কবিতা

কবিতা
মোহাম্মদ রফিক
ঘোর
ভালোবাসা, ভালোবাসা, শেষ ভালোবাসা, অন্তিম প্রণয়,
নেই কোনো অতীত বা বর্তমান, ভবিষ্যৎ,
তবু কেন ভালোবাসি, কেন ভালোবাসা, ভালোবাসা,
এই গূঢ় অন্ধকার, তাপ, দাহ, শূন্যের বিলাস,
প্রতীক্ষায় সর্পের নিশ্বাস, কার দংশনে-দংশনে জর্জরিত,
বিষে নীল, সে নয় তোমার জানি, তবে কার,
নিয়তির, প্রতিদিন প্রতিক্ষণ সমূহ জীবনযাপনের,
ধায় কাল, অজর অক্ষম অধিবাস, বিবাহ, বাসর,
অর্ধচেতনায় অনন্তের সাথে লীলাসক্ত, উলঙ্গ, উদোম;
একটি দেহ অচেতন খাটজুড়ে ফুলের শয্যায়, তবে উৎসব শীৎকার,
মিলনের উজ্জ্বল আকাক্সক্ষা, কার সঙ্গে কার, তুমি কি আমার,
ব্যর্থ প্রশ্ন, অবান্তর, ততোধিক অর্থহীন বিষম উত্তর,
কথা তো কথার সাথে প্যাঁচ খেয়ে কাটা-ঘুড়ি অসীমে উধাও,
হাওয়ায়-হাওয়ায় বুদ্বুদ, জানি সত্য নয়, তবু শব্দ
জন্ম দেয় শব্দের বাহারি সাজ, চিত্রকল্প, প্রতিমা বাক্যের,
ভিড় করে আসে গাছ নদী পাতা বিস্তীর্ণ প্রান্তর নীলে-নীলিমায়,
থামে না সে স্রোত, মাথা কুটে মরে নপুংসক প্রতারক বালুতে কাদায়,
কে কতটা অসহায়, এ কী প্রশ্ন, কে দেবে উত্তর, বিবমিষা, তেতো স্বাদ,
ছেড়ে যাও, ছেড়ে দাও, ওই দেখো তটরেখা কোঁকায় রোদ্দুরে,
মরীচিকা, মরু নয়, তবুও বিস্তৃত মরুভূমি, ক্লান্ত শরীরে শরীর
এই রাত, অন্ধকার, ভালোবাসা, নয় সীমা, সীমাহীনতাও নয়,
নেভে, না জ্বলে না একবারও, শুধু দপদপ শব্দ বাজে শূন্যতায়
এই ক্ষণে, নিশ্চয় কোথাও, কুঁড়ি থেকে ঘটে যায় পাপড়ির উত্থান,
নিরাসক্ত বিজন দেহের তটরেখা ছলনায় ঢেউয়ে-ঢেউয়ে, মৃতপ্রায়
সেও তো কাহিনি মাত্র, তোমার-আমার চক্ষু মুদে এল, ঘোর…
মাহমুদ আল জামান
কোথায় যাচ্ছ
সম্পর্কের সব সুতো ছিঁড়ে দিয়ে
কোথায় যাচ্ছ সবিতা হালদার?
স্বপ্নভঙ্গে সব ভেঙে পড়ছে
লাল হয়ে যাচ্ছে নীল; কখনো সরলরেখায়
চোখ রাখলে দেখা যায়
সবুজ দিগন্ত-জোড়া মাঠে
কুরুক্ষেত্রের পদচিহ্ন এঁকে
সৌহার্দ্য আর তৃষ্ণার মুর্হূতের বোধ
হারিয়ে যাচ্ছে –
শান্ত স্থিত পৃথিবীর সব আলোড়ন
তুমি কোথায় যাচ্ছ সবিতা হালদার?
তুমি তো জানো নধর এক কালো বেড়াল
শক্তিধর হয়ে
ন্যায়যুদ্ধ, ধর্মযুদ্ধ সবকিছু তছনছ করে
কেবলই হানা দেয় মধ্যরাতে
আর কোমল শান্ত স্নিগ্ধ প্রাকৃতিক অবয়বকে
শোকার্ত করে তোলে
সেই এক নধর কালো বেড়াল
আমি তৃষ্ণার্ত, বড় এলোমেলো
নামহীন, গোত্রহীন
বৃক্ষছায়ায় শুয়ে আছি; আমার
শোণিত ও শ্বাসপ্রশ্বাস
খুঁজে নিচ্ছে তিমির হননের গান
কাঁপা গলায় ঘুমপাড়ানি কথা আর
ছেলে ভোলানো ছড়া
বিচ্ছিন্ন স্মৃতিসত্তা ভবিষ্যতের কল্পতরু মায়ায়
বিচ্ছিন্নতায় নৈঃসঙ্গ্যে
ঘুমহীন ঘুমে বিষাদগীতি হয়ে জেগে থাকে শরীরে
সম্পর্কের সব সুতো ছিঁড়ে দিয়ে
কোথায় যাচ্ছ সবিতা হালদার? আমাকে
কুরে কুরে খাচ্ছে যে নধর এক কালো বেড়াল!
