নদীও গড়ে – মনি হায়দার

গল্প
নদীও গড়ে
মনি হায়দার
হ্, তুমি তো খুব মিষ্টি একটা মেয়ে! মোনার গালে আদর করতে করতে বলে আফরিন। কখন খেয়েছো? কিছু খাবে?
মাথা নাড়ায় মোনা, না কিছুই খাব না।
এটা তোমার বিছানা। তোমার আগে ছিল হিস্টরির তুহিন আপা। গত মাসে চলে গেছেন। রুমে এতদিন একাই ছিলাম। তুমি আসায় ভালোই হলো। পড়ার টেবিল, বিছানা গুছিয়ে নাও, আমি বাইরে যাচ্ছি- যেতে যেতে ফিরে আসে আফরিন, তোমার নাম কি?
মোনা আকতার।
এখন থেকে তোমাকে মোনা ডাকবো। টেবিলের নিচে কিছুটা আড়ালে রাখা একটা বৈয়াম দেখায় আফরিনÑওভালটিনের বিস্কুট আছে, খিদে লাগলে খেয়ে নিও।
ঘাড় নাড়ে মোনাÑঠিক আছে।
রুম থেকে বের হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে মোনা অগোছালো বিছানার উপর বসে পড়ে। গালে, যেখানে আদর করেছিল আফরিন সেখানে মোনা হাত দেয়। মোনার সারা শরীর কেমন ঝিম ঝিম করতে থাকে।
পিরোজপুরের মেয়ে মোনা। প্রথম ঢাকা এসেছে থাকার জন্য। মনে ভয় দ্বিধা ও সংকোচ। ঢাকা শহরের গল্প সে শুনেছে খালাতো বোন ইশরাতের কাছে। ইশরাত এখান থেকেই মাস্টার্স করেছে ইংরেজিতে। এখন প্রশাসন ক্যাডারে বড় চাকরি করে। বাবা আবদুল মোমেন আইনজীবী। তার ইচ্ছে মোনা লেখাপড়া শিখে ইশরাতের মতো হোক। এসএসসি, ইন্টারমিডিয়েডে মোনা ভালো রেজাল্ট করেছে। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে তেমন সমস্যা হয়নি। পছন্দের সাবজেক্ট ইকোনমিক্স পায়নি, পেয়েছে পলিটিক্যাল সায়েন্স। তাতেই খুশি মোনার বাবা আবদুল মোমেন। মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে শুনেই বারো কেজি মিষ্টি কিনে পাড়া-প্রতিবেশীদের বিলিয়েছেন।
মোনা আগে আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে এসেছিল দু’একবার। একবার ফাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর ঘুরেও গেছে। তখন মোনা পড়তো দশম শ্রেণিতে। ভাবেনি একদিন ছাত্র হয়ে এই বটতলায়, কলাভবনে হাঁটবে। এখন বুকের ভেতর অনেক অনেক স্বপ্ন।
সন্ধ্যায় রুমে ঢুকে আফরিন দেখে মোনা নামাজ পড়ছে। হাসে আফরিন। নামাজ শেষ করে বিছানায় বসে মোনা। বাথরুম থেকে বের হয় আফরিন- তুমি নিয়মিত নামাজ পড়ো?
হ্যাঁ, শৈশব থেকে।
রোজা-
কথা শেষ করতে পারে না আফরিন, মুখের কথা কেড়ে জবাব দেয় মোনাÑ আমি যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি তখন থেকে রোজা রাখি।
তাই! আফরিনের কণ্ঠে কৌতুক।
আপনি রোজা রাখেন না?
মাথা নাড়ায় আফরিন- না।
কেন? মরণের ভয় নেই আপনার?
