো আগ্রহ নেই। এসব নিয়ে বেশি চাপাচাপি করলে মেয়েটি কল কেটে দেয়। পরের দিন বা তার পরের দিন আবারও কল দিয়ে কিষানের সন্ধান করে। আর ব্যাপারটি নিয়ে কৌতূহলও যেন বাড়তে থাকে। পারভেজ সারোয়াররাও আরও অধিক তৎপর হয়ে ওঠে। গুলশান-তেজগাঁও লিংক রোড সংলগ্ন একটি বহুতল ভবনের সুউচ্চ চূঁড়ায় এক বার-কাম-রেস্তোরাঁয়, যেখান থেকে হাতিরঝিলের চক্কর-পথের প্রায় এক-তৃতীয়াংশই দেখা যায়, সেখানে এক সন্ধ্যায়, অফিসের সিইও আফজালুর রহমান, পারভেজ সারোয়ার আর শর্মিলা রহমান অফিস নিয়েই এক গোপন মিটিংয়ে বসে, যখন এক দুই প্যাগ হুইস্কির ঝাঁজালো স্বাদে নেশাগ্রস্ত হতে শুরু করেছে, তখনই পারভেজ সারোয়ার হাসতে হাসতে আবারও কিষানের কথাটা উঠায়, বস। শর্মিলাকে তো একটা অ্যাসাইনমেন্ট দিছিলাম। ফেল করল।
শর্মিলা রহমান ও আফজালুর রহমান দু’জনই হঠাৎ কৌতূহলী হয়ে ওঠে, কি ফেল করল? ও তো ফেল করার মতো মেয়ে নয়।
তখন গ্লাসটায় একটা জোর চুমুক দিয়ে পারভেজ সারোয়ার বলল, ওরে দায়িত্ব দিছিলাম কিষানের জিনিসটা আছে কি নাই ইনবক্সের মাধ্যমে বের করে আনতে। বস ও পারল না।
শর্মিলার হাসতে হাসতে খুন হওয়ার অবস্থা। বস আমি চেষ্টা করেছি। ওর তো এখন আইডিই নেই। ফেসবুকে বসে না। আমি কী করব?
আফজালুর রহমান সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলার চেষ্টা করল, দাঁড়াও ওরে আমি ফেসবুকে অ্যাকটিভ করতেছি। ডোন্ট অরি পারভেজ!
পারভেজ সারোয়ার সিরিয়াস হয়ে ওঠে, বস। এটা কিন্তু আরেকটা কেস। কিষান ফেসবুক বন্ধ করে রাখছে কেন, জানেন সেইটা? ফেসবুক ডিঅ্যাকটিভেটিভ, মোবাইল অফ।
কেন? কী হয়েছে ওর?
সেইটাই তো দেশ ও জাতির প্রশ্ন। তবে ক্লু একটা পাওয়া গেছে বস। কোন জায়গার একটা কচি মেয়ে নাকি কিষানের সঙ্গে কথা বলতে চায়, দেখা করতে চায়। মুশতারি আপারে ডেইলি ফোন মারে। কিষান ধরা দেয় না। বস কেন ধরা দিচ্ছে না এইটাও তো একটা রহস্যময় ব্যাপার, তাই না?
অবশ্যই। শর্মিলা তুমি একটু দেখো না, কোথাও কিষানকে নিয়ে বেড়াতে যাও, বুঝলা নাÑ সব বাইর করতে পারবা।
বস এত ক্ষ্যাত!
আরে ইয়ার! এইটা তোমার জব। খরচ আমি দেবো। তোমার শালা একটা ট্যুর হয়ে যাবে। পারভেজ কী বলো।
হুইস্কির শীতল এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বরফখণ্ড নিজের জিভের ভেতর নিয়ে খেলতে খেলতে শর্মিলা রাজি হওয়ার ভঙ্গিতে সায় দেয়, আচ্ছা! ঠিক আছে। পড়েছ মোগলের হাতে, খানা খেতে হবে সাথে।
পারভেজ সারোয়ার নতুন আরেক পেগ গ্লাসে ঢালতে ঢালতে সিরিয়াসলি জানতে চায়, কিষান সম্পর্কে ডিটেইলস জানতে আমাদের কতদিন অপেক্ষা করতে হবে শর্মিলা?
জিভে লুক্কায়িত বরফ খণ্ডটা আমূল গলার ভেতরে নিতে নিতে শর্মিলার উদাস স্বরÑ দেখি, কোনো বসন্ত খুঁজে পাওয়া যায় কিনা!
হামিদ কায়সার : কথাসাহিত্যিক
#