আবুল মোমেন
নীরবতা
কবে যে হেঁটেছি ঘাসে যে ঘাস আড়ালে রাখে
কিশোরের মাঠভরা নীরবতা- যে তোমাকে ডাকে,
সুদূরবাসিনী তুমি, উদাসীন মাঠের কাশের প্রতিরূপ।
নেমে গেছি মাঠে, কাশের রেণুতে ফোঁটা ফোঁটা নিশ্চুপ
ডানা মেলে নিয়ে যায় কবেকার আমাদের একাকার ভোরে।
মাঠ বড় খুশি, ঘাস-কাশ আলো করে নীলাকাশ চলেছে অঝোরে-
কত নেব মাঠ? কোথায় যত্নে রাখি? অসহায় মুখে ফুটেছে ভ্রু কুটি,
মাঠ হাসে ঘাস হাসে আকাশ-প্রাঙ্গণে মেঘ-রোদ বেঁধেছে জুটি।
ছিন্নতা পাঁজরে লাগে, উপেক্ষা হৃদয় জুড়ে হাহাকার-
নীরবতা জেগে ওঠে, টের পাই শক্তি কত উদাসীনতার।
অসীম সাহা
পরিবর্তন
তোমার দেহের মধ্যে ঢুকে গেছে যন্ত্রণার গুপ্ত টাইটানিক;
জলের অতল থেকে দ্রুত বেগে উঠে আসছে ক্রুদ্ধ ডিনামাইট
আকস্মিক বিস্ফোরণে জেগে উঠে কাঁপাচ্ছে পৃথিবী!
কর্ণফুলীর মিল কিছুই বোঝে না!
দিস্তা দিস্তা শাদা পাতা প্রতিদিন উগ্ড়ে দিলে
হৃদয়ের অনুরাগ ছাপা হয় মাধবীর মনে!
চশমার কাচ ঘষে সীতানাথ বসাকের হাত থেকে
নেমে আসে প-বর্গীয় ধ্বনির উচ্ছ্বাস!
কোমল ম-এর কাছে আর্তনাদ পৌঁছে যায়
প্রথাগত শিক্ষকের শাদামাটা পরীক্ষার নগ্ন কেমিস্ট্রিতে!
হৃদয়ের ট্রেডমার্ক নেই!
তাই তার অবিরাম ব্যবসা জমে না।
শপিংমলের কাছে পজিশন বিক্রি করে উজ্জ্বল মধ্যরাতে
যে দোকানি চলে যায়-
তার কাছে কমিশনে হৃদয়ের বিকিকিনি কিছুতে চলে না!
বাতাবিলেবুর মতো কোমল কান্নার সুরে
ঝরে যায় মহুয়ার মন;
মাধবীলতার বনে জ্বলে ওঠে প্রতারক আগুনের
মুহ্যমান শিখা!
এই দৃশ্য দেখে দেখে মহাপ্রাণ ধ্বনিগুলো
আদর্শলিপির সব পাতা থেকে সরে গিয়ে ভাষা পায়
প-বর্গীয় ধ্বনির রেখায়;
আর মৃদুলকান্তির এক স্বরলিপি আশ্রয়ের সন্ধানে
সরল বিশ্বাস নিয়ে ঢুকে যায় অসীমের চিরন্তন অগ্নিশিখায়!
রবীন্দ্র গোপ
বদলে যায় মানুষ
দিন বদলালে কী মন বদলে যায়
কখনো বৃষ্টি হয়ে গেলে মেঘ নিঃশেষ হয়কি
হয়তো হয় সময় বদলালে, বদলে যায় পৃথিবী
বদলে যায় মানুষ শুধু পথ পড়ে থাকে।
দীর্ঘশ্বাস শ্বাস থেকে কিছুটা বড়
শ্বাস নিঃশেষ হলে কি আর থাকে জীবন
পৃথিবী থাকে মাটি বুক পেতে নেয় সন্তানেরে
এভাবেই কখনো মাটি উপরে আবার কখনো মাটির উপরে।
এক দুপুরে ডুব-সাঁতারে শৈশবের খেলা
মনে পড়ে যায়, বয়স বাড়তে বাড়তে যায় বেলা
অবহেলা প্রিয় মানুষের যান্ত্রিক খেলা
ল্যাপটপ কম্পিউটারে সাজানো সব
এখন মানুষ শুধু কঙ্কাল।
মানুষ নামের মানুষগুলো চেহারার উলঙ্গ পুতুল
মেঘ উড়ে যায় বৃষ্টি দিয়ে যায় ভিজে না যে তার মন,
ল্যাপটপ ল্যাপটপ নগ্নতার খেলা
মানুষ মানুষে বাড়ে অবহেলা
মায়াহীন-স্নেহহীন ভালোবাসার কেবলই
বেচাকেনা কেবলই খেলা।
বিমল গুহ
কালপঞ্জি ৪
জন্মান্তরের পথে অস্তগামী সূর্য দেয় উঁকি,
কে যেন দাঁড়িয়ে বলে : দেখো ঐ দূরে
কারা যায় সরু রাস্তা ধরে- কারা এই অধোমুখী
ছায়ার আগল ভেঙে মহোৎসবে মাতে?
বিদায়ী সূর্যের রেখা নতুন প্রভাতে
পুনর্বার জেগে ওঠে, পুনরায়
খাবি খায় আমার পুরানো বিছানায়!
অবিন্যস্ত ঘরের দেয়ালে আলোকরশ্মিগুলি
ছায়া ফেলে, পুরানো মাথার খুলি
ঘরের মেঝেয় অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে!
আমরা কি আজো সোজা হয়ে দাঁড়াতে পেরেছি?
জন্মান্তরের পথে প্রাচীন বটের ছায়া মাথা কুটে মরে!
ফারুক মাহমুদ
মুগ্ধকর প্রেমের হৃদয়
সঞ্চয়ে রাখি না কিছু। দু’হাতে যেটুকু থাকে ব্যয় করে ফেলি
উৎসাহে উপুড় করি মন…
আগুনের স্পর্শ নেই, বজ্রপোড়া বৃক্ষটির মতো
ভৌতিক দাঁড়িয়ে থাকা আর কতক্ষণ!
