গল্প : রক্তে নাড়িতে বাঁধন : আফরোজা পারভীন

গল্প
রক্তে নাড়িতে বাঁধন
আফরোজা পারভীন
ঢাকা থেকে সাতক্ষীরা যাচ্ছে মিঠুন। হঠাৎ করেই যেতে হলো একটা সাহিত্য সম্মেলনে। মিঠুন বরাবর লেখাটাকেই প্রাধান্য দিয়ে এসেছে। সম্মেলন-সংগঠন-সভা-সমিতি তথাকথিত কানেকশন, যা আজকাল সাহিত্যের উপর পরাগাছার মতো ভর করেছে এসবের প্রচ- বিরোধী সে। নিভৃতচারী মানুষ, সাহিত্যকে ভালোবেসে লেখে মনের আনন্দে। কিন্তু একসময় সেও হতাশ হতে শুরু করে। সাহিত্য যেন আজকাল হয়ে গেছে বাণিজ্যের উপকরণ। চারিদিকে কাড়াকাড়ি, হুড়োহুড়ি, ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা। এসব দেখে হতাশ মিঠুন আস্তে আস্তে লেখা কমিয়ে দেয়। এবং একসময় হারিয়ে যেতে বসে সাহিত্যের ঐন্দ্রজালিক জগৎ থেকে। সাহিত্যকে দূরে সরিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে তার ব্যক্তিজীবনেরও রয়েছে অনেক অবদান। কিন্তু হারিয়ে যেতে চাইলেই কি হারিয়ে যাওয়া যায়। মাঝে মাঝে কোনো কবিতার লাইন, কোনো গদ্যের দুএকটি ছত্র ওর মনের মাঝে গুনগুনিয়ে ওঠে। ও লিখতে চায় না, আর এই না চাওয়া ওকে পাগলের মতো করে দেয়। দিনের পর দিন নিজের সাথে যুদ্ধ করে না-লেখার পক্ষ নিয়ে। তারপর একসময় পরাজিত হয়ে লিখে ফেলে। কে যেন ওকে দিয়ে লিখিয়ে নেয়। কেন লিখল এই আক্ষেপে নিজেকে অত্যাচারও করে। খায় না ঘুমায় না, ঘর থেকে বের হয় না। এমন চলছে অনেকদিন ধরে। বাবা চেষ্টা করে করে ক্লান্ত হয়ে ছেড়ে দিয়েছে। আন্টি এ নিয়ে উঠতে-বসতে বাবাকে কথা শুনায়। বাবা মাঝে মাঝে রেগে গিয়ে যাচ্ছেতাই বলে। সেগুলো মিঠুনের কানেও ঢোকে না। এমন শুনে শুনে সে ছোটবেলা থেকে অভ্যস্ত। শুনলেই যেন মনে হয় কোথায় কি একটা ছন্দপতন ঘটেছে। এমনই চলছিল । ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা ডেকে ডেকে ক্লান্ত। আজকাল কেউ তেমন একটা ডাকেও না। এর মাঝে হঠাৎ করে এই ডাক। বন্ধু রাজীব সাতক্ষীরা থেকে বারবার ডাকছে। ওখানে একটা সাহিত্য-অনুষ্ঠানে তাকে প্রধান অতিথি করা হয়েছে। বক্তা হিসেবেই তাকে কেউ কখনও ডাকে না, তাতে একেবারে প্রধান অতিথি! এটা যে শুধুমাত্র রাজীবের কারণেই ঘটেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মিঠুন না করেছিল বারবার। রাজীব প্রথম দিকে অনুরোধ করেছিল। তারপর মিঠুনের ক্রমাগত না শুনতে শুনতে এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে প্রচ- রেগে গিয়ে বলেছিল,
: শোন আমি কার্ডে তোর নাম ছাপিয়ে ফেলেছি, এরপরও যদি তুই না আসতে চাস আসিস না। আমাকে মানুষের মাঝে অপদস্থ করে যদি তোর আনন্দ হয়, আনন্দ কর। আমারই ভুল হয়েছিল তোকে বন্ধু ভাবা।
শেষ দিকে রাজীবের গলাটা ধরে এসেছিল। এরপর রাজীব আর ফোন করেনি। অনুষ্ঠানের মাত্র একদিন বাকি। মিঠুনের মনে তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। ভালো লাগুক আর না-লাগুক তাকে যেতে হবে। রাজীবকে সে মানুষের মাঝে ছোট করতে পারে না। মিঠুন ফোন করে রাজীবকে
: শোন আমি কাল আসছি । কিভাবে যাবো, রাস্তাটা বলে দে।
: আসছিস কেন, আমাকে দয়া করতে? আসার দরকার নেই। বন্ধুত্বের মাঝে দয়া-করুণা এ-সবের স্থান নেই।
রাজীবের কণ্ঠে তীব্র অভিমান।
: অভিমান করিস না দোস্ত , আমি আসছি । রাস্তা বল।
রাজীব রাস্তা বলে দেয়। একপর্যায়ে তার সমস্ত রাগ অভিমান জল হয়ে যায়। আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ে। পারলে টেলিফোনের ওপার থেকে ওকে জড়িয়ে ধরে।
এই সেই সাতক্ষীরা যাওয়া। সকাল সাড়ে আটটায় বাস ছাড়ার কথা থাকলেও ছাড়ল ৯টার পর। আর তার থেকে বড় কথা, এসি বাসে টিকেট কাটলেও শেষ মুহূর্তে বাস কর্তৃপক্ষ জানাল এসি বাসটা নষ্ট হয়েছে। যদি সে নর্মাল চেয়ার কোচে যেতে চায় যেতে পারবে নইলে আরও একদিন অপেক্ষা করতে হবে। অপেক্ষা করার সুযোগ নেই, কালই সম্মেলন। মিঠুন জানিয়ে দেয় সে নর্মাল বাসেই যাবে। বাসে উঠে ভালো লেগে যায় রাজীবের। উপভোগ করতে থাকে মিঠুন। দুপাশের সবুজ প্রকৃতি, বিচিত্র সব মানুষ, তাদের আচার-আচরণ। বিশেষ করে বিভিন্ন পণ্যের হকারদের ক্যানভাস। গাবতলি থেকে ওঠে এক ডিমের হকার। সে বিচিত্র শব্দে বিচিত্র উচ্চারণে টেনে টেনে বলে,
‘কম্পিউটারে ছোলা, চাবানে চাবানে মজা। না খাইলে হয় না মজা। কারে দেব কয় হালি?’
