স্বপ্ন : নাজমা পারভিন

গল্প
স্বপ্ন
নাজমা পারভিন
ফুল নিবেন স্যার ফুল? আপার মাথায় দিলে খুব মানাবি।
পর পর ৩টি রিকশা চলে গেল। কেউ কিনল না। একটা ছেলের সাথে একটা মেয়েকে দেখলেই ফুল নিয়ে এগিয়ে যেতে হয়। এটাই ফুল বিক্রির একটা অলিখিত নিয়ম। এই নিয়ম মেনেই গত তিন বছর ফাতেমা ফুল বিক্রি করে আসছে রাস্তায়। এই ব্যবসায়ে লাভ বেশি। তেমন কোনো খরচ নেই। ফুলের দোকানগুলোর পাশেই ঝরা-আধমরা ফুল পড়ে থাকে। শাহবাগে জাদুঘরের উল্টাদিকে ফুলের দোকানগুলো ফাতেমার আয়ের উৎস। বাইরেও কমিউনিটি সেন্টারে কোন অনুষ্ঠানে ফুল দিয়ে সাজানোর পর অনুষ্ঠান শেষে সেই ফুল সংগ্্রহ করে ওরা। নাইলনের তৈরি শক্ত টেপ দিয়ে গোলাকার ফ্রেম বানিয়ে সেই ফ্রেমের গায়ে স্কস টেপ দিয়ে ফুল লাগানো হয়। এভাবেই মাথায় পরার উপযোগী করা হয় ফুল যার নাম দেয়া হয়েছে ফ্লাওয়ার ক্রাউন। বর্তমানে এই ফ্যাশান খুব জনপ্রিয়। পহেলা বৈশাখ, বইমেলা, বাণিজ্য মেলা সবখানেই মেয়েরা এই ফুল মাথায় পরে। গলা থেকে ফুল এখন মাথায় উঠেছে। ফ্লাওয়ার ক্রাউন পরে সেলফি তুলে ফেসবুকে আপলোড না-করা পর্যন্ত তরুণীদের সাজগোজ পূর্ণ হয় না ইদানীংকালে।
সাধারণত ছোট বয়সের ছেলেমেয়েরা ঘুরে ঘুরে এই ফ্লাওয়ার ক্রাউন বিক্রি করে। ফুলের দোকানে কিনতে পাওয়া গেলেও ফুটপাতে বিক্রি বেশি হয়। এই ফ্লাওয়ার ক্রাউন যারা বানায়, যারা বিক্রি করে তারা এই নাম জানে না। জানার প্রয়োজনও পড়েনি কখনও। তারা ফুল, ফুলের মালা এভাবেই ডাকে। ফাতেমার বয়সিরা এই ব্যবসার উপযোগী নয়। এই জন্য ওর বেচাবিক্রি কম।
মানুষ বাচ্চাদের থেকে কিনতে চায়। মধ্যবয়সি মহিলার কাছ থেকে ফুল কেনায় কোনো মহত্ব নেই। ছোট বাচ্চা ছেলে বা মেয়ে যখন বলে আপা ফুল নেবেন ফুল? সারাদিন কিছু খাই নাই। এইডা বেইচা হেই পয়সা দিয়া ভাত খামু। এই কথায় মন গলে সহজেই। এই জন্য বাচ্চা ছেলেমেয়েদের বেচাবিক্রি বেশি।
ফাতেমা ফুল বেইচা ভাত খামু বলতে পারে না। ওকে শুনতে হয় কাজ করে খেতে পারো না? ফুল বিক্রির ব্যবসাকে কাজ মনে করে না মানুষ। ফুলের দোকান থাকলেও এক কথা ছিল। কুড়িয়ে পাওয়া ফুল দিয়ে মালা গেঁথে সেধে সেধে বিক্রি করা আবার কিসের ব্যবসা?