ফণার সৌন্দর্য নেই, শুধু শুধু কেন তবে ছেঁড়াখোঁড়া সাপের খোলস!
সবার অভ্যাস নয় ক্লান্তিকর খাদ্য খুঁজে মরা
আগুনে ঝাপায় কেউ। বুকে রাখে পাথরের ধস
যে আমার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন
ব্যয় করে করি তাকে শীর্ষ মূল্যবান
থেমে যাওয়া মানে
শেষ হওয়া নয়
চক্ষুজলে ফুটে থাকে সময়ের গান!
হারিয়ে, কুড়িয়ে যদি পুনঃপুন ব্যবহৃত হয়
অন্তরে অনন্ত জাগে, বেঁচে থাকে মুগ্ধকর প্রেমের হৃদয়
ইকবাল হাসান
তোমাকে পড়তে চাই
তোমাকে পড়তে চাই দাঁড়ি-কমা-সেমিকোলনসহ
আপাদমস্তক, প্রিয় কোনো পুস্তকের মতো
তোমাকে জাগাবে জানি পয়েন্টালিজমের স্বপ্নপরিরা
সংখ্যাহীন ডটের ভেতর ভেসে উঠবে তোমার অবয়ব
যেন অগণিত বুদবুদের ভেতর তোমার স্তন, নাভিমূল,
যোনি ও জঙ্ঘার কোমল বিষাদ
একটি খোলা মাঠের উদাসীনতা-কে যেভাবে পাঠ করে
সবুজ ঘাসের চোখ
নদীর তরঙ্গমালাকে যেভাবে পাঠ করে
ভাসমান কচুরিপানারা
একটি ধাতব ব্রিজ যেভাবে পাঠ করে পূর্ণ চাঁদের রাত
নিমগ্ন সন্ধ্যাকে যেভাবে পাঠ করে স্নিগ্ধ জোনাকিরা
ঘুমিয়ে পড়ার আগে তোমাকে পড়তে চাই সেভাবে আবার
ক্যানভাস থেকে নেমে এসে তুমি যেন পাঠ্য হ’য়ে ওঠো।
অঞ্জনা সাহা
তোমার চোখে
তোমার চোখে এখন অন্ধত্বের আবরণ!
সারা রাত ঐ দূর আকাশের কান্নাগুলো
নীল শিশির হয়ে ঝরে পড়ে; তুমি দেখতে পাও না।
আপ্রাণ চেষ্টায় সারা দিন মুখ বুজে দুই হাতে
যে তোমার অন্ধকারগুলো সরিয়ে দিতে চায়,
তাকে ব্রাত্যজন আখ্যা দিয়ে পুরস্কৃত করো!
যে তোমার বৈভবের প্রতি ঘৃণিত লোলজিহ্বা
আর দশ আঙুল মেলে ধরে,
তাকে তুমি ভালোবাসা মনে করে
রত্ন-সিংহাসনে বসাও।
এ-খেলা খেলতে খেলতে
তোমার দেহের আবরণ একে একে খসে পড়ে যাচ্ছে;
সেদিকে তোমার ভ্রুক্ষেপ নেই।
অথচ একদিন ভালোবাসা আর বিশ্বাসের
কৃষ্ণচূড়া-আগুন নিয়ে
তোমার আকাশ-ছোঁয়া অহংকার ছিল!
তমিজ উদ্দীন লোদী
স্টেশন ও একটি ভোরের গল্প
শেষ ট্রেন আসবার আগেই আমরা প্লাটফর্মে এসে দাঁড়ালাম।
তুমি তখনো হাঁফাচ্ছো আর এলোমেলো তোমার একগুচ্ছ চুল
কপোলের ঘামের সাথে লেপ্টে আছে। যদিও লালচে আকাশ তবু
সূর্য উঁকি দেয়নি তখনো।
ভোর সমাহিত। গেরুয়া পোশাকে আচ্ছাদিত কোনো এক সন্তের মতো
স্পর্শাতীত পবিত্রতা নেমেছে চারপাশে। ঈষৎ ঠান্ডা ফাগুনের হাওয়া
ছুঁয়ে যাচ্ছে তোমার শিউরে ওঠা চোখ ও ভ্রুযুগল।
হালকা কুয়াশার পর্দা ঠেলে সহিসেরা এগোচ্ছে। শান্ত ও সারিবব্ধ গরুপাল।
ভেসে আসছে শালিক ও টিট্রিভ পাখিদের কলতান। দু’ একটা চড়ুই খড়কুটো মুখে
উড়ে যাচ্ছে স্টেশন মাস্টারের বাংলোর দিকে।
এভাবেই ভোর গড়িয়ে যাচ্ছে সকালের দিকে। তোমার আলুথালু চুল
ঘাম শুষে নিয়ে ইতোমধ্যেই বেশ ফুরফুরে। ঈষৎ ঠান্ডা হাওয়ার স্পপর্শে
তোমার মুখ জসীমউদ্দীন-এর ‘নতুন চরের মতো’ জ্বলজ্বলে।
তোমার দিকে খুব আগ্রহ নিয়ে তাকাতেই
সশব্দে একটি ঝকঝকে নতুন ট্রেন এসে দাঁড়াল প্লাটফর্মে।
ফয়েজ কবির
সপ্তর্ষি
বাজাতে পারি তোমার বুকের গিটারে আমার কাফি বা কেদার
রাখতে পারি তোমার গ্রীবায় আমার সাত ছন্দ সূর্যের পাপড়িগুলো
ভেজাতে পারি তোমার শাড়ি আমার চোখের রুহ আফজায়
কিন্তু কি হবে?
