আর্কাইভগল্প

ভোঁদড়

রাসেল রায়হান

আজ রাতে হেনার আর ঘুম হবে না মনে হচ্ছে। যেদিকেই গাল রাখছে, কেমন শিরশির করছে। চোখের জলে ভিজে আছে পুরো বালিশ।

এতটা অশ্রুও জমা ছিল তার!

আছরের নামাজের পর বাবাকে শুইয়ে দিয়ে আসা হয়েছে কবরে। হেনা ভাবতে পারছে না, কীভাবে ওখানে একা থাকবে তার বাবা ? হ্যাঁ, বাবা সাহসী, সে জানে। বাবার বীরত্ব নিয়ে তার কোনও সন্দেহ নেই।

দিনের পর দিন গভীর রাতে জঙ্গলে থেকে যেতেন বাবা। হঠাৎ কোনও এক সকালবেলা ব্যাগভর্তি বাজার নিয়ে আসতেন―তেল, আলু, পটল, ডাল, চাল। কোনও কোনও দিন ঝুড়ি ভরে নিয়ে আসতেন মাছ।

মাসে একবার ভেড়ার মাংসও নিয়ে আসতেন। সেদিন ঈদ ঈদ লাগত হেনার। ভেড়ার নরম মাংস খেতে খুব পছন্দ করে সে।

বাবার পেছনে পেছনে গুটি গুটি পায়ে আসত পোষা ভোঁদড় ‘ভালু’ আর ‘কালু’। দুটিই দেখতে প্রায় হুবহু―ছোট কান, চওড়া মাথা, তেলতেলে শরীর, লম্বা লেজ আর হাঁসের মতো পা―আঙুলগুলো পাতলা পর্দা দিয়ে জোড়া লাগানো। এই পা দুটি দেখতেই হেনার সবচেয়ে ভালো লাগে। কী অদ্ভুত! আর ভালো লাগে গায়ে হাত বোলাতে। কী নরম―রেশমের মতো লোমে শরীরভর্তি। সম্ভবত খুব কাতুকুতু এদের শরীরে। হেনা হাত বোলালেই এরা মাটিতে গড়াগড়ি করে; প্রায় মানুষের মতো হাসে। সেই গড়াগড়ি দেখে আনন্দ পান হেনার বাবা, সুলতান।

সুলতানও খুব ভালোবাসতেন ভালু-কালুকে। হেনার জন্মের পরপরই শিশু অবস্থায় ভালু-কালুকে কিনে এনেছিলেন সুলতান। সারা মাসের আয়ের প্রায় অর্ধেক খরচ করেছেন এদের পেছনে। এরা মাছ খায়, ব্যাঙ খায়, কাঁকড়া খায়। যখন খুব ছোট ছিল, গরুর দুধ খাইয়েছেন এদের পেটভর্তি করে। এমনও হয়েছে যে হেনার খাওয়ার দুধ নেই, অথচ ভালু-কালু চুকচুক করে দুধ খাচ্ছে। হেনা লোভী লোভী চোখে তাকিয়ে থাকত। তখন তো খুব ছোট সে, অনেক কিছু বুঝত না।

এখন হেনার বয়স দশ বছর। অনেক কিছু বোঝে সে। ভালু-কালুকে সে আপন ভাইয়ের মতো দেখে। হেনার ভাগের দুধের সেই ঋণ অবশ্য ভালু-কালু শোধ করেছে হেনাকে অকৃত্রিম ভালোবেসে। হেনাকে দেখলেই তারা অবিকল শিশুর মতো হাসে। হাততালি দেওয়ার মতো ভঙ্গি করে। আরও নানান কারিকুরি করে হেনার সঙ্গে।

সুলতান মাঝেমাঝে হেনাকেও নিয়ে যান মাছ ধরতে। হেনার খুব ভালো লাগে মাছ ধরা দেখতে। বড় একটা জাল লম্বা বাঁশের দুই প্রান্তে বেঁধে নৌকা থেকে আড়াআড়িভাবে পানিতে নামিয়ে দেওয়া হয়―ওপরের দুই প্রান্ত নৌকার দুই গলুইয়ের কাছাকাছি বাঁধা। তখন স্রোতের বিপরীতে ধীরে ধীরে এগোতে থাকেন বাবা, হারুন কাকা আর অন্য সঙ্গীরা। লম্বা দড়িতে বাঁধা ভালু-কালুকে ছেড়ে দেওয়া হয় ডুবন্ত জালের দুপাশ থেকে। রশির অন্য প্রান্ত নৌকার সঙ্গে বাঁধা। পানিতে নামলেই কী যে আনন্দ করে ভালু-কালু। ডুব দেয়, আবার হুস করে ভেসে ওঠে। লুটোপুটি খায়। তারপর আবার ডুব দেয়।

এবার তারা মাছ ধরতে গেছে। জালের চারপাশে অনবরত ডুব দিয়ে শোল, ট্যাংরা, পুঁটিসহ কত কত পদের মাছ তাড়িয়ে জালের দিকে নিয়ে আসে ভালু-কালু। হেনা জানে যে মাছ কত পছন্দ এদের, তবু নিজেরা না খেয়ে কচুরিপানা আর জলজ পাতা সরিয়ে সরিয়ে মাছের খোঁজ এনে দেয়। একসময় জাল ভরে ওঠে। তখন বাবা, হারুন কাকারা নৌকায় থাকা বাঁশের প্রান্তে উঠে বসেন, তরতর করে জাল পানির ওপরে উঠে আসে। অনেক সময় এত পরিমাণ মাছ জালে উঠে আসে যে জাল তুলতে গলদঘর্ম হয়ে যেতে হয় সুলতান-হারুন কাকাদের। মাছের লাফ-ঝাঁপ দেখে ভালু-কালুও খুব খুশি হয়। সুলতান তখন তাদের দিকে মাছ ছুড়ে দেন। বেছে বেছে কাঁকড়া, খলসি মাছ ছুড়ে দেয় হেনাও।

একসময় প্রায় সব বাড়িতেই ভোঁদড় ছিল। হাজার দশেক টাকায় একটা ভোঁদড় কিনতে পাওয়া যায়। এখন অবশ্য কমে গেছে ভোঁদড় দিয়ে মাছ ধরা পরিবারগুলো। ভোঁদড় আছে―এমন পরিবার নেমে এসেছে তিন ভাগের এক ভাগে। সেই তিন ভাগের এক ভাগে পড়ে হেনারা। তাদের দুইটা ভোঁদড়। শিশু অবস্থায় বারো হাজার টাকায় এদের কিনেছিলেন সুলতান।

হেনার মা মালিহা পাশে শুয়ে আছেন। উনিও ঘুমাতে পারছেন না নিশ্চয়ই। বারবার এপাশ-ওপাশ করছেন। হেনার ধারণা, মায়ের বালিশও ভিজে আছে। তার নিজের বালিশের চেয়ে বেশিই ভিজে আছে। মা যে কত ভালোবাসতেন বাবাকে, হেনা কি তা বোঝে না ? জানে না সে ?

সেই দুপুরে যখন বাবার বাঘে খাওয়া ছিন্নভিন্ন লাশ নিয়ে এল হারুন কাকা, কামরুল কাকারা, তখন থেকেই কেঁদে যাচ্ছেন মালিহা। শুরুতে তো আছাড়িপিছাড়ি কাঁদছিলেন। মায়ের কান্না দেখেই বুঝি হেনার মনে হলো, তার কাঁদা উচিত। বাবা যে মারা গেছেন, সেই মৃত্যুর ঠিক কী কী মহিমা থাকতে পারে, গ্রামের একটি দশ বছরের মেয়ের তা না বোঝা খুবই স্বাভাবিক।

আবার পাশ ফেরে হেনা। একবার মায়ের ফোঁপানির আওয়াজ পেল বোধ হয়। কান্না শুনতে পাওয়ার ব্যাপারটি ধরা দিল না সে। সামান্য কিছু বলতে গেলেই যে আবার হাউমাউ করে কেঁদে উঠবেন মা, হেনা সেটা ভালো করেই বোঝে। হেনা তা সইতে পারবে না। মায়ের কান্না সে সইতে পারে না মোটেও।

অবশ্য বাবাকে কখনও কাঁদতে দেখেনি হেনা। নিশ্চয়ই বাবার কান্নাও তার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব হতো না। আর ধৈর্য রাখতে পারল না ছোট্ট মেয়েটি। ফিসফিস করে বলল, ‘আম্মা, ঘুমাও না কেন ?’

হেনাকে টেনে বুকে সঙ্গে প্রায় মিশিয়ে ফেললেন তার মা মালিহা। যা ভেবেছিল, তা-ই। জোরে জোরে কেঁদে উঠলেন মালিহা। হেনাও কেঁদে উঠল তখন। সেই কান্নার সমান্তরালে হারুন কাকার পোষা কুকুরটাও ডেকে উঠল করুণ সুরে। দূর কোনও ঘর থেকে কে যেন চেঁচিয়ে উঠল, ‘চুপ কর কুত্তা। এই রাত্তিরেও ঘুমাইতে দিবি না!’

নিজাম উদ্দীন কাকার গলা। কাকা এই গ্রামের প্রধান। ওই তো, কয়েক বাড়ি পরেই তিনি থাকেন। হেনা শুনেছে, নিজাম কাকার অনেক টাকা। যাদের অনেক টাকা, তারা নাকি যা খুশি তা-ই করতে পারেন―বাবা বলেছিলেন। ‘যা খুশি, তা-ই’ মানে ঠিক কী কী করতে পারেন, হেনা বোঝে না। তবে গত বছর যখন একদম বৃষ্টি হচ্ছিল না গ্রামে, মানুষজন হাহাকার করছিল এক ফোঁটা বৃষ্টির জন্য, তখন যে বৃষ্টি নামাতে পারেননি কাকা, সেটা সে জানে। বাবাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিল হেনা, ‘কই আব্বা, আপনে না বলছিলেন যে নিজাম কাকা যা খুশি তা-ই করতে পারেন, তার কাছে বলেন না কেন বৃষ্টি নামানোর জন্য ?…’

শুনে ঠা ঠা করে হেসে উঠেছিলেন হেনার বাবা। সেই হাসি থামছিলই না তার। শেষে তো মা কড়া ধমক দিলেন বাবাকে, ‘থামো! কী হইছে ? শুধু শুধু হাসতেছ কেন ?’

ধমক খেয়েও বাবা থামছিলেন না। হেনা ঠিক বুঝতে পারেনি সেদিন কেন অমন ঠা ঠা হেসে উঠেছিলেন বাবা।

সেই নিজাম উদ্দীন কাকা অমন চিৎকার করে ঠিক কাকে থামতে বললেন, কুকুরকেই, না আম্মাকে―বোঝা গেল না। তবে ধমক শুনে মালিহা থেমে গেলেন। কুকুরটা আরেকবার সুর দিয়ে কেঁদে থেমে গেল। বারদুয়েক নাক টানলেন মালিহা। হেনাকে আরও চেপে ধরলেন, যেন পাঁজর ভেদ করে বুকের মধ্যেই ঢুকিয়ে ফেলবেন। তারপর ফিসফিস করে বললেন, ‘বাবার জন্য পরান পোড়ে, মা ?’

হেনা মাথা ঝাঁকাল, পোড়ে। সম্ভবত তার মনে হলো যে এই ঘুটঘুটে অন্ধকারে আম্মা তার মাথা নাড়া দেখবেন না, তাই দ্বিতীয়বার শব্দ করল সে, ‘হুম।’

‘পরান পুইড়া লাভ নাই, মা। তোমার বাবারে বাঘে মাইরা ফালাইছে। তোমার বাবা আর ফিরা আসবে না।’

একটুক্ষণ থেমে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাবার গল্প শুনবা ? তোমার বাবা খুব বীর আছিল। বাবার কুমির মারা গল্প শুনবা ?’

হেনা মাথা ঝাঁকায় আবার, শুনবে।

মালিহা বলতে থাকেন, ‘হারুন কাকা আছে না তোমার, তার বাবা আর তোমার কাকায় গেছিল জঙ্গলের  ভেতরে, মাছ ধরতে। তখন তারা জঙ্গলের অনেক  ভেতরে যাইত মাছ ধরার জন্য―গহিন থেকে গহিনে। বড় বড় মাছ পাওয়া যাইত। কী যে সাহস আছিল! ছোট্ট একটা ডিঙ্গি, তার মইধ্যে দড়ি, কয়েকটা হাঁড়িপাতিল, দুটা বল্লম, লাঠি আর টর্চ―এই কয়টামাত্র জিনিস নিয়া জঙ্গলে যাইত তারা। বাঘ, কুমির, যে-ই আসুক, এই কয়টা জিনিস নিয়াই লোক দুইটা টানটান হইয়া দাঁড়ায়া যাইত।…’

হেনা টের পায়, বলতে বলতে আম্মাও বুক টানটান করে ফেলেন। মালিহা আগের কথার রেশ ধরে বলে যেতে থাকেন, ‘দুইটা মানুষ দিনের পর দিন জঙ্গলে যাইত। আসার সময় আসত নৌকাভরা মাছ নিয়া। আর বাঘের টের পাইলে ওই হাঁড়িপাতিল বাজাইত লাঠি দিয়া। বাঘ আর কাছে ভিড়ত না।

‘তো একদিন এমনই জঙ্গলে গেল দুজনে। গভীর রাইত। তোমার বাবার হাতে বৈঠা। হারুন ভাইয়ের বাবা বসে আছেন টর্চ হাতে। একটু পরপর টর্চ জ্বালায়াই আবার নিভায়া ফেলতে হয়। এমন করলে ব্যাটারি ক্ষয় হয় কম। হঠাৎ টর্চের আলো জ্বালাইতেই হারুন ভাইয়ের বাবায় দেখল, সামনে কী যেন জ্বলজ্বল করতেছে। যা বোঝার বুইঝা গেল দুইজনই। কুমির! বিশাল সাইজের এক কুমির। মুহূর্তের মইধ্যে তোমার বাবায় বল্লমটা হাতে নিল। তারপরই ছুড়ল কুমিরের মাথা আর শরীরের ঠিক মাঝখানে। এক্কেবারে ঘ্যাচাৎ!…’

বলে একমুহূর্ত থামলেন হেনার মা। যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন কুমির শিকারের সেই দুর্লভ দৃশ্য। আবার বলা শুরু করেন, ‘বল্লমের পেছন আগে থেকেই লম্বা দড়ি দিয়া নৌকার সঙ্গে বান্ধা আছিল। তো কুমির তো ছুটল উল্টা দিকে। পিছন পিছন নৌকা। শাঁ শাঁ কইরা ছুটতেছে। ছুটতে ছুটতে ছুটতে ছুটতে কুমির তো গেল ক্লান্ত হইয়া। কত আর ছুটবে! আস্তে আস্তে কুমিরের গতি আসল কমে। তখন তোমার বাবায় ছুড়ল আরেকটা বল্লম। কুমির তো সেইখানেই মারা পড়ল। পরদিন সকালে দেখলাম দুইজনে মাছের বদলে নিয়া আসছে ইয়াব্বড় এক কুমির।’―দুই হাত প্রসারিত করে দেন মা। তার উষ্ণ হাত হেনার কাঁধে ঠেকে।

মালিহা বলে যাচ্ছেন, ‘কত মানুষ আসছিল সেই কুমির দেখতে! অনেক দামে বেচছিল কুমিরটা। সেই টাকা হারুন ভাইয়ের বাবা আর তোমার বাবায় সমান ভাগ কইরা নিল।…এই হইল তোমার বাবা। মহাবীর!’

একনিশ্বাসে বলে এবার দীর্ঘ দম নেন মালিহা। তারপর যেন আবার মনে পড়ে যায় তার স্বামীর কথা। মনে পড়ে যায় যে সকালে স্বামীর ক্ষত-বিক্ষত মৃতদেহ ফেরত এসেছে। মাথাটা ছিঁড়ে নিয়ে গেছে বাঘ।

তীক্ষè সুরে কেঁদে ওঠেন আবার, ‘সেই তোমার বাবারে বাঘে খাইয়া ফালাইল। তিন-চাইরটা মানুষ, কেউ বাঁচাইতে পারল না।’

হেনাও গলা মেলায় মায়ের সঙ্গে। দুজনের কান্না শুনে পোষা কুকুরটাও কেঁদে ওঠে আবার। পুরনো ধমকটিও শোনা যায়―নিজাম উদ্দীনের গলা।

দুই

কী যে করবেন, ঠিক বুঝতে পারছেন না মালিহা। মেয়ের চোখের দিকে সরাসরি তাকাতে পারছেন না। লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে তার। কিন্তু উপায়ও তো নেই। চার দিন ধরে শুধু চিড়া খেয়ে আছেন দুজন। শরীর কাঁপছে ক্ষুধায়, লজ্জায় আর ভয়ে।

হেনার বাবা মারা যাওয়ার দুমাস পরই ভালু আর কালুকে মালিহা বিক্রি করে দিয়েছেন আঠারো হাজার টাকায়। ভালু-কালুকে যখন দড়ি বেঁধে নিয়ে যাচ্ছিল ক্রেতা লোকটি, এমন গড়াগড়ি করছিল তারা। এই প্রথম মনে হয়েছিল, ভালু-কালু কাঁদছে―অবিকল মানুষের মতো।

কাঁদছিল হেনাও। হ্যাঁ, মালিহাও কি কাঁদছিল না ? সেই কান্না সে বুকের মধ্যে চেপে রেখেছে।

সুলতান মারা যাওয়ার দিন তিনেক পরই নিজাম কাকার চাকর সালেক এসেছিল ভালু-কালুকে কিনতে। দশ হাজার দেবে বলেছিল। মালিহা বিক্রি করেননি। চেয়েছিলেন বেচবেন না কখনও। নিজেরা যেভাবে বাঁচেন, সেভাবেই ভালু-কালুও বাঁচবে। কিন্তু এই জেদ বজায় রাখতে পারেননি মালিহা। একসময় ঠিকই বেচতে হলো। নিজেদেরই খাবার জুটছে না, ভোঁদড়দের খাওয়াবে কে ?

কত দিন বাবার সঙ্গে হেনা গিয়েছে মাছ ধরতে। পানিতে নিখুঁত ভঙ্গিমায় ঝাঁকি-জাল ছোড়া শিখে ফেলেছিল। একদিন মালিহা দেখে ফেলেন সে দৃশ্য―কেমন যেন একটি কুঁড়ি বাতাসেই ফুল হয়ে ফুটে টুপ করে ডুব দিল পানিতে! সে দৃশ্য দেখে মালিহার মেজাজ এমন খারাপ হলো যে সেই সৌন্দর্য তার চোখেই লাগল না। মালিহা তখনই চেঁচিয়ে উঠলেন স্বামীর সঙ্গে, ‘আমার মাইয়ারে কি জাইল্যা বানাবা ? ওরে লেহাপড়া শিখামু আমি। আর একদিন যদি ওরে নিয়া মাছ ধরতে আসছ তুমি!’

আর কখনও হেনাকে নিয়ে বাবা মাছ ধরতে যাননি।

সুলতান মারা যাওয়ার মাস ছয়েক পর এক হাড় ঝিম ধরা রাতে সেই জাল ছোড়ার দৃশ্য মনে পড়ে যায় মালিহার। চার দিন ভাত না খেয়ে আছেন। কেউ কাজ দিচ্ছে না। কী করবেন তিনি ছোট এই মেয়েটাকে নিয়ে ? ‘বাঘবিধবাদের একটা ভাতা দেয় সরকার, নানান ছুতোয় সে ভাতা জোটেনি মালিহার কপালে। বরং ভাতার পেছনে ছুটতে ছুটতে ছেঁড়া জুতার তলাই ক্ষয় হয়েছে কেবল। চার দিন চিড়া খেয়ে থাকার পর পঞ্চম দিনের গাঢ় রাতটিতে সন্তর্পণে ঠেলে তোলেন হেনাকে, ‘হেনা, ও হেনা, ওঠ। ওঠ। চল তো।’

ধড়মড় করে উঠে বসে হেনা।

মালিহা বলেন, ‘মাছ ধরতে পারবি না ?’

হঠাৎ ঘুম ভাঙায় হেনা কিছুই বুঝতে পারছিল না। সে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। মালিহা আবার বললেন, ‘জাল ছুড়তে পারবি ?’

হেনা মাথা নাড়ল, পারবে।

‘চল। কেউ টের না পায়।’

হেনা উঠে চৌকির নিচ থেকে বহু কষ্টে টেনে বের করে বাদামি রঙের ঝাঁকি-জাল। তার ভয় লাগছে খুব। উত্তেজনাও বোধ করছে একরকম।

…অন্ধকারে ক্ষুধার্ত কোনও বিড়ালের মতো বেরিয়ে পড়ে একজোড়া প্রাণী।

তিন

প্রথমবার জাল ছুড়ল হেনা। সেই পুরোনো দৃশ্য। যেন একটি কুঁড়ি পাপড়ি মেলে ফুল হয়ে ফুটে নিপুণ ভঙ্গিমায় ঝাঁপিয়ে পড়ল পানিতে। ‘ঝুপুস’ করে একটি শব্দ হলো।

মালিহা শক্ত হাতে খামচে ধরেন হেনার কাঁধ। ফিসফিস করে বলেন, ‘মা, আস্তে। কেউ টের না পায়।’

কাঁধে রাখা হাতটার কাঁপুনি লুকাতে পারছেন না মালিহা। হেনাকে তিনি বলেননি যে নিজাম উদ্দীনের পুকুরে তারা মাছ চুরি করতে এসেছেন। বলা সম্ভবও নয়। তবে হেনার এই ব্যাপারটা না বোঝার যে কোনও কারণ নেই, সেটা বোঝেন মালিহা। যতটা সম্ভব নিঃশব্দই থাকতে চাইছে মেয়েটা। তবু একটা ঘাসের ওপরে পা পড়লেও যেন সেই শব্দ কানে আসছে মালিহার। কেঁপে কেঁপে উঠছে শরীর।

দ্বিতীয়বার জাল ছুড়তেই জাল পড়ার আওয়াজ ছাপিয়ে ভেসে এল গমগমে একটা স্বর, ‘কে রে ? মাছ ধরে কোন কুত্তার বাচ্চায় ? ধর তো!’ নিজাম উদ্দীনের গলা।

শরীরে যেন তীব্র একটা ঝাঁকি অনুভব করেন মালিহা। ওই একটি ডাকে কী যে হয়ে যায় তার! মুহূর্তের মধ্যে মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। তার মনে থাকে না যে ছোট্ট একটা মেয়ে―তার নিজের মেয়ে―সঙ্গে এসেছে, তার কী হবে ? একটি চিন্তাই তাকে আচ্ছন্ন করে কেবল―নিজেকে রক্ষার চিন্তা। তার সমস্ত ইন্দ্রিয় যেন ভোঁতা হয়ে গেছে। যেন এই পৃথিবীতে একমাত্র তিনি আর নিজাম উদ্দীন―এই দুটি প্রাণীরই অস্তিত্ব আছে।

মালিহা যখন কিছুটা স্বাভাবিক, টের পান তিনি ছুটছেন। ছুটছেন ছুটছেন ছুটছেন…ততক্ষণ ছুটতে থাকেন, যতক্ষণ না মনে হয় যে পা ছিঁড়ে গেছে হাঁটুর নীচ থেকে।

ঘরের সামনে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যান। শরীরটাকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে ওঠান ঘরে। তারপর দরজার খিল লাগিয়ে মেঝেতে পড়ে যান।

চার

পরদিন সকালে জ্ঞান ফেরে মালিহার। মনে হয় যেন কেউ দরজা ভেঙে ফেলছে। বাইরে থেকে মানুষজনের চিৎকার-চেঁচামেচি ভেসে আসছে। পরিস্থিতি বুঝতে একমুহূর্ত দেরি হয়। পরক্ষণেই মনে পড়ে যায়, গতরাতে কী ভুল করেছেন তিনি! কী বিপদের মুখে ফেলে এসেছেন ছোট্ট মেয়েটাকে ? কেমন আছে মেয়েটা এখন ? বেঁচে আছে ? আর কখনও দেখতে পাবেন তাকে ?

‘ও আল্লাহ’ বলে একটি চিৎকার দিয়ে বাইরে বের হন মালিহা।

হ্যাঁ, দেখতে পেয়েছেন মেয়েটাকে। উঠানে অনেক অনেক মানুষ জড়ো হয়ে আছে। ভিড়ের মাঝখানে দলা পাকিয়ে পড়ে আছে ছোট্ট একটা শরীর। হলুদ একটা কাপড়ে ঢাকা। কাপড়টা বারবার সরে যাচ্ছে বাতাসের তোড়ে। সরে না গেলেও বুঝতেন, নিস্তরঙ্গ, স্থির, নগ্ন শরীরটা তার মেয়ে হেনার।

চিল-মাতার মতো এক উড়াল দিয়ে যেন মালিহা পড়েন হেনার ওপর।

পাঁচ

হেনার মৃত্যুটা রহস্যই থেকে গেল। শুধু জানা গেল তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে। আশপাশে কোনও থানা নেই। দূরে যে থানা আছে, একবার গিয়েছিলেন, আক্ষরিক অর্থেই ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করা হয়েছে তাকে।

এরপর গ্রামপ্রধানের কাছে যান মালিহা। পা জড়িয়ে কাঁদতে থাকেন, ‘আমার মেয়েটার হত্যার বিচার করেন…’

আজ বিচার হচ্ছে। তবে সেই বিচার ধর্ষণের নয়, চুরির। গনগনে সূর্যের নীচে জুতার মালা গলায় পরিয়ে গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে মালিহাকে। ঠিক করা হয়েছে, বুধবার রাতে নিজাম উদ্দীনের পুকুরে মাছ চুরি করতে যাওয়ার কারণে তাকে জুতার মালা গলায় দিয়ে গ্রাম ঘোরানো হবে। তার আগে তাকে বিশটি বেতের ঘা মারা হয়েছে। আধমরা মালিহা প্রায় ঝুলে আছেন গাছের সঙ্গে। শক্ত করে বাঁধা দড়ি তাকে পড়ে যেতে দিচ্ছে না। এখন অপেক্ষা করা হচ্ছে নিজাম উদ্দীনের আসার। তিনি এলেই এই ‘গ্রাম-ভ্রমণ’-এর প্রক্রিয়া শুরু হবে।

আধঘণ্টা বাদে নিজাম উদ্দীন এলেন। গদগদ হাসি মুখে ঝুলিয়ে, বিনয়ে মাটির সঙ্গে প্রায় মিশে গিয়ে নিজাম উদ্দীন বললেন, ‘আহা, আমার জন্য আবার অপেক্ষা কেন ? আগেই তো শুরু করতে পারতেন আপনারা। শুধু শুধু গণ্যমান্য মানুষগুলারে রইদের মইধ্যে দাঁড় করায়া রাখছেন! …আচ্ছা, শুরু করেন এবার।’

শুরু হলো মালিহাকে গ্রাম ঘোরানো। তার কোমরে দড়ি বাঁধা। দড়ি ধরে আছে নিজাম উদ্দীনের খাস চাকর সালেক। কাজটা করে সে বিমলানন্দ উপভোগ করছে।

সালেকের খুব শখ ছিল, একজোড়া ভোঁদড় পুষবে―ঠিক সুলতানের মতন। দড়ি বেঁধে ভোঁদড়গুলোকে নদীতে ছেড়ে দেবে সে। গভীর জলে ডুব দিয়ে তারা মাছ ধরে আনবে সালেকের জন্য। বাঘের আক্রমণে সুলতান মারা যাওয়ার পরপরই সালেক মালিহাকে বলেছিল যেন তার কাছে ভোঁদড় জোড়া বেচে দেয়। মালিহা বিক্রি করেননি। সেই অপমান এতদিন হাড়ের মতো বিঁধে ছিল সালেকের গলায়। এত দিনে লাঘব হলো তা।

দড়ির অন্য প্রান্তে ভোঁদড় থাকলে এত আনন্দ নিশ্চয়ই সালেক পেত না। মালিহা হয়তো পোষা ভোঁদড়ের মতো তাকে মাছ এনে দিতে পারবে না, তবে তার মেয়েটা―হেনা―মেয়েটাকে যখন মাটিতে ফেলে প্রায় পিষছিল নিজাম উদ্দীন, পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছে সালেক। সেই দেখার আনন্দ মাছ পাওয়ার আনন্দের তুলনায় অনেক গুণ বেশি। প্রায় হাজার গুণ তো হবেই।

সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button