মরতে একদিন হবে জানি কিন্তু ভয় নেই আমার। যা থেকেও নেই তাকে খামাখা ভয় পাবো কেন? চলো, বাইরে থেকে ঘুরে আসি।
দুজনে সামান্য প্রসাধন সেরে রুমের বাইরে আসে। হাঁটতে হাঁটতে আসে হাকিম চত্ত্বরে। আফরিন কয়েকজন ছেলে বন্ধুর সঙ্গে আড্ডায় মেতে ওঠে। ওদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়- মোনার। মোনা শুধু হাত তুলে ওদের পাশে কুণ্ঠিতভাবে বসে থাকে। আফরিনের বন্ধু কমল কথা বলতে চেষ্টা করে মোনার সঙ্গে। কিন্তু মোনার নিস্পৃহতায় কথা জমে ওঠে না। বাদাম খেতে খেতে, লজিকের নতুন স্যারের পড়ানোর ঢং বিষয়ে কথা বলতে বলতে রাত ন’টা। কমলেরা চলে যায় টিএসসিতে, আফরিন আর মোনা ফিরে আসে হলে। ঢোকে ডাইনিং হলে। দুজনে রাতের খাবার খায়, খাবার খাওয়ার সময়ে মোনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় বুয়াদের। খেয়েদেয়ে বিল দেয় আফরিন। মোনা দেয়ার চেষ্টা করলে ছোট্ট ধমকে থামিয়ে দেয় আফরিন- প্রথম হলে খাওয়ার বিলটা আমিই দিই। স্মৃতি হয়ে থাকবে।
হাসে মোনা- ঠিক আছে।
দুজনে হলের সিঁড়ি ভেঙে উপরে ওঠে পাশাপাশি। মোনার মনে হয় সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে উঠতে আফরিন ওকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করছে। নিজের অজান্তেই হাত চলে যায় গালে, যেখানে দুপুরে আদর করেছিল আফরিন। আবার মোনার শরীর শিরশির করে ওঠে।
মোনা অনেকটা নির্ভরশীল হয়ে পড়ে আফরিনের উপর। দুজনে শৈশবের গল্প, স্কুলের গল্প, বাড়ির গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে মোনাকে ওর ডিপার্টমেন্টে পৌঁছে দিয়ে ক্লাস করতে যায় আফরিন। নতুন রুমমেটকে নিয়ে গল্প করে আফরিন আর কমল। কমল জানতে চায় মোনা সম্পর্কে।
হাসে আফরিন- কমল, ওর সঙ্গে তোর হবে না।
কেন?
কারণ মোনা প্রেমে বিশ্বাস করে না।
হা করে তাকিয়ে থাকে কমল- বুঝলাম না।
গত কয়েকদিনে মোনার সঙ্গে আমার অনেক কথা হয়েছে। ও একটা অদ্ভুত মেয়ে।
তো?
মোনা কোনো ছেলের সঙ্গে পাশে বসে গল্প করতে আড়ষ্ট বোধ করে। প্রচণ্ড ধর্মীয় বোধ কাজ করে ওর ভেতরে।
যেমন?
ও পুরুষদেরকে এক প্রকার ভয়ই পায়। পত্রিকার ধর্ষণের খবর ওকে খুব বিচলিত করে। মার্কেটে গেলে সব সময়ে সতর্ক থাকে কোনো পুরুষের সঙ্গে ওর শরীরের স্পর্শ না লাগে।
বলিস কী? হা হা হাসিতে ফেটে পড়ে কমল- ওকে ওর মা বাবার কাছে প্যাকেট করে পাঠিয়ে দে। নইলে কবে ও নিজের আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে হঠাৎ আয়না ফেটে মারা যাবে।
রেগে যায় আফরিন- প্রত্যেক মানুষের আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে পারে কমল। ওকে ওর মতো থাকতে দে।
আমি যে ওকে… কথা শেষ করে না কমল।
তাই?
হ্যাঁ, দেখেছিস কি মিষ্টি দেখতে ও? গরম জিলাপির কোয়ার মতো ওর গাল দুটো।
আর উপমা খুঁজে পেলি না? শেষপর্যন্ত জিলাপির কোয়ায় নিয়ে গেলি! হাসে আফরিন।
গরম জিলাপি আমি খুব ভালোবাসি আফরিন, তুইতো জানিস। থাক ওসব, ওকে তো মানুষ বানাতে হবেÑগভীর উৎকণ্ঠা কমলের কণ্ঠে।
মানে? মোনাকে তোর কী মনে হয়? এক চামচ আলুর দম? নাকি একমুঠো চিনি? গ্লাসে পানি নিয়ে গুলে খাবি?
চটে যায় কমল, আফরিন তোর সব কিছুতেই বাড়াবাড়ি। আমি বলতে চেয়েছি এ যুগে এই রকম একটা ভাবনার মেয়ের মানসিক পরিচর্যার একটা ব্যাপার আছে। আমার দৃঢ়বিশ্বাস মোনার সঙ্গে দু’একবার কথা বললে ওর ভেতরে পরিবর্তন আসবে। ভাবা যায়Ñওর মতো সুন্দর একটা মেয়ে ইউনিভারসিটিতে পড়ে অথচ ছেলেদের সঙ্গে কথা বলতে ভয় পায়?
ঘটনা আরও আছে- কৌতুকের হাসি দিয়ে বলে আফরিন।
কি ঘটনা? প্রশ্ন করে কমল।
মোনা বোরকাও পরতে চায়- পুরুষের লোলুপ চোখ থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য।
কিন্তু এখন পর্যন্ত তো ওকে বোরকা পরতে দেখিনি- মন্তব্য কমলের।
ওর ট্রাঙ্কে বেশ কয়েকটি বোরকা আছে, আমাকে দেখিয়েছে। এটাও ঠিক-ও একটু জটিল টাইপের মেয়ে। বোরকা থাকলেও পরে না। ভাবে-শরীরের চেয়ে মনের পর্দা অনেক বেশি জরুরি। আজকাল নাকি অনেক মেয়েরা বোরকা পরো ফষ্টিনষ্টি করে বেড়ায়। ও বোরকা পরলে অন্যরা কি ভাববে, তাই পরে না।
আফরিন? হাত ধরে কমল।
কী?
যতই শুনছি মোনা সম্পর্কে, ততই আকৃষ্ট হচ্ছি। মোনার মধ্যে জটিলতার যে ঢেউ, ওই ঢেউয়ে আমি নাও ভাসাতে চাই। দোস্ত, একটা ব্যবস্থা করে দে-
গাধা! এটা কি ডাক্তারখানা? একটা ব্যবস্থাপত্র লিখে ঔষধ খাওয়ালেই কি হয়? মনের গহিনে ডুব দিতে হয়। আমি তোর সম্পর্কে মোনাকে বলবো। দেখি, তোর জন্য ওকে পটানো যায় কি না?
আফরিনের হাতের তালুতে চুমু খায় আনন্দে উদ্ভাসিত কমল- থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ। আমি জানি, তুই পারবি।
রাতে বিছানায় শুয়ে আফরিন প্রশ্ন করে- বাড়িতে কে কে আছে?
মা, বাবা, দাদি আর ছোট্টা দুটো ভাই।
ওদের জন্য মন খারাপ লাগছে?
আফরিনের প্রশ্নে সঙ্গে সঙ্গে কান্নায় ভেঙে পড়ে মোনা। আফরিন নিজের বিছানা থেকে নেমে কাছে আসে। মাথায় হাত রাখে। গুমরে গুমরে কাঁদছে মোনা। মোনার শরীরে আদর করতে করতে ওকে প্রায় জড়িয়ে ধরে। আফরিনের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে মোনা একটু স্বস্তির স্বাদ নিচ্ছিল। আহা, মা বাবা, ভাই বোনদের কোলাহল থেকে সে আজ কতদূরে! আফরিন না থাকলে তার যে কী হতো? সারাটা জীবন নিজের কাছে নিজেই একটি রহস্যের আধার হয়েছিল। নিজের কথা, ব্যথা সে কারও কাছে বলতে পারতো না। সেই মোনা আজ নগরে মানুষের বিপুল কোলাহলে নিজেকে দেখে কিছুটা বিহ্বল, খানিকটা অস্থির, একটু দিশেহারাও।
তার নিজস্ব ভাবনার মধ্যে হঠাৎ দেখে আফরিন তাকে জড়িয়ে ধরছে। জীবনের দরজা থেকে মোনা যে অভিজ্ঞতা এতদিনে তিলে তিলে অর্জন করেছিল কল্পনায়, সেই কল্পনার নোনা স্বাদে আফরিন তাকে আঁকড়ে ধরেছে বলিষ্ঠ সৌষ্ঠবে। এবং তার ঈষৎ ভেজা ঠোঁটের ভেতর আফরিন তার ঠোঁট ঢুকিয়ে দিয়েছে। মোনার শরীরের সমস্ত কুঠুরি ভেঙে নেমে আসে বিপুল প্রপাত। তার শরীর কাঠামোয় শরীর নেই, গোটা শরীর নাচছে গনগনে আগুনের লেলিহান শিখায়। ওর ভেতরে লালিত দীর্ঘদিনের সংস্কার তীব্র এক অভিঘাতের সৃষ্টি করে। দ্রুত নিজেকে বিযুক্ত করে আফরিনের গ্রাস থেকে। হঠাৎ সব হারানোর মাঠে আবিষ্কার করে কিছুক্ষণ আগের ফেলে আসা বাড়ির স্মৃতিক্লান্ত বিকেলে বিলে হাঁস খুঁজতে যাওয়ার মতো মোনা আকতারকে ডাকে।
কমল বাড়ি গিয়েছিল।
ফিরে আসার দুদিন পর কলাভবনের সামনে পাকড়াও করে আফরিনকেÑ কোথায় থাকিস বলতো। গতকাল থেকে তোকে খুঁজছি।
কেন খুঁজছিস?
মোনার সঙ্গে পরশু দেখা হয়েছিল।
তারপর?
মেয়েটিকে কত কথা জিজ্ঞেস করলাম- মেয়েটি একটি কথাও বললো না। এমন কী আমার দিকে ফিরে তাকালো না পর্যন্ত। সত্যি করে বল তো আফরিন ও কী মেয়ে?
হাসে আফরিন- মেয়ে, এক্কেবারে রক্তে মাংসের আস্ত একটি মেয়ে। এবং একটা মেয়ের যা যা থাকা দরকার সবই আছে।
আমার মনে হয় তুই সত্যি বলিসনি।
কিসে সন্দেহ হলো তোর?
কত কথা বললাম, জিজ্ঞেস করলাম- কিছুই বললো না। নিশ্চয়ই ও গ্রামে কারও সঙ্গে প্রেম করে।
মোটেই না।
তোকে বলেছে মোনা?
ওর জীবনের মোটমুটি সবই আমি জানি। আগেই তোকে বলেছি- ধর্মীয় বোধের কারণে ও ছেলেদের কাছ থেকে দূরে থাকতে চায়। ছেলেদের হয়ত খানিকটা ভয়ও পায়।
কিন্তু আমিত ওকে সহজে ছাড়ব না।
কী করবি?
ওর রোবটিয় অস্থিতে আমি সবুজ ঘাসের চাষ করবো। ওর চেতনার জগৎ রঙিন করে দেব। আমি এত সহজে হারতে রাজি নই। তুই ওর সেল নম্বর দে।
কী করবি তুই?
ওকে ফোন করবো, বলবো- ভালোবাসি। হাজার বার বলবো, লক্ষবার বলবো- অবশ্যই ওর বন্ধ দরজা খুলে যাবে। মোনা আমাকে ভাবতে বাধ্য হবে।
হাসে আফরিন- মোনা আননোন নম্বর ধরে না।
সেটা আমি বুঝবো। তুই দে-
তুই একটা জিনিস বটে কমল। নে, তোর সেলে সেফ কর- জিরো, ওয়ান, নাইন, ডাবল টু, ডাবল থ্রি, সেভেন…
নিজের সেলে মোনার নম্বর সেভ করে কমল, তাকায় আফরিনের দিকে-তুই কি আমার কথা বলেছিলি?
বলেছি।
ও কি বললো?
ও দু’হাতে দু’কান চেপে ধরে বললো- আফা, বিয়ের আগে ওসব শুনলেও পাপ হয়। বেহেস্ত হারাম হয়ে যাবে আমার জন্য, আমার মা বাবা ভাইবোনের জন্য।
এতক্ষণে হাসে কমল- ও বেহেস্তে গিয়ে কী করবে?
পাল্টা হাসে আফরিন- তোর মতো কোনো নাছোড়বান্দাকে খুঁজবে।
মোনা রুমে মন খারাপ করে বসে আছে। গিয়েছিল হাউজ সুপারের কাছে- রুমটা চেঞ্জ করতে চায়। কিন্তু হাউজ সুপার রাজি হয়নি। বলেছে মাত্রÑ মাস দুয়েক হয় উঠেছ, এত তাড়াতাড়ি চেঞ্জ করবে কেন?
এমনিই।
অবাক হাউজ সুপার- বলে কি মেয়ে, এমনি কি কেউ রুম চেঞ্জ করতে আসে নাকি! যাও, রুমে গিয়ে ঠিকভাবে পড়াশুনা কর।
মোনা কী করে বুঝাবে- রুমে এলে, বিশেষ করে রাতে সে আর মোনা আকতার থাকে না। হয়ে যায় আফরিনের- কেবল আফরিনের কেন, নিজেও দিশেহারা হয়ে যায়। নিষিদ্ধ জীবনের দ্রাক্ষারসে শরীরের প্রতিটি কণা উত্তাপে উত্তাপে খান খান হয়ে ভেঙে যায়, উড়ে যায় শিমুল তুলার মতো আকাশ বাতাস মথিত করে। শরীর হননে এত সুখ, এত উচ্ছ্বাস- জানতে পারেনি। আফরিন ওর শরীরের দরজার পর্দা ধীরে ধীরে একটা একটা করে খুলে দিচ্ছে।
কয়েকদিন আগে অনেকটা জোর করেই নিয়ে গিয়েছিল শিল্পকলার থিয়েটার মঞ্চে। দেখেছে থিয়েটার আর্ট-এর নাটক-‘কোর্ট মার্শাল’। যদিও নাটক, হচ্ছে অভিনয়, কিন্তু দেখতে দেখতে মোনার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। জীবনে এই প্রথম নাটক দেখা। তাও সেনাবাহিনী নিয়ে। নাটক দেখে ফেরার পথে রিকশায় বসে জানতে চেয়েছে মোনা-এই নাটক কী সেনাবাহিনীর লোকেরা দেখে না?
হয়ত দেখে, হয়ত দেখে না। তাতে তোমার আমার কী?
ওদের বিরুদ্ধে নাটক- ওরা যদি কিছু মনে করে? ওদের হাতে অস্ত্র আছে।
ওদের সেই অস্ত্র কেনা হয়েছে আমাদের মতো নাগরিকের ট্যাক্সের টাকায়। ওরা যা খায়, পরে, ভোগ করে- সবই আমাদের টাকায়।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সেনাবাহিনীর মধ্যে এসব হয়েছে?