তুমি কি থাকবে বাউলের পাগড়ি পড়ে সন্ধ্যার একতারায়?
বিদিশার কর্পূরে উড়ে উড়ে শিমুল ছবি এঁকে, তুমি কি হবে
সেই নিরাল মাছরাঙা নদী আমার মনোভূমে?
ভালোবাসাটা এখন ভারী আঁটসাঁট বোতামহীন ভ্যাসেলিন
মিশে যাচ্ছে ত্বকের কোষে কোষে
ঠিক যেমন রূপকথাটি- তোমার সাথে।
ফকির ইলিয়াস
সকল ছায়া ছিন্ন করে
জেগে আছে মেঘপালিত পৌষের ভোর। যে শীতকণা
শরীরে জড়িয়ে সূর্যের কাছে প্রেম চাইছে পৃথিবী-
সেই সূর্য দীর্ঘকাল থেকে পড়ে আছে পরিত্যক্ত জলাশয়ে।
একটি শাপলাসন্ধ্যা, খুব যতনে জমিয়ে রেখছে
জল ও জ্যোতির মায়া।
সকল ছায়া ছিন্ন করে আকাশে উড়তে চাইছে
মায়াপাখি। পালকবিহীন স্মৃতিচন্দ্রগুলো- উড়তে চাইছে
তার পাশাপাশি। যারা প্রেমবন্দনা গায়-
তারা প্রথমেই পাখির মতো শিখতে চায়
উড়ালবিদ্যা। তারপর বহু, বহুকাল শেষে-
গালে হাত দিয়ে মাঘের অপেক্ষা করে। বারবার
মুক্তকণ্ঠে গায় জীবন থেকে হিমবিদায়ের গান।
গোলাম কিবরিয়া পিনু
মৃত্যুঘরেও শত্রুতা
জন্মঘরের শত্রুতা
মৃত্যুঘরেও জেগে ওঠে
কী ভয়াবহ!
জিদ্দিবাজের কাছে উদারতা নেই
আক্রোশপরায়ণ হয়ে-
বছরের পর বছরব্যাপী
শত্রুতার সম্বন্ধঘটিত অঙ্কপ্রণালিতে
ঈর্ষানীল হয়ে নীল আকাশটা ঢেকে ফেলে!
অসূয়াপরবশ হয়ে–
সেই পুরনো আকচাআকচিতে
কোন্ মোরগের ডাকে মোড়ক খুলে
পুরো ন্যাংটা হয়ে যায়
আর তখনই-
জলকাদা প্যাচপ্যাচ করে!
একটা পুটলি বহন করা যায়-
তাকে আর বহন করা যায় না!
সোহরাব পাশা
ব্রক্ষ্মপুত্রের বিকেলে শঙ্খচিল
জল খোয়া গেছে অগ্নিপথে
তার গন্ধ লেগে আছে আলো নিভে আসা
গোধূলির মৃত ঘাসে রুগ্ণশালিকের
চোখে
বড়ো নিঃসঙ্গ ব্রক্ষ্মপুত্রের বিকেল
পাখিদের ছায়া পড়ে না জলের আয়নায়
নেই বৈঠার ধ্রুপদী সুরের মূর্ছনা,
জলের প্রতিভা নেই জলে
লাল ফড়িং উড়ছে লাল ইটে
বাউরি বাতাসে কেঁপে ওঠে জন্মের হাহাকার
ভোরবেলাকার আলোভেজা জল স্মৃতির কোলাজ
শামসেত তাবরেজী
পুনর্জন্ম
সিংহদরোজা ভেঙে ঢুকলাম তোর দাড়িম্ব-গর্ভে,
জন্মাব ফের লোকলালিমায়- জানি তুই-ই লুম্বিনী।
চটকিলা স্বপ্নের সুধা-রতি ভাসিয়ে তেপান্তর
আমি এসে যাব স্বাদ জেনে-জেনে কিসে নুন কিসে চিনি
আচমন করে উঠব লাফিয়ে আদিগন্ধের স্বর
শিরায় শিরায় জিব থেকে জিবে আমের-ডৌল পর্বে।
পিছলে নামব সূর্যসোহম- সৌরচক্র ছিঁড়ে,
দাঁড়িয়ে থাকিস বাকি রাত মা গো গৌড়ীয় নদীতীরে।
আবাদের জমি চাঁদ-জাগানিয়া পশুর প্রত্নমর্মে
হরফে-হরফে অভিসার হব, পড়ব গলায় মোতিহার
মীরাবাঈ গেয়ে উঠবেন প্রাচী-গলা খুলে উজ্জ্বল
কস্মিনকালে আমরা হব না চলতি-হাওয়ার ব্যবহার
পাহাড়ের খাঁজে, গিরিসংকটে ফোটাব অ্যাস্ফাডল
দিঠির দরদে ঘন-ঘন শ্বাস ফেলব পঝ্জ-ধর্মে
শালবীথি ঘিরে নেচে যাবে হাওয়া হরিণীর শামগানে
তারাদল নেমে আসবে মাটিতে অশোকের সন্ধানে
মারুফ রায়হান
শপিংমলে
অভব্য অদৃশ্য পিংপং খেলে কতিপয় প্রৌঢ় পৌর ধড়িবাজ
বিকিকিনি হাট যেন নগরীর পেটে নগরবিচ্ছিন্ন এক দ্বীপ
বিচিত্র বাহারি আলোঝলমল- তবু জয়ী গূঢ় অন্ধকার
দেহ সাজানোর দেহ জাগানোর শতমুখী পণ্য খায় গড়াগড়ি
ঘুটেনির এটিএম ফুটানির চাবুক সচল অবিচল
পার্থক্য পাবে না খুঁজে ম্যানিকিন ও উদ্ভিন্নযৌবনায়
