প্রচ্ছদ রচনা : বেলাল চৌধুরীর কবিতার পুনর্পাঠ

প্রচ্ছদ রচনা
কবি বেলাল চৌধুরীর জন্মদিনে আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য
বেলাল চৌধুরীর কবিতার পুনর্পাঠ
রাম দাওয়াই
রাম মন্দির আর বাবরি মসজিদে কি ধুন্ধুমার কাণ্ড
চারদিকে কি ঘোর বিতণ্ডা আর কাজিয়া ফেসাদ
সন্দ কি- যদি থাকতেন আজ রসরাজ চক্রবর্তী শিব্রাম
দিতেন বিধান সুনিশ্চত :
রাম মন্দির আর বাবরিতে কী আর তেমন তফাৎ
বাবরির বদলে বরং রাবড়িতে করহ মনোনিবেশ
‘মন্দির আর মসজিদে টাইকাছে তোমার পথ’
বলেই তো গেছেন সাধক গুরু সাঁই।
এত সব শুনে শক্তি আর রশীদেতে সেকি গলাগলি কত না আহ্লাদ
রাবড়ির বদলে আমীর খান বন্দিশে বিভোর
দু’জনে মিলে আকণ্ঠ নির্জলা রামই গেলে
প্রাণভরে সাঁটে তোফা তরল গরলে
তারপর দু’জনার অট্টরবে হাসির বাহার ছোটে দিগবিদিকে
সে কি দমফাটা গমক, লা জবাব!
রাম রাবণের লড়াইতেও বোধ করি তেমনটা
দেখা গিয়েছিল কি না ঘোর সন্দ;-
‘নাম কি মিয়া’র প্রত্যুত্তরে ধ্বনিত হয় শুধু কল্যাণ রাগ
‘নিকুতি করি শরাবখোর ব্যাটা বামুন কোথাকার’
এমত খিস্তি খেউড়ের ফাঁকে যে দু’জনেই হল পগারপার
ওদের অট্টহাসে দেয় যোগ শামসের আনোয়ার
এরপর এখন এই যে বামিয়ন ভাঙল বর্বরস্য বর্বররা
ওরাই না পুড়িয়েছিল আলেকজান্দ্রিয়ার সুপ্রাচীন গ্রন্থাগার
এরপরেও সুচিশুভ্র মোমের শিখায় জ্বল জ্বল করে জ্বলছিল
আমাদের কবিতার ইস্পাতদৃঢ় শাণিত ইশতাহার।
বাল্যশিক্ষায় ভালোবাসা
‘ভ’য়ে আকার ভা
‘ল’য়ে ওকার লো
‘ব’ এবং
‘স’য়ে আকার
যথাক্রমে বা
এবং সা
দিয়ে তৈরি শেকলে
যেসব ‘আলো’র মতো
বাক, শব্দ, শক্তি তেজ ভরা
রূপ, সুধা, ছন্দ দ্বন্দ্ব আছে
তেমনই
ভাত, ভাষা’ ভান, ভাগা
লোক, লোচ্চা, লোহা, লোহু
বাক্, বাক্য, বাগ, বাঘ, বাংলা
সাং, সাকি, সাক্ষী, সাঙ্গ, সাজ
সাত সাড় সাধ সাধ্য সাদি
সান্ত্রী সাপ সাফ সান্য সায়া
সারি সালু সাস্না দিয়ে হয় সাঙ্গ
দেখা হল অবেলায়, বই মেলায়
বাঃ দেখতে বেশ হয়েছে তো বইটি, কি সুন্দর
আর প্রচ্ছদপট, উফফ… কার আঁকা,
কাইয়ুম চৌধুরীর না অন্য কারুর?
নামটি যদিয়ো এক্কেবারে অফবিট-
তবুয়ো সুপার ডুপার
আগে কোনোদিন-
এই লেখকের কোনো বই দেখেছি বলে তো মনে পড়ছে না
আবার হতে পারে এমনও যে আমিই জানি না
জানে প্রকৃত সাহিত্যপ্রেমী –
সঠিক না বেঠিক, ছিলেন কোথায় এতদিন?
বন থেকে বেরুল টিয়ের মতো
তাহলে শেষমেস কতদিন বাদে দেখা হল বলুন তো
তাও আবার এই বইমেলার মাঠেই
আপনার বইও বেরুল
আমাদের দেখাও হল বই মেলার মাঠে
বহুক্ষণ হাতে নিয়ে নড়াচড়া করতে করতে
দ্রুত হাতে পাতা উল্টিয়ে নজর বোলাতে বোলাতে
আরে উৎসর্গটা তো ভারি মজার
দারুণ বোল্ড, সাহস আছে মানতে হবে;
দু’হাতে বইটি বুকে চেপে আদর সোহাগ করার মতো
নাকের কাছে নিয়ে ঘ্রাণ শোঁকার মতো
বুকভরে টেনে নেয় তরতাজা বাতাস
আবার কেমন উদাস অন্যমনস্ক আর সুদূর মধুর হয়ে পড়ে
বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ রেখে দেয় বইটি
তারপর কোথায় কোন দিকে চলে গেল
সেদিনও যেমন বুঝিনি আজও তাই…
আততায়ী মধ্যরাত
মধ্যরাতের সঙ্গে তার প্রথম দেখা
নিদারুণ এক গ্রীষ্মরাতের অচেনা স্টেশনে
সবাই যখন অচেতন, নিমজ্জিত গভীর ঘুমে ;
এখানে দাঁড়ায় না কোনও ট্রেন, এ-স্টেশনে
কেবল সবুজ বাতি আর পতাকার প্রশ্রয়ে
ঘুমোয় অকাতর, পড়ে থাকে নির্বিকার, অশ্রুত অগোচর।
সেই থেকে শুরু চেনাজানা পরস্পরের
সেই থেকে মধ্যরাত নিয়েছে তার পিছু-
নিকষ কালো ঢিলেঢালা আলখাল্লা-আবৃত
মধ্যরাত, জাদুদ- হাতে হুল্লোড়ে মাতে ফুটপাতে, রাস্তায়।
নিঃস্ব ও নিঃসঙ্গ, আর্ত ও ভঙ্গুর রাতের শিখরে
শোনে সে অবিরাম ভিখিরি-কোরাস
মধ্যযামে কেবলই মধ্যরাতের তুখোড় পাগলামি-
ঘন আঠার রুমালে দ্যায় বেঁধে চোখজোড়া
দ্যায় উদোম করে নির্জলা
মটকে দ্যায় হাতের সরুশীর্ণ আঙুল
টানাটানি করে চুল ধরে, নাচে বাউলের মতো
হেসে ওঠে হাঃ হাঃ বিকট রবে, মারে তুড়ি
তাকে ঘিরে যেন চকচকে শব্দের মোহর গড়ায় ঝন্ঝন্
নাছোড়বান্দা মধ্যরাত নাচানাচি করে তাকে নিয়ে
ঝাঁকুনি মারে প্রবল, ভাঙে চোরে,
ল্যাং মেরে ঠেলে ফেলে দ্যায় পথের ওপর
– ধূলো আর কাদায় খায় গড়াগড়ি
মধ্যরাত বড় বেশি কঠিন ও নির্মম
মধ্যরাতের নেই কোনও আদর-সমাদর
মধ্যরাতের নেই কোনও দ্রব অশ্রুজল
মধ্যরাত নির্নিমেষ দ্যাখে শুধু উত্থান ও পতন-
শীতল ও বধির একচক্ষু মধ্যরাত
ঠিক যেন এক কুশলী কূট চতুর চৌকিদার
সোপর্দ করে তাকে দায়রায় :
আইন-শৃঙ্খলা ভঙ্গকারী বেহেড মাতালের
চাই সমুচিত সাজা-কোথায় জল্লাদ
ফাঁসির দড়ি রুদ্ধ করে দিক কণ্ঠনালী।
অচেনা, অজানা থাকো তুমি
ওদিকটায় কি আছে জানি না, খোঁজও করিনি কোনোদিন
আসলে কোনো প্রয়োজন হয়নি খোঁজ করার-
কেবল দূর থেকে দেখে মনে হয়েছে
নিরন্ধ্র ঐ সবুজ অরণ্য আছে তার নিজস্ব নিয়মে
কিছু বুনো ঝোপঝাড়, গাছপালা, ফুলফল
পাখি, লতাপাতা নিয়ে, ঝিল, ডোবা জলাশয়ও
থাকতে পারে তার নিজস্ব জগতে।
কোনো গুপ্ত সংগঠন আছে কিনা জানি না,
সন্ত্রাসবাদী কিংবা চোর ডাকাত কিংবা
পীর ফকির সাধু সন্ত-র আস্তানা আছে কিনা
তাও জানি না, যেমন জানি না
প্রাচীন কোনো ভাঙা মন্দির-টন্দিরের ইটের পাঁজরে
সাপেরা বাসা বেঁধে মিথুনে মগ্ন থাকে কিনা
-কোনো তক্ষকের ডাকও শুনি নি কোনোদিন।
শুধু একটাই কমনা আমার
থাক ঐ অরণ্য অক্ষত কুমারী
রঙে রঙে ভেসে যাক সূর্যোদয় ও সূর্যোস্তে
কোনো কাঠুরের অনুপ্রবেশ যেন না ঘটে কোনোদিন।
আলপিন এবার মানুষ হয়ে যাবে
চারপাশে ক্রমাগত সব কিছুই বেড়ে চলেছে দ্রুততালে
জন্মহার থেকে ঝাড়বংশে কিলবিল পোকা-মাকড়,
এর মধ্যে শুধু মানুষই কেবল ছোট হয়ে
আসছে দিনের পর দিন,
দিন যাপনের গ্লানি শুনতে শুনতে কড়া পড়ছে আঙুলে।
এই তো বিপদসীমা অতিক্রম করে বাড়ছে কূলপ্লাবী
বন্যার জলরাশি
জিনিস-পত্রের দরদাম আকাশছোঁয়া,
দেশজুড়ে দারুণ আকাল ;
গনগনে আগুনের ছেঁকা লেগে পুড়ে যাচ্ছে সর্বাঙ্গ
শিরে সংক্লান্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নির্বিকার
বাজ-পোড়া অর্ধদগ্ধ সারি সারি তালগাছ-
আর অসহায় চোখে তাকিয়ে দেখছে এই অবেলায়
অবিবেকী ঐরাবতযূথ কেমন পাশব মদমত্তায়
স্পর্শকাতর শুঁড় দিয়ে গ্রাস করছে বিশ্বচরাচর,
সামান্য বেঁচে থাকার অধিকার এই নিয়ে ছিল যারা
তাদের তীব্র হাহাকার থেকে আজ ঝাঁক ঝাঁক আলপিন
হু হু করে ছুটে আসছে তোমাদের দিকে হে ঐরাবত,
সমস্ত আলপিন এবার মানুষ হয়ে যাবে
আলপিনের আকার ও আকৃতি নিয়ে প্রতিটি মানুষ
সোজাসুজি বিঁধে যেতে থাকবে তোমাদের নির্লজ্জ চর্মবক্ষে।
উপদ্রুত কাল
পুবের আকাশে দ্যাখো চেয়ে, দ্যাখো ঐ দূরের
লাল টকটকে অন্ধকার ভেঙে ঠিক যেন শ্রেণিবদ্ধ
সোপানের এক কোণে, একটি বিশেষ নক্ষত্রের
আকৃতিতে ফুটেছে রূপালি খইফুল সারারাত ;
কিংবাদন্তি নয়, এই দেশে সব কিছু জাম জারুলের
আম কাঁঠালের,
জামদানি দিন শেষ শালেকের ঠোঁটে-ঠোঁটে
ভেসে যায় মরুজ্যোৎস্না, রৌদ্রঘ্রাণ, সারাদেশে ;
শশকের লঘু মুগ্ধতা কি চক্ষুষ্মান ধাঁধা ?
এইভাবে শব্দহীন বিস্ময়ের দিকে ধাবমান
আপন স্বভাবে স্থিত কথকতা, রূপান্তরে মেধাবী উজ্জ্বল,
এই দেশে মরা কোটালের শেষে অন্তর্বর্তী ফেনরেখা
ধীরে ধীরে মুছে যায় তটিনী তরঙ্গে চুলচেরা।
পলিমাটি বুক জমে গাঢ় দাগ ; অস্তগামী রজনীর
বিহ্বল মৃত্তিকা শুধু বেদনারহিত স্মৃতির অতিরঞ্জন।
নিষ্ফল রচনা, ফলবতী শ্রমে উপদ্রুত কাল-
দিন যায় নিরবধি, গূঢ় ব্যঞ্জন্যয় তবু কথা বোনে কবি।
বিলুপ্ত প্রজাপতির ভ্রামণিক পায়রারা
শেষ কবে দেখা গিয়েছিল তা নিয়েও বিতর্কের শেষ নেই-
কেউ বলে বিগত শতকে কারও মতে তারও ঢের আগে
সমগ্র আকাশ থেকে রৌদ্র মুছে একদিন তারা ঝাঁকে ঝাঁকে,
নেমে আসত উদার উন্মুক্ত বিশাল প্রান্তরের দ্বীপপুঞ্জসমূহে;
পরিযায়ী পর্যটক হিসাবে যাদের নামডাক ছিল বিশ্বজোড়া
বসন্তে ভাসত তারা দক্ষিণের কনকনে প্রজননভূমিতে শৈত্যপ্রবাহে
নীড় বাঁধতে ডিম পাড়তে ছানাপোনাসহ সংসারধর্ম নির্বাহ করতে;
আজ মনে হয় আর বোধহয় বেঁচেবর্তে নেই তাদের কেউই-
গ্রীষ্মশেষে তো ওদের আবার চলে যেতে হতো দক্ষিণমুখী নবতর
শীতের সন্ধানে
পক্ষীবিশারদ এক দেখেছিল তাদের দ্রুতগতিতে উড়াল;
প্রায় এক মাইল প্রশস্ত দু’শো চল্লিশ মাইল দীর্ঘ
হাতের আন্দাজে গুণে মানে হয়েছিল তার
দুই কোটি দু’শো ত্রিশ লক্ষ দু’শো বাহাত্তর হাজারের বেশি বই কম নয়,
খাদ্যাখাদ্যে ছিল না তাদের তেমন কোনও অরুচি
বুনোফল ধান চাল গম শস্যদানা
তবে অপচয় কি জিনিস জানত না তারা।
আর এক পাখিপ্রেমী চাক্ষুষ করেছিল তাদের
বিগত শতাব্দের হেমন্ত ব্রহ্মপুত্র নদীর নির্জন অববাহিকায়
তার মতে ঐ অভিযাত্রিক পায়রারা ততটাই আকাশজুড়ে ডানা মেলে দিত যে
তার মনে হয়েছিল দিবালোকে মরে গিয়ে গ্রহণ নেমেছে বুঝি চরাচরে!
নিঃসৃত পাখির বিষ্ঠাকে মনে হচ্ছিল অঝোর শিলাবৃষ্টি
আলটপকা বাজপাখিদের সঙ্গে সংঘর্ষ বেধে
পরিব্রাজ্য পায়রারা যখন এককাট্টা হয়ে গিয়েছিল
তখন তাদের ডানার শব্দকে মনে হচ্ছিল বুঝি বা সুতীব্র বজ্রনাদ;
-এরপর এক সময় সমস্ত ঝাঁকটাই
একটা অতিকায় সাপের মতন এঁকেবেঁকে
চোখের সামনে ক্রমশ মিলেয়ে গেল দিকচক্রবালে
-বিলুপ্তির পথে যাওয়ার আগে
এইভাবে না কি শেষ দেখা দিয়েছিল তারা, ভ্রমাণিক পায়রারা।
সচিত্রকরণ : মোস্তাফিজ কারিগর