ওর অদ্ভুত উচ্চারণে হাসি পায় মিঠুনের। একবার ভাবে দুটো ডিম কিনে হকারকে উৎসাহিত করবে। তখনই ডেকে বসে পেছন থেকে এক মহিলা।
: ডিম কত করে?
: বারো টাকা পিস।
: একটা ডিম বারো টাকা ! ডাকাইত ডাকাইত।
মিঠুনের হাসি পায়। প্রতিটি জিনিসের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। অবশ্য সে দাম তাকে স্পর্শ করে না। বাবার অঢেল আছে। আর দোষ হয় এই গরিব হকারের। দাম দিয়ে কিনলে ও কম দামে বেচবে কি করে ? ও হকারকে ডাকতে চায় তখনই বাস ছেড়ে দেয়।
সাভার বাসস্ট্যান্ড থেকে ওঠেন এক মহিলা। হিচড়ে-পাচড়ে ওঠেন পাদানি অবধি। এরপর আর উঠতে পারেন না। পাদানিতে বসে করুণ চোখে মিঠুনের দিকে তাকিয়ে বলেন,
: একটু হাতটা ধরো না বাবা।
মিঠুন সামনের সিটে বসা। স্বভবতই তার দিকে হাতটা বাড়ায় মহিলা। মিঠুন যেন দেখেও দেখে না। নির্লিপ্ত চোখে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। মহিলা আবার ডাকে,
: ধরো না বাবা একটু, কণ্ঠে রাজ্যের আকুতি।
মিঠুন আগের মতোই অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। এই নির্লিপ্ততা যে ইচ্ছাকৃত তা বাসের অন্য যাত্রীরা বুঝতে পেরে অবাক হয়ে ওর দিকে তাকায়। কারও কারও কপালে ভাঁজ পড়ে। মিঠুন ভ্রুক্ষেপও করে না। শেষমেশ বাসের হেলপার গিয়ে টেনে তুলে মহিলাকে ঠিক মিঠুনের পেছনের সিটে বসিয়ে দেয়। মহিলা হাঁফাতে হাঁফাতে বলে,
: ধন্যবাদ বাবা, তুমি না ধরলে আমাকে ওই পাদানিতেই বসে থাকতে হতো।
: চাচিআম্মা এত অসুস্থ শরীর নিয়ে একা একা আসলেন কেন? সাথে কাউকে নিয়ে আসলেন না কেন?
: সাথে আনার মতো সাথী কি সবার থাকে বাবা? থাকে না। যাদের থাকে না তাদের আমার মতো একা চলতে হয়। আল্লাহ তাদের সাথী হন। মহিলা হালকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।
এবার মিঠুন পেছনে তাকিয়ে মহিলাকে দেখে। অভিজাত চেহারা মহিলার। পোশাক-আশাক সাদাসিদে, তবে খুবই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। একমাথা কালোচুল। একসময়ে যে যথেষ্ট সুন্দরী ছিলেন বোঝা যায়। ছিটেফোঁটা আছে আজও। কি এমন বয়স মহিলার। বিলাসী জীবন পেলে ওকে এখনও চল্লিশ বলে চালিয়ে দেয়া যায়। কিন্তু এই বয়সে এতটা অসুস্থ হলেন কি করে?
মহিলার চোখে চোখ পড়ে মিঠুনের। মহিলা স্মিত হাসেন। একটু আগে যে তিনি হাত বাড়িয়ে দেয়া সত্ত্বেও মিঠুন হাত বাড়ায়নি বরং ইচ্ছাকৃতভাবে তার প্রতি চরম ঔদাসীন্য প্রদর্শন করেছে তা যেন মহিলার মনেই নেই। মিঠুন অবাক হয়। বাস চলছে। বাসে দুলুনিতে ঘুম আসে মিঠুনের। কালরাতে একটুও ঘুম হয়নি তার। ওই বাড়িটাই যেন তার ঘুম হরণকারী চরম অস্বস্তিকর এক বাড়ি। ও বাড়িতে প্রাণ নেই, আনন্দ নেই। প্রাণছাড়া বাড়িতে ঘুম আসবে কি করে। ওর দুচোখ বেয়ে নেমে আসছে ঘুম। মিঠুন বাসের দুলুনিতে ঘুমিয়ে যায়, ঘুমাতেই থাকে। কয়েক বছরের ঘাটতি ঘুম যেন ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর চোখের পাতায়। হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে যায়। পেছন থেকে কে যেন তাকে ডাকছে, তার মাথায় হাত রেখেছে।
: বাবারে ঘুমের ঘোরে মাঝে মাঝে তোমার মাথা সিটের পাশ দিয়ে চলাচলের ফাঁকা জায়গায় নেমে যাচ্ছে। ব্যথা লাগতে পারে বাবা, হাতলেও বাড়ি লাগতে পারে। তুমি এক কাজ করো বাবা। আমি ভেতরের দিকে আছি। তুমি এখানে এসে বোসো বাবা, আমি তোমার সিটে বসি।
মিঠুন চেঁচিয়ে উঠতে গিয়ে নিজেকে সংবরণ করে। এভাবে কেউ কখনও তার কথা ভাবেনি। ওর চোখ জ্বালা করে ওঠে। কি এক অচেনা অনুভূতিতে মন দুলে ওঠে।
: আসো বাবা, আমি তো একা উঠে বসতে পারব না, আমার হাতটা ধরে তোমার সিটে বসিয়ে দাও। আচ্ছা থাক, আমি হেলপার ছেলেটাকে বলছি।
তার হাত ধরতে অনিচ্ছার কথা এতক্ষণে বুঝি মহিলার মনে পড়েছে। কেমন এক অপরাধবোধ আচ্ছন্ন করে ফেলে মিঠুনকে।
: না থাক, আমি আর ঘুমাবো না। আর আপনি কেন আমাকে নিয়ে এতটা ভাবছেন সেটাও তো বুঝলাম না।
মিঠুনের কণ্ঠে স্পষ্ট বিরক্তি। মহিলা ক্ষণকালের জন্য চুপসে যায় তারপরে বলে,
: আমি জানি তুমি বিরক্ত হচ্ছ। ভাবছ আমি তোমাকে নিয়ে ভাবার কে। কথা ঠিকই বাবা। কিন্তু মায়ের মন তো, না ভেবে পারি না। বাবা ঘুম যখন আসছে একটু ঘুমিয়ে নাও না। আমি বুঝতে পারছি অনেকদিন তোমার ঘুম হয়নি। ঘুম হচ্ছে চোখের জলের মতো। একবার পড়ে গেলে আর চোখে ফিরে আসে না। আসো বাবা।
: না না থাক। আপনি অসুস্থ।
: আমার কোনোই অসুবিধা হবে না। তুমি এখানে না এলেই কি আমি সুস্থ হয়ে যাব। বরং তুমি এখানে এসে বসলে আমি স্বস্তি পাব। তা নাহলে পুরোটা রাস্তা তোমার মাথাটাকে আমার পাহারা দিতে হবে। কখন কোথায় লেগে যায় কিছু কি ঠিক আছে।
: আপনি পাহারা দেবেন কেন?
: সেটাও একটা প্রশ্ন, কিন্তু জান বাবা সব কেনর উত্তর নেই। ওই যে বললাম মায়ের মন তো।
মহিলার জোরাজুরিতে মিঠুনকে পেছনের সিটে এসে বসতে হয়। বিস্মিত মিঠুন বুঝে উঠতে পারে না সে মাথায় আঘাত পেলে মহিলার কি অসুবিধা। পৃথিবীতে প্রতি মুহূর্তে কত মানুষ মাথায় আঘাত পাচ্ছে তাতে কার কি যাচ্ছে আসছে।
মিঠুন পেছনের সিটে আসামাত্র ঘুমিয়ে যায়। মানিকগঞ্জে আসার আগে সে ঘুম আর ভাঙে না। হকার আর যাত্রীদের মিলিত চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙার পর ও দেখতে পায় মহিলা তার দিকে পরিতৃপ্ত চোখে তাকিয়ে আছে,
: ঘুম ভাঙল বাবা, যাও এবার নিচে গিয়ে একটু চোখমুখে পানি দিয়ে এসে কিছু খাও। সকাল থেকে তো কিছুই খাওনি।
মিঠুন তলপেটে কিছুটা চাপ অনুভব করে। সকাল থেকে কিছু খায়নি একথাও সত্যি। অত সকালে বাড়ির কারও ঘুম ভাঙিয়ে বিরক্তির কারণ হতে তার ইচ্ছে হয়নি। ও ওঠে। নিচে গিয়ে পেটের চাপ হালকা করে। তখনই মহিলার কথা তার মনে পড়ে, উনি বয়স্ক মানুষ। তার যেমন পেটে চাপ হচ্ছে ওনারও নিশ্চয়ই হচ্ছে। তাছাড়া উনিও তো সকাল থেকে কিছু খাননি। ওনারও খাওয়া দরকার। বাস ছেড়ে দিচ্ছে। মিঠুন দ্রুত বাসে ওঠে। কিছুটা চলার পর জ্যামে বাসটা আটকে যায়। সেই সুযোগে বাসে ওঠে একটা হকার।
‘বিট লবণে ঝাল হবে, ঝাল-মশলা ভালো হবে। টমেটো কুচি চানাচুর মেশা ঝালমুড়ি হবে।’
: বাবা ঝালমুড়ি খাও। সকাল থেকে কিছুই খাওনি। এই ঝালমুড়িওয়ালা বাবাকে একঠোঙা ঝালমুড়ি দাও। শোনো, টমেটো আর চানাচুর কম দিও। টমেটোর চেহারা ভালো মনে হচ্ছে না। বাসি-পেটে চানাচুর বেশি খেলে গ্যাস হতে পারে। পিঁয়াজ বেশি দিও। ঝালমুড়িওয়ালা ঝালমুড়ি বানাতে শুরু করে।
: এই রাখো, শোনেন, আপনিও তো সকাল থেকে কিছু খাননি। আমি খেতে পারি যদি আপনি খান। আর এক ঠোঙা বানাও ভাই। মহিলা হাসে।
: তুমি অমন করে বললে না খেয়ে কি পারি। ঠিক আছে বানাক।
ঝালমুড়িওয়ালা ঝালমুড়ি বানিয়ে এগিয়ে দেয়। মহিলা ধরতে গিয়ে ঠোঙা থেকে খানিকটা খসে পড়ে। মিঠুন বিরক্তির সাথে বলে,
: তোমাদের কিন্তু এটা খুব খারাপ অভ্যাস। ঠোঙার কাগজটা একটু বড় দিলে কি হয়। এতটুকুর মধ্যেও পয়সা বাঁচাও তোমরা। অর্ধেক মুড়ি পড়েই যায়।
: থাক বাবা ওকে বলো না, গরিব মানুষ। কোটিপতিরা সারাক্ষণ ঠকাচ্ছে আর ওতো সাধারণ একটা হকার। ওরা অসৎ বলেই এদের সৎ হবার উপায় থাকে না।
মহিলার কথা শুনে কিছুটা অবাক হয় মিঠুন। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে উনি ভালো লেখাপড়া জানেন। তাহলে ওর এই দীনহীন দশা কেন!
এর কিছুক্ষণ পরে বাসে ওঠে এক শসা বিক্রেতা।
: কচিশসা, খেতে খাসা, মনে আশা, খাব শসা। খান ভাই দুই এক পিস।
মিঠুন শসাওয়ালাকে ডাকে। এবারও দুটো দিতে বলে। মহিলা বলে,
: বাবারটায় আলাদা করে ঝাল লবণ দাও। ও প্রয়োজনমতো মিশিয়ে নেবে। তোমরা ঝাল-লবণ মিশিয়ে ছত্রখান করে ফেলবে।
মিঠুন অবাক হয়। মহিলা এত কেয়ারিং!
বাস পাটুরিয়া এসে বিশাল লাইনে আটকে পড়ে। কখন ফেরি পাবে ঠিক নেই। মিঠুন ওঠে। নেমে এদিক-ওদিক দেখে আবার বাসে ফিরে আসে। মহিলার দিকে হাত বাড়িয়ে বলে,
: নেমে আসুন
: কোথায় বাবা?
: নেমে হাতমুখ ধুয়ে কিছু খেয়ে নিন।
মিঠুন মহিলাকে হাত ধরে টয়লেটের দরজায় পৌঁছে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। টয়লেট থেকে বের হওয়ামাত্র ওর হাত ধরে। বলে,
: এখানেই হোটেলে কিছু খেয়ে নিই। ফেরি কখন পাবো ঠিক নেই। আর পেলেও লাভ নেই। ফেরির তিনতলায় ক্যান্টিন। ওখানে আপনি উঠতে পারবেন না। তাছাড়া ক্ষুধাও তো লেগেছে।
: না না আমার ক্ষুধা লাগেনি। ঝালমুড়ি খেলাম, শসা খেলাম। তুমি কি না-খাইয়ে রাখার ছেলে।
: ওই ঝালমুড়ি আর শসা কোনো খাওয়ার জিনিস হলো। ও কখন পেট থেকে হাওয়া হয়ে গেছে। এই হোটেলটা । ইলিশ মাছ আছে, মুরগি আছে, ডালটাও ভালো।
: কিন্তু বাবা।
: কোনো কিন্তু না, আপনি না খেলে আমি খাবো না।
অগত্যা খেতে বসে মহিলা। মিঠুন মহিলার পাতে খাবার তুলে দেয়। খেতে খেতে মহিলা লক্ষ্য করে, মিঠুন মাছের কাটা ভালোভাবে বাছতে পারছে না। মহিলা মিঠুনের পাতের মাছটা বেছে দেয়, তারপর নিজের পাতের মাছটাও বেছে মিঠুনকে খাওয়াতে থাকে। মিঠুন লক্ষ্য করে প্রতিবাদ করে।
: করছেন কি, করছেন কি, আপনার মাছটা আমাকে খাইয়ে দিচ্ছেন। আপনি তো কিছুই খাননি। এই এখানে আর একটা মাছ দাও।
: না না বাবা , আমি এমনিতেও মাছ বড় একটা খাই না। তোমাকে খাওয়াতে পারলে আমার ভীষণ ভালো লাগবে। হা কর বাবা।
মিঠুন কিছু বুঝে উঠবার আগেই ওর অজান্তে মুখটা এগিয়ে যায়। মহিলা ইলিশ মাছের ডিমটা ওর মুখে তুলে দেয়। হতবাক মিঠুন অবাক হয়ে তাকায়। এমন করে কেউ কখনও তাকে মুখে তুলে খাওয়ায়নি। মহিলার চোখেমুখে অপার তৃপ্তি। খাওয়ার পর মহিলা গ্লাসে পানি খেতে যায়। মিঠুন মহিলার হাত ধরে,
: ও পানি খাবেন না, এই মাম দাও।
বয় মামের বোতল নিয়ে আসে। মিঠুন বোতল খুলে মহিলার দিকে এগিয়ে দিতে গিয়ে থেমে যায়।
: আপনি বোতলে পানি খেতে পারবেন না। আপনার শাড়ি ভিজে যেতে পারে। আমি গ্লাসে পানি ঢেলে দিচ্ছি।
মিঠুন গ্লাসে পানি ঢেলে মহিলার দিকে এগিয়ে দেয়। তারপর কি মনে করে মহিলার ঠোঁটে গ্লাসটা ছোঁয়ায়। মহিলা কি মনে করে পানি টেনে নেয়। পানি খেয়ে লম্বা একটা স্বস্তির নিশ্বাস নিয়ে বলে,
: পানিটা খেতে যে কি ভালো লাগল বাবা। এমন করে তো কেউ কখনও খাওয়ায়নি তো।
: কেন আপনার স্বামী সন্তান পরিবার?