ব্যক্তির রয়েছে অভিব্যক্তি, নেই পুতুলের, তবু প্রাণ
থাকা মানে কখনো হৃদয় থাকা নয়; হালফ্যাশনের
পোশাকের মধ্যে মনুষ্যহৃদয় ছিল কি কখনো কোনো কালে
অধরে অচ্ছুত মাতৃভাষা, স্বচ্ছন্দ অধিক আদি প্রভুর ভাষায়
জীবন্মৃত বিত্তবান যুবার জীবন স্বয়ংক্রিয় সিঁড়ির মতন
সপ্রতিভ
স্বার্থপর
পদতলভুলো
ঊর্ধ্বগামী
যন্ত্রবৎ
ঈশ্বরের চোখ হতে চাওয়া সিসি ক্যামেরার লেন্স
জমা রাখে প্রতিবেলা কিছু লাঞ্ছনা, পীড়ন আর অশ্লীল মুহূর্ত
সুবেশী শপিংমল হাই তোলে রাত্রিশেষে, আর তার
কোষে কোষে জমা রাখে সভ্যতার বিষ্ঠা আর মল
ভবিষ্যৎ গোরস্তানের ওপর ব্যর্থ দর্প নিয়ে
পরদিন ভোরবেলা জেগে ওঠে ফের সকরুণ বিপনিবিতান
রেজাউদ্দিন স্টালিন
দুঃসহ দিনপঞ্জি
প্রতিদিন জেগে উঠি দিনপঞ্জির পৃষ্ঠা থেকে
প্রিয়জন আসবে সোমে
আমি ঘুম থেকে জাগলাম বুধে
আমার কিছু অর্থ চাই শনিবার
আজ বৃহস্পতি
অপেক্ষার ভ্রুর মধ্যে আরো দু’টো দিন
জানি পুরাকালে এক শনিবার
নিষেধ অমান্যকারীদের দোজখের দিন ছিলো
বিপ্রতীপ বানর-জীবন
মঙ্গলে মায়ের কাছে যাবো
আজ শুক্র
আরো পাঁচদিনের প্রতীক্ষা
আমার সব ইচ্ছার পায়ে দিনপঞ্জির বেড়ি
সব স্বপ্নে ক্যালেন্ডারের কারাগার
জন্মাবধি দেখতে চেয়েছি দিনক্ষণহীন
নামের বাঁকল ছেঁড়া উদয়-অস্ত
আলেকজান্ডার যেমন শেষবার হারিয়েছিলেন
হলুদ চোখের এক নামহীন সূর্যাস্তে
শূন্যতার এতো কাছে আমি
অনির্দিষ্টের এতো সহগামী
তবু কী অসীম সবকিছু
যখন ইচ্ছা ঘুমাবো আর জাগবো
চাঁদ যতই নির্ধারণ করুক রাত্রি আর সূর্য দিন
এই দণ্ডিত দিনরাত্রির অনন্ত শয়ান থেকে
জেগে ওঠা কখনো সম্ভব
সৈকত হাবিব
তোমার কণ্ঠস্বর
এক মন্দ্রিত মেঘ নেমে এলো শহরের প্রান্ত থেকে, যখন উদ্ভাসিত তোমার
কন্ঠস্বর ভেসে এলো টেলিফোনে। এখন বর্ষা, আজও কালিদাসী মেঘ ভেসে
আসে দূর উজ্জয়িনী থেকে- শোনায় অলকার দূরসংগীত…
এই মেঘ, এই বিধবাশুভ্র মেঘ, আমার শূন্যতাকে নিয়ে যায় মহাশূন্যে।
আর তোমার কণ্ঠ স্পর্শ করে সেই শূন্য- শরীরময় তবু শরীরহীন।
টেলিফোন যেন মেঘ, মেঘের সিঁড়ি হয়ে ঢুকে যায় আমার গভীরে
আর শীত-উষ্ণ এক স্রোত বয়ে যায়।
তবু, সেই মেঘ-টেলিফোন আমি ভালোবাসি; ভালোবাসি এই দূরতম উষ্ণতা
তোমার কণ্ঠস্বর যেন বৃষ্টি, আমাদের মেঘবিরহের গান।
অন্য কেউ
আমি নই, হয়তো অন্য কেউ
জুড়িয়ে দেবে তোমার হৃদয়
তার স্পর্শে মগ্ন হবে তোমার
গভীর শরীর
সে তোমাকে নিয়ে যাবে
কোনো এক
স্বপ্নের শহরে
পার্থিব সব পিপাসায়
দেবে বাসনাপূরণমধু
আমি শুধু দূরের পাহাড়
স্বপ্নের সবুজ
দূরতম পাখির সীমানা
তোমার পা তো আর উড়তে পারে না…
তুষার কবির
সমুদ্র মুদ্রণ
দ্যাখো সমুদ্রেরও পৃষ্ঠা উল্টে যায় মহাকালের পাণ্ডুলিপির মতন!
একেকটা ঢেউয়ের পর ঢেউ যেন একেকটা পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টে
যাওয়া- যার ভাঁজে ভাঁজে লেখা হতে থাকে ফেনায়িত দাহগাথা-
মন্দ্রস্রোত মহাকাব্য- দ্রবীভূত জলউপাখ্যান!
সৈকতের তীর ঘেঁষে ধূসরিত ধূলিরেখা-বালুতটে তোমার পায়ের
ছাপ-বিকেলের দিকচিহ্ন- জলনূপুরের জমানো কিন্নরী- যার পাশ
দিয়ে তুমুল আছ্ড়ে পড়ে সমুদ্রের স্রোতকান্না!
সন্ধ্যার রক্তাভ রেখা উঁকি দেয় সূর্যাস্তের জলছাপে- দেখি
সারসের সরস গ্রীবার নিচে জড়ো হতে থাকে তরঙ্গের
ফেনাচিত্র-সমুদ্রের মুদ্রিত সংগীত!
শামীম হোসেন
গল্পাংশ
তোমার কোনো গল্পে যিশু হাঁটেন না।
আমি হাঁটি। আমার কৃষিগন্ধা হাত-
ছুঁয়ে আসে- তোমার মাটিমগ্ন মৌনতা।
হয়ত পাতার জাহাজ জলহীনস্রোতে
ফ্রেমে আটক ছবির মতো ধূসর-
বহু প্রাচীন কোনো জাদুর বাক্স
মেলে ধরছে কিছু বাজির খেলা…
তুমি মৌন-নির্বিকার- স্থির-
চোখের কোণে একফোঁটা জল
তাপ ও হাওয়ায়-রেখা হয়ে
ফুটে থাকে লতা ও পাতায়!
অনেকটা পথ হেঁটে এসে আমরা-
বসি। যিশু বসেন। মৃদু হাসেন।
তোমার ধ্যান ও ধারণায় আমি
নতুন কোনো গল্প হয়ে যাই…
রাসেল রায়হান
পর্তুগিজ
এই পর্তুগিজ ভাষার চিঠি তুমি লেখোনি?…
তাহলে
মধ্যবর্তী প্রজাপতিগুলি কেন তোমার শরীরে
ভর করে থাকা সব ঘ্রাণ নিয়ে উড়ে যাচ্ছে দূরে;
ঘরভর্তি ছড়াচ্ছে বিবিধ বর্ণের পালক;…
আর
লেপ্টে থাকা নেইলপলিশ পাল্টে যাচ্ছে ঋতুবৈচিত্র্যে?
আমাদের কার্নিশে বারান্দায় কতক কুৎসিত
পালকবিহীন বড় পাখি এসে বসেছে, তাদের
শরীরে ম্যাজিক হয়ে লেগে যাচ্ছে পালক।…
পর্তুগিজ
ভাষার চিঠিটি যদি তুমিই না লেখো, শীতকালীন
দস্যু আর পর্তুগিজ নাবিকের নরম ভাষার
শব্দ উচ্চারণ করে পাখিগুলি উড়ে যাচ্ছে কেন?
শামীম রফিক
সময়
এক
ক্ষুধা এত নির্মম কেন তোমাকে উপেক্ষা করি! প্রিয় টেবিল আমাকে কেড়ে নেয়
আর লাল বেলুনের ফেরিওয়ালা হয়ে পাড়ি দিই এতটা মিউজিয়াম একা একা, জানতো
কেঁপে কেঁপে উঠি, যতবার বলি-‘কি করে সাহস পায় বাতাসের বুদবুদ?’ কুয়াশা যদি
ঘাম ঝরায় বাম অলিন্দের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে, তুমি মনে রেখো সমুদ্র থেকে ফিরে
আসবে বিক্ষুব্ধ সৈনিকেরা, ট্যাংকের পাইপে ঝুলিয়ে দিবে ডলফিনের বিজ্ঞাপন আর
হা-করা জনতার দিকে ছুঁড়ে দিবে পিং পং বল, তারা কোমরে ব্যালে নৃত্যের ঢেউ
তুলে কাটিয়ে দিবে রাত, আমি যতই চীৎকার করি, যতই খাই নেক্সাম ফোরটি
সারবে না হৃদয়ের ক্ষত, আমি যে আজন্ম অভুক্ত, থামাও থামাও ভয়ে ন্যূব্জ।
দুই
সময় হয়েছে বলে তোমাকে মনে পড়ে বেশি। আর কতদিন শুকনো পাতলা ফ্যাসাদে
এরকম নিজকে জড়ায়ে ফেলি, হঠ্যাৎ বন্ধুত্ব ছেড়ে দিকভ্রান্ত রাখালের মতো আশ্বস্ত
হয়েছিলাম লোকেদের কথায়, কে জানতো তখন মাধবীর কামনায় পুড়ছে আমার
একমাত্র পৌরুষ, যে যুবক আমাকে করাতকলের নীচে রেখে বলে- ‘চেয়ে দেখ্…’, তার
রক্তেও খেলা করে অস্তমিত ভ্রমর, পরাজয়ের শেষপ্রান্তে এসে আমি অপেক্ষা করি, পেটে
কদাকার কু-লি পাক খেতে খেতে চৌকাঠে এসে ঘুমায়, চার ঘণ্টা ধরে আড্ডা শেষে
টের পাই প্রিয়তম ব্রার নিচে লাল সেলাই, এ সবের পর তামাকের অভাব শ্বাসকষ্টের
কারণ হয়ে নীরবে ভোগায়, সময় হয়েছে বলে- না না, আর কিছু নয়, এমনই হয়।
তিন
বিশ্বাসের ওপর জমে গেছে সবুজ শ্যাওলার স্তর, আহারের জন্য যতটা ঘুরি বিস্তৃত পরিধিতে-
ততটা নয়, এখন কৃতদাস। হৃদপিণ্ডের শুষ্কতা নিয়ে ঝিমায় তোমার স্তনের মোহনীয় স্বাদ,
কিলবিল করে ওঠে আমার মস্তিষ্ক-আঙুল আর সামর্থ্যরে রাখাল, আসবার কথা ছিল যাদের
তারা পালিয়ে গেছে, কী যেন নেই, কী যেনো থাকবার কথা ছিল, তাই সকলকে বলেছিলাম-
‘অপেক্ষা করো।’ এখন নতজানু বিস্ময়ে-ক্ষোভে, অথচ আমার ছোট ছোট হাত অঙ্গ-পতঙ্গ
তোমাকে কি করে নায়াগ্রা স্বপ্ন দেখায়? তুমি ভাবো তোমাদের চৌরাস্তায় আমি রোজ ঈশ্বরের
সাথে দর্শন নিয়ে আলোচনা করি, আর উৎসুক জনতা সেই রহস্য গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে জ্বলে
ওঠে, তোমার প্রশ্নবাণে জর্জরিত হতে হতে আমি সময়ের গলায় দর্শনের মালা পরাই প্রতিনিয়ত।
মানজুর মুহাম্মদ
অনেকদিন কবিতা লিখিনি
পাতার গান হয় না হওয়ার কানে, কাঁপে না সবুজলোভা বন, আলোর বানে
মেঘেরাও মনহারা যেন, পাখিদের নির্বাক চেয়ে থাকা- সুনীলে, আর্তি শুধু- কেন?
মোড়ের টং দোকানে ভাসে না চাঁদের আলোয় দুধ সাগর
চা ঠোঁটে চোখ কাছের ব্যালকনিতে, গোলাপি ওড়নায় থমকে থাকে না মায়াবী প্রহর
তখন অমৃত সব নিরেট জহর।
অনেকদিন কবিতা লিখিনি, শুনিনি পাখির ডাক
মন টানে মন, বাউল বসন, বলে- ফিরি চলো মূল গৃহে,
এখানের সব এখানে থাক, সব মায়া প্রেম, সব সুধা সুর পড়ে থাক।
জুননু রাইন
তোকে দেখি না কতদিন
তোকে দেখি না কতোদিন
তোর নাম বারান্দার সামনের ডালিম গাছের
ডালে বসে উড়ে যাওয়া দোয়েল পাখি
তোর নাম শেষ বিকেলের অশ্রুর মতো
ঝরে পড়া শান্তির হাসি…
তুই ছুটে বেড়াতিস আমাদের ধুলোমাখা পায়ের
ছন্দে তাল মিলিয়ে
খেলতিস ফুটবল ক্রিকেট।
তোকে দেখিনা কতদিন
তু-ই’ত শিশির ফোঁটা;
সমুদ্র পেটে নিয়ে চেয়ে থাকতিস।
না, সকাল-বিকেল চারাগাছে পানি দিতিস
না, তুই ছিলি চারাগাছ শীতের সবজি-স্বজন।
না না না ! তুই ঘুড়ি উড়াতিস আকাশে
অথবা ছিলি সুতাভর্তি নাটাইয়ের চালক
কিংবা তোরই নাম ঘুড়ি উড়ানো সেদিনের বিকেলবেলা।
তোকে দেখি না কতদিন…
মিন্টু হক
রোদফুল
তুমি যদি হও নষ্ট
আমি নষ্টরে ভালোবাসি
শূন্যের বুকচিরে সোনালী হাসি
কামনা-কানন জুড়ে আবিষ্ট স্বপ্নমুকুল
আহা ! কী মায়া তাঁর গালে রয়েছে ফুটে রোদফুল
১. চারুভূমি
পরিচয়ের প্রথম পাঁচ মিনিটে
আপনি থেকে তুমি
সে ছিল দারুণ চারুভূমি।
খানিক সময় পর ।
তুমি ফেলে হয় তুই
কথার কথক নৃত্যে ভুলে
দু’য়ে মিলে সুই।
২. তুইফুল
জলে ভেজা দুই চোখে নয় এক চোখে দেখ
কামনার কত কথা কই খোঁপা বেঁধে রেখ।
বাসনা-বাগান জুড়ে শুধু তুইফুল হায়
মন পুড়ে মরুভূমি ধু-ধু বিরহ জ্বালায়।
৩. বৃত্তান্ত
হৃদয় পোড়া ভস্ম দিয়ে সাজিয়েছি অর্ঘ্যডালা
একফোঁটা জল বাকি সবটুকু তার জ্বালা।
শিমুল রায় সরকার
বৃষ্টির স্বরলিপি
এই মেঘহীন দুপুরে
তোমাকেই চিঠি লিখছি মেঘ।
হিমালয়ের পাহাড় ছুঁয়ে…
বৃষ্টির স্বরলিপি নিয়ে তুমি এসো।
মেঘে মেঘে ঢেকে দাও আমার জমানো যতো অভিমান।
তারপর…
ছাতিম ফুলের ঘ্রাণ ছড়িয়ে
বৃষ্টি নামুক শহর জুড়ে।
যাই বলো তুমি
সব অভিমান ভুলে;
মেঘে মেঘে চাই ভাসতে…
ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে
চাই তুমুল হাসতে।।
তারপর রাত্রি গাঢ় হলে যেও চলে
তোমার জলজ সংসারে।
দুর্জয় আশরাফুল ইসলাম
শেষ লেখার প্রেক্ষাপট
এই শেষবার তুমি আমাকে লিখছো স্বগত উচ্চারণ
আকাশে আজ উঁকি দিচ্ছে যে অগ্নিপাহাড়, তার
সৌন্দর্য মেঘের মতো উড়ে উড়ে কতদূর যায়-
সাংকেতিক খোঁজ সম্ভাবনায় আমার ব্যতিব্যস্ত দিনে
পড়তে পারিনি অনন্ত কোন আঁধার ভাষ্য আর।
এখানে কলমের নিভ ধরে আছে অদৃশ্য কাঁটাতার
স্বাধীনতার উচ্চভাষ্যে কে চেপে ধরে কণ্ঠ আমার
বলে লিখ অনবরত লতাপাতা আর ফুল
চক্ষুয় দেখা বিদ্বেষ আর মানবিক যাপন সব ভুল।
বুকে চেপে থাকা সাহস অছন্দের ভেতর জাগে-
দুর্দশাগ্রস্ত উচ্চাশা চুপিসার, দিনান্ত জানে গন্ধচাপা
ফুলের ভেতর রয়ে গেছে মুখাবয়ব তোমার,
অন্ধকার যত আসে, আশ্চর্য কিরণের কোন দেশে
ঘণ্টি বাজায় প্রেম, অনুচ্চারণ রহস্য ভাঙা কারবার।
রেজওয়ান তানিম
ডুব–সাঁতার
আহত পাথর বলে না কখনো, কোন ক্ষতে
কালো গোলাপটি ঝরে যায়, অসহ্য রৌদ্রের মদ পান করে।
শরীরে কামড়ের দাগ নিয়ে, মরেছে যে সময়-
তার কোলে শুয়ে আছে
ভুলে যাওয়া প্রিয়ন্তিকাদের কঙ্কাল!
আমরা নির্বাক,
সমুদ্রে ফেলে এসেছি কিছু বিশ্বাস
ও যাবতীয় প্রেম!
অলৌকিক অন্ধকারে ডুব-সাঁতার দিয়ে বেড়াচ্ছে
আমাদের যাপন, বিকেলের রোদ এবং
প্রিয়ন্তিকার খয়েরি চুল!
নায়না শাহরীন চৌধুরী
আমায় ভাবো কি?
আজকাল বড় ব্যস্ত তুমি,
গোলাপের সৌরভ তোমার নিউরনে
দোলা দেয় না আগের মতো।
লেখার টেবিলে, গল্পের বইয়ে ধূলার আস্তর;
দেখে দেখে দীর্ঘশ্বাসগুলোও এখন একঘেয়ে।
ঠেলে সরিয়ে রাখ আমাকে
তোমার ভার্চুয়াল জগৎ থেকে।
বাইরে অনেক রোদ,
রাত কেটেছে লোনাজলে,
ভেজা বালিশে।
আমি বাইরে যাব।
দেখব, রোদ কতটা পোড়ায়!
অথবা মেঘলা ছাদে যদি খালি পায়ে যাই?
বখাটে বাতাস ছুড়ে ফেলুক ওড়নাটা,
নিরাভরণ করে ছুঁয়ে যাক
অসহ্য আবেগে, তীব্র বাসনায়।
তাতেও কি কিছু যায় আসে তোমার?
তোমার চোখের সামনের যন্ত্রগুলোয়
আমার চোখের চেয়েও বুঝি অনেক আবেদন?
শেষ কবে বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম?
শুধু দু’জন?
তুমি কি ভাবো আমায়? একটুও?
নাকি ভাবনাগুলো থেকেও বেজেছে,
আমার বিদায়ের সানাই?
আজমাঈন তূর হক
নির্জন
পচে যাওয়া গাছের ভিতরে,
তার ঝরে ঝরে যাওয়া পানির ভিতরে,
কোন একটা অট্টালিকা জ্বলে যাচ্ছে, মরে যাচ্ছে।
সন্ধ্যা, পিতামহের কবরের মতো শান্ত-
দেয়ালে দাঁড়কাক
জীবিতদের চোখ চিনে নিচ্ছে, মৃত্যুর জন্য;
ভাঙা তিনতলা বাড়ির আধোভাঙা দেয়ালে
কালো বেড়াল তুমি শ্বাস নিতে পারো?
লাল মড়ক ছড়ায়ে আছে, আরো লাল তুষারের ভিতর
এখনো বাজছে হৃদয়, দূর থেকে শোনা।
পাগল পো, তোমার ঘুম বাজছে এখনো
খান রুহুল রুবেল
সঙ্গম
পোষাক খুলে নিলে, শরীর হয়ে পড়ে প্রতিভাহীন!
যতটা জমেছে সৌরছায়া, দিনের উড্ডীন বিতরণ-
খুলে পড়ে, ভাবে-
এই অবতরণই ভালো- কৌণিক হ্যাঙারে।
তথাপি পোশাক খুলি,
জানি- সুবর্ণগ্রাসী প্রপাত ও ক¤পন
যতটা পোশাকে থাকে, আরো বেশি আছে মৌন শরীরে!
অথচ, চাঁদের উত্থান শুনে ভয় পাও,
জানাও, পোশাক খুললেই আমাদের,
বেরিয়ে পড়বে প্রকৃত জিরাফ!
লুণ্ঠিত হবে কমলাগন্ধ, গ্রীবার গৌরব!
বসন্ত উত্তরিত হবে কামনার কোরকে।
অথচ কাঠের পা নিয়ে আমার মনে হয়-
বাতাসেই ঝুলে আছে আমার শরীর!
তোমার দরোজায় দৃঢ়তা, ইস্পাত মনোরম-
তাতে কড়া নাড়ি, কামনা করি,
যতটা বাতাস আমি তুমিও ততটা ইস্পাত হয়ে ওঠো!
শরীরেই কুণ্ঠা তোমার, ইস্পাত ও বাতাসে নয়।
অতএব উত্তাপ মুঠো করে, দেরাজে তুলে রাখো
আমাদের তুলোর শরীর, কবোষ্ণ ক্ষীণ মোম!
দরজা যদিও দেখে ফেলে, ভয় নেই-
এখন শরীর নেই, আমাদের শুধু আছে তুলোর সঙ্গম!