আর্কাইভগল্প

প্রথম স্পর্শ

সুজন বড়ুয়া

মোবাইল ফোনটা বেজে উঠতেই কাজ থামায় সুহাস। কম্পিউটারের স্ক্রিন থেকে চোখ ফেরায় মোবাইলে। মোবাইলের স্ক্রিনে রতনের নাম ভাসছে। ছেলেবেলার সহপাঠী-বন্ধু রতন। চট্টগ্রামেই থাকে। শহরে ছোটখাটো ব্যবসা করে। মাঝে মাঝে ফোন করে আনন্দ-বেদনার সংবাদ দেয়। অযথা গাল-গল্প ওর তেমন পছন্দ নয়। তাছাড়া ও জানে সুহাস ঢাকায় খুব ব্যস্ত থাকে। খবর জানানোটাই ওর কাছে বড়। যেন এটা ওর দায়িত্ব।

সুহাস মোবাইল তুলে হ্যালো বলতেই ওপাশে রতনের কন্ঠ, কেমন আছিস বন্ধু ?

এই আছি এক রকম। তোরা কেমন আছিস ?

রতন বলে, আমরাও মোটামুটি আছি। কিন্তু একটা খবর তোকে বলা দরকার।

কী খবর ? বল, বল।―সুহাস যেন শোনার জন্য অস্থির।

নিপা খুব অসুস্থ রে।

নিপা! ―আচমকা নিপার নাম শুনে চমকে ওঠে সুহাস ।

হ্যাঁ নিপা, তোর সেই নিপা। ও চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি আছে।―রতনের গলা কেমন নিষ্প্রাণ শোনায়।

সুহাস সামলে ওঠার চেষ্টা করে, ও আচ্ছা, কী হয়েছে নিপার ?

আরে কিডনি, লিভার এসব জটিল সমস্যা নাকি। যাক, তুই ভালো থাকিস।―বলতে বলতেই ফোন কেটে দিল রতন।

সুহাস চেয়ারে বসে থাকে চুপচাপ। সামনে কম্পিউটার খোলা। বাসার কম্পিউটারেই কাজ করছিল ও। আজ অফিস বন্ধ। কিন্তু অফিসের কাজই করতে হচ্ছে বাসায়। এজিবির অডিট বিভাগে চাকরি করে সুহাস। সুপারিন্টেডেন্ট। দু’তিন জনের দল নিয়ে বিভিন্ন সরকারি অফিসে অডিট করতে হয় ওকে। অডিটের সেই রিপোর্ট পেশ করতে হয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে। সেইরকম একটি অডিট রিপোর্ট তৈরি করছিল আজ। তখনই এলো রতনের ফোন। বলল, নিপা অসুস্থ। মেডিক্যালে ভর্তি।

নিপা অসুস্থ। বুকটা হঠাৎ ধক করে ওঠে সুহাসের। কিন্তু কী করবে সুহাস ? কী করার আছে ওর! কম্পিউটারের স্ক্রিনে তাকিয়ে আছে আনমনে। কালো অক্ষরগুলো এখন আর দেখতে পাচ্ছে না কিছুই। ওর চোখের পর্দা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে নিপা। ঝলমলে হাসিমাখা সেই মুখ। ডাগর চোখের দুষ্টুমি ভরা চাহনি। মখমলের মতো কোমল মসৃণ ত্বক। সুহাস ফিরে গেল পঁচিশ বছর আগের জীবনে।

দুই

গ্রামের কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছে সুহাস। বাড়ির কড়াকড়ি এখন আর নেই। রেলওয়ে বিভাগে চাকরি করেন বাবা। চট্টগ্রাম থাকেন শহরে। বাড়িতে ওরা তিন জন। মা, সুহাস আর ছোট বোন। ছোট বোন গ্রামের স্কুলে সিক্সে পড়ে। সুতরাং বাড়িতে যখন তখন সুহাসকে আর ঘাটায় কে ?  কলেজ, খেলাধুলা, আড্ডা এসব করে ওর সময় কাটছে ফুরফুরে। এর মধ্যেই গ্রামের এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় বাড়িতে টিউশনি জুটে গেল ওর। পড়াতে হবে দুই ভাইবোনকে। গ্রামের স্কুলে সিক্স-সেভেনে পড়ে ওরা। শুভ-দীপা ওদের নাম।

সন্ধ্যায় ওদের পড়াতে যায় সুহাস। পায়ে হেঁটে দশ মিনিটের পথ। দেড় থেকে দুই ঘণ্টা পড়ায় ওদের। বাড়ি ফেরে রাত নয়টার দিকে।

তিন মাস পর। বার্ষিক পরীক্ষা শেষ। ছাত্ররা নতুন ক্লাসে উঠেছে। সুহাস নিয়মিত পড়াতে যায় না এখন। ছাত্রদের বলে এসেছে, তোমরা নিজেরা নিজেরা কদিন পড়। স্কুল ভালোভাবে শুরু হলে আমি আসব।

দিন সাতেক পর আজ পড়াতে গিয়েছে সুহাস। ঘরে ঢুকেই একটু থমকে দাঁড়াতে হলো ওকে। শুভ-দীপার সঙ্গে টেবিলে আরও একটি মেয়ে বসা। আগে কখনও ওকে দেখেছে বলে মনে হয় না। সালোয়ার কামিজ পরা, ফর্সা গোলগাল সুশ্রী অবয়ব। ঘন কালো চুলের একটি মোটা বেণি গড়িয়ে পড়েছে পিঠে। ওর সামনে টেবিলের ওপর একটি বই খোলা।

সুহাসকে দেখে শুভ-দীপা দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা জানায়। মেয়েটি বসেই আছে আগের মতো। শুধু একটু নড়েচড়ে যেন জড়োসড়ো হয়ে বসেছে। বই থেকে চোখ তুলে তাকায়। সপ্রতিভ হাসি হাসি মুখ। হাসির ভেতরেই যেন অনেক কথা ছড়ানো।

সুহাস চেয়ারে বসতেই শুভ বলে, ও আমার দিদি নিপা। এখন থেকে দিদিও আপনার কাছে পড়বে।

সুহাস চুপচাপ নিপার দিকে তাকায়। নিপা ততক্ষণে বইটা বন্ধ করে হাতচাপা দিয়ে বসেছে। নিজেই শুরু করে কথা বলা। ওর কথায় কোনও রাখঢাক নেই। আবদেরে গলায় বলে, আমি পড়ব, কিন্তু ‘আপনি’, ‘স্যার’ এসব বলতে পারব না।

নিপা এবার ক্লাস নাইনে উঠেছে। শহরের স্কুলে পড়ত এতদিন। শহরেও একটি বাসা আছে ওদের। নিপার বাবার দুই বিয়ে। ছোটমাকে নিয়ে বাবা থাকেন শহরে। এতদিন নিপাও সেখানে ছিল একসঙ্গে। চট্টগ্রাম বন্দরে চাকরি করেন বাবা। ছোটমা হাসপাতালের নার্স। বাবার ওই সংসারে দুই ছেলে। পাঁচ আর তিন বছর ওদের বয়স। ওদের দেখভালের জন্য আয়া আছে একজন। সকালে বাবা আর ছোটমা চলে যান অফিসে। তারপর নিপা স্কুলে যায়, আসে একা একা। এই নিয়ে গ্রামে মা থাকেন বড় দুশ্চিন্তায়। তাই নিপাকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে গ্রামের বাড়িতে। বাবা গ্রামের বাড়ি আসেন মাসে এক বা দুই বার। ছোটমা বাড়ি আসেন খুব কম।

সুহাস একটু অপ্রস্তুত। তবে মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নেয় ভেতরে ভেতরে। হালকা গলায় বলল, ‘আপনি’, বা ‘স্যার’ বড় কথা না, ঠিকমতো পড়াশোনা করাটাই বড়। তা এখন কোন বই পড়ছ তুমি ?

শরৎচন্দ্রের বই পড়ছি, বড়দিদি।

ওহ, আচ্ছা। কিন্তু ওটা তো বড়দের বই। বিন্দুর ছেলে, রামের সুমতি এসব পড়েছ ?

হ্যাঁ, সেই কবে! বড়দের ছেটোদের আলাদা বই কী। আমি যা বুঝতে পারি তা-ই পড়ি।

বাহ, বেশ। তুমি বুঝি নিয়মিত বাইরের বই পড় ?

হ্যাঁ, কত!

তো এত বই পাও কোথায় ?

স্কুলের লাইব্রেরি আর ক্লাসমেট বন্ধুদের কাছ থেকে। আচ্ছা, তুমি কি বই পড় ?

হ্যাঁ, পড়ি, কিন্তু এখানে তো বেশি বই পাওয়া যায় না। এটা গ্রাম না!

তাইতো, আমিও ভাবছি, এখানে কোত্থেকে নতুন বই পাব। তা তুমি যখন বই পড়―আচ্ছা এমন কি হতে পারে না, তুমি নতুন যে বই পড়বে, পড়ার পর সেটা আমাকে দিলে!

সুহাস নিপার চোখে চোখ রেখে হাসে। মনে মনে ভাবে, কী অদ্ভুত মেয়ে! এই বয়সে এমন বইয়ের পোকা! শহুরে মেয়েরা বুঝি এমনই হয়!

একটু পর টেবিল ছেড়ে উঠে যায় নিপা। পা বাড়ায় ভেতরের ঘরে। খানিক পর ফিরে আসে আবার। ওর হাতে একটি ট্রে, ট্রে ভর্তি জলখাবার।

পরদিন সন্ধ্যায় সুহাস নিপার জন্য দুটি বই নিয়ে হাজির। একটি কাজী আনোয়ার হোসেনের কুয়াশা সিরিজের ধ্বংস পাহাড়, অন্যটি রোমেনা আফাজের আলেয়ার আলো।

নিপা ধ্বংস পাহাড় বইটি হাতে নিয়ে বলে, আরে এটি তো আমার পড়া। কুয়াশা সিরিজের অনেক বই আমি পড়েছি।

সুহাসের অবস্থা যেন ফুটো বেলুন। নিপা আঁচ করতে পেরে সহসা কথা ঘুরিয়ে বলে, তবে আমি পড়েছি অনেক আগে। কাহিনিটা প্রায় ভুলেই গিয়েছি। দ্বিতীয় বার পড়তে আমার খারাপ লাগবে না। রোমেনা আফাজের এ বইটি তো নতুন। বই দুটি আনার জন্য ধন্যবাদ।

গ্রামের স্কুলে ক্লাস নাইনে ভর্তি হয়ে গেল নিপা। বাড়ি থেকে তিন কিলোমিটার দূরে স্কুল। পায়ে হেঁটে যাওয়া-আসা করতে হয় স্কুলে। দশটা-চারটা স্কুল। সন্ধ্যায় সুহাস যায় পড়াতে। ছুটির দিন বাদে সপ্তাহের প্রায় সব দিন পড়ায় ও। পড়ার ফাঁকে চলে ভালো লাগা, মন্দ লাগা নানা গল্প-কথা। কখনও মিষ্টি খুনসুটি।

গ্রাম হলেও এটি একেবারে অজপাড়া গাঁ নয়। যদিও এখনও বিদ্যুৎ আসেনি, অন্য সব সুবিধা মোটামুটি হাতের নাগালে। পায়ে হাঁটা দূরত্বেই থানা, বাজার, স্কুল কলেজ। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের একটি ধারাও এখানে বহমান। ছেলেমেয়েদের ক্লাব আছে। ক্লাব থেকে বার্ষিক সাংস্কৃতিক, ক্রীড়া অনুষ্ঠান, বর্ষবরণ এসব আয়োজন করা হয় নিয়মিত।

অল্প কদিনের মধ্যেই গ্রামের আলো-হাওয়ার সঙ্গে একেবারে মিশে গেল নিপা। ক্লাব অনুষ্ঠান বিতর্ক গল্প বলা গান গাওয়া সবকিছুতে ওর প্রবল আগ্রহ এবং সপ্রতিভ উপস্থিতি। অবশ্য এর পেছনে সুহাসের ইন্ধন সবসময় সক্রিয়।

এবার গ্রামে বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হলো। অংশগ্রহণ করে গ্রামের ছেলেমেয়েরা। নিপা গায় একটি একক রবীন্দ্র সংগীত। ‘আলো আমার আলো ওগো আলো ভুবন ভরা’। গান শেষে হাততালিতে মুখরিত হয় অনুষ্ঠান।

পরদিন সন্ধে বেলা। সুহাস পড়াতে এসেছে। নিপাও পড়তে বসেছে ভাইবোনদের সঙ্গে। কিন্তু আজ নিপা কেমন যেন একটু গম্ভীর। চোখ মুখ থমথমে।

সুহাস পড়ানোর ফাঁকে বলে, কী, আজ এমন লাগছে কেন তোমাকে ? কী হয়েছে ?

কই, কী হবে!

মুখ কালো করে রেখেছ।

তাতে কার এত কী আসে যায়!

নিপার খোঁচাটা পষ্ট টের পায় সুহাস। ওর ওপরই অভিমান নিপার। কিন্তু কেন ? নিপার দিকে তাকায় সুহাস, আমি কোনও ভুল করেছি ?

না না, তুমি ভুল করবে কেন ? তুমি কি ভুল করতে পারো ? আমি ভুল করেছি হয়তো। তা না হলে, কালকের অনুষ্ঠানে গানটা কেমন গাইলাম তুমি বলতে।

সুহাস আবার তাকায় নিপার দিকে। ওর চোখে মুখে কাচুমাচু ভাব। নিজের দোষ কাটানোর জন্য নরম সুরে বলে, তুমি যে ভালো গান গেয়েছ তা তো অনুষ্ঠানে সবাই হাততালি দিয়েই বলেছে। আমি তো গানের মানুষ নই। তুমি যখন বিতর্ক, বক্তৃতা কর, সেগুলোর ভালোমন্দ তো বলি। বলি না ?

বিতর্ক, বক্তৃতা তো তুমি শিখিয়ে দাও, আমি মঞ্চে পারফর্ম করি, এই যা। গান আলাদা বলেই তো জানতে চাই।

সুহাস এবার ঘাট মেনে নেওয়ার ভঙ্গিতে বলে, ভুল হয়ে গেছে। আগামীতে খেয়াল করে ঠিক ঠিক বলব।

তিন দিন পর আজ আবার পড়াতে এসেছে সুহাস। কলেজে ওর ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হয়েছে। তাই মাঝখানে দুদিন পড়াতে আসবে না বলে গিয়েছিল। দুদিন না আসায় আজ অনেক চাপ। ছাত্রদের জমানো পড়াগুলো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সুহাস। শুভ-দীপার অংক ইংরেজি শেষ করে নিপার দিকে তাকায়। সুহাসের ডানপাশের চেয়ারে বসে ও। শুভ-দীপা বসে বাঁপাশে। নিপা ইংরেজি ট্রানস্লেশন করছিল। সুহাস ফিরে তাকাতেই ওর চোখ আটকে গেল নিপার খাতার ওপর। খাতাটা নিপা বাড়িয়ে রেখেছিল ওর দিকে। খাতার পৃষ্ঠার কোনায় লেখা, ‘তুমি পড়াতে না এলে আমার কিচ্ছু ভালো লাগে না’।

চোখ জোড়া থমকে যায় সুহাসের। ভেতরটা যেন হঠাৎ দুলে ওঠে ওর। নিপা কী লিখেছে এটা! একি সত্যি! ভাবতে থাকে সুহাস। মনে মনে বলে, এ যে আমারও মনের কথা নিপা। তোমাকে কী করে বলি, এখানে না আসতে পারলে আমারও তো ভালো লাগে না। বুকটা কেমন ভারী হয়ে থাকে।

বেশ খানিকটা পর খাতার ওপর থেকে চোখ ফেরায় সুহাস। নিপার দিকে তাকায়। নিপা মুখ নিচু করে আছে খাতার ওপর। ওর ডান হাতে কলম। বাঁ হাত টেবিলের নিচে নিজের উরুর ওপর রাখা। সুহাস কী করবে ভেবে পায় না। নিপাকে কিছু বলতে ইচ্ছে করছে ভীষণ। কিন্তু কীভাবে বলবে ? টেবিলের নিচে দিয়ে ডান হাত বাড়িয়ে নিপার বাঁ হাত স্পর্শ করার চেষ্টা করে চুপচাপ। হ্যাঁ, এই তো নিপার নরম মসৃণ তুলতুলে হাত, চম্পাকলি আঙুল। স্পর্শ মাত্র চমকে ওঠে নিপা। মুহূর্তেই যেন চমক ভাঙে ওর। সুহাসের হাতটা নিবিড় করে টেনে নেয় নিজের হাতে। উরুর ওপর রেখে হাতটা ধরে রাখে গভীর আবেগে, যেন এই স্পর্শের প্রতীক্ষায় ছিল এতদিন।

সুহাসকেও যেন মাতাল করে দিল এই স্পর্শ। ওর পরীক্ষা বাকি ছিল আরও কটা। কিন্তু একদিনও টিউশনি কামাই করেনি আর। পড়াশোনা পরীক্ষা কলেজ এত কাজের মাঝেও অদ্ভুত এক তীব্র টান অনুভব করেছে সারাদিন। সন্ধ্যার সময় ঠিক গিয়ে হাজির হয়েছে নিপাদের বাড়ি। নিপাও যেন পথ চেয়ে থাকে সুহাসের। সুহাস চেয়ারে বসতেই ওর স্পর্শ চায়। টেবিলের নিচে দিয়ে বাঁ হাত বাড়িয়ে দেয় সুহাসের দিকে। সুহাস বাড়ায় ওর ডান হাত। তারপর নিঃশব্দে ধরে রাখে পরস্পর। একটানা অনেকক্ষণ। চলে না আসা পর্যন্ত। এভাবে একটি হৃদয়ের শিহরণ-স্রোত হাতের মধ্য দিয়ে যেন আছড়ে পড়ে অন্য হৃদয়ে। এই স্পর্শই যেন ওদের কথা বলা। এই স্পর্শই যেন বড় আকর্ষণ।

ক্রমে এই আকর্ষণ বেড়ে গেল আরও। এখন সাপ্তাহিক বা সরকারি ছুটির দিনে সকালেও পড়াতে আসে সুহাস। এতে নিপার মা বরং ভেতরে ভেতরে খুশি। মেয়ের পড়াশোনা ভালো হচ্ছে। অবশ্য শুভ আর দীপা পড়তে বসে না সকালে। নিপা একাই বসে। ওরও পড়াশোনার চাপ বেড়ে গেছে। তবু এই অতিরিক্ত পড়ানো ওদের একটি অছিলা মাত্র। আসলে পড়ানোর নামে অতিরিক্ত সঙ্গ লাভ। এর মধ্যেই চলে ওদের নতুন বই-বিনিময়। কখনও বইয়ের ভেতর থাকে পরস্পরকে লেখা দীর্ঘ চিঠি। চিঠিতে থাকে বাঁধ ভাঙা আবেগ, হৃদয় উজাড় করা ভালোবাসা।

অন্যান্য দিন যখন স্কুল-কলেজ খোলা তখনও দিনের বেলা কেমন লকলক করতে থাকে ওরা। কলেজে যাওয়ার আগে বা বিকেলে কলেজ থেকে ফিরে নিপার স্কুল-পথের আশেপাশে ঘুরে বেড়ায় সুহাস, বিজলি চমকের মতো নিপাকে এক ঝলক দেখত পাবে এই আশায়।

এভাবেই চলছিল বেশ। কিন্তু সময় তো দাঁড়িয়ে থাকে না। দেখতে দেখতে সুহাসের এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হয়ে গেল। নিপাও উঠে গেল ক্লাস টেনে। এবার ও এসএসসি দেবে। সুহাস ভর্তি হবে বিশ্বদ্যিালয়ে, লক্ষ্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। এই নিয়ে শুরু হয়েছে তোড়জোড়। এখন আর প্রতিদিন আসা হয় না ওর। অবশ্য দু-তিন দিন পর যেদিন আসে সেদিন পড়ায় অনেকক্ষণ। সুহাস একদিন বলে, তোমরা এবার নতুন একজন মাস্টার দেখে নাও। আমার তো বিদায়ের সময় হলো।

নিপা চুপচাপ শোনে। সহসা কোনও কথা যোগায় না ওর মুখে। বুকে যেন উথালপাতাল কষ্টের ঢেউ। কিছুক্ষণের মধ্যেই জলে ভরে গেল দুচোখ। নিঃশব্দে অশ্রু ফোঁটা গড়িয়ে পড়ে বইয়ের পাতায়। একসময় বলে, আমার আর কোনও মাস্টার চাই না।

সুহাসেরও কোনও কথা বলা হয় না আর। দুদিন পর নিপার মা বলেন, সুহাস, তুমি ভার্সিটিতে ভর্তি হলে এক দু সপ্তাহ পরে পরে বাড়ি আসবে না ? বাড়ি এলে তুমিই এদের খোঁজ খবর নিয়ে যেও।

তিন

সুহাস চট্টগ্রাম বিশ্বদ্যিালয়ে ভর্তি হয়ে গেল। ওর পছন্দের সাবজেক্ট ছিল একাউন্টেন্সি। ওই সাবজেক্টেই সুযোগ মিলেছে। বিশ্ববিদ্যালয় হলেই ও থাকে। সারাদিন ক্লাস, লাইব্রেরি, সেমিনার এসব নিয়ে কাটায়। কিন্তু সন্ধে হলে সময় আর কাটতে চায় না ওর। কোনওমতে সপ্তাহ দশ দিন পার হলেই ছুটে যায় বাড়িতে। বাড়িতে গিয়ে সন্ধে হওয়ার অপেক্ষা মাত্র। আঁধারের রংটা গাঢ় হয়ে এলেই ও পায়ে পায়ে গিয়ে হাজির হয় নিপাদের বাড়ি। তারপর সেই মখমলী স্পর্শে মন জুড়ানো।

দেখতে দেখতে এক বছর গড়িয়ে গেল। নিপা এখন গ্রামের কলেজে এইচএসসি পড়ছে। এর মধ্যে ওদের জীবনে ঘটে গেছে দুটি খুব বড় ঘটনা। নিপার বাবা চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। ছোটমার সঙ্গে বাবার বনিবনা হচ্ছিল না আগে থেকেই। বাবার প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুয়েটির সব টাকা নিজের কব্জায় রেখে দিয়েছেন ছোটমা। এই নিয়ে চরম অশান্তি। বাবা স্থায়ীভাবে চলে এসেছেন গ্রামে। শরীর স্বাস্থ্যও ভেঙে গেছে বেশ। প্রায়ই অসুস্থ থাকেন এখন। দুশ্চিন্তার শেষ নেই নিপার। সংসারের বড় সন্তান। ওকে তো ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতেই হবে।

সুহাসও এখন মাঝে মাঝে ভাবে। নিপার সঙ্গে সম্পর্কটা কোথায় দাঁড়াবে ? যতই ও সম্পর্কটাকে ইতিবাচক অর্থে ভাবতে চায়, ততই ওকে দুর্বল করে দেয় মার সতর্কবাণী। মা সেদিন কথায় কথায় বলেন, তুমি কি এখনও টিউশনিটা করো ? বাড়ি এসে সন্ধ্যা হতে না হতে ওখানে ছুটে যাও কী জন্য। এত রাত পর্যন্ত ওখানে কাটিয়ে আসো। এটা কিন্তু ভালো দেখায় না। ওই পরিবারের সঙ্গে আমাদের এত দহরম মহরম কীসের! আমাদের সঙ্গে কি ওদের মানায় ? তোমার বাবা কিন্তু ভালোভাবে নিচ্ছেন না এটা।

মার সেদিনের কথায় খুব রাগ হয়েছিল সুহাসের। তবু মুখের ওপর জবাব করতে পারেনি কিছু। আর বলবেই বা কী! চুপচাপ সরে গিয়েছিল মায়ের সামনে থেকে।

সেবার বাড়ি থেকে ফিরে দুইমাস আর বাড়ি যায়নি সুহাস। মায়ের ওপর ভীষণ অভিমান হয়েছে ওর। মা এভাবে বলতে পারলেন ? ঠিক আছে, আর বাড়ি যাব না। বাড়ির কোনও টাকা-পয়সাও নেব না। আমি নিজে নিজেই চলব।

সুহাসের তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা শেষ হয়ে চতুর্থ বর্ষের ক্লাস শুরু হয়েছে। ক’মাস পরেই অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা। ওর এখন একমাত্র চিন্তা, নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। প্রতিদিন পত্রিকায় চাকরির বিজ্ঞাপন খুঁজতে থাকে ও।

এরই মধ্যে এক ছুটির দিন সকালে রতন হলে এসে হাজির। গ্রামের কলেজে ডিগ্রি পড়ছে ও। এসে বলে, তুই বাড়িঘরে যাচ্ছিস না। মামি, মানে তোর মা খুব চিন্তিত। আমাকে দিয়ে তোর জন্য টাকা পাঠিয়েছে। ধর, তোর টাকাগুলো নে।

সুহাস হাত বাড়িয়ে টাকাগুলো নিতে নিতে রতন আবার বলে ওঠে, আরেকটি খবর আছে, তুই কি জানিস, নিপার বাবা মারা গেছেন।

সুহাস হঠাৎ যেন আকাশ থেকে পড়ে।―জানি না তো!

অনেকক্ষণ ওদের মুখে আর কোনও কথা নেই। সুহাস কিছুটা অস্থির আর বিমর্ষ। হায় রে, নিপার তো তাহলে বড় বিপদ। কী হবে এখন ? ওদের চলবে কী করে ?

সুহাস-নিপার ব্যাপারটা রতন আগে থেকেই জানত। এ বিষয়ে রতন সব সময়ই ইতিবাচক। সুহাসকে হালকা করার জন্য রতন বলে, এই চিন্তা কী,  তোর অনার্স পরীক্ষা হয়ে যাচ্ছে। একটা চাকরি বাকরি ধরে নে।

রতনের ইঙ্গিতটা বুঝতে পারে সুহাস। সঙ্গে সঙ্গে হতাশ গলায় বলে, কী যে বলিস তুই, কোথায় রয়েছে কী!

সুহাসের অনার্স পরীক্ষা শেষ হতে হতে নিপার এইচএসসি পরীক্ষাও হয়ে গেল। নিপা গ্রামের কলেজে ডিগ্রিতে ভর্তি হয়েছে। কৃষি বিজ্ঞান নিয়ে পড়ছে ও। কিন্তু পড়াশোনার চেয়ে সংসারের হাল ধরার চিন্তাই এখন বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে ওর কাছে। ছোট দুই ভাইবোনের লেখাপড়ার খরচ, বয়স্ক মায়ের ওষুধ-পথ্য, সেবাযত্ন এসব চিন্তা সব সময় অস্থির করে রাখে ওকে। সুহাসের সঙ্গেও খুব একটা দেখা হয় না আর। গ্রামে এলেও সুহাস নিপাদের বাড়ি আসে খুব কম। পথেঘাটেই হয় এক ঝলকের চকিত দেখা।

অনেকদিন পর গতকাল সন্ধ্যায় বাড়ি এসেছে সুহাস। সকালে মাকে বলে, বাজারে যাব। আসলে ওর ইচ্ছে, কলেজে আসা-যাওয়ার পথে নিপার সঙ্গে দেখা করা। বাজার আর কলেজের একই পথ। তাই নয়টার দিকে একা অলসভাবে পা বাড়ায় বাজারের পথে। হাঁটছে ধীর পায়ে।

বেশি দূর এগোতে হয়নি। বড় রাস্তায় পা ফেলে পেছন দিকে তাকাতেই দেখে, নিপা বেরিয়েছে ওদের বাড়ি থেকে। সুহাস হাঁটার গতি কমিয়ে দিল আরও।  কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা হয়ে গেল দুজনের। সুহাসই কথা বলে প্রথম, কেমন আছ নিপা ?

নিপা মাথার ওপর থেকে ছাতাটা খানিক হেলিয়ে থমকে দাঁড়ায়, ওমা তুমি! তুমি কোত্থেকে, কখন এলে ?

এই তো কাল সন্ধ্যায়।

আমাদের বাড়ি এলে না যে! ―নিপার গলা থেকে যেন অভিমান ছলকে পড়ে। সুহাসকে কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়েই আবার বলে ওঠে, আসলে তুমি কেমন যেন হয়ে যাচ্ছ।

সুহাস আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা করে, আরে, তুমি এত জটিল করে দেখছ কেন ? আসতে আসতে একটু রাত হয়ে গেল, তাই।

ওহ, আগে কিন্তু এমন ছিলে না।

আগে তো তোমাদের পড়াতাম।

বেশ, ভালো।―নিপার গলায় যেন অভিমান থইথই।

দুজনই ধীর পায়ে সামনে হাঁটছে আর কথা বলছে। সুহাস এবার বলে, এতদিন পর দেখা হলো, পথের মাঝেও ঝগড়া করবে নাকি ? শোনো, একটি ভালো খবর আছে কিন্তু। আমি একটি চাকরির ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম। ইন্টারভিউ খুব ভালো হয়েছে, আমার চাকরি হয়ে যেতে পারে।

চাকরি! তুমি মাস্টার ডিগ্রি করবে না ?

করব। তবে চাকরি পেলে আগেই ঢুকে যাব। চাকরি করেও মাস্টার ডিগ্রি করা যায়। এখন আমার চাকরিটা খুব দরকার। আচ্ছা, আমার চাকরি হলে তুমি খুশি হবে না।―সুহাস নিপার দিকে তাকায়।

খুশি হব কি-না জানি না, অখুশি হব না। তবে তোমার আগে আমার চাকরি হলে ভালো হতো।

তোমারও চাকরি হবে। এখন আমার এ চাকরিটা হয়ে গেলে ভালো হয় না ? আমার চাকরিটা হলে আর দেরি করব না। তোমাকে নিয়ে ভাবব।

আমাকে নিয়ে ভাববে! আমাকে নিয়ে কী ভাববে তুমি ? তোমার ফ্যামিলি কি ভাবে ?

জ্বলন্ত কাঠের ওপর যেন পানি পড়ল, হঠাৎ এমনি করে চুপসে গেল সুহাস। মার সেদিনের কথাগুলো মনে পড়ে সঙ্গে সঙ্গে।… ‘আমাদের সঙ্গে কি ওদের মানায়’…! সুহাস গলায় জোর পায় না আর। অনেক চেষ্টা করেও ঝটপট কোনও কথা খুঁজে পেল না। পথও ফুরিয়ে এসেছে এদিকে। তাকিয়ে দেখে, নিপা ঢুকে যাচ্ছে কলেজের গেটে। ‘সন্ধ্যায় বাড়িতে যাব’ বলে সুহাসও পা বাড়ায় বাজারের পথে।

চার

চাকরিটা সত্যি পেয়ে গেল সুহাস। বাংলাদেশ মহাহিসাব নিয়ন্ত্রকের দপ্তরের চাকরি। এজিবি-র অডিটর। ওর পোস্টিং হলো ঢাকার সেগুনবাগিচায়, এজিবি প্রধান কার্যালয়ে। আগেপিছে আর কিছু ভাববার সময় নেয় না সুহাস। নিয়োগপত্র হাতে পেয়ে অনুমতি চায় বাবার। বাবাকে বলে, আমি ঢাকায় গিয়ে চাকরি করব আর মাস্টার ডিগ্রিতে ভর্তি হব।

সুহাসের কথায় অমত করেন না বাবা। বাবার মাথায় হয়তো অন্য চিন্তা, ছেলে দূরে চলে গেলেই ভালো থাকবে। নিপার সঙ্গে ক্রমে দূরত্ব তৈরি হবে আর একসময় ভুলে যাবে।

বাবার অনুমতি পেয়ে সুহাস ছুটে গেল বাড়িতে। মাকে আর নিপাদের বাড়িতে খবরটা জানিয়েই আবার ফিরে আসে শহরে। রাতেই ওকে রওনা হতে হবে ঢাকায়। যোগদানের জন্য হাতে সময় খুব কম। তাছাড়া বেশি সময় কাছে থাকলে মন আবার ভারাক্রান্ত হয়ে উঠতে পারে। সেটা চায়নি সুহাস। অবশ্য আসার সময় অফিসের ঠিকানা লিখে দিয়ে এসেছে নিপাকে। বলেছে, চিঠি দিও।

নিপা লক্ষ্মী মেয়ে। চিঠি লেখে। সপ্তাহ দশদিন পর একটি করে চিঠি। খুব বড় চিঠি নয়, সংক্ষিপ্ত। কিন্তু চিঠির শব্দে শব্দে থাকে গভীর আবেগ আর প্রাণের ছোঁয়া। রাজধানীর মতো বড় শহরে আনাড়ি সুহাসের জন্য ভালোবাসাময় উদ্বেগ। কখনও থাকে সুহাসকে কাছে পাওয়ার আকুলতা। নিপার চিঠি পেতে ভালোই লাগে সুহাসের। মাঝে মাঝে চিঠি পড়ে উদাস হয়ে যায় সুহাস। ইচ্ছে করে এখনই পাখির মতো উড়াল দেয় গ্রামে। কিন্তু নিজের মনের কথা কিছুই জানাতে পারে না নিপাকে। চিঠিও লেখা হয় না। যদি সেই চিঠি অন্য কারও হাতে পড়ে যায়, এই ভয়ে।

ছয় মাস হয়ে গেল। বাড়ি যাওয়া হয় না সুহাসের। নতুন চাকরি। অফিসের নিয়ম-নীতি, কাজ শেখা এসব তো আছেই। তার ওপর সুহাস মাস্টার ডিগ্রিতে ভর্তি হয়েছে বিশ্বদ্যিালয়ে। নিয়মিত না হলেও সময় সুযোগ মতো সপ্তাহে দু’একটি ক্লাসে হাজিরা দিতে হয়। তা না হলে বছরের শেষে পরীক্ষার সুযোগ মিলবে না।

এভাবেই দিন কাটছিল। হঠাৎ নিপার একটি চিঠি। চিঠি খুলে সুহাস অবাক। নিপা লিখেছে―

‘আমার একটি চাকরি হয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগে। পদ : ব্লক সুপারভাইজার। পোস্টিং দেওয়া হয়েছে হাটহাজারী উপজেলায়। এতদিন আমিই কেবল একতরফা চিঠি লিখে গিয়েছি। সব চিঠি তুমি ঠিকমতো পেয়েছ কিনা তাও জানি না। আমার ঠিকানা দিলাম। ইচ্ছে হলে লিখতে পারো। ইতি―

নিপা চৌধুরী

ব্লক সুপারভাইজার

উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয়

হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।’

চিঠি পড়ে অনেকক্ষণ থমকে বসে থাকে সুহাস। নিপারও তাহলে চাকরি হলো শেষ পর্যন্ত। চাকরিটা নিয়ে ভালোই করেছে নিপা। এবার নিশ্চয় ওদের পরিবারে স্বস্তি ফিরবে। ছোট ভাইবোনের পড়াশোনা, মায়ের ওষুধ-পথ্য, সেবাযত্ন এসব নিয়ে দুশ্চিন্তা কিছুটা হলেও কমবে। কিন্তু তারপর ? নিপা কি নিজের কথা ভাববে না ? সুহাস ভাবতে পারে না আর। যাক, সে পরে দেখা যাবে। চাকরির জন্য অভিনন্দন জানিয়ে সঙ্গে সঙ্গে চিঠি লিখে পাঠায় নিপাকে।

কিন্তু এরপর অনেক দিন কোনও চিঠি আসে না নিপার। তিনমাস পর এলো আর একটি চিঠি। নিপা লিখেছে―

‘আমার বসন্ত হয়েছিল। মুখে, কপালে ও চোখের আশপাশে বেশ গুটি দেখা দেয়। এখন সেরেছে। তবে দাগগুলো রয়েছে এখনও। তুমি হয়তো আমাকে দেখলে চিনতেই পারবে না। আমি এখন কোথায় জানো ? নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে। এখানে অফিসের ট্রেনিংয়ে এসেছি। একমাস থাকব। তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। কতদিন দেখা হয় না। পারলে একবার এসো। ইতি―

নিপা।’

চিঠিটা পড়ে অস্থির হয়ে ওঠে সুহাস। সত্যি, কতদিন দেখা হয় না। একবার দেখতে যাওয়া দরকার। পরিচিত কেউ নিশ্চয় ওখানে নেই। গেলে আর কে জানবে ?

এবার আর চিঠির কোনও উত্তর দেয় না সুহাস। সশরীরে গিয়ে চমকে দিতে চায় নিপাকে। পরের সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবার সকালেই বেরিয়ে পড়ে নোয়াখালীর উদ্দেশ্যে। রাস্তাঘাটের খোঁজ-খবর নিয়েছে আগেই। সায়েদাবাদ থেকে নোয়াখালীর কোচ যায়। সুহাস ধরে ভোরের প্রথম কোচ। যাতে দিনে দিনে ফিরে আসা যায়।

সকাল সাড়ে এগারোটা নাগাদ নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ পৌঁছায় সুহাস। কোচ থেকে নেমে আবার চাপে রিকশায়। কৃষি বিভাগের ট্রেনিং সেন্টার মিনিট পাঁচেকের পথ। বেশ ঝকঝকে তকতকে তিন তলা ভবন। দক্ষিণমুখী ভবনের সামনে একচিলতে খোলা মাঠ। মাঠের পরে ধূ ধূ কৃষি জমি। নাগালের মধ্যেই যেন বাস্তব শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অনুকূল সব ব্যবস্থা।

গেটে সিকিউরিটির লোকদের বলতেই সুহাসকে নিয়ে বসায় গেস্টরুমে । টেবিল সোফা সাজানো নিরিবিলি গেস্টরুম। অপেক্ষমান অতিথি আর কেউ নেই। সুহাস একা।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘরে ঢোকে নিপা। সালোয়ার কামিজ আর ওড়না পরা। পায়ে পাতলা হাওয়াই চপ্পল। শুকনো ম্লান মুখ। মুখে বসন্তের দাগগুলো স্পষ্ট। আগের কোনও চেকনাই ভাব আর নেই নিপার। আট নয় মাসে এত পরিবর্তন! যেন নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে না সুহাস। নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে ও।

নিপাই কথা বলে প্রথম, কী দেখছ অমন করে ?  ভাবছ, কত বিশ্রি হয়ে গেছি। তাই না ?

নিপার কথায় চমক ভাঙে সুহাসের। বলে, এমনটা কল্পনাই করতে পারিনি আমি। যা হোক, তুমি তো তুমিই।

নিপা এবার বলে, এখন তো দাগ অনেকটা কমে এসেছে। আগে আরও বেশি ছিল। জানো, চোখের চারপাশে যখন গুটি দেখা দিল, তখন ভাবলাম, অন্ধ হয়ে যাব বুঝি। কেবল মনে হতো, তোমাকে আর দেখতে পাব না।

বুকের ভেতরটায় হঠাৎ কেমন যেন একটা ধাক্কা লাগে সুহাসের। স্থির থাকতে পারে না আর। নিপার হাত ধরবে বলে হাত বাড়ায় সুহাস। নিপা হাত সরিয়ে নেয়, বলে, বসো, আমি তৈরি হয়ে আসি। আজ আমার তেমন কাজ নেই। বাইরে ঘুরে বেড়াব।

বাইরে ঘুরে দেখার মতো তেমন কিছু এখানে নেই। নিপাও এখানে নতুন। পথঘাট ভালো চেনে না। কদিন আগে মেয়েদের সঙ্গে বেরিয়ে পাশে একটি প্রাচীন হিন্দু মন্দিরে গিয়েছিল। আজও সুহাসকে নিয়ে সেখানটায় এলো নিপা। মন্দিরে কিছু লোক পুজো-অর্চনায় ব্যস্ত।  সুহাস দুষ্টুমির সুরে বলে, কী, মন্দিরে আমার জন্য পুজো দেবে নাকি ?

নিপাও কম যায় না। আরও এক ধাপ এগিয়ে বলে, সেই পুজো তো আমি কবেই দিয়েছি তোমার মনের মন্দিরে।

কথা বলতে বলতে মন্দিরের পাশ দিয়ে ছোট রাস্তা ধরে বেশ কিছুটা এগিয়ে এসেছে ওরা। রাস্তাটা এখানেই শেষ। নির্জন এলাকা। আকাশে দুপুরের বৈশাখী সূর্য। টা টা রোদ। বড় কয়েকটা জাম জারুল গাছ যেন এখানে ছায়া বিছিয়ে রেখেছে। মৃদু হাওয়া বইছে। নিপা বলে, এখানে বসবে নাকি ?

বসা যায়।―বলেই সুহাস ছায়াময় এক জারুল গাছের গুড়িতে বসে পড়ে। নিপাও বসে সুহাসের পাশে, একেবারে গা ঘেঁষে। সুহাস বলে, কতদিন পর!

নিপা সামনে দূরে তাকিয়ে চুপচাপ। মুখে কোনও কথা নেই। সুহাস বাঁ হাতটা ধরে নিপাকে টেনে নেয় বুকে। বেঁধে নেয় নিবিড় আলিঙ্গনে। নিপার সুগঠিত শরীরের মিষ্টি সৌরভ ভরিয়ে দিচ্ছে সুহাসের বুক। মনে যেন জেগে উঠেছে মাতাল শিহরণ। সুহাস দীর্ঘ চুম্বনে রাঙিয়ে দিতে থাকে নিপার কম্পমান ঠোঁট। গভীর সুখোষ্ণ কণ্ঠে বলে, তোমার কেমন লাগছে নিপা, বলো।

সুহাসের আলিঙ্গনের সুখস্রোতে নিপা তখন ভাসমান তরী। আবেশ জড়ানো নিমীলিত চোখজোড়া। অস্ফুট কণ্ঠস্বর ওর, ভালো লাগছে, খুব ভালো লাগছে। তোমাকে যে আরও নিবিড় করে পেতে ইচ্ছে করে আমার। কিন্তু―।

কিন্তু কী, নিপা, বলো বলো। আমার শুনতে খুব ইচ্ছে করছে আজ।―সুহাস আলিঙ্গনের বন্ধন আলতো আলগা করে নিপার মুখের দিকে তাকায়।

নিপা আবেশের রেশ কাটিয়ে চোখ খোলে। বুকে যেন ওর দীর্ঘশ্বাস, কিন্তু তোমাকে যে আর এভাবে পাওয়া হবে না আমার।

কেন, নিপা কেন ? ―হঠাৎ আর্তনাদ করে ওঠে সুহাস।―আমি তো কেবলই তোমার।

নিপা এবার খুব শান্ত ধীর গলায় বলে, কিন্তু আমি যে কখনওই তোমার হতে পারব না প্রিয়। কারণ তোমার বাবা-মা তা চান না। তারা যদি চাইতেন, নিশ্চয় এতদিন অপেক্ষা করতে হতো না।

সুহাস অসহায় দৃষ্টিতে দেখে নিপাকে। নিপা মিথ্যে বলেনি। মার কথাগুলো এখনও তার কানে বাজে,… ‘আমাদের সঙ্গে কি ওদের মানায়’…! 

নিপা আবার বলতে শুরু করে, এদিকে মার শরীর দিন দিন ক্ষীণ-দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। আমার বিয়ের জন্য তিনি উঠেপড়ে লেগেছেন। ছোট বোনটাও বড় হয়ে উঠেছে। ছোট ভাই শুভ পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে। ব্যবসা করবে বলে সে খাগড়াছড়ি চলে গেছে। এখন আমি তো আর চুপ থাকতে পারি না।

কথা বলতে বলতে নিপা সুহাসের দিকে তাকায়। সুহাসের করুণ মুখচ্ছবি যেন নিপাকে আরও এলোমেলো করে দেয়। নিপার গলাও এবার করুণ শোনায়, জানি, তুমি একা সিদ্ধান্ত নিতে পারো, চাইলে অন্যরকম কিছু করতেও পারো। কিন্তু আমি সেটা তোমার কাছে চাইব না। কারণ সেটা কারও জন্যই সুখের হবে না। মনে রেখো, তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে না হলেও আমি সারা জীবন তোমাকেই ভালোবাসব। তুমিই আমার প্রথম স্পর্শ।

বলতে বলতে নিপার চোখ বেয়ে গড়িয়ে নামে অশ্রুধারা। সুহাসও হঠাৎ কেমন যেন হয়ে গেল। ভেঙে পড়ে বোবা কান্নায়। নিপাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে এবার।

বিকেলের সূর্য আরও পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। কেউই টের পায়নি এতক্ষণ। হঠাৎ সংবিত ফিরে পেয়ে সুহাস বলে, আমাকে তো ঢাকায় ফিরতে হবে।

নিপার কণ্ঠে এবার গভীর অনুনয়, আরেকটু থাকো। রাতের গাড়িতেই না হয় যেও।

সন্ধ্যার মুখে মুখে ওখান থেকে ফিরে আসে ওরা। বাজারের দিকে এসে একটা হোটেলে বসে দুজন। খানিক পর নিপা বলে, অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে, আমার হোস্টেলের গেট বন্ধ হয়ে যাবে।

সুহাস নিপার দিকে তাকিয়ে থাকে। বোবা চাহনি। নিপা আবার বলে ওঠে, আমি যাই। তুমি ভালো থেকো। সাবধানে যেও। গিয়ে চিঠি দিও।

নিপার পিছু পিছু সুহাস রাস্তায় এসে দাঁড়ায়। বাজার হলেও এদিকটায় রাস্তায় আলো নেই তেমন। দোকানের আলোতে অবছা পথ দেখা যাচ্ছে কিছু দূর। তারপর পুরো পথ অন্ধকারে ঢাকা। সুহাস তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে। মনে মনে বলে, আর কি দেখা হবে নিপা ? নিপা চলে যাচ্ছে। এখনও চোখের আড়াল হয়নি। আবছা দেখা যাচ্ছে নিপাকে। নিপা এগিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারের দিকে। মিশে যাচ্ছে অন্ধকারে। দেখতে দেখতে একেবারে চোখের আড়াল হয়ে গেল।

পাঁচ  

সেই পঁচিশ বছর আগের কথা।  একা একা বসে চুপচাপ ভাবছে সুহাস।

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের ওই ট্রেনিং শেষ করার পর পরই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল নিপার। বিয়ের আগে নিপা নিজেই খবরটা জানিয়েছিল চিঠিতে। সুহাস আর চিঠি লেখেনি। অনেক চেষ্টা করেও লিখতে পারেনি। তবে দূর থেকে মনে মনে শুভ কামনা করেছে, সুখী হও নিপা।

তারপর আর কোনওদিন দেখা হয়নি দুজনের। সুহাস গ্রামে গেলে এর ওর মুখে খবর পেত, নিপা ভালো আছে, সুখে সংসার করছে। রতন একদিন বলেছিল, নিপার দুই ছেলেমেয়ে। বড় হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। শুনে সুহাস বলেছে, বাহ, বেশ।

সুহাসের জীবনও থেমে থাকেনি। সুবোধ ছেলে সুহাস। বাবা-মার পছন্দে বিয়ে করে সংসারী হয়েছে। তবু মনের কোন গহীন কোণে যেন নিপার স্পর্শ টের পায় মাঝে মাঝে। নিপার খবর এখনও নাড়া দেয় ওকে।

নিপা অসুস্থ, মেডিক্যালে আছে। রতনের কাছ থেকে এই খবর শোনার পর আজ সুহাসের বার বার মনে পড়ছে নিপাকে। আর কি দেখা হবে না ? সেরে ওঠো নিপা, একবার অন্তত দেখা হোক।

রাতে শুয়ে শুয়ে সুহাস ভাবে, এবার চট্টগ্রাম গেলে নিপার সঙ্গে অবশ্যই দেখা করতে হবে।

সকালে অফিসে যাওয়ার জন্য দ্রুত তৈরি হচ্ছে সুহাস। মোবাইলে রিং বাজতে থাকে এমন সময়। স্ক্রিনে রতনের নাম দেখে আঁৎকে ওঠে সুহাস। না জানি রতন কী খবর দেবে। ভয়ে ভয়ে ফোন অন করে সুহাস। ওপাশ থেকে রতনের ব্যস্ত কণ্ঠ, খবর ভালো নয় রে। নিপা কাল রাতেই চলে গেছে।

অ্যাঁ, কী বলিস! ―আর্তনাদ করে ওঠে সুহাস। হায় নিপা ! শেষ দেখা হলো না। চলে গেলে!

ফোন রাখতে রাখতে নিপার শেষ কথাগুলো কানে বাজে সুহাসের। সুহাস পষ্ট দেখতে পায় বেগমগঞ্জের অন্ধকার পথ ধরে একা হেঁটে যাচ্ছে নিপা। যেতে যেতে বলছে―আমি যাই, তুমি ভালো থেকো। বলতে বলতে আলোকদ্যুতি মিলিয়ে যাচ্ছে গূঢ় অন্ধকারে।

সচিত্রকরণ : নাজিব তারেক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button