ফাতেমা আজ প্লান করে বেরিয়েছে। আজ ওর অনেক আশা। কারণ আজ একুশে ফেব্রুয়ারি। সকালে শহিদ মিনার ভরে গেছে ফুলে ফুলে। এখন ফুল দেয়া শেষ। সারাদিন ফাতেমা শহিদ মিনারের আশপাশেই থেকেছে। অনেক ফুল কুড়িয়েছে এখান থেকে।
সেগুলো দিয়ে দশটা মাথায় পরার মালা তৈরি করেছে সে। প্রতিটা ৫০ টাকা করে বিক্রি হলেও ৫০০ টাকা। এই টাকা দিয়ে কি করবে সেটাও ঠিক করা আছে।
কয়দিন ধরে তার মেয়ে শিউলী একটা জিনিসের আবদার করেছে। কিন্তু দিতে পারেনি। আজ নিশ্চয় পারবে। কারণ আজ ২১শে ফেব্রুয়ারি, ফুল যেমন বেশি পাওয়া যাবে তেমনি ছুটির দিন হওয়ায় বইমেলায় লোকও আজ বেশি আসবে। আজ ফুল বিক্রি অনেক বেশি হবে।
কেউ কেউ খুশি হয়ে একটা মালা ৭০-৮০ টাকা দিয়েও কেনে। অতএব ৫০০ টাকার কম হবে না নিশ্চয়। ও ভাইজান আপারে একটা মালা কিনে দ্যান।
দাম কত?
১০০ টাকা। ফাতেমা জানে মানুষ দরকষাকষি করতে ভালোবাসে। তাই বাড়িয়েই বলে একটু।
ডাকাত নাকি? একটা মালা ১০০ টাকা!
কত দিবেন ভাই? ডাকাত কথা শুনে রাগ করে না ফাতেমা। ফাতেমাদের রাগ করতে নেই। এরকম ভাষা ওদের প্রায়ই শুনতে হয়।
নাহ নেব না।
চলে যায় কপোত-কপোতী। পিছন থেকে ডাকে ফাতেমা। কত দিবেন একটা দাম তো কন। নেন ৮০ টাকায় দিমু। ৭০ টাকায় দিমু নিয়া যান।
তবুও কাস্টমার ধরতে পারে না ফাতেমা।
রেস্টুরেন্টে খাবারের বিল দিতে গিয়ে কেউ বলে না একটা চিকেন ফ্রাই ২৫০ টাকা যেখানে এক কেজি ব্রয়লারের কেজিই ১৫০ টাকা?
কিন্তু ফুলওয়ালা, রিকশাওয়ালা এদের সাথেই সবাই দরদাম করতে ভালোবাসে।
মাইনষে এমন ক্যান? আনমনে প্রশ্ন করে ফাতেমা। অত ভাবার সময় কই?
সামনে আরেক জোড়া ছেলেমেয়ে। ফাতেমা আগায়।
আপা ফুল নিবেন? বাচ্চা ফুল বিক্রেতা ছেলেমেয়েরাও ছুটে আসে। এই পোলাপানগুলোর জন্যই ফাতেমার বিক্রিতে ভাটা পড়েছে। ফুলগুলো শুকায়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি বিক্রি করতে হবে না হলে বিক্রি হবে না। মাত্র ২টা মালা বিক্রি করেছে। এই টাকা দিয়ে হবে না। চাল কেনার পর টাকা থাকবে না।
কিন্তু আজ তাকে মেয়ের জন্য জিনিসটা কিনতেই হবে। গত ২০ দিন ধরে মেয়েকে সে ঘুরাচ্ছে। আজ কিনে দিবেই, বলে এসেছে।
ভাইয়া ফুল নিবেন? ভাবির জন্য?
একটু বয়স্ক জুটি দেখলে আপু ডাকে না। তখন ভাবি বলতে হয়। অর্থাৎ এরা বিবাহিত ধরে নেয়া হয়।
কত?
৭০ টাকা। এবার ফাতেমা কমিয়ে চায়। কারণ বিবাহিতরা বেশি দামে ফুল কেনে না। দীর্ঘদিনের ব্যবসাতে এই অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে ফাতেমা।
২০ টাকায় দেবে?
ফাতেমা মাথা নাড়ে। মনে মনে বলে শালা ফইন্নির পুত।
এক দাম ৫০ টাকা
অনেক দরকষাকষি করে ৩৫ টাকায় দেয় ফাতেমা। চোখ ছল ছল করে ফাতেমার।
ওর সামনেই বিল্টুনামের ছেলেটা ৫০ টাকায় ফুল বেঁচল একজনের কাছে।
বয়স বেশি এটাই কি ফাতেমার অপরাধ?
ফাতেমার মেয়ে শিউলির বয়সি হবে বিল্টু। শিউলীকে সে ফুল বিক্রির ব্যবসায় না নামিয়ে স্কুলে দিয়েছে এটাই কি তার অপরাধ? সেও তো পারত বিল্টুর মায়ের মতো মেয়েকে দিয়ে টাকা কামাই করাতে! ফাতেমা মনে মনে আবার বলে সব শালারা ফইন্নীর পুত। হাতের টাকাগুলো গোনে ফাতেমা। সব মিলিয়ে ৩৭৫ টাকা। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমেছে। আটটায় বইমেলা শেষ হবে আজকের মতো। ক্লাস সেভেনে পড়া মেয়ে আজ বায়না ধরেছে একটা বই কিনে দিতে হবে তাকে। স্কুলের বন্ধু-বান্ধবীর কাছ থেকে বই নিয়ে পড়েছে সে এতদিন। মেয়ের বই পড়ার নেশা আছে খুব।
মুহম্মাদ জাফর ইকবাল নামে একজন বিরাট লেখক আছে। তার লেখা নতুন বইটা কিনে দেয়ার বায়না ধরেছে শিউলী। ক্লাসের বই খাতাই দিতে পারে না ঠিকমতো এর উপর গল্পের বই! তবুও আজ ফাতেমাকে কিনে দিতেই হবে। মেয়েকে কথা দিয়েছে।
মানুষের কাছে খোঁজখবর নিয়ে স্টল খুঁজে বের করে ফাতেমা। অনেক ভিড়। না কোনো বায়োস্কোপ নয়। সবাই ভিড় করেছে নামি লেখকের বই কেনার জন্য। ফাতেমার গর্ব হয়। আজ সব বড়লোকের ভিড়ে সেও বই কিনতে দাঁড়িয়েছে স্টলের সামনে। হাতে ফুল দেখে সবাই ভাবছে ও ফুল বিক্রি করতে এসেছে। কিন্তু আজ ও বই কিনতে এসেছে, গরিব বলে কি বই কিনতে নাই! মাইনষে এমন ড্যাব ড্যাব কইরা চাইয়া রইছে ক্যান! ফাতেমা ভেবে পায় না।
আঁচলে বাধা টাকা বের করে ফাতেমা।
বইয়ের নাম বলতে পারে না সে।
কি বই?
ঐ যে জাফর ইকবাল নাম। উনি যে বই লিখেছে সেইটা দেন।
ওনার তো অনেক বই। ওনার তো অনেক বই। কোনটা?
সবচেয়ে নতুন যেডা সেইডা দেন।
এইবার দুইটা নতুন বই এসেছে স্যারের।
আইচ্ছা এত বই থাকতে সবাই উনার বই কিনতেছে ক্যান? কি লিখছেন উনি?
স্বপ্নের কথা লেখেন, কল্পনার কথা লেখেন, সায়েন্স ফিকশন লেখেন, এসব আপনি বুঝবেন না।
বুঝুম না ক্যান? আমিও তো মাইয়ারে নিয়া কত স্বপ্ন দেহি। দ্যান আমারে স্বপ্নের বই দ্যান, দুইডাই দ্যান।
নতুন দুইটা বই প্যাকেটে দেয় ফাতেমার হাতে।
ফাতেমা ৩৫০ টাকা তুলে দেয় দোকানদারের হাতে।
প্যাকেট ভরা স্বপ্ন নিয়ে ফেরে ফাতেমা।
শিউলীর চোখ আনন্দে চক চক করে।
পরান ভরে মেয়েকে দেখে ফাতেমা। চুলো জ্বলবে না আজ রাতে। কারণ চাল কেনা হয়নি। বই কেনার পর ছিল মাত্র ২৫ টাকা। অবিক্রিত ফ্লাওয়ার ক্রাউনগুলো পড়ে থাকে। শুকিয়ে গেছে সেগুলোর ফুল। কাল তা আর বেচা যাবে না।
ফুল শুকায়, পেট শুকায়; কিন্তু স্বপ্ন শুকায় না।
ফাতেমা মেয়েকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে দেখতে ঘুমায়।
লেখক : গল্পকার