: সবার কি সব কিছু হয় বাবা, নাকি থাকে?
: আপনি যাবেন কোথায়?
: কামারখালি। নদী পার হলে আর বেশিদূর না। ভাবছি কি করে যাব। রিকশাতেই বা উঠব কি করে, নামবইবা কি করে। রিকশা থেকে নেমে খানিকটা হাঁটতে হয় সেটুকুইবা যাব কি করে। যাকগে, আল্লাহ যখন রাস্তায় নামিয়েছেন তিনি একটা পথ দেখাবেনই।
: অত ভাববেন না। ব্যবস্থা একটা হবেই।
ওরা খেয়ে বেরিয়ে আসে। মিঠুন মহিলার হাত ধরে হাঁটতে থাকে বাসের দিকে। হঠাৎ থেমে দাঁড়ায়।
: এই মাল্টা কত করে ডজন?
: একশ ষাট টাকা
মহিলার দিকে তাকিয়ে মিঠুন বলে,
: আপনি মাল্টা খানতো? আপনার বাড়ির জন্য কিনে দিব।
: না না আমার বাড়িতে কেউ নেই। তুমি যদি খাও কেন, নইলে দরকার নেই।
: দুই কেজি দাও তো ভাই।
: না না এত দামি ফলের দরকার নেই। খাওয়ার লোক নেই আমার। তাছাড়া ও বেশি দাম চাচ্ছে।
: দাম নিয়ে ভাবতে হবে না আপনাকে। আর যদি খাওয়ার লোক না থাকে পাড়া-প্রতিবেশীদের দিয়ে দেবেন।
মাল্টা কিনে মহিলার হাত ধরে এনে বাসে বসিয়ে নিচে নেমে যায় মিঠুন। কিছুক্ষণ পরে ফিরে আসে। জানালা দিয়ে মহিলাকে ডাকে,
: শুনুন শুনুন, দেখুন তো এই আংটিটা আঙুলে লাগে কিনা?
একটা আংটি এগিয়ে দেয় মিঠুন।
: আংটি দিয়ে কি হবে বাবা ?
: এটা অষ্টধাতুর আংটি। এ আংটি হাতে পরলে অনেক অসুখ সারে। বিশেষ করে ব্যথা বেদনা। পরে দেখুন।
আংটিটা মহিলার হাতে বড় হয়। মহিলা দ্বিধার সঙ্গে বলে,
: আঙুলে বড় হচ্ছে বাবা, থাক না আংটি দিয়ে কি হবে।
: নিচে নামতে আপনার কষ্ট হবে। বারবার নামান ঠিকও না। কি করা যায় বলুন তো?
: লাগবে না বাবা?
: লাগবে না বললে তো হবে না। আচ্ছা আপনার হাতে কি কোনো আংটি আছে? যেটার মাপে আমি আনতে পারি?
মহিলা ইতস্তত করে। তার হাতে একটাই আংটি আছে। সেটা বিয়ের আংটি। ওটাই স্বামীর একমাত্র চিহ্ন। অন্য সব গহনা স্বামী একটু একটু করে আত্মসাৎ করেছে। এটা ওর হাতে দেয়া কি ঠিক হবে ? তার বিবাহিত জীবনের একমাত্র স্মৃতিচিহ্ন। অতীত জীবনের একমাত্র নমুনা।
ভাবনা শেষ হবার আগেই আংটি খুলে ফেলেছে মহিলা। মিঠুনের হাতে দিতে দিতে বলে,
: এটাই শুধু আছে। সাবধানে রেখ বাবা, আমার বিয়ের আংটি।
আংটিটা হাতে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অদ্ভুত এক অনুভূতি হয় মিঠুনের মনে। মহিলা কত ভালো কত সহজ সরল! সেএক অজানা অচেনা মানুষ। ইচ্ছে করলেই আংটিটা নিয়ে চলে যেতে পারে। আংটিটার অনেক ওজন। কম করে ছয় আনা। আজকাল সোনার যা দাম। মহিলা হতদরিদ্র না হলেও সচ্ছল যে নয়, ওকে দেখেই বোঝা যায়। কী সরল বিশ্বাসে অবলীলায় আংটিটা ওর হাতে দিল। খুব যতেœ আংটিটা হাতে নিয়ে হাঁটতে থাকে ও। মনে হয় এটা এক চরম সম্পদ যা ওর কাছে গচ্ছিত আছে। বিক্রেতা যতক্ষণ আংটি বানায় মিঠুন খুব খেয়াল রাখে মহিলার আংটিটার দিকে। আংটি বানানো শেষ হলে ওটা নিয়ে বাসে ওঠে মিঠুন। মহিলার হাতে দিয়ে বলে,
: পরে দেখুন মাপ মত হয়েছে কিনা?
: দিলেই যখন তুমিই পরিয়ে দাও ।
মহিলার হাতে আংটি পরায় মিঠুন। মহিলা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আংটি পরানো হলে বলে,
: জানো বাবা মনে হচ্ছে আমার একান্ত আপনজন কেউ আমার হাতে আংটি পরাচ্ছে ।
: আপনি মানুষ খুব ভালো তো তাই অমন মনে হচ্ছে।
ফেরিঘাটে এসে ভিড়েছে। ফেরিতে তোলা হয় বাস। মিঠুন ফেরিতে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানতে টানতে বিস্তীর্ণ জলরাশি, অজস্র নৌকা, নৌকায় ভাসমান মানুষের সাথে নিজেকে মিশিয়ে ফেলে। একসময় ফেরি তীরে ভেড়ে। বাসের চাকায় টান পড়ে। মিঠুন বাসে ওঠে। ধুলো উড়িয়ে একটানে উপরে উঠে যায় বাস। ধুলোর ঝাপটা এসে মুখে বাড়ি মারে। মহিলা চেঁচিয়ে ওঠে।
: বাবারে তোমার মুখে ধুলো লাগল।
: সেতো আপনার মুখেও লেগেছে
: কি বোকামি করলাম! আগে যদি জানালাটা লাগিয়ে দিতাম এমন হতো না। ইস তোমার মাথাতেও ধুলো লেগেছে। বাড়ি পৌঁছে মাথাটা ভালো করে ধুয়ে ফেল বাবা।
আশ্চর্য মহিলা। নিজের কথা না ভেবে ভাবছে মিঠুনের কথা। অথচ রাস্তায় পরিচিত এক মানুষ, কঘণ্টারইবা আলাপ!
বাস চলছে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে মিঠুন। এখন মাঠে দুতিন ফসল হয়। তাই মাঠের চেহারা এখন অন্যরকম। তারুণ্য আর বার্ধক্যের মিশেল। মাঠের একধারে সবুজ ধান, অন্যধারে পাকা ধানের হরিদ্রাবর্ণ। ধানের ভারে নুয়ে পড়া গাছ। গাছের সবুজ হারিয়ে ওরা এখন পেটে সবুজ ছড়ায়, নয়নের তৃপ্তি পরিণতি পায় পেটের তৃপ্তিতে। ভাবনার মাঝে ডুবে গেছিল মিঠুন। হঠাৎ পেছন থেকে ডাক পড়ে।
: বাবা সামনেই কামারখালি। আমি নেমে যাব। পথে তোমার সাথে দেখা, আর দেখা হবে কিনা জানি না। আমি তোমার মায়ের মতো। দোয়া করছি ভালো থেক বাবা।
বাস থামে, মহিলা ওঠে। অনেক কষ্টে পায়ের কাছে রাখা ব্যাগটা হাতে তুলে নেয়। মিঠুন উঠে একহাতে ওর ব্যাগটা নিয়ে অন্য হাত বাড়িয়ে দেয়,
: হাত ধরে নামুন
: কিন্তু বাবা, বাস ছেড়ে দিতে পারে।
: ছাড়বে না।
নিচে নেমে একটা রিকশা ডাকে মিঠুন। হাত ধরে যতেœ মহিলাকে উঠায়।
: এবার তুমি যাও বাবা। বাস বারবার হর্ন দিচ্ছে। আমি এখন যেতে পারব।
মিঠুন রিকশায় উঠে বসে।
: চলো রিকশা, বাসের দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে বলে, চলে যাও ভাই। আমি যাব না। মহিলা অবাক হয়ে দেখে মিঠুন কখন যেন তার ব্যাগটাও নামিয়ে নিয়েছে।
: কিন্তু বাবা তোমার তো দেরি হয়ে যাবে।
: হোক ওতে আমার কোনো অসুবিধা হবে না। আমি ঠিক পৌঁছে যাব। কিন্তু আপনাকে পৌঁছে দেয়াটা অনেক জরুরি। বলুন কোনদিকে যাবে?
মহিলা পথ দেখায়। এক সময় তার বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়ায় রিকশা। হাত ধরে ওকে রিকশা থেকে নামায় মিঠুন। মহিলার হাত থেকে চাবি নিয়ে দরজা খোলে। একঝাঁক বন্ধ হাওয়া এসে ধাক্কা মারে ওর চোখমুখে। মিঠুন ভেবে পায় না এমন একটা আধভাঙা বিরান বাড়িতে মহিলা একা একা থাকে কি করে। বাথরুম রান্নাঘর সবইতো দূরে দূরে।
: আপনি বলেছিলেন আপনার কেউ নেই, আসলেই কি তাই?
: আসলেই এখানে কেউ থাকে না, আমার সাথে কেউ থাকে না, আমি একাই থাকি।
: কেউ নেই আর সাথে কেউ থাকে না এক কথা হল না
: ও কথা থাক বাবা, তুমি একটু বস। দেখি তোমাকে কি খাবার দেয়া যায়।
: না আমি এখন যাই। অনেকটা দূর যেতে হবে। আপনি অনেকদিন পর বাড়িতে এলেন। এখন কিছু থাকার কথা না।
মিঠুন আসি বলে হাঁটতে থাকে। কয়েক পা এগিয়ে যায়। ঠিক তখনই পেছন থেকে ডাকে মহিলা।
: বাবা একটা কথা জিজ্ঞাসা না করে পারছি না। আমার ভীষণ কৌতূহল হচ্ছে জানতে। আচ্ছা বাবা আমি বাসে ওঠার সময় তোমাকে হাত ধরতে বলেছিলাম। তুমি ধরোনি। আমার বারবার ডাকে ফিরেও তাকাওনি পর্যন্ত। অথচ সেই তুমি আমার জন্য পরে কত কিছু করলে, যা আপনজনও করে না। এমন কি নিজের বাস ছেড়ে দিয়ে বাড়ি অবধি পৌঁছে দিলে। তোমাকে এখন না জানি কত কষ্ট করে যেতে হবে। তুমি একই মানুষ অথচ এই দুই একেবারে ভিন্নরূপ কেন বাবা ? আমার জানতে ভীষণ ইচ্ছে করছে।
মিঠুন কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপর বলে,
: আমার বলতে দ্বিধা নেই, মহিলাদের উপর আমার তেমন শ্রদ্ধা নেই। তাই আপনার ডাকে সাড়া দিইনি।
: তাই যদি হয় পরে কেন সাড়া দিলে না চাইতেই?
: সেটাই তো আশ্চর্য কেন এটা হলো আমি নিজেই জানি না! এই দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দেয়া ঠিক হয়নি। আর কখনও দিব না।
: মহিলাদের অশ্রদ্ধা করার কারণটা জানতে পারি বাবা?
: পারেন। কারণ আমার মা একদম শিশু বয়সে আমাকে ফেলে রেখে তার ভালোবাসার মানুষের সাথে চলে গিয়েছিল। একবারও ভাবেনি অতটুকু শিশু কি খাবে, মায়ের ¯েœহ ছাড়া কিভাবে বাঁচবে। সেই থেকে আমি মহিলাদের ঘৃণা করি। আচ্ছা চলি।
: যেও না বাবা, দাঁড়াও। আর দুএকটা প্রশ্নের জবাব দিয়ে যাও। এই যে তুমি তোমার মার সম্পর্কে কথাগুলো বললে এগুলো তুমি জানলে কি করে?
: আমার বাবা বলেছে
: যাচাই করেছিলে, তুমি তো এখন বড় হয়েছ ?
: না, বাবার কথা যাচাই করার দরকার নেই।
: তা তোমার বাবা বুঝি তোমাকে নিয়েই কাটিয়ে দিলেন সারাটা জীবন, বিয়ে করেননি?
মিঠুন ক্ষণকাল থমকায়। তারপর বলে,
: করেছেন। মা চলে গেলে উনি কিইবা করতে পারেন।
: বেশি কিছু করার দরকার ছিল না। তোমাকে নিয়ে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিলেই হতো। তা তিনি করেননি।
: থাক থাক আপনার সাথে আমার বাবাকে নিয়ে আলাপ করতে চাইনে। চললাম।
মিঠুনের কণ্ঠে বিরক্তি। মহিলাকে বেশি প্রশ্রয় দিয়ে ফেলেছে। উনি এখন অনধিকারচর্চা করতে শুরু করেছেন। বাবাকে সে ভালোবাসে। কিন্তু তার অনেক কিছুই মিঠুনের ভালো লাগে না। বাবার দ্বিতীয় বিয়ে কোনো পুত্রেরইবা ভালো লাগতে পারে। যাকে বিয়ে করেছেন সেই আন্টি তো রীতিমতো অসহ্য। শিশু বয়সে তার ¯েœহ আদর পাবার অনেক চেষ্টা করে বারবার ধাক্কা খেয়ে ফিরে এসেছে। এমনকি মা ডাকেও ছিল তার আপত্তি। সব মেয়েই এক। বাবাইবা কি ভালো। কিন্তু তাই বলে এক সদ্যপরিচিত মহিলার সাথে বাবার বিষয় শেয়ার করতে চায় না মিঠুন।
মিঠুন এগিয়ে যাচ্ছে। মহিলা ওর চলার পথের দিকে তাকিয়ে আছে। সেই শিশুটি কেবল হাঁটতে শিখেছিল, টলোমলো পায়ে হাঁটতো। বারবার পড়ে যেত। শিশুর মা জবার দিন কখন যে শুরু হতো আর কখন শেষ তা বুঝতেই পারতো না। স্বামী কেবল কোম্পানি শুরু করেছে। তারও সংগ্রাম করে ওপরে ওঠার সময়। এদিকে হাজারটা কাজ ঘরে। কিন্তু কোনো কাজই কাজ মনে হতো না বাচ্চার মুখের দিকে তাকিয়ে। সীমাহীন আনন্দে ভরে থাকত দেহমন। এর মাঝে যে ঘরে ফাটল ধরেছে, বুঝতেও পারেনি। স্বামী যে একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে ধরতে পারেনি জবা। দেরিতে বাড়ি ফিরছে, লুকিয়ে ফোনে কথা বলছে, বিছানাতেও আগের মতো সক্রিয় নয়। এর কিছুই লক্ষ্য করেনি জবা। লক্ষ্য দেয়নি ওই ফোকলা দাঁতের ভুবনমোহিনী হাসির একরত্তি শিশুর প্রতি। পাঁচ বছর প্রগাঢ়ভাবে ভালোবেসে বিয়ে করা স্বামীর বদল হতে পারে এটা ভাবনারও অতীত ছিল জবার কাছে। তাই তার কোনো কাজে কোনো প্রশ্ন জাগত না কখনই। সেদিন বিকেলে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে সই করতে বললেও প্রশ্ন জাগেনি।
: কাগজটায় সই করে দাও।
: কি এটা?
এ প্রশ্ন যেন বলার জন্যই বলা।
: তা দিয়ে তোমার দরকার কি। আমি সই দিতে বলছি দাও। বিশ্বাস করো না নাকি আমাকে ?
স্বামী হাসে। জবার সব দ্বিধা কেটে যায়। স্বামী সই দিতে বলছে এতে প্রশ্ন করার কি আছে। হয় তার নামে টাকা রাখছে নয়ত তাকে কোনো কিছুর নমিনি করছে। এত জিজ্ঞাসা করার কি আছে।
সে রাতে স্বামী কাছে আসে না। কাজের অছিলায় পাশের ঘরে রাত কাটায়। সকালে বেরিয়ে যাবার আগে বলে,
: বাবুকে সাজিয়ে দাও, অফিসে নিয়ে যাব। ওকে অফিসের স্টাফরা দেখতে চেয়েছে। ঘণ্টাদুয়েক পরে দিয়ে যাব
: আরে না না, ও একা থাকতে পারবে না। কেঁদে কেটে একসার করে ফেলবে। তাছাড়া আমারও দুশ্চিন্তা হবে। ঠিক আছে আমিও সাথে যাই।
: আরে না, না। তোমাকে যেতে হবে না। আমি যাব আর আসব। আমার উপরে ভরসা নেই নাকি?
অগত্যা একান্ত অনিচ্ছেয় বাবুকে গুছিয়ে দিতে হয়। বারবার সাবধান করে দেয় চোখে চোখে রাখতে। ওরা চলে গেলে জানালায় দাঁড়িয়ে ওদের ফেরার প্রতীক্ষা করে। ঘরের সব কাজ পড়ে থাকে।
সকাল গড়িয়ে বিকেল হয়। বিকেল গড়িয়ে রাত। অস্থির অধৈর্য জবা ছুটে যায় স্বামীর অফিসে। খবর পায় স্বামী ওদিন অফিসে যায়নি। জবা উন্মাদের মতো ছুটে যায় থানায়। খবর পায় না, হাসপাতালে হাসপাতালে ঘোরে, খবর পায় না। তারপর আর ফেরে না ওরা। পাগলের মতো দিন কাটে জবার। তারপর স্বামী এক বিকেলে ফোনে জানিয়ে দেয় সে বিয়ে করেছে।
পরদিন অফিসে স্বামীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জবা।
: তুমি ফোনে যা বললে তাকি সত্যি?
: সত্যি। স্বামীর দ্বিধাহীন নির্বিকার জবাব।
: কিন্তু আমি
: তোমার সাথে আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে জবা। তুমি নিজেই ডিভোর্স দিয়েছ। এই যে কাগজ।
সেদিন রাতে সই করা কাগজটা দেখিয়েছিল স্বামী।
জবার পৃথিবীটা টলে উঠেছিল।
: কাকে বিয়ে করেছ তুমি?
: আমার পিএকে।
শোক করার সময় পায়নি জবা। বিশ্বাস করতেও অসুবিধা হয়েছে। স্বামীকে সে পাগলের মতো ভালোবাসে, বিশ্বাস করে। স্বামী তাকে ঠকিয়ে ডিভোর্স করেছে এ অবিশ্বাস্য! পৃথিবী যে ঘোরে সেদিনই প্রথম উপলব্ধি করেছে জবা।
: কিন্তু আমার ছেলে, বাবু সোনা। ওকে আমি নিয়ে যাব।
: না ওকে দেব না। ওকে দিলে আমার কষ্ট হবে।
ভালোবাসার স্বামীকে কষ্ট দিতে পারেনি জবা। কষ্টটা নিজে বুক পেতে নিয়েছে। সব কিছু হারিয়ে চলে এসেছে খালিহাতে, নিঃস্ব-রিক্ত। ঢাকা শহরে কোথায় থাকবে সে। চলে এসেছে বাবার গ্রামে। ভাইয়েরা ঠকিয়ে সামান্য কিছু দিয়েছে তাকে। ও নিয়ে কোনো ভাবনা নেই জবার, চাওয়া-পাওয়াও নেই। শুধু আজও কষ্ট হয় সেই ভালোবাসার স্বামীর জন্য। ডিভোর্সি স্বামীর কথা নাকি মনে করতে নেই। কিন্তু মন কি আইন মানে, মানে না। তাই মনে না করে পারে না জবা, ভুলতে পারে না। আর সারাদিন সারারাত মনে পড়ে সেই টলোমলো শিশুটিকে। ওই শিশু তাকে জাগিয়ে রাখে, ঘুম পাড়ায়। মৃত্যুর আগে কি একবারও দেখা হবে না তার সাথে! হে খোদা তুমি এত নিষ্ঠুর!
মিঠুন চলে যাচ্ছে। ওর মুখটা আর একবার দেখে নিতে চায় জবা। পথে দেখা এই ছেলে তাকে সম্মান দিয়েছে, শ্রদ্ধা দিয়েছে। আরও কিছু দিয়েছে যার নাম তার জানা নেই। অথচ ছেলেটার মনে কত কষ্ট। নিজের মাকে ঘৃণা করার কষ্টের সমান কষ্ট এ অতলান্ত পৃথিবীতে আর নেই। জবা চেঁচিয়ে ডাকে।
: বাবা আর একবার ফিরে তাকাও তোমার মুখটা দেখি।
মিঠুন ফিরে তাকাতে চায় না তবু তাকায়।
: তোমার বাবার নাম কি, কি করেন উনি?
: তা দিয়ে আপনার দরকার কি? যাকগে আমার বাবার নাম রফিকুল ইসলাম। উনি একটা কোম্পানির মালিক। জবা ফুড অ্যান্ড বেভারিজ। জবা আমাকে ফেলে প্রেমিকের হাত ধরে চলে যাওয়া সেই মহিলার নাম। আমি চললাম। আর পিছু ডাকবেন না।
জবার পায়ের নিচের মাটি টলতে থাকে, তারপর কাঁপতে তাকে। অবিরাম কাঁপন। রফিকুল ইসলাম ! বউ বদলে ফেলেছে, বদলাতে পারেনি কোম্পনির নাম। ট্রেড লাইসেন্স বদল আরও কতকিছু বদলের ঝক্কি আছে। কি দরকার সে ঝক্কি পোহানো। জবা মিঠুনকে ডাকতে গিয়ে থেমে যায়। সন্তান-ছাড়া থাকা বড় মর্মান্তিক, বড়ই মর্মান্তিক। রফিক থাক, তার সন্তান নিয়ে ।
মিঠুন গাছের মতো সোজা হয়ে হাঁটে। বারবার ভাবে কেউ তাকে পিছু ডাকবে। ডাক শুনবার জন্য ওর মন আকুলি বিকুলি করে। কেন সে জানে না।