হবে না কেন? মুক্তিযুদ্ধ- একাত্তর- রাজাকার- নিয়েই তো সেনাবাহিনীর মধ্যে বারবার ক্যু হয়েছে। একদল আর এক দলকে মেরে লোপাট করেছে। চায়ে ভিজিয়ে পাউরুটির মতো ক্ষমতা পান করেছে। এই নাটক সেই সব ঘটনার সামান্য প্রতিচ্ছবি মাত্র। আর মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল বলেই আজ আমাদের এত মেজর এত কর্নেল এত জেনারেলÑএত প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক…
মুক্তিযুদ্ধ এলেই মোনার চিন্তার জগতে বুদবুদ ওঠে। মোনার নানাÑআজিজ উদ্দিন এলাকার নামকরা রাজাকার ছিল। দু’একজন মুক্তিযোদ্ধাকে দিনের মধ্যে নিজের হাতে জবাই দিতে না পারলে রাগে ঘরে এসে নানিকে দরজার দাশা দিয়ে পিটিয়ে ভাত খেতো। মানুষটা নাকি দেখতে ছিল সাদা ধবধবে ফর্সা। চোখে মাখতো সুরমা। মাথায় কান পর্যন্ত ঢাকা কালো টুপি। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পরও আরও কী সব নামাজও পড়তো। মুখভরা ছিল সাদা চাপদাড়ি। যুদ্ধের শেষের দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়বার ভয়ে দাড়ি কেটে, সুরমা ছেড়ে, টুপি গুডবাই জানিয়ে দূরের গ্রামে ভিখিরি সেজে ঘুরে বেড়াতো। এত কিছুর পরও মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়লো। মুক্তিযোদ্ধারা তার গায়ের চামড়া তুলে লবণ মেখে রাস্তায় রাস্তায় হাঁটিয়েছিল। নানার চিৎকারে নাকি গাছের পাতাও কাঁদতো… সবই মায়ের মুখে শোনা। মোনা আকতারের মা মর্জিনা বেগম বলতো আর কাঁদতো। সেই কান্না প্রবাহিত ছিল মোনার ভেতরেও। এমন পরহেজগার নানাকে এমনভাবে কষ্ট দিয়ে মারলো- ভাবলেই মুক্তিযুদ্ধের প্রতি একটা বিবমিষা জাগে, ধর্মের প্রতি দরদ বাড়ে মোনার। ধর্মের পথেই নানা আজিজউদ্দিন শহিদ হয়েছে, বিশ্বাস ওর।
সেই ধর্মবৃক্ষের সুশীতল ছায়া থেকে আফরিন আপা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? ও শুনেছে এসব করে তারা কস্মিনকালেও বেহেস্তে যেতে পারবে না। কিন্তু মোনার এই দিনের ভাবনাটা রাতে আর অটুট থাকে না। ভাবনা, ধর্ম সব ছাড়িয়ে শরীরই তার কাছে অমোঘ, অনিয়ন্ত্রিত এক জাদুর মধুভাণ্ডে রূপান্তরিত হয়। তখন মোনা নিজেকেই চিনতে পারে না। রাতের ঘন অন্ধকারে সে আর আফরিন হয়ে ওঠে দুর্ধর্ষ ঘোড়সওয়ার।
সকালে মোনা প্রার্থনায় বসে প্রার্থনা করে- আমি আর যাব না ওই অমিত পাপের রাজ্যে। আর আফরিনের প্ররোচনায় হব না বিভ্রান্ত। থাকব মহান প্রভুর দেখানো পথে, সত্য ও সঠিকভাবে। দিনের আলোয় ভেতরে ভেতরে আফরিনের জন্য তীব্র ঘৃণা, ক্রোধ সৃষ্টি হয় মোনার মনে। কিন্তু তার প্রার্থনা পরের রাতে কবুল হয় না, পুনর্বার মোনা এবং আফরিন…
কমল গুনে গুনে এক হাজার তিনশ একাশিবার ফোন করেছে মোনাকে। না, মোনা একবারও রিসিভ করেনি। একজন মানুষ, বিশেষত সে নারী, তার ওপর তরুণী। কৌতূহলেও তো একবার বাটন টিপে জানতে চাইতে পারে- কেন তাকে এতবার ফোন করছে? অথবা প্রকাশ করতে পারে- ক্রোধও। কেন তাকে বিরক্ত করা হচ্ছে? অথচ কি নির্মম নিস্পৃহ সে? ওর ভেতরে কৌতূহলের কোনো কণাবিন্দু নেই? মোনা কি রক্তে মাংসে নারী?
ফোন না ধরলে পাঠিয়েছে ভালোবাসার বার্তা। কত রকমের যে বাতা- কখনও গানের, কখনও কবিতার, কখনও নিজের রচনা…। যাই পাঠাক- সবই বৃথা, কোনো সাড়া মেলেনি। কী হবে মোনার? মোনা কী চিরকাল জলহীন নদীর স্রোত হয়ে থাকবে?
এসব কমলের আত্মগত প্রশ্ন। স্বাভাবিকভাইে সে কোনো উত্তর পায় না। কান্নিখাওয়া ঘুড়ির মতো ঘুরে বেড়ায়।
আফরিনের মাস্টার্স শেষ, চলে গেছে হল ছেড়ে। হাফ ছেড়ে বাঁচে মোনা। এখনও রুমে কেউ ওঠেনি। এখন থেকে ও একলা থাকবে। নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় নিজের কাছে। আফরিনের সকালে চলে যাবার পর সুন্দর করে রুম সাজিয়েছে মোনা। আফরিনের দেয়া কানের দুল, একটা পার্স, কয়েকটি বই ফেলতে গিয়েও ফেলে না, রেখে দেয় টেবিলে যত্ন করে। কোটমার্শাল নাটকের পর আরও কয়েকটা নাটক দেখেছে মোনা আর আফরিন। দেখেছে- এবং বিদ্যাসাগর, রাঢ়াঙ, ভাগের মানুষ, চে’র সাইকেল, ডালিমকুমার, কথা একাত্তর। নাটক দেখতে দেখতে মোনার মনে হয়েছে এইসব তার মা মর্জিনা বেগমকে যদি দেখাতে পারতো, খুব ভালো লাগতো। একটা নাটকের ভেতর কীভাবে কয়েক সহস্র বছর কাল বন্দি হয়ে থাকে, অভিনয়ের ভেতর দিয়ে সেইসব কাল কতটা সজীব আর প্রাণবন্ত হয়ে চোখের সামনে হাঁটে!
সারাদিন ক্লাস করে, বিকেলে হলে এসে ভাত খেয়ে ঘুমিয়েছে মোনা। ঘুম থেকে উঠতে উঠতে প্রায় সন্ধ্যা। আকাশে মেঘ জমেছে। ও বারান্দায় আসে, তাকায় আকাশের দিকে; ভয়ানক ভার আকাশের মুখ। আকাশ থেকে তাকায় রুমের মধ্যে, আর তখনই মনে হলো সে, মোনা আকতার সম্পূর্ণ একা। পাশে কেউ নেই। কামনা মদির শরীর উছলে আলোর দানা নামছে, তার ভেতরের কেউ একজন হু হু কান্নায় উজান বাইছে, ওর মরমে পশিয়া যায় নির্ভরতার একটি চাবি চাই… একটি চাবি… নির্ভরতার…
বাইরে বেশ বৃষ্টি। কমল লাইব্রেরিতে পাঠ নিচ্ছে। সামনে খোলা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বই। পাশে রাখা সেল ফোনে ম্যাসেস আসে। আনমনে সে মেসেস দেখে, আমি স্বোপার্জিত স্বাধীনতার সামনে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছি। তুমি আসবে? ভিজবে বৃষ্টিতে আমার সঙ্গে?
মোনা।