প্রচ্ছদ রচনা : শব্দঘর : আমি আর কী চাই : পবিত্র সরকার

প্রচ্ছদ রচনা
শব্দঘর :
আমি আর
কী চাই
পবিত্র সরকার
শব্দঘরকে আমি কীভাবে দেখতে চাই? বা শব্দঘর-এ আরও কী কী চাই? দুটোই বেশ কঠিন প্রশ্ন। প্রথমটা সংগত হতো যদি শব্দঘর প্রকাশের আগে এটা করা হতো। এখন শব্দঘর প্রকাশিত হয়ে, তার সুদৃশ্য রূপ আর চিত্তাকর্ষক নানা বিষয় নিয়ে বাঙালি পাঠকের কাছে সমাদৃত হয়েছে- এখন এ প্রশ্ন তোলা মানে শব্দঘর-এর মৌলিক অস্তিত্ব সম্বন্ধেই প্রশ্ন তোলা যেন। আমার নিজের কাছেও আমি প্রশ্ন করি, আমি লোকটা এর উত্তর দেওয়ার যোগ্য কিনা। প্রিয় মোহিত কামাল আর তাঁর সহযোগীরা মিলে যে অনিন্দ্যসুন্দর পত্রিকাটি নির্মাণ করে চলেছেন, রুচিমান বাঙালি পাঠক যে পত্রিকাটিকে সাগ্রহে হাতে তুলে নিয়েছেন, যা এর মধ্যেই প্রমাণ করেছে নিজের বৈধতা ও গ্রহণীয়তা- তাকে আমি অন্য কোনো-ভাবে দেখতে চাইব, আমি এমন কী মাতব্বর এসেছি? ও প্রশ্নটার সোজা উত্তর হবে- ‘শব্দঘর যেমন আছে আমি তাকে সেইভাবে দেখতে চাই।’ এই বলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচা যেত, কথাটা অসত্যকথনও হতো না।
যা আছে তা দেখে তো মনে হয় এর বাইরে আর কী হতে পারে? এত শোভন শিল্পসম্মত একটি প্রকাশনা- রং আর রুচির যেখানে মিলন ঘটেছে, প্রচ্ছদ থেকে পাতায় পাতায় ছবিতে চিত্রণ দৃষ্টির উৎসব- চমৎকার কাগজ, প্রায় নির্ভুল সুমুদ্রণ, এখানে ওখানে উঁকি দিচ্ছে প্রিয় লেখকদের মুখচ্ছবি, আমাদের চোখই প্রথমে এ-পত্রিকাটির অন্দরে আমাদের টেনে নিয়ে যায়। তার পর প্রখ্যাত, প্রিয় ও প্রার্থিত লেখকদের, এবং সেই সঙ্গে প্রতিভাঋদ্ধ নবীন লেখকদের লেখাতে মানুষের জ্ঞান আর অনুভববিশে^র নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচন হচ্ছে প্রতি সংখ্যায়, তাতে মন দৌড়ে বেড়ায়, কখনও উত্তেজনা কখনও বিশ্রাম ও অপার সুখশান্তি পায়। এর বাইরে আর কী চাইতে পারি।
শব্দঘর জন্ম থেকেই ভালোত্বের এমন একটা পরাকাষ্ঠা খাড়া করেছে যে, আমাদের প্রত্যাশাকে যেন তার মধ্যেই আটকে রাখতে চায়, বলতে চায়, ‘আমিই সীমা, আমিই চূড়ান্তÑ আমাকে ছাড়িয়ে আর কী চাইবে তুমি?’ দেশের সহিত্য আছে, বিদেশের সাহিত্য আছে, আছে ভ্রমণকথার পৃথিবীর নানা কোণের ছবি ও খবর, আছে নাগরিক ও লোকসংস্কৃতির নানা বিষয়ের সচিত্র আলোচনাÑ তা আমার পৃথিবী আর কত বড়, আমি এই নির্ণীত দিগন্তের বাইরে আর কোথায় উঁকি দেব? শব্দঘর তাই আমাকে খুব মুশকিলে ফেলে দিয়েছে। অল্প কটি পাকাচুলের ব্যাপক টাকমাথায় এই বুদ্ধিজীবীর মানসম্মান বুঝি আর থাকে না।
২
যাই হোক, ওই সম্মান বাজায় রাখার খাতিরেই কিছু বোকা বোকা কথা বলি। সব শব্দঘর দেখিনি, কাজেই যা বলব তা হয়তো শব্দঘর-এ আছে, কিন্তু আমার চোখ এড়িয়ে গেছে। তবু বলতে হবে বলেই বলা, চালাক লোক হলে সাহস করতাম না। এক, বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিকে কি একটি বেশি জায়গা দেওয়া যায়। না বিজ্ঞানের দুরূহ তত্ত্ব নয়, বা সাধারণের পক্ষে অপ্রাসঙ্গিক কোনো খবর নয়, কিন্তু যে বিজ্ঞান আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে জড়িয়ে আছে তার কথা কি সহজভাবে কেউ বলবেন না শব্দঘর-এর পাতায়? শুনেছি আধুনিক প্রযুক্তির পিছনে আছে বাঙালি বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্রের একটা তত্ত্ব। এই বিষয়টা কি কেউ সহজে বাংলায় প্রমাণ বা অপ্রমাণ করতে পারেন, কোনো বাঙালি পদার্থবিদ, দূর-নিয়ন্ত্রণের মূল কথাগুলি বলে? আসলে এই বিশ^চরাচর সম্বন্ধেই তো আমাদের ধারণা স্পষ্ট নয়। প্রত্যেকটা তারাই যদি একটা সূর্য হয়, তা হলে সৌরজগতের সংখ্যাই অগণিত, আমরা সেখানে একটা সৌরজগতের বাসিন্দা, হয়তো ওই কোটি কোটি সৌরজগতের মধ্যে একটিমাত্র, যার একটি গ্রহে প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে। এই ব্যাপারটার তাৎপর্য কী- এই জ্ঞান নিয়ে আমরা কী করব- ধ্বংসের দিকে আগাব, না একসঙ্গে হাতে হাত রেখে বাঁচার দিকে? এই দেখুন, বয়স হয়েছে বলে হয়তো এক কথা থেকে অন্য কথায় কেমন সহজে চলে গেলাম- বিজ্ঞান থেকে দর্শনে। তা দর্শনের কথাও একটু আসুক না, দর্শন থেকে যদি আমাদের বাঁচা-মরার কোনো দিগ্দর্শন মেলে। জীবনঘনিষ্ঠ নানা বিষয়ে শব্দঘর নিজেকে বিস্তারিত করুক, সমাজবিজ্ঞানে, নৃবিজ্ঞানে, আরও কত কী অভিমুখে।
আর-একটা জিনিস মনে এল। শব্দঘর কি সব সময় খুব গুরুগম্ভীর থাকবে? আমি তো মাঝেমধ্যেই, হয়তো নিয়মিতই, দেখতে চাইব একটি রসরচনা- যার চিত্রণে রঙিন কার্টুন থাকবে। আমি জানি দেশের এই দুঃসময়ে হাসিঠাট্টার কথা বলা অনুচিত, কিন্তু অতি দুঃখী মানুষও জীবনের প্রত্যেকটা মুহূর্ত কেঁদে কেঁদে কাটায় না। যারা হাসি ঠাট্টাকে স্থিতাবস্থার সমর্থক বলে হয়তো তারা বলে না, কিন্তু হাসি কখনও প্রথাকেও উলটে দিতে চায়।
বই সম্বন্ধে আলোচনায় যেমন শব্দঘর যতœ করে ছাপে, তেমনই চিত্রপ্রদর্শনী, নাটক, সংগীতানুষ্ঠান ও অন্যান্য উৎসবের সচিত্র আলোচনা আরও বেশি বেশি করে আসুক শব্দঘর-এ।
আপাতত এই। এই ক্ষুদ্র মাথায় সত্যি ভাববার শক্তি খুব বেশি নেই।
লেখক : সাবেক উপাচার্য
রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা