মহি মুহাম্মদ
টুপ।
নিঃশব্দের শব্দ হলো। এক ফোঁটা। টুপ। আরেক ফোঁটা। শিরশির করে উঠল নাকের পাটাতন। চোখজোড়া খুলবে খুলবে করেও খুলতে পারছিল না। রাতের শরীর চুঁইয়ে শিশির ঝরছে। দুহাতের অঞ্জলি পাতবে পাতবে করে হাতের মুঠো খুলতে পারছিল না সে। কেমন বিবশ হয়ে আছে। পিঠের নিচে ধানক্ষেতের নাড়া কেমন নিশ্চেতন। শিমুলের ডালে লক্ষ্মীপেঁচা ডেকে উঠল। দূরে কোথাও কেউ শাঁখ বাজাল। ফসলের গন্ধ নাকের ভেতর দিয়ে পেটে চালান হয়ে যাচ্ছে। ধঞ্চের ঘ্রাণে মুখর অন্ধকার। সে অন্ধকারে কোনও কিছুই ভালো করে ঠাহর হলো না। নিজের হাতটাও ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। তবে নিঃশ্বাসের শব্দ পাচ্ছে। তার মানে সে বেঁচে আছে।
ছেলেবেলায় একদিন এমন করে ঘাসের ভেতর শুয়েছিল। গরুর বাচ্চা খুঁজতে গিয়ে এই অভাবনীয় কাণ্ডটা ঘটেছিল। আজ খুব মনে পড়ল সেদিনটি।
সবুজ ঘাসের ভেতর গরুর বাচ্চাটা শুয়ে আছে। চারদিকে এত তোলপাড় করা ডাক, বাচ্চাটা শুনতেই পাচ্ছিল না। বাচ্চাটাকে খুঁজতে খুঁজতে সে হয়রান হয়ে গিয়েছিল। অথচ বাচ্চাটা কি নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে। তারপর সেও শুয়েছিল। ঘাসের নরম গা ছুঁয়ে চুপচাপ শুয়েছিল। কখন যে দুচোখের পাতা বুজে এসেছিল বলতেই পারে না। যখন ঘুম ভাঙল তখন দেখল সবাই উৎকণ্ঠায় তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। বেলা গড়িয়ে তখন বিকেল হয়েছে। খেতে বসে সবার রহস্যময় চোখমুখ খেয়াল করল। আর সন্ধ্যের দিকে যখন হুজুর এসে তাকে ঝাড়ফুঁক দিল, সে তখন অবাকই হয়ে গেল। আরও অবাক হওয়ার পালা তার কপালে ছিল। দেখল টেবিলে এক বোতল পড়া পানি। সময় করে তাকে সেটাও পান করতে হচ্ছে।
পাড়ায় চলতে-ফিরতে গিয়ে আরও টের পেল সবাই কানাকানি করছে তাকে নিয়ে। ব্যাপারটা কি! মুখরোচক কাহিনি। ডালপালা ছড়াতে থাকল। তার ওপর পরির নজর পড়েছে।
পরির নজর! কী করে সম্ভব ?
সম্ভব, সম্ভব, সবই সম্ভব। কারণ তাকে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি! তার মানে এত সময় সে পরির সঙ্গেই ছিল। কী এমন আছে তার ভেতর যে পরি তাকে পছন্দ করে ফেলেছে ? পরিটা কী ? ফাহাদের মাথায় ধরে না। মহিলারা, বাচ্চারা তাকে কেমন করে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। তার কাছে কেমন কেমন লাগে যেন!
পরি নিয়ে লোকজনের জিজ্ঞাসায় সে কোনও জবাব দিতে পারে না। লোকজনের কথায় কোনও যুক্তি সে দিতে যায় না। যুক্তি প্রমাণ দিতে তার ভালো লাগে না। কিসব বলে লোকজন! এতে হিতে বিপরীত হলো, লোকজনের সন্দেহ আরও ঘনীভূত। তাকে কেউ কেউ এড়িয়ে চলতে লাগল। আবার কেউ কেউ তাকে কাছে ডাকল। কারণ পরিকে তারাও চায়। তাকে ঘিরেই কেন ঘটনাগুলো ঘটতে শুরু করল তার কারণ সেও জানে না। তবে আর যা-ই হোক, সে কখনও পরি দেখেনি। কিন্তু এ কথাটি ফাহাদ কাউকেই বলতে পারে না। অন্তর্মুখী ফাহাদের আচার-আচরণ লোকজনকে আরও বেশি সন্দিহান করে তোলে। তারা জোর দাবি করে ছেলেটিকে পরিই ধরেছে।
কিন্তু সে কোনও পরিকে দেখতে পায় না। ও পাড়ার রূপসী মেয়েটি নাকি তার কথা উদগ্রীব হয়ে শোনে। ফজল এসে সে কাহিনি বলে আর দীর্ঘশ্বাস চাপে। কেন ফজল দীর্ঘশ্বাস চাপে ? কারণ পাড়ার এই মেয়েটিকে কেউ দেখেনি। তার গল্প শুনেছে সবাই। মেয়েটি নাকি পরির মতো। ফজলের কাছে এ গল্প শুনতে তার ভালোই লাগে। তবে যার গল্প সে শুনছে, তার সঙ্গে তার দেখা হয় না। আর এ আফসোস সে বুকে পুষে এক ধরনের প্রতীক্ষার প্রহর গোনে। নজর লাগা তরুণের প্রতি যে মর্ত্যরে পরির নজর লাগবে কে জানত! ফজল তাকে একদিন ঠিকই দেখা করিয়ে দিল সে পরির সঙ্গে।
নজর লাগা তরুণ ফাহাদ সেদিন কেমন ভিরমি খেয়ে চিন্তাভাবনার ঊর্ধ্বে উঠে গেল। তার মুখ দিয়ে কথা সরে না। তার চোখের পাতায় পলক পড়ে না। যার ফলে চোখে জল টলমল করে। কি অদ্ভুত এক ভালো লাগায় সে বিহ্বলতাড়িত হয়ে পড়ে তা সে কাউকে বোঝাতে পারে না। সে অনুভূতির কথা কেউ বুঝবে না-বলে সে কাউকে বলতেও যায় না।
পরি এসে ফাহাদের হাত ধরে। বলে, কি সমাচার ফাহাদ বাদশা ? তুমি নাহি পরির লগে সাক্ষাৎ করো!
ফাহাদ গভীর কুয়োয় হারিয়ে যেতে যেতে বলে, হ্যাঁ, পরিই তো আপনে ইয়াছমিন পরি তাই না ?
এ শুনে মেয়েটি খিল খিল করে হাসে। ফাহাদ অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে দেখে ইয়াছমিন পরির কোনও ডানা নেই। মর্ত্যরে মানবীর মতো তার চোখমুখ কান-হাত-পা চোখ। তবে তা অদ্ভুত ফর্সা। পরি বুঝি এমনই হয়! এ আবার কেমন ধারার পরি! তবে ইয়াছমিনকে খুব ভালো লাগে ফাহাদের। সারাক্ষণ ইয়াছমিনের সঙ্গে থাকতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সে ইচ্ছে পূরণ হবার নয়! কারণ ইয়াছমিন ইচ্ছে করলেই ঘরের বাইরে আসতে পারে না। ওদের বাড়ির বাউন্ডারির ভেতর ইয়াছমিনের পৃথিবী। সে পৃৃথিবীতে ফাহাদের প্রবেশ নিষেধ।
ফাহাদের পরির কথা জানতে বাড়িতে সময়-অসময় মানুষের আনাগোনা লেগেই থাকে। ফাহাদের বাবা এসব নিয়ে খুব মেজাজ দেখায়। এমনিতেই সে ফাহাদের মাকে সময়-অসময়ে দৌড়ের ওপর রাখে। তার ওপর নতুন ঝামেলায় ফাহাদের মা একেবারে নাকাল হয়ে পড়ে। ছেলের এমন অবস্থা দেখে ফাহাদের মাও বিরক্তি প্রকাশ করে। ফাহাদের ভেতর একধরনের অনুশোচনার জন্ম নেয় কিন্তু তাতে কারও বিরক্তি কমে না। সবাই শুধু দেখে পরির কারণে ফাহাদের আচার-আচরণ পাল্টে গেছে।
এরপর পরির কারণে সবকিছুই আরও পাল্টে গেল। প্রথমেই ফাহাদের মা আর ইয়াছমিন। আর এ জন্য সবাই ফাহাদকেই দোষী করে। লোকে বলে ফাহাদকে পরি না ধরলে এমনটা হতো না। ফাহাদকে পরি ধরাতে ওর মাকেও পরি ধরেছে। ফলে যা হবার তাই হয়েছে। কী হয়েছে ? ফাহাদের মা এক সকালে নিখোঁজ হয়ে গেছে। সবাই পরিকে দোষারোপ করলেও এর আসল কারণ একমাত্র ফাহাদই জানে তবে সে কথা সে কাউকে বলে না। কারণ মা যে রাতে চলে গিয়েছে সে রাতে ফাহাদের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। এবং সে পুরুষটির কণ্ঠ স্পষ্ট শুনতে পেয়েছে। মাকে যে সুখের ঠিকানায় পুরুষটি নিয়ে যাচ্ছে তাই ফাহাদ এতে বাধ সাধেনি। শুধু পেছন থেকে তার বোবা মনটি ‘মা মা’ বলে কেঁদেছিল।
গ্রামের লোকজন সবাই যখন তার দিকেই আঙুল তুলল তখন সে একেবারে কোণঠাসা হয়ে পড়ল। ওদের মূর্খতা দেখে মনে মনে সে বিরক্ত হলেও মায়ের আসল অন্তর্ধানের কাহিনি সে কাউকে বলেনি।
ইয়াছমিনের ব্যাপারটিও অনেকটা এমন। তবে কেউ তা জানে না। গ্রামে এমন একটি ব্যাপার ইয়াছমিন কেমনে গোপন রাখল সে কথা কারও মাথায় আসে না। ফাহাদ ব্যাপারটি বুঝেছিল। বুঝলেও সে কারও কাছে মুখটি খোলেনি। কারণ সবার মাথায় খালি পরি ঘোরে। আর সবাই পরি সংক্রান্ত ব্যাপারে ফাহাদকেই দোষী সাব্যস্ত করে। এর আড়ালে কি যে হয়ে যায় তা গ্রামের মানুষ উদ্ঘাটন করতে আরও সময় নেয়। ততদিনে যা হবার তাই হবে। কী হবে ? ইয়াছমিন যখন গ্রাম ছেড়ে চলে যায় আর তার দোষের ভার এসে পড়ে ফাহাদের ওপর। তখন ফাহাদ গ্রামের কতিপয় মানুষের মূর্খতায় মর্ম যাতনায় ছটফট করতে থাকে। একটা সুন্দর মন নিয়ে বেড়ে ওঠার যে স্বপ্ন ফাহাদ লালন করেছিল তা পড়শিদের কথায় আর এগোতে পারে না। ফাহাদের কী এমন বয়েস হয়েছে ? সবে নাকের নিচে সরু গোঁফের রেখা দেখা দিয়েছে। কিন্তু ফাহাদ মানুষের কথাকে সহ্য করতে পারে না। মানুষের জিহ্বার বিষ ফাহাদকে অস্থির করে তোলে। নির্ঘুম কাটে রাত। এই বিষের হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে ফাহাদ বিষের আশ্রয় নেয়। ফাহাদের মৃত্যুর আসল কারণ উদ্ঘাটন হয় না। লোকজন পরির নজরেই বন্দি হয়ে থাকে। পরিকে তারা কেউ দেখেনি। তবু তারা এই পরিকেই সকল ঘটনার মূলে রাখতে চায়। এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনার জন্য সে না-দেখা পরির নজরই দোষী সাব্যস্ত হয়।
ফাহাদ যে ঘটনার সাক্ষী ছিল, তা বলে গেলে হয়ত পরির নজরের একটা সুরাহা হতো। কিন্তু ফাহাদ তা করেনি, কারণ ফাহাদ জানে আসল সত্যটি মানুষ একদিন ঠিকই জানবে।
সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