গল্প : ফেরা না ফেরার সন্ধ্যা : ইমতিয়ার শামীম

ইমতিয়ার শামীম ।।
বারান্দায় সেদিন দিন চারেক বাদে আবারও উঁকিঝুকি মারছে একটু-আধটু ঠান্ডা বাতাস। কিন্তু চরিত্রহীন কোনো পাখির ঠোঁট থেকে খসে পড়া বীজ বাঁজা মাঠের স্নেহপ্রেমে কতটুকুই-বা আর বেড়ে উঠতে পারে। ছন্নছাড়া, হতভাগা কড়ইগাছটার যথেষ্ট উস্কানি থাকার পরও তাই মাঝে মধ্যে থেমে যাচ্ছিল সেই বাতাস। পাড়ার ছেলেরা সেটার নিচে বসে চেষ্টা করছিল খড় দিয়ে তাগড়া একটা ফুটবল বানাবার। ওদিকে ঘরের মধ্যে বসে আধহাত জিভটাকে সিকি হাত করার চেষ্টা চালাতে চালাতেই ফের মাছি তাড়ানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল মোশাররফের নানি। ঠিক ওই সময়েই প্রচণ্ড গুলির শব্দ ভেসে আসতে শুরু করলে আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, সত্যিই যুদ্ধ লেগেছে।
আমরা মানে আমি আর মাবিয়া। এ গাঁয়ের লোকজন আমাদের দুই সই বলে জানে। আরও জানে, খাওয়া আর ঘুমের সময়টা বাদে আমরা নাকি একসঙ্গেই থাকি। এই যেমন যুদ্ধ লাগার সময়Ñ মানে গুলির আওয়াজ ভেসে আসার সময়। একাব্বর মাওলানা অবশ্যি যুদ্ধের ব্যাপারটা মানতে নারাজ। এখনও প্রতিদিন সে তার নিজস্ব ট্রানজিস্টর বাজিয়ে চলেছে, ‘কিসের যুদ্ধ? দুই-চারটা ফাচুক পোলাপান চার-পাঁচটা ফটকা ফুটালেই কি আর যুদ্ধ লাগে? যুদ্ধ অতই সোজা? যুদ্ধ করছিল ব্রিটিশরা, যুদ্ধ করছিল জার্মানরা। বাপ রে বাপ, কোনকার সেই জাপানে বোমা ফেলাইত- এইখানে বইসা তার আওয়াজ পাইতাম। কী মোল্লার ব্যাটা, পাইতাম না? যুদ্ধ হইল ওইরহম।’ এখন এই ঠা ঠা দ্রিম দ্রিম আওয়াজ শুনতে শুনতে তার ওই রকম না কোন্ রকম যুদ্ধের কথা মনে হচ্ছে, কে তা জানে! আমরা তখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে কেবলই ভিটার গড়ান বেয়ে ক্ষেতের মধ্যে নেমেছি। মাবিয়ার চোখ একটা দইনাচা পাখির দিকে আটকে গেলেও আমি তাকে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছি দক্ষিণপাড়ার দিকে। উনিশ ঘর মানুষ আমাদের এই গাঁয়ে। কিন্তু কোনো বাড়ির চুলায়ই একটু আগুন নেই। চুলাভর্তি ছাই, কিন্তু তার কোনোখানে একটু-আধটু আগুনের উস্কানিও নেই। ঘরের সামনে কাঁঠালগাছের নিচে ন্যাটা দিয়ে বসে বাঘবন্দি খেলছিলাম আমি আর আগুন আনতে মা আমাকে দক্ষিণপাড়ায় যেতে বলল। সেখানেও যদি আগুন না পাওয়া যায়, তা হলে যে আরও কত গাঁয়ে ঘুরতে হবে, তা বলা মুশকিল।
কিন্তু দক্ষিণপাড়া পর্যন্ত আর যেতে হলো না। গুলির শব্দ শোনা গেল- তারপর আগুনও দেখা গেল না জানি কোন গাঁয়ে।
আমি আর মাবিয়া ঘুরে বাড়ির দিকে দৌড় দিলাম। মানুষজন হই হই রই রই করে বেরিয়ে আসছে ঘরবাড়ি ছেড়ে। কে জানে মোশাররফের নানি এখনও তার আধহাত জিভটাকে সিকি হাত করার চেষ্টা করছে কি-না। আমার গড়ান বেয়ে গাঁয়ের ভিটায় আর ওঠা হলো না। দেখলাম মা, আব্বা আর দাদা লাফিয়ে লাফিয়ে নেমে আসছে। বাবার কাঁধের ওপর ফুল-পাখি-লতা আঁকা টিনের মাঝারি ট্রাঙ্কটা। দাদা তার হাতে নিয়েছে বাঁশের বড় ঝুড়িটা আর মার কাঁখে একটা বড় বোঁচকা। ছোটখাটো আরও দু-তিনটা বোঁচকা নিয়ে পিছে পিছে আসছে ভাইজান আর বুবু। আশ্চর্য, আমার ছোট টিনের বাক্সটা কারও হাতে নেই।
নেই, নাকি ইচ্ছা করেই আনেনি? আমি প্রশ্ন করতে যাব। কিন্তু ‘চল- চল-’ বলে মা তার শক্ত মুঠিতে আমার হাতটা চেপে ধরে হেঁচকা টানে আমাকে টেনে নিলো নিজের কাছে। তারপর মাবিয়াকেও বলল- ‘ও মাবিয়া, আমাগারে সাতেই চলো, তোমার বাপ-মাক পরে খুঁইজা বাইর করমুনি।’
মাবিয়া একটু ইতস্তত করে। এই তো এই ভিটা পেরিয়ে ওই ভিটাতেই বাড়ি তাদের- কী এমন সময় লাগবে যেতে! কিন্তু মা আবারও তাড়া দেয় তাকে, ‘অ্যাহন যায়্যা লাভ নাই। যে যেমুহে পাইরতেছে পালাইতেছে। এহন গেলি হারাইয়া যাইবার পারো।’
আমি আর টিনের ছোট বাক্সের কথা বলার সুযোগই পেলাম না। মার সঙ্গে পা মেলাতে গিয়ে বার বার হিমশিম খেতে লাগলাম। কখনও হাত ফসকে যাচ্ছে, দৌড়াতে দৌড়াতে আবারও শক্ত করে ধরছি মায়ের হাত। কখনও মা দাঁড়িয়ে পড়ছে- যাতে আমি এসে ধরতে পারি তাকে। মাবিয়া এখন আর কার হাত ধরবে! কাঁদতে কাঁদতে দৌড়াচ্ছে ও আমাদের সঙ্গে। কিছুতেই হাতছাড়া করতে চাইছি না ওকে। কিন্তু আলপথে চলার সময় আপনাআপনিই পিছে কিংবা সামনে পড়ছে ও- খুলে পড়ছে আমার আর মাবিয়ার হাত। এই আলপথ দিয়ে তো কতদিন কত দৌড়াদৌড়ি করেছি- কখনওই হয়রান হইনি। কিন্তু বুঝতে পারছি না, আজ এত হয়রান হয়ে যাচ্ছি কেন। বুঝতে পারছি না, কেন এত ক্লান্তি এসে জাপটে ধরছে, কেনই-বা এত হোঁচট খাচ্ছি আজ। ওদিকে আকাশটা কেবলই লাল-কালো হয়ে উঠছে। মানুষজন তা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে আর হঠাৎ আবারও গুলির শব্দ হতে না হতেই চিৎকার করতে করতে দৌড়াচ্ছে সামনের দিকে। সামনে মানে সামনে- অনন্তশূন্য এক ফসলের প্রান্তরে। দূরে সারি সারি গাছের আভাস। কিন্তু সেখানে কতদিনে কীভাবে গিয়ে পৌঁছানো যাবে, সেটা আমার পক্ষে বলা সম্ভব না।
‘অ্যাল্লা দাঁড়ান না’- হঠাৎ করেই কাতর কণ্ঠে বলে ওঠে মা। আর আমি খেয়াল করি, আমার হাতকে আঁকড়ে ধরে রাখা তার আঙুলগুলো আলগা হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। আপনা-আপনিই তার কাঁখ থেকে গড়িয়ে পড়ল বিশাল বোঁচকাটা। আর মা ধপাস করে বসে পড়ল আইলের ওপরে। পেছনের এক-দুইজন ‘ওঠো, ওঠো’ বলে টেনে তোলার চেষ্টা করল তাকে। তারপর চলে গেল পাশ কাটিয়ে। দূরে- অনেক দূরে রেলস্টেশনের দিকে যে সড়কটা চলে গেছে, তার ওপর দিয়ে তখন একটা পাক আর্মি বোঝাই গাড়ি আসছে দেখা গেল। বুঝতেই পারছি, খুব কষ্ট হচ্ছে মার- কিন্তু এই সুযোগে আমি আর মাবিয়াও একটু জিরিয়ে নেওয়ার জন্য মার পাশে বসে পড়ি। বুবুও নিজের বোঁচকাটা নামিয়ে বসে মায়ের পাশে। তারপর আব্বা আর দাদা পিছ ফিরে এগিয়ে আসছে দেখে বলে- ‘মনে কয় ব্যথা উইঠছে।’
‘হায়, হায়, কী কও তুমি!’
বিকেলের আলোয় আব্বার মুখ বড় বিবর্ণ লাগে। বিবর্ণ লাগে ভাইজানকেও। বয়স ১২-১৩ হলেও এসব কমবেশি আমিও বুঝি। আর তাই আরও বেশি বোঝার জন্য চুপচাপ থাকি আর দেখি। মা তো একদিন আমার এক প্রশ্ন শুনে বলেই দিয়েছে, বয়স বাইড়লে এইসব একা একাই বুইঝতে পাইরবা। অতএব আমি কিছু না বলে একা একাই এসবের হিসাব-নিকাশ করি। আকাশের দিকে তাকিয়ে টের পাই, এইবার আমাদের গাঁয়েও আগুন জ্বলে উঠল। গাঁয়ে এখন আর কাকপক্ষীও নেই। নাকি অন্তত একাব্বর মওলানাটা আছে? কিন্তু থাকার তো কোনো কারণ দেখি না। যতই আওয়াজ দিক না কেন, সটকে পড়তে ওস্তাদ এই লোকটা। একবার গাঁয়ে হারু মিয়ার বাড়িতে গরুচোর এসেছিল। ‘ধর, ধর’ বলে একাব্বর মওলানা দূর থেকে অনেক আওয়াজ দিলো ঠিকই; কিন্তু এক পা-ও এগুলো না। বরং দেখা গেল, কোন সময় সে যেন কেটে পড়েছে। এই রকম আগুন আর গোলাগুলির মধ্যে সে আর বসে আছে নাকি! মনে হয়, সে-ও পিঠটান দিয়েছে।
কিন্তু আমরা এখন যাই কোনখানে? তাও এই চার মাসের পোয়াতি মাকে নিয়ে? বিকেল গড়িয়ে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সন্ধ্যা নেমে আসবে। সন্ধ্যা যত এগিয়ে আসছে, আকাশের আগুন তত স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আচ্ছা, আমাদের বাড়িতেও কি আগুন লেগেছে? আমাদের টিনের ঘরে? তা হলে তো আমার বাক্সটাও পুড়ে গেছে! বুকটা কেমন হু হু করে ওঠে। গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে। কিন্তু এই পরিস্থিতির মধ্যে কাঁদি কেমন করে! আষাঢ়ী ধান বোনার জন্য চাষ করা ক্ষেতের মাটির ওপর বুবু কাঁথা বিছিয়ে দিয়েছে। তার ওপর শুয়ে কাতরাচ্ছে মা। কাতরাতে কাতরাতে বলছে, যারা চইল্যা যাইতেছে, তাগারে কয়্যা দে জামাল, মাবিয়ার মা-বাপের সাতে দেখা হইলে য্যান কয়, ও আমাগারে কাছে আছে।
মানুষজন আশপাশ দিয়ে যেতে যেতে তাকাচ্ছে। এদের মধ্যে কতজন চেনাজানা! কিন্তু কেউ কিছুই বলছে না। দ্রুত পা চালাচ্ছে সবাই। দু-একজন কথা বললেও তা বড়জোর এইটুকু যে- ‘কী হইছে?’ তারপর উত্তর শোনার জন্য অপেক্ষা না করেই দৌড়াচ্ছে সামনের দিকে। আমার আর একটুও কাঁদা হয় না। আব্বা আর ভাইজান একটু দূরে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে কী যেন বলাবলি করছিল। দাদা বসে ছিল আইলের ওপর। স্পষ্ট শুনলাম, আব্বা তার কাছে যেতে যেতে বলছে- ‘আমরা ওই গাঁয়ের মুহে যাই- দেহি, গরুর গাড়ি না অয় চাঙ্গারি পাওয়া যায় নাহি। এইহানে তো আর থাকা যায় না।’
দাদা কিছু বলে না। খালি হাঁফায়। তাও ভালো মোশাররফের নানির মতো আধহাত জিভকে সিকি হাত বানানোর চেষ্টা করে না। আব্বা তাড়া দেয় তাকে, ‘কী কন আপনে? যাইগা, নাহি?’
এবার দাদা তড়বড়িয়ে বলে, ‘যা কইরবা তাড়াতাড়ি করো। জিজ্ঞাস করার দরকার কি?’
তার গলার জোর থেকে বোঝা যায়, রাগ এখনও কমেনি দাদার। চর আধখানে দাদার জায়গা-জমি আছে বেশ খানিকটা। একটা নাকি ছাপরাও তোলা আছে। তা ছাড়া সেই চরে লোকজনও থাকে। যদিও যাওয়া খুব মুশকিল। সেখানে যাওয়ার পথে যমুনায় ভারি এলোমেলো স্রোত বয়, পাকা মাঝি না হলে বুঝতে পারে না, নদীর পানি এখন ভাটার দিকে নাকি উজানের দিকে যাচ্ছে। যাকে বলে স্রোত- সেই স্রোতের পাঁকে পাকিস্তানিদের একটা স্পিডবোটও নাকি ডুবে গেছে দিন পাঁচেক আগে। আর সেই থেকে ভয়ের চোটে লঞ্চ নিয়েও ওইদিকে যাওয়ার সাহস আর করছে না তারা। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই দাদা বলছিল, মার যে অবস্থা তাতে তাকে নিয়ে এখন চর আধখানে চলে যাওয়া ভালো। গেল খন্দের ধান-ডাল তো এখনও আনা হয়নি, থাকা-খাওয়ার সমস্যা হবে না। পরিস্থিতি ভালো হলে আবারও চলে আসা যাবে। কিন্তু আব্বার মনে তখন তেল, চিনি, লবণ আর কেরোসিন বিক্রি করে লালে লাল হওয়ার বাসনা জেগেছে। তা ছাড়া একাব্বর মওলানা যতই বলুক, ‘যুদ্ধ লাগেনি, পোলাপান পটকা ফুটায়া কইতেছে বোমা ফুটতেছে’, জিনিসপত্রের দাম তবু বাড়ছিল হু হু করে। বাজারে একটা মনিহারি দোকান আছে আব্বার। তমিজ মিয়াদের মতো অত বড় না হোক, একেবারে ছোটখাটোও না। আটার দাম সেই আগের মতো সেরপ্রতি ১২ আনা থাকলে কী হবে, কেরোসিনের দাম ততদিনে এক লাফে তিন আনা থেকে এখন ১৩ টাকা হয়ে গেছে। আব্বা এখন দুই টাকা চার আনা সেরের সরিষার তেল পাঁচ-ছয় টাকায় বিক্রি করে আর জোরে জোরে গান গায়, ‘মোক্তেলের মাও, আগুন জ্বালাও, মশা মারি, কুন কুন করে…’। কোত্থেকে যে এইসব গান শিখে আসে আব্বা, কিছুই বুঝি না। বুঝি না কী করে, কোত্থেকে আব্বা এইসব কেরোসিন, সরিষা আর চিনি পাচ্ছে। কিন্তু এটুকু বোঝা গিয়েছিল, গাঁও ছেড়ে যেতে রাজি নয় আব্বা। মা একবার এ নিয়ে আব্বার কাছে কী বলতে না বলতেই সে ঝাড়ি দিয়ে উঠেছিল- ‘কী সব আজগুবি কতা কও? আর্মি আসুক না। তারপর দেহ্যা যাইব।’
আজকে আব্বা দেখছে, দাদাও দেখছে। দাদার ঝাড়ি খেয়ে আব্বা আর কিছু না বলে ভাইজানকে নিয়ে রওনা দেয় দূরের গাঁয়ের দিকে। যাওয়ার আগে মার দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে শুধু বলে- ‘জবার মা, আমরা চাঙ্গারি আইনতে যাইতেছি। চিন্তা কইর না।’
‘না, চিন্তা কইরবে না!’ -বলে দাদাকেও দেখি উঠে দাঁড়াতে। হাঁটতে হাঁটতে একটা বেড়া দেওয়া ক্ষেতের কাছে যায় সে। ক্ষিপ্র হাতে বেড়ার মধ্য থেকে কয়েকটা কঞ্চি টেনে তুলে নেয়। ফিরে এসে সেই কঞ্চিগুলো শুয়ে থাকা মায়ের চারপাশে গুঁতিয়ে গুঁতিয়ে পুঁতে দেয়। তার পর হাঁফাতে হাঁফাতে তাকায় আমার আর মাবিয়ার দিকে, ‘কাজ হয়্যা যাইবে, না কী কস?’
বলে দাদা বুবুকে একটা বোঁচকা এগিয়ে দেয়, ‘একটো শাড়ি বাইর কইরা চাইরমুহে প্যাঁচায়া দে।’
বুবু মার পিঠ আর মাথা টিপে দিচ্ছিল। উঠে দাঁড়িয়ে বোঁচকা খুলে একটা শাড়ি বের করে কঞ্চিগুলোর পাশ দিয়ে টেনে ঘিরে দিল মাকে। এখন আর মাকে আমরা দেখতে পাচ্ছি না। শুধু মাঝে মধ্যে কঁকিয়ে ওঠার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। গাঁয়ের লোকজন কাউকে আর দেখা যাচ্ছে না এখন। কিন্তু খুব বেশি দূরে যে তারা যেতে পারেনি, তা দূরের আকাশের দিকে তাকালেই টের পাওয়া যাচ্ছে। চার দিকে ক্ষেত আর ক্ষেত, তারই মধ্যে ঠনঠনে খানিকটা জায়গায় শাড়ি দিয়ে ঘেরা মার বিছানাকে বোধহয় দূর থেকে কাকতাড়ুয়ার মতো লাগছে।
দাদা আবারও আইলের ওপর গিয়ে বসেছে। একা একা গজ গজ করছে- ‘কত কইরা কইলাম, চল চর আধখানে চইলা যাই। না, যাওয়ার দরকার কী! এহানে কি কুনু গণ্ডগোল আছে নাহি! এইবার বোঝো। ক্ষ্যাতের মইধ্যে বউয়েক শোয়ায়া রাইখা যাও এহন চাঙ্গারি খুঁইজা ব্যারাও!’
তা ঠিকÑ চর আধখানে গেলে এমন বিপদে পড়তে হয়! না হয় দাদার ওই ছাপরার মধ্যে থাকতে একটু কষ্টই হতো আমাদের। তা ও রকম কষ্ট তো আমরা বাড়িতেও করি। চর আধখানে কি আর মানুষজন থাকে না? সেখানে কি আর চাল-ডাল পাওয়া যায় না? যারা দাদার জমিজমায় বর্গা চষে, তারা কি আমাদের খেতে দিত না? আর দাদা তো বলেই, ওইখানে যাওয়ার সাধ্য আর্মিদের নেই, কোনো সারেংয়েরও নেই, এসব ছোটখাটো খুচরা হাবিজাবি নদীর মাঝিদেরও নেই। ওইখানে যেতে পারে কেবল তারাই, যারা দিনরাত যমুনা-ব্রহ্মপুত্রে নৌকা বেয়ে বেড়ায়।
মাবিয়া আমাকে ফিসফিসিয়ে বলে, তোর আব্বা চর আধখানে যাইতে রাজি হয়নি ক্যান রে?
আমি তো জানিই, কেন রাজি হয়নি। আব্বার জিভটা লালায়-লালায় জ্যাবজেবে হয়ে গিয়েছিল, সর সর করছিল খুব। কায়েদে আযমের ছবিওয়ালা সবুজ রঙের নোট জমানোর লোভে আব্বা ঘুমাতেও ভুলে গিয়েছিল। কিন্তু তার পরও মাবিয়ার কাছে মিথ্যা বলি আমি, ‘জাইন্ না আমি।’ তার পরই মনে হয়, এটা বলা বোধহয় ঠিক হলো না। তাই সঙ্গে সঙ্গে আবারও বলি, ‘এই বাড়িঘর ফেল্যায়া রাইখা ওই চরের মইধ্যে যাইবার মন চায়, ক?’
তা ঠিক। স্বীকার করে মাবিয়া, আর বলে- ‘তোর বাপেক কইল্ মানুষজন খুব গাইলমন্দ করে।’
‘ক্যান, গাইলমন্দ করে ক্যান? আমার বাপে কি কুনু মুক্তিযোদ্ধাক ধরায়া দিছে? ওইদিন রাইতে যে তোগারে বাড়িত কয়াকজন মুক্তিযোদ্ধা আইছিল, তা কি কাউক কইব্যার গ্যাছে?’
‘তা না কইলে কী অয়, তোর বাপের দোকানে গ্যালে জিনিসপত্রের দাম যে চামারের মতো রাহে-’
‘এহ্, চামারের মতো রাইখব ক্যা? জিনিসপত্রের দামই তো বাইড়া গ্যাছে। আর কারু দোহানে কুনু কিছু পাওয়া যায় নাহি?’
একেবারে ছোট হলেও এসব খোঁজখবর আমার কানে আপনা-আপনিই চলে আসে। হয়তো ছোট বলেই। কেউ গুরুত্ব দেয় না, নিজেদের মতো করে নিজেদের মধ্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ সব আলাপ করতে থাকে। আর সব কথা আমার কানের মধ্যে এসে ঢোকে। কিন্তু মাবিয়াও কম যায় না, পাল্টা কথা সেও বলতে জানে, ‘আর কারু দোহানে জিনিসপত্র থাইকব কেব্যা কইরা? তোর বাপে তো সব কিছু আটকায়া রাইখছে। আবার মোকামের লোকজনের সাতেও নাহি লাইনঘাট কইরছে- ওই যে যেদিন পয়লা যুদ্ধ লাগার খবর আইল, হেইদিন কইল তোর বাপে ইচ্ছা কইরা লবণের দাম ব্যাবাকের কাছ থাইকাই বেশি রাইখছে। ক্যা, ওই লবণ তো সাত দিন আগেকার কেনা। ওই লবণের দাম বাড়াইছিল ক্যা?’
জুৎসই উত্তর খুঁজে না পেয়ে আমি শুধু বলতে পারি- ‘তোর খালি আজাইরা কতা।’
আব্বার নিন্দা করেছে, আমার তাই মাবিয়ার ওপর রাগ হচ্ছে একটু একটু করে। আমি তাই একটু সরেও বসি। আর ঠিক তখনই এতক্ষণের সব কাতরতাকে ছাপিয়ে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে মা হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে। চিৎকার করতেই থাকে। তারপর হঠাৎ করেই আবার চুপ হয়ে যায়।
দাদা অবশ্যি এর মধ্যেই বিদ্যুৎগতিতে উঠে পড়েছে। শাড়ির ঘেরাটোপের বাইরে থেকে বার বার বুবুর উদ্দেশে বলছে, ‘আসার দরকার আছে নাহি!’
আর বুবু সন্ত্রস্ত ভীত গলায় চিঁ চিঁ করে উত্তর দিচ্ছে, ‘দরকার নাই দাদাÑ দরকার নাই।’
আমরা উদ্বেগ-উৎকন্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকি। এখন আর অন্ধকারে চোখে পড়ছে না কোনো কিছু। না কোনো ধানকাটা ক্ষেত, না কোনো ধানের চারা ফেলা ক্ষেত। আষাঢ়ী ধান বোনার জন্য কোপানো ক্ষেতের মধ্যে শুয়ে শুয়ে মা হাঁসফাঁস করছে। মাবিয়া আমাকে ফিসফিসিয়ে বলছে- ‘তোর মার প্যাট হইছে, আমাক কইস নাই ক্যা?’
‘আমি ভালো কইরা টের পাই নাই তো!’
‘নাÑআ-, ভালো কইরা টের পাও নাই!’- নিচুস্বরে হলেও মাবিয়া ভেংচায় আমাকে। তারপর আবারও বলেÑ ‘প্যাট হইলে যা আরাম, বাড়ির হ¹লে খালি ভালো-মন্দ খাইবার দ্যায়। প্যাট ভইরা খাওয়া যায়।’
আমার হাসি পায়। কনুই দিয়ে মাবিয়াকে খোঁচা মারি, ‘কইছে তোরে…’
‘হ, জানি তো আমি। আমার ছোট খালার হইছিল না?’
কত কিছু জানে মাবিয়া! কত কিছু জানতে হয় মেয়েদের- এই এতটুকুন বয়সটাতেই। আবার জানার পরও সেসব অজানার সমুদ্রে লুকিয়ে রাখতে হয় কত যত্ন করে। কিন্তু আমি কথা বাড়াতে চাই না। হারিকেন নিয়ে কেউ আসছে মনে হয়- সেদিকে তাকিয়ে থাকি। মিটমিটিয়ে আলো জ্বলছে আর দুলছে। যেন ভূত-প্রেত নাচানাচি করছে। অনেকক্ষণ ধরেই মাঝে মধ্যে এ রকম চোখে পড়ছে। কিছুক্ষণ পর মনে হয়, এদিকেই আসছে। আবার খানিকবাদেই দেখি, চলে যাচ্ছে অন্যদিকে। কিন্তু এই আলো মনে হয় এদিকেই আসছে। আমি আর মাবিয়া দুইজনেই সেদিকে তাকিয়ে থাকি। আবার পরস্পরের দিকে তাকাই। মাবিয়া আমার ঘাড়ে-কাঁধে হাত রেখে বলে- ‘যত জোরে চিক্কুর দিল, তোর মার প্যাট মনে কয় খইসাই গ্যাছে।’ বলে চুপ হয়ে যায়। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই কথা বলতে থাকে- ‘হেই চাঙ্গারি আইল- প্যাট খইসা যাওয়ার পর! জাউরার ব্যাটারা জন্মাইবার তো পারে না, পারে খালি মাইরব্যার। বুর কাছে শুনিস তো, ছওয়াল হইছিল, নাহি মেয়ে হইছিল।’
মেয়ে হয়েছিল? নাকি ছেলে হয়েছিল? জানার কোনো আগ্রহই জাগে না আমার। যাই হোক, খসে পড়েছে- আকাশ থেকে তারা ঝরে পড়ার মতো করে। কিন্তু মা-ও যদি খসে পড়ে টুপ করে এই পৃথিবী থেকে! আমার অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে থরথরিয়ে। সুতীব্র আকুলতা নিয়ে আমি অন্ধকারের দিকে, দুলন্ত আলোর দিকে তাকিয়ে থাকি। এই তো এই ক্ষেতখোলা পেরিয়ে কাঁচা সড়কে উঠে তিন-চার মাইল হাঁটলেই যমুনা নদী। সেখান থেকে নৌকায় চর আধখান। হয়তো যেতে সারা রাত লাগবে। হয়তো ভোর হয়ে যাবে। মাঝি হয়তো যেতে রাজি হবে না। কিন্তু দাদা তো আছে। সে নিশ্চয়ই পারবে রাজি করাতে। নিজেই তো পাকা মাঝি সে।
টিনের ছোট বাক্সটার কথা মনে হতে-হতেও মনে পড়ে না। কয় গোছা চুড়ি, একটা কানের দুল, লাল-নীল ফিতা- কত কিছু ছিল তাতে। নাকি ছিল না কিছুই! থাকে না কিছুই! কত কিছু ফেলে দিতে হয় পথে যেতে যেতে। হুড়মুড়িয়ে উঠে পড়ি আমরা- বাঁশের চাঙ্গারিটার ওপর মাকে তুলে শুইয়ে দিচ্ছে আব্বা আর ভাইজান। বুবু আলতো করে পা জোড়া ঠিক করে দিল। চাঙ্গারির সামনের দিকটা কাঁধের ওপর তুলে নিয়েছে দাদা আর আব্বা- পেছনের দিকটা ভাইজানের কাঁধে।
চারপাশে স্তব্ধ অন্ধকার। সবগুলো বোঝা-বোঁচকা এবার বুবু, মাবিয়া আর আমি ভাগাভাগি করে নিয়েছি। হাঁটতে খুব কষ্টই হচ্ছে। কিন্তু আমরা তবু হেঁটে চলেছি। একটু একটু করে। সামনের দিকে।
ইমতিয়ার শামীম : কথাশিল্পী
#