কবিতা : ঈদসংখ্যা ২০১৯

মোহাম্মদ রফিক
ওম
জাপটানো শরীরে বালু নুন
আদিগন্ত আকাশ রোদ্দুর,
যদি-বা তোমাকে খুঁড়ে চলি
অবিরল, তবে মিলে যাবে
কোন সত্য, বোধহীন বোধ,
সে অগ্নির কিবা তুষারের;
দূরে নয়, তবু নাতিদূরে
ঢেউয়ে ঢেউয়ে রক্তিল ফেনায়
পাহাড়ের পাদভূমি ছুঁয়ে
অস্পষ্ট ভাষায় অলৌকিক
মহাসমুদ্দুর মন্ত্র যপে;
শীৎকার ভেবে না ভুল হয়!

###
রবিউল হুসাইন
বায়ুবিশ্লেষণ
সেদিন লিখতে বসেছি বেশ সাবলীল আর অবাধে
লেখা তরতর করে এগিয়ে চলেছে লেখার বিষয়বস্তু
সেই একই- একাকিত্ব প্রেমপ্রিয়হীনতা নিঃসঙ্গতা
যা প্রতিটি শিল্পের সারসত্তা এবং
চারিদিকের ভীষণ ভিড়ে একজনও পরিচিত নয় আর
চেনা তো দূরের কথা- আহা কেউ যদি সেই মানুষের
মিছিল থেকে ডেকে উঠত- এই কী খবর আমি তখন
বলতাম আমি কি সাংবাদিক যে শুধু খবরের খবর নিয়ে
থাকব যারা সাংবাদিক তাদের সম্বোধন করতে হয়
এই যে কী খবর বলে আর আমরা যারা সাধারণ মানুষ
তাদের বলতে হয় এই যে কেমন আছেন
শরীরটা ভালো তো ঘুম খাওয়া-দাওয়া কেমন চলছে
অর্জন বর্জন বিশ্রাম সঙ্গম হ্যাঁ নিয়মিত সঙ্গম করা
শরীরত খুব প্রয়োজনীয় ও স্বাস্থ্যসম্মত
তা না হলে মূত্রস্থলীর গ্রীবা-সংলগ্ন গ্রন্থিবিশেষে ঝামেলা হয়ে থাকে
আর চিকিৎসাশাস্ত্র অমার্জিত বর্ণনায় বলে সঙ্গমশীর্ষ সময়ে
সঙ্গিনীর দ্বারা স্ত্রীর স্খলিত বীর্য পানে তার প্রসব জটিলতা রোধ
করে আর পুরুষের বীর্য আগের দিনে যুদ্ধ বা দুর্ঘটনাজনিত জখমে
এক ধন্বন্তরী ওষুধ হিসেবে লেপন করা হতো যাতে শরীরে বীজদূষণ না ঘটতে-
ঠিক সেই সময়ে বিদ্যুৎবিভ্রাট ঘটলো আর লেখাগুলো এমন যে :
লড়গ্য প্রশিড়গণ ঞযব ঊহরমসধ ড়ভ সড়ৎ এ
ঝযধশবংঢ়বধৎব নবংববপয় ংঢ়ড়শব পধাষক
ঃড়হরমযঃ সষড়ৎু ফৎড়ঢ়বঃয ংযধঢ়ব ধঃবৎরপ
ঃযড়ঁ ওহফরধহ খধফরবং গধমধুরহব-এ ংঁষঃ ডড়ৎুঃর
ধহধ’ং উৎবধস ইধফমব ড়ভ ঝষধাবৎু গ্রম্নপ চৎৎসরপ
উলে সুখ্য ঙধঃসং ড়ভভর পব জবস ঝর সঢ়ষ
ড়াধষ ঈডহভরহসবহঃ ড়ৎ ঋরহব ঝর ঠর পবুঃষ
তলঃ ঁৎক্ষহহবত ঘড়ভমবপযয়পসঢ় ঝপক ঘনয
ঙছঝটধন তমমঘযয লৎঋব মাঝল কুল বঃঘ
চৎক্ষধফ মধপ ঘভড় বঃবং যব নধুঁঃষবংং রং সড়ৎবখ-
এরপর যে কী হলো আমি কিছুতেই আর আমার লেখাটা উদ্ধার করতে-
কিন্তু যা বলার তা বলা সারা কাগজের উপর
অক্ষরে না পেলেও বাতাসের প্রবহমান পাতায় পাতায়
আমি নিশ্চিত এই প্রযুক্তির যুগে যাবে
বায়ুবিশ্লেষণের মাধ্যমে পাওয়া যাবেই-
###

মাহমুদ আল জামান
তুমি যাও
কেবলই নাম ধরে ডাকি; সৈকতে
কখনো গোধূলির স্নিগ্ধ হাওয়ায়
তুমি নেই কোথাও-
না, গাঢ় নীল পাখি যেদিন ডেকেছে আকাশে
সেদিনও খুঁজে পাইনি তোমাকে
মুখোশ মুখোশ খেলায়
যেদিন ভরদুপুরে
শ্লোকের মতো আউড়ালে অলৌকিক একটি নাম
দৃষ্টিহীন হয়ে কেবলই নিষিদ্ধ সংলাপ শুনেছি
বাক্যহীন
উটের গ্রীবার নিঃশব্দ হৃদয়স্পন্দনে
পড়ে থাকি মরুভূমির বুকে
বন্ধুহীন,
শেষ হলো সবকিছু, অস্তিত্বের স্বরূপও বদলে গেল
দেয়ালের ছায়ায় মনে হয়েছিল ছায়াচ্ছন্ন
মানুষ হাঁটছে
আর্তনাদ আর বঞ্চনার শব্দে
ভিক্ষা চেয়েও লাভ নেই, কেননা সেদিন আমরা ছিলাম ক্ষুধার্ত
একান্ত ভাবনায় দুর্বিষহ হয়ে ওঠে
জীবনের সকল দায়।
ক্রুশবিদ্ধ যিশুর মতন শোক ধমনিতে
আর দুঃসহ চিত্রাবলি বুকে নিয়ে দুঃখময় ক্ষত
দাঁড়িয়েছিলাম অলিন্দে
পার্কে, আর অ্যাভিনিউতে
বলেছি, যাও তুমি যাও, নিরুদ্দেশে যাও

###
আনোয়ারা সৈয়দ হক
ওরা তিনজন
১.
প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে ফিরে যায় ওরা,
ওরা তিনজন
রূপালি শোকের শিশ তীব্র হয়ে বেজে ওঠে রাতে
বিছানায় বালিশে সুতোলি চাদরে
শুভ্রতায় হারাবার বিপুল বিলাপ
কেঁদে যায় পাঁচিলের বেড়াল শাবক
যেন তার হারিয়েছে স্নেহের আশ্রয়
নীল স্তব্ধ দগ্ধতায় পুড়ে যায় দ্যুলোক ভূলোক
মশারির কোণে কোণে বেজে ওঠে স্মৃতির শরীর
প্রেমের সাগরে ওঠে সুখের তরঙ্গ
মৃদঙ্গের ঢিমি তালে জীবনের অপূর্ব বিথার
সে কোন স্বপ্নের মতো আজ তারা সুদূরে মিলায়
ওরা তাই তিনজন চিরচেনা বিরহীর বেশে
মিশে যায় বিছানা চাদরে
একা একা ক্লান্তিগুলো ঠেলে দিয়ে নোনা অশ্রুজলে
ক্রন্দনের নিরাশায় তোষকে কাঁথায়
বুনে যায় ঝরাপাতা শোক
ঝরাপাতা ঝরাপাতা ঝরাপাতা শুধু
রুবি ও দিলারা সাথে মঞ্জুও খুঁড়ে চলে
একাকীর গভীরে গরল।
২.
বুলবুল ঘোড়া আর
বুলবুল ঘোড়া আর আকাশে ওড়ে না
সোনালি কেশর তার ওড়ে না বাতাসে
সাগরের টলোমলো লবণের জলে
সারস পাখিরা আর কাটেনা চক্কর
সবকিছু মোটামুটি শেষ হয়ে গেছে
‘চুম্বন করিনি আগে’ শেষ হয়ে গেছে
আমি শুধু হেঁটে যাই পিচ্ছিল খাদে
ওড়বার ডানা দুটি ভাঁজ হয়ে গেছে।
আমরা সকলে এভাবেই কখনও-বা
শীতল মৃত্যুর কোলে বসে যাই চুপে।
৩.
অনুচ্চারিত কথাগুলো
অনুচ্চারিত কথাগুলোর ভারে মানুষ যখন অবনত তখন সে কবরের আশ্রয় খোঁজে। কবরেও সমাহিত মানুষের প্রাণে চেপে রাখা কথার ভার বড় অসহ্য মনে হয় মাঝে মাঝে। কখনও কেউ সাহসী হয়ে কবর খুঁড়লে কোটি কোটি অনুচ্চারিত শব্দাবলি সয়লাব করবে পৃথিবী, কথার ভারে পৃথিবী টলমল করে উঠবে, রণডঙ্কা বেজে উঠবে চারদিকে, রক্তগঙ্গায় ভেসে যাবে ভূলোক, তবু মুক্তি হবে মানুষের, মানুষ তখন স্ফটিকের জলাধারে রাখা জলের মতো শুভ্র পবিত্র।
###

হাবীবুল্লাহ সিরাজী
জীবনের লীলা
মাছের জিহ্বার নিচে নুন এসে ব’লে গেছে ভোর
ফেনামুগ্ধ বিপ্লবের তোড়।
বরফের ভিন্ন গতি আহ্নিক-বার্ষিক হ’য়ে
অতলেই পাবে বুঝি তলের ঠিকানা।
শাপলা-পাতা মাছ ঘোরে,
ঢেউয়ে-ঢেউয়ে পেতে চায় তুফানের লেজতেজ
ছানা হয়, ডানা হয় কামনার বীজ।
বঙ্গোপসাগর ধরা অনুরাগ, অনুভব,
পেটে-পেটে বিলি দেয়া নবীন হাঙর
সেও বুঝি জলচিল, বুকচিতা
যেন চোখটানা পাতামিল, হাওয়া-ধাওয়া শ্বাস…
খাদকের খোঁজ আর সংহারের বোধ নিয়ে
মেরুদণ্ড সোজা হ’লে শাপলা-পাতা ও—ে
ঘুড়িঝাঁপে সম্মুখেই দেখে এক কামিনী-কৌশল
বল বৃদ্ধি, ধীবরের নেত্র শুদ্ধি
নুন আর খুনে ভাসা শাঁখের করাত!
এই বেলা লতায় তো ওই বেলা পাতায় প্রণাম
মিল ভাঙে ধর্মপথ, স্বাদে মেলে নগ্নক্ষত
লগ্নি যত আমিষ ও অধিবাস
উঠে এসে ভোগ হয়, মর্ম হয়,
অনন্তে প্রকৃতি হয় জীবনের লীলা!
###

মুহম্মদ নূরুল হুদা
নারী, তোমার তরঙ্গ ২৬
তোমার অশ্রু
খরস্রোতা
তুরাগের চেয়ে
তোমার অশ্রু
খরস্রোতা
বুড়িগঙ্গার চেয়ে
তোমার অশ্রু
খরস্রোতা
নীল-আমাজনের চেয়ে
তাকে তুমি কিভাবে আগলে রাখবে, মেয়ে?
ছেড়ে দাও
ছেড়ে দাও
ছেড়ে দাও
ভবতরঙ্গ ছেড়ে
নবতরঙ্গে যাও
নবতরঙ্গ ছেড়ে
সর্বতরঙ্গে যাও
খরতরঙ্গের
ঘাটে ঘাটে
এ নাও ভেড়াও
তুঙ্গতম আনন্দবেদনার শীর্ষাসনে
জোড়া পালে ভেসে যাচ্ছে জোড়া তরঙ্গ
তোমার আমার জোড়া অশ্রু দিয়ে গড়া
এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের দ্রুততম নাওতরঙ্গ
তোমার অঙ্গ
আমার অঙ্গ
অঙ্গে অঙ্গে
নাওতরঙ্গ
আসছে ধেয়ে
তাকে তুমি কিভাবে আগলে রাখবে, মেয়ে
###

অসীম সাহা
চুম্বনের মায়াবী নেশায়
মহুয়া, মল্লিকা এবং মাধবীর লতা থেকে কোমল বর্ণগুলো
মার্চ পাস্ট করতে করতে ছুটে যাচ্ছে
অবরুদ্ধ অক্ষরের ক্যান্টনমেন্টের দিকে।
ভাষাবাহিনীর এক মেজর জেনারেল বর্ণের ব্যাকরণ হাতে নিয়ে
রিক্রুট করে যাচ্ছে ম-বর্ণের কোনো কোনো রূপসী মেয়েকে।
দূরে দাঁড়িয়ে সীতানাথ বসাকের ছেলেবেলা হাসছে কেবলি।
চোখে তার উজ্জ্বল সিসার মতো অপরূপ জ্যোৎস্নার ঢেউ।
পিংপং বলের মতো প-বর্গীয় ধ্বনিগুলো খেলা করছে
আদর্শলিপির সব বিবর্ণ পাতায়।
৫ ফুট ৬ ইঞ্চি দৈর্ঘের কোনো ধ্বনি আজও সৃষ্টি হয়নি
পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে।
একবার মোনালিসা নামে এক ম-বর্ণের রহস্যময়ীর চোখে
জ্বলে উঠেছিল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম আলো!
সেই থেকে বাঁকাচোরা হাসির আড়াল বেয়ে সংগোপনে
জেগে উঠছে কাঠঠোকরা ভোরের মতো অর্ধেক হৃদয়!
আর বাংলার মৃত্তিকায় প-বর্গীয় ধ্বনির মাঝে
পঞ্চম ধ্বনির এক তৃষ্ণার্ত নারীর ঠোঁট
অকস্মাৎ জেগে উঠছে চুম্বনের মায়াবী নেশায়!
###

রবীন্দ্র গোপ
কানামাছি খেলা
আজকাল মৃত্যুর সান্নিধ্যে বেশ জমে বেলা অবেলা
জীবনের সাথে চলে গোল্লাছুট কানামাছি খেলা
শৈশবের স্কুল পালানোর স্মৃতি, ঈশাখাঁ, মুসাখাঁ
আওরঙ্গজেব শৈশবের পাঠ ইতিহাসে মন বসে না,
ঘুমের সাথে হেলা ফেলা দিন,
পণ্ডিত স্যারের কান মলার গল্পটা মনে পড়ে যায়,
উহরে! স্যারের হাতের চামড়া কী শক্ত রে বাবা!
এখনও স্মৃতির মধুর কষ্টটা মনে পড়ে যায় আহা সেদিন।
আহারে স্যারের হাতে না জানি আমার কানের তৈলাক্ত জমাধুলো
লেগে যেত, স্যার ক্ষমা করবেন, এখন আমার কানে আর
ময়লা জমেনা, তরল সাবান জলে কত যত্নে পরিষ্কার রাখা হয়
কে-ইবা আর কানমলা দেবে ইতিহাস না পড়ার জন্য।
আহা ইতিহাস ! এখন গভীর রাতে কথা বলে পানাম নগরী!
মাঝ রাতে জেগে ওঠে নূপুরের নিককনে অচেনা গানের সুর বাজে
বড় সর্দারবাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসেন ঈশাখাঁ তার সুন্দরী স্ত্রী
সোনাবিবি দিঘিতে নৌকায় রঙ্গিন বৈঠায় বাজায় নূপুর ঝুমুর ঝুমুর
রাত জাগা পাখিরা গানের সুরে আকাশের তারা নাচায়
কানে কানে কথা হয় ঈশ্বরের সাথে, আর কদিন পৃথিবীতে!
###

নাসির আহমেদ
অনুশোচনার গাথা
॥ এক ॥
আমাকেই দিলে তুমি এমন দায়িত্বভার-
যা বহনে সাধ্য কি না করলে না যাচাই।
বেকুবের মতো আমি ভালোবেসে নির্দ্বিধায়
কবুল করেছি এই দুবির্নীত স্নেহভার তোমার ইচ্ছায়।
স্নেহেরও যোগ্যতা লাগে ভারবাহকের মতো
নিষ্ঠায় জড়িয়ে থাকা, প্রেম না-ই দিলে তুমি
মমতাটুকু তো নেবে; নাকি তাও তুচ্ছ অবহেলা।
কেমন নাদান দেখো এই তুচ্ছতাও মেনে নিচ্ছি নির্বিকার।
পূর্ণিমা তিথিতে দেখা হয়েছিল সংক্রান্তিমেলায়
আজ মনে হয় বড় ভুলের সূচনা ছিল বর্ষের অন্তিমে।
স্নেহ-প্রেম মমতার দারুণ বুভুক্ষু মন কিছুই না ভেবে
গ্রহণ করেছে সব অমেয়-গরল কিন্তু হলো না হজম।
বসন্তে কোকিল ছিল কুহুটুহু ছিল কিছু কৃষ্ণচূড়াও
এখন দারুণ শীতে কেঁপে যাচ্ছে হাড়-মাংস
পত্রপুষ্পহীন বৃক্ষ-লতায় জড়িয়ে যাচ্ছে সমস্ত প্রত্যাশা
এখন কী করে বলি- আমাকে ফিরিয়ে দাও বিগত ফাল্গুন!
॥ দুই॥
অথই জ্যোৎস্নায় দেখো কীরকম শাদা মিহি দুঃখ ঝরে পড়ে
এই দৃশ্য সকলের নজরে আসে না জানি, সবাই কী করি
কবির মতন ভান, যদিও অনেকে করে কিন্তু কবি নয়
জীবনানন্দের মতো কে আর জেনেছে সত্য কবিপরিচয়!
তুমি যে এতটা প্রেমে ছিলে গদগদ তাতে কবিতা কি
নিশ্চিত ছিল না ভাবজগতের কানাকড়ি, সবই বস্তুগত
এখন বস্তু তো নেই, আছে শুধু হৃদয়ের গভীর উত্তাপ
এই তাপে গলবে না আমার প্রেমের পাপ, বস্তু থাকা চাই!
বাবুই পাখির মতো আমি চাই বুনে যেতে শৈল্পিক নিবাস
তুমি চাচ্ছ শক্তভিত্তি চুনকামে সুশোভিত স্থায়ী বাসস্থান।
এ রকম কতশত বৈপরীতে ভরে আছে মনুষ্য-হৃদয়
জেনেশুনে তবু বলে- তুমিময় এ জীবনে চাওয়া শুধু প্রেম।
নিসর্গের কাছে গিয়ে অসহায় একাকিত্বে নিজেকে যখন
গভীর ভেতর থেকে দেখার সুযোগ পাই, কেবল তখনই
বুঝে ফেলি মানুষের সীমাবদ্ধতার সীমা; আর কী সাজানো
জটিল মিথ্যায় বোনা আহ্ কী সুন্দর এই ক্ষণস্থায়ী প্রেম।
জেনেশুনে তুমি দিলে আমারই স্কন্ধে তুলে এই গুরুভার
কী তোমার লীলা বন্ধু কেবল তুমিই জানো, জানে না সংসার।
###

ফারুক মাহমুদ
স্থান
ইতিহাসে ছিল শেওলা জড়ানো জটা
ভূগোলে দেখেছি কাঁটাতার-ঘেরা মাটি
আমরা কিন্তু উল্টে ফেলেছি স্মৃতি
স্বচ্ছ করেছি- অমূল্য পরিপাটি
চলাতে বলাতে কঠিন সীমানারেখা
সামনে পেছনে ধূর্ত গুপ্তচর
মিলিত মানুষ পরাজিত হবে কেন
পেয়েছি স্বদেশ অনেক রক্তের পর
পোড়ামাটি থেকে ফুটেছে কুসুমকলি
আগুন হয়েছে অঝর আলোকরেখা
আমাদের পথ মিলেছে নতুন পথে
আমরা শিখেছি জীবনকবিতা লেখা
সুরের তুলিতে কত রং ছবি আঁকি
মিলনে বিরহে গানের সঙ্গে থাকি
###
কামাল চৌধুরী
দর্শক
দরজার দিকে যেতে যেতে হাতে উঠে আসছে খোলা বারান্দা
শূন্যতা পেরুতে গিয়ে উঠোন ঢুকে পড়েছে ঘরে
তুমি বলছ অধ্যাস- আমি গান ধরেছি আন্দামানের বন্দির গলায়
পৃথিবীটা বাতাসের অমিতাচারে চুপসে যাচ্ছে
তুমি কড়িকাঠে যা দেখছ, সেখানে একটা গোটা সমুদ্র ঝুলে আছে
তুমি বলছ অধ্যাসÑ আমি বলছি তিনভাগ জলের পৃথিবী
হাত সাফাইয়ের আগে তোমার আস্তিন আমাকে দেখাও
কবুতর উড়িয়ে দেওয়ার আগে মঞ্চে উঠে আসছে আলাউদ্দিন খিলজির হাতি
কোনো কারণ ছাড়াই একটা মিলনায়তন ভেঙে পড়ছে দেখে
সেখানে সশব্দে ঢুকে পড়ছে অচেনা আকাশ
আমার দশ আঙুলে বেজে উঠছে খোল করতাল
যারা নেচে যাচ্ছে তারা হাতি থেকে রূপান্তরিত হচ্ছে মহিমাময় সন্ধ্যায়
হাততালি দিচ্ছি আমি
তুমি বলছ অধ্যাস- আমি বড়ো পর্দার দর্শক।
২০/৪/২০১৯
###

মাহবুব বারী
শূন্যে মিলাও
কিছুদিন সংসারে কিছুদিন সন্ন্যাসে কাটে
মাঠেঘাটে মন পড়ে রয়, আবার কুড়িয়ে নিয়ে
নানাদিকে, বুজুর্গ বুজুর্গে, শূন্যে মার্গে-
সংসারে তো তোমাকে পাই
কিন্তু এখানে কেউ নাই, দেখা নাই সাক্ষাৎ নাই
তাই খুঁজতে থাকি, খুঁজতে থাকি
একবার ধরতে পারলে সাঁই
আমি যাই তোমার সন্ধানে তখন, তত্ত্বতালাশ করি-
আমাকে পিছু টানে কামে আর ঘামে
কামে ঘামে মিসমার হয়ে যাই
ঘোড়ার লাগাম মনে লাগাই, মন এবার তুমি যাও
ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলো দিগন্তের নীলে
আদিতে যাও অনন্তে ধাও
মন তোমাকে পোড়াতে পোড়াতে যাই
পোড়াই- কালো হও লাল হও সাদা হও
শূন্যে মিলাও।
###

শামীম আজাদ
আগুনগেলা নারী
‘আমি আগুনের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে এসেছি।
যেটুকু পুড়বার পুড়ে ছাই হয়ে গেছে,
আর যেটুকু বাকি আছে, তার আর মরণ নেই।’
এ বিমলার আত্মকথন ছিল,
কিন্তু তোমার হয়ে উঠেছিল জীবনাচরণ।
আমি যে আগুনের কথা বলেছি,
তা সামাজিক আগুন।
যে আগুন একজন নারীকে সামাজিক প্রতিবন্ধী করে দেয়।
আমি যে আগুনের কথা বলছি,
সে আগুনের হল্কা, হাল্কা থেকে শুরু করে দাউ দাউ হয়ে ওঠে।
কখনও বা সে আগুন বার্বিকিউর মত
মেয়েটিকে গরম ধাতবের বিছানায় রেখে
নিচ থেকে মিঠে মিঠে তাপে বাইরেটা ছ্যাঁকা দিয়ে,
ওয়াইনের সাথে খাবারযোগ্য ক্রিস্পি করে তোলে।
সে আগুন পরাস্ত হবার আশঙ্কা দেখলে
অগ্নি রামদা হয়ে যায়,
কোপায় আর কোপায়-
একেবারে অঙ্গার করে, কালো করে না দেয়া অবধি থামে না।
সে কয়লায় দাঁত মেজে হাসে তারাই যারা
আগুনটাতে কুটো ফেলে, পেট্রল ঢেলে, খুঁচিয়ে খাঁচিয়ে বাড়িয়ে দিয়েছিলো।
কিতাব, গ্রন্থ, বিদেশি লেবাসি হেফাজি, ইউটিউবের বক্তৃতা,
মহফিল, সালিস বা মালিশ কোন কিছু বাকি রাখে না তারা।
আমি তেমনি এক আগুনের কথা বলছি যা দৃশ্যমান নয়
যা শুধু আঁচ করা যায়।
আর আঁচ থেকে আন্দাজে কাউকে ছোঁয়া যায় না।
কোন অগ্নি-নির্বাপণ, পুলিশ, পুলটিশ
কিছুই করা যায় না।
প্রিয়ংবদা, তুমি তাই সে আগুন গিলে
অপ্রিয় ভাষণ ও ভানগুলো বদলে প্রিয়ভাষিনী হয়ে,
আমাদের ক্ষুদ্র ও ব্যর্থপ্রাণের বর্জ্য পোড়াতে ব্রতী হয়েছিলে।
সর্বকলুষতা, অপমান, অবজ্ঞা, কুসংস্কার আর সামাজিক প্রতিবন্ধিত্ব
পালটা আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছিলে।
আমরা সেই নীল অগ্নিতে হাত সেঁকে,
মনউপ্ত করেছি।
এবার ভিন্ন আগুনে তাদের পুড়বার পালা
জলের মঞ্চে শ্রেষ্ঠ ছোবল মারবই দেখো আমরা।।
লন্ডন
২৩ মার্চ ২০১৯
###

আসাদ মান্নান
বধ্যভূমি
একটা গভীর ঘুমে কাল রাত ঘুমের ভেতরে
প্রসন্ন আলোর দ্বীপে খুব একা আমি জেগি ওঠি;
এটা কোনো স্বপ্ন নয়- বাস্তবের নির্মম কথন :
পাল তোলা পৌরাণিক একটা জাহাজে চড়ে আমি
ভাসতে ভাসতে যেখানে নোঙ্গর ফেলে তীরে এসে নামি
সেখানে হঠাৎ দেখি কী রক্তাক্ত অস্ত্রের অক্ষরে
পশুশক্তি লিখে গেছে আমাদের বিজয়-এলিজি!
আমার বাবার মাংস শকুনে খেয়েছে; কিছু বুনো
শিয়াল কুকুর শুধু ঝগড়া করে হাড়-গোড় নিয়ে,
অদূরে ছড়িয়ে আছে রাশি রাশি খুলি ও কঙ্কাল;
একটা খুলির মধ্যে দেখি আমার মায়ের মুখ-
আহারে কিশোরী বউ! ডোরাকাটা তাঁতের শাড়িতে
কী নিপুণ হাতে লাল সবুজের মিলন ঘটিয়ে
স্বাধীনতা শব্দটিকে তার দেহে জড়িয়ে রেখেছে!
২.
নরজন্তু হায়েনারা যে-বোনের ইজ্জত লুটেছে,
তার মৃত দেহ বুকে একটা বিস্মৃত বধ্যভূমি
কতকাল ধরে আমার পায়ের নিচে পড়ে আছে!
বিত্তের সাগরে ভাসে সারাক্ষণ স্বার্থের জাহাজ;
যখন যেখানে হাঁটি পিছে হাঁটে খাস চাটুকার;
খেয়ালে আসে না আর কিংবা ভুলে কখনও ভাবি না
অই বধ্যভূমি ছাড়া বাংলাদেশ কী নিয়ে দাঁড়াবে?
নিজের পকেটে ভরে নিতে সুযোগের শেষ কড়ি
দেশের পকেট কাটতে যেখান সবাই থাকে মগ্ন,
সেখানে কী করে বলো, মানবিক সুন্দর দেশের
তালিকায় উঠে আসবে রক্তে পাওয়া আমার এ দেশ!
আমার নিজেকে খুব অপরাধী বলে মনে হয়;
ঘুমের ভেতরে অন্য এক ঘুম ভেঙে যায় : আমি
পায়ের নিচের বধ্যভূমিটাকে বুকে তুলে রাখি।
###

হারিসুল হক
হ্রস্ব জলাগুলি
পুব আকাশে সূর্য ওঠার আভা
ঝিলের জলে তরল অন্ধকার
হারিয়ে যাওয়া দু’একটি সুর ছেঁড়া
কুড়োয় বসে মাতাল পদ্যকার
স্তব্ধ করা দামাল দিনের স্মৃতি
মিলিয়ে ছিল দীর্ঘ দিগরালে
বনের কোণে হ্রস্ব জলাগুলি
চিতিয়ে ওঠে প্লাবন কলরোলে
ছিটিয়ে থাকা দৃষ্টিরেণু অঢেল
কান পেতে অই সরুপথের ইটে
বাজবে কখন ছাড়ার বাঁশি বাঁকে
ছুটব ঝেড়ে স্বপ্ন এবং ভিটে
বাদলা দিনে এ কোন চিতাবাঘ
গুঁড়িয়ে দিলো অতল অহংকার
সাতসকালে নিমপাতার অই ঝাড়
বল্ল হেলে- বন্ধু তুমি কার
ঝিলে তখন তরল অন্ধকার
###

ইকবাল হাসান
যাত্রা
আমি যখন রোমে ছিলাম
তুমি তখন ভিয়েনা
তোমার খোঁজে ছুটছি যখন
তদ্দিনে তুমি তিরানা
রোম থেকে যাই ভিয়েনা
ভিয়েনা থেকে তিরানা
তারপর দেখি হঠাৎ একি
পথ কিছুতেই ফুরায় না
পথের শেষেও পথ পড়ে থাকে
যেন অফুরান ঢেউ
ততদিনে তুমি কোথায় গিয়েছ
বলতে পারে না কেউ
এভাবেই তবু ছুটাছুটি করি
ঝড় ঝাপটায় পড়ি আর মরি
এ জীবন বুঝি যাপিত হবে
অবাক কুহক, ঘোরে ও বেঘোরে
আমার সকল যাত্রা তবুও
তোমাকে কেন্দ্র করে।
###

বিমল গুহ
অবসর
‘অবসর’ শব্দকেই প্রৌঢ় মনে হয়-
অঙ্কের নিয়মে যা মান্য কারণ,
তবুও কোথাও আছে মৌন সংঘাত
অম্ল-মধু-তিক্ত চাটে লোলজীবীগণ।
অবসর কারও কাছে রক্তমেঘছায়া
কারও কাছে মায়াময় ছায়ার বিভূতি;
দুপুরের রোদ তার বোঝে না কিছুই-
মানুষের চাপা ক্ষোভ, চাপা অনুভূতি!
অস্তবেলা বর্ণহীন শস্যের ভাণ্ডারে
যারা উঁকি দেয়, তারা কেউ অর্থহীন
ডিগবাজি খায়। কালধর্ম তুচ্ছ করে
মেঘমল্লারে কেউ খোঁজে দূরবীন!
পরিচিত রোদ যেই ম্লান হয়ে আসে
হাই তোলে বৃদ্ধস্বভাব। তীব্র ক্ষিধে
চোখেমুখেÑ দূরে ঐ মেঘের কার্নিসে
ছায়া খোঁজে পুনর্বার বাঁচার তাগিদে!
###

জাফর সাদেক
ইজারাদার এরিস্টটল
সময় কেবল পরিবর্তনের হাট
এখানে পসরা সাজিয়ে আছে শুধুই বর্তমান, আর ওই
গ্যালাক্সিতে বসে আছে এই হাটের ইজারাদার- এরিস্টটল
গুরু সক্রেটিসের দুঃখকষ্ট বুকে নিয়ে তিনিই আমাদের বর্তমান
কবিতার সমঝদার
সব পূর্ণিমায় বর্তমানের অবগাহনে
ভিঞ্চি কিন্তু খুঁজতেন রহস্যের এক হাসিমুখ
এবং অবজ্ঞা করতেন কল্পিত ভবিষ্যতের স্বর্গসুখ
সত্যি সত্যি একদিন তিন আঙুলে ধরে ফেললেন
সময়ের সবচেয়ে দামী হীরক খণ্ডের আঁচল
পাশাপাশি তার অনুজ ভিনসেন্ট ভ্যান গগ
সময়ের মন্থন উপভোগ করতে গিয়ে দেহজীবীকে
কানটায় উপহার দিয়ে বসলেন একরাতে
বটবৃক্ষ ছড়ায় বীজ, না বীজ ছড়ায় বৃক্ষের বিস্তার
বর্তমানের কাছে এমন প্রশ্ন নিয়েই হাঁটছি
সেইসব পরিত্যক্ত ইমারতের দেয়াল ধরে ধরে
এই দেয়ালে প্রতিদিন বসা কাকের বর্জ্যে বৃক্ষের বীজ
###

তমিজ উদ্দীন লোদী
এই রাত্রিতে, এই মুহূর্তে
এই রাত্রিতে কে যেন বাজাচ্ছে
পিয়ানোর সুর
মেঘ-ভাঙা আকাশ
অচেনা ফুলের গন্ধ
ঢেউয়ের মতো ভেসে যাচ্ছে স্মৃতি ও সংলাপ।
হুড়মুড় করে বুকের কাছে এগিয়ে আসে এক নদী
রাতচরা পাখির মতো কোনো পাখি, চৈত্রের বাতাস
নাকি এপ্রিলের?
সুরমার মতো নদী, নাকি ইস্ট রিভার?
সমস্ত ছাপিয়ে শুধু জলের কহ্লার!
খুব চেনা চাঁদ এখানেও
নিঃসঙ্গ নারীর মতো স্থির হয়ে আছে
ভেসে যাচ্ছে পিয়ানোর সুর
রাত্রি ছুঁয়ে ছুঁয়ে।
###

মাহমুদ কামাল
মুহূর্ত আর মুহূর্তমা
মুহূর্তকে ধরে ফেলে মুহূর্তমা
পাখির খাঁচায় নয়
জেলবন্দী নয়
মানিব্যাগ কিংবা ভ্যানিটি ব্যাগেও নয়
মুঠোবন্দী করে
মুহূর্তকে ধরে ফেলে মুহূর্তমা।
এরপর উল্লাস করে- উল্লসিত হয়,
মুঠো খুলে দেখতে গেলেই
মুহূর্ত নিমেষে উধাও
যুদ্ধশেষে মুহূর্তমা
জয়ী কিংবা বিজিত
কোনোটাই নয়
সবশেষে পড়ে থাকে জীবনের দেনা
সেইসব লেনদেন নতুন মুহূর্তে
বয়ে চলে যথারীতি মুহূর্তের মোহে…
###

গোলাম কিবরিয়া পিনু
উদয়মণ্ডল
অস্থি ও মাংসপেশীর সংবাহন নেই?
আন্দোলিত হও
বিদ্যুৎপ্রবাহে!
গৌরবর্ণ মানুষও গোঁড়া হতে পারে
কৃষ্ণবর্ণ মানুষও।
পুষ্পবৃক্ষের শুষ্ক মূল থেকে গন্ধদ্রব্য প্রস্তুতের
অভিলাষ নেই?
সঙ্গীতে বনের পশুরাও আত্মহারা হয়ে যায়!
গোঁড়ামির গোড়া খুলে ফেলো-
তুমি শুধু হাড়-হাড্ডি নও!
গুপ্ত থেকে থেকে সুপ্ত রাখো-
নিজের প্রবল অভিব্যক্তি!
সূক্ষ্ম মসলিনের সূত্রাবলী জেনে নিয়ে
তোমারই হাতে সুচিশিল্প-
মূল্যবান হয়ে উঠতে পারে।
সৃজনপ্রকৃতি তোমারও প্রকৃতিতে আছে
এখনও তোমার উদয়মণ্ডলে তুমি তো জীবন্ত!
###

চিরসবুজ ঘুম
মাহফুজ মুজাহিদ
দারুণ শৈশব জেগে থাকে ঘুমন্ত প্রাণে
মগজে ও মননে মানুষ দেখে ক্ষয়ের বিবর্তন
স্থানান্তর লোকালয়ে ক্রমশ জাগে বালুচর
সময়ের বন্দি কারাগারে নিশ্চুপ দেহ
রূপান্তরের কষ্ট বয়ে যায় স্রোতহীন নদীধারায়
এইতো জীবন- ফিরে ফিরে আসে বিনষ্ট খেলায়
চুপচুপ ঝরে যায় বাতাসের ডানা
বদলে গেলে সময়
স্রোতের বিপরীতে তুমি-আমি; আমি-তুমি
সকলই সকল সবার হবে জানা
তবুও জীবন নিঃশেষে হবে ক্ষয়
ভূমি ও দেহে রয়ে যাবে শুধু নাম
মানুষে মানুষ চির অক্ষয়
###

অঞ্জনা সাহা
সাম্প্রতিক
হয়তো ঢের বেশি প্রয়োজন ছিলো
তাই তো বদলে গেছে সবকিছু
চিরচেনা এই আমিটাকে আর চিনি না এখন।
সময় বদলে দিলো গোটা একটা জগৎ;
এত অচেনা লাগে তাই নিজেকেই!
লাজুক কিশোরী তার অদ্ভুত অনুভূতি নিয়ে
অকারণ হাসি আর শিহরনে ছিল সদা-কম্পমান।
একদিন ডবকা রজনীতে কেঁপে কেঁপে
অসময়ে বেজে উঠলো বিষণ্ন বেহাগ।
তারপর দেয়ালে পিঠ- শুরু হলো যুদ্ধ!
মাঝে-মধ্যে সরব হয়ে উঠলো নিঃশব্দ রণাঙ্গন;
তবু যুদ্ধ চলল তার কেশে-বেশে আর আত্মায়,
চোখে বিদ্যুৎ-রেখা মেলে দিয়ে হাসিটি রেখে দিলো বাঁকা দুই ঠোঁটে;
যদিও বসতি গড়লো বেদনার উঁই, তারও কারণ ছিলো বটে!
গাঙুরের জলে আজও ঢেউ নাচে খুব-
বেহুলার মতো সে-ও বেসেছিলো ভালো
ভেলায় ভাসানো আছে তার মৃত বর-লক্ষ্মীন্দর,
মন্দাকিনীর ঘাটে পৌঁছতে আর খুব বেশি দেরি নেই
কাঁটাবিদ্ধ রক্তমাখা দু’টি পায়ে ভাটফুলের নূপুর
নিঃশব্দে কাঁদবে বলে আজও তার কম্পিত পায়ের ছন্দে
ঝরিয়ে চলেছে ফিনিক জ্যোৎস্নার অসম্ভব আলো!
###

মিনার মনসুর
এই শেষ পাত্র
যত পারো গাও গান; নাও
দেখে রূপসীর ভাস্কর্য গ্রীবার। একটিই মোম-
বাতাসে কাঁপছে তার শিখা।
অন্ধকারÑ তাতার দস্যুর মতো- ওত পেতে আছে
চৌদিকে তোমার। মঞ্চে বিদ্যুতের ছুরি
ঝলসায়; দেহে তার অমৃতের বিষ।
তবু পেতে দাও বুক;- এ…ই শেষ পাত্র
তোমার। অদূরে- ব্লাডহাউন্ডের মতো-
মরুভূমি অপেক্ষায় আছে।
###

মারুফ রায়হান
অগ্নিস্নান: বনানী থেকে প্যারিস
কাল নিরবধি, আমার নিয়তি নিত্য অগ্নিস্নান
বিদগ্ধ সত্তার ক্ষত সারিয়েই জীবন ভাসান
রাক্ষস লিখিত ভস্মশাস্ত্র আমাদের পড়া নেই
তাই কুপোকাৎ সব অগ্নিযোদ্ধা এক গড়ানেই
মানুষই মহান, তার অপমৃত্যু চিরঅবাঞ্ছিত
সৃজন স্থাপনা চিত্র- কিছু হতে পারে না লাঞ্ছিত
যখন সভ্যতা পোড়ে, পৌঁছে আঁচ মানব মুকুরে
অনলে মানুষ নিলে ইতিহাসও ছাই হয় পুড়ে
নিসর্গের অশ্রুপাতে নিভবে না বনানী-দহন
কেঁপে ওঠে যন্ত্রণায় প্যারিসের গভীর গহন
ধোঁয়া নয়, শূন্যে ঘুরপাক দানবের অট্টহাসি
এখানে ইবলিশ এক সদানন্দ দারুণ মাংসাশী
আগুনের গ্রাসে আজ শান্তিধাম অনাদি সুন্দর
ধ্বংসস্তূপে পাতো কান- স্বপ্নসুর বহে নিরন্তর
###

রেজাউদ্দিন স্টালিন
এমন বেদনা আমাকে দিয়েছ
এমন বেদনা আমাকে দিয়েছ
আমাকে দিয়েছ তুমি
পৃথিবীর সব পাথরখণ্ড
যদি নিতো এই ভার
মিশে যেতো তারা মাটির গভীরে
বালু বিন্দুর মতো
অথবা সে যদি সমুদ্র হতো
পলকমাত্র, বাষ্পের মতো উবে যেতো মেঘলোকে
মরুভূমি হলে ভূমিকম্পের বিপুল শব্দে
চরাচর ধসে যেতো
অরণ্য হলে খাণ্ডবদাহ শুরু হতো ভয়াবহ
এমন বেদনা আমাকে দিয়েছ
আমাকে দিয়েছ তুমি
সমুদ্র হলো পর্বত আর পর্বত মরুভূমি
এই দুঃসহ বেদনার বীণা আমিই বাজাতে পারি
আর পেরেছিলো নিরো একবার অগ্নিদগ্ধ রোমে
###

টোকন ঠাকুর
ভালোবাসা একটি বাঘ
স্বপ্নের সঙ্গে থাকা যায় না, সংকট তৈরি হয়। ভোরকে ভোর মনে হয় না, দুপুরকে মনে হয় গনগনে
নদী, নদীর কী ধাঁধা! বিকেলকে ভাঁজ করে রাখতে পারি বীজগণিতের খাতায়। এবং সন্ধ্যে, সন্ধ্যের
কথা তো আমি গতকালও বলেছি, সে আমাকে সপ্তসিন্ধুর দিকে নিয়ে যাওয়ার নাম করে ডেকে নিয়ে
যায় রূপনগর আবাসিক এলাকায়। রূপনগরে যাওয়ার পর আমার চোখ বেঁধে ফেলা হয়। এরপর আর
কিছুই দেখতে পাইনি, ভেতর থেকে শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গীত ছাড়া কানেও কিছু শুনতে পাইনি। মনে হয়
শ্বাস-প্রশ্বাসের আঘাতেই একসময় আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি, জ্ঞান ফিরলে বুঝতে পারি, নিঃশব্দে
চলাফেরা করছে উদ্বাস্তু রাত। পালাতে চাইলেও পালাবার পথ নেই। দিগন্তপ্লাবিত মাঠে নেমে আসে
চাঁদ। প্রশাসনিক চাঁদ, আমাকে তুমি ক্রসফায়ারে মারবে?
জানি, চাঁদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ টিকবে না, কোনো বিচার হবে না। কোন বনে বা উঠোনে
কয়টা জোনাকি মরেছে গতকাল, তার কোনো নথি নেই, তারাও বিচার পাবে না। নদী-হত্যারও বিচার
হয়নি, সমতল গিয়ে পাহাড় কাটছে রোজ. . .
এত এত সংকটের পরও, আমি প্রত্যেকদিন রান্না করেছি ভালোবাসা, ভালোবাসা খেয়েই বেঁচে আছি।
ভাত রানতে যেমন চাল লাগে, চাল আনতে ধান লাগে, ধান বুনতে শ্রম লাগে, স্বপ্ন লাগে,
ভালোবাসতেও স্বপ্ন লাগে অনেক। স্বপ্ন একটি বাঘ। খাঁচায় রাখা যায় না, ছেড়ে দিলেও মুসকিল। তবে
কি আমি ভালোবাসার সন্ধানে গিয়ে স্বপ্নের থাবায় পড়ে মরে যাব?
আমাকে বাঁচাবে কে?
###

সৈকত হাবিব
নিজেকে নিয়ে
এ কি তোমার নাম
নাকি ছদ্মবেশ
জড়িয়ে আছো গোপন আবেশ?
তুমি কি আসলে তুমি
ছড়ানো হৃদয় যার আভূমি
যে ছুঁতে চায় নক্ষত্রের নদী
নাকি তুমি এক নগর-ইতর
অশ্রাব্য কোলাহল যার ভিতর
হতে চাও তো নৈঃশব্দ্যের সুর
অথচ তুমিও এক মানব-অসুর
নিজের জীবন কি যাপন করো তুমি
নাকি কেবলই মুখোশ, ছদ্ম-মাতলামি?
আসলেই সৈকত হাবিব কি তোমার নাম
কবি যিনি, আয়নায় ধরেন জীবনের ছবি?
প্রণাম তোমাকে তবে, মহাকাব্যিক সালাম।
###

সুহিতা সুলতানা
বরষার কবিতা
আষাঢ়ের এমন দিনে শুরু হয় অপেক্ষার দুলুনি ঘেরাটোপের মধ্যে
পড়ে গেলে যেমনটা হয়, তেমনটা এখন আর হয় না। নিজের
শহরের মানুষগুলোর ওপর একটা আলাদা মায়া আর বিশ^াস থাকে!
কেন থাকে তাও জানি না! কিছুক্ষণ হলো বরষা থেমে গ্যাছে, আমার
ইচ্ছে ছিল আজ সারাদিন বরষা আমার সাথে থাকবে। চাইলেই তো
আর সবকিছু হয় না! শহরের জীবনে বরষাও একান্ত নিজের নয়!
খাপছাড়া সম্পর্কের মতো! এই আসে এই যায়! নিস্তব্ধতার প্রহরগুলো
বরষার মতো হিম ও অবসন্ন! আমার দৃশ্যসীমায় কোথাও তুমি ছিলে
না! হঠাৎ চা বাগানের সরল রীতির মতো তুমিও দাঁড়ালে তার পাশ
ঘেষে! অভ্যাসবশত নদী ও বনভূমি বৃষ্টির জল নিয়ে খেলতে থাকে
সারাদিন। পাল তোলো নৌকার ওপারে ধু ধু মরুভূমি, মরুবাসীদের
মন ছোট হতে হতে ঘাসের চেয়েও আরও ছোট হতে থাকে!
তাদের কাছে বরষা ও নদীর গল্প যথেষ্ট সুখকর নয়!
###

ফকির ইলিয়াস
পাঠপর্বের চিহ্নগুলো
চিহ্নগুলো চিনে রাখো। রোদ উঠবে না জেনেও
সূর্যের দিকে তাকাও। দেখবে আদিম তেজ ও তৈজস
ঝলসে দেবে তোমার চোখচক্র-
আর এই চক্রের ভেতরেই আমি তোমাদের জন্য
রেখে যাচ্ছি যে আয়ু;- তোমাদের যাত্রা শেষ হলে
তা তোমরা অন্য কারও মাঝে বিলিয়ে দিও।
বিলিয়ে দিও সকল পঠন এবং পর্বত,
পথ এবং পথ্য
পরাগ এবং পরমাণু।
সূর্যের ক্ষুদ্রাংশটুকু চিনে রাখো। যে বাষ্প সমুদ্রে হারায়
কিংবা যে ঘূর্ণি, হাওয়াকেই মনে করে তার সহোদরা,
দাঁড়াও তার সমান্তরালে।
তখন তুমি আর নিজের অস্তিত্ব কিছুই দেখবে না।
জানতে পারবে না, গহীন সমুদ্রের বুকে এর আগে
হারিয়ে গেছে কত প্রাণের সমাধি।
###

কাজী জহিরুল ইসলাম
মৃত ঘোড়া ভেবে
মৃত ঘোড়া ভেবে কোনো জুয়াড়ি এখন পাশ কেটে
যেতে তাকায় না কৌতূহলি চোখে। অথচ আমার
দুরন্ত খুরের ওপর সর্বস্ব রেখে ওরা ফেটে
পড়তো উল্লাসে। ময়দানে ধুলো উড়িয়ে পাহাড়
গড়ে দিয়েছি ওদের। দম্ভের পাহাড়ে ওঠে শ্লেষা
ঝাড়ে দেখো ওরা এখন আমার নিস্তেজ শরীরে।
খর-বিচালির জন্য আমি যখন তাকাই, হ্রেষা
ডাক পৌঁছে পাহাড় চুড়োয়, চায় না ওরা ফিরে।
শেষ বিকেলের আলো এসে পড়েছে ঘাসের মাঠে
আমি উঠে দাঁড়াব যেভাবেই হোক আরও একবার
ডোবার আগেই অস্তগামী সূর্য দূরের অরণ্যে
প্রান্তরের বনভূমি প্রকম্পিত করে সমস্ত তল্লাটে
ঘোষণা করব, দেখো, আমি ময়দানে পুনর্বার।
কোনো জুয়াড়ির জন্যে নয়, এবার নিজের জন্যে।
###

শতাব্দী জাহিদ
দাঁড়ি
[ইদ্রিস আলী মাস্টারকে]
দুধের দাঁত চলে যায়―
যায়, শীতের অজু না ভেঙে সরিষার ফুলে ঢাকা মাঠের
আইলের মাটি ঘষে ফুলে ওঠা নুনুর দিন।
কৈশোরের নিষিদ্ধ ইশারায় শৈশবের মিথ উধাও
উধাও, ঘাড়ত্যাড়া দিনলিপি;
ঠুকে ঠুকে আদায় করা ম্যাচিউরিটি পৌঁছানো রক্তের গরম।
সূত্রের ফাঁদে পড়ে লুটপাট পায়ের নিচের শক্ত জমিন
প্রেমিকার মুখ, প্রেমময় নারী-শরীর।
নবুয়তের প্রেমে জিরো টলারেন্ট বয়সের সিঁড়ি
তাও কেমন করে যেন পড়ে যায় বার্ধক্যের প্রেমে!
সংসার ফেলে যেমন পড়েছিলাম মদের দোকানের নাচনেওয়ালিদির ঘোরে।
আকাশটায় ছোটে মেঘের ভেলা
হালকা হতে থাকে বিসর্জনের মায়ায়
স্মৃতিরা আওড়ে ভুলভাল ঠিকানায়,
সম্পর্কের কাভারে টানে মার্জিন
চিরসত্যের হরফে এবার ঠিকঠাক আঁকে দাঁড়ি।
###

ভাগ্যধন বড়ুয়া
অরণ্যঘ্রাণ
ধ্যানী অরণ্যে আমিও হাজির হই শুক্লপক্ষের সপ্তম রাতে ; সাধক বৃক্ষরা জোছনা সাদায় নিজ ভাষায়
ভাব বিনিময়ে ব্যস্ত আর তাদের স্বতঃস্ফূর্ত ঝিমঝিম শব্দে চু এর মাদকতায় ঢুলুঢুলু চোখ,বনের
আধো ঘুম আধো জাগরণে পাতা ঝরার শব্দ বিচলিত করে অরণ্যপ্রেমী আগন্তুকের। বসন্তের প্রথম
পাক্ষিকে শীতের জড়ানো-কাঁপানো স্বভাব তখনও কমেনি কিন্তু বৃক্ষের শীত লাগে না, তারা নিজেদের
বাকলে শীত কিংবা বর্ষা প্রশমন করে তবুও আগন্তুক কাঁপে হিমের প্রবলে কিন্তু জোছনার প্রাবল্যে
নিদ্রাদেবী ভর করে না চোখের কোণে। বন নিজেই মাতাল হয় নিজস্ব ঘ্রাণে, প্রাণে বহতা থাকে রাতের
শব্দাবলি, ধীরলয়ে বেজেই চলে ঝি ঝি ঝি… সপ্তরাগ মিশে যায় চুনিয়ায়।
হারে রে হারে রে…সমবেত সংগীতে আদিবাসী উঠোনে প্রাণের উচ্ছ্বাস তখনও কমেনি, কেউ ঝিমায়,
কেউ ঘুমায় আর কেউ নেচে-গেয়ে উৎফুল্ল রাখে রাতের প্রহর। জোছনার মতো সহজ-সরল আদিবাসী
রাত, প্রহর কেটে যায় নৃত্যরত পায়ের ছন্দে, চৈতি ফুলের গন্ধে আর চাঁদবুড়ির সুতা কাঁটার গল্পের
মতো উত্তরাধিকার আখ্যানে…
রাত ও নেশা বাড়লেই পাহাড়ে প্রথম প্রবেশের কথা মনে পড়ে; সেদিন বেলা পশ্চিম দিগন্তরেখা ছোঁয়ার
কাছেই, গাছের ফাঁকে ফাঁকে সূর্যালোকের নির্দেশনায় পার করি পাথুরে পথ, অসতর্কতায় পা পিছলে
ধূলিমাখা শরীরে নিজেরে লুকাই; ততক্ষণে পাহাড়ি সারল্যে আড়ষ্টভাব কেটে গিয়ে ধুলোর মমতায়
জড়িয়ে যাই, মঙ্গোলিয়ান মোটা নাকে আমিও তাদের বংশধর…
ভেতরে ভেতরে এতদূর এসেছি টের পাইনি; ভেসেছি জোছনা প্লাবনে, কেঁপেছি জমিদারি শীতের
আভিজাত্য আদরে আর নিমজ্জিত ছিলাম ভালোবাসাভরা বনের ঘ্রাণে। বনের গহীনে মনের গোপন
কিছু অনুভব জমা রেখেছি, জানি বৃক্ষ কোনদিন কাউকে প্রকাশ করবে না আবক্ষ অনুরাগ আবেগ;
শীতে পাতা ঝরার কালে যদি ভুলে যায় আমার জমানো কথা তবে তার আগে আবার অনুরোধ করে
আসব যেন এইসব কথাবার্তা না ভোলে তোমার সঙ্গে দেখা না হওয়া পর্যন্ত!
আশায় আছি আবার অরণ্যঘ্রাণে মাতাল হবো ভরাপূর্ণিমায় আর তখনও আদিম হবো যূথবদ্ধ
ভালোবাসায়…
###

মাসুদ পথিক
সঙ্গম রিটার্ন
শীত কেনো আজ বৃষ্টির রুমে ঢুকে
শুয়ে আছে, বন্ধ করে দরজা
মা বকছেন, কলেজের সময় গড়িয়ে যায়
বইয়ের পাতায় নিদ্রা ঝাপিয়ে পড়েছে
বাক্যগুলো পিছল, অক্ষরও ভেজা ভেজা
বর্ণেরা খুব আত্মহারা
দূরে, হিজলবনে ডাকছে ঘনকালো দেয়া
গল্পটা আজ কামুক ও অনুভূতিপ্রবণ
দুই বোনের মাঝে, লেপের নিচে ডালিমকুমার
পেয়েছে খুঁজে কঙ্কাবতীকে
মা বকছেন, মেয়ে দুটো কেমন নির্লজ্জ!
পাঠ্যবইয়ের পাতা কাঁপছে, থরোথরো
বাইরে বৃষ্টি ঝরঝর
শীত ও বৃষ্টির ছায়া নড়ে, বিছানার পাশের দেয়ালে
পুষি বেড়ালটি করে শিকার তাকে জৈব খেয়ালে
###

শামীম হোসেন
খ্যাপক
কাঁধে কলা গাছ নিয়ে ঘুরছে খ্যাপক। থলেতে খড়িশের বিষ।
মাটিতে লুটিয়ে পড়ে হাড়ের বাঁশি। ফুঁ দিলে বেরিয়ে আসে
ক্যালসিয়াম সুর। মেহেদি রঙ। নাগকেশর। হরিণের শিং।
কামশাস্ত্রের পৃষ্ঠা থেকে সেই খ্যাপক ছেড়ে দেয় ক্যাটফিস
যত জলা ও জঙ্গল পেরিয়ে লাফ দিয়ে ভাসিয়ে দেয় নদী।
আমাদের মাঠ মাঠখ্যাপক।
খ্যাপকের থলে ভরা বিষ।
গোল গোল চোখের বিস্ফার। ইঁদুর রঙা টুটাফাটা মেঘ।
নবহাওয়া। চরকের রক্ত। রেললাইন। সব যজ্ঞডুমুর।
ভেঙে পড়া চাঁদের চূর্ণ কুড়িয়ে বানানো সেই চন্দ্রমাঠে
ঘোড়ার খুরের নিচে প্রাণ দিল এক গর্ভবতী বেড়াল।
এতদিন গুপ্তকূপের ভেতর লুকিয়েছিল খ্যাপক মাছি।
###

মুজিব ইরম
নিমন্ত্রণপত্র
উত্তরেতে বাঁশের ঝাড় কুটুম পাখির বাস
দক্ষিণেতে কলার ঝাড় ভর্তি দূর্বা ঘাস।
পুবের দিকে বিরাট পুকুর জিওল মাছে ভরা
পশ্চিমেতে ফলের বাগান সবুজ দিয়ে গড়া।
আছে একটা বিরাট উঠান জোছনা ঝরে রাতে
আছে একটা ফুলের বাগান শিউলি ঝরে প্রাতে।
চারপাশেতে খালবিল সবুজ ধানের মাঠ
পুকুরেতে হিমশীতল জল শান বাঁধানো ঘাট।
সকাল বিকাল পাখির ডাকে বাড়ি জেগে রয়
সকাল বিকাল আলোছায়া মিষ্টি হাওয়া বয়।
এই তো আমার বাড়ি এই তো আমার ঘর
আইস তুমি আমার বাড়ি নও তো তুমি পর।
###

তুষার কবির
নাচঘর
কেয়া ও কামিনীর ঘ্রাণে তুমি ছুটে এসেছ এই সান্ধ্য অপেরায়!
নাচঘর থেকে কিছুটা দূরেই পুড়ছিল প্রণয়ীর শেষ পাণ্ডুলিপি ছায়া ও ছাতিমতলা থেকে আরও কিছু দূরে উড়ছিল মুঠোভরা শাদা পাতা শুনতে কি পাচ্ছ সেই কান্নাভরা দাহগাথা?
ঘুঙুরের দানা গড়ানো সড়ক ধরে প্রহরী ও পায়রাঘেরা প্রাচীর পেরিয়ে তোমার পায়ের ছাপ ধরে আরও এসেছে এক বিষাদ ময়ূর!
ময়ূর যে পথে হেঁটে যায় তৃণলিপি পার হয়ে সেই পথে আমিও ছুটে যাই কোরক ছড়ানো আমলকীবনে!
শোনো, জগতের এই ভ্রম অপেরায়, তুমি আমি সকলেই, পাটাতনে তলিয়ে যাওয়া কোনো দণ্ডিত নর্তক!
###

নওশাদ জামিল
বৃষ্টি নদী
চোখের কোণে নামল টলোমলো
বৃষ্টি নদী, ভিজলো দুইধার
অন্ধকারে কাঁপছে সরোবর
স্তব্ধ হলো হৃদয় পারাবার!
বৃষ্টি মুছে আঙুর মেখে ঠোঁটে
নামলো ঝড় তোমার সিঁথিজুড়ে
হঠাৎ করে তীব্র ঢেউ আজ
তুফান বেগে আছড়ে পড়ে দূরে।
বৃষ্টি দেখে জোরসে দাও টান
আয় রে নদী, ভিজুক চারপাশ
আঁধার রাতে কাঁপছে সরোবর
বুকের কাছে ভাসলো রাজহাঁস।
অন্ধকারে তোমার ঠোঁটে ঝরে
আর্দ্র মধু, প্রেমের নিরাময়
মুগ্ধ হয়ে উঠল ফুঁসে জল
ভাসল তরী, নাই রে কোনো ভয়!
###

মিছিল খন্দকার
নকশা করা রঙিন হৃদয়
উল্টেপাল্টে দেখছি আবার
মুখ ঘুরিয়ে দেখছি সকল-
কিছুক্ষণের ‘না’য়ের ভেতর
কোথায় কিসের ছোটার ধকল।
তাই সকালে হাঁটতে গেলাম
পা আটকে নেয়, ফাটল মাঠের
সবাই আছেন রক্তে-মাংসে
আমার শরীর হয়তো কাঠের।
নয়তো তাতে কাটলে এমন
রক্ত পড়তো; যখন জখম-
একটা মুখকে পরখ করায়
মুখ হয়েছে তিরিশ রকম।
কোন মুখে সে হাসছে এখন
কোনটাতে বিষবিরক্তি তার,
কোন তাকানো সন্ধ্যাসম
কোন কথাতে সানাচ্ছে ধার!
ফলে জটিল কঠিন হলো
ফস্কা গেরো বজ্র আঁটে-
নকশা করা রঙিন হৃদয়
দুপুরবেলা পিঁপড়া কাটেন।
###

নাহিদ হাসান খোকন
ভাবের গীতি
এক.
পূর্ণিপসার দিঘির জলে
জলের মাঝে চাঁদ যে জ¦লে
অপরূপে স্বরূপচন্দ্র
জ্বলজ্বল করে ॥
গগনের চাঁদ বড়ই নিটোল
জলেতে করে রে টলমল
মধুরাতে মিলন ঘাটে
পিরিতের আলো ঝরে ॥
পাড়ে থেকে চাঁদের আলো
দেখিতে যে লাগে ভালো
ভুলে সে জলে নামিলে
সোনাচাঁদ পাবে না রে ॥
মণিচান্দে মুনি ঋষি
জ্যোৎস্নাস্নানে যে খুশি
খোকন চায় বেশি বেশি
তা হবে কেমন করে ॥
দুই.
ওই চাঁদের কথা বুঝাই কেমনে।
অমাবস্যা-পূর্ণিমা হয়, মানবমনে ॥
দেহনদীতে চন্দ্রপক্ষ
না বুঝে করো না তর্ক।
তিথি পরে স্থিতি যোগ
রতি ধারণে ॥
দেহ জলের জোয়ার কালে
নাম ভুলিলে ডুববে তলে।
মণিচন্দ্রের সাধন হয় গো
মধুর বনে ॥
দেহ নদীর জল ছলছল
কাম বিহনে গেলেই অটল।
কাঁদে খোকন, চাঁদের কারণ
গুরুর চরণে ॥
গুরুছায়া দিঘি
কলকাতা
ফাল্গুন ১৪২১
###

ফারুক আহমেদ
নুসরাত
একটা পথ বলাৎকার হয়ে পড়ে থাকল; আর তার উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে গেল লোকগুলো। ওই লোকগুলো একটা জঙ্গলকে এমনভাবে ধর্ষণ করল যে- ওই জঙ্গলের গোপনাঙ্গ থেকে কল কল রক্তের মতো বেরিয়ে গেল পশু-পাখি-ফুল আর তার নিজস্ব গন্ধরাজ। আমরা বলাৎকার এবং মৃত পথ নিয়ে মাতম করতে থাকলাম, মাতম করতে থাকলাম গোপনাঙ্গ খোয়ানো জঙ্গলের জন্য। এই দিকে সেই লোকগুলো একে একে বলাৎকার করে গেল, চেয়ার, টেবিল, ব্ল্যাকবোর্ড, রাষ্ট্র, বড় বড় নদী, অক্ষর, এমনকী সেই নবীন স্বপ্নকে, যে স্বপ্ন আজ সকালেই আপনার আঙুল ধরে বেরিয়েছিল পৃথিবী দেখতে। এইভাবে সেই লোকগুলো নুসরাত, ফাতেমা, বাস-ট্রাক-লঞ্চ, সুন্দরবনের চিত্রা হরিণ, মফস্সল থেকে লোকাল ট্রেনে মাত্রই আসা বিহ্বল চোখের দল- সব বলাৎকার করে যাচ্ছে।
সেই লোকগুলো যেন একটা বাতাস- বাতাস ধানগাছকে এমনভাবে বলাৎকার করে যে, ওই ধানগাছ চিরকালের জন্য ঘাড় কাৎ করে পড়ে থাকে ক্ষেতে। সেই লোকগুলো যেন একটা ঝড়- ঝড়ে কত বৃক্ষ বলাৎকার হয়ে ভেঙেচুড়ে যায় নিঃশব্দে। না, না, সেই লোকগুলো সুনামি- লোকালয়ের পর লোকালয় ভেঙেচুরে গিলে ফেলে। না, না সেই লোকগুলো আরও বড়, আরও…
###

পিয়াস মজিদ
জ্যোৎস্নার কাছে বালকের শহর
ঘুমের ভেতর চলে যাই ফেলে আসা শহরে,
যেহেতু আমার যাবত জাগরণ ঘুমোয় সে শহরে।
মাঝেমধ্যে বুকের নিঝুম প্রাণপুকুর-পাড়ে
নিবিড় এক রামঘাট জেগে ওঠে,
সেখানে
বিগত-বালকের চলাফেরার চিহ্ন কি কেউ খোঁজে?
তোমাদের আজকের নিরুপম নগরে
দরদালানের ভিড়ে যে জ্যোৎস্না স্থবির হয়ে আছে
শুধু তাকে বলি,
স্বপ্নের ভেতরেও উদ্বাস্তু যে তিমির-বালক;
তার ভূমিহীন পদতল আর পুষ্পকরথে
ভারসাম্যের বিন্দু এঁকো না
তোমার আলোর আলপনাতে।
বরং তুমি ত্বরিৎ
জানাও আমাকে
সোনালি সংগোপনে;
একজীবনের গাড়িতে
ঢাকা থেকে
কুমিল্লা
কতদূরে
কতদূরে…
###

রাসেল রায়হান
ভালোবাসা
আপনি তাকে ভালোবাসবেন, বিনিময়ে খোলা জানালা দিয়ে সে বাড়িয়ে দেবে অতিসতর্ক হাত। শোবার ঘরের প্রতিটি দৃশ্য, এমনকি সন্তান জন্মদানের প্রক্রিয়াও ধারণ করে রাখবে নিখুঁতভাবে।
আপনি তাকে ভালোবাসবেন, বিনিময়ে সে আপনাকে গুম করে দেবে কোনো নক্ষত্রহীন অন্ধকারে। দেশদ্রোহী উপাধি দিয়ে অন্য কারও ছাতার তলায় দাঁড় করিয়ে রাখবে জীবনভর। জেলে পচিয়ে মারবে। তারপর যখন আপনার শরীর গন্ধ ছড়াতে থাকবে, রাস্তা ভেঙে হেঁটে যাওয়া মানুষ গালি দেবে, তখন যদি সে আপনাকে পরিত্রাণ দেয়।
বরং নিজেকে ভালোবাসুন। অন্য কাউকে ভালোবাসা নিরাপদ নয় এখন।
###

মিলু শামস
আংটি ও এক কিশোরীর গল্প-৩
পশ্চিমের ঘর বাসর সেজেছে
হাস্নুহানা, কামিনীর, গন্ধরাজের
যৌথ সুবাসে উদ্বেল
সন্ধ্যাত্তোর মিহি রাত
কিশোরী জড়সড়, থরথর বুক
আনত দু’চোখ।
থেমে গেছে কোলাহল
বিয়েবাড়ির
দরজায় পড়েছে খিল;
অচেনা পায়ের আওয়াজ
এগিয়ে আসে ধীরে-
আলগোছে পাশে বসে
তুলে নেয় হাত
উষ্ণ দু’হাতে।
সেই কবে কারুকাজ করা
বটুয়া হাতে গুঁজে
দ্রুত পায়ে পালিয়েছিল যে
ঘোরলাগা সন্ধ্যায়-
দেখা হয়নি ভাল করে তাকে
ধূসর আবছায়ায়,
স্পর্শ শুধু জাগিয়েছিল শত সুর
আর আংটি-
ভেলভেট মোড়া রত্নটি যেন
ছিল বাক্সময় অনামিকায়।
কথা হতো শতবার মনে মনে
কোন্্ ফাঁকে হৃদয় গিয়েছে চলে
একটু একটু করে
সন্ধ্যার সেই অভ্যাগত-র দখলে।
বাড়ি থেকে বিদায়ের আগে
আত্মীয়গুরুজন দিয়েছে
ঘরকন্না, স্বামী ও শ্বশুরবাড়ি
সামলানোর মন্ত্র ও উপদেশ।
নিমন্ত্রণ রাখতে এসেছিল
গীতামাসী, পরান কাকা
মার অনুরক্ত বৈষ্ণব যুগল,
সংসার বিরাগী গীতামাসী-
সেও বলেছিল পরম স্নেহে
স্বভাবসুলভ পরিহাসমাখা
শ্লোকে শ্লোকে-
‘মা জননী শোনো,
আক্কেলে সক্কল বন্দি
শিকড় বন্দি গাছ
মায়াজালে পুরুষ বন্দি
জলে বন্দি মাছ।’
আরও কত শত বাণী, কত জনের
সবার সব কথা শুনেছে কিশোরী
ধারণ করেছে কেবল
সেই কথা বড় ভাইয়ের-
‘… হোসনে গৃহপালিত প্রাণী’
ওই এক বাণী বুকে গেঁথে
এসেছে আজ শ্বশুরবাড়ি।
॥ দুই ॥
স্বামী তার সন্ন্যাসী গৃহী
পেশা সরকারি চাকরিজীবী
নেশা বাগান করা।
শৈশবে পিতৃহীন, সে সুবাদে
সংগ্রামী জীবন
করেনি কুটিল তাকে
বরং আকাশের মতো উদার হৃদয়
নিয়ে উদাসীন যেনো
কোন্্ সুদূরের টানে।
যেদিন দেখেছিল সে
কনে দেখা আলোয়
দৃঢ়চেতা কিশোরীকে
সেদিনই আঁকা হয়ে গেছে
অবয়ব তার হৃদয়ের ক্যানভাসে।
শাশুড়ি শরিফ বংশের মেয়ে
সরল সৌকর্যে ভরা খান্দানি মেজাজ
বধূকে টেনে নিয়ে বুকে
অকৃত্রিম মমতায়
বলেন সস্নেহে-
‘সংসার কোরো মা, নিজের মতো করে।’
তাই হয়েছিল তার নাতিদীর্ঘ
দাম্পত্য জীবনে,
স্বামী তার হয়নি বাধা কোনো কাজে
বরং পেয়েছে অপার স্বাধীনতা
সবটাতে আর
সম্মান সব মতামতে।
জানা হয়নি কিশোরীর তাই
স্বামী-স্ত্রীর প্রথাগত
প্রভু-ভৃত্য সম্পর্কের স্বরূপ
কাকে বলে স্বামীর মন যোগানো।
শরতের শুভ্র মেঘের মতো
নির্ভার কেটেছে জীবন
বয়ে গেছে অনাবিল
শান্ত নদীর মতো।
ওলস্টোনক্রাফট কিংবা রোকেয়ার
লেখা পড়েছিল কি সে
ওই বয়সে? না।
ক্লারা জেৎকিন, বোভোয়ারকেও
চেনে না সে তখন
আয়োজন করে হয়নি প্রয়োজন
জানার, কাকে বলে নারীবাদ
নারী স্বাধীনতা।
কেননা পরাধীন ছিল না সে কোনকালে
মগজে-মননে,
কর্মেও নয় সংসারে এসে।
॥ তিন ॥
স্বামীর বদলির চাকরি-
শেষ হলে বিয়ের যাবতীয়
অনুষ্ঠান আচার
বধূসহ ফিরে যায়
কর্মস্থল জেলা শহর।
দোতলা সরকারি কোয়ার্টার
সামনে সবুজ লন
পেছনে খিড়কির বাগান,
রান্না বান্না নিয়েছে শিখে
হাত পুড়িয়ে ধীরে ধীরে
স্বামীই শিক্ষক এ কাজে
যদিও পরে, শিক্ষক তো বটেই
ছাড়িয়ে গিয়েছিল অনেক
পাকা রাঁধুনীকে।
পুরোটাই ছিল শৌখিন তার
রান্না বা হাতের কাজ-
সুঁইসুতো থেকে কুরুশ কাঁটা
উল বোনা
সব কিছু পরিপাটি।
হাতের কাজ শিখেছিল
মা ও ফুফুদের কাছে-
নিখুঁত নিটোল রিপু
যেন বাগানের ফুল
ফুটেছে রুমালের ভাঁজে
টেবিল ক্লথ আর বালিশ-কভারে;
এসব ছাড়া মূল কাজ ছিল তার
বই পড়া।
সকালে স্বামীর অফিস,
ঘরকন্নার কাজে তদারকি
তোড়জোড়
তারপর অখণ্ড অবসর
কেটে যেত বইয়ের পাতায়।
ছেলেবেলা থেকে সাহিত্য-পড়া মন
বিকশিত, আলোকিত হয় আরও
সঙ্গীর সোৎসাহ সাহচর্যে;
॥ চার ॥
বিদ্যাপীঠে যাওয়া হয়নি আর
সেটাই হয়তো রেখেছিল তাকে
প্রকৃতির মতো স্বাভাবিক
আর অকৃত্রিম উদার।
মেয়েলি ন্যাকামোর ঠাঁই ছিল না
জীবনের পরিসরে-
আরশোলা দেখে কৃত্রিম ভয়
ছুঁচোর গন্ধে অজ্ঞান
অথবা অন্ধকারে শাকচুন্নির
নাচ দেখে জড়সড়
এসব ছিল না তার অভিধানে
মনটা ছিল পুরোপুরি
অন্য ধাঁচে গড়া।
যেন হিমালয় থেকে নেমে এসেছে
দৃপ্ত হৈমন্তিকা,
হেঁট হয় না ঋজু মাথা
কুপ্রথার প্রাচীরের কাছে।
কথার প্রলেপে গাঁথা
মধুর চাতুরির ফাঁদ
পাতেনি সে কোনোকালে
বরং ঘৃণার গরল
ঢেলে তাতে
এগিয়েছে সে
একটু একটু করে
শুদ্ধ জীবনের পথে।
খিড়কির বাগান টপকে
বর্ষায় মাঝে মাঝে ঢুকে যেত
সাপ খোপ নিচের করিডোরে
কোমরে আঁচল বেঁধে
কঞ্চির মোটালাঠি হাতে
একাই মুখোমুখি হত তার।
‘তুমি যাও এসব নয়
মেয়ে মানুষের কাজ’
গৎবাঁধা এই কথা শোনেনি
কোনদিন স্বামীর মুখে তার
এমনকি যখন গিয়েছে সে
কাঠমিস্ত্রীর কাছে
ফার্নিচার বানাতে অথবা
ঘরের আর কোনো কাজে
অন্য কোনোখানে
সেই মধ্য ষাটের দশকে।
॥ পাঁচ ॥
‘মেয়ে মানুষ’- এই জঘন্য শব্দবন্ধ
শুধু শব্দ তো নয়
দৃষ্টিভঙ্গী প্রচলিত সমাজের
অধস্তন, হেয় করতে মেয়েদের
করেছে দুই ভাগ মানুষের;
বানিয়েছে ‘নারী অধিকার’
নারীর জন্য হেন তেন ইত্যাদি।
মানুষ সে তো মানুষই
স্বাভাবিক বিকাশ নিশ্চিত হলে
সব মানুষের
প্রয়োজন কী বিশেষ সুবিধার?
তা যাতে না হয়
পাকা ব্যবস্থা করেছে তার
রাষ্ট্র ও সমাজ;
পুরুষতো বটেই
বহু নারী পারে না যা থেকে
মুক্ত হতে পুরোপুরি
প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চ শিক্ষায়
হয়ে শিক্ষিত কিংবা কর্ণধার হয়ে
বড় প্রতিষ্ঠানের।
মগজে গেঁথে থাকে তার
মাথা হেঁট করে রাখার
ওই দৃষ্টিভঙ্গি- ‘তুমি মেয়ে মানুষ’;
এমন কি তত্ত্বের স্লোগান তোলা
চিহ্নিত বহু ‘নারীবাদী’
অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি- আক্রান্ত
ভেতরে ভেতরে।
কিশোরী মুক্ত ছিল পুরোপুরি
এ থেকে, মুক্ত রেখেছিল
ছেলে ও মেয়েদের তার
‘মানুষ’ হওয়ার পাঠ নিয়েছিল নিজে
দিয়েছিল সন্তানদেরও
এই তার বিশেষত্ব
এখানেই অসামান্য সে
সফল পেশাজীবী, প্রতিষ্ঠিত
অনেক নারীর চেয়ে।
পৃথিবীর পাঠশালায়
নিতে নিতে পাঠ
কিশোরী দেখেছে-
এ সমাজ ক্ষমতার দাস
ক্ষমতার নিচে চাপা পড়া
কত দীর্ঘশ্বাস
মিশে থাকে কালের
কঠিন শিলায়,
রয়ে যায় আড়ালে
প্রথা ও প্রতিষ্ঠান নামের
নানান কুটচালে।
###

অতনু তিয়াস
ঢেঁকি
গাছটাকে হত্যা করতেই একপসলা বৃষ্টি ঢলে পড়ল ঘুমে
নাব্যতার খোঁজে বয়ে চলা নদী স্রোত হারিয়ে
মাঝপথে গেল থেমে।
গাছের বুক বরাবর চলছে করাত
আর্তনাদে ঝাঁঝাঁ রোদ্দুর পেরিয়ে
বাতাসের দীর্ঘশ্বাস তপ্ত হয়ে ওঠে
নেমে আসে বিষণ্ন রাত
পরিচয় পাল্টে দিয়ে
গাছের গল্প হয় অন্যরকম-
আলতাপায়ের পাড়ে গেরস্তের ব্যস্ত ওসারায়
মাথা তুলে জেগে ওঠে ঢেঁকি শিরোনামে
হয়ে ওঠে কর্মমুখর পুনরায়।
ধীরে ধীরে আলতা রঙ পা বদলায়
প্রতিটি পায়ের গোছা দিনে দিনে শীর্ণ হয়ে আসে
হাজারো নবান্নকে কুর্নিশ করে অবসন্ন ঢেঁকি
অবশেষে ধান ভানতে স্বর্গে চলে যায়।
###

মিতুল দত্ত
বাজি
পাতা ছেঁড়ো, খেয়ে ফেলো অমিত্র অক্ষর
স্থানাংক ভুলেছ যদি, তবে গান এখানে থামাও
পারিপাট্যহীন জলে যে আহ্লাদী দেখে তার মুখ
তার অবলুপ্ত জিভে চেপে ধরো অযৌন সন্ত্রাস
কালো কুলুঙ্গির দিকে ফেরানো নিকষ মুখ, যে মুখ তোমার
ক্ষমাতীর্থে কাঁপে চাঁদ, একাদশী, আরব্ধ আচার
গল্প না শোনার ছলে, গল্প থেকে দূরে বসে কারা
আর্তনাদ বাজি রাখে, যেন তুমি মায়াবী ক্যাসিনো
রুপোর চাকতির মতো, গিলে নিচ্ছ লিবিডো আমার
###

স্নিগ্ধা বাউল
ছাতিফাটা দুপুরে
ঠিক দুপুরটা মাথার উপর ইতিহাস
নামিয়ে আনে,
ব্যক্তিগত পাঠের অক্ষরে চোখ পাতি
শতছিদ্র বেয়ে নামে টিনের চালায়
সুখের আলো-
অক্ষরগুলো জ্বলে মখমলের মতো
হরিতকীর ডালে ডেকে যাওয়া দোয়েল
নির্বাসিত জমির আইলে জোড়াপা ধরে
মচমচে পাতায় দীঘল কান্না;
এখানে দুপুর নেমে আসে
পাড়াগাঁয়ের আলতা দুপুর
রোদের বদৌলতে এখানে
পঠিত হয় ‘মনে রেখো’
‘ভুলো না আমায়’ জেগে থাকে
সুঁই এর ডগায় নরম ফোঁড়ে
কতদূর কে ভুলে যায় এমন
বহুদিন ধরে বহুদিন ধরে
ইতিহাস নামে এই দুপুরে
দিঘির জলে পা ডুবিয়ে
জীবনের মতো একটি কবিতা
লিখিয়ে রাখে আমায় দিয়ে।
###

আকাশলীনা
শ্রাবণ-ক্ষত
এই যে নিজেকে নিজে এত আঘাত করা,
প্রতীক্ষার গা বেয়ে গড়িয়ে আসছে নীল কষ,
রাতকে দিন করে, নিঃশ্বাসের অনুশোচনা গোলাপের ঘ্রাণ দিয়ে ডাকছে জ্বরের পূর্বাভাস…
জ্বর ফুটে ওঠে দুঃখ ছোঁবে বলে,
সে যে আমার স্বেচ্ছাচার প্রতিবেশী…
এখন বন্ধ চোখেই দেখতে পাই, কপালে বিশ্বাসের স্বাক্ষর,
যে আগুনে পুড়ছে চুম্বন, যে বিষে সুখ হয়েছে প্রবল শব্দহীন,
সেখানে রাত আমার আশ্রয়, নৈঃশব্দ্যে ঘুরেফেরে বিহ্বল মায়া!
তাই খোঁপাতে জড়াই তোমার ফেলে দেওয়া
শ্রাবণ-ক্ষত…
চরাচর জুড়ে জন্ম জন্মান্তরের
ভালোবাসা গুছিয়ে রাখি জাফরানি
আতরের বাক্সে, গুছিয়ে রাখি চোখের টলটলে লবণে ভাসা আমার টিয়া রঙের গাঁ।
পরবাসে ছুটে আসে ঋতুদের ঘ্রাণ,
তবে স্বপ্নে কি ছিলো নদী সঙ্গম না কি
বিষাদ-জোছনা!
###

অরবিন্দ চক্রবর্তী
আলফা ক্ষমতা
লিখিত হলো শিলার কথা, তোমার লেজ ভালো নেই-
যে সুতো ধরে ডাকি, আরস কেঁপে ওঠে।
যাবে কথা লেজের দরবারে, ক্রমিক থেকে জানা হবে
তালিকায় খুঁজে পাওয়া গেল না প্রাণীমন।
তুমি, তোমার শরীর কারও ইকেবানা ধরে বাঁচে
ক্রোমোজম বনে প্রাণের কাঠামো অথবা কাঠামোর প্রাণ দেখা দেয়
খুঁটে খুঁটে মউড় বানায় একজন, গম্বুজ করে তারই সহোদর
ডাকা হলো আমাকে, আরও এলো গলির মাস্তান; নাম আইনস্টাইন।
প্রকাশ্য রাতে ফোটালে ডিম
শুরু হলো জীবলীলা, লাঠিখেলা, মুকুট দখল;
সেই থেকে আমাদের রিলেদৌড় যথাতথা আর চোখভর্তি আল্পনিক উইন উইন।
###

নাহিদ ধ্রুব
স্বপ্নের ভিতর স্বপ্ন
এমন জগতে তুমি এসেছিলে কবে?
যেখানে মানুষ সব ফুল হয়ে ফোটে
সারারাত জেগে থাকে নিভু নিভু চাঁদ
নিজে নিজে মরে যায় ফেলে রাখা ফাঁদ
বহুকাল পর তাই মনে পড়ে যাবে
যখন আকাশ থেকে খসে যাবে তারা
কতদিন যেন কারও আসেনি দোসর
জেগে রবে সারা নিশি আহামরি পাড়া
কেউ কারও কথা ভেবে খুলবে দুয়ার
একদিন যারা ছিল সবকিছু ভুলে
এই দেখো চারিদিকে বইছে বাতাস
মানুষ যখন থাকে ছায়াদেহ খুলে!
গভীর বনানী থেকে আসবে খবর
জগতে তোমার কাছে কেউ নাই পর!
###

কুশল ইশতিয়াক
যাত্রিক
কথাটা প্রাচীন। বলতে চাইলাম আবারও।
সমুদ্র বাতাসের গন্ধও তখন টের পাওয়া গেল । একবার যখন যাবো-
আর তো ফিরব না। করোটিতে তারপরও পাই সে সব স্মৃতিদৃশ্য-
যা আগে দেখি নাই। প্রাণ কি হাওয়ার মতো- কোনো পরজীবী?
ভালো লাগে না আমার।
এই সত্য কয়বার উচ্চারণ করলে মিথ্যার মতন দেখাবে না আর?
###

অপু মেহেদী
হল্লামুখর চিত্রনাট্য
এইসব টিকিটাকা দৌড়ঝাঁপ ফেলে একদিন দেখে ফেলব হস্তবিশারদের গোপন হাঁসফাঁস। আমার কোনো ব্যক্তিগত রোদ থাকবে না, কস্টিউমের জিপারে মরিচা জমবে অবিরাম। হাতিরঝিলের বোটম্যানকে জিজ্ঞেস করব না-‘কতটা জল ফুরালে শুষ্ক হয় হাম্বুরাবির অশ্রুনদী’।
এক নিয়ান্ডারথাল মানবীর দেহের গন্ধে জেগে থাকব ঊনবরষা। প্লানচেট গ্রাফিতিতে ভরে উঠবে হল্লামুখর চিত্রনাট্য। কর্ষিত জলের যৌবনে মানুষ মানুষ খেলবে ইহজৈবনিক পাপের হলুদ।
একদিন ঠিক সাঁতরে যাব তোমাদের কাগুজে আকাশ…
###

রওশান ঋমু
চিঠির সংস্করণ
অনেক বছর আমাকে কেউ চিঠি লিখে না।
আমিও। চিঠি। রহস্য ঘেরা স্বপ্নকুসুম।
দুপুরের কাচা কাপড় ঝেড়ে মেলে দিই।
রোদ তৃষ্ণার্তের মতো ছুঁয়ে থাকে ওদের।
আর দূরের আকাশটা উপুর হয়ে মুখ
দেখে নেয় পুকুরের জলে।
বিকেলে বারান্দায় পায়চারি।
বন্ধুর দেওয়া চারটে কোয়েল খাঁচার ভেতর।
শান্ত, যেন কোথায় বৃষ্টি হয়।
আমার ছোট মেয়ে অসময়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
অনেক দিন আমার জন্যে একটি কথাও লিখা হয়নি।
কুড়ি বছর আগে লিখত চিঠি।
আঁকা থাকত একটা কবিতা।
হলুদ, কমলা, নীল, লাল এরকম রংয়ের কবিতা।
জারুল বনে বেগুনি কবিতা।
এখনও চিঠি পাই। আধুনিক চিঠি।
ইনবক্সে জমা হয়।
এর জন্য নাই শিমুলের আকুলতা,
নাই জলপরিদের হাতছানি!
#
#