আর্কাইভভ্রমণ গদ্য

ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলভ্রমণ

শাহাব আহমেদ

অরল্যান্ডো এয়ারপোর্ট থেকে উড়ে আসি ভিয়েনায়। অনিন্দ্য, আমি, শ্বেতা। যাব বেইজিং।

চীনে সাকুল্যে চারদিন কাটিয়ে ট্রান্সসাইবেরিয়ান রেল ভ্রমণ শুরু হবে। মঙ্গোলিয়া হয়ে সাইবেরিয়া দিয়ে রাশিয়ায় ঢুকব, তারপরে বিভিন্ন শহর দেখতে দেখতে যাব মস্কো। চৌদ্দ দিনের জার্নি। ক্যালিফোর্নিয়া থেকে আসবে ডা. প্রদীপ চৌধুরী তার পরিবার নিয়ে। জারেনগোল্ড নামে একটি জার্মান কোম্পানির ট্রেন। টিকিট কাটা হয়েছে তাদেরই এক ট্যুর কোম্পানির মাধ্যমে। ৪ জনের কামরা বা কুপে, সামান্য কিছু বেশি ফি নিয়ে ওরা পুরো কুপেটি আমাদের জন্য বরাদ্দ করে দেয়।

আমার রাশিয়ান পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে বহু বছর আগে। ১৯৯৬ সালে রাশিয়া ছেড়ে আসার পরে আর যাওয়া হয়নি, না-আমার, না-শ্বেতার। ট্যুর কোম্পানিই ভিসার বন্দোবস্ত করেছে।

২০১৩ সাল।

বড় দীর্ঘ সময়। মনটা আনচান করে লেনিনগ্রাদ বা মস্কোর অতি প্রিয় স্থানগুলো দেখার জন্য।

৮ ঘণ্টার লে ওভার ভিয়েনায়। ঘণ্টা পাঁচেক সময় হাতে নিয়ে বের হয়ে পড়ি ভিয়েনা শহর দেখার জন্য। অসম্ভব গরম দিনটি। শহরের ডাউনটাউন ঘুরে দেখি। পরিপাটি সুন্দর শহর। একটি গির্জা দৃষ্টি আকর্ষণ করে, রাশিয়ান অর্থোডক্স গির্জার মতো নয়, অন্য ডিজাইনের। এর সৌন্দর্য সত্যিই মনোহরণ করে। আরও কোথাও ঘুরেছিলাম, স্মৃতি ধূসর হয়েছে। প্লেন ছাড়ে সময়মতো। নিদ্রাহীন দীর্ঘ উড়াল শেষে নামি বেইজিং এয়ারপোর্টে। জুলাইয়ের ২৮ তারিখ, ট্যুর কোম্পানির লোক অপেক্ষা করেছিল। নিয়ে যাওয়া হয় সদ্য নির্মিত এক ঝকঝকে হোটেলে।

সামান্য কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ হয়। অপরাহ্নেই ট্যুর শুরু হয়। আমাদের চাইনিজ গাইড লিকলিকে লম্বা ট্র্যাসির ইংরেজির প্রাঞ্জলতা তার রূপের মতোই, মন্দ বললে কম বলা হয়, ভালো বললে বেশি হয়ে যায়। তবে চীনের ইতিহাস পরিবেশনে তার আগ্রহের ঘাটতি নেই। বিশাল তিয়ানমেন স্কোয়ার হচ্ছে এদের মিং এবং কিং ডাইনাস্টির রাজপ্রাসাদে ঢোকার মূল ফটক, যার টাওয়ার থেকে সম্রাটেরা জনগণের সামনে দেখা দিতেন। মস্কোর রেড স্কোয়ারের মতোই চীনের তিয়ানমেন স্কোয়ার বড় বড় রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান, কুচকাওয়াজ, শক্তি প্রদর্শন ইত্যাদির প্রাণকেন্দ্র। ১৯৮৯ সালে সারা বিশ্ব এখানেই দেখেছিল বিক্ষুব্ধ জনতার প্রতিবাদ, ট্যাংকের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ান একজন ছোট (?) মানুষ ও হিংস্র হত্যাযজ্ঞ।

এখানেই আছে মাও সে তুং মুসোলিয়াম, স্কোয়ারের অন্য প্রান্তে। ট্র্যাসি আমাদের সেখানে নিয়ে যায়নি যদিও তর্জনি তুলে দেখিয়েছে।

‘ওই, ওটা চেয়ারম্যান মাওয়ের সমাধি মন্দির।’

কেউ সেখানে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেনি।

‘মাও সে তুং কে তোমরা এখন কীভাবে মূল্যায়ন করো ?’―প্রশ্ন করি।

‘উনি কিছু ভালো কাজ করেছেন, কিছু মন্দ কাজও করেছেন।’

মনে পড়ল চেরনেনকার আমলে আমাদের ইতিহাস পড়াতেন যে বৃদ্ধ শিক্ষক, তাকে একই প্রশ্ন করেছিলাম স্তালিন সম্পর্কে। তিনিও নিরস গলায় বলেছিলেন, ‘উনি কিছু ভালো কাজ করেছেন, কিছু মন্দ কাজও করেছেন।’ লোকে বলে পৃথিবী বদলায়, আসলেই বদলায় কি ?

লৌহমানবেরা মরে ধুলো হয়, অন্যেরা এসে মাস্তুল ধরে।

স্কোয়ার থেকে যাই চীনের নিষিদ্ধ নগরীতে। নিষিদ্ধ পল্লী নয়, সম্রাটদের প্রাসাদ কমপ্লেক্স। সারি সারি প্রাসাদ রয়েছে এই ৭৫০ মিটার, ৯৬০ মিটার বা ৭২০,০০০ বর্গমিটারের শ্বাস নিস্তব্ধকারী নগরীতে। এখান থেকেই তারা শাসন করতেন বিশাল দেশ।

জনসাধারণের মাথা কোটা ছাড়া সেখানে করার কিছু ছিল না বলেই তাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল।

পরের দিন ২৯ তারিখে আমরা যাই টেম্পল অব হেভেন দেখতে। অসামান্য এই বৌদ্ধ মন্দিরটি ১৪২০ সালে তৈরি, তিন স্তরের তিনটি বৃত্তের কেন্দ্রে দাঁড়ানো একটি বৃত্তাকার লাল বিল্ডিং, তার ওপরে তিন স্তরের তিনটি ঘননীল চাল যা ওপরে উঠে গেছে কোণের আকারে। স্বর্গের কাছে বৃষ্টি ও শস্য চেয়ে সম্রাটেরা পূজা-অর্চনা করতেন এখানে এসে।

এখান থেকে বাস ছাড়ে মিং ডাইনাস্টির সম্রাটদের অন্তিম শয়নপুরী ‘শি সেন লিং’ এর পথে। ড্রাগন ও টাইগার মাউন্টেনের পাদদেশে ৪০ কিলোমিটার জায়গাজুড়ে ১৩ জন সম্রাটের শেষ শয়নঘর। যেকোনও সমাধিক্ষেত্রের মতোই শান্তিপূর্ণ। সবুজ পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে, উপত্যকায় বা পাদদেশে, কখনও বা পাহাড়ের ওপরে যারা সেখানে শুয়ে আছেন, বেঁচে থাকতে এরা সবাই রক্তারক্তির খেলায় একে অন্যের সাথে প্রতিযোগিতা করেছেন। তাদেরও ক্ষমতার দম্ভ ছিল বর্তমানের ‘মেডিয়া পকেটে’, ‘সামরিকশিল্প মাথায়’, ‘গির্জা কাঁধে’ ও ‘অথৈ বিত্তাধিকারীদের পায়ে’ বসা রক্তাক্ত হাতের যুদ্ধবাজ প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রীদের মতোই। কিন্তু এখানে তারা মৃত্যুর অবয়ব দেখে স্তব্ধ হয়ে মুখবিবরে হাড়ের কুলুপ নিয়ে ঘুমিয়ে আছেন।

কোথায় তাদের রাজ্যপাট, কোথায় নিপীড়িত প্রতারিত প্রজাগণ ?  তাদের কিন্তু মৃত্যু হয় না।

তবে এই মহাজনদের কাছে পৌঁছাবার পথটি ভীষণ সুন্দর, ভাষায় বর্ণনার অতীত ও অনন্য। প্রশস্ত রাস্তা, দুইপাশে সবুজ গাছপালা, সামনে সারি সারি শক্তিশালী প্রাণী, কেউ মাথানত করে আছে, কেউ নতজানু, কারও মুখে বিষণ্নতা ও কান্নার অভিব্যক্তি! ক্ষমতার মানুষ মারা গেলে পশুপাখি অবশ্যই কাঁদে।

শেষদিনটি কাটে চীনের বৃহৎ দেয়ালের দৃশ্য দেখে। হোটেল থেকে বেশ দূরে। দুর্গম পাহাড়ের ওপর দিয়ে তৈরি সুদীর্ঘ এই দেয়াল সত্যিই বিস্ময়কর এবং হাজার হাজার বছর ধরে তা চীনকে রক্ষা করেছে বাইরের আক্রমণ থেকে। তবে চীনের দেয়ালের ভিত্তি তৈরি হয়েছিল বহু হাজার মানুষের হাড় ও কঙ্কাল দিয়ে, দেয়াল দেখে বিস্ময়ে বিহ্বলিত পরিব্রাজক ওই হতভাগ্যদের কথা প্রায়ই ভুলে যায়। সব স্থাপত্যই মানুষের রক্ত দিয়ে পবিত্র কিন্তু কোনও স্থাপত্যেই তাদের স্মৃতিফলক নেই।

দৌড়ের ওপর হয়ত আরও কিছু দেখেছি যা প্রতিটি টুরিস্ট দেখে, প্রত্যেকেই মুগ্ধ হয় এবং তা নিয়ে অনেকেই লেখে। আমি আর লিখলাম না। তবে বেইজিং ভালো লেগেছে। পদ্মলোচন সমাজতন্ত্রের আমলে রাশিয়ায় দেখেছি সুন্দর সুন্দর প্রাচীন বিল্ডিং, উদ্যান, রাস্তাঘাট কিন্তু তারা ছিল সময়ের ভারে জীর্ণ ও ধূসর, ধারণা ছিল ও রকম কিছুই দেখব। না, ঝকঝকে শহর, পরিচ্ছন্ন, বহু চোখধাঁধানো আধুনিক বিল্ডিং, প্রশস্ত রাস্তাঘাট। তবে কোনও এক ন্যাড়া নাকি এককালে বেল তলায় গিয়েছিল এবং তার মাথায় ধুপ করে বেল পড়েছিল। কী ধরনের বেল, পাকা না কাঁচা, ছোট না বড়, সে কথা যৌবনে জানলেও এখন আর মনে নেই। আমি-ন্যাড়াকে গাইড যতটুকু দেখিয়েছে, ততটুকুই দেখেছি, তার বাইরের বেইজিং দেখিনি, মানুষজনের সাথে কথা বলিনি, তারা কোথায় থাকে, কোথায় খায়, কোথায় পায়খানা করে এবং দিনে কয়বার শ্বাস নেয়, কয়বার বন্ধ করে থাকে, সে সম্পর্কে আমার জ্ঞান সীমিত নয়, একেবারেই নেই। দৃষ্টির আড়ালে যা রয়ে গেছে, তার সৌন্দর্য বা কদর্যতা নিয়ে কিছু বলতে অপারগ। তবে চাইনিজ ফুড বাংলাদেশে যতটা সুস্বাদু চীনে ততটা নয়। ধারণা করি, আমাদেরটাই আসল চাইনিজ, ওদেরটা নয়।

আমাদের বিদায়ের দিন একটি ঘটনা ঘটেছিল। বেইজিং থেকেই ট্রান্সসাইবেরিয়ান ট্রেনে ওঠার কথা। কিন্তু বড় কোনও কর্মকর্তা, বা আকাশচুম্বী কোনও নেতার আসার কথা ছিল রেলস্টেশনে। তাই সেখান থেকে ট্রেন ধরা যাবে না, যেতে হবে অন্যত্র। জুলাইয়ের ৩০ তারিখে আমাদের নিয়ে বাস ছোটে মরুভূমির ওপর দিয়ে। রাস্তার দুই পাশে বিস্তীর্ণ ফাঁকা, মাঝে মাঝে শহর। একই সাইজের, একই ডিজাইনের অসংখ্য দালান ৫ বা ৬ তলা, শত শত, হাজারও হতে পারে। এগুলো ছিল আগে তৈরি। মজার ব্যপার হলো একদিকে তারা এই দালানগুলো ভেঙে ফেলছে এবং পাশেই তৈরি করছে আকাশচুম্বী মডার্ন বিল্ডিং। স্থাপত্য সৌন্দর্যে দৃষ্টিনন্দন। প্রশস্ত রাস্তা, দোকান-পাট, স্কুল, পার্ক, খেলার মাঠ, হাসপাতাল, কিন্ডারগার্টেন মানুষের যা যা প্রয়োজন, সবই আছে। বিশাল শহর ইতোমধ্যেই দাঁড়িয়ে গেছে। কাজ চলছে সমান্তরালে, ভাঙাগড়ার মহাকালের ডিজাইন অনুসরণ করে। খুব ভালো লাগল। পরিকল্পিত অর্থনীতির বহু অথর্বতার পাশাপাশি কিছু ভালো দিক যে আছে এ তার দৃষ্টান্ত। 

আমরা ডাটোং নামে এক প্রাচীন শহরে পৌঁছাই যা মূল ভ্রমণ তালিকায় ছিল না। কিন্তু এ ছিল এক অসামান্য উপরি পাওনা। ডাটং পাহাড়ি শহর। ঐতিহাসিক কিছু স্থান ঘুরে দেখান হয়। পাহাড়ের আকাশচুম্বী খাড়া শৈলদেয়ালে ঝুলে আছে খোলা বারান্দাসহ প্রাচীন বৌদ্ধমন্দির। যেন বিরাটাকৃতির পাখির বাসা। মাটি থেকে এত উঁচুতে যে, খুব ছোট মনে হয়। কীভাবে ওরা তা বানিয়েছে আল্লা মালুম। দড়ি দিয়ে ঝুলন্ত মই বেয়ে ওঠে। ঈশ্বরে পৌঁছার পথ সহজ নয়।

ঈশ্বর কি সেখানে আছে ? কমিউনিস্টরা জানে, নেই।

নিবেদিত ভিক্ষুরাও জানে, নেই।

তবে কেন এই কষ্ট করা ? নিবেদন ও নিরত্যয় আত্মসাধনা। তারা সংসারের উপকারে নেই, অপকারেও নেই। শরীর ও মন নিয়ে নির্বাণে সমর্পিত। পাপের এই পৃথিবীতে তাহলে আসার কী প্রয়োজন ?

 স্বেচ্ছায় আসিনি তো―হয়ত কেউ বলবে ওমর খৈয়ামের ভাষায়। অথবা হিন্দু পুরানের মহাসুন্দরী তিলোত্তমা বলবে, সে এসেছে দেবতাদের অবধ্য দানব সুন্দ উপসুন্দ দুই ভাইকে প্রলুব্ধ করার জন্য, যাতে তাকে পাবার জন্য তারা একে অন্যকে হত্যা করে দেবতাদের সংসার কণ্টকমুক্ত করে।

অন্যেরা বলবে, এসেছি ঈশ্বরের উপাসনা করার জন্য। খাচ্ছি দাচ্ছি ঘুমাচ্ছি অর্থ উপার্জন করছি আর মসজিদ মন্দির গির্জা বানাচ্ছি বিপ্লব করার জন্য―এমন কথা বলার মানুষও কম নয়। যৌবনে আমিও একজন ছিলাম। এখন চুল পড়ে গেছে, দাঁত পড়ি পড়ি, ভালোবাসা স্তিমিত, অনঙ্গ স্পর্শনের অনিন্দিতাকে এখন প্রেমিকা নয়, বোন মনে হয়। তা সত্ত্বেও বলি―ভালোবাসার জন্য এসেছি এই পৃথিবীতে, ভালোবাসা দেয়ার ও নেয়ার জন্য।

পাহাড়ের যোনির গহ্বরে অনন্ত অন্ধকার হাল্কা করেছে টিমটিমে আলো। সেখানে কোনও গুহায় পাহাড়ে পিঠ রেখে বিশাল বুদ্ধ দাঁড়িয়ে আছেন, লম্বায় হয়তো পঁচিশ বা পঞ্চাশজন আমার সমান। পাহাড় কেটে কেটে বানানো হয়েছে বিস্ময়ের ভাস্কর্য! অন্য গুহায় ধ্যানে বসেছেন অমিতাভ বুদ্ধ।

অসংখ্য গুহা, অসংখ্য বুদ্ধ, ছোটবড় মাঝারি। প্রাচীনকালে নিশ্চয়ই মানব সভ্যতার বাইরে ছিল এই শহর। এবং সংসার বিবাগী ভিক্ষুরা জীবনভর অমিতাভ বুদ্ধে নিমজ্জিত থেকেছেন।

এখানে এসে অনুভব করা যায় মরুভূমি-উদগত ধর্মের সাথে ভারতবর্ষের ধর্মের পার্থক্য। অসি নয়, শান্তি, অধ্যাবসায়, ঈশ্বরে অবগাহন, সৌন্দর্যময় সৃষ্টির সাধনা। মরুভূমিতে কোনও গান নেই, নাচ নেই, সুর নেই, ভাস্কর্য নেই, ছবি আঁকা নেই―আছে শুধু মরুভূমি, ক্যাকটাস, নিধনের সাইমুম আর সত্যের অসুন্দর অবয়ব।

সত্যের দিকে তাকালে মন খারাপ হয়।

এখানে রাত কাটে অত্যাধুনিক এক হোটেলে। বহু দেশ ঘুরেছি। চীনের হোটেলগুলো নতুন, মডার্ন জিনিসে ঠাসা। সত্যিই তুলনাহীন। ডাটোং থেকে বাসে চড়ি। গোবি মরুভূমির ওপর দিয়ে ৬ ঘন্টার পথ। গোবি আরব মরুভূমির মত নয়, বালু আর বালু নয় বরং বিস্তীর্ণ প্রান্তর, ছোট ছোট গুল্মে ঢাকা। তবে উষর। বিশাল এক ডাইনোসরের মনুমেন্ট কিছুটা হলেও একঘেয়েমির বৈচিত্র এনেছে।

সীমান্ত শহর এরলেইন পৌঁছাই। পরিখা অতিক্রম করে ট্রেনের কাছেই দেখি ছোটখাটো এক স্ট্রিট কনসার্ট চলছে মঙ্গোলিয়ান আর্টিস্টদের। আমাদের বিয়ার দেওয়া হয় কিন্তু সাথে সাথে হুশিয়ারি করে দেওয়া হয় যে এখন তা খোলা যাবে না। মঙ্গোলিয়ায় জনসমক্ষে এলকোহল পান নিষেধ। প্রতি মাসের প্রথম দিনটিও পবিত্র শুকনো দিন, এলকোহলে গলা ভেজানো নিষেধ।

ট্রেনে অসংখ্য খাদ্য ও পানীয়ের ডিনার শেষ হবার আগেই সন্ধ্যা উৎরে যায়। খাদ্য পরিবেশকরা বন্ধুত্বপরায়ণ, পরিবেশিকারা সুন্দর এবং পরিবেশন করে ধন্য। এই অভিজ্ঞতা আমাদের আগে কখনও হয়নি। সার্ভিসে সোভিয়েত নাগরিকরা সব সময়ই ছিল অনেক পেছনে, ‘আমরা সবাই সমান, আমি তোমাকে সার্ভ করব কেন, তুমি কোন গস্পাদিন ? ‘অনেকটা এই মনোভাবের। রাশিয়ায় কতটুকু পরিবর্তন হয়েছে তা দেখতে পাব কয়েকদিনের মধ্যেই।

ট্রেন ছাড়ে।

বহুদিন পরে ট্রেন চড়ছি। অতি পরিচিত সোভিয়েত ট্রেন। প্রতি বগিতে অনেকগুলো কামরা। দুটো বার্থ নীচে, দুটো উপরে। গোসলখানা, টাট্টি ওয়াগনের শেষে। প্রথম শ্রেণির যারা তাদের অবশ্য স্ব স্ব কামরায়। ক্লান্তি জমেছিল বেশ। ট্রেনের দুলুনি, চাকার ঝিক-ঝাক অল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের তন্দ্রায় তন্ময় করে দেয়।

সকালে মঙ্গোলিয়ার রাজধানি উলানবাটোর পৌঁছাই। চিঙ্গিজ খানের দেশ, দরিদ্র ও দীন।  বাজ পাখির পাহাড়ায় শস্যহীন বিস্তীর্ণ ফাকা মাঠ। চীনের ঝকঝক তকতকে ভাবটা নেই। পুরনো মলিন চোখ বোজা ক্লান্ত নগরী।

রাশিয়ায় বিপ্লবের পরে পরাজিত শ্বেত বাহিনী মঙ্গোলিয়ায় এসে ক্ষমতা দখল করে, চীনের সৈন্যরাও দখল করে নেয় অনেকাংশ। লালবাহিনীর সহযোগিতা নিয়ে মঙ্গোলিয়ার বিপ্লবীরা ১৯২১ সালে এদের তাড়িয়ে একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ গঠন করার ঘোষণা দেয়। দেশটি চলে স্ট্যালিনের কঠোর নির্দেশে। কোনও পার্টি-নেতা বা রাষ্ট্রনেতা তার অবাধ্য হলে তাকে মস্কোতে ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়। রাশিয়ায় যে নিপীড়ন হয় ১৯২০, ৩০, ৪০, ৫০ দশকে, মঙ্গোলিয়া তার চামড়ায় সবটাই টের পায়। হাজার হাজার বৌদ্ধ মন্দির মাটিতে মিশিয়ে দেয়া হয়, হত্যা করা হয় অগনিত বৌদ্ধভিক্ষু ও ধর্মগুরুকে। পার্টির মধ্যে চলে শুদ্ধিকরণ ও হত্যাযজ্ঞ। পৃথিবীর ২য় সমাজতান্ত্রিক দেশ হবার সম্মান, রক্ত ও অশ্রুর নদী পার হয়ে অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর মতই নব্বইয়ের দশকে তারা উল্টা পথে হাঁটা ধরে। কিন্তু খুব যে ভালো করছে, মনে হচ্ছে না।

মনে হয়, মঙ্গোলিয়া স্বয়ং ঈশ্বরের দৃষ্টির বাইরের দেশ।

বাসে শহর ঘুরে দেখেছি কিন্তু মনে রাখার মতো কিছু দেখিনি। তবে প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দিরগুলো সুন্দর এবং ইতিহাসে সমৃদ্ধ। সময় কাটাবার মত বহুকিছু আছে সেখানে। বড় বড় বুদ্ধ মূর্তি সব মন্দিরেই। তাদের সামনে মাথা নত হয়ে আসে আপনা আপনি। আমাদের দেশে ভুলে যাওয়া  ধর্মপাল ওই মন্দিরগুলোতে খুবই শ্রদ্ধেয় ও সম্মানিত। অতীশ দীপঙ্করের নামটি হয়ত ছিল, চোখে পড়েনি।

ওদের অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় একটি নাম, ‘জানাবাজার।’ এক মহান সন্তান, যার কথা আমি জানতাম না। ১৬৩৫-১৭২৪ সাল তার জীবৎকাল। দীর্ঘদিন বেঁচেছেন, কিন্তু বৃথা নয়। তিব্বতের মহান বৌদ্ধপণ্ডিত তারানাথ গৌতম বুদ্ধের শিক্ষা নিয়ে গিয়েছিলেন মঙ্গোলিয়ায়, বহু বৌদ্ধমন্দির তৈরি করেন তিনি। তারপরে ১৬৩৪ সালে দেহত্যাগ করেন। একবছর পরে তিনিই পূনর্জন্ম নিয়ে আসেন চেঙ্গিজ খানের বংশধর তুষিত খানের ঘরে। ৪ বছর বয়সেই মঙ্গোলদের সবচাইতে বড় গোত্র ‘খালখা’র অভিজাতেরা তাকে ধর্মগুরু হিসাবে মেনে নেয়। ৫ম দালাইলামা স্বীকার করেন যে, ‘জানাবাজার’ তারানাথেরই নতুন অবতার। পরবর্তীকালে তার জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় মুগ্ধ হয়ে সংস্কৃত ভাষায় উপাধি দেন ‘জানার (জ্ঞানের) বজ্র’। সেই থেকে মঙ্গোলিয়ান নাম ‘জানাবাজার’। একদিকে বৌদ্ধ সন্ত, অন্যদিকে পেইন্টার, ভাস্কর ও বিজ্ঞানী, প্রাচ্যের মাইকেলেঞ্জেলো। মঙ্গোলিয়ায় গোত্রযুদ্ধে তার খালখা গোত্র যখন নিপীড়নের শিকার হয়, জানাবাজার চীনের কিং ডাইনাস্টির তৃতীয় সম্রাটের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন এবং মঙ্গোলিয়াকে চীনের শাসনাধীনে আনতে সাহায্য করেন। তাতে বহুমানুষের প্রাণ বাঁচে বটে কিন্তু ‘বিশ্বাসঘাতক’ আখ্যায় ভূষিত হন মঙ্গোলিয়ার কমিউনিস্ট শাসনামলে। তার সমাধি মন্দির তছনছ করা হয় ১৯৩৭ সালে। এখন তিনি ফিরে এসেছেন স্বমর্যাদায়।

কনকনে শীতের একটিদিন কাটে চারদিকে পাহাড়ঘেরা সবুজ উপত্যকায় মঙ্গোলিয়ান গ্রাম ও ট্র্যাডিশনাল তাবু (ইউর্তা) দেখে। নির্দিষ্ট ফি দিয়ে কেউ কেউ রাত্রিযাপনে থেকে যায়। আবহমান কাল ধরেই তাঁবু এদের নোমাডিক জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। পশুপালন ছিল এদের মূল পেশা, ঘাসের সন্ধানে পশু নিয়ে একস্থান থেকে অন্যস্থানে যেতে হতো, তাই স্থায়ী বাসস্থানের তুলনায় তাবু ছিল তাদের জন্য বেশি উপযোগী।

গ্রামটিতে লোকজনের চেয়ে টুরিস্টই বেশি। গবাদি পশু কিছু আছে তবে অনেক নয়। গ্রামেই সম্পন্ন হয় ভেড়ার মাংসের ভুড়িভোজন। অনিন্দ্য তির চালান শিখেছিল স্কুলে থাকতে, এখানে সে তার দক্ষতা দেখানোর সুযোগ পায়।

চিঙ্গিজ খানের জন্ম হয়েছিল আশেপাশেই কোনও গ্রামে। সামনের ইউর্তাটির দিকে তাকিয়ে অতীতে চলে যাই। কালো মিচমিচে রাত, আকাশে জ্বল জ্বল করছে লক্ষ কোটি নক্ষত্র, বিস্তীর্ণ স্তেপে ছুটন্ত বাঁধনহীন অশ্বের মত হাওয়া অস্থিতিশীল অস্থির করে দিচ্ছে মশালের শিখাটিকে মাঝে মাঝেই। গ্রীষ্মের রাত তবু কিছুটা শীত শীত ভাব। তাঁবুর ভেতরে চিন্তামগ্ন বসে আছে তিমুজিন, বেয়ারা রেখে গেছে সদ্য প্রস্তুত কুমিস, কিন্তু তার মুখে কী এক তিক্ততা, মনে অস্থিরতা এক! সে মশালের শিখার অনিয়মিত কম্পনের দিকে তাকিয়ে আছে।

চোখে ভেসে ওঠে শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের দিনগুলোর কথা। তার বয়েস মাত্র ৯, পিতা বিয়ের আয়োজন করেছে খনগিরাড গোত্রের বের্তে নামে এক মেয়ের সঙ্গে। ট্র্যাডিশন মাফিক তাকে ১২ বছরের বিয়ের বয়েস হওয়া পর্যন্ত সেই বাড়ির কর্তা ডাই সেটসেনের চাকুরি করার কথা। গোত্রপ্রধান পিতা তাকে পৌঁছে দিয়ে ফেরার পথে পার্শ্ববর্তী তাতারদের হাতে নিহত হয়। তিমুজিন বাড়ি ফিরে আসে পিতার গোত্রপ্রধানের স্থান দাবি করার জন্য কিন্তু তার গোত্র নাবালক তিমুজিনকে নেতা মানতে অস্বীকার করে।

কঠিন ছিল সেই দিনগুলো। তার মা ছোট ছোট শিশুদের নিয়ে গোত্রের কৃপা বঞ্চিত হয়ে কঠোর দারিদ্র্যের মধ্য দিনাতিপাত করে। কখনও বুনো ফল বা বেরি সংগ্রহ করে পেট চলে। কখনও পাখি শিকার করতে পারলে তাই খেয়ে অর্ধাহার, অনাহারে জীবন কাটে। এভাবেই বড় হতে থাকে ধীরে ধীরে। পিতার বড় ছেলে বেগটার ছিল তিমুজিনের সৎভাই, সে ক্ষমতা দেখাতে শুরু করে। ট্র্যাডিশন অনুযায়ী যৌবনপ্রাপ্ত হয়ে তার সৎমা হেলানকে বিয়ে করার কথা। তিমুজিন মায়ের এই অবমাননা কোনও মতেই মেনে নিতে পারে না। একদিন তার অন্য ভাই খাজারকে নিয়ে শিকারে গিয়ে হত্যা করে বেগটারকে।

কিছুদিন পরে পার্শ্ববর্তী গোত্রের হাতে বন্দি হয় তিমুজিন কিন্তু এক রক্ষীর সহায়তায় পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়। ফলে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। গোত্রগুলো একে অন্যের সঙ্গে যুদ্ধ, বিশ্বাসঘাতকতা, লুটপাট নিয়ে ব্যস্ত ছিল, ঐক্যবদ্ধ হবার কোনও ইচ্ছা ও প্রচেষ্টা তাদের মধ্যে ছিল না। মা হেলান তিমুজিনকে তার প্রজ্ঞায় সমৃদ্ধ করেন, ধীরে ধীরে বোঝান যে সময় এসেছে গোত্রগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার। এই আত্মবিধ্বংসী হানাহানির শেষ হওয়া প্রয়োজন। ১৬ বছর বয়সে সে বের্তেকে বিয়ে করে তাদের দুই গোত্রের মধ্যে সম্পর্ক সিমেন্ট করে। বের্তের রূপমুগ্ধ হয় সে। এক অদ্ভুত কোমল অনুভূতির জন্ম হয় তার মধ্যে। কী যেন এক পরিপূর্ণতা নিয়ে আসে বের্তে তিমুজিনের জীবনে। কিন্তু এই সুখ দীর্ঘস্থায়ী হবার সুযোগ পায় না।  মেরকিট গোত্রের দস্যুরা অপহরণ করে নিয়ে যায় বের্তেকে। তাদেরই একজনের ভোগের সামগ্রী হয় বের্তে। বেপরোয়া হয়ে পড়ে তিমুজিন। খাঁচাবদ্ধ সিংহের মতো ক্রোধে হিংস্র হয়ে ওঠে।

চিন্তায় ছেদ পড়ে তার, সহকারী এসে কুর্নিশ করে জানায় বন্দিকে আনা হয়েছে, অপেক্ষা করছে তাঁবুর বাইরে কড়া প্রহরায়। নির্দেশ দেয়া হয় তাকে ভেতরে নিয়ে আসার। হাত পা বাঁধা পিটান দেহের, ঋজু ও গর্বিত এই বন্দি। তাকে ক্লান্ত লাগছে, বসন ছিন্ন ও স্থানে স্থানে রক্তের দাগ, কিন্তু চোখে ঈগলের মত ক্ষিপ্রতার চিক চিকে আলো। তার দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, সে পরাজিত কিন্ত নত নয়।

উঠে দাঁড়াল তিমুজিন, একতরফাভাবে আলিঙ্গন করল হাত বাঁধা, পায়ে শৃংখলিত বন্দিকে। প্রচণ্ড ক্ষমতাধর সে, বন্দিদের এভাবে গ্রহণ করা তার স্বভাবে নেই।

‘তুমি আমার অনেক মানুষ হত্যা করছ, তোমার যে সহচর বিশ্বাসঘাতকতা করে তোমাকে ধরিয়ে দিয়েছে, উপকার করা সত্ত্বেও আমি তার মৃত্যুদণ্ড দিয়েছি, কারণ আমি বিশ্বাসঘাতকদের ক্ষমা করি না। ’

তোমার বিদ্রোহ ও বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তিও মৃত্যুদণ্ড কিন্তু তুমি আমার বন্ধু, আমরা এক সঙ্গে বড় হয়েছি। এই স্তেপের প্রতিটি তৃণ, প্রতিটি বাজপাখি জানে আমাদের সখ্যের কথা। তুমি শত্রুর হাত থেকে বের্তেকে উদ্ধার করায় সাহায্য করেছ। আমরা একসঙ্গে শত্রু দমন করেছি, এখন আমরা এক সঙ্গেই জয় ও শাসন করব এই পৃথিবী। তুমি শত্রুতা ত্যাগ করে ফিরে আসো, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দেব, ভুলে যাব সমস্ত কিছু।’

‘এক আকাশে শুধু একটিই সূর্য শোভা পায় তিমুজিন, ভাগ্য তোমার প্রতি প্রসন্ন, আমার যোগ্যতা সাহস ও বুদ্ধি তোমার চেয়ে কম নয়, আমি দ্বিতীয়জন হয়ে তোমার অধীনে বাঁচতে চাই না। আমি তোমার বশ্যতা স্বীকার করব না। শুধু একটাই অনুরোধ, যদি বন্ধু হও আমাকে রক্তপাতহীনভাবে হত্যা করো।’

তার অনুরোধ রাখা হয়, ট্রাডিশন অনুযায়ী রক্তপাতহীনভাবে শিড়দাড়া মটকিয়ে তাকে হত্যা করা হয়। তিমুজিন একদিন চিঙ্গিজ খান নামে সারাপৃথিবীর পিলে কাঁপিয়ে দেয়। দুর্ধর্ষ ও হৃদয়হীন হলেও একটি কোমল হৃদয় ছিল বের্তের প্রতি। শত্রুর বন্দিশালা থেকে বের্তেকে যখন সে উদ্ধার করে আনে, সে ছিল সন্তান সম্ভবা। বের্তের সেই সন্তানকে তার প্রথম সন্তানের মর্যাদা দেয় এবং আজীবন বের্তে থাকে তার প্রধান মহিষী।

এক বিশাল মুর্তি হয়ে বসে আছে সে আমার সামনে চোখের, উলান বাটোরের প্রধান চত্বরে।

রাতে ট্রেন ছেড়ে যায় মঙ্গোলিয়ার রাজধানী থেকে। শেষরাতে রাশিয়ার বর্ডার অতিক্রম করে। তারপরে রেললাইন মিটার গেজ থেকে ব্রডগেজে পরিবর্তন করার সময় বেশ কিছু সময় ট্রেন থেমে থাকে। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সাইবেরিয়ার প্রথম শহর ‘উলান উদে’ পৌঁছাই। এটি বুরিয়াতিয়া রিপাবলিকের রাজধানি। বাইকাল হ্রদের ৬২ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে উদা এবং সেলেঙ্গা নদীর সঙ্গমস্থলে ৪ লক্ষ মানুষ নিয়ে পূর্ব সাইবেরিয়ার ৩য় বৃহত্তম ঘনবসতিপূর্ণ শহর। খামার দাবান ও খেরবেত উলান বুরগাসি পর্বতমালার পাদদেশে অবস্থিত। শহরটি ঘুরে দেখি আমরা আধা বেলা। মনে রাখার মত বিশেষ কিছু নেই। কয়েকটি গির্জা তাদের প্রাচীনত্ব নিয়ে।

ট্রেন ছাড়ে আবার। সাইবেরিয়ায় ঢোকার পর থেকেই আমাদের সমান্তরালে চলতে থাকে ঘোলা জলের বিশাল একটি নদী, নাম তার সেলেঙ্গা। কখনও আমাদের ট্রেনের ডানে, কখনও বামে, বিশ্বস্ত স্পুতনিকের মতো। জন্ম তার পশ্চিম মঙ্গোলিয়ায়, গন্তব্য বাইকাল হ্রদ। নদীর ঘোলাজল দেখলে আমার মন চনমন করে ওঠে, শৈশবের জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষে পদ্মার ঘোলা জলের কথা মনে পড়ে। এবং বুকের ভেতরটা ঘুলিয়ে যায়।

ট্রেন এসে থামলো বাইকাল হ্রদের তীরে, জল থেকে মাত্র কয়েক পা দূরে। ঘোষণা করা হল লেকের জল খুব ঠাণ্ডা, মাত্র ১২ ডিগ্রি, কিন্তু যারা সাহস করে হ্রদে স্নান করবে তাদের প্রতিবার জলে নামার জন্য ঢালা হবে এক শট করে স্তালিচনায়া ভদকা। ভদকা স্বচ্ছ ও পবিত্র জিনিস। সব পাপের স্খালন হয় ভদকায়। চরিত্রের পর্যন্ত।

পৃথিবীর সর্ববৃহৎ হ্রদ, বহু বছর রাশিয়ায় থেকে গেছি কিন্তু দেখা হয় নি। এখন কত দূর থেকে দেখতে এসেছি এবং তার জলে অবগাহন করতে। ভদকা তো ফাও। শর্ট পরে নেমে পড়ি। পেছনে যার পই পই করে না করার দায়িত্ব সে হৈ হৈ করে, ‘জলে নেমো না বলছি, ভীষণ ঠাণ্ডা, শরীর খারাপ করবে।’

তার কথা শেষ হবার আগেই বুম্। জলে ঝাঁপ। জল নয় যেন বরফের রস। তিড়িং করে ঝাঁপ, তিড়িং করে লাফ। ঠক ঠক কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে এলাম ট্রেনের যে যুবতী সুইমিং ড্রেস পরে বক্ষ প্রদর্শনীর মূল কাজের ফাঁকে ফাঁকে ভদকা সার্ভ করছে হাসি মুখে, তার কাছে। গলায় ভদকার ঝালের কামড়, না সাকির বুকের উষ্ণতার উৎপূর্ণতায়, গায়ে বেশ উত্তাপ অনুভব করলাম।

দেখি আমার ১১ বছরের ছেলে জলে ঝাঁপ দেবে কি দেবে না, সেই গবেষণা করছে তীরে দাঁড়িয়ে।

বলি, ‘বাপ, প্রায় তোর বয়সে, তোর মাকে দেখে আমি কিভাবে ঝাঁপ দিয়েছিলাম, দেখ্।’

আবার ঝাঁপ। কাজ হয়, নির্দোষ সারমেয় শাবক যেভাবে ঝাঁপ দেয় মনিবের পিছনে, অনেকটা সেভাবে লাফ দেয় ছেলেও।

অন্যেরা যেন জলে নয়, মন্দির ঢুকেছে, বড়ই সাবধানি ও পবিত্রতা সংরক্ষণে ব্যস্ত। আমরা দু’জনে জল ছিটিয়ে, হৈ হৈ করে প্রতিযোগিতা করে সাঁতার কাটি।

সাবাস বেটা, বাপকে প্রায় হারিয়ে দেয়নি।

তীরে একজন চিৎকার করছে, ‘অনিন্দ্য, অনিন্দ্য’, গলাটা চেনা।

কালিনিন জেলার ‘রেড মে’ গ্রামে বড় এক সরোবরে আমার গলা ধরে, পিঠে বুক রেখে, যুবতি এক রাঁজহাসের মতো সে বলেছিল, ‘ডলফিন, আমার ডলফিন।’ অনেকদিন আগে।

এই সেই গলা।

সময়, সময় বড় কঠিন। যুবতিকে মা, মাকে বৃদ্ধা, বৃদ্ধাকে মৃত করার কত না ভেল্কি তার মায়ার সিন্দুকে! জল থেকে উঠে আবার ভদকা-সুন্দরীর বুকের যুগল বনকপোতের কাছে ছুটি। আরও এক পেগ আবে জমজম হলকুম পবিত্র করে।

পেছনে অনিন্দ্য, হাত বাড়িয়ে বলে, ‘আমারটা কই ?’

‘ধুর ব্যাটা ভাগ, তোর বাপ জেলে যাবে, তোর মা জেলে যাবে, তোর আঠারো  গোষ্ঠী জেলে যাবে ১১ বছর বয়সে ভদকা খেলে!’

পিছনে ওর মা এসে দাঁড়িয়েছে তোয়ালে নিয়ে, ছেলেকে দেখিয়ে দেই।

প্রদীপ হাঁটু জলে নেমে জলদেবীর প্রণাম সেরে আর যেতে সাহস পাচ্ছে না। সুতরাং আবার নামতে হয়। বন্ধুকে বাইকালে স্নান করানো পবিত্র কাজ। স্বচ্ছ শীতল জল। আঁবরুয়া বসনের নারীর মত বাইকালের তলা দেখা যায়। জলের শান্ত, নিস্তরঙ্গ, আয়নার মত মসৃণ যে উপরিভাগ, যাকে রুশভাষায় বলা হয় ‘গ্লাদ’, মৃদু বাতাসে আন্দোলিত হয়ে জন্ম দিয়েছে ছোট ছোট ঢেউ-ছানার। তারা একে অন্যের পিছু ছুটছে। গাছেরা মুখ দেখছে জলে। নড়ছে তাদেরও মুখ। নির্মেঘ নিষ্ক হরিদ্রাভ দিন। আকাশের হাল্কা নীলে সৌপর্ণ সাদা সাদা মেঘ। মেঘ নয়, যেন অজস্র রাজহাঁসের সুষমা। রাজহাঁস সাইবেরিয়ার আদিবাসী বুরিয়াতদের পবিত্র পাখি। এবং কী করে সে পবিত্র হল সে এক অসামান্য গল্প।

একদিন এক শিকারী শিকার করতে গিয়ে দেখে তিনটি অপূর্ব সুন্দর রাজহাঁস উড়ে যাচ্ছে হ্রদের দিকে। সে তাদের অনুসরণ করতে করতে হ্রদে গিয়ে উপস্থিত হয়। কিন্তু তার বিস্ময়ের সীমা ছাড়িয়ে যায় যখন দেখে তিনটি রাজহাঁস তাদের পালক খুলে বদলে গেছে তিন অপূর্ব রূপসী নারীতে। রূপ দেখে তার চোখ ঝলসে যায়। মেয়েরা ছিল বুরিয়াতদের আদি পিতা ‘এসেজে মালান’-এর তিন কন্যা। অনাঘ্রাত নিরাবরণ তিন বোনের দেহ-বৈভবে আলোকিত হয়ে ওঠে জল, ওরা মেতে ওঠে সুখের কেলিতে, সাঁতরে চলে যায় তীর থেকে দূরে। তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর যার তনুলতা, সবচেয়ে অশিথিল ও দৃঢ় যার বুক, লম্বা যার গ্রীবা আর দিপ্র যার মুখ, শিকারী তার পালকগুলো নিয়ে যায় চুরি করে। জলকেলি শেষে তীরে ফিরে দুজন আবার রাজহাঁসে পরিণত হয় কিন্ত সবচেয়ে ছোট যে বোন সে তার পালক খুঁজে পায় না। আশেপাশেও কেউ নেই। এদিক সেদিক ছোটে, বুনো গুল্ম চষে ফেলে কিন্তু নেই নেই নেই, তাজ্জব ব্যাপার! এমন কখনই ঘটেনি। বোনেরা অপেক্ষা করে, সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে, পিতা রাগ করবে। তখন দুই বোন চলে যায় ফেলে যাওয়া ছোট বোনের জন্য চোখ মুছতে মুছতে। পরিত্যক্তা বোনের চোখ ভরে নেমে আসে অশ্রুর প্লাবন। অনম্বর ও শীতার্ত সে। ক্ষুধার্তও। পশ্চিমের আকাশে আবির মেখে সূর্য ডুবি ডুবি করছে। পাখিরা কোলাহল করে গৃহে ফিরছে সাথীদের নিয়ে। সে কোথায় যাবে, কী করবে কিচ্ছু জানে না। বাতাসে মৃদু মৃদু কাঁপছে হ্রদের বুক, তার বুকের মত। শিকারী ফিরে আসে পালক নিয়ে। যত্নহীন স্বাধীন ও কুমারী জীবন শেষ হয়ে যায়। দিন যায়, রাত্রি গড়ায়, বছরগুলো গলে যায় শৈলচূড়ার তুষারের মত। একে একে জন্ম হয় ছয়টি সন্তানের কিন্তু তার মন পড়ে থাকে শৈশব-স্মৃতির দেশে। বর্তমানের নখরে বন্দিনী সে। মেনে নিতে পারে না নৈমিত্তিকতার বাস্তবতা। অতীতের যত্নহীন, যন্ত্রণাহীন, স্বাধীন সোনালি দিনগুলো হ্যালুসিনেশনের মত তাড়া করে। অতীত যতটা সুন্দর নয়,তার চেয়েও বেশি সুন্দর মনে হয়। সুখ সেখানে আমরা যেখানে নেই। শৈশবের দেশ তাই সবচেয়ে সুন্দর দেশ।

সে ভাবে, ভাবে আর ভাবে। বিষণ্নতায় নীলকণ্ঠ নীল হয়ে থাকে। তারপরে একদিন তৈরি করে এক তীব্র পানীয়, স্বামী টাল হয়ে মেষে পরিণত হয়। নারী পালক ফেরত চায়। স্বামী সুবোধের মত বের করে দেয়।

পালক গায়ে তুলতেই সে আবার বদলে যায় এক অপূর্ব রাজহাঁসে, উড়াল দেয় অতীতের দিকে। কিন্তু অতীতের কোনও দিক-নির্দেশনা নেই। অতীত―যেখানে সমাহিত কৈশোর বা যৌবন, অতীত-যার হাতে ভবিষ্যতে তাকিয়ে দেখার উত্তল আয়না।

ছোট মেয়ে দেখে ফেলে মা উড়ে চলে যাচ্ছে কোথাও, সে কেঁদে কেঁদে ছুটে এসে ধরে ফেলে তার দুই পা। কচি হাত, ধূলি কাদায় অপরিচ্ছন্ন, তার হাতের ময়লা কালো করে দেয় মায়ের ধবল যুগল চরণ। সে থেকেই রাজহাঁস সাদা ধবধবে হওয়া সত্ত্বেও পাগুলো কালো ।

মেয়ে ধরে রাখতে পারে না মাকে, উড়ে চলে যায় সে। কিন্তু যেতে পারে কই, ফিরে ফিরে আসে, চক্কর দিতে থাকে মেয়ের মাথার ওপর, বলে ‘নতুন চাঁদের রাতে, ঘোটকীর দুধ আর চা রেখে দিও বাইরে, উঠোনে ছড়িয়ে দিও লাল তামাকের গুড়ো। আমি ফিরে আসব, আসব অবশ্যই।’ তারপরে সে উড়ে চলে যায়। ‘এসেজে মালানে’র এই কন্যাই হল ট্রান্স-বাইকাল এলাকার বুরিয়াতদের আদি মাতা এবং রাজহাঁস তাদের পবিত্র পাখি।

ট্রেনে ফিরে স্নান সেরে যোগ দিলাম বনভোজন পার্টিতে, বাইকাল হ্রদের তীরে উৎসব যেন। প্রাইভেট ট্রেনের সব যাত্রী ও সব কর্মচারী সেখানে। প্রচুর খাদ্য, প্রচুর পানীয়, খাও দাও ফুর্তি করো, নাচো, জীবন সংক্ষিপ্ত―কে যেন বলেছিল ? আমি আর প্রদীপ বের হয়ে পড়লাম হাঁটতে। দূরের পাহাড় থেকে বাইকালে মিলেছে ছোট একটি নদী। তার ওপর দিয়ে লোহার ব্রিজ, আমাদের রেল লাইনের সমান্তরালে। ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে লম্বা কুমিরের মত, তার ডানে বাইকাল, বামে ছোট নদী, বেশ নীচুতে। দুই বন্ধু হাঁটতে হাঁটতে নদীতীরে যাই। সুন্দর নির্জন সন্ধ্যা। পালক পেলব ফুরফুরে হাওয়া, দূরে পাহাড় আর বন। অজস্র অচেনা রঙ্গিন ফুল ঈশ্বরের বাগানে, অরক্ষিত ও মালিকানাহীন। কুড়িয়ে নিলাম কিছু, সুন্দর ঘ্রাণ। যে ছিল বগিতে অপেক্ষা করে, সে কী যে খুশি ফুলগুলো মেয়ে! রুশ নারীর এই এক গুণ, ফুল দিয়ে মন পাওয়া যায়।

ট্রেন ছেড়ে দিল সন্ধ্যার পর পর। এ ক’দিন এসি কাজ করেছে বেশ, কিন্তু আজ সারারাত ট্রেনের গরমে হাঁসফাঁস করে সকালে ( আগস্ট ৫,২০১৩ ) ইরকুতস্ক পৌঁছলাম।

বাস ঘুরিয়ে দেখালো ১৬৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত পরিচ্ছন্ন শহর, পূর্ব সাইবেরিয়ার রাজধানী। শহরের প্রতীক ‘দাউরিয়া’ নামের এক সাইবেরিয়ান বাঘ, মুখে যার একটি পশমি ছোট প্রাণি, স্যাবল।

রাশিয়ার পুরানো শহর মানেই সুন্দর গাম্ভীর্যপূর্ণ অর্থোডক্স চার্চ থাকবে। আমরা ‘চার্চ অফ আওয়ার সেইভিয়র’ ঘুরে দেখি। শহরের জনসংখ্যা প্রায় ৬ লাখ। আঙ্গারা ও ইরকুত নদীর মোহনায় যেখানে প্রথম ভিত্তি-প্রস্তর স্থাপন করা হয়, সেখানে একটি মনুমেন্ট দাঁড়িয়ে আছে সাইবেরিয়া দখলকারী কসাকদের স্মরণে।

বৃহৎ আঙ্গারা নদী বয়ে গেছে ইরকুতস্ক শহরের ওপর দিয়ে। অন্য একটি ছোট নদী ইরকুত, আঙ্গারায় পতিত, তার থেকে শহরের নাম। ছোট নদী ইদা বা উশাকোভ্কাও বয়ে গেছে এর ওপর দিয়েই।

১৮৭৯ সালের জুলাই মাসে আগুন লেগে ৪০০০ বাড়ি সহ প্রায় পুরো শহর ধ্বংস হয়ে যায় কিন্তু দ্রুত পুনর্গঠন করা হয়। প্রিন্স নিকোলাই ১৮৯১ সালে সাইবেরিয়া ভ্রমণ করেন এবং ইরকুতস্ক শহরে আঙ্গারা নদীর দুই তীর সংযোগকারী প্রথম ব্রিজের উদ্বোধন করেন। একটি বিশাল ও সুন্দর মনুমেন্ট হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। গাইড বলে, তিনি নাকি স্বপ্ন দেখতেন সাইবেরিয়া থেকে আলাস্কা হয়ে আমেরিকা পর্যন্ত রেললাইন তৈরি করার।

শহরে বিদ্যুৎ আসে ১৮৯৭ সালে এবং রেলস্টেশন ১৮৯৮ সালে। ১৯০০ সালেই এর সুনাম হয় ‘সাইবেরিয়ার প্যারিস’বলে।

বিপ্লব পরবর্তী রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধের সময় এ ছিল রাশিয়ান শ্বেতবাহিনীর শক্তিশালী কেন্দ্র। ১৯২০ পর্যন্ত এরা টিকে থাকে। বলশেভিকরা বিজয়ী হয়ে শ্বেতবাহিনীর মূল নেতা এডমিরাল কলচাকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে এখানে, ১৯২০ সালে। সারা সোভিয়েত আমলে সে কুখ্যাত ও ঘৃণ্য হলেও, তার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি এখন পরিবর্তিত। তারা মনে করে, বিপরীত মতের হলেও, দেশের জন্যই যুদ্ধ করে সে প্রাণ দিয়েছে, সুতরাং তাকে প্যাট্রিয়ট না বলার কোনও কারণ নেই। যেখানে তাকে হত্যা করা হয়েছিল ২০০৪ সালে তার একটি মনুমেন্ট স্থাপন করা হয়েছে।

নিরুপম এপিফেনি ক্যাথেড্রাল ঘুরে দেখি। ১৭১৭-১৭৪৬-এ তৈরি, এখনও তার সৌন্দর্যের শেষ নেই। উন্মুক্ত মাথা ও দোলায়িত উলঙ্গ উরু নিয়ে মেয়েদের ঢোকা নিষেধ কিন্তু প্রবেশপথে তাদের লম্বা স্কার্ফ দেওয়া হয়।

১৯৩০ সালের কুলাক নিধন ও জবরদস্তির সময়বায়করণের কালে, তাতার কৃষাণী জুলেখার স্বামীকে হত্যা করা হয় এবং শত শত মানুষের সাথে তাকে নির্বাসিত করা হয় প্রচণ্ড শীতের সাইবেরিয়ায়। আঙ্গারা নদীর তীরে জনমানবহীন তাইগায় অন্ন বস্ত্র বাসস্থানহীন শূন্যতায় ছুঁড়ে দেওয়া হয় তাদের। এই মানুষগুলোর কঠিন জীবন সংগ্রাম ও ক্ষমতাসীনদের হয়রানি ও হৃদয়হীনতার সাথে লড়াই করে বেঁচে থাকার কাহিনি নিয়ে লেখক গুজেল ইয়াহিনা লেখেন ‘জুলেখার দৃষ্টি উন্মোচন’ নামে এক হৃদয়বিদারক উপন্যাস। আঙ্গারা নদী সমাজতান্ত্রিক নিরীক্ষার বহু জাতি-গোষ্ঠীর অশ্রু বহন করেছে।

১৮২৫ সালের ১৪ই ডিসেম্বর জার প্রথম নিকোলাইয়ের বিরুদ্ধে সেইন্ট পিটার্সবুর্গে যে ডিসেম্ব্রিস্ট অভ্যুত্থান হয়, তা জারতন্ত্রের ভিত্তি নাড়িয়ে দেয়। অভ্যুথানের নেতাদের ৫ জনের ফাঁসি হয়, বাকিদের হাতে পায়ে শিকল পরিয়ে পাঠানো হয় সাইবেরিয়ায়, এই শহরে। কিন্তু রুশজাতির মনোজগতকে নাড়িয়ে দেয় এই বিপ্লবীদের সাহসী স্ত্রীরা। যৌবনবতী, অভিজাত ও অপরূপা এই নারীরা তাদের পরিবার পরিজন সন্তানদের ফেলে রওনা দেয় কঠোর সাইবেরিয়ায়। সন্তানদের নেয়া নিষেধ। বলা হয়, অভিজাতদের খাতা থেকে তাদের খারিজ করে সাধারণ কৃষাণীর স্তরে নামিয়ে আনা হবে, তাদের সন্তানেরা কোনওদিন অভিজাত বলে গণ্য হবে না, তারা আর সেইন্ট পিটার্সবুর্গ বা মস্কো ফিরে আসতে পারবে না, কোনওদিন দেখবে না ফেলে যাওয়া সন্তানের মুখ। কিন্তু তারা অনড়, স্বামীদের যে কষ্ট ও দুর্ভোগ, তারা ভাগ করে নেবে তা।

এই হলো রুশ নারী, অনড় ও অপরাজেয়।

মারিয়া ভলকোনস্কায়া, ইকাতেরিনা ত্রুবেৎস্কায়া, আলেকসান্দ্রা মুরাভেওভা, এলিজাবেথা নারিশকিনা অনেক নামের মধ্যে কয়েকটি নাম। পুশকিন তাদের বন্ধুদের উৎসর্গ করে কালজয়ী কবিতা লিখে পাঠিয়ে দেন আলেকসান্দ্রা মুরাভেওভা’র হাতে। পথে যদিও সার্চ হয় ঘন ঘন, কেড়ে নেয়া হয় অর্থবিত্ত ও সন্দেহজনক চিঠিপত্র, সে সযত্নে লুকিয়ে রাখে সেই কবিতা। ঘোড়ার গাড়ি, শ্লেজ বা পায়ে হাঁটা ছাড়া অন্য কোনও বাহন ছিল না তাদের। কিন্তু নরক অতিক্রম করে নেমে আসে আরও কঠিন নরকে।

কারও কারও ৬ মাস চলে যায় স্বামীর সাথে দেখা পেতে।

স্বামীরা কাজ করে খনিতে, জেলখানায় ফিরে আসে হাতে পায়ে শিকল বাঁধা অবস্থায়। সপ্তাহে দুদিন মাত্র দেখা করতে দেয় রক্ষীর উপস্থিতিতে। ক্ষুধা, শীত, কফিনের মতো সরু বাসস্থান, যেখানে ঘুমাতে গেলে মাথা দেয়ালে ঠেকে তো পা ঠেকে দরজায়। খবর আসে সন্তানেরা মরে যাচ্ছে একে একে, যাচ্ছে মা, বাপ, আপনজন। তুষার ঝড়, কনকনে হাওয়া আর ক্ষমতার মানুষগুলো―নরকের পাহারাদার।

বহুদিন পরে যখন স্বামীরা সাজামুক্ত হয়, তারা এখানেই থেকে যায়। তাদের বাসস্থানগুলো হয় সাহিত্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও মিউজিকের কেন্দ্রবিন্দু। মস্কো ও সেইন্ট পিটার্সবুর্গের আলো জ্বলে ওঠে সুদূর সাইবেরিয়ায়।

ডিসেম্ব্রিস্টদের স্মৃতি মিউজিয়মে তন্ময় সময় কাটে আমাদের। মিউজিক হলে শুনি অভিজাত রাশিয়ান রোমান্স সঙ্গীত। তারপরে আমাদের ট্যুর দেয়া হয় বিশাল এক থিয়েটারে। অসংখ্য সিটের থিয়েটারটিতে টিকেট সহজলভ্য নয়। আমরা সেখানে স্থানীয় নাচ গান ও বাদ্যমুখর সন্ধ্যা কাটিয়ে হোটেলে ফিরে আসি।

আমাদের পরের দিন সকাল কাটে বাইকালের তীরে ও লঞ্চভ্রমণ করে। সুদর্শনা ও সুস্বনা গাইড রুশভাষায় গড় গড় করে বর্ণনা করে বাইকাল হ্রদ সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য। সময়টা গ্রীষ্মকাল। গ্রীষ্মে সাইবেরিয়া স্বর্গের সঙ্গে সৌন্দর্য ও প্রীতির প্রতিযোগিতায় নামে। এই যে আমাদের গাইড, সাদা ধবধবে, গায়ে হাল্কা বসন, বুকে নিম্নমুখী অগভীর গিরিখাতের চিরল দেখে কার মনে হবে সে মেনকা বা ঘৃতাচি নয়। তার কথা শুনতে শুনতে কূল থেকে দাঁড়িয়ে দেখলাম পৃথিবীর অন্যতম সৌন্দর্য ও বিস্ময়ের জলধিকে। তীরে তীরে তার বনরাজি সবুজ, জলে বাতাসের খেলা। আমাদের জন্মেরও কোটি বছর আগে তার যাত্রার শুরু, আমাদের মৃত্যুর কোটি বছর পরেও তার বুকে খেলা করবে রোদ ঝলমলে ছোট ছোট ঢেউ।

মূল গ্রুপ থেকে সরে একটি বিশাল পাথরে বসে বাইকাল দেখছি। এই পাথরের বয়েস কত ?

আমার বয়সের সাথে তুলনা করলে তাকে অনন্তকাল বলা যায়। দূরে হ্রদের জলের বুক ফুঁড়ে দাঁড়িয়ে আছে নিমজ্জিত কোন শৈলের অনুচ্চ শৃঙ্গ। মনে হয় যেন একটি পাথর জলে ভাসছে। উড়ো পাখিদের বিশ্রামের স্থান। পাখির কোনও সংস্কৃতি বোধ নেই, ওরা যেখানে বসে, সেখানেই খায়, গায়, ভালোবাসে, মলত্যাগ করে। ওদের পুরীষ ও পূজার বহু শ্বেত-চিহ্ন আছে হিপোর নাকের মত সেই পাথরে। এই পাথরের নাম ‘শামান রক।’ আগের দিনে তুক-তাক, ফুঁক-ফাঁক, লতা-গুল্ম দিয়ে মানুষের চিকিৎসা করত যারা, তাদের বলা হতো ‘শামান’। সমাজে তাদের কদর ছিল বেশ, ক্ষমতাও ছিল যথেষ্ট।

প্রাচীনকালে বাইকাল নামে এমনি এক প্রতাপশালী ও রাগী শামান ছিল।  তার অত্যন্ত রূপসী এক কন্যা ছিল। যেমন সুন্দর সে, তেমনি সুন্দর তার নাম, আঙ্গারা। সে মেয়েকে অসম্ভব ভালোবাসতো, তাকে না দেখে থাকতে পারত না এক মুহূর্ত। ছবির মত সৌন্দর্য যার, তার সমকক্ষ পাত্র পাওয়া দুষ্কর। সে ছিল দিনের আলোয় আকাশের মেঘের চেয়েও হাল্কা আর রাতের অন্ধকারের চেয়ে ও কালো ছিল তার চুল! সব মানুষ তাকে ভালোবাসত, মোহিত ছিল তার রূপে। এমনকি পাখিরা হ্রদের বুকের উপর দিয়ে উড়ে উড়ে যখন তৃষ্ণার্ত নেমে আসতো জলের কাছে, তারা ওর দিকে তাকিয়ে ভুলে যেত জল স্পর্শ করতে। আঙ্গারা বড় হয়।

যৌবন ঝলমলে রূপবতী দয়মন্তী যেন, ভীষণ ভালোবাসার কাঙাল। পাখিরা কথা বলত ওর সাথে, নিয়ে আসত দূর দূরান্তের খবর। কনকবর্ণ নামের হংসদূত মহাভারতের দয়মন্তী ও নলের কাছে যেমন একে অন্যের রূপের বর্ণনা করত, ঠিক তেমনি পাখিরা গল্প করত চির তুষারাবৃত দূরের ‘সায়ান’ পর্বতমালার কাছের এক দীর্ঘদেহী, সুঠাম রূপবান তরুণের। নাম তার ইনেসেই। এই পাখিরাই ইনেসেই’র কাছে নিয়ে যেত আঙ্গারার খবর। এভাবেই তারা ভলোবেসে ফেলে একে অন্যকে। কিন্তু পিতা জানতে পেরে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। বন্দি করে রাখে চারিদিকে উঁচু উঁচু পাহাড়ের দেয়াল তুলে। পাহারা দেয় দিন রাত্রি। কিন্তু প্রেমিক হৃদয় কি ঠেকানো যায়? এক রাতে বাইকাল যখন তন্দ্রায় এলিয়ে পড়ে, আঙ্গারা কাঁধে তুলে নেয় তার জলের বৈভব। ছুটতে শুরু করে যত দ্রুত সম্ভব ইয়েনিসেইয়ের দিকে। জেগে ওঠে বাইকাল, রাগে বিস্ফারিত হয় মেয়ের আস্পর্ধায়।

উন্মত্ত উর্মি-ঝাপটে কেঁপে কেঁপে ওঠে চারিদিক, পর্বতমালা ভেঙে পড়ে অশ্রুর বিস্ফোরণে। অরণ্যানী নুয়ে পড়ে, আকাশ ঢেকে যায় শোকের কৃষ্ণতায়, পশুরা ভীত সন্ত্রস্ত প্রাণভয়ে ছুটতে থাকে দিগ্বিদিক। পাখিরা চিৎকার করতে করতে উড়ে যায় জল ও পৃথিবীর বুক হতে যতদূর উচুতে সম্ভব। মাছেরা লুকায় গিয়ে গভীর জলে, হ্রদের তলানিতে।

বাইকাল কোন মতেই মেনে নিতে পারে না কন্যার এই বিশ্বাসঘাতকতা। লাথি দিয়ে ভেঙে ফেলে মস্ত বড় পাথরের পাহাড়, তারপর বিশাল একটি খণ্ড তুলে নেয় হাতে। সর্বশক্তি দিয়ে ছুড়ে মারে ছুটন্ত কন্যার দিকে। সেই পাথর গিয়ে লাগে আঙ্গারার গলায়, তার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, তৃষ্ণায় ফেটে যেতে থাকে বুক। যে ভালোবাসার সন্ধানে সে ছুটেছিল জীবনবাজি রেখে, সে ব্যথা ও তৃষ্ণায় প্রিয়তম ইনেসেই’র কথা মনে করতে পারে না। চিৎকার করে পিতার কাছে চায় এক ফোঁটা জল। পিতা ফিরিয়ে দেয় আর্ত ফোঁপানি,‘জল নয়, তুমি আমার অশ্রু নাও, অশ্রু চিরন্তন।’

আঙ্গারা ঢলে পড়ে ইনেসেইয়ের কোলে। ইনেসেই প্রেয়সির দেহ কোলে নিয়ে বিরাট বিরাট পাথর, পাহাড় ও বিস্তীর্ণ স্তেপ পার হয়ে চলে যায় লোকালয় ছেড়ে পৃথিবীর হিমতম ‘কারা’ সাগরে যেখানে আঙ্গারা ও ইনেসেই বিলীন হয়ে যায়।

আমার সামনে জলে ভেসে আছে আঙ্গারার গলার সেই পাথর। এখানেই নাকি বসবাস করে আত্মারা, ভালো ও মন্দ দুই-ই। তাই এটি পবিত্র পাথর। এখানে বাইকালকে দেয়া হয় পুজো, যাতে সে রাগত হয়ে প্লাবিত না করে দুই কূল।

৫.

কোনও এক কালে এক প্রেম-দেবী যাদুকরী পরী ছিল যার কাজ ছিল ঘুরে ঘুরে প্রেম বিতরণ করা। যে-ই ছিল ভালোবাসার কাঙাল, সে উপস্থিত হতো তার দুয়ারে। তার হৃদয় ছিল কোমল এবং সে চাইত ভালোবাসায় ভরে থাকুক পৃথিবী, সুখী হোক প্রতিটি মানুষ। মার্কসবাদের জন্ম হবার বহু আগে জন্ম হয়েছিল তার এবং ভালোবাসার বিষয়টি সে যেভাবে বুঝত তাই ছিল ঠিক এবং বিকল্প চিন্তা ছিল ভ্রান্ত। ভালোবাসা বিতরণ ছাড়াও তার ছিল আর একটি কাজ, সে প্রতিরাতে ঘুরে বেড়াত কাছের হ্রদের তীরে এবং সংরক্ষণ করত এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পশু-পাখি ও কীট পতঙ্গ। একরাতে সে মুখামুখি হয় এক বিশালদেহী অপরিচিত যুবকের। বাইকাল তার নাম। দেখে মনে হয় সে স্থানীয় নয়। ক্লান্ত, বঞ্চিত, নিঃসঙ্গ, মরণশীল এই মানুষটির অবয়বে ছিল অসহায়ত্বের ছাপ। দেবীর মনে হল এই মানুষটির প্রয়োজন ছিল একটু আশ্রয়, স্বস্তি, যত্ন ও ভালোবাসার।

দীনে দয়া করাই তার কাজ। সে ভালোবাসা দিতে গিয়ে যেই তাকালো ওর চোখে, অমনি হারিয়ে ফেলল নিজেকে। নিজেই পড়ে গেল গভীর প্রেমের অতলান্ত গহীনে। বাইকালও তাই। খুব অল্পসময়ের মধ্যে তাদের এই ভালোবাসা রূপ নিল এক বিশাল মহীরুহের। কিন্তু মানুষের জীবনের ধর্মই হল উল্টা স্রোতে হাঁটা। প্রাপ্তিই জন্ম দেয় অপ্রাপ্তির, সুখেই বোনা হয় অসুখের বীজ। বাইকালের জীবনে খুব শিগগিরই নেমে আসে ক্লান্তি ও একঘেয়েমি। মনে হয় জীবন যেন জীবন নয়, তুঁতের নির্ঝর। মনে হয় সে সামান্য মানুষ, তার কী দরকার ঐ বিশুদ্ধ সত্তার? সে নিজে কোনদিন তার সমকক্ষ হতে পারবে না। অসম এই প্রেম দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। একদিন সে পালিয়ে যায়, পরীকে কিছু না বলে। প্রেমিককে হারিয়ে নারী বেপরোয়া হয়ে পড়ে। তার কোমল হৃদয়ে অন্ধকার হয়ে ওঠে বিষকাঁটার আমাজন।

সে খুঁজতে থাকে সর্বত্র। তার চোখ মানুষের চোখ নেয়, তার কান অতিসংবেদনশীল। তার ঘ্রাণানুভূতি অতি তীক্ষè। ‘অকৃতজ্ঞ মানুষ, আমি তাকে ভালোবাসা দিই, বিনিময়ে সে হয় কাঁটা’, সে ভাবে। একসময় ঠিকই খুঁজে বের করে তাকে, ধরে নিয়ে আসে, তারপর দুটো পা কেটে দেয়, যাতে সে তার ভালোবাসার গরল ও ক্ষীর ফেলে কোথাও পালিয়ে যেতে না পরে।

বাইকাল প্রেমের যে অতলে পড়ে গিয়েছিল একদিন, এবার সে পড়ে তারও চেয়ে গহীনে। নীল নিতল অন্ধকার সেখানে। বিষণ্ন হয়ে শুয়ে থাকে, নড়ে না, মরে না, শুধু চোখ দিয়ে তার অশ্রু ঝরে অবিরল। সেই বিশাল দেহ, অশ্রুজল, স্বপ্ন-মৃত্যু ও দুঃখানুভূতির গভীরতা নিয়ে বাইকাল শুয়ে আছে। আর পরী, পরী কই ? মানুষকে ভালোবাসার প্রতিযোগিতায় ২০ শতকের লাল-সাদা পিগমিদের কাছে হেরে গিয়ে কোথায় চলে গেছে কে জানে ?

১৫৮০ সালের জুলাই মাসে কসাক ইরমাকের নেতৃত্বে ৫৪০ জন সৈন্যের একটি দল সাইবেরিয়ার কুসুম খানের তাতার রাজ্য আক্রমণ করে। আইভান দি টেরিবল বা ইভান গ্রজনি রাশিয়ার ক্ষমতায়। শক্তিশালী স্ত্রোগানভ পরিবার এই রাজ্য-জয় অভিযানের খরচ বহন করে। সৈন্যদের সাথে ৩০০ জন লিথুনিয়ান ও জার্মান দাস ছিল এই দলে। জারের কাছ থেকে তাদের ক্রয় করা হয়েছিল।

ছোট ছোট যুদ্ধগুলোতে জয় করতে করতে তারা এগিয়ে আসে কুসুম খানের রাজধানি ‘কাসলিক’-এর সন্নিকটে। ইরতিশ নদীর তীরে যুদ্ধ হয়। কুসুম খান ও ৬ জন তাতার প্রিন্সের সম্মিলিত বাহিনীকে পরাজিত করে। কাসলিক দখল করতে তাদের আরও কয়েক মাস সময় লাগে। শেষ পর্যন্ত কুসুম খান পালিয়ে যান। কিন্তু শক্তি সংহত করে ১৫৮৪ সালের কোনও এক মধ্যরাতে অতর্কিতভাবে কাসলিক আক্রমণ করে পুনর্দখল করতে সক্ষম হন। ইরমাক আহত হয়ে ইরতিশের একটি শাখানদী সাঁতরে পার হতে গিয়ে জলে ডুবে মারা যায়। কিন্তু তার অবশিষ্ট সৈন্যরা কাসলিকে আগুন ধরিয়ে পালায়। ১৫৮৬ সালে আরও বেশি শক্তি নিয়ে ফিরে আসে এবং কামান দেগে স্থানীয় দুটি উপজাতিকে পরাজিত করে কাসলিকের অদূরে ‘তিউমেন’ নামে একস্থানে দুর্গ স্থাপন করে। ১৫৮৪-১৫৯৫ সাল পর্যন্ত আক্রমণ পাল্টা আক্রমণ চলতে থাকে। ১৫৯৮ সালে ‘ওব’ নদীর উপকূলে ‘উরমিনের যুদ্ধে’ কুসুম খান পরাজিত হন এবং তার পরিবার রুশদের হাতে বন্দি হয়।

কুসুম খান এবারও পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।

তাঁর পরিবারকে মস্কো নিয়ে যাওয়া হয়। ছেলেদের সাইবেরিয়ার প্রিন্স টাইটেল দেওয়া হয়। কুসুম খান মস্কোর জারের কাছে চিঠি লেখেন ইরতিশ নদীর উপকূলে ছোট্ট একটি এলাকায় রাজত্ব করার অনুমতি চেয়ে, কিন্তু তাঁকে বলা হয়, মস্কো এসে অভিজাতের মর্যাদায় শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন করুন, কী দরকার বৃদ্ধ বয়সে রাজ্যশাসনের ভার কাঁধে নেয়ার ? কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করে চোরাগোপ্তা আক্রমণ চালিয়ে যেতে থাকেন শেষ বয়স পর্যন্ত। বৃদ্ধ বয়েসে বুখারায় চলে যান। অন্ধ ও অথর্ব অবস্থায় সেখানেই মারা যান ১৬০৫ সালে।

‘দীর্ঘ আয়ু মেগে এনেছিলাম চারটি দিন

দুদিন গেল প্রার্থনায়, দুদিন―প্রতীক্ষায়

কী যে দুর্ভাগা জাফর, দাফনের জন্য

দু’গজ জমিও মিলল না বন্ধুদের দুনিয়ায়।’

-বাহাদুর শাহ জাফর (জ্যোতির্ময় নন্দীর অনুবাদ)

কুসুম খানের মৃত্যুর পরে রুশ আগ্রাসন চলতে থাকে। তারা বাইকাল হ্রদ, অখতস্ক সাগর ও আমু দরিয়া অতিক্রম করে চীনের বর্ডার পর্যন্ত পৌঁছায়। তারপরে ১৬৩৯ সালে দূর প্রাচ্যে প্রশান্ত মহাসাগরের তীর স্পর্শ করে। এভাবে রাশিয়ার পূর্ব সীমান্তের বিস্তৃতি হয় কয়েক মিলিয়ন বর্গ কিমি। ধীরে ধীরে ইওরোপিয়ান রোগসমূহ বিশেষ করে গুটি বসন্ত, যা ছিল সাইবেরিয়ায় অজ্ঞাত, মহামারি হয়ে আসে। জনপদের পর জনপদ উজার হয়ে যায়, রুশ ইতিহাসবিদরা দাবি করে যে, বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ছাড়া সাইবেরিয়ায় আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়ার মত নিপীড়ন, হত্যা, ফাঁসি, ধর্ষণ, দাসত্ব, এলকোহল ও যৌনরোগের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেনি। সত্যের দূরত্ব কয়েক আঙুল নয়, কয়েক শতাব্দী। কামচাতকা এবং কুরিল দ্বীপসমূহের দিকে একটু মনোযোগ দিলে দেখা যায় পালাক্রমে রুশরা আসে, কিছু ফাঁসিতে লটকায়, তারপরে তাদের তাড়িয়ে আসে জাপানিরা, তারা কিছু ফাঁসিতে লটকায়, তারপরে আবার রুশরা আসে―এইভাবে দ্বিধাকর্তৃত্বের শাঁখের করাতে দ্বিখণ্ডিত হয় জনগণ দীর্ঘদিন।

১৭৪২ সালে রুশরা আলাস্কায় পৌঁছায়।

১৭৮৪ সালে রুশ ব্যবসায়ী গ্রিগরি শেলিখভ আলাস্কায় রুশ কলোনি স্থাপন করে রাশিয়ান আমেরিকান কোম্পানি ১৮১২ সালে সানফ্রান্সিসকোর সনোমা কাউন্টিতে ‘ফোর্ট রস’ নামে দুর্গ প্রতিষ্ঠা করে ‘রাশিয়ান রিভার’ এর তীরে। ১৮৪২ সালে তারা এই দুর্গ বিক্রি করে দেয়। ১৮১৭ সালে রুশরা হাওয়াইতে প্রতিষ্ঠা করে ‘ফোর্ট এলিজাবেথ।’ কিন্তু ক্রিমিয়া যুদ্ধের পরে মূল ভূ-খণ্ডের থেকে দূরের কোনও মাথাব্যথা গ্রহণ করতে অনিচ্ছুক, জার দ্বিতীয় আলেকজান্দার ১৮৬৭ সালে আমেরিকার কাছে আলাস্কা বিক্রি করে দেন ৭.২ মিলিয়ন ডলারে।

৬.

প্রাচীনপন্থী রুশ ধর্মযাজক আভাকুমকে সাইবেরিয়ায় নির্বাসিত করা হয়েছিল ধর্মমতের পার্থক্যের কারণে। বাইকাল হ্রদের কাছে এসে এর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘ওঃ রং ধ ঢ়ধৎধফরংব ড়হ বধৎঃয, যিবৎব বাবৎুঃযরহম ধিং ষধৎমবৎ ঃযধহ ষরভব.’

আভাকুমের এই কথাগুলোর সাথে দ্বিমত করার উপায় নেই। সেই বাইকালের বুকে আমরা লঞ্চে বসে আছি। পোর্ট বাইকাল থেকে এই মাত্র ছেড়ে এলো। রোদ ঝলমল করছে জলে। হ্রদের বুকে একটি দ্বীপ, একটি ছোট্ট গ্রাম। সারি সারি সাদাকাণ্ডের বার্চ যা রুশ মানসে চিরকাল আন্দোলন তোলে, ও বন জঙ্গলে ঘেরা বিপ্লবপূর্ব এক সম্পন্ন কৃষকের বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখলাম। তিনশ বছর পুরনো একটি কাঠের গির্জা দাঁড়িয়ে আছে মৌন।

লোকজন খুব বেশি নেই।

দ্বীপে ঘোরাফেরা করে, এর ইতিহাস, শান্তি ও নির্জনতায় অবগাহন করে, আবার লঞ্চে চড়ে বসি। স্বচ্ছ জলে ফিরোজা আসমানের প্রতিবিম্ব, ঢেউয়ের খেলা দেখতে দেখতে, দুলতে দুলতে ভাসতে লাগলাম বৈকাল হ্রদে, বয়েস যার কত কোটি বছর কেউ জানে না।

আকারে কলার মত দেখতে বাইকাল হ্রদকে বলা হয় ‘সাইবেরিয়ার মুক্তা’, এর স্বচ্ছ নীল জলের জন্য। এর তলায় অজস্র উষ্ণ প্রস্রবন রয়েছে। আর আছে ‘এপিশুরা’ নামে ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র চিংড়ি জাতীয় লক্ষ কোটি প্রাণী, যারা হ্রদের জলকে বিশুদ্ধ রাখে। প্রায় ২৫০০ প্রজাতির প্রাণী ও জলজ উদ্ভিদ-শ্যাওলা আছে, তাদের দুই-তৃতীয়াংশ অন্যত্র দেখা যায় না। ‘অমুল’ নামে সাদা স্যামন জাতীয় একটি মাছ হল বাইকালের একান্ত নিজস্ব, তারও অন্য কোন নিবাস নেই। জালে ধরা পড়ে সে উঁচু ও তীক্ষè গলায় এমন এক চিৎকার দেয় যে, সবাই জানে এটা অমুলের কন্ঠস্বর। অমুল জন্মায় সেলেঙ্গা নদীতে, কিন্তু সেখানে সে থাকতে পারে না। তার খাদ্য, বিশেষ এক শৈবাল, ‘মেলোসিরা’ পাওয়া যায় শুধু মাত্র বাইকালে। শুধু মানুষই স্বদেশ ত্যাগ করে না―বাঁচার তাগিদে, প্রাণীও করে। কিন্তু এ নিয়ে তারা ফেইসবুকে কুরুক্ষেত্রের সৃষ্টি করে না।

বাইকালে বাঙালির মত সবচেয়ে গিজগিজে যে মাছ, তার নাম, ‘গলোমিয়ানকা’। আঁশহীন, তৈলাক্ত ও হাল্কা গোলাপি। ডিম দেয় না, প্রায় ২০০০ জীবন্ত পোনার জন্ম দেয় প্রতিবার। হ্রদের গহীনে লুকিয়ে থাকে দিনের বেলায়, রাতের অন্ধকারে ওপরে উঠে আসে।

এই মাছ খেয়ে বাঁচে ‘নেরপা’ সিল। পৃথিবীর একমাত্র মিঠাপানির সিল, এবং সবচেয়ে ক্ষুদে। ১.১-১.৪ মি. লম্বা, ৬২-৭২ কিলো ওজন। থ্যাবড়া মুখ, কানহীন ও বড় বড় চোখের গোলগাল সুদর্শন সে। ১৫০০ মিটার গভীরে ডুব দিতে পারে, শিকার করে দিনে বা রাতে সমান দক্ষতায়। হ্রদ যখন জমে যায় সে প্রয়োজনে বরফের ওপর দিয়ে চলাচল করে।

বাইকাল উত্তর দক্ষিণে ৬৩৬ কি.মি. কিন্তু মাত্র ৬০ কি. মি. প্রশস্ত। এই হ্রদ তৈরি হয়েছিল পৃথিবীর টেকটনিক প্লেটের পরস্পরের থেকে দূরে সরে যাবার কারণে, যা এখনও ধীরে ধীরে সরে গিয়ে হ্রদের গভীরতা বাড়িয়ে চলছে এবং বৈজ্ঞানিকেরা ধারণা করছেন যে, ভবিষ্যতে এটি এশিয়া মহাদেশকে বিভক্ত করে পৃথিবীর ৫ম মহাসাগরে পরিণত হবে। এর বয়েস ২০-৩০ মিলিয়ন বছর, বেশির ভাগ হ্রদ বাঁচে মাত্র ১০-১৫ হাজার বছর, তারপরে আস্তে আস্তে শুকিয়ে যায়।

বর্তমানে বাইকাল পৃথিবীর গভীরতম হ্রদ, প্রায় ১৬৩৭ মি. এর পশ্চিম তীরের কাছে। পৃথিবীর পঞ্চমাংশ মিঠা জল ধারণ করে সে, যা উত্তর আমেরিকার ৫ টি বৃহৎ লেকের সম্মিলিত জলের চেয়েও বেশি। জলের তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে কখনও যায় না। স্বচ্ছতার কারণে প্রায় ৪০ মি.গভীর পর্যন্ত দেখা যায়। মঙ্গোলিয়ায় জন্ম নেয়া সেলেঙ্গা নদী সুদীর্ঘ পথ অতিক্রম করে নাইতে নামে বাইকালে। আঙ্গারা নদী বাইকালের স্বচ্ছ জল নিয়ে ইনেসেই নদীতে মেশে।

বড় ইনেসেই (৬০৫ কিমি) এবং ছোট ইনেসেই (৫৬৩ কিমি) নামে দুটি নদী মিলিত হয়ে তৈরি করে ইনেসেই নদী। বড় ইনেসেই’র উৎপত্তি সাইবেরিয়ার পাহাড়ি হ্রদ ‘কারা-বালিক’-এ। ছোট ইনেসেই’র জন্ম মঙ্গোলিয়ায়, পাহাড় থেকে নেমে আসা দুই তরুণ নদীর ভালোবাসার সংবেশনের ফলে। ছোট ও বড় ইনেসেই যেখানে মিলিত হয়, সেখানে সৃষ্টি হয়েছে শহর, কিজিল তার নাম। আর আঙ্গারা ও ইনেসেই’র মিলন হয় ইনিসেইস্ক শহরের অদূরে স্ত্রেলকা গ্রামের কাছে। মিলনস্থলে অঙ্গারা ইনেসেই’র চেয়ে অনেক প্রশস্ত এবং মনে হয় সে-ই মূল নদী এবং ইনেসেই মাথা রেখেছে তার বুকের পেয়ালায়।

৭.

প্রাচীনকালে কোন এক সময়ে বাইকালের বর্তমান স্থানে ছিল গহীন বন। সেখানে বহু ধরনের পশু-পাখি ছিল শিকার করার জন্য। এদের মধ্যে ছিল মস্ত বড় এক পাখি। ওর পাখাগুলো বিশাল ও শক্তিশালী। সেই পাখা কোনও গাছকে স্পর্শ করলে সে গাছ উপড়ে পড়ত শিকড়সুদ্ধ, যদি স্পর্শ করতো কোন পাথর তা ভেঙে চুরমার হয়ে উড়ে যেত চতুর্দিকে। লোকজন এই পাখিকে ভয় পেত। তারা ওকে মারতে পারত না। ওর নিঃশ্বাস থেকে বের হতো আগুনের লেলিহান রশ্মি, এবং মৃতবৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ত শিকারীরা।

অবশেষে জন্ম হল এক শিশুর, সে বড় হতে লাগল সবার চোখের সামনে, পুরানো দিনে যেভাবে বলত, দিনে দিনে নয়, ঘণ্টায় ঘণ্টায়, বর্ষায় ঘাস বাড়ে যেমন লক লক করে, ঠিক তেমন। অতি শীঘ্রই তার শক্তির সমকক্ষ কেউ থাকে না। অপরাজেয় ও অভীক, অমোঘ অভিজিৎ। বিপন্ন লোকজন তার সাহায্য চায়। ১০০ টা দেবদারু দিয়ে সে বানায় ধনুক, আর ২০০ টি কাণ্ড ছেঁচে তীর। তারপর রওনা দেয় সেই পক্ষি-দানব সংহারে। কিছুক্ষণের মধ্যেই কেঁপে ওঠে পৃথিবী। পক্ষি-অসুর ধুপ করে পড়ে আকাশ থেকে এবং সাথে সাথে জ্বলে উঠে আগুন চারিদিকে। সেই আগুনের ক্ষুধার্ত জিভ চাটতে থাকে আকাশের বুক। সন্ত্রস্ত মানুষ ‘বাইকাল’ ‘বাইকাল’ বলে চিৎকার করে তাইগা ছেড়ে ছোটে পাহাড়ের দিকে। তারা আগুনের শিখার মধ্য দিয়ে দেখতে পায় বিশাল বিশাল জলস্তম্ভ, আকাশচুম্বি ঢেউ। তাদের চোখের সামনে সমস্ত স্থল ধীরে ধীরে তলিয়ে যায় সমুদ্রের গভীরে। কেউ জানে না ওই ভীত সন্ত্রস্ত মানুষগুলো কি বোঝাতে চেয়েছিল ‘বাইকাল’ ‘বাইকাল’ চিৎকার করে : ওই দানব পাখিটিকে, না বিশাল সেই অগ্নিকাণ্ডকে, না বিশাল জলাধারকে। কিন্তু যা-ই তারা বোঝাক না কেন মানুষ মনে রেখেছে সেই জায়গাটির নাম ।

বাইকাল।

অনেক উপকথা, অনেক ইতিহাসের জন্মভূমি।

ওই যে আভাকুমের কথা বলেছিলাম, তিনি ছিলেন রাশিয়ার প্রাচীন অর্থডক্স ধর্মে বিশ্বাসী। তিনি রুশ প্যাট্রিয়ার্খ নিকোনের ধর্ম-রিফর্মের সাথে একমত হতে পারেননি। নিকোনের সাথে ধর্মীয় রীতি ও আচারগত পার্থক্য ছাড়াও আভাকুম মনে করতেন রুশদের তুলনায় ইউক্রেনিয়ান, গ্রিক ও সের্বিয়ানদের অর্থডক্স ধর্ম ত্রুটিপূর্ণ, তাই ঈশ্বর তাদের অন্যজাতির দাসত্বে নিপতিত করে শাস্তি দিয়েছেন।

কিন্তু ততদিনে লিথুনিয়া-পোল্যান্ডের সম্মিলিত রাষ্ট্র ‘রেচ পাসপালিতা’র জোয়াল ভেঙে কসাক বগদান খ’মেলনিৎস্কির নেতৃত্বাধীন অর্থডক্স মেজোরিটির ‘মালায়া রাশিয়া’ (বর্তমান ইউক্রেনের পশ্চিমাংশ) রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। জার আলেক্সেই মিখাইলোভিচ রমানভ চাইছেন সকল শ্লাভ অর্থডক্স খৃস্টানদের মস্কোর চার্চের অধীনে এক অবিভক্ত প্লাটফর্মে নিয়ে আসতে। তিনি নিজে সময় দিয়ে শুনেছেন আভাকুমের যুক্তি, চেষ্টা করেছেন বোঝাতে। এমন কী চার্চের বিরোধ মিটানোর লক্ষ্যে জার তাকে নিজের ব্যক্তিগত ধর্মগুরু হবার প্রস্তাব পর্যন্ত করেন কিন্তু আভাকুম নতুন ধর্মমতকে ভ্রান্ত মনে করে অনড় থাকেন। ‘প্রতাপভ আভাকুমের জীবন’ নামে লেখেন আত্মজীবনী। তার সাহস, ধর্মের জন্য যিশুখ্রিস্টের মত জীবন দিতে অবিচল অবস্থান―জনসাধারণের মধ্যে তার সম্মান  অনেক বাড়িয়ে দেয়।

তিনি দিনের পর দিন, রাতের পর রাত জেলে নিপীড়ন সহ্য করেছেন, কিন্তু মত পরিবর্তন করেননি। তার অনুসারীদের জিভ কেটে নেয়া হয়েছে, তাকে টলানোর জন্য কিন্তু তিনি অনড় থেকেছেন।

জার আলেক্সেই মিখাইলোভিচ রমানভ মারা যান ১৬৭৬ সালে। ক্ষমতায় আসে তাঁর ছেলে ফিওদর আলেক্সেইভিচ, অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ, শান্ত ও নিরীহ। আভাকুম তাকে চিঠি লেখেন, স্বপ্ন দেখেছেন যে, জারের প্রয়াত পিতা আলেক্সেই মিখাইলোভিচ পূর্বপুরুষদের ধর্ম থেকে বিচ্যুতির কারণে নরকের আগুনে পুড়ছেন। পিতার দুর্ভাগ্য এড়াতে তাকে অবিলম্বে সত্যপথে ফিরে আসার আহ্বান জানান।

এটা ছিল দুঃসাহসিক ভুল চাল, অন্ধকারে ঢিল মারা। মহান জার পরিবারের বিরুদ্ধে এতবড় অপরাধ সম্পন্ন করার অভিযোগে আভাকুম এবং তার সহযোগীদের ১৬৮২ সালে জ্যান্ত চিতায় পুড়িয়ে মারা হয় এই সাইবেরিয়ায়।

বিশ্বাস, বিশ্বাসের জন্য মানুষ কত কিছু করতে পারে, ধর্ম বলো, আদর্শ বলো, বিশ্বাস সঠিক হতে হবে এমন কোনও কথা নেই। একজনের কাছে যা সঠিক বিশ্বাস, অন্যের কাছে তাই ভুল হতে পারে। অন্যে তার বিশ্বাসে অন্ধ হয়ে মানুষ হত্যা করতে পারে, কিন্তু তুমি তো তা পারো না। আর যদি পারো, তাহলে তোমার সাথে তার তফাত রইলো কোথায় ? শ্বেতা আমাকে প্রশ্ন করে।

তা বলে ন্যায় অন্যায় বলে কি কিছু নেই ?

তোমার কাছে যা ন্যায়, তার কাছে অন্যায়।  অথবা উল্টা। বিপ্লবের পরে আমাদের দেশে এত মানুষ একে অন্যকে হত্যা করেছে, শ্বেত বাহিনী বিশ্বাস করেছে তারা ধ্বংসের হাত থেকে মাতৃভূমিকে রক্ষা করছে, লালবাহিনী বিশ্বাস করেছে তারা রাশিয়াকে শোষণমুক্ত করার জন্য লড়ছে। কিন্তু সবচেয়ে দৃঢ়বিশ্বাসী যারা তারা একে অন্যকে হত্যা করে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, যারা ক্ষমতায় থেকে গেছে, তারা ঠগ, তারা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে নাই। তাই আমরা ফিরে এসেছি বৃত্তের শুরুতে।

বৃত্তের কি শুরু আছে ?

সে হাসে, তুমি তর্ক করতে পছন্দ করো। ধরে নাও, বৃত্তের শুরুটা সেখান থেকে যেখানে মানুষ মানুষকে প্রথম শৃঙ্খলিত করতে শুরু করেছে।

এই কথাগুলো আমাকে ভাবায়, কষ্ট দেয়, আমার দেহের কোনও অসুখ নেই, মনের আছে। মনে কৃষ্ণপক্ষ রাত হাঁটে পেছনে দুই হাত রেখে সামনে বাঁকা হয়ে, বৃদ্ধের মত। অথচ বসন্তের থৈ থৈ নেভা নদীর তীরে, লাইলাক ও চেরেওমুখার বকৌলির পরিপূর্ণতায় শ্বেতা বলেছিল, ‘ইয়া ল্যুব্লু তিবিয়া!’ (আমি ভালোবাসি তোমাকে), আকাশের রং তার চোখে, বাদামি চুল আর সাদা মেঘের দাঁতের রং দাঁতে অথচ বুঝ কত পরিষ্কার, মানুষ কেন মানুষকে বিভাজন করবে, কেন হত্যা করবে তার নিজস্ব বুঝের কারণে ?

চিন্তার কোন বুক-পিঠ নেই, ওই যে মেয়েটি ডিনার সার্ভ করছে কী যেন ওর নাম ? বলেছিল, মনে রাখিনি। সুন্দর, ছোট্ট, তন্বী ও চোখ দুটো মায়াময়। বিকিনি পরে কাল সে আমাদের ভদকা বিলিয়েছে বাইকালের তীরে। মনে পড়েছে, ওর নাম ইউলিয়া। সে মস্কোতে থাকে, স্কুলে কাজ করে বাচ্চাদের স্পিচ প্যাথোলজিস্ট হিসাবে। ওদের ধ্বনির ত্রুটি সংশোধন করার কাজ। মাত্র এক বছর আগে পড়াশুনো শেষ করেছে। সতেজ টিউলিপ ফুলের মতো। গ্রীষ্মে স্কুল বন্ধ, ট্যুরিস্ট ট্রেনে কাজ করতে এসেছে। ভ্রমণের সঙ্গে কিছু অর্থ আয়, খারাপ কী ?

কী সুন্দর সে, কী সুন্দর যৌবন! নিশ্চয়ই সে জানে প্রেম কী এবং প্রেমের বিধ্বংসী চুম্বক, দেহের সঙ্গে দেহের মিলনের রসায়ন। ওর বয়সে ওই অনুভূতিগুলো কী তীব্র ছিল আমাদের। মনে হতো পাথরের বুকও বুক দিয়ে পিষে ফেলতে পারি।

ট্রেন ছুটছে। সারি সারি পাইন বার্চ মগ্ন চৈতন্যে মৌন। বাইকাল দৌড়ুচ্ছে হরিণের মত ট্রেনের পাশাপাশি। পাহাড় আর পাহাড়। বেঁচে থাকার জন্য, ভালোবাসার জন্য, কী সুন্দর এই পৃথিবী!

 লেখক : ভ্রমণসাহিত্